ভাঙ্গন
ভরা শ্রাবণের অপরাহ্ন, দু দিন থেকে নাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে সঙ্গে পূবালী হাওয়ার টান। এসময়টা পদ্মা পাড়ের মানুষগুলোর দু চোখ থেকে ঘুম হারিয়ে যায়, অনাগত বিপদের আশঙ্কায় সর্বদা তটস্থ থাকে ওরা। বাপ ঠাকুর্দার আমলের ভিটেমাটি জমি জিরেত সবই এখন কীর্তিনাশার গর্ভে, পিছু হটতে হটতে এখন শেষ আশ্রয় নদীবাঁধের ওপর কোনমতে দিন কাটছে এখন। বাঁধের নিচেই বয়ে চলেছে ভয়ংকরী পদ্মা, এই ভরা শ্রাবণে ওকে যেন রাক্ষসী মনে হয়, অথচ এই পদ্মাই ওদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ওদের রুটি রুজি সবেতেই পদ্মা। তাই বারবার ঠিকানা হারিয়েও ওরা পদ্মার কোলেই থাকতে চায়।
বাসন্তীর মনে আজ এক অজানা আশংকা সকাল থেকেই, খুব একটা ভালো ঠেকছে না পদ্মার ভাব গতিক, আসলে পদ্মার কোলে থাকতে থাকতে ওরা জেনে গেছে পদ্মার আচরণ। হরিচরণরা গেছে নৌকা নিয়ে পদ্মার গভীরে রূপালী ফসলের খোঁজে সেই কাকভোরে, ওদের ফেরার সময় হয়ে এলো আর একটু পরেই পরপর নৌকাগুলি ফিরবে ঘাটে তারপর মহাজনের কাছে মাছ বেচে রোজগারের পয়সা নিয়ে ঘরে আসবে, এটাই ওদের নৈমিত্তিক কাজ। বাঁধের একদিকে রান্নার জন্য চালাটায় ভাত চাপিয়েছে বাসন্তী, বছর পাঁচেকের ছেলে গণেশ অনেকক্ষণ থেকে বাসন্তীর সাথে লটকে আছে খাওয়ার আশায়। বাসন্তী বুঝতে পারে গনশার ক্ষিধে পেয়েছে, আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো রোস এই ভাত হলেই তোক খেতে দিচ্ছি। গনেশ মাথা নেড়ে বলে আমাকে মাছের মাথাটা দিবি, বাসন্তী জানে তার এই ছেলেটা মাছের মাথা খেতে ভালোবাসে, তাই হাসতে হাসতে বললো আচ্ছা তাই খাস।
বাসন্তীর মনের উচাটন ক্রমেই বাড়ছে সূর্য ডুবতে চললো অথচ একটা নৌকাও আজ ঘাটে ফেরেনি, দূরে পদ্মার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো নৌকাগুলি দেখা যায় কিনা? এমনিতেই হরিচরণরা পাকা মাঝি জন্ম থেকেই পদ্মার বুকে ওদের বিচরন,পদ্মার স্রোতের স্বভাব ওদের চেনা তবুও একটা প্রবাদ আছে জলের গভীর, অন্ধকার রাত, আর মানুষের মন বোঝা বিষম দায়।বিশেষ করে এই ভর বর্ষায় পদ্মার মনে কি আছে কেউই আন্দাজ করতে পারে না। অনেকক্ষণ পর বাসন্তীর মনে হলো দূরে যেন নৌকাগুলি দেখা যাচ্ছে, বাসন্তীর মনে হলো একবার ঘাটের দিকে যায়, হরিচরণের নৌকা ফিরলো কিনা দেখে আসে এদিকে গণশাটাও খাওয়ার জন্য বায়না করছে, বাসন্তী তাড়াতাড়ি গরমভাত থালায় বেড়ে দিয়ে মাছের মাথাটা গণশাকে দিয়ে বললো বসে বসে খা তোর বাবা এলো কিনা একটু দেখে আসি।
বাসন্তী ঘাটে এসে দেখে নৌকাগুলি ফিরেছে ঘাটে, বেশ হৈচৈ হচ্ছে, সবার কেমন খুশি খুশি ভাব আজ সব নৌকাতেই মা পদ্মার দয়া উপচে পরেছে প্রচুর মাছ নিয়ে ওরা ফিরেছে আজ। বাসন্তী দেখলো হরিচরণ হাসতে হাসতে বাসন্তীকে ইশারায় কিছু বলছে। বাসন্তী এগিয়ে যেতেই হরিচরণ ওর হাতটা ধরে বললো অনেকদিন পর এতো লাভ হলো কাল হাট থেকে সবার জন্য জামা কাপড় কিনে দিও। বাসন্তী বললো সব হবে আগে ঘরে চলো গনশাটা একা আছে, রান্নার চালায় ওকে খেতে দিয়ে এসেছি। দুজনে দ্রুত বাঁধের ওপর ওদের ঘরের দিকে এগোতে থাকে, কিন্তু একি আলো আঁধারিতে ওদের রান্না ঘরের চালাটা দেখা যাচ্ছে না তো, বুকের ভেতর কূ ডেকে উঠলো বাসন্তীর, তবে কি? আর ভাবতে পারে না বাসন্তী ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, হরিচরণ দেখলো তাদের রান্না ঘরের চালা সহ অনেকটা জায়গা তলিয়ে গেছে পদ্মার গর্ভে। পদ্মার ঘোলা জল তখন পাক খাচ্ছে ওদের উঠোনে এখুনি তলিয়ে যাবে ওদের মাথা গোঁজার আস্তানাটুকু, বিপদ বুঝতে দেরি হলো না হরিচরণের বাসন্তীর হাত ধরে ও তখন ছুটছে বাঁধের থেকে দুরে অনেক দুরে, শুধু বাসন্তীর বুক ফাটা আর্তনাদ গ-ণ-শাশাশা ভর সন্ধ্যায় পদ্মার বুকে ভেসে যাচ্ছে স্রোতের টানে।