Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বেশি দূরে নয় – ০৫

পরশু ইঁদুর মারার ওষুধ আটার গুলিতে মাখিয়ে দোকানের মধ্যে ছড়িয়ে রেখেছিল সরস্বতী। আজ মাঝেমধ্যে পচা গন্ধ পাচ্ছে। চারটে ঘেঁষাঘেষি কাচের আলমারি, শো-কেস, বসবার টুল। মেঝেতে অ্যাসিড, ফিনাইল, ব্লিচিং পাউডারের শিশি আর প্যাকেটের সংকীর্ণ পরিসরে মরা ইঁদুর খুঁজে বের করা সহজ কাজ নয়। ফুরসুতই বা কোথায়? এই তো, পরপর চার জন খদ্দের আর একঝাঁক বাচ্চা মেয়ে এসে কত কী নিয়ে গেল। বিক্রি হওয়া জিনিসের নাম আর দাম খাতায় টুকতে টুকতে সরস্বতী বলল, অ্যাই, একটা কাজ পারবি?
— কী কাজ?
— করিস যদি বিস্কুট খাওয়াব।
— বলো না, কী করতে হবে?
— মরা ইঁদুর খুঁজে বের করতে হবে। তুই তো রোগা পটকা আছিস। ঠিক পারবি। দেখ না ভাই। ওই আলমারির তলায় টলায় কোথায় আছে। অন্ধকারে কি দেখতে পাবি? দাঁড়া, একটা মোম জ্বেলে দিই।
— আমি খুব ভাল দেখতে পাই। মোম লাগবে না।
সীতু দিব্যি হামাগুড়ি দিয়ে খুঁজতে লাগল আনাচ কানাচ। একটু ভয় হল সরস্বতীর। শেফালি যদি জানতে পারে যে তার হাবা ভাইটাকে মরা ইঁদুর খুঁজতে লাগিয়েছে, তা হলে কি দু’কথা শোনাতে ছাড়বে? ছেলেটা তো হাবা, ভাল-মন্দ বোঝে না। কিন্তু, হাবা লোক না থাকলে দুনিয়াটা কি চলে? ওই জন্যেই তো ভগবান দু’চারটে হাবা লোককে দুনিয়ায় পাঠান।
দু’হাতে দুটো মরা ইঁদুরের লেজ ধরে বের করে এনে তার মুখের সামনে দুলিয়ে একগাল হেসে সীতু বলল, এই দুটোই ছিল, আর নেই।
নাকে আঁচল চাপা দিয়ে সরস্বতী আর্তনাদ করে উঠল, উঁঃ! ফেলে দিয়ে আয় না।
সীতুর ঘিনপিত নেই। নির্বিকার মুখে ইঁদুরদুটোকে নাচাতে নাচাতে দোকানের পিছনে গিয়ে ফেলে দিয়ে এসে বলল, কাক এসে নিয়ে গেল।
সরস্বতী বলে, ওই কোণে বোতলে জল আছে, হাত ধুয়ে নে তো। তোর বাপু একটুও ঘেন্নাপিত্তি নেই।
— ইঁদুরের বিষ দিয়েছিলে তো? কাকদুটোও মরবে তা হলে।
— মরুক গে। কাঠের বাক্সে সোডা আছে। একটু হাতে নিয়ে ঘষে ঘষে হাত ধুয়ে আয়।
সীতু বেশ বাধ্যের ছেলে। যা বলা হল, তাই করল। আসলে, বুদ্ধি নেই বলেই যে যা বলে তা শোনে।
দুটো ফুকিন বিস্কুট বয়ম থেকে বের করে দিল সরস্বতী। দোকান থেকে কাউকে বিনা পয়সায় কিছু দেওয়া বারণ। তাই নিজের ছোট্ট বটুয়া থেকে বিস্কুটের দাম নিয়ে ক্যাশবাক্সে রেখে দিল।
— খা।
কুড়মুড় শব্দে বিস্কুট দাঁতে ভেঙে সীতু বলল, দিদি তো খাওয়াবে বলেছিল। কোথায় যে গেল!
মনোরঞ্জন মাইতি চানাচুরের প্যাকেট, পরিমল আদক ডিমসুতো, অনাদি দাস থিন অ্যারারুট আর দুটো মেয়ে শ্যাম্পু আর সাবান কিনে নিয়ে গেল।
একটু ফাঁক পেয়ে সরস্বতী বলল, কী বলছিলি যেন?
কাউন্টারের বাইরে এক কোণে দাঁড়িয়ে হাঁ করে রাস্তা দেখছিল সীতু। দিদিকেই খুঁজছিল বোধহয়। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে সরস্বতীর দিকে চেয়ে বলল, তোমার ডান কাঁধে একটা টিকটিকি পড়বে।
— অ্যাঁ! টিকটিকি পড়বে কেন রে?
— পড়বে। দেখ।
— দুর পাগল! এ ঘরে একটাও টিকটিকি নেই। আমি টিকটিকি ভীষণ ঘেন্না পাই, বাবা।
— দিদিও পায়। ডান কাঁধে টিকটিকি পড়লে অনেক টাকা হয়।
— দুর বোকা। আমার কাঁধে টিকটিকি পড়বে, তুই কী করে জানলি?
— পড়বে।
— আমার ভয় করে না বুঝি? ভয় দেখাচ্ছিস, না ইয়ারকি মারছিস?
— টিকটিকি কামড়ায় না।
— হ্যাঁ, তুই বড় জানিস কিনা!
ভিড়ের ভিতর থেকে একটা শ্যামলা মেয়ে দোকানের আলোয় এসে দাঁড়াল। বলল, এই হাঁদারাম, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? কতক্ষণ ধরে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি তোকে।
— ফুটুদার খোঁজে এসেছিলাম।
— ফুটুদা! ফুটুদা কে?
সরস্বতী বয়মের আড়াল থেকে মুখ তুলে বলল, আমার দাদা। তোমার ভাই আমার সঙ্গে এতক্ষণ গল্প করছিল।
শেফালি তার বন্ধু নয়। এক ক্লাস নীচে পড়ে। তবে, চেনা।
শেফালি একটু জড়সড় হয়ে বলল, ও, এই দোকান তো প্রীতম…
— হ্যাঁ, দাদা সময় পায় না বলে আজকাল আমি বসছি।
শেফালি যেন একটু কেমনধারা হয়ে গেল। বলল, ও, তুমি প্রীতমদার বোন! আমি জানতাম না।
এসো না, আমাদের দোকান দেখে যাও।
— এসেছি তো। সীতু তোমাকে বোর করছিল বুঝি?
— না। তবে, ভয় দেখাচ্ছিল।
— ওমা! তাই নাকি?
ঠিক এই সময় ঝপ করে সরস্বতীর ডান কাঁধে নরম মতো কী যেন পড়ল। আর, পড়েই কিলবিল করতে লাগল।
— ও মাগো, এটা কী! কী এটা…
বলেই টুল থেকে লাফিয়ে উঠে কাঁধে একটা ঝটকা মারতেই তার ডান কাঁধ থেকে একটা টিকটিকি কাউন্টারের কাচের ওপর ছিটকে পড়ল।
অবিশ্বাস্য! অবাক চোখে চেয়েছিল সরস্বতী।
— কী হল, কী পড়ল গায়ে? বলে তাড়াতাড়ি দোকানের পাদানিতে উঠে এল শেফালি।
সীতু বলল, টিকটিকি।
সরস্বতী কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। তার পর হাঁফ-ধরা গলায় বলল, তোমার ভাইটা…
— ভাইটা কী করেছে?
— বড় অদ্ভুত ছেলে তো! একটু আগেই বলেছিল, আমার ডান কাঁধে নাকি টিকটিকি পড়বে। কী করে বলল, বলো তো?
শেফালি হেসে বলে, ও তো কেবল আবোল তাবোল বকে।
সরস্বতী বড় বড় চোখে এক বার সীতুর দিকে তাকিয়ে ফের শেফালির দিকে ফিরে বলল, তা হলে টিকটিকির কথাটা কী করে বলল, বলো তো! আমার এ দোকানে আমি একটাও টিকটিকি কখনও দেখিনি। আজই প্রথম…
টিকটিকিটা ঝিম ধরে কিছুক্ষণ পড়ে থেকে তার পর ধীরে ধীরে শো-কেস পার হয়ে দেয়ালে উঠে গেল। দুজনেই দেখল দৃশ্যটা। সীতু নয়। সে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। বিস্কুট খাচ্ছে আর হাসছে।
— ও অত হাসে কেন?
— ওটাই তো ওর রোগ। বকুনি খায় কত, তবু ওর হাসি সারে না। এই বোকাটা, চপ খাবি বলেছিলি না?
— খাওয়াবি?
— চল।
সরস্বতী এই দুই ভাইবোনের কথার মধ্যে পড়ে বলল, দাঁড়াও। আমার আজ খুব ইচ্ছে করছে তোমাদের দুজনকে চপ খাওয়াতে।
শেফালি বলল, না, না। তুমি কেন খাওয়াবে?
— খাওয়ালেই বা! এই সীতু, মাঝেমাঝে আমার কাছে আসবি তো। তুই যা সাংঘাতিক ছেলে, আমাকে আজ ভারী চমকে দিয়েছিস। এসো না শেফালি, দোকানের ভিতরে এসে বসো। বসার জায়গা আছে। আমি চপের কথা বলে দিয়ে আসছি। ষষ্ঠীপদ দোকানের গরম চপ পাঠিয়ে দেবে।
দোকানের ভিতরে বসবার জায়গা আছে বললে ভুল হবে। একটা ওল্টানো কাঠের বাক্স আছে। বোধহয় সেটাতে উঠে দাঁড়িয়ে সরস্বতী ডিং মেরে উঁচু তাকের জিনিস পাড়ে। ভাইবোন তাইতেই ঘেঁষাঘেষি করে বসল। সরস্বতী চপের কথা বলেই ফিরে এসে বলল, এখুনি আসছে।
চপ খেতে খেতে কত গল্পই যে হল! সরস্বতীর মুখে শুধু তার দাদার কথা। দাদার মতো মানুষ যে হয় না, সেটা শতমুখে বলছিল। কথাগুলো হাঁ করে গিলছিল শেফালি। হ্যাঁ, শেফালি জানে, পৃথিবীর সেরা পুরুষ ও, প্রীতম। ও রকম আর এক জনও চোখে পড়ল না তার। শেফালি এই দোকানঘরে বসে প্রীতমের গায়ের স্বেদগন্ধ পাচ্ছে। এই দোকানের আনাচে কানাচে তার স্পর্শ। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। চপের ডেলা গিলতে পারছে না। একখানা পেটুক ভাইটাকে দিয়ে দিল।
ফেরার সময় শেফালি বলল, অ্যাই, তুই টিকটিকি পড়ার কথা কী বলেছিলি?
— জানতাম, তাই বলেছিলাম।
— তুই তো কেবল আবোল তাবোল বলিস।
— না। আমি টের পেয়েছিলাম। মনে হল, তাই বলেছিলাম।
— তুই তো বলেছিলি, ফুটুদার সঙ্গে নাকি… হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ
— ঠিকই বলেছি।
— কী ঠিক বলেছিস?
— তোর তো ফুটুদার সঙ্গেই বিয়ে হবে।
— যাঃ, পাজি কোথাকার!
— দেখিস।
হঠাৎ সর্বাঙ্গে শিরশির করল তার। কাঁটা দিল গায়ে। সত্যিই কি সীতু কিছু টের পায়? ওর কথা সত্যিই ফলে? হে ভগবান…

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *