ডিসেম্বর। পরীক্ষার মাস
বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ মাস কোনটা?
ডিসেম্বর। পরীক্ষার মাস। এই মাসটা না থাকলে কেমন হতো? সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর তারপর জানুয়ারি। মাঝখানের ডিসেম্বরটা নেই। বোতল ভূতকে বললে হয়। না? নিশ্চয়ই হয়। সে কিছু একটা করবেই–কিন্তু তাকে বলা যাচ্ছে না। কারণ বড়চাচা বোতল ভূত স্টিলের আলমিরায় বন্দি করে রেখেছেন। ফাইনাল পরীক্ষার আগে তাকে হাতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। পরীক্ষার পরেও যে পাব সে আশাও খুবই ক্ষীণ। এরকম কেন হলো সেটা আগে বলে নিই।
আমাকে আর অন্তুকে পড়ানোর জন্য নতুন। একজন স্যার রাখা হয়েছে, মজিদ স্যার। এই স্যাবের চেহারাটা খুব ভালোমানুষের মতো, কিন্তু মেজাজ আগুনের মতো। বাড়িতে ঢুকেই বিনা কারণে একটা হুংকার দেন। তারপর বলেন–হোমটাস্কের খাতা আর বেতটা বের কর। কত ধানে কত চাল আগে হিসেব নিয়ে নেই। আমরা ভয়ে ভয়ে হোমটাস্কের খাতা বের করি। পরবর্তী আধা ঘণ্টা আমাদের উপর দিয়ে বড় ধরনের একটা সাইক্লোন বয়ে যায়। আমরা কান্নাকাটিও করি। তাতে লাভ হয় না। বড়চাচা হৃষ্টচিত্তে বলেন, ভালো মাস্টার দিয়েছি। এইবার টাইট হচ্ছে। মাস্টার, আরো টাইট দাও। আরো। উৎসাহ পেয়ে মজিদ স্যার আরো টাইট দেন। আমরা চোখে অন্ধকার দেখি।
শেষ পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে অন্তু যা করল তা মোটেই দোষের নয়। দুলাইনের একটা কবিতা লিখল–
মজিদ স্যার মজিদ স্যার
চোখে দেখি অন্ধকার।
কবিতা লিখেই সে থামল না। আমার কাছ থেকে বোতল ভূত কিছুক্ষণের জন্যে ধার করে নিয়ে চলে গেল ছাদে। তারপর খুব করুণ গলায় বোতল ভূতকে বলল, ও আমার প্রিয় ভূত, ও আমার লক্ষ্মী ভূত, ও আমার ময়না তৃত, তুমি মজিদ স্যারের পা ভাঙার একটা ব্যবস্থা করে দাও ভাই। যাতে সে আর আমাদের পড়াতে আসতে না পারে।
অন্তু লক্ষ করে নি যে বড়চাচা ছাদের এক কোণায় সারা গায়ে অলিভ অয়েল মেখে রোদ তাপাচ্ছেন। সেখান থেকে তিনি মেঘগর্জন করলেন, অন্তু এদিকে আয়।
অন্তু এগিয়ে গেল।
বোতলটা আমার কাছে দে।
অন্তু বোতল দিল।
কানো ধর।
অন্তু কানো ধরল। বড়চাচা বললেন, শকুনের বদদোয়ায় গরু মবে না, বুঝলি। যদি মরত— দেশের সব গরু মরে সাফ হয়ে যেত। বুঝতে পারলি?
জি বুঝতে পারছি।
কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাক। আর আমি মজিদ মাস্টারকে খবর পাঠাচ্ছি। সে যেন আজ থেকে দুবেলা আসে। সকালে একবার, সন্ধ্যায় একবার। যে রোগের যে দাওয়াই।
মজিদ স্যারকে খবর পাঠাতে হলো না। তার বাড়ি থেকে খবর এসে পড়ল–কিছুক্ষণ আগে বাথরুমে পা পিছলে পড়ে তার পা ভেঙে গেছে। বড়চাচা অত্যন্ত গম্ভব হয়ে গেলেন। বোতল ভূতকে স্টীলের আলিমিরায় তালাবদ্ধ করে রাখলেন। চাবি সব সময় তার কোমবে কালো সুতোর সঙ্গে বাধা। সেই চাবি হাতে পাওয়ার কোনো উপায়ই নেই।
অথচ এই মুহুর্তে বোতল ভূতকে আমাদের খুবই দরকার। না, আমাদের পরীক্ষাব জন্যে নয়। পরীক্ষা যা হবার হবে। হয়তো ফেল করব। সেটাও ভালো। ফেল করলে রবীন্দ্রনাথ হবার একটা সম্ভাবনা থাকে। যারা সব পরীক্ষায় ফার্স্ট সেকেণ্ড হয় তাবা কবিসাহিত্যিক হতে পারে না। নিয়ম নেই।
বোতল ভূতটা আমাদের দরকার পাশ-ফেলের জন্যে নয়, অরু, আপার জন্যে। অরু আপার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে যাচ্ছে।
বড়চাচাই ব্যবস্থা করছেন। তার মতে— মেয়েগুলিকে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে হয়, আর ছেলেগুলোকে দেরিতে। তাহলেই সংসার সুখের হয়। অরু, আপার বিয়ে করার মোটেও ইচ্ছা নেই। সে খুব কান্নাকাটিও করছে। বড়চাচা বলেছেন, কেঁদে লাভ হবে না। আজ হোক কাল হোক বিয়ে তো করতেই হবে। আজ হলেই ক্ষতি কী?
একদিন চার-পাঁচ জন ইয়া মোটা মোটা মহিলা এসে অরু, আপাকে দেখে গেল। তাদের কী সব প্রশ্ন
গান বাজনা জানো?
সেলাই জানো?
রান্না-বান্না কিছু শিখেছ?
কোরান শরীফ পড়তে পার?
বেতেরের নামাজ কয় রাকাত বলে তো?
অরু, আপা দিন-রাত কাঁদে। তার কত ইচ্ছা সে পড়াশোনা শেষ করে জাহাজে করে সারা পৃথিবী ঘুরবে। বেচারির জন্যে আমাদেরও খুব মন খারাপ। অরু আপা চলে গেলে বাড়ি অন্ধকার হয়ে যাবে। আমরা ঝগড়া করব কার সাথে? হাসি তামাশাই-বা করব কার সাথে?
শেষটায় যেদিন পান-চিনি হবে, সেইদিন কোনো উপায় না দেখে স্টীলের আলিমিরায় মুখ লাগিয়ে বললাম, বোতল ভূত ভাই, একটা উপায় করা। কোনো কথা শুনব না। উপায় তোমাকে করতেই হবে। এটা যদি করে দাও, তাহলে আগামী তিন মাস তোমাকে আর বিরক্ত করব না। কথা দিচ্ছি। এক সত্যি, দুই সত্যি, তিন সত্যি।
পান-চিনি উপলক্ষে অরু, আপাকে সাজানো হচ্ছে। সাজাচ্ছেন আমার মেঝ। মামি। আমরা দূরে বসে দেখছি। কাজল পরানোর সময় তিনি হঠাৎ অবাক হয়ে বললেন, তোর চোখগুলি এমন ফোলা ফোলা লাগছে কেন? মনে হচ্ছে ব্যাঙের চোখ।
অরু আপা উত্তর দিল না। আমরা দেখলাম সত্যি তাই। চোখ দুটি যেন ঠেলে বের হয়ে আসছে। সাজানো শেষ হবার পর সবার চোখ কপালে উঠে গেল। কী কুৎসিত যে দেখাচ্ছে। তোকানো যাচ্ছে না। আমার মা বিরক্ত হয়ে মেজ মামিকে বললেন–এটা কী রকম সাজ হলো? মেজ মামি বললেন, কোথায় যেন গণ্ডগোল হয়ে গেছে। অসুবিধা নেই, আবার সাজানো হবে। এবাব আরো বিশ্ৰী হলো। মনে হচ্ছে নীল শাড়ি পরে একটা বুড়ো বাদর বসে আছে। অথচ অরু আপা পরীর মতো সুন্দর।
তৃতীয়বাল সাজানোর সময় ছিল না। পত্রিপক্ষ এসে গেছে। অরু আপাকে তাদের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। তারা ভূত দেখাব মতো চমকে উঠল। একজন মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?
অরু, আপা অবিকল বানরদের মতো কিচকিচ করে বলল, জাহানারা। নিজের গলা শুনে সে নিজেই অবাক।
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। বড়চাচা বাবান্দায় গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। একবার শুধু বললেন, ব্যাপারটা কী হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি।
আমরাও খুব ভালোমতো বুঝতে পারছি। আমাদের আনন্দের সীমা নেই। কারণ বিয়ে ভেঙে গেছে। বরপক্ষের লোকজন চলে গেছে। অরু, আপা হাসছে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে!