বড় পাপ হে
দুচোখ কুঁচকে সে দূর মাঠের দিকে তাকালো। এখন ভর দুপুর। সেই সকাল থেকে মাছ ধরার চেষ্টায় সময়টা গেছে ফালতু। শুধু চুনো পুঁটি আর পাথরঠোকরা। কদিন থেকে তক্কে তক্কে ছিল সেই মোটকা বাণমাছটাকে ধরবেই, হারামীটা আজও সটকে গেল। ওটা নিয়ে ধোউয়ালির হাটে গেলে এক কিলো চাল হয়ে যেত নিশ্চয়। গরম গরম কিলোটাক ভাতের সঙ্গে মাছ, আজ সকাল থেকে সে খুব মৌজে ছিল। এখন এই খানিক আগে চুনোগুলোকে বাটিতে পুরে উনুনে চাপিয়ে দিয়েছে ও। নামাবার সময় একটু নুন আর তেলের ছিটে দিলেই হবে। মাছের এই হাল দেখে ভেবে রেখেছে রোদ একটু মিয়োলেই বেরিয়ে পড়বে। নিচে, খুঁটিমারির জঙ্গলের ধারটায় যে বাঁশঝাড়গুলো, শালা ঘুঘু পাখির বাগান হয়ে আছে। কালকে অবশ্যি অদ্দুরে যেতে হয়নি, নাথুয়ার রাস্তায় পেয়ে গিয়েছিল বাপধনকে। বুক চিতিয়ে দেখছিল শালা। সাঁই করে গুলতি ছুঁড়তেই কেলিয়ে গেল। উনুন বলতে তো তিন পাথরের বুকে গোঁজা জঙ্গুলে কাঠ। তাতেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেঁকে নিয়েছিল পাখিটাকে। নুন মেখে এই দাওয়ায় বসে রাত্তির বেলা চাঁদ দেখতে দেখতে ভুট্টা খাওয়ার মতো খেয়ে নিয়েছিল ও। খেয়েদেয়ে বলেছিল, বড় পাপ হে, বিচার করো। কেমন অভ্যেস হয় গেছে আজকাল, কিছু একটা কাজ করলেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ওই কথাগুলো।
নোনা রায় তো ওকে আজকাল সহ্য করতে পারে না। যখন ধান কাটাতে আর লাগাতে লোকজন নিয়ে এখানে আসে ওকে বলে সামনে না আসতে। কি মুশকিল! তা নোনা রায়কে তো বেশি আসতে হয় না এখানে। এক ফসলের জমি। ধানও তেমন হয় না। এবার নাকি মকাই লাগাবে ও। এসব জোতজমি নোনার।
আবার ভালো করে নজর রাখল সে। কারা যেন আসছে। কে আসবে? এখন তো ধান-ফানের সময় নয়। নাথুয়ার রাস্তাটা আর ফাঁকা মাঠ। লোকজনের মুখ দেখতে হলে চলে যাও ধোউয়ালির হাট। পারতপক্ষে যেতে চায় না ও। খুব যদি দরকার হয়, এই তেলটা নুনটা কিংবা মোটকা কোন মাছ-ফাছ যদি পেয়ে যায় সকাল সকাল। পেলেই লোকজন ওর দিকে ড্যাবডেবিয়ে তাকায়। প্রথম প্রথম কয়েকজন ভিড় করে আসত। মেয়েছেলেগুলোন রস রস করে তাকাতো। সে তিন চার বছর আগের কথা। ধান কাটতে এসেছিল নোনা রায় ছয়-সাতজন মদেসিয়া নিয়ে। মেয়ে মদ্দ। তাদের কেউ কেউ দেখেছে মাঝ রাতে সে নাকি বলেছে, ‘বড় পাপ হে, বিচার কর।’ দলের একটা মেয়ে নাকি পনের বছরের বাঁজা ছিল। ফিরে গিয়েই সে পেটের দড়ি আলগা করেছে। ব্যস, রটে গেল চারধার। হাট থেকে ঘুরে এসে নোনা রায় কাতলা মাছের মুখ করে বলল, ‘খবরদার, মেয়েছেলের দিকে, নজর দিয়েছো কি মেরে ছাল ছাড়াবো হারামজাদা। তোর বাপের তো কুষ্ঠ ছিল, তোরও একদিন হবে। তা আমি বলে দয়া করে থাকতে দিচ্ছি, চার মাস পঁচিশটা করে টাকা দিই, হ্যাঁ।’ তারপর হিকহিক করে হেসে বলেছিল, ‘ভালো ভালো’, ভূত-প্রেতের সঙ্গে কথা বলিস, লোকজন আর এদিকে ঘেঁষতে সাহস পাবে না।’
