বৈকুন্ঠের উইল : সাত
গোকুলের বড়মেয়ে হেমাঙ্গিনী তাহার ঠাকুরমার কাছে শুইত। সে ভোর হইতে-না-হইতে চেঁচাইতে চেঁচাইতে আসিল, কাকা এসেচে মা, কাকা এসেচে।
পাশের ঘরে গোকুল শুইয়াছিল। সে ধড়ফড় করিয়া কম্বলের শয্যার উপর উঠিয়া বসিল। শুনিতে পাইল, তাহার স্ত্রী নিরানন্দ-বিস্ময়ের সহিত প্রশ্ন করিতেছে, কখন এল রে তোর কাকা?
মেয়ে কহিল, অনেক রাত্তিরে মা।
মা জিজ্ঞাসা করিল, এখন কি কচ্চে?
মেয়ে কহিল, এখনও ওঠেন নি। তিনি নিজের ঘরে ঘুমিয়ে আছেন।
তাহার মা আর কোন প্রশ্ন না করিয়া কাজে চলিয়া গেল। গোকুল দরজা হইতে গলা বাড়াইয়া হাত নাড়িয়া মেয়েকে কাছে ডাকিয়া কহিল, তোর ঠাকুরমা তাকে কি বললে রে হিমু?
হিমু ঘাড় নাড়িয়া বলিল, জানিনে ত বাবা।
গোকুল তথাপি প্রশ্ন করিল, খুব বকলে বুঝি রে?
হিমু অনিশ্চিতভাবে বার-দুই মাথা নাড়িয়া অবশেষে কি মনে করিয়া বলিল, হুঁ।
গোকুল ব্যগ্র হইয়া তাহার একটা হাত ধরিয়া একেবারে ঘরের মধ্যে টানিয়া লইয়া গিয়া আস্তে আস্তে কহিল, তোর ঠাকুরমা কি কি সব বললে—বল ত মা হিমু।
হিমু বিপদে পড়িল। কাকা যখন আসেন, তখন সে ঘুমাইতেছিল—কিছুই জানিত না। বলিল, জানিনে ত বাবা!
গোকুল বিশ্বাস করিল না। অপ্রসন্ন হইয়া বলিল, এই যে বললি, জানিস। মা তোকে মানা করে দিয়েচে, না? আমি কাউকে বলব না রে, তুই বল না।
জেরায় পড়িয়া হিমু ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল। গোকুল তাহার মাথায় মুখে হাত বুলাইয়া উৎসাহ দিয়া কহিল, বল ত মা, কি কি কথা হ’ল? মা বুঝি বললে, বেরিয়ে যা তুই বাড়ি থেকে? এই নে দুটো টাকা নে—পুতুল কিনিস। বলিয়া সে বালিশের তলা হইতে টাকা লইয়া মেয়ের হাতে গুঁজিয়া দিল।
হিমু শুষ্ক হইয়া বলিল, হুঁ বললে।
তার পর? তার পর?
হিমু কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, তার পরে ত জানিনে বাবা।
গোকুল পুনরায় তাহার মুখে মাথায় হাত বুলাইয়া দিয়া কহিল, জানিস বৈ কি! তোর কাকা কি বললে?
কিচ্ছু বললে না।
গোকুল বিশ্বাস করিল না। বিরক্ত ও কঠিন হইয়া প্রশ্ন করিল, একেবারে কিছুই বললে না? তা কি হয়?
পিতার ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করিয়া হিমু প্রায় কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, জানিনে ত বাবা।
ফের জানিস নে? হারামজাদা মেয়ে? বলিয়া সে চটাস্ করিয়া মেয়ের গালে চড় কসাইয়া ঠেলিয়া দিয়া বলিল, যা, দূর হ।
মেয়ে কাঁদিতে কাঁদিতে চলিয়া গেল।
গোকুল দ্রুতপদে নীচে নামিয়া তাহার বিমাতার ঘরে ঢুকিয়া বলিল, তা বেশ করেচ! সে বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই নানারকম করে নাগিয়েচ, ভাঙিয়েচ—আমার ওপর যাতে তার মন ভেঙ্গে যায়—এই ত? সে-সব কিছু আমার আর শুনতে বাকী নেই। কিন্তু তোমার ছেলেকেও সাবধান করে দিয়ো—আমার সুমুখে না পড়ে, তা বলে দিয়ে যাচ্চি। বলিয়াই তেমনি দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল। ভবানী কিছুই বুঝিতে না পারিয়া অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন। বাহিরের নানা লোক নানা কাজে ব্যস্ত ছিল। সে খানিকক্ষণ এদিক-সেদিক করিয়া হাবুর মাকে ডাকাইয়া আনিয়া কহিল, ও হাবুর মা, বলি, ভায়া যে বাড়ি এসেচেন, শুনেচিস?
ঝি ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ বাবু, ঘোর রাত্তিরে ছোটবাবু বাড়ি এলেন।
গোকুল কহিল, সে ত জানি রে। তার পরে মায়ে-ব্যাটায় কি কি কথা হলো? আমার নামে বুঝি মা খুব করে লাগালে? বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার-টাবার কথা—
ঝি বাধা দিয়া কহিল, না বড়বাবু, মা ত ওঠেন নি। যদু তার ব্যাগটা নিয়ে এলে আমি ছোটবাবুর ঘর খুলে আলো জ্বেলে দিলুম। তিনি সেই যে ঢুকলেন আর ত বার হননি।
গোকুল অপ্রত্যয় করিয়া কহিল, কেন ঢাকচিস ঝি? আমি যে সব শুনেচি।
গোকুলের কথা শুনিয়া ঝি বিস্ময়ে ক্ষণকাল চাহিয়া রহিল। তার পরে হাবুর দিব্যি করিয়া বলিল, অমন কথাটি ব’লো না বড়বাবু। আমি সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ছোটবাবুর কাজকর্ম করে দিলুম। তিনি মাকে ডাকতে নিষেধ করে বললেন, ঝি, আর আমার কিছু দরকার নেই। তুই শুধু আলোটা জ্বেলে দিয়ে শুগে যা। আহা! চোখ-মুখ বসে গিয়ে এক্কেবারে কালিবণ্ণ হয়ে গেছে।
গোকুলের চোখ দুটি ছলছল করিয়া উঠিল। কহিল, তা আর হবে না? তুই বলিস কি হাবুর মা, বাবা মারা গেলেন, ছোঁড়া একবার চোখের দেখাটা দেখতে পেলে না—একটা পয়সার বিষয়-আশয় পর্যন্ত পেলে না—তার মনে মনে যা হচ্ছে, তা সেই জানে। বাবাকে সে কি ভালই বাসত, তা তোরা সব জানিস? কি বলিস হাবুর মা? বলিতে বলিতেই গোকুলের চোখের কোণে জল আসিয়া পড়িল।
হাবুর মা অনেকদিনের দাসী। চোখের জল দেখিয়া তাহার চোখেও জল আসিল। গাঢ়স্বরে কহিল, তা আর বলতে বড়বাবু! তেনার বাবা-অন্ত প্রাণ ছিল যে! তবে কিনা বড় বড় লেখাপড়া করতে করতে মগজটা কেমনধারা যে গরম হয়ে গেল—তাই—
গোকুল হাবুর মাকে একেবারে পাইয়া বসিল। কহিল, তাই বল না হাবুর মা। মগজটা গরম হবে না? বিদ্যেটা কি সে কম শিখেচে! অনার গ্রাজুয়েট্! বলি, এই হুগলি-চুঁচড়ো-বাবুগঞ্জে ক’টা লোক আমার ভায়ের মত বিদ্যে শিখেচে—কৈ দেখিয়ে দে দেখি? লাটসাহেব নিজে এসে যে তাকে হাত ধরে বসায়—সে কি একটা হেঁজিপেঁজি মানুষ! তুই ত ঝি, কিন্তু কলকাতায় গিয়ে কোন ভদ্রলোককে বল্ গে দেখি যে, তুই বিনোদবাবুদের বাড়ির দাসী! তোকে ডেকে নিয়ে বসিয়ে হাজারটা খবর নেবে, তা জানিস? কিন্তু ঐ যে কথায় বলে গাঁয়ের যুগী ভিক্ষে পায় না! এখানকার কোন ব্যাটা কি তারে চিনতে পারলে? মুখখানি একবারে শুকিয়ে গেছে দেখলি, না রে ?
ঝি ঘাড় নাড়িয়া বলিল, মুখখানি দেখলে চোখে আর জল রাখা যায় না বড়বাবু!
গোকুলের চোখ দিয়া দরদর করিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। উত্তরীয় অঞ্চলে অশ্রু মুছিয়া কহিল, তুই তাকে মানুষ করেচিস হাবুর মা, তুই শুধু তাকে চিনতে পেরেচিস। আহা! চিরটা কাল তার হেসেখেলে আমোদ-আহ্লাদ করে লেখাপড়া নিয়েই কেটেচে। কবে এ-সব হাঙ্গামা তাকে পোয়াতে হয়েচে, বল দেখি? আর উইল করে বিষয় দেব না বললেই দেব না! তার বাপের বিষয় নয়? কোন্ শালা আটকায়? কি করেচে সে? চুরি করেচে? ডাকাতি করেচে? খুন করেচে? কোন্ শালা দেখেচে? তবে কেন বিষয় পাবে না বল দেখি শুনি? আইন-আদালত নেই? বিনোদ নালিশ করলে আমাকে যে বাবা বলে অর্ধেক বিষয় কড়ায়-গণ্ডায় তাকে চুলচিরে ভাগ করে দিতে হবে তা জানিস!
ঝি সায় দিয়া বলিল, তা দিতে হবে বৈ কি বাবু!
গোকুল উৎসাহে চোখ-মুখ উদ্দীপ্ত করিয়া কহিল, তবে তাই বল না! আর এই মা-টি! তুই মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষের মত থাক না কেন? তুই কেন উইল করার মতলব দিতে গেলি? এইটে কি তোর মায়ের মত কাজ হ’লো? ধর্ম নেই? তিনি দেখচেন না? নির্দোষকে কষ্ট দিলে—তাঁর কাছে তোকে জবাব দিতে হবে না? আর বিষয়! ভারী বিষয়—আজ বাদে কাল সে যখন হাইকোর্টের জজ হবে—সে ত আর কেউ তার আটকাতে পারবে না—তখন কি করে রাখবি বিষয়? এ-সব ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে না? এখন স-মানে না দিলে, তখন অপমান হয়ে দিতে হবে যে!
হাবুর মা খুশী হইয়া উঠিল। সে বিনোদকে মানুষ করিয়াছিল—এই সমস্ত উইল-টুইল তাহার একেবারে ভালই লাগে নাই; কহিল, আচ্ছা বড়বাবু, তুমি তাই কেন ছোটবাবুকে ডেকে বল না যে, তোর বিষয়-আশায় ভাই তুই নে! তুমি দিলে ত আর কারুর না বলবার জো নেই।
কিন্তু এইখানেই ছিল গোকুলের আসল খটকা। সে খানিকক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া কহিল, তবে সবাই যে বলে, আমার দেবার সাধ্যি নেই। বাবার উইল ত রদ করতে পারিনে হাবুর মা। আমাদের বড়বৌর মামাত ভাই একজন মস্ত মোক্তার—সে নাকি তার বোনকে চিঠি লিখেচে, তা হলে জেল খাটতে হবে। তবে যদি মা রাজী হয়, বড়বৌ রাজী হয়, তখন বটে।
হাবুর মা ইহার সদুত্তর দিতে না পারিয়া তাহার কাজে চলিয়া গেল।
গোকুল মুখ ফিরাইতেই দেখিল হিমু খেলা করিতে যাইতেছে। তাহাকে আদর করিয়া কাছে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোর কাকা উঠেচে রে?
হিমু ঘাড় কাত করিয়া কহিল, হুঁ, উঠেই তার বসবার ঘরে চলে গেলেন—কারু সঙ্গে কথা কইলেন না।
বাটীর একান্তে পথের ধারের একটা ঘরে বিনোদ বসিত। ঘরখানি ইংরাজি ধরনে সাজানো ছিল—এইখানেই তাহার বন্ধু-বান্ধবেরা দেখাসাক্ষাৎ করিতে আসিত। গোকুল পা টিপিয়া কাছে গিয়া জানালার ভিতর দিয়া চাহিয়া দেখিল, বিনোদ চৌকিতে না বসিয়া নীচে মেঝের উপর ওদিকে মুখ করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। তাহার এই বসিবার ধরন দেখিয়াই গোকুলের দুটি চক্ষু জলে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। সে নীরবে দাঁড়াইয়া ছোট-ভাইয়ের মুখখানি দেখিবার আসায় মিনিট-পাঁচ-ছয় অপেক্ষা করিয়া শেষে চোখ মুছিয়া ফিরিয়া আসিল।
চক্রবর্তী কহিল,বড়বাবু, অধ্যাপক বিদায়ের ফর্দটা—
গোকুল সহসা যেন অন্ধকারে আলোর রেখা দেখিতে পাইল। তাড়াতাড়ি কহিল, এ-সব বিষয়ে আমাকে আর কেন জড়াও চক্কোত্তিমশাই। মা সরস্বতী ত স্বয়ং এসে পড়েছেন। কে কেমন পণ্ডিত, কার কত মান-মর্যাদা বিনোদের কাছে ত চাপা নেই—তাকেই জিজ্ঞাসা করে ঠিক করে নাও না কেন। আমি এর মধ্যে আর হাত দেব না, চক্কোত্তিমশাই।
চক্রবর্তী কহিল, কিন্তু ছোটবাবু ত এখনো ঘুম খেকে উঠেন নি।
গোকুল ম্লানভাবে একটুখানি হাসিয়া কহিল, ঘুম থেকে! তার কি আহার-নিদ্রা আছে? হাবুর মাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে দেখ—সে স্বচক্ষে দেখেচে। বলে, বড়বাবু, ছোটবাবুর মুখের পানে চাইলে আর চোখের জল রাখা যায় না—এমনি চেহারা হয়েছে। ভেবে ভেবে সোনার বর্ণ যেন কালিমাড়া হয়ে গেছে। বলিয়া তাহার বসিবার ঘরটা ইঙ্গিতে দেখাইয়া দিয়া বলিল, গিয়ে দেখ গে—সে ঠাণ্ডা মাটির উপর একলাটি চুপ করে বসে আছে। সে দেখলে কার না বুক ফেটে যায়, বল ত চক্কোত্তিমশাই!
চক্রবর্তী দুঃখসূচক কি-একটা কথা অস্ফুটে কহিয়া ফর্দ লইয়া যাইতেছিল, গোকুল তাহাকে ফিরাইয়া ডাকিয়া কহিলো, আচ্ছা, তুমি ত সমস্তই জানো—তাই জিজ্ঞাসা করি, আমি থাকতে বিনোদকে আর এত কষ্ট দেওয়া কেন? উপোস-তিরেশ কি ওর ওই রোগা দেহতে সহ্য হবে? হয়ত বা অসুখ হয়ে পড়বে। আমি বলি—খাওয়া-শোওয়া ওর যেমন অভ্যাস তেমনি চলুক!
চক্রবর্তী নিরুৎসাহভাবে কহিল, না পারলে—
কথাটা গোকুল শেষ করিতেই দিল না। বলিল, পারবে কি করে, তুমিই বল দেখি? আমাদের এ-সব কুলি-মজুরের দেহ—এতে সব সয়। কিন্তু ওর ত তা নয়। পাঁচ-সাতটা পাশ করে যে দেশের মাথার মণি হয়েচে, তার দেহতে আর আমার দেহতে তুমি তুলনা করে বসলে? কে আছিস রে ওখানে—ভূতো? যা ত একবার চট করে আমাদের ভশ্চায্যিমশাইকে ডেকে আন। না হয় যত টাকা লাগে—শ্রাদ্ধের সময় আমি মূল্য ধরে দেব। তা বলে ত মায়ের পেটের ভাইকে মেরে ফেলতে পারব না। ওকে আমি আলোচালের হবিষ্যি করিয়ে নিকেশ করতে পারব না, এতে তিনি যাই বলুন।
চক্রবর্তী অত্যন্ত অপ্রতিভ হইয়া সায় দিয়া কহিল, সে ত ঠিক কথা বড়বাবু। তবে কিনা লোকে বলবে—
আরে লোকে কি বলবে বলে কি নিজের ভাইটাকে মেরে ফেলব? তোমার এ-সব কি বুদ্ধি হ’লো, বল ত চক্কোত্তিমশাই? না না, ফর্দ-টর্দ নিয়ে তোমার এখন তাকে জ্বালাতন করার দরকার নেই। মুখে যা হোক একটু-কিছু দিয়ে আগে সে সুস্থ হোক, বলিয়া গোকুল নিতান্ত অকারণেই সে বেচারার উপর রাগ করিয়া চলিয়া গেল।