Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভক্তিভাজন || Sharadindu Bandyopadhyay

ভক্তিভাজন || Sharadindu Bandyopadhyay

মাতালকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করিবার প্রথা আমাদের দেশে নাই। বরঞ্চ মাতালের প্রতি কোনও প্রকার সহানুভূতি দেখাইলে বন্ধু বান্ধব সন্দিগ্ধ হইয়া ওঠেন, গৃহিণীর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়। বস্তুত মদ্য পান করা যে অতিশয় গর্হিত কার্য, বোম্বাই প্রদেশে বাস করিয়া তাহা অস্বীকার করিতে পারি না। কিন্তু তবু আমার প্রতিবেশী ব্রাগাঞ্জা সাহেবকে যে আমি সম্প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা করিতে আরম্ভ করিয়াছি, সত্যের অনুরোধে তাহাও মানিয়া লইতে আমি বাধ্য।

ব্রাগাঞ্জা একজন গোয়াঞ্চি পিড়ু। এদেশে গোয়ানী খ্রীস্টানরা সাধারণত ঐ নামে অভিহিত হইয়া থাকে। ব্রাগাঞ্জার চেহারাটি যেমন প্যান্টুলুনপরা গজপতি বিদ্যাদিগগজের মতো, মানুষটিও অতিশয় শান্তশিষ্ট ও নির্বিরোধ। আমার বাড়ির পাশে একটা ভোলার ঘরে বাস করিত এবং মোটরমিস্ত্রীর কাজ করিত। আমি কখনও তাহাকে শাদা-চক্ষু অবস্থায় দেখি নাই; সর্বদাই তাহার গোলাপী চক্ষু দুটি ঢুলুঢুলু। আমার সঙ্গে দেখা হইলে কোমল হাস্য করিয়া কপালে হাত ঠেকাইত। দুনিয়ার কাহারও সহিত তাহার অসদ্ভাব আছে এমন কথা শুনি নাই; মাতাল অবস্থাতেও সে কাহারও সহিত ঝগড়া করিত না। আবার কাহারও সহিত অতিরিক্ত মাখামাখিও ছিল না। সে আপন মনে মদ খাইত এবং বানচাল মোটরের তলায় প্রবেশ করিয়া ঠুকঠাক করিত।

গত মহাযুদ্ধের সময় বোম্বাই শহরে মানুষের যে জোয়ার আসিয়াছিল তাহা বোম্বাই শহরকে আকণ্ঠ পূর্ণ করিয়া উপকণ্ঠেও প্রবাহিত হইয়াছিল। আমি থাকি উপকণ্ঠে। এতদিন বেশ নিরিবিলি ছিলাম, আমার বাড়ির সামনে রাস্তার ওপারে খোলা মাঠ পড়িয়া ছিল। ক্রমে সেখানে দুটি-একটি টিনের চালা বা ঘর দেখা দিতে আরম্ভ করিল।

একদিন দেখিলাম আমার বাড়ির ঠিক সম্মুখে কোনও এক ব্যবসায়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি এক চায়ের দোকান খুলিয়া সাইনবোর্ড লটকাইয়া দিয়াছে শ্রীবিলাস হিন্দু হোটেল। নিতান্তই দীনহীন ব্যাপার, টিনের চালার নীচে কয়েকটি বার্নিশহীন কাঠের টেবিল ও লোহার চেয়ার। কিন্তু খদ্দের জুটিতে বিলম্ব হইল না। এদিকে তখন মার্কিন গোরার ভিড়। দেখিলাম, শাদা সিপাহীরা লোহার চেয়ারে বসিয়া অম্লানবদনে চা ও চিড়েভাজা খাইতেছে। দোকানদার লোকটা রোগাপটকা ছিল, দেখিতে দেখিতে খোদার খাসী হইয়া উঠিল।

সাহেবদের দেখাদেখি দেশী-খদ্দেরও অনেক জুটিয়াছিল। কিন্তু ব্রাগাঞ্জাকে কোনও দিন দোকানে ঢুকিতে দেখি নাই। চায়ের মতো নিরামিষ নেশায় তাহার রুচি ছিল না।

তারপর একদিন মহাযুদ্ধ শেষ হইল। সাহেব সিপাহীরা ক্রমে ভারতরক্ষারূপ নিঃস্বার্থ কর্তব্য শেষ করিয়া দেশে ফিরিয়া গেল। শ্রীবিলাস হোটেলের চায়ের ব্যবসাতেও ভাটা পড়িল।

কিন্তু ব্যবসায়ে ভাটা পড়িলে ব্যবসায়ীর প্রাণে বড়ই আঘাত লাগে; তখন সে মরীয়া হইয়া আবার ব্যবসা জাঁকাইবার নানা ফন্দি-ফিকির বাহির করিতে থাকে। একদিন লক্ষ্য করিলাম, শ্রীবিলাস হোটেলের স্বত্বাধিকারী গ্রামোফোন কিনিয়াছে এবং তাহাতে লাউড-স্পীকার লাগাইয়া তারস্বরে তাহাই বাজাইতেছে।

প্রথমটা বিশেষ বিচলিত হই নাই! সিনেমার বর্ণসঙ্কর গান আমার ভালই লাগে; তাহাতে বিশুদ্ধ রাগ-রাগিণীর উচ্চ গাম্ভীর্য না থাক, প্রাণ আছে, চঞ্চলতা আছে। তাহাই বা আজকাল কোথায় পাওয়া যায়? কিন্তু যখন দেখিলাম, দোকানদার মাত্র দুই তিনটি রেকর্ড কিনিয়াছে এবং সেগুলি একটির পর একটি ক্রমান্বয়ে বাজাইয়া চলিয়াছে, তখন মন চঞ্চল হইয়া উঠিল। সঙ্গীত ভাল জিনিস; কিন্তু সকাল পাঁচটা হইতে রাত্রি বারোটা পর্যন্ত যদি একই সঙ্গীত বারম্বার শুনিতে হয়, তাহা হইলে স্নায়ুমণ্ডলের অবস্থা বিপজ্জনক হইয়া পড়ে।

পাশ্চাত্য সভ্যতা মনুষ্যজাতিকে অনেক নব নব আবিষ্কার দান করিয়াছে, তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর দান বোধ হয়—যান্ত্রিক শব্দ। শতবর্ষ পূর্বেও পৃথিবীতে এত শব্দ ছিল না। মেঘগর্জনই তখন শব্দের চূড়ান্ত বলিয়া মনে হইত। এখন মানুষ যন্ত্রের সাহায্যে এমন শব্দ সৃষ্টি করিয়াছে যাহার কাছে বজ্রপাতও কপোত কূজন বলিয়া মনে হয়। লাউড়স্পীকার যুক্ত গ্রামোফোনও এইরূপ একটি শব্দ-যন্ত্র। এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়, দেখিয়া বিশ্বের লাগে বিষম বিস্ময়। শুধু বিস্ময় নয়, মানুষ এই শব্দের আক্রমণে কেমন যেন জবুথবু হইয়া গিয়াছে!

শরীরের একই স্থানে যদি ক্রমাগত হাত বুলানো হয় তাহা হইলে প্রথমটা বেশ আরাম লাগে কিন্তু ক্রমে অসহ্য হইয়া ওঠে। গান শোনাও তেমনি। প্রত্যহ প্রত্যুষ হইতে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন একই গান শুনিতে শুনিতে স্নায়ুমণ্ডলী বিদ্রোহ করে। প্রাণ ছটফট করে; ইচ্ছা করে কোথায় ছুটিয়া পলাইয়া যাই। কিন্তু যাঁহারা শহরের বাসিন্দা তাঁহাদের পক্ষে এ-জাতীয় অভিজ্ঞতা নূতন নয়; সুতরাং বিশদ বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন।

মরীয়া হইয়া একদিন দোকানদারকে গিয়া বলিলাম, বাপু, চায়ের দোকান করেছ তা এত গান বাজনার কি দরকার?

দোকানদার এক গাল হাসিয়া বলিল, শেঠ, গ্রামোফোন কেনার পর আমার খদ্দের বেড়েছে।

দেখিলাম কথাটা মিথ্যা নয়; অনেকগুলি গলায়-রুমাল বাঁধা হাফ-শার্ট-পরা ছোকরা বসিয়া চা। খাইতেছে ও টেবিল বাজাইতেছে। বলিলাম, তা খদ্দেরকে গান শোনানোই যদি উদ্দেশ্য হয় তবে আস্তে বাজাও না কেন? পাড়ার লোকের কান ঝালাপালা করে কি লাভ?

সে বিস্মিত হইয়া বলিল, কেন, আপনি কি গান ভালবাসেন না? এ দেশের লোক কিন্তু খুব গান ভালবাসে।

চলিয়া আসিলাম। লোকটা আমাকে সঙ্গীত রস বঞ্চিত পাষণ্ড মনে করিল তাহাতে ক্ষতি নাই; কিন্তু সে যে আমার অনুরোধে গ্রামোফোন বন্ধ করিয়া ব্যবসার ক্ষতি করিবে এমন সম্ভাবনা দেখিলাম না।

পুলিসে খবর দিব কিনা ভাবিতে লাগিলাম। এদেশে আইন-কানুন নিশ্চয় একটা কিছু আছে; যন্ত্রসঙ্গীতের উৎপীড়ন হইতে নিরীহ মানুষকে রক্ষা করিতে পারে এমন আইন কি নাই? হয়তো আছে; কিন্তু পুলিস কিছু করিবে কি? এদেশের পুলিসের সে রোয়াব নাই, গাম্ভীর্য নাই, দাপট নাই। রাস্তার ধারে যে-সব হলদে শামলাপরা কস্টেবল দেখিয়াছি তাহারা মনে সন্ত্রম উৎপাদন করে না; তাহাদের দেখিলে ইয়ার্কি দিবার ইচ্ছা হয়, নালিশ জানাইবার ইচ্ছা হয় না। আমি যদি নালিশ করি, পুলিস হয়তো মিঠেভাবে একটু মুচকি হাসিবে। তাহাতে আমার কি লাভ?

এইভাবে মাসখানেক চলিল। স্নায়ু বলিয়া শরীরে যাহা ছিল ছিঁড়িয়া-খুঁড়িয়া জট পাকাইয়া গিয়াছে, মস্তিষ্কের মধ্যে চাতক পাখির কাানির মতো একটা ব্যাকুলতা পাকাইয়া পাকাইয়া ঊর্ধ্বে উঠিতেছে। ডাক্তারেরা যাহাকে নাভার্স ব্রেক-ডাউন বলেন সেই অবস্থায় পৌঁছিতে আর বিলম্ব নাই। এমন সময়

পরিত্রাণায় সাধূনাং—ইত্যাদি।

ত্রাণকর্তা যে কত বিচিত্ররূপে সম্ভবামি হন তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। অপার তাঁহার মহিমা।

রাত্রি সাড়ে নটার সময় একদিন বাড়ির সমস্ত বিদ্যুৎবাতি নিভিয়া গিয়াছিল। এত রাত্রে কোথায় মিস্ত্রী পাইব; ব্রাগাঞ্জার কথা মনে পড়িল। সে মোটর-মিস্ত্রী, নিশ্চয়ই বিদ্যুৎ সম্বন্ধে জানে শোনে। তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলাম।

সম্মুখের হোটেলে তখন উদ্দাম সঙ্গীত চলিয়াছে—পহেলি মোহব্বত কি রাত। অন্ধকারে প্রথম প্রণয় রজনীর উল্লাস যেন আরও গগনভেদী মনে হইতেছে।

ব্রাগাঞ্জা আসিয়া পাঁচ মিনিটের মধ্যে আলো জ্বালিয়া দিল। বিশেষ কিছু নয়, একটা ফিউজ পুড়িয়া গিয়াছিল। আমি ব্রাগাঞ্জাকে একটি টাকা দিলাম। তৈলাক্ত হাসিতে তাহার মুখ ভরিয়া উঠিল; কপালে হাত ঠেকাইয়া সে বলিল, থ্যাঙ্ক ইউ স্যর।

দ্বার পর্যন্ত গিয়া সে একবার থামিল; একটু ইতস্তত করিয়া বলিল, স্যর, এই গান শুনতে আপনার ভাল লাগে?

লক্ষ্য করিলাম, তাহার ঢুলুঢুলু চক্ষের মধ্যে ফুলঝুরির ফুলকির মতো একটা আলো ঝিকমিক্ করিতেছে। বলিলাম, ভাল লাগে! অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। তুমিও তো দিনরাত শুনছ, তোমার ভাল লাগে?

ব্রাগাঞ্জা মাথাটি দক্ষিণ হইতে বামে আন্দোলিত করিতে করিতে বলিল, না, ভাল লাগে না।

ব্রাগাঞ্জা চলিয়া গেল। নিজের ঘরে গেল না; এত রাত্রে অপ্রত্যাশিত একটি টাকা পাইয়াছে, বোধ হয় মদের সন্ধানে গেল। ওদিকে গান চলিয়াছে—লারে লাপপা লারে লাপপা

রাত্রি সাড়ে দশটা। শুইতে গিয়া কোনও লাভ আছে কিনা ভাবিতেছি এমন সময় শ্রীবিলাস হোটেলে রৈ রৈ মার মার শব্দ হইয়া গ্রামোফোনটা মধ্যপথে থামিয়া গেল; তৎপরিবর্তে চিৎকার চেঁচামেচি দুমদাম্ শব্দ আসিতে লাগিল।

ছুটিয়া রাস্তায় বাহির হইলাম। দেখি, হোটেলে দক্ষযজ্ঞ বাধিয়া গিয়াছে। তফাৎ এই যে দক্ষযজ্ঞে অনেকগুলা ভূত যজ্ঞ পণ্ড করিয়াছিল, এখানে একা ব্রাগাঞ্জা। সে একেবারে ক্ষেপিয়া গিয়াছে; তাহাকে দেখিয়া সেই নিরীহ নির্বিরোধ ব্রাগাঞ্জা বলিয়া চেনা শক্ত। গ্রামোফোনটাকে মাটিতে আছড়াইয়া ফেলিয়া সে তাহার উপর তাণ্ডব নৃত্য করিতেছে, টেবিল চেয়ার পেয়ালা গেলাস যাহা সম্মুখে পাইতেছে তাহাই ধরিয়া আছাড় মারিতেছে। আর গভীর গর্জনে বলিতেছে—ড্যাম্ লারে লাপপা—টু হেল উইথ গিলি গিলি গিলি-ডেভিল টেক পহেলি মোহব্বত কি রাত…।

রাস্তায় দাঁড়াইয়া দুই চক্ষু ভরিয়া দেখিতে লাগিলাম। হোটেলের মালিক ও তাহার সাঙ্গোপাঙ্গ ঘরের কোণে দাঁড়াইয়া ঐকতানে চেঁচাইতেছে; কিন্তু এই দুর্দান্ত মাতালকে বাধা দিবার সাহস তাহাদের নাই।

.

মদমত্ত অবস্থায় পরের সম্পত্তি নাশ করার অপরাধে ব্রাগাঞ্জার জেল ও জরিমানা হইল। জেল খাটিয়া আসিয়া ব্রাগাঞ্জা পূর্ববৎ মোটর মেরামত করিতেছে; যেন কিছুই হয় নাই। কিন্তু শ্রীবিলাস হোটেলের গ্রামোফোন বাজনা বন্ধ হইয়াছে। ব্রাগাঞ্জা নাকি দোকানের মালিককে ইসারায় জানাইয়াছে যে, আবার গ্রামোফোন বাজিলে আবার সে দক্ষযজ্ঞ বাধাইবে।

ব্রাগাঞ্জাকে আমি ভক্তি করি, তা যে যাই বলুন। মাঝে মাঝে ক্ষেপিয়া যাইবার সাহস যাহার আছে সে আমাদের সকলেরই নমস্য।

একদিন তাহাকে ডাকিয়া তাহার হাতে পাঁচটি টাকা দিয়া বলিলাম, সেদিন তুমি আমার বিদ্যুৎবাতি মেরামত করে দিয়েছিলে তার জন্যে তোমাকে উচিত পুরস্কার দিইনি। এই নাও।

ব্রাগাঞ্জা কপালে হাত ঠেকাইয়া সলজ্জ মিটিমিটি হাসিল। সে মাতাল হইলেও নির্বোধ নয়।

থ্যাঙ্ক ইউ স্যর।

সম্প্রতি মদ্য-নিবারণী আইন জারি হইয়াছে; কিন্তু সেজন্য ব্রাগাঞ্জার আটকায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *