ভবিষ্যতের জানালা
তোমরা কেমন আছো?
আমি ভালো আছি। আজ ৯০ বছরে পা দিলাম। আজ আমার জন্ম দিন । এই 90 বছরে কত কিছু দেখলাম, কত কিছু শিখলাম। জীবন যেন এক বিশাল উপন্যাস, যেখানে প্রতি অধ্যায়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়েছে। এখন আমার দিন কাটে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে। ওদের হাসি, দৌড়ঝাঁপ, প্রশ্ন—সবই আমাকে জীবনের এক নতুন মাত্রা দেয়। পূর্ণিমা আজও আমার পাশে, আমার যত্ন নেয়, আমার ওষুধ খাওয়ার খেয়াল রাখে। আমাদের সম্পর্ক বদলায়নি, কিন্তু পৃথিবী বদলে গেছে।
এখন ২০৬০ সাল। চারপাশের দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে গেছে। একসময় যে রান্নাঘর ছিল বাড়ির প্রাণকেন্দ্র, যেখানে মা, ঠাকুমা, কাকিমারা বসে শুক্তো, শাক, মোচার ঘন্ট বানাতেন, এখন সেই রান্নাঘর বিলুপ্ত। রান্নার প্রয়োজন নেই, কারণ এখন শুধু চারটে বিশেষ ট্যাবলেট খেলেই শরীরের সব পুষ্টির চাহিদা মিটে যায়। খাবারের আর কোনো ঝামেলা নেই। শুধু একটি পাউচ খুললেই বিশুদ্ধ জল পাওয়া যায়, যা শরীরের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করে।
ডাক্তারখানার প্রয়োজনও শেষ হয়ে গেছে। শরীরে সামান্য অসুবিধা হলে কেউ আর হাসপাতালে ছোটে না। এখন মোবাইলে নিজের ছবি তুলে আপলোড করলেই বিশেষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্লেষণ করে বলে দেয় রোগের ধরন, তার প্রতিকার এবং কী ওষুধ খেতে হবে। রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা—এসব কেবল ইতিহাসের পাতায়।
রোবট এখন মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু। একসময় মানুষ বই পড়ত, সিনেমা দেখত, গল্প করত। এখন চাইলেই একজন রোবট বানিয়ে নেওয়া যায়, সে বন্ধু হতে পারে, জীবনসঙ্গী হতে পারে, এমনকি প্রেমিক বা প্রেমিকাও হতে পারে। এই রোবটগুলো শুধু কাজ করে না, অনুভূতিও প্রকাশ করে, কথাও বলে, এমনকি মন খারাপ হলে সান্ত্বনাও দেয়। ফলে একাকিত্বের সংজ্ঞা বদলে গেছে।
আরো অবাক করা বিষয় হলো মানুষের ক্লোন তৈরি করা সম্ভব। কেউ যদি তার প্রিয়জনকে হারায়, তাহলে সে চাইলে তার ডিএনএ ব্যবহার করে ক্লোন বানিয়ে আনতে পারে। সেই ক্লোন দেখতে একদম আসল মানুষের মতো, কথা বলতে পারে, পুরনো স্মৃতির মতো আচরণ করতে পারে। এখন যারা মারা গেছেন, তাদেরও যেন মৃত্যু নেই। একবার ক্লোন তৈরি করলেই চিরদিনের জন্য থেকে যেতে পারে।
এই পরিবর্তনগুলো জীবনকে সহজ করে দিয়েছে, কিন্তু সম্পর্কের উষ্ণতা কেড়ে নিয়েছে। একসময় সকলে একসঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া করত, এখন কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না, কারণ রোবট আছে, ক্লোন আছে, ভার্চুয়াল বাস্তবতা আছে। মানুষ কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। ভালোবাসা, অনুভূতি, আদর—এসবের জায়গায় শুধু কার্যকারিতা এসেছে।
আমি জানি না, এই পরিবর্তন ভালো না খারাপ। হয়তো একদিন আমিও ক্লোন হয়ে ফিরে আসব, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে গল্প করব, পূর্ণিমার হাত ধরে পুরনো দিনের কথা বলব। ততদিন পর্যন্ত আমি শুধু দেখব, শিখব, ভাবব—এই যান্ত্রিক ভবিষ্যতের মধ্যে সত্যিকারের মানুষ কোথায় হারিয়ে গেল?