নোনা রায়ের বাড়ি এখান থেকে দশ ক্রোশ দূরে কাঠভাঙ্গায়। ঐ চার মাস আনাগোনা করে। বাকি আট মাস ধু ধু সব। এই চালা ঘরটায় থাকে ও। প্রথম প্রথম পাহারা দিত ও জায়গা-জমি। এখন জানে তার দরকার নেই। লোকজন আসেই না ভয়ে! বাপটা অবশ্যি সত্যি মরেছিল মাংস পচে খসে। সেই সময় গাঁয়ের লোক, নোনা রায়ের গাঁ, এক ঘরে করে দিয়েছিল ওদের। মরার আগে বাপ বলেছিল, ‘মেয়েছেলের কাছে যাবি না—বড় পাপ নিয়েছি হে—বিচার করো।’ তারপর থেকে কিছু করলেই ওর মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ে কথাগুলো। তা নোনা রায়ের কথা শুনে ও চমকে উঠেছিল প্রথমটা। আজ অবধি কোন মেয়েছেলে বলতে পারবে না নজর খারাপ করছে। সে সব দিকে ভয় নেই। শুধু পরদিন সকাল থেকে একটা অভ্যেস হয়ে গেল ওর। চালাঘর থেকে বেরিয়ে এসে সূর্যের আলোয় হাত-পা লক্ষ করে ও। টিপে টিপে কান নাক দেখে। বাপের শালা প্রথম কান নাক ফুলেছিল লাল হয়ে। বলতো সাড় নেই। ওর তো নিজের কানে চিমটি কাটলে জোর ব্যথা লাগে। তার মানে সেই দিনটা ও বাপ হয়ে যায়নি। বড় পাপ হে, বিচার করো।
এই জঙ্গুলে জায়গাটায় ওর একরকম চলে যায়। মোটমাট একশ টাকা বছরে পায় ও নোনার কাছ থেকে। শর্ত, হাতি এলে তাড়াতে হবে। গত বছর কলাগাছ লাগিয়েছে নোনা। কোন খবরাখবর হলে ধোউয়ালির হরেন মুদিকে খবর দিলেই নোনা পেয়ে যাবে। শালা ওকে একমুঠো ধানও দিয়ে যায় না। তা না দিক। পেট তো ওরই চাকর। আঙরাভাসায় মাছ আছে, আর ঘুঘু ডাহুক চখা এরা আছে। চলে যায় কোনরকম। এখন কলা পাকছে। চিনিকলা। নোনা ওকে অবশ্য খেতে বলেনি, মানাও করেনি। ভালো করে পাকলে খেয়ে দেখবে একদিন।
সত্যি লোক আসছে। ভালো করে ঠাওর করল ও। মাথার উপরে সূর্য, যারা আসছে তাদের ছায়া পায়ের তলায়। একটার হাতে লাঠি, অন্য দুজন হাত ধরাধরি করে আসছে। মেয়েছেলে। তিন পা হাঁটে তো হাঁ করে বাতাস নেয়। এ শালার বুড়িরা এখানে কি করতে এলো। থু করে থুতু ফেললো ও। মানুষজন দেখলেই আজকাল গা শিরশির করে। তারপর এরা তো শালা বুড়ি। দুপুরবেলা ঘুঘুর মতো গলা হেঁকড়েই চলবে। কিন্তু পাঠালো কে, কোন শত্রু! চট করে সামনে থেকে সরে এল ও। আড়াল থেকে লক্ষ করলে বোঝা যাবে মতলবটা কি।
তিন বুড়ি ঠুকুর ঠুকুর করে কোনরকমে চালাঘরটার সামনে এসে দাঁড়াতেই একটা ডাহুক আচমকা চেঁচিয়ে উঠল। মাথার ওপর করকরে রোদ, মুখ হাত কিন্তু ঘামেনি কারো। তিনজনের যে বড় তার গায়ের চামড়া মালার মতো শরীরে জড়ানো। ময়লাটে শাড়ি তিনজনের অঙ্গে। যদিও দ্বিতীয়জন বাতগ্রস্ত তবু তার শাড়ি প্রথমজনের মতো অগোছালো নয়। হাঁটতে তার কষ্ট হয়েছে খুব। তৃতীয়জন বয়সে ওদের চেয়ে ছোট। কাঁচাপাকা চুল। অন্যদের মতো খালি গা নয়। তবে জামাও ওকে বলা যায় না ঠিক, কারণ পিঠের দিকটা কোনরকমে গিঁট বাঁধা। পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে অনেকদিন তবু পাছাটাছাগুলো ভার ভার। মিলের মধ্যে তিনজনেরই গালের ওপর মেচেতার দাগ ঘন।
ধপাস করে ওরা চালাঘরটার দাওয়ায় বসে পড়ে নিঃশ্বাস সইয়ে নিচ্ছিল। ছোটজন বলল, ‘এলাম গো শেষ পর্যন্ত।’ গলাটা এখনও মরেনি, ধাক্কা খায় না কোথাও। দ্বিতীয়জন বলল, ‘মানুষজন কাউকে দেখি না কেন!’ গলার স্বর খনখনে। প্রথমজন দুই হাতের মুঠোয় লাঠি নিয়ে গাল চেপে বসেছিল, ‘একটা লোক থাকে বললো যে, সে ব্যাটা কোথায়?’
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর ওরা উঠল। তৃতীয়জন উঁকিঝুঁকি মেরে ঘরের মধ্যে তাকালো। আগে শুধু দাওয়াটা আর মাথার ওপর চালা ছিল একটা। এখন চাটাই দিয়ে চারটে দেওয়াল দেওয়া হয়েছে। দরজাও আছে একটা। ‘কেউ নেই মনে হয়।’ বলে তৃতীয়জন ঘরে ঢুকে পড়ল। একটু বাদেই তার গলা শোনা গেল, ‘অ দিদি, লোক আছে গো। উনুন জ্বলে তাতে গাদাখানেক মাছ সেদ্ধ হয় দেখি।’
দ্বিতীয়জন বলল, ‘মাছ? আহা—কি মাছ রে!’
বড়জন চারপাশ দেখে নিয়ে বলল, ‘দুটো নিয়ে আয় দেখি।’
ছোটজন বেরিয়ে এলো খালি হাতে। ‘নিয়ে আসব যে, অন্য লোকের মাছ না?’ বড়জন হি হি করে হাসল খানিক, ‘তাতে কি, ব্যাটাছেলেরা তো আমাদের ছেলের মতো।’ আশেপাশে কেউ থাকলে শুনতে পারে এমন জোরে বলল কথাগুলো। খিলখিল করে হাসতে চেষ্টা করল তৃতীয়জন, ‘যে-সে লোক নয় গো, ভূত নামায়। রাতবিরেতে কথা বলে তাদের সঙ্গে, হ্যাঁ।’ দ্বিতীয়জন জোগান দিল, ‘আবার বাঁজা মেয়ের সাধ খাওয়ার ব্যবস্থা জানে।’
তিনজনেই হো হো করে হাসল। বড়জন জোরে, দ্বিতীয় চেপে চেপে, ছোট রসিয়ে রসিয়ে। ছোটর নজর পড়ল কলাগাছে কলা হয়েছে। একটা কাঁদিতে বস্তা জড়ানো। তার ফাঁক দিয়ে পেকে যাওয়া নাদুসনুদুস এক ছড়া বেরিয়ে এসেছে।
‘বোতাম ছিঁড়েছে গো, আহা।’ ঘাড় দোলালো সে। দ্বিতীয়জন বুঝতে পারেনি প্রথমটা। শেষ পর্যন্ত কলা লক্ষ করে খরখরে জিভটা জলে ধুয়ে নিল, ‘যা না ভাই, হাত বাড়ালেই পাবি, যা না, পেট আমার অম্বুবাচী করা মেয়েছেলের মতন হয়ে আছে।’
বড়জন বলল, ‘যা না মাগী, খিদে লাগেনি তোর?’
গড়িমসি করে ছোটজন উঠল। ওপাশে কুয়ো আছে একখান। তার গা দিয়েই কলাগাছের ঝাড়। শরীর এখন ভারী, মনের চাকর নয়। হাত বাড়ালেই নাগাল হয় না। লাফাবে এমন সাহস নেই। কোথায় কোন জন শত্রুতা করার জন্য বসে আছে বলা যায় না। লম্বা শরীরের আঁকশি পেলে হতো। একটা ছোট্ট কঞ্চি পড়ে আছে দেখে তুলতে যাচ্ছে এমন সময় একটা ধমক শুনতে পেল ছোটজন, ‘কলা পাড়া নিষেধ আছে।’
দাওয়ায় বসে বড়জন বলল, ‘কে রে?’
দুপদাপ পা ফেলে সে সামনে এসে দাঁড়াল। তিনজনই অবাক চোখে ওকে দেখছিল। ও বাবা, এ যে দেখছি বেশ মদ্দ মানুষ। দাড়ি গোঁফ গজিয়েছে এমন, বয়স বোঝা মুশকিল। চুল বেশ বাবরি হয়ে আছে। হাঁটু অবধি ধুতি গোটানো, উদোম গা। হাত-পা ফাটা ফাটা। বেশ রেগে গেছে দেখলেই বোঝা যায়, ‘কি মনে করে এখানে? কি চাই?’
‘চাই? না না, কিছু না, কিছু চাই না। এই বয়সে আর চাইবো কি বাপ! তা তুমিই বুঝি সেই।’
বড়জন মাথা দুলিয়ে বলল।
‘সেই মানে?’ লোকটা তিন বুড়িকে দেখে নিল।
‘ঐ যে ভূতের সঙ্গে কথা বলে, মেয়েছেলের বাচ্চা করে দেয়। শুনলাম যে, ধোউয়ালির হাটুরেরা বলছিল।’ ছোটজন সামনে এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে লোকটার শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল, ‘নাঃ অ দিদি, পাপটাপ তো ঢোকার জায়গা পায়নি মনে হয়। পেটটেট তো দেখি এখনো এয়ো হয়ে আছে।’
বড়জন বলল, ‘তা পায়ের গোড়ালি দেখেছিস? কানের লতি নাকের পাটা? ঠিকঠাক বলিস বাপু, আমি আবার পানসে দেখি আজকাল।’
এতক্ষণে কথা বলল মেজো, ‘না গো, ছোট ঠিকই বলেছে!’ লোকটা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল গতিক দেখে, শেষ পর্যন্ত সামলে নিল, ‘কে পাঠিয়েছে এখানে?’
‘হাটের লোকজন।’ ছোটজন বলল, ‘থাকার জায়গা খুঁজছিলাম, তা বলল সবাই তোমার গুণের কথা, দেখতে এলাম।’
মেজো ধমকে উঠল এবার, ‘আঃ কাজের কথাটা বল না আগে। এই যে বাছা, খিদে লেগেছে বড়, মাছ রাঁধছ শুনলাম, দুটো ভাত চাপিয়ে দাও আমাদের জন্য।’
‘ইস।’ ভেংচে উঠল লোকটা, ‘আমার কে রে! এক ফোঁটা চাল নেই ঘরে উনি খাবেন ভাত। এখানে থাকা-টাকা হবে না। একটাই ঘর।’
‘তাতে কি! আমরা তো ঘাটের মড়া। ফেলিস না বাপ।’ বড়জন বলল। ‘ভূত দেখার বড় সাধ।’ ছোটজন পিনিক কাটলো।
‘নোনা রায় শুনলে ছাল ছাড়য়ে নেবে আমার।’ লোকটা চোখ বড় বড় করে ভয় দেখাতে গিয়ে দেখল ছোট হাসছে। ‘কোন নোনা? কাঠভাঙ্গার সেই মিনসে! গোঁফ না উঠতেই আমার ঘরে এসেছিল গো। কি ছেলে, বুঝলে দিদি, সেদিনই আবার ওর বাপের আসার কথা! কোনরকমে সামলে-সুমলে ফেরত পাঠাই। বাপটা ছিল কসাই। ছিবড়ে করে ফেলতো যেন। তা সেই নোনা নাকি! বাঃ বাঃ।’ লোকটা হাঁ হয়ে শুনছিল কথাগুলো। ছোট থমতেই মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, ‘বড় পাপ হে, বিচার করো।’
মেজো যেন ভূত দেখলো সামনে, ‘আঁ! বলে কি গো।’
ছোটজন চোখ ঠারল, ‘পাপ, পাপ’ করেছে গো বিচার চায়!’
বড় মাথা দোলাল, ‘শুনবো সব শুনবো। আগে খেতেটেতে দাও। বুঝলে বাপ, পেট হলো সবচেয়ে বড় পুণ্যি। সেটা মিটালে পাপের কথায় জিভে স্বাদ লাগবে।’
‘এখানে খাবারটাবার নেই। চাষ-বাস হয় যার খাবার তার কাছে। আমি মাছ মাংস ধরে খাই, তোমরা বিধবা মানুষ—!’ লোকটা মিনমিনে গলায় বলতে চেষ্টা করল। ওদিকে উনুনে চাপানো বাটি থেকে গন্ধ উঠছে জোর। এবার নামানো দরকার।
বড়জন শিরাঝোলা হাত আকাশের দিকে উঁচিয়ে বলল, ‘ও বাপ, বিধবা বোলো না গো। হাজার হাজার ভাতার ছিল আমার, মরে হেজে গেলেও কেউ কেউ তো এখনো দিব্যি ফুরফুরিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তা বিধবা হলাম কি করে!’
লোকটা টক করে লাফ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। হায় হায়, আর একটু দেরি হলেই হয়েছিল আর কি! জল শুকিয়ে তলা ধরবো ধরবো করছে। নুন তেল ছিটিয়ে নামাতে নামাতে ও বাইরের দিকে তাকাল। ছোটজনের ছেঁড়া জামার গিঁট দেখা যাচ্ছে; পেছন ফিরে আছে। আর দুজন চোখের আড়ালে তাই নিজের মনেই যেন বলল ও, ‘হাজার ভাতার তো বেবুশ্যেদের হয়।’
মেজোজন বলল, ‘ছেলের দেখি বুদ্ধি আছে খুব। ঠিক ধরে ফেলেছে।’
কথাটা শুনেই লোকটা কাঠ হয়ে গেল। অ্যাঁ! এই তিন বুড়ি বেবুশ্যে! ধোউয়ালির লোকজন এখানে পাঠিয়ে দিল কেন? ওকে পরীক্ষা করতে? মেয়েছেলের কাছে গেলে শরীর নষ্ট হয় বাপ বলতো। বাপেরও শরীর নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাই। তা এদের কি মেয়েছেলে বলা যায়? দুজন তো শুকিয়ে আমসি, হাড়গুলো পটাং পটাং করে। ছোটজন, যার শরীর একটু ভারী, সেও তো এখন আভাঙা কুঁজোর মতো, মুখটাই সরু, তলায় মস্ত ফাঁক—জল ধরে না। তা এদের কি আর মেয়েছেলে বলা যায়? এর আগে মেলায় ও বেবুশ্যে দেখেছে। তা তাদের ঠাটঠমক আলাদা, বাপের কথা মনে হলেই বুকের মধ্যে ভয়টা টনটনাতো। এরা কিন্তু সে জাতের নয়। এককালে হয়তো ছিল, লোকটা ভাবলো, এখন তো গাঁয়ের পাঁচ পুরুষ দেখা হরিবালার মতো চেহারা সব। মাসী বলে ডাকা যায়। পরক্ষণেই নিজেকে ধমকে উঠল সে, কোথাকার কে, আদিখ্যেতা দেখানো মানে নিজের বাঁশ নিজে নেওয়া। মেয়েছেলে হোক না হোক, তিনটে পেট তো! ওগুলো ভরাবে কে? ঘর থেকে হাঁক ছাড়ল ও, ‘এখানে সুবিধে হবে না, চলে যাওয়া হোক।’
‘তাই নাকি!’ ছোটজন বলল।
‘রাতবিরেতে জায়গা ভালো নয়, আর কিছু না হোক, হাতি নামে জঙ্গল থেকে।’ লোকটা যেন ভয় দেখাল।
‘কত হাতি মোষ দেখলাম সারাজীবন।’ ঠেস লাগলো গলায়।
‘তারপর নোনা রায় আছে! বড় রাগী মানুষ।’ লোকটা যেন অনুনয় করছিল এবার।
‘নোনার তলপেটে একটা আধুলির মতো জড়ুল আছে, ও কিছু বলবে না, কী ভিতুই ছিল না দিদি কি বলবো।’ ছোটজনের উদাস গলা।
যাঃ শালা। লোকটা অসহায় চোখে বাটির দিকে তাকালো। নোনা রায়ের বেবুশ্যে এরা। আবার নোনার বাপেরও। অথচ এদের কথা কোন দিন শোনেনি ও। ওর বাপ কি এদের—। খুব কৌতূহল হল ওর ‘তা এ তল্লাটে আগে দেখিনি কেন?’
‘দশ বছর ছিলাম না গো, তীর্থ মারাতে গিয়েছিলাম। তা দেখলাম সেখানেও এক ব্যাপার। প্রথম প্রথম ছোটটার দিকে লোকে তাকাতো। তারপর তো আমরা পুঁটলি। তাই ফিরে এলাম এখানে। জায়গাটা চিনি, মানুষজন জানি। তা বলো, এই কুড়ি ত্রিশ ক্রোশের সব বুড়ো মানুষই আমাদের চেনে, হে হে।’ বড়জন গলা কাঁপিয়ে কথাগুলো বলল।
খুব ভয়ে ভয়ে গোপন খবর নিচ্ছে এমন গলায় সে বলল, ‘আচ্ছা, কাঠভাঙার আর কেউ, লম্বামতন বাবরি চুল, গলায় কম্বল ছিল—।’
মেজোজনের গলা শুনতে পেল সে ‘গলকম্বল—ও দিদি সেই লোকটা গো, তোমার কাছে একরাত বাকি রেখে গিয়েছিল, মনে পড়ছে, বাবরি চুল।’
চট করেই প্রথমজন যেন মনে করতে পারল, ‘সেই কেষ্ট ঠাকুর! বাকি রেখেছে আর শোধ করেনি। তা আমাদের পয়সা মারলে নিস্তার আছে বাপ! শুনেছি কুষ্ঠ হয়ে মরেছে। চেন নাকি বাপ? কেউ হয়টয় নাকি?’
বাটি হাতে নিয়ে লোকটা কুঁকড়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়াল, ‘আমার বাপ।’
সন্ধ্যে থেকেই খুঁটিমারি জঙ্গলের নিঃশ্বাসের মতো একদল বাতাস আনাগোনা করছিল। এখন আকাশে মেঘ নেই। বুকে বাঁধিয়ে রাখার মতো আকাশটার তলায় দাঁড়ালে শরীর শিরশির করে। এ জায়গাটায় দিনে যতই গরম হোক রাত পড়লে কেমন শীত শীত ভাব। যেদিকে তাকাও আলোর দেখা পাওয়া যায় না। শুধু ফাঁকা মাঠের ওপর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা জোনাকিরা কিলবিল করে।
কলাগাছের ঝোপের ওপাশে একটা বড় পাথরে লোকটা বসেছিল। ওর ঠিক মাথার ওপর ছাতির মতো চাঁদ ঝুলছে। লোকটা অনেকক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে আছে। ওর পেছনে চালাঘরটায় তিন বুড়ি কুকুরকুণ্ডলী হয়ে পড়ে আছে। তিন তিনটে পেটে আধচেবানো ঘুঘুর মাংস পড়েছে রাত হলেই। রোদ মরলে ও চলে গিয়েছিল সেই বাঁশঝাড়ে। ঘণ্টাখানেক লাগেনি, গোটা চারেক ঘুঘু হাতে ঝুলিয়ে ফিরে এসেছিল। কিন্তু আজ পোড়ানো হয়নি সেগুলো, ছোটজন ভাঙা হাঁড়িতে সেগুলো সেদ্ধ করছে। এ অন্যরকম স্বাদ। আজ সারা দিনটাই অন্যরকম গেল। চাঁদের দিকে তাকিয়ে লোকটা বাপের মুখ মনে করতে চাইল। তারই মতো বাবরি চুল ছিল বাপের। লোকে বলত বাপ-বেটা দেখতে একরকম। বাপ, তুমি বাকি রেখেছিলে কেন হে বেবুশ্যেদের কাছে? আমার কিছু পয়সা আছে ঘরের নিচে পোঁতা, তোমার ধার শোধ করে দেব। অভ্যেসে লোকটার একটা হাত চলে গেল কানের লতিতে। টেনেটুনে দেখল। প্রথমে ছিল অন্যমনস্ক, চট করে খেয়াল হতেই অন্য লতিতে হাত দিল। সাড় নেই নাকি! না, ঠিকই আছে, বেশ ব্যথা করে একটা। অন্যটার—মাথা ঝাঁকালো সে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘বড় পাপ হে, বিচার করো।’ জল এসে গেল চোখে।
‘আমরা এসেছি বাপ।’
চমকে ফিরে তাকালো সে। প্রথমটা ঝাপসা দেখল ও। তিনটে বাঁকা আধবাঁকা শরীর ওর ঠিক পেছনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। চাঁদের আলোয় তাদের সেই তেনাদের মতো দেখাচ্ছে। হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়াল ও। দাঁড়িয়ে হাতজোড় করল। তারপর চোখ বড় বড় করে দেখল তিন বুড়ি ওর দিকে কেমন মোহিনী মুখে তাকিয়ে আছে।
‘কথাবার্তায় বিঘ্ন করলাম না তো।’ বড়জন ফিসফিস করে বলল, ‘উনারা রাগ করবেন না তা, ক্ষমা চেয়ে নাও বাপ। তুমি তো আমার ছেলে।’
মেজোজন বলল, ‘এই শুনেই এসেছি গো তোমার কাছে। হাটুরেরা বলেছে, তোমার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে স্বচক্ষে দেখলাম আজ।’
ছোটজন মাথা নিচু করে বলল, ‘নইলে কেউ একা একা এই বাদাড়ে থাকতে পারে।’
ওরা তিনজন পাশাপাশি মাটিতে উবু হয়ে বসল। ওদের সামনে লোকটা হাঁ করে দাঁড়িয়ে। কি করবে বুঝতে পারছিল না সে। বড়জন তেমনি ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমরা এখানে থাকতে আসিনি বাপ। কাল ভোর ভোর চলে যাব। তোমাকে একটা কাজ করে দিতেই হবে।’
খসখসে গলায় লোকটা বলল, ‘কী’?
মেজোজন বলল, ‘তুমি কোন মেয়েছেলের সঙ্গে শুয়েছ গো?’
চমকে উঠল লোকটা, ‘না, না। কক্ষনো না। মেয়েছেলে শরীর নষ্ট করে দেয়।’
ছোটজন বলল, ‘মেয়েছেলে নিয়ে কোন কুচিন্তা—।’
প্রবল বেগে ঘাড় নাড়ল লোকটা, ‘না না।’
মাথা দোলালো তিনজন। বড়জন বলল, ‘অঙ্গ দেখেই বুঝেছিলাম। তাই তো উনারা তোমাকে বেছে নিয়েছেন। তা আমাদের অনুরোধ রাখো এবার। আমরা তিনজন তো ঘাটের মড়া, পা বাড়িয়ে বসে আছি। সারা জীবন বেবুশ্যে ছিলাম, মরতে গেলেও বেবুশ্যে। অনেক তীর্থ করলাম, লোকে যেই শোনে বেবুশ্যে চোরা চাহনি চালায়। ছোটর যৌবন গেলেও খোলসটা যে ছাই যায়নি। তা তোমার কথা শুনে এখানে এসে তোমাকে দেখলাম। তা বাপ, মরার পর সব তো যাবে আগুনে যদি শ্যাল কুকুরে না খায়, পাপগুলোর গতিটা কি হবে! তুমি বাপ আমাদের বিচার করো। না বোলো না বাপ—পিতৃঋণ না হয় শোধ করো।’
তিনজন ভিখিরীর মতো ওর দিকে তাকিয়ে থাকল এবার। থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে লোকটা বসে পড়ল পাথরটার ওপর। সামনে তিন বুড়ি মাটিতে বসে। চাঁদের আলোয় সর পড়েছে জব্বর। অজান্তে হাতের আঙুল চলে গেল লতিতে। কুঁকড়ে গেল ও, হায় বাপ, এটাতেও ব্যথা লাগে না কেন? ফিসফিস করে সে বলল, ‘বড় পাপ হে—।’
‘বলি তা হলে বাপ’, প্রথমজন বলল, ‘বারো বছর বয়সে বিধবা হয়েছিলাম। না, মিছে কথা না, কেউ আমাক বেবুশ্যে করেনি। স্বামী মারা যাবার আগে স্বাদ পেয়েছিলাম রক্তে। তার টানেটানে চলে এলাম গো। না, আফসোস করি না ত্রিশ বছর কাজ করেছি আমি। হাজার হাজার মানুষ দেখলাম। সব এক রকম। ঘরে ঢোকার পর অবশ্য চেহারা থাকে আলাদা। এর জন্য বিচার চাই না। আমি তো পাপ করিনি কিছু। লোককে আনন্দ দেওয়া কি পাপ? কিন্তু আমার কি হতো জানো? যেই কোন লোককে ঘরে তুলতাম, ভাবতাম আমার স্বামী এসেছে। সেই স্বামী, যে বারো বছর বয়সটাকে সামনে দিয়ে চলে গেছে। এখন মনে হয় বাপ, আমি অন্যায় করেছি। সেই লোকটার আত্মাটাকে কষ্ট দিয়েছি।
এটাই তো পাপ, তুমি বিচার করো বাপ, সে কি বলে জিজ্ঞেস করো!’
বড়জন থামতেই চারধার হঠাৎ নির্জন হয়ে গেল। লোকটার দুটো পা মাটিতে যেন আটকে গেছে। ও নড়তে পারছিল না। এই বুড়ি মেয়েছেলেটার সঙ্গে চুরি করে রাত কাটাতো ওর বাপ। এই বুড়ি ওর বাপের শরীর নষ্ট করেছে। কিন্তু বাপ কেন বাধা রেখেছিল এর কাছে। ওর মা, যে নাকি ওকে জন্ম দিয়েই কার সঙ্গে কোথায় চলে গিয়েছে, সে কি বাপকে সুখ দেয়নি! ফিসফিস করে ও বলল, ‘মা, মা—।’
সঙ্গে সঙ্গে প্রথমজন টলমল গলায় বলে উঠল, ‘জোরে বল বাপ, আঃ আঃ, কি শান্তি।’ হু হু করে কেঁদে ফেলল বুড়ি।
নড়েচড়ে বসল দ্বিতীয়জন, ‘আমার ঠাকুরপো আমাকে রাস্তায় এনেছিল। রাস্তা থেকে নিজেই ঘরে এলাম। তা দিদির মতো আমার দুঃখ হয় না বলবো না, হয়। সংসারের জন্য আগে কষ্ট হতো। এই কুকুরের জীবনে ঘেন্না ধরে গেছে। কপাল এমন, তিন তিনবার ছেলে বিয়োবার চেষ্টা করেছি, জন্মাবার সময় কে যেন ফাঁস টেনে মেরে ফেলেছে তাদের। রাজপুত্র না হোক, আমার ছেলে হতো তো বেঁচে থাকলে। দিদি বলত, আগের জন্মে ব্রাহ্মণ ছিল তারা, তাই নাড়ি পৈতের মতো গলায় আটকে যেত তাদের। তাতে আমি কি পেলাম বল। এসব সুখদুঃখ তো আছেই। একদিন দেখলাম শরীর জ্বলছে। কাউকে বললাম না। এক সন্ন্যাসীর কাছে পুজো দিতে গিয়েছিলাম, তিনি প্রসন্ন হয়ে আমাক কোন সাধুর গল্প বললেন। মন সায় দিচ্ছিল না, তবু ভাবলাম হয়তো এটা পরীক্ষা। রাত্তিরবেলা শরীর দিয়ে তার পুজো করলাম। বললেন, এবার ছেলে বাঁচবে। তা ভোর রাতেই মনে হল অস্বস্তি হচ্ছে। সন্ন্যাসী চলে গেলে টের পেলাম পরে, বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। রাগ হয়ে গেল খুব। মায়া নেই মমতা নেই। ডাক্তার দেখালাম না, এক মাস ধরে মানুষের শরীরে সেই বিষ ছড়াতে লাগলাম। এখন মনে হয় কি পাপই করেছি আমি। কত মানুষ অন্ধ হলো, কত সংসার ভেসে গেল, সব আমার হিংসের জন্য, পাপের জন্য। এখন আমি কি জবাব দেব?’
চারধার আবার চুপচাপ। শুধু বড়জন এখনো ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। একটা রাতের পাখি শব্দ করে ডেকে উঠল কোথাও। জোছনার সর ক্রমশ হলদে হয়ে আসছে। লোকটার মনে পড়ল বাপ বলেছিল, ‘মেয়েছেলের কাছে যাবি না—বড় পাপ নিয়েছি হে।’ যেন বালতিতে জল ভরা আছে, লোকেরা এসে মগে করে তুলে তুলে নিয়ে যায়।
‘কিছু বলো গো, আমার বুক জ্বলে যায় পাপে!’ মেজোজন যেন থাকতে পারছিল না আর।
লোকটা বলল, ‘আমি জানি না, কিছু জানি না।’
‘তোমাকে বলতেই হবে বাপ। যা শাস্তি হয়—। তোমার মায়ের দিব্যি।’
চমকে উঠল লোকটা। মায়ের দিব্যি। মা কেমন দেখতে? কোন ছবি নেই ওর মায়ের। বাপ বলতো কালোকেলে ছিল না। সামনে তাকালো ও। মেজোজনের মুখ দেখল। মাংস নেই একরত্তি। বুড়ো হলে কি কঙ্কাল শুকিয়ে যায়? সব মানুষের কঙ্কাল তো একই রকম দেখতে। মাংস আর চামড়ার হেরফের চেহারা আলাদা আলাদা হয়। মায়ের বয়স এখন কি এর মতো হবে? মা এখন কোথায়? যার সঙ্গে চলে গেছে মা সে কি রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে? ফিসফিস করে বলল সে, ‘মা গো, মা—।’
সঙ্গে সঙ্গে দুই বুড়ি দুজনকে আঁকড়ে ধরল। লোকটা দুজনের কান্না শুনতে পাচ্ছিল। ছোটজন মুখ নিচু করে বসে এক ধারে। বড় দুজন পরস্পরকে ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তারপর একটা কান্না নিয়ে মাখামাখি করতে করতে চালাঘরটার দিকে কেমন আবিষ্টের মতো চলে গেল। লোকটা দেখল, বড়জন লাঠিটা মাটিতে ফেলে রেখে গিয়েছে। ফিসফিস করে বলল সে, ‘বড় পাপ হে, বিচার করো।’
খুব মৃদু কান্নার শব্দ আসছে ঘর থেকে। চাঁদ এখন ছায়া ফেলেছে লম্বা লম্বা। ডাহুকগুলো এত রাত্রে চেঁচায় কেন? ছোটজন নড়েচড়ে বসল। তারপর সামনের দিকে মুখ তুলে বলল, ‘কোন পাপ করিনি।’
কথাটা একদম আশা করেনি লোকটা। প্রতিদিনও নিজে কত পাপ করে তার কি শেষ আছে। এই মাছগুলোকে যখন মারে তখন মনে হয় পাপ করলাম। ঘুঘু পাখিগুলো যখন খাবি খায় তখন মনে হয় পাপ করলাম। তবে? ছোটজন বলল, ‘আমার মা ছিল এই লাইনেই, আমিও তাই করেছি। লোকে বলতো আমি নাকি উর্বশীর চেয়ে সুন্দর, রম্ভার চেয়ে আমার যৌবন বেশি। লাইন পড়তো আমার ঘরের সামনে। সে সব যা দিন গেছে, আঃ। দু হাতে টাকা উড়িয়েছি, একদম আফসোস নেই এখন, কি দেখতে ছিলাম। তুমি এমন মেয়েছেলে দেখেছ যার গায়ের রং গমের মতো, চুল খুললে শাড়ি পরতে হয় না, ভেতরের জামা পরেনি দেখে এই সেদিনও লোকে হাঁ হয়ে চেয়ে থাকতো, হাঁটলে পরে ছেলে বুড়োর জিভ শুকিয়ে যেত, দেখেছ?’ মুখ কাত করে প্রশ্ন করলো ছোটজন।
ঘাড় নাড়ল লোকটা। না, না।
‘তাহলে আর কী দেখেছ? ভোর হবার আগে আকাশ দেখেছ কিংবা সন্ধে হব হব আকাশ? দ্যাখোনি, তা হলে কী দেখেছ! আমি সেই রকম ছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে যেমন রাত হয়ে যায়, এ আমার তেমন হলো যে। সব যে চলে যায়, যৌবনটা চোখের ওপর দিয় গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেল। অথচ মন আমার মানতে চায় না কেন? কেন ইচ্ছে করে একটা পুরুষ মানুষ আমাকে দেখে ভিতরে ভিতরে কাঁপুক। কেন ইচ্ছে করে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি একটা সত্যিকারের পুরুষমানুষকে ধরে রেখে থর থর করে কাঁপি? কিন্তু আমার যে কিছুই নেই আর। শরীরের কোথাও সাড় পাই না আজকাল। মনে হয়, এটা আমার দেহ নয়। কেন যৌবন চলে গেল, শরীর থেকে তো মন বয়স গেল না?’ গোখরো সাপের মতো ফণা তুলে ছোটজন ওর দিকে তাকালো।
‘আমি জানি না।’ অসহায়ের মতো বলল লোকটা। বলতে বলতে আঙুল দিয়ে দু কানের লতি স্পর্শ করল। ব্যথা লাগে না কেন? চট করে নাক ধরল ও। কি ঠাণ্ডা নাক!
‘জানো না! তোমার মনের মধ্যে এমন হয় না? সত্যি বল? শরীরের সব কিছু তোমার বশ?’ উঠে দাঁড়াল ছোটজন।
‘জানি না।’ দু হাতে মুখ ঢাকল লোকটা।
‘জানো না! ছি ছি ছি। তুমি আবার পুরুষমানুষ নাকি! সাড় নেই যার শরীরে তার আবার যৌবন কিসের! আমার মনে সাড় আছে, তোমার তো তাও নেই। হায় কপাল, কার কাছে বিচার চাইতে এল ওরা। তোমার সারা শরীরে কুষ্ঠ, দগদগে ঘা, বাইরে থেকে দেখা যায় না, তাই তোমার সাড় নেই শরীরে। ওয়াক, থু।’ এক দলা থুতু মাটিতে ছিটিয়ে ছোটজন দুপদাপ পা ফেলে ঘরের দিকে চলে গেল। ভয়ে কুঁকড়ে আঙুলের ফাঁক দিয়ে লোকটা দেখল হাঁটার তালে তালে ছোটজনের অহংকারী শরীর কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে।
হঠাৎ সে আবিষ্কার করল, তার জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সারা শরীরে কোথাও যেন জল নেই, হাত পায়ে কানের লতিতে সাড় নেই একদম। বাপ বলেছিল কুষ্ঠ হলে সাড় চলে যায়! কিন্তু এই মুহূর্তে ও নিজের বাপকে হিংসে করতে শুরু করল। মিথ্যে কথা।
ছোটজনের শরীর এখনও দেখা যাচ্ছে। নেতানো জ্যোৎস্না মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সেখানে। হঠাৎ মুখের সামনে একটা হাত নেড়ে কিছু একটা সরিয়ে দেবার ভঙ্গি করে চেঁচিয়ে উঠল সে, ‘হটো বাপ।’