Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বেনোজল || Samaresh Majumdar

বেনোজল || Samaresh Majumdar

স্টেশনটা পেরিয়ে শানবাঁধানো রিকশার চত্বরটায় পা দিতেই চমক লেগেছিল। কেমন একটা রুপোর স্রোত বইছে চারপাশে। একটা নিস্তরঙ্গ অথচ মৃদু নেশার ঘোর লাগা জগতে যেন হঠাৎই পা দিয়ে ফেললাম আমরা। এটা এমন একটা সময় যখন পৃথিবীর শেষতম বেরসিক লোককেও মাথা তুলে তাকাতে হয়। ভুলে যেতে হয় নিজেকে। আর একটা আচ্ছন্নতা ঘিরে ধরে তখন হুঁসিয়ার মনটাকে। ঘাড় নামিয়ে সোমা হাসল, এই, চাঁদনিকে দ্যাখো।

আর এখন আমরা যখন রাস্তায় নেমেছি হোটেল ছেড়ে, তখন বাতাসে ঈষৎ গা-কনকনে ভাব, অন্ধকার ডালপালা মেলেছে গাছের মাথায় আর বুকে হাজার-হাজার তারার মেডেল আঁটা অধিকারীর মতো বুড়ো আকাশটা দোহার গাইছে রসের নাগরসাজা চাঁদের তালে-তালে। সমস্ত আকাশটা জুড়ে যেন আজ যাত্রাগানের আসর জমজমাট। বাইরে বেরিয়ে সোমার ফুরতির বাঁধটা দু-টুকরো হল। গলগলিয়ে উঠল ও, এই চলো, সমুদ্র দেখে আসি আগে। আমি কখনও সমুদ্র দেখিনি গো।

বেশ তো চলোনা।

এই রাস্তা দিয়ে গেলে হবে? তুমি তো আসনি আগে! সোমা ধ্রুকুটি করল।

বাঃ হোটেলের ম্যানেজার বলল শুনলে না, নাক-বরাবর চলে যান। গেলেই সমুদ্র। ভাবলাম বলি, নাক-বরাবর গেলে একটা জিনিসই পাব, অবশ্যি তাকেও সমুদ্র বলা যেতে পারে নাকি!

অসভ্য! নাক ফোলাল সোমা। কি বুঝল কে জানে। তবে নাক ফোলালে ওকে বেশ ভালো লাগে। পুতুল-পুতুল দেখায়। এই, আমার না ভীষণ ভালো লাগছে, জানোনা?

কি আমাকে? না এই রাতটাকে। বললাম আমি।

নিজেকে। আমার হাতটা টেনে নিল সোমা। দু-পাশের প্রাচীর ছোটবড় মন্দিরগুলোর গা বাঁচিয়ে আমরা হাঁটছিলাম। শঙ্খ বাজছে মন্দিরে-মন্দিরে, আরতির প্রসন্ন পরিবেশের স্পর্শ পাচ্ছিলাম আমরা। সোমার মুখচোখে কোথাও ট্রেন-জার্নির ক্লান্তি নেই। এই, কাল সকালে এইসব মন্দিরগুলো দেখব, হ্যাঁ। আজ শুধু সমুদ্র।

রাস্তাটা ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর যখন আরতির ঘণ্টা শোনা যাচ্ছিল না, খোলকরতাল বাজিয়ে নামসংকীর্তনের সুর যখন আর কেউ মুঠো-মুঠো করে ছুঁড়ে দিচ্ছিল না বাতাসে, তখন সোমা গুনগুনিয়ে গান ধরল, যাবে না যাবে না ঘরে। পূর্ণচাঁদের আলোয় সামনের পথটা কোন। স্বপ্নলোক থেকে নেমে এসে যখন আমাদের বুকের ভেতর মিশে যেতে চাইছে তখন, ঠিক তখন সেই প্রাণ-কাঁপানো ডাকটা শুনতে পেলাম। আমার হাতটা শক্ত মুঠোয় ধরে সেই ডাকের আকস্মিকতায় থরথর করে কেঁপে উঠল সোমা, কি গো!

ডাকটা আসছিল সামনের দিক থেকে যেখানে পথটা ঘোড়ার নালের মতো বাঁক নিয়েছে। আমরা কয়েক পা এগোতেই ডাকটা বিভিন্ন কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়ল। বাঁকের মুখে এসে দাঁড়াতেই সোমা অস্ফুট গলায় কি যেন বলে আমার শরীরের সঙ্গে লেপটে দাঁড়াল। চাঁদের আলোয় চকচক করছে। দু-পাশের আধভাঙা প্রাচীর ঘেরা পথটা। আর সেই পথের দু-ধারে সার দিয়ে বসে শুয়ে গোঙাচ্ছে কয়েকজন নারী পুরুষ। জ্যোৎস্না পড়েছে তাদের সর্বাঙ্গে। আলোর সঙ্গে যেন মাখামাখি হয়ে গেছে তাদের ক্ষত বাঁধা ময়লা কাপড়, খসে যাওয়া চোখমুখ। হঠাৎ মনে হল, এই ভয়ঙ্কর। জ্যোৎস্না যেন ওরা সহ্য করতে পারছে না। ওদের শরীর যেন জ্যোৎস্নায় জ্বলছে আর সেই। জ্বলুনিতেই তাদের এই যন্ত্রণার চিৎকার। তারা সমস্বরে গোঙাচ্ছে। সেই গোঙানির স্বরে তারা করুণাময়ের নামে পথচারীর কাছে করুণার প্রত্যাশা করছে। আমাদের চোখের সামনে কোনও অদৃশ্য চিত্রকরের আঁকা ছবির মতো এই ছায়াছায়া শরীরগুলোর দিকে কেউ-কেউ পয়সা ছুঁড়ে দিচ্ছে আর মুহূর্তে ভীষণ চিৎকার কী ভীষণ হিংস্রতায় মারামারি করে পয়সা কুড়াচ্ছে তারা। এই দারুণ জ্যোৎস্নার রাত্রে, যখন বাতাসে ঈষৎ শীতলতা মাখানো তখন সমুদ্রে যাওয়ার এই পথটার দু-ধারে সার দিয়ে শুয়ে বসে থাকা কুষ্ঠরোগগ্রস্ত মানুষগুলোকে কোনও প্রেতলোকের বাসিন্দা বলে মনে হতে লাগল আমার। এই ভয়ঙ্কর গা-ছমছমে পরিবেশে চোখের ভেতর দিয়ে একটা সিরসিরে ঘৃণা মনের ভেতরে এসে কিলবিল করতে লাগল।

ওগো, ফিরে চলো, আমার ভীষণ ভয় করছে। সোমার শরীর হিম।

আমি জোরে পা চালাতে চাইলাম। সোমার হাত ধরে দু-পাশে কুষ্ঠরোগীদের রেখে হাঁটতে-হাঁটতে বললাম, ধৎ সব তো ভিখিরি, ভয় কী।

সোমা আকাশের দিকে মুখ তুলে হাঁটছিল, কুষ্ঠ?

হ্যাঁ! শুনে সোমার হাতটা থরথর করে কেঁপে উঠল যেন।

বস্তুত এই সময় আমি প্রচণ্ড ঘৃণা-ভয়ের মধ্যে যেটুকু সাহস অবশিষ্ট ছিল তা মুঠোয় আগলে রাখতে চাইছিলাম। সোমা হাঁটবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, বুঝতে পারছি আমার হাত ধরে একটা ঘোরের মধ্যে ও এগোচ্ছে। আমাদের দেখে দু-পাশের ছায়াগুলো নড়ে-নড়ে উঠল, ওদের আর্তনাদের স্বরে মনে হল আমরা যেন কোনও বিষাক্ত ক্ষুধার্ত সাপের গা বাঁচিয়ে হাঁটছি। আমি বুঝতে পারছিলাম ওরা কিছু প্রত্যাশা করছে এবং আমাদের উদাসীন হয়ে হাঁটতে দেখে ওরা। ক্রমশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ওদের অশ্লীল হাসি আর গালাগাল শুনতে শুনতে আমরা এগোচ্ছিলাম। এই সময় আমরা কেউ কোনও কথা বলছিলাম না। আমার রোমকূপে একটা ক্লেদের শিহরণ। পাক খাচ্ছিল।

শেষপর্যন্ত আমরা বালির ওপর পা রাখলাম। আমাকে দাঁড়াতে দেখে সোমা সামনের দিকে চোখ মেলল। সামনে এই বালির জমাট ঢেউগুলো পেরোলেই আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষিত সমুদ্র। দূরে, বহুদূরে সাগরের জল যেন জ্যোৎস্নায় ভর করে আকাশে উঠে গেছে। চকচকে বালি পেরিয়ে এসে আমরা পা-ঢেউ জলে রাখলাম। টলমলে জ্যোৎস্নায় পাক খাওয়া ঢেউয়ের ফসফরাসে কোনও অদৃশ্য বাজিকর যেন চটপটি জ্বালাচ্ছে। আমাদের সমস্ত শরীরে বিলি কাটছে বাতাসের-পর বাতাস। এই মুহূর্তে, এই ভীষণ সুন্দরের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনের ঘরে কোনও অন্ধকার। ছিল না। সোমা এতক্ষণ নেতিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ শুনলাম ও বলছে, সুন্দর। আমার ভালো লাগছিল। এই মুহূর্তে নিজেকে ভীষণ সুখী বলে মনে হল। এক-একটা ঢেউ আমাদের নিয়ে এসে গর্জনে ফেটে পড়ছে। আমি জ্যোৎস্না দেখছিলাম না, সমুদ্র দেখছিলাম না। এই ঢেউয়ে পা ডুবিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে কৃপনের মতো পরম সুখের স্বাদ নিচ্ছিলাম একটু-একটু করে। সোমা আমার পিঠে মাথা রেখে বসেছিল। কথা বলতে ভীষণ ভালো লাগছিল আমাদের।

ক্রমশ বুড়ির চাঁদে টানে-টানে ঢেউগুলো যখন এগিয়ে আসতে লাগল শরীরের কাছে তখন সোমা উঠে দাঁড়াল। অলস চোখে তাকালাম সামনের বালিয়াড়ির দিকে। বেলাভুমি ফাঁকা হয়ে গেছে। কখন, খেয়াল ছিল না। এই নির্জনে গা-ছমছম করা চাঁদের আলোয় আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই।

বাঁ-হাতে চটি নিয়ে ডান হাতে শাড়ি সামলে বুড়ো আঙুল দিয়ে বালি ছিটিয়ে-ছিটিয়ে সোমা হাঁটছিল। তোমার সন্ধেটা একদম মাটি করে দিলাম, না? নিচু স্বরে স্বগতোক্তির মতো বলল সোমা।

আমি প্রথমে কিছু বললাম না। সোমা একটু হাসল, আমার ভাগ্যটাই এইরকম।

এবার খুব দামি কথা বলার ভঙ্গিতে বললাম, শাস্ত্রে আছে, দেবদর্শন করতে হলে সৃষ্টির কুশ্রী দিকটা দেখে নেওয়া দরকার। এই জ্যোৎস্নায় সমুদ্র দেখা সার্থক হত না যদি না ওদের আমরা দেখতাম।

মুহূর্তে আশ্চর্যজনকভাবে সহজ হয়ে গেল সোমা। উজ্জ্বল খুশিতে তাকাল, এই ছুটব?

ছুটব মানে? আমি অবাক।

এই চকচকে বালির ওপর দিয়ে দৌড়োতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। কতকাল দৌড়াই না।

বাচ্চা ছেলের মতো গাল ফোলাল সোমা।

হেসে বললাম, বেশ তুমি এগোও, আমি তোমাকে ধরছি।

চাপে বালি বসে যাচ্ছিল, চুল উড়ছিল বাতাসে। সোমাকে এই দারুণ জ্যোৎস্নায় কোনও সুরকোলের বাসিবলমাত্র আঁচল কোমরে গুঁজে বালির ওপর দিয়ে ছোট-ছোট পা ফেলে সোমা ছুটতে শুরু করল। পায়ের চাপেন্দা বলে ভাবতে ইচ্ছে করছিল! বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে সোমা ঘাড় ঘুরিয়ে চিৎকার করে আমাকে ডাকল, এই এসো না! আর ঠিক তখনি এত দূর থেরে আমি ওকে পড়ে যেতে দেখলাম। ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে মারামারি করে একটা আর্ত চিৎকার ছুটে এল আমার কানে। সেই নরম বালিয়াড়ি ভেঙে প্রাণপণে সোমার কাছে এসে দাঁড়াতেই ও বিস্ফোরিত চোখ তুলে তাকাল। শরীর থরথর করে কাঁপছে ওর, ভীষণ ভয়ে মুখটা সাদা হয়ে গেছে।

কী হল, এই সোমা, কী হয়েছে তোমার? আমি ঝুঁকে বসে ওর কাঁধে হাত রাখলাম। দুটো চোখ বন্ধ করে কী ভীষণ ঘৃণায় মুখ বিকৃতি করে সোমা বাঁ-হাত দিয়ে পা দেখাল। মুহূর্তে আমার রক্তে একটা শীতলতা টোকা দিয়ে গেল। ছোপ-ছোপ রক্ত আর পুঁজে বীভৎস হওয়া এক ফালি কাপড় জড়িয়ে ধরেছে সোমার মসৃণ পায়ে। হোঁচট খেয়ে পড়েছে ও। সোমার পায়ে ছাপ পড়েছে পুঁজ ও রক্তের।

হাত বাড়িয়ে সরিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম সেটাকে, সঙ্গে-সঙ্গে সোমা ফুসে উঠল, না, কক্ষনো না, তুমি ছোঁবে না। চকিতে সোমা হাত দিয়ে ব্যান্ডেজটা খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল এক পাশে। আমি। দেখলাম, সোমার হাত বীভৎস হয়ে উঠল, ভূত দেখার মতো চোখ তুলে দুটো হাত মুখের সামনে এনে দেখল সোমা। তারপর সমস্ত শরীরের শক্তি দু-পায়ে নিয়ে টলতে-টলতে উঠে দাঁড়াল ও।

দু-পায়ে এগিয়ে গিয়ে সোমা হঠাৎ হু-হুঁ করে কেঁদে উঠল। এই মুহূর্তে আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ওপাশে সমুদ্রের জোয়ারলাগা ঢেউ-এর গর্জন আর জ্যোৎস্না মাখা দুরন্ত বাতাস আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছিল। দু-হাতে মুখ গুঁজে সোমা কাঁদছিল। আমি এগিয়ে গেলাম, এই লক্ষ্মীটি, ছেলেমানুষি করো না। তোমার কিছু হয়নি, কাঁদছ কেন? এই সোমা–।

হঠাৎ সোমার কান্না থেমে গেল। চোখ বন্ধ করে ভাবল কিছু একটা। তারপর যেন কয়েক যোজন দূর থেকে কথা বলছে এমনি গলায় বলল, কুষ্ঠ, না?

আমি স্বাভাবিক হতে চাইলাম প্রাণপণে, তাতে কি হয়েছে, তুমি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছ।

সোমা কিছু বলল না প্রথমে, তারপর কেমন একটা আর্তস্বরে ডুকরে উঠল, আমার কি হবে!

কি হবে মানে? কিছু হবে না, চলো হোটেলে গিয়ে কার্বলিক সোপে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নেবে। আমি ওর কাঁধে হাত রাখতে চাইলাম।

চকিতে প্রচণ্ড চিৎকার করে সোমা ঘুরে দাঁড়াল, না। আমাকে ছোঁবে না তুমি। কুষ্ঠ ভয়ানক ছোঁয়াচে। আমি জানি, আমার মেজদাদুর হয়েছিল?

সোমার চোখমুখে এমন একটা ছবি দ্রুত আঁকা হয়ে গেল যে তা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, তোমার মেজদাদুর হয়েছিল।

হ্যাঁ, ঠাকুরদা ভয় পেয়ে তাকে কুষ্ঠ আশ্রমে দিয়ে এসেছিলেন। ছোঁয়াচে যে!

তোমার ঠাকুরদার কুষ্ঠ হয়েছিল?

একথা তুমি আগে কখনও বলনি তো।

বলিনি, এমনিই বলিনি, লক্ষ্মীটি আমি কখনও মেজদাদুকে ছুঁইনি, তুমি বিশ্বাস করো, আমি–তুমি যদি আমাকে ভুল বোঝো, আমি ভয় পেয়েছিলাম গো।

তোমাদের বংশে কুষ্ঠ হয়েছিল! ছোট ছেলে যেমন করে টেনিস বল লোফালফি করে তেমনি ভঙ্গিতে বললাম আমি।

নাগো…আমাদের বংশে নয়, শুধু মেজদাদুর হয়েছিল–আমি তোমাকে ঠকাইনি। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো…।

হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মতো চোখ-মুখ হয়েছিল সোমার। আর আমার মাথার ভেতর অজস্র সিম্ভনির ঢাক একসঙ্গে বেজে উঠল। আজ সন্ধেবেলায় কুষ্ঠরোগী দেখার পর সোমার মানসিক পরিবর্তন একটু-একটু করে আমার কাছে অর্থবহ হয়ে উঠেছে। আমি আমার শুভবুদ্ধির ওপর ক্রমশ আস্থা হারিয়ে ফেলছিলাম।

হঠাৎ লক্ষ করলাম সোমা পায়ে-পায়ে জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাতাসে ওর শাড়ি বিস্রস্ত। চুল উড়ছে। চকিতে বুকের ভেতরে ভীষণ দুর্ঘটনা ঘটে গেল। দৌড়ে সোমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, কোথায় যাচ্ছ?

সোমা কোনও কথা না বলে হাঁটতে লাগল। ওর চলার ভঙ্গি দেখে একটা ভয় আমার সমস্ত সত্তাকে অধিকার করল। আমার মনে হল সোমা একটা ভয়ানক কিছু করতে যাচ্ছে। আমরা জেলেডিঙি পেরিয়ে জলের ধারে এসে পড়েছিলাম। আমি এস্তে সোমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাঙা এবং তীক্ষ্ণ স্বরে সোমার গলা সামুদ্রিক গর্জনের সঙ্গে পাল্লা দিল, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। আমাকে। খবরদার–ঘঁয়ো নাঘঁয়ো না। তারপর অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল, তোমার কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারব না। আমাকে বাধা দিও না, আমি স্নান করব।

এই নির্জন সমুদ্রতীরে তখন অসংখ্য ঝিনুক বালির রুপোয় মুখ ডুবিয়ে পড়েছিল, সমুদ্রের গভীরে কোনও বিশাল শঙ্খের বুকে ঢেউ লেগে কেউ প্রলয়ের ডাক তুলেছিল হয়তো, নাম না জানা। কোনও সামুদ্রিক দল ছাড়া পাখি ওই বিস্তীর্ণ জলের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে-যেতে নিচের ফসফরাস জ্বলা ঢেউগুলোকে আগুনের বিছেহার ভেবে চন্দাহত বিবশ হয়ে ঢলে পড়ছিল জলের বুকে পরম তৃষ্ণায়, কিন্তু আমি এই মুহূর্তে আমার হাতের নাগালের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সোমাকে বহুযোজন দূরবর্তী এক অচেনা মানুষের মুখোশ পরে নিতে দেখলাম এই রাতে, চাঁদের রাতে, সমুদ্রের রাতে।

এই নিশীথবেলায় সমুদ্রতীরে কোনও মানুষ ছিল না জেগে। চন্দ্রালোকে যে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে তারই আঁচ লেগেছে সমুদ্রের বুকে। ক্ষিপ্ত ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে সে ঢেউগুলোকে ছুঁড়ে-খুঁড়ে মারছিল বালির গায়ে। অবাক হয়ে দেখলাম, শুকনো বালির ওপর শাড়ি খুলে রেখে সোমা সমুদ্রের জলে পা দিল। ঠিক এই মুহূর্তে আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এই জোয়ারের সমুদ্রে স্নান করার কথা ভেবে আমার শরীর হিম হয়ে যাচ্ছিল। পা-ঢেউ-জলে দাঁড়িয়ে আমি ওকে ধরতে চাইছিলাম, ছিনিয়ে নিলাম হাত, কী পাগলামি করছে সোমা। এখন রাত কত খেয়াল আছে? এই জোয়ারের সমুদ্রে, কেউ কখনও কোনওদিন স্নান করেছে? চলো, আর এক মুহূর্ত এখানে নয়।

তেমনি শান্ত গলায় সোমা বলল, আমাকে বাধা দিও না।

আমি সোমার পাশাপাশি জলের ভেতর দিয়ে হাঁটছিলাম, সোমা ফিরে চলো। আমার মেরুদণ্ডে একটা শীতল অনুভূতি ছটফট করছিল। আমার ভয় করছিল। আমার ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে। করছিল। এই মুহূর্তে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল আমি তোমাকে ভুল বুঝিনি সোমা। কিন্তু ক্রমশ এগিয়ে যেতে-যেতে সোমা বলল, না, সমুদ্রে স্নান না করলে আমার শান্তি হবে না।

আমরা প্রায় কোমরজলে চলে এসেছি। বিরাট দু-মানুষ সমান ঢেউ একটার-পর-একটা আসছে পৃথিবী কাঁপিয়ে। আমি সোমার হাত ধরলাম, ও তাকাল কিছু বলল না এবার। বিরাট একটা ঢেউ এসে মাথার ওপর থেকে চাঁদের আকাশটাকে যেন হঠাৎ ছিনিয়ে নিয়ে গেল। আমরা ডুব দিলাম।

জানি না কতক্ষণ ধরে স্নান করেছি আমরা। রুপোলি ঢেউ আর রূপকথার মতো সামুদ্রিক রাত আমাকে বিবশ করে রেখেছিল। এক সময় আমি ক্লান্ত অবসন্ন সোমাকে তীরের দিকে টেনে নিয়ে চললাম। হঠাৎ নজরে পড়ল, অস্পষ্ট চোখে দেখলাম একটা ছায়াশরীর শুকনো বালি ভেঙে দ্রুত পাশের ঝাউবনে ঢুকে গেল। আমার প্রচণ্ড শীত করছিল। জল ছেড়ে উঠতেই বাতাসের চেহারা মুহূর্তেই কসাই হয়ে গেল। হঠাৎ সোমার চিৎকার কানে এল, আমার শাড়ি!

শীতে থরথর করে কাঁপছে সোমা। দু-হাত ভাঁজ করে বুকের কাছে ধরা, অন্তর থেকে জল ঝরছে টপটপ করে। আমার দিকে চোখ তুলে সোমা আবার বলল, আমার শাড়ি। কেমন যেন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি তো, শাড়িটা কোথায় গেল? চোখ বোলালাম বালির চরে, কেউ কোথাও নেই। হঠাৎ সেই ছায়াশরীরের কথা মনে পড়তেই চকিতে একটা সন্দেহ মনে উঁকি দিল। আমি ঝাউবনের দিকে ছুটলাম।

বালির ঢেউগুলো ভেঙে ঝাউবনের কাছে যেতেই একটা কলকলে হাসি কানে এল। কয়েক পা এগিয়ে পা বাড়াতেই ঝাউবনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ছবি আমি দেখতে পেলাম। কয়েক হাত বালির চত্বরে জ্যোৎস্নায় একটি মেয়ে কি ভীষণ খুশিতে হাসছে। মেয়েটার সর্বাঙ্গে রক্তমাখা ব্যান্ডেজ, একটা ঠোঁট খসে গেছে, চুলহীন মাথায় বড়-বড় ঘা। সোমার শাড়িটাকে পরবার চেষ্টা করছে সে ক্ষতবিক্ষত শরীরে জড়িয়ে-জড়িয়ে, আর তার সামনে উঁচু হয়ে বসে কুষ্ঠরোগগ্রস্ত একটি লোক, যার একটি কান নেই, সমস্ত শরীরে সাদা চাকা-চাকা দাগ, যেন মুগ্ধ নয়নে পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর জিনিসকে তারিফ করছে মাথা দুলিয়ে-দুলিয়ে। চাঁদের আলোমাখামাখি হয়ে গেছে তাদের অঙ্গে।

সন্ধেবেলায় রাস্তায় বসে থাকা এই কুষ্ঠরোগী দুটোকে এখন আমার অন্য গ্রহের মানুষ বলে মনে হল। পৃথিবীর চারদেওয়ালের বাইরে খুঁটিয়ে তৈরি করা এই জগতের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না আমি। হঠাৎ একটা শীতল স্পর্শ পেলাম কাঁধে। কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, সোমা ইঙ্গিতে নিষেধ করল। আমরা চোরের মতন ঝাউবন থেকে নেমে এলাম। সেই নির্জন জ্যোৎস্নারাতে সমুদ্রের বালির ওপর দিয়ে আমাদের দুটো শরীরকে পেছনের ঝাউবন থেকে ভেসে আসা একটা দারুণ খুশির হাসি তাড়া করে বড় রাস্তার দিকে পাঠিয়ে দিল।

চোখ তুলে তাকালে হয়তো দেখতাম বাতাসের দাপট বুঝি থমকে গেছে, মৃত মাছের চোখের চেহারা নিয়েছে জ্যোৎস্না আর বুড়ি চাঁদের মুখটাকে বিবর্ণ করে একটা দারুণ হাসি ভীষণ অহঙ্কারে চৌচির হয়ে বলছে, এই আমাকে দ্যাখো, এই আমাকে দ্যাখো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress