Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বেহুলার ভেলা || Bani Basu

বেহুলার ভেলা || Bani Basu

দীর্ঘ পনেরো বছর পর এক কৃতজ্ঞ মক্কেলের নিবন্ধাতিশয্যে বিখ্যাত পেশাদার রঙ্গমঞ্চে থিয়েটার দেখতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে সংহিতা দত্তগুপ্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। যাত্রা-থিয়েটার গানের আসর ইত্যাদি সাংস্কৃতিক চিত্তবিনোদনের অবসর বা সুযোগ কোনোটাই আমার আজকাল আর হয়ে ওঠে না। প্রত্যেকটি অনুপল বিপল ব্রিফ দিয়ে ঠাসা। কারণ শুধু অন্নচিন্তা নয়, অর্থলালসাকেও। পুরোপুরি দায়ী করা যায় না। আসলে, সব দায়িত্বশীল বৃত্তিরই আমিষাশী উদ্ভিদের মতো কতকগুলো আঠালো আকর্ষ থাকে যাদের সাহায্যে বৃত্তিজীবীকে ধীরে ধীরে তারা নিজস্ব পরিপাকযন্ত্রের কেন্দ্রে টেনে নেয়। উদ্ধারের আশা কম। কোর্ট অর্থাৎ মলে অর্থাৎ কেস অর্থাৎ সাফল্য অর্থাৎ আরও মক্কেল-কর্মের চক্রবৎ আবর্তন। এই ছাঁচে চলতে থাকে। কাজেই নেহাত ভালো ছবি-টবি এলে একে-ওকে-তাকে ধরে টিকিটের ব্যবস্থা যদি বা করে উঠতে পারি, থিয়েটার দেখা বহুকাল ছেড়ে দিয়েছি। তাই ক্লায়েন্ট ভদ্রলোক যখন অযাচিতভাবে সমস্ত ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করে একেবারে রথ এবং সারথি নিয়ে উপস্থিত হলেন, না করিনি। থিয়েটার তো এককালে আমারও মগজে ঘুরঘুরে পোকার মতো ঘুরে বেড়িয়েছে।

ইদানীং যে সমস্ত পেশাদার নাটক চারদিকে হচ্ছে তাদের মধ্যে এটাই নাকি শ্রেষ্ঠ। কলকাতা রঙ্গমঞ্চের সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। নবযৌবন হলে রেকর্ড করা বা রেকর্ড ভাঙা উৎকর্ষের মাপকাঠি নয় জাতীয় ক্লিশে নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করতাম। কিন্তু এখন বহুজননন্দিত বস্তু মাত্রই বৈজ্ঞানিক কৌতূহল জাগায়। কী সেই সংজ্ঞাতীত রহস্যময় উপাদান যা জনগণেশ নামক অস্থিরমতি পাঁচমিশালি ব্যাপারটিকে দীর্ঘমেয়াদি সম্মোহনে রাখবার ক্ষমতা ধরে!

বিদেশি গাড়ির বিলাস-আসনে সাদরে বসিয়ে কিং সাইজ বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে মি. মান্না অর্থাৎ আমার মক্কেলটি বললেন, এ আপনার সো কলড এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারের আঁতলামো নয়, খাঁটি বনেদি জিনিস। শিশির ভাদুড়ি, ছবি বিশ্বেস ঘরানার। সহস্র রজনি তো কবেই পার হয়েছে। আরও কত রজনি রান করবে তার ঠিক নেই। দুর্দান্ত অভিনয় শুনছি।

থিয়েটার হলের সামনে পৌঁছে জনপ্রিয়তার লক্ষণ দৃষ্ট হল। প্রাগৈতিহাসিক মেরুদণ্ডী প্রাণীর কশেরুকা-শ্রেণির মতো গাড়ির সারি। হাউসফুল-বোর্ড টাঙানো হয়ে গেছে। অ্যাডভান্স বুকিং কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন। টিকিট ব্ল্যাক হচ্ছে। দেয়ালের গায়ে অতিকায় প্রাচীরচিত্র। তবে দামি নামের প্রধান কুশীলবদের নয়, এক ক্যাবারে নর্তকীর। খুব কসরতের ছবি। মুখের ডিটেল বাদ দিয়ে শুধু অবয়বহীন, লোভনীয় লাস্য-ভঙ্গি। মিস শর্বরী। তৎক্ষণাৎ সহস্র রজনি, শিশির ভাদুড়ি ঘরানা, দুর্দান্ত অভিনয় এই সমস্ত সম্প্রসারিত ভাবের সারমর্ম নির্ভুল উপলব্ধ হল। মনে মনে খুব এক চোট হেসে নিয়ে সামনের সারিতে মি. মান্নার মেদলগ্ন হয়ে বসা গেল। আসলে আইনের আড়াই চালে ভদ্রলোককে অনিবার্য ব্যাবসায়িক ভরাডুবি থেকে বাঁচানো গেছে, ভবিষ্যতের একটা পাকাঁপাকি বন্দোবস্তের ভরসাও করছেন, তাই কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ ভদ্রলোক রৌপ্য রেকাবিতে সোনালি তবক মোড়া যৌন উত্তেজনার নির্দোষ সুড়সুড়ি যখন-তখন উপহার দিতে চাইছেন। বিচক্ষণ লোক। কোন ক্ষেত্রে কোথায় থামতে হয় জানেন। শুধু ফি-তে কি আর এসব কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ হয়?

কাহিনিটাই একটা হোটেল নিয়ে। ক্যাবারে-পর্ব প্রায় সমস্ত নাটক জুড়ে। তবে এ নটী নায়িকা, উপনায়িকা এমনকি ভ্যাম্পও নয়, এর কাজ শুধু কারুকাজ। আবহসংগীতের মতো আবহনৃত্য। পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে মৌলিক এবং সাহসী। সর্বোপরি, মেয়েটির ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিক্স অবাক করবার মতো। একেবারে মন্দিরগাত্র থেকে কেটে তুলে আনা। ওই সাইজের ক্ষীণ কটিদেশ যে কি কায়দায় দু-প্রান্তের চমকপ্রদ পৃথুলত্ব ব্যালান্স করে রেখেছে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। এ রমণীর স্রষ্টাকে নির্ঘাৎ ফিজিক্সের অঙ্ক কষতে হয়েছে। মি. মান্নাও ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন, সংক্ষেপে বললেন, ফাটাফাটি। আড়চোখে দেখলুম, নীচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়েছে, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। তবে অভিনয় সম্পর্কে উনি খুব একটা অতিশয়োক্তি করেননি। কাহিনিবিন্যাস, সংলাপ, অভিনয়, আলোকসম্পাত এবং আধুনিক মঞ্চের টেকনিক্যাল স্টান্ট সহযোগে সামগ্রিক যোগফল প্রশংসনীয়। পাকা হাতের কাজ। মঞ্চে যান্ত্রিক কলাকৌশল প্রয়োগকে যাঁরা অনাটকীয় মনে করেন এবং অভিনয়শিল্পকে পূর্ণ সুযোগ দেবার জন্য মঞ্চকে শেকসপিয়রীয় যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান, যখন অরণ্য লেখা নোটিশ ঝুলিয়েই দৃশ্য-পরিকল্পনার দায় চুকিয়ে দেওয়া হত আমি তাঁদের সঙ্গে একমত হতে পারি না। ইনটেলেকচুয়ালরা যা-ই-ই বলুন আমার ভালো লাগল।

শেষ অঙ্কের আগে যবনিকাঁপাত হয়েছে। মি. মান্না আমার হাতে ঠান্ডা পানীয়ের বোতল দ্বিতীয় দফা ধরিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে অদৃশ্য হয়েছেন এমন সময় জনৈক মঞ্চকর্মী আমার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে গেল। সাজঘরের মধ্যে থেকে কেউ আমাকে সমাপ্তির পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যেতে বলছেন। সনির্বন্ধ অনুরোধ। যদি একলা এসে না থাকি সঙ্গী-টি অথবা-দের বিদায় করে যেন অবশ্যই এই কর্মীর সঙ্গে ভেতরে যাই।

নাটক শেষ হলে মি. মান্নাকে ব্যাপারটা খুলে বললাম। উনি বললেন, হুম। নাটকের মধ্যে নাটক। ডাকছে যখন, যাবেন বইকি! তা কিছু গেস করতে পারলেন না কি লেডিস না জেন্টস? আমি হেসে বললাম, না।

কৌতূহল হচ্ছে কিন্তু স্যার যাই বলুন, গাড়ি রেখে যাচ্ছি, নইলে ফেরবার সময় আপনি বিপদে পড়বেন। শোফারকে বলে যাচ্ছি, যখন যেখানে যেতে চান পৌছে দেবে। বাঁ চোখটা সামান্য টিপলেন মান্না, আমি একটা ট্যাকসি ধরে চলে যাচ্ছি। প্রচুর আপত্তিতেও ফল হল না। মি. মান্না আমাকে বাধিত করবেনই।

আইনজীবীর বৃত্তিতে মন্দ দিন কাটল না। এখন কৌতূহল উদগ্রতার স্ফুটনাঙ্ক স্পর্শ করে না। মানসিক ভারসাম্য বজায় রেখে চলবার শিক্ষা আরও কয়েকটি স্বাধীন বৃত্তির মতো এ-বৃত্তিরও অন্যতম শর্ত। খেলার মধ্যে যে-কোনো রকম আবেগকে প্রশ্রয় দিলে ভরাডুবির শঙ্কা জেনে স্থির মস্তিষ্কে খেলা শুরু এবং শেষ করতে হয়। কিন্তু যবনিকার অন্তরালে সাজঘর কমপ্লেক্সের একটি একান্ত উইং-এ যখন পৃথিবীতে এত ব্যক্তি থাকতে সংহিতা দত্তগুপ্তর সঙ্গে সাক্ষাৎকার হল তখন বিস্মিত হলাম বললে কমিয়ে বলা হবে। হতভম্ব হয়ে গেলাম।

সযত্নে মেক-আপ তুলে ফেলেছে। ক্রিমমাখা তেলতেলে মুখ। খোলা চুল। গেরুয়া রঙের শাড়ি আর লাল ব্লাউজ। সংহিতা আমার দেখে উঠে এল। কপালে সিঁদুরের তিলক আর হাতে একটা ত্রিশূল ধরিয়ে দিলে উপন্যাসে পড়া সুন্দরী ভৈরবীর বাস্তব সংস্করণ মনে হতে পারত। বিশাল বিশাল চোখ মেলে সত্যিকারের অবাক দৃষ্টিতে দারুভূত আমার দিকে তাকিয়ে সংহিতা বলল, সার, আপনি এখানে?

সামান্য রাগ হল। এটা শুড়িখানা না বেশ্যালয়? যে আমাকে এখানে দেখে এমন বড়ো বড়ো চোখ করবে সংহিতা! পরক্ষণেই অবশ্য বুঝলাম এখানে উপস্থিত থাকাটা গর্হিত এমন ইঙ্গিত করে আমাকে লজ্জা দিতে বেচারা চাইছে না। বহুদিন পর দেখা হলে পরিচিতজনকে তো আমরা প্রথম প্রশ্ন এই-ই করে থাকি। তুমি এখানে? কাজেই ইংরেজি হাউ ডু য়ু ডু-র মতো ওর প্রশ্নটা ওকে ফিরিয়ে দিয়েই আমি জবাব দিই। উত্তরের অপেক্ষা করছিলাম না। প্রশ্নটা নেহাত করার জন্যই করা। কারণ এতক্ষণে আমি বুঝেই গেছি নাটকের আবহরচনাকারী সেই কারুকুশলিনী ক্যাবারে নর্তকীটি সংহিতাই। বুঝেছি এবং বুঝে মর্মাহত হয়েছি।

সংহিতা বলল, কফি বলি? মান্নাসাহেবকে বাধিত করতে দু-বার চা দু-বার ঠান্ডা পানীয় হয়েছে, আবার কফি? সামাজিকতা দেখছি আজ আমার স্বাস্থ্য শিকার করেই ছাড়বে না। কিন্তু সামনে কোনো গরম পানীয় না থাকলে আলাপ জমা তো দূরের কথা, আরম্ভই যে হতে চায় না! অগত্যা বললাম, বলো।

আপনার কী খবর সার?

ভালো।

বউদি আছেন?

হ্যাঁ।

ছেলে-মেয়ে?

হ্যাঁ।

ক-জন?

একা।

প্রোফেশন চেঞ্জ করলেন যে?

এমনি।

ভালো লাগছে?

হ্যাঁ।

আমায় কিছু জিজ্ঞেস করবেন না?

অবশেষে সংহিতা হতাশ গলায় বলল, আমায় কি ঘেন্না করছেন সার?

না।

ঘেন্না করবার মতো কিছু কি আমি করেছি?

সংহিতা কারণ ছাড়াই উত্তপ্ত। বলে ওঠে, সকলেই তো কিছু না কিছু বিক্রি করে। আপনারা বিদ্যা বিক্রি করেন না? বুদ্ধি বিক্রি করেন না? ঈশ্বর যদি আমাকে শো-বিজনেসের মূলধন ছাড়া আর কিছু না দিয়ে থাকেন তাই দিয়েই তো সম্মানের অন্ন আমার জোগাড় করতে হবে?

সংহিতা তার পেশার সপক্ষে দীর্ঘ বক্তৃতা ভাঙা ভাঙা বাক্যে দিতে থাকল যেমন করে একদিন ও যুক্তিজালে ওথেলোর মহত্ত্ব ধূলিসাৎ করত, দ্বিতীয় এডোয়ার্ড-এ রানি ইসাবেলার সমস্ত দুষ্কৃতি পরিস্থিতির বিচারে ক্ষমার যোগ্য বলে ঘোষণা করত। অবিকল সেই ভঙ্গিতে। কিন্তু আমি তখন বহুদূর মনস্ক। স্মৃতি ট্রেকিং করছে আরোহ, অবরোহ, হিমবাহ সংকুল অতীতবত্মে, সেই সময়ে যখন আদর্শের জন্য মানবিক ক্ষুধা, সৃজনের রাসায়নিক তাগিদ, দিবারাত্রের জাগর স্বপ্ন প্রায়শই ঘনীভূত হয় নারীবিগ্রহে। যখন অন্বিষ্ট ছিল সংহিতা।

হ্যাঁ, সংহিতা আমার ছাত্রীই ছিল। উজ্জ্বল ছাত্রী। উজ্জ্বল বুদ্ধিতে। উজ্জ্বল ব্যবহারে। আর আকৃতি? এখন যে কোনারকের দেবনর্তকী, খাজুরাহোর যক্ষিণী তখন সে তার নবীন বয়সে অধ্যাপকের নবীন চোখে কী ছিল? অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করছি, ক্লাসে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গে সংহিতা সম্মোহন চৌম্বক-স্পর্শে আমায় গ্রাস করত, আমার সকল গান তখন শুধু তাকেই লক্ষ করে, আবিষ্টের মতো শেষ করতাম বক্তৃতা, স্বপ্নচালিতের মতো স্টাফরুমে ফিরতাম। হাইড্রোজেন পরমাণুর একমেব ইলেকট্রনের মতো সংহিতা নিউক্লিয়াসের চারদিকে অমোঘ আকর্ষণে পরিক্রমা করত মন। আমায় জীবনের সবচেয়ে গোপন, সবচেয়ে সোচ্চার সেই সংহিতা-যুগ। গোপন, কারণ স্পর্শভীরু, মর্যাদাসচেতন অধ্যাপক ঘুণাক্ষরেও এ কথা কারও কাছে হাবে-ভাবে, বাক্যে-ব্যবহারে প্রকাশ করেনি, সোচ্চার কারণ নিজের কাছে ওই আকর্ষণের চেয়ে স্পষ্ট এবং জোরালো তার আর কিছু ছিল না। এইসব অনুভূতির কথা স্বীকার করতে ত্রাস হয় যখন বুঝি হিসেবি জজিয়তির পুরোনো অধ্যায়ের ব্যক্তিগত ছেড়া পাতা কত অর্থহীন দেখায়, কিন্তু যতই ওরা এসব দিয়ে মুদির দোকানের মুড়ির ঠোঙা বানাক, এই ছেড়া পাতাই যে আমাদের সাধারণ জীবনের অসাধারণ ছিন্নপত্র!

যাক, গোপন করার শত চেষ্টাও কিন্তু মহিলাদের প্রতিভার কাছে বিফল হয়ে যেতে বাধ্য। বিফল হয়ে যায় এটাই সুখ। সংহিতা বুঝতে পারত বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু কারও কাছে প্রকাশ না করে আমার বাঁচিয়েছিল, নইলে ক্লাসে নির্ঘাত প্রতিক্রিয়া দেখতাম। সংহিতার সঙ্গে আমার এই অপ্রকাশিত গোপন চুক্তি ছিল বড়ো আরামের। এ যেন একটা সুখের বল দিয়ে গৃহকোণে দ্বিপাক্ষিক খেলা। দুজনে দুজনের দিকে নিঃশব্দে বল গড়িয়ে দিই। বল তেমনি নিঃশব্দে ফিরে আসে। এটুকুকেই আমি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য ভূমিকা মনে করতাম এবং করে নিশ্চিন্ত থাকতাম। কারণ অধ্যাপক-ছাত্রীর সম্পর্কটাকে চট করে রোমিও-জুলিয়েট পর্যায়ে নিয়ে যেতে আমার মানসিক বাধা ছিল। অধ্যাপক মহলে, ছাত্র মহলে বেশ একটা দীর্ঘস্থায়ী, মুখরোচক কেচ্ছায় পরিণত হবার কোনো সাধ আমার ছিল না।

কানে আসত মেয়েটির গোপন নাম না কি ভ্যাট-সিক্সটি নাইন। সার্থকনাম্লী বটে। কিন্তু সে মত্ততা সংহিতা অমন অবলীলায় সঞ্চারিত করত তার দায়িত্ব তার স্বভাবে আদৌ ছিল না। বড্ড সৎ, আন্তরিক প্রকৃতির মেয়ে বলে মনে হত। সপ্রতিভ, প্রাণোচ্ছল, সচেতন কিন্তু প্রগলভ নয়। রূপের জন্য জীবনের কাছ থেকে বিশেষ কোনো অধিকার দাবি করত বলেও মনে হত না। ফস্টিনস্টির পাত্রীই নয়। ফস্টিনস্টিকারী কোনো এক এক যুবককে পায়ের চটি খুলে মারার অপরাধে একবার ছাত্র ইউনিয়নের দাবিতে তাকে এক মাস সাসপেন্ড করা হয়। এক মাস পরে কলেজে যোগ দিয়ে সংহিতা প্রথমে প্রিন্সিপ্যালকে তারপর ক্লাসরুমের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সহপাঠীদের জানায় যে শাস্তি সে গ্রহণ করেছে এবং আবার যদি কেউ তার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করতে আসে সে ওই একই দাওয়াই-এর পুনরাবৃত্তি করবে।

সততা, সাহস ও চারিত্রিক গভীরতা এই তিনটি গুণের জন্যই আমি সংহিতার প্রতি আমার দুর্বলতাকে আরও বাড়তে প্রশ্রয় দিয়েছিলাম। নইলে মোহকে বিচারবুদ্ধি দিয়ে শাসন করবার বয়স এবং মনোবৃত্তিতে তখন পৌঁছে গেছি। বিশ্বাস করতাম সংহিতার মধ্যে সেই উপাদান আছে যাতে ও নিজের জোরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। নারী পরগাছা হিসেবে নয়। তার জন্য অবশ্যই প্রস্তুতি চাই। সেই প্রস্তুতি কীভাবে গড়ব, স্বমহিমায় পুরোপুরি ফুটে ওঠবার জন্যে ওর যা প্রয়োজন সে উপকরণ আমি কোথা থেকে কীভাবে সংগ্রহ করে আনব, ব্যক্তিগত গবেষণার চেয়েও জরুরি ছিল তখন এইসব অন্বেষণ।

বি. এ ফাইনাল আসন্ন। ভাবলাম পরীক্ষার সময় বিরক্ত করা ঠিক হবে না। পরীক্ষাটা হয়ে গেলে ও আর আমার ছাত্রী থাকছে না। তখনই প্রস্তাবটা পেশ করব। তারপর শুভস্য শীঘ্রম। কিন্তু কানাঘুষোয় শুনলাম সংহিতা না কি এবার পরীক্ষায় বসছেই না। ওর বাড়ির ঠিকানাটা সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। পরীক্ষা না দেবার খবর শুনে আত্মগ্লানির সঙ্গে মনে হল এর আংশিক দায়িত্ব কি আমারও? একটা চিঠি দিলাম। কোনও একটা দিন বিকেল তিনটে নাগাদ পার্কস্ট্রিটের চিনে রেস্তোরাঁয় বৈকালিক নিমন্ত্রণ। তিনটের সময় ওই রেস্তোয়াঁ একেবারে ফাঁকা। থাকে। আলাপ এবং দরকার হলে প্রলাপেরও অসুবিধে নেই। নিশ্চিত হবার জন্য যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে আমার প্রিয় অল-হোয়াইট-লুক অর্থাৎ সাদা শার্ট, সাদা ট্রাউজার্স, সাদা স্লিপ-ওভারে সেজে রেস্তোরাঁয় টেবল বুক করে বসে রইলাম। কাঁটায় কাঁটায় তিনটেয় সংহিতা এল। অঙ্গে চোখ ধাঁধানো ক্যার্ডিগ্যান, নরম রঙের সিল্কের শাড়ি, কানে জ্বলজ্বলে লাল পাথর এবং পেছনে ইউনিভার্সিটির তৎকালীন ছাত্র নেতা-অমিতেশ বারিক।

সংহিতাকে আমি ক্ষমা করতে পারিনি। দুঃখ, আশাভঙ্গ, অপমান এমনকি প্রতারণাও বোধহয় কালক্রমে ক্ষমা করা যায় কিন্তু উপহাস কদাচ নয়। উপহাসাস্পদ হবার লজ্জা ভোলার জিনিস নয়। তাই আজ পনেরো বছর পরেও ওর কাছে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য নেই। ওর সব প্রশ্নের জবাবে আমার সব উত্তর একাক্ষরী।

কুঙ্কুটিজাল সরে গেল। দেখলাম ওর চোখের কুয়াশা আর্দ্রতায় রূপান্তরিত হচ্ছে। সংহিতা কি আমায় আরও কিছু জিজ্ঞেস করেছিল? উত্তর পায়নি? নরম গলায় বললাম, কেমন আছো বলো সংহিতা। চিবুকের টোলের ওপর শিশির জমল। ধরা গলায় সংহিতা চোখ নীচু করে বলল, আপনি আমার কথা, অমিতেশের কথা কিছু জানেন না, না সার?

চমকিত হলাম! সংহিতার কথা আমি সত্যিই জানতাম না। কিন্তু সংহিতাদের খবর তো মোটামুটি এক ধরনেরই হয়! বাল্যপ্রেম, কৈশোরপ্রেম, ধাপে ধাপে। তারপর প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে…। ইলোপমেন্টের পরিকল্পনা। প্ল্যান কেঁচে যাওয়া। অভিভাবক নির্বাচিত তিন হাজারি মনসবদারের দামি গলায় নিরাপদ বরমাল্য অর্পণ অতঃপর, সম্ভবত কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করতে করতে। এবং সুরক্ষা, সংহিতার যা ক্যাপিটাল তাতে করে তিন হাজারি কেন দশ হাজারিও অবলীলায় জুটে যেত। ও কি তবে এখনও অমিতেশের সঙ্গে যুক্ত আছে? অমিতেশের খবর সামান্য কিছু রাখতাম। সে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবের পথ বেছে নিয়েছে। পুলিশ তাকে খুঁজছে, সে আনডারগ্রাউন্ডে—এমনি ছাড়া ছাড়া খবর কানে এসেছে। এর বেশি সংবাদ তো এসব ক্ষেত্রে মেলেও না। তবে অমিতেশ ছিল বেআইনি দেশি কারখানায় তৈরি হ্যান্ডগ্রেনেডের মতো অগ্নিবর্ষী। সে বোমা কাছাকাছির মধ্যে ফাটলে সপ্লিনটারের আগুনে কুচি ছুটতে দেখতাম—এ বিশ্বাস আমার ছিল। যেটুকু জানি গোপন করে বললাম, আমি তো ভিন্ন পথের পথিক। কিছু জানি না। বলো সংহিতা, তোমাদের খবর বলো।

সংহিতা প্রায় এক ঘন্টা ধরে যা বলে গেল তার সারমর্ম হল অমিতেশ বারিকের মতো চাষির ছেলেকে বিয়ে করায় সংকল্প করায় স্বগৃহ থেকে সে বহুদিন বিতাড়িত। অমিতেশের পিতৃকুল পৃথিবীর থেকে মুছে গেছে। প্রতিভাবান ছেলেকে দশজনের একজন দেখবার মানসে সর্বস্ব পণ করেছিলেন কৃষক পিতা। সংসারে আর কেউ ছিল না। সর্ব অর্থে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে তিনি মারা গেছে। বহুদিন আত্মগোপন করে থাকবার পর অমিতেশ অবশেষে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সে খবর, তার ক্রিয়াকলাপ, অজ্ঞাতবাস কিছুর সঙ্গেই সংহিতার কোনও যোগাযোগ ছিল না। তবুও পুলিশ তাকে ছাড়েনি, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সে ধরে পড়ে, অত্যাচারে তার গর্ভপাত হয়, পরে তার কাছ থেকে কিছু জানা যাবে না নিশ্চিত বুঝে দয়া করে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। দু-তিন বছর হল অমিতেশ ছাড়া পেয়েছে। অমানুষিক অত্যাচারে পঙ্গু। তাকে বাঁচাতে সংহিতা শেষ পর্যন্ত এই বৃত্তির দ্বারস্থ হয়েছে।

গল্পটা নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় তৃতীয় দশকের রোম্যান্টিক উপন্যাসের কথাসার। অগ্নিযুগের পর, বহুবাঞ্ছিত স্বাধীনতা লাভের পর যে জাতের উপন্যাস বাতিলের খাতায় নাম লিখিয়েছে। কিন্তু গল্প যখন নিছক সত্য হয় এবং তার পাত্রপাত্রী যখন একেবারে রক্তমাংসের চেনা মানুষ হয় তখন তার আঘাত কী দুঃসহ! অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকবার পর আমি সংহিতাকে কথা দিলাম অমিতেশকে দেখতে আমি তাদের ডেরায় অবশ্যই যাব। সেই মর্মে স্থান এবং কালও ঠিক করা গেল।

যখন শিক্ষক ছিলাম ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করার অভ্যাস ছিল। ছাত্রপ্রিয়তার সস্তা লোভ হয়তো ভেতরে ভেতরে কাজ করে থাকবে, জানি না। তবে ওদের সঙ্গে ব্যবধানটা সহকর্মীদের সঙ্গে ব্যবধানের চেয়ে কম দুস্তর মনে হত। সদ্য পাস করে বেরিয়েছি। নীচেকার বেঞ্চ থেকে প্ল্যাটফর্মের চেয়ারে প্রমোশনটা যেন নেহাত আপতিক। চোখে তখনও নতুন কিছু করার স্বপ্ন, জিভে নতুন ভাষা, টাটকা ধ্যান-ধারণার সংস্পর্শে আসবার রোমাঞ্চ তখনও আমায় ছেড়ে যায়নি। ছাত্ররা আমায় দেখে সিগারেট লুকোত না, বারণ করে দিয়েছিলাম। ক্লাসে, করিডরে, কফিহাউসে যখনতখন যে-কোনও বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে তুমুল তর্ক জুড়ত, তার অনেকগুলোতে আমি গো-হারান হেরে যেতাম এবং কোণঠাসা হয়ে সগর্বে হার স্বীকার করতাম। যে বিষয়ের ওপর বিতর্কে আমায় পরাজয় অবধারিত ছিল তা হল পলিটিকস।

সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেওয়া আমার মতে ছিল যৌবশক্তির মারাত্মক অপচয়। অপ্রস্তুত, অর্ধপ্রস্তুত, মন-বুদ্ধি-হৃদয়বৃত্তির উপকরণ নিয়ে রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে অসম টক্করে লড়তে যাওয়া এবং তার ফলশ্রুতি আত্মহত্যার শামিল বলে মনে করতাম। গবেষকের মেজাজ নিয়ে তথ্য তোমরা জোগাড় করো, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে, সাধ্যমতো সমাজকল্যাণের কাজে হাত পাকাও, প্রত্যেকটি মানুষই তো সেই একক যাদের পর পর গেঁথে তৈরি হয় সমাজের পাকা গাঁথনি! প্রত্যেকটি হঁটের গুণগত উৎকর্ষের ওপর কি ইমারতের সামগ্রিক উৎকর্ষ নির্ভর করে না? একাধিক খেলোয়াড়ের মধ্যে ক্ষমতা দখলের ছদ্মবেশী লড়াই চলছে। তার ভেতরের ছবি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হয়ে স্রেফ অ্যাডভেঞ্চারের মোহে রাজনীতির নোংরা দাবার ছকে বড়ের চালে পর্যবসিত হওয়া টিন-এজার ভ্রষ্টতরী ছাড়া কি! মহাকুজ্বটিকায় যার ভেঁড়া পাল ভাঙা হাল, একূল-ওকূল যার চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে!

আমার সমস্ত বাগবিস্তারের অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া ছিল—

জানি রজতদা, বিপ্লবকে, রক্তপাতকে আপনি ভয় করেন।

করি।

অথচ আপনার প্রিয় নেতা স্বাধীনতার জন্য রক্তের মূল্য চেয়েছিলেন!

স্বাধীনতা? সে তো তোরা পেয়ে গেছিস? পাসনি?

ফুঃ। এ জারজ স্বাধীনতা কে চেয়েছিল?

ইতিহাসকে তো উলটে দিতে পারিস না! যা পেয়েছিস তাকেই প্রাণপণে গড়ে তোলবার চেষ্টা করতে দোষ কি?

আমরা স্পার্টান আদর্শে বিশ্বাসী। আঠাশে শিশু প্রতিপালন করবার চেয়ে বরং ইতিহাসের ছক উলটে দেয়। দেওয়া যায়। আপনিও জানেন, আমরাও জানি।

ক্রমিক অসহযোগ কিংবা হঠকারী কু দিয়ে শাসনযন্ত্রের উৎসাদনের যে প্রচেষ্টা তাকে সার্থক করতে হলে প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, পৌরুষ এবং সর্বোপরি শুভবুদ্ধি থাকা দরকার। তার পুঁজি, তোদের কুষ্ঠগ্রস্ত নেতৃত্বে নেই, বিশ্বাস কর। এখনকার সব লড়াই শেষ পর্যন্ত গদির লড়াই। দল ভেঙে উপদলও আবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়, আদর্শের চুলচেরা পার্থক্যের খাতিরে নয়, স্বার্থের চুলচেরা হিসেবের জন্যে। যদি ভেবে থাকিস তোরা সেতুবন্ধের কাঠবেড়ালি, ভুল করবি, তোদের ভবিতব্য সেই হতভাগ্য মূষিকগুলোর মতো বাঁশিওলার মারণসুরের তালে তালে যারা নদীতে গিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল।

ওদের তর্ক আবার উত্তাল হয়ে উঠত। সার বিশ্ব খুঁড়ে খুঁড়ে নিয়ে আসত উদাহরণ। বিপ্লব এবং বিপ্লব। এবং আশ্চর্য একই উদাহরণ থেকে আমরা কীরকম ভিন্ন এবং পরস্পরবিরোধী শিক্ষা গ্রহণ করে থাকি! অবশেষে ওরা ফিরে আসত স্বদেশের অগ্নিযুগে। ক্ষুদিরাম, কানাইলাল। অবোধ-কৈশোরের আনাড়ি হাতে মারণাস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে ফাঁসিমঞ্চে পাঠাবার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নিয়ে গর্ব করার এই জাতীয় প্রবণতা স্মরণ করলে এক দুর্জয় আর্তক্রোধে আমার অন্তরাত্মা জ্বলে যেত। স্বরাজপূর্ব বালকবলির ট্র্যাডিশন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে যে-সব মাস-হিপনটিস্ট আজও চালিয়ে যেতে চায় আমি তাদের সর্বান্তঃকরণে অভিশাপ দিই। কিন্তু ওদের সামনে এতটা উম্মা প্রকাশ করা কি সমীচীন?

বিপ্লব না হলে আপনাদের পচা সমাজের কাঠামো পালটাবে না।

ভবিষ্যৎ সমাজের ছকটা তোদের কাছে তা হলে পরিষ্কার!

ইয়েস, ব্লু-প্রিন্ট তৈরি।

তাই বুঝি? আমার ধারণা ছিল থিয়োরি একটা খসড়া করে দেয় মাত্র। তারপর দেশ-কাল-পাত্র অনুসারে তার অদলবদল না হওয়াটা অস্বাস্থ্যকর। জীবন যখন চলিষ্ণু, তত্ত্বকে তখন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, নইলে আবার তৈরি হবে অচলায়তন যাকে ভাঙতে আবার তোদর শাবল, গাঁইতি, গ্রেনেড, ডিনামাইটের দরকার হবে।

উপহাস করছেন রজতদা?

উঁহু। তোরা আমাদের বংশধর। তোদের হাতে সাধের বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যাব বলেই আমাদের দাঁড়িয়ে থাকা। তোদের ক্যানন ফডার হতে দেখে ভেতরটা জ্বলে যায়। যা মহাকাশযান হতে পারত তা আতশবাজিতেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। তোরা হলি ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সেই হতভাগা রেজিমেন্ট যারা ভুল কম্যান্ডে চোরাবালির অতলে গিয়েছিল।

তারা বীর ছিল রজতদা। আপনাদের মতো কাপুরুষ নয়। নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই আপনাদের এই সমস্ত পুথিগত যুক্তির ভণ্ডামো!

নিঃশ্বাস ফেলে ব্রেখটের গ্যালিলিয়োর সেই উক্তি স্মরণ করতাম-হতভাগ্য সেই দেশ যে দেশে শুধু বীরপুরুষেরই প্রয়োজন হয়। সোল্লাস স্লোগান ভেসে আসত, চলছে, চলবে, লড়াকু ছাত্র লড়ছে, লড়বে। মনে মনে বললাম, লড়ছে, লড়বে, মরছে মরবে, আস্তিনের পেছনে যারা হাসবার তারাও হাসছে হাসবে। কত বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, রাষ্ট্রনায়ক, সমাজতাত্ত্বিক, চিকিৎসক, কত প্রতিভাধর এমনি করে বোকা বনে অপঘাত লুঠছে তার হিসেব তো তোরা চাস না! এইজন্য, এরই জন্য কি সৃষ্টির সূর্য জ্বলেছিল!

উনিশশো বাহাত্তর। তিন বিখ্যাত ছাত্র নির্মলেন্দু লাল, প্রদীপ জানা আর মনোজিৎ বাগচি বেপাত্তা হল। নির্মল, যার পেপার মাত্র সতেরো বছর বয়সে বিখ্যাত জার্মান জার্নালে প্রকাশিত হয়ে বিশ্ববন্দিত হয়েছিল সে আমার চোখের সামনে বৃদ্ধ প্রিন্সিপালকে রিঅ্যাকশনারি বাস্টার্ড বলে ঠাশ করে এক চড় কশাল। পাইপগান তাক করে মনোজিৎ বলল, রেজিগনেশন লেটারটা পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে সই করে না দিলে গরম সিসেগুলো নাকি সোজা ওঁর বস্তাপচা ব্রেনের মধ্যে সেঁদিয়ে যাবে। তখনকার মতো সমবেত প্রচেষ্টায় তাদের নিরস্ত করা গেল। কিন্তু পরে কলেজ ক্যাম্পাসে যখন তিনি খুন হলেন সকলেই অনুমান করল এ ওই ত্রয়ীর কাজ। আমি অনুমান করতে চাইনি। মনোজিৎ আমার সবচেয়ে গর্বের ছাত্র ছিল। মহাশক্তিধর কলম ছিল তার। অধ্যাপক মহলে প্রদীপের নাম ছিল হিউম্যান কম্পিউটার। শ্রদ্ধেয় প্রবীণ শিক্ষাগুরুদের শেষ প্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গে নিহত হল বিজ্ঞানী শিল্পী গণিতবিদের প্রতিভাধর নব প্রজন্ম। বিপ্লবের হাতে।

সেই আমি চাকরি ছাড়লাম। আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি তখন থেকেই। সিভিল প্র্যাকটিস করি। আদালত আমার বিবেককে মোটামুটি একটা সহনীয় আশ্রয় দিয়েছে। সুখী নই। সন্ত এবং মূঢ় ছাড়া এ পৃথিবীতে সুখী কে? কিন্তু ন্যূনতম শাস্তির জন্য জীবনের সঙ্গে একটা রফায় পৌঁছোনো দরকার। হাজার হাজার বছরে পুঞ্জিত সভ্যতার সম্পদকে লাথি মেরে ওরা নখদন্তে বর্বর আরণ্যক আইনের কাছে ফিরে যাবে, নপুংসকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব-এ মর্মাহ থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম।

গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম গ্র্যান্ডের তলায়। সংহিতা এল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। ও একটু একটু ভিজেছে। চুলে বৃষ্টির কুচি। চোখের বড়ো বড়ো পাপড়িতেও দু-একটা পোখরাজের দানার মতো আটকে আছে। আঁচলে মুখটা মুছে নিল সংহিতা। থিয়েটারের চড়া মেক-আপ ব্যবহারে ওর মুখের চামড়ার খয়েরি খয়েরি মেছেতার মতো দাগ। আগের বার বিজলিবাতির তলায় বুঝতে পারিনি। শ্রমসাধ্য জীবিকার কালি চোখে মুখে। সব রূপসি নারীই তা হলে ইন্দ্রাণীর সিংহাসনে সখীপরিবৃতা হয়ে বিরাজ করে না! ভুবনজুড়ে অলক্ষ্য ফাঁদ বিসর্পিত, মহাকবির ভাষায় কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে। যে যেখানে যাবে বলে বেরিয়েছিল, যাওয়া হয় না। ভুল স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে ট্রেন চলে যায়। মুখ যেমন মনের আয়না নয়, সকাল যেমন নয় পরিণত দিনের অভিজ্ঞান তেমনি কার কর্মফল কাকে কোন চক্রনেমিতে বেঁধে মহাকালের পথ পরিক্রমা করবে কারও জানা নেই।

ঠিকানা পূর্ব কলকাতার। সংহিতার নির্দেশে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে যাচ্ছি। চোখ উইন্ডস্ক্রিনে। রক্ষণশীল মেজাজের লোক। পরকীয়াতত্ত্বকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারি না। একদম অপ্রাসঙ্গিক ভাবে সংহিতা বলে উঠল—আমি কিন্তু অন্য চাকরি খুঁজেছিলাম, সার।

বুঝলাম গতদিনের সাক্ষাৎকার এখনও ওর বুকে হুল ফুটিয়ে রেখেছে। বড়ো কষ্ট হল, বললাম—কি হল, পেলে না?

আমার তো সেই থেকে বি, এটা কমপ্লিটই হল না! ও যখন নিরুদ্দেশ চেষ্টচরিত্র করে স্টেনোগ্রাফি শিখে নিয়েছিলাম। ও চাকরি করেছিলাম কিছুদিন। কিন্তু অত সামান্য টাকায় এখনকার খরচ আর চালাতে পারি না।

কত টাকার দরকার তোমার, সংহিতা!

অনেক অনেক সার। সে আপনি না-ই শুনলেন। ডাক্তারদের ফি-এর কথা তো আপনি জানেনই। সবাইকে নিয়মিত বাড়িতে ডাকতে হয়। প্যাথলজিক্যাল টেস্ট রেগুলার। শুশ্রুষা এবং আনুষঙ্গিক আরও। শরীরে ওর কিছু নেই। সাইকিয়াট্রির কী প্রচন্ড খরচা আপনি কল্পনা করতে পারবেন না সার, প্রতি সপ্তাহে অ্যানালিসিস, এক একটা সিটিং পঞ্চাশ। পুরো দেড় বছর এই জিনিসও চালাতে হয়েছে।

তোমার পেশাটা বিপজ্জনক, সংহিতা—সন্তর্পণে উচ্চারণ করি।

যতটা ভাবছেন ততটা নয় সার, স্টেনোগ্রাফারের চাকরিটা এর চেয়ে হাজারগুণ বিপজ্জনক ছিল। সেখানে বিপদ কোনদিক থেকে কীভাবে আসবে বোঝা যেত না। এখানে বুঝি। আওয়ার্স কম। টাকা বেশি। অমিতেশকে সময় দিতে পারি।

এদিকে যখন এলেই ফিলমে-টিলমে গেলেও তো পারতে। তোমার টাকার ব্যাপারটা ফর গুড সলভড হয়ে যেত!

অত সোজা ভাববেন না সার, তেমন যোগাযোগও আমার ভাগ্যে ঘটে ওঠেনি। তা ছাড়া আপনি বোধহয় সিনেমা দেখেন না, আমার চেহারায় একজন নামকরা স্টারের ভীষণ সাদৃশ্য আছে। ওই জন্যেই ও লাইনে আমার কোনোদিন কিছু হওয়া শক্ত। তৃতীয় সারিতে থেকে যাওয়ারই কপাল!

নাচই যখন বেছে নিলে, সত্যিকার নৃত্যশিল্পীও তো হতে পারতে!

আপনি এখনও আগের মতোই ছেলেমানুষ আছেন সার, সংহিতা বলল, আমি কি কোনোদিন নাচের জন্যে তৈরি হয়েছি, নাকি? তা ছাড়া উপযুক্ত গুরু, শিক্ষার সুযোগ, প্রতিভা কিছুই কি আমার ছিল? পড়ে গেলাম তো ঘূর্ণিঝড়ে! আমার ফিগারে ক্ল্যাসিক্যাল ডান্স হওয়াও শক্ত। আপনার মনে নেই উওম্যান অফ রোম-এ আদ্রিয়ানাকে ব্যালে-স্কুল থেকে কেন ফিরিয়ে দিয়েছিল?

বলেই সংহিতা অপ্রস্তুত হয়ে ঠোঁট কামড়াল। ওর মনে হয়ে থাকবে তুলনাটা বেফাঁশ হয়ে গেল। বাকি সময়টা ও কাঠ হয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাটিয়ে দিল, আর একবারও মুখ ফেরাবার সাহস সঞ্চয় করতে পারল না।

আশ্চর্য হয়ে দেখলাম অমিতেশকে সংহিতা খুব সুখে রেখেছে। আমি বেলেঘাটার বস্তি-টস্তি আশঙ্কা করেছিলাম। মোটেই না। দু-কামরার ছোটো ফ্ল্যাট। দোতলায়। নতুন চুনকাম। আসবাব কম কিন্তু অতি পরিচ্ছন্ন। প্রচুর আলো হাওয়া, বাতাসে চন্দন ধূপের গন্ধ। কিন্তু অমিতেশকে চেনা যে-কোনও লোকের পক্ষে শক্ত ছিল। কূঢ়োরস্ক বৃষস্কন্ধ সেই বীরভূম ঘরানার কৃষক সন্তান, যার পিতৃপুরুষ শুধু কাঁধের জোরে জোড়া বলদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত শ্বেতির তাপ্পি। স্বাভাবিক গ্রামবাংলার নির্ভেজাল কৃষ্ণবর্ণের সঙ্গে শ্বেতির এই বৈপরীত্য এক কথায় বীভৎস। লোহার ফ্রেমের মধ্যে শরীরটা আটকানো। পাঁজরা বাঁকা। অনেক রকম রোগ, অনেক রকম চিকিৎসা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত সব সেরে যাতে এসে দাঁড়িয়েছে তার নাম স্পাইন্যাল টিউবারকুলোসিস। সংহিতা আশ্বস্ত করল রোগটা ছোঁয়াচে নয়। হাতের আঙুলগুলো ব্যবহার করতে পারে না। প্রত্যেকটি আঙুলের গাঁটে পুলিশ কি কায়দা করেছে যার জন্য আঙুলগুলো অকেজো হয়ে গেছে। ফিজিওথেরাপি চলছে। দূর ভবিষ্যতে নিজের হাতে খাওয়া-দাওয়া করার ক্ষমতা ফিরে পেলেও পেতে পারে। অন্তত সংহিতার তাই আশা।

অমিতেশ ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। যাতে আর কোনোদিন ছুরি-ছোরা-রিভলভার ধরতে না পারি তার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, রজতদা। জানে না আঙুলের গ্রন্থি আসল রিভলভারটা ধরে না।

সতেজ কণ্ঠ। সজীব চোখ। সজীব মস্তিষ্ক। বিধাতার কী আশ্বর্য সৃষ্টি এই বীর পুরুষরা

ধবধবে বিছানার প্রান্তে একটা অয়েল ক্লথ ভাঁজ করে পেতে দিল সংহিতা। বড়ো ট্রেতে খাবার নিয়ে এল। মুরগির স্টু, কাঁচা স্যালাড, সুগন্ধ ভাত, ছানার সন্দেশ। চামচ করে খাইয়ে দিল। তারপর সযত্নে ধুইয়ে মুছিয়ে অয়েল ক্লথ ট্রে তুলে নিয়ে গেল। আমাকে বলল, রোগীর ঘরে আপনাকে দোব না সার, আপনি বাইরে আসুন।

আমার তো খাওয়ার কথা ছিল না! লাঞ্চ সেরে বেরিয়েছি সংহিতা। সে কী! আমরা খাব, আর আপনি খাবেন না, তাই কি হয়? খেতেই হবে। বললাম, শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের যুগ চলে গেছে। জোর করে খাওয়ালে আজকালকার বাঙালি পুরুষ কিন্তু মোটেই খুশি হয় না। আমার খাওয়া-দাওয়ার সময়, পরিমাণ সব বাঁধা। যাবার সময় চা খেয়ে যাব, তুমি ব্যস্ত হয়ো না সংহিতা।

মুখটা ওর ম্লান হয়ে গেল। কিন্তু আর জোর করল না।

আমি অমিতেশের সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম। অন্তরালে সংহিতা তার গৃহস্থালির লক্ষ কাজ সারতে লাগল। সম্ভবত রান্নাবান্না, ঝাড়পোছ, ধোয়াপাকলা, বাজারহাট, সর্বোপরি শয্যাগত পঙ্গু রোগীর সেবা, যে জলটা পর্যন্ত নিজে খেতে পারে না—এসবের জন্য ওর কোনো সাহায্যকারী নেই।

অনেকদিন পর কথা বলার লোক পেয়ে অমিতেশ খুব খুশি। সমাজ পরিত্যক্ত, নির্বান্ধব, রাহুগ্রস্ত এই যুগলের কাছে কে-ই বা আসে! কিন্তু কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরই বুঝলাম পনেরো বছরেও অমিতেশ একটুও বাড়েনি। অতীত-বর্তমান ভবিষ্যৎ এই ত্রিকালের ত্রিমাত্রায় গড়া মানুষ সে নয়। সে একমাত্রিক। শুধু ভবিষ্যতের আয়তনে বিশ্বাসী। তার অনতি-অতীত জীবনের কথা আমি জানি না, অনুমান করতে পারি। কিন্তু অমিতেশ সে-ধার দিয়েই গেল না। সে যেন আরব্য উপন্যাসের সেই ধীবর। অতীতের দৈত্যটাকে কলশির মধ্যে পুরে কোনো মহাসমুদ্রের জলে ফেলে দিয়ে হাত ধুয়ে এসেছে। বলল, খুব ভালো আছি রজতদা, নেভার ফেল্ট বেটার। এই খাঁচাটা দেখছেন? বছরখানেক পর মনে হয় এটার আর দরকার হবে না। উঠে দাঁড়াতে পারব। আঙুলগুলোর কথা ভাবি না। শরীরটা আর বিপ্লবের কাজে লাগবে না। কিন্তু অমূল্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। সংগঠন তৈরির কাজে শিগগিরই হাত দেব। ফুল প্রুফ। বুলেট প্রুফ।

আমার হয়তো অনধিকার চর্চা। তবু কীসের তাগিদে বলে ফেললাম জানি না, বিপ্লবের প্রতি কর্তব্য ছাড়া আর কিছুর প্রতি কোনো কর্তব্যের কথা তোমার কখনও মনে হয় না অমিতেশ?।

আপনি কি সংহিতার কথা বলছেন?—অমিতেশ একদেশদর্শী হতে পারে, বোকা নয়।

খানিকটা।

একটা মহৎ স্বপ্ন সত্য করতে গেলে ওরকম অনেক মেয়ের আত্মত্যাগের দরকার হয় রজতদা। যারা কোম্পানি এগজিকিউটিভের বউ হয়ে শেষ দুপুরের কফি পার্টিতে সোশ্যাল ওয়ার্ক করতে যায় সেরকম শৌখিন মজদুরির ধাত সংহিতার নয়।

এ কথা আমি খুব জানি! তুলা রাশি, ধনু লগ্ন। জ্যোতিষে বিশ্বাস করি আর না ই করি, শুনেছি মানিয়ে নেবার অমানুষিক ক্ষমতা থাকে এসব জাতক-জাতিকার। বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠা তুলনাহীন। সংহিতার ভবিতব্যই তাকে হাত ধরে বিপ্লবের এই নাভিকেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে গেছে। কিন্তু এ-ও নিশ্চিত জানি সে ভবিতব্যের অন্য নাম ভালোবাসা, সেই পুরাণ কথিত বস্তু, যার জোরে মানুষ অসাধ্যসাধন করতে পারে। সংহিতার মুখে আমি সন্ত্রাসী বিপ্লব সম্পর্কে কোনো বিশ্বাসের কথা কোনোদিন শুনিনি। বিপ্লবের প্রয়োজনে সে সামান্য দৌত্যের কাজও কখনও করেছে বলে জানি না। দরজার দিকে সভয়ে তাকালাম। ধারে কাছে নেই তো? না থাকলেই ভালো। অমিতেশের ভাষায় তার দেওয়া-নেওয়ার হিসেব-নিকেশ সংহিতার পছন্দ হবে কি?

অমিতেশ আলাপে আগ্রহী। তার পরিকল্পনার রূপরেখা আমার মতো অবিশ্বাসী কাফেরকে সে বলবে কেন? কিন্তু স্বপ্নসৌধের সম্ভাব্যতার কথা আলোচনা করতে তো দোষ নেই। জ্বলজ্বলে চোখে, গমগমে গলায়। কিন্তু আমি এই আলোচনায় এই বিতর্কে একদিন এত বেশি যোগ দিয়েছি এবং শুধু প্রাণশক্তির প্রবল জোয়ারি চাপে বুদ্ধির সমস্ত শক্তিকে পরাভূত হতে দেখেছি যে এই নিষ্ফল বাদানুবাদের মধ্যে প্রবেশ করতে আমার এখন বড়ো ক্লান্তি! আমি শুধু মানবিক, বৌদ্ধিক আলাপচারিতে রাজি অমিতেশ।

বহুক্ষণ একতরফা উত্তেজিত বক্তৃতার পর তাই শ্লিষ্ট হাসি হেসে ও বলল, আসলে কী জানেন রজতদা, ব্রিটিশের তৈরি সাহিত্যগুলো আর ওই অপসংস্কৃতিতে ভরতি স্যানসক্রিট লিটারেচার-টারগুলো আপনারা বড্ড বেশি পড়েছেন। আপনাদের ধাতটা হয়ে গেছে কনসটিট্যুশন্যাল। ছকের বাইরে কিছুর কথা আপনারা কল্পনা করতে পারেন না। নীচ প্রবৃত্তিগুলোর সাবলিমেশনকে শিল্পের নামে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আপনারা বোধহয় স্বপ্নও দেখেন বানান করে করে। ফ্রয়েড সাহেবের ফর্মুলা অ্যাপ্লাই করলে অ্যাভারেজ বাঙালির চিত্তবৃত্তি থেকে সাপ্রেশড় লিবিডো ছাড়া কিছুই বেরোবে না। আসলে আপনি চিরকাল সেই আদি অকৃত্রিম শোধনকারী বুর্জোয়াই রয়ে গেলেন।

সংহিতা বাইরের পোশাকে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে গভীর ক্লান্তির কাজল। ওর মঞ্চে যাবার সময় হল। আমিও এবার উঠি, সৈনিকের তিরস্কার শিরোধার্য করে। বলার কিছু আছে কি? দৃষ্টিহীন সংকল্পে বেঁকে আছে বিদ্রোহীর কঠিন করতল। ওদিকে ঘাটে ঘাটে সাধ্বীত্বের কঠিনতর পরীক্ষা দিতে দিতে নাগিনীদষ্ট পূতিগন্ধময় শবদেহ নিয়ে ভেলা চলেছে। লম্পট সভায় ছিন্ন খঞ্জনার মতো নেচে নেচে বেহুলা নাচনি একদিন না একদিন আদায় করে আনবেই মুক্তিপণ। বিপ্লব জানতে চাইবে না কীসের মূল্যে মুক্তি খরিদ হল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress