Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বেগম মেরী বিশ্বাস || Bimal Mitra » Page 4

বেগম মেরী বিশ্বাস || Bimal Mitra

বেভারিজ সাহেবের সোরার গদিতে তখন ষষ্ঠীপদ ঘুম থেকে সবে উঠেছে। হিসেবত্তরটা ঠিক না রাখলে আখেরে বড় মুশকিল হয়। একবার যদি সাহেবের সন্দেহ হয় তো মুনশিগিরি ঘুচে যাবে। তিরিশ টাকাকে কী করে তিন টাকা করতে হয় তার কসরত ষষ্ঠীপদ জানে।

ষষ্ঠীপদ মুখে বলে–আমি বাপু ধর্ম করতে এসেছি, ধর্ম করে যাব! তাতে যদি আমার লোকসান হয় তো হোক! আমার বাপের কাছে আমি একটা জিনিস শিখেছি বাপু যে, অধর্মের পয়সা থাকে না

সেই অধর্মকেই ধর্ম বানাতে হলে কিন্তু হিসেবটি পাকা রাখা চাই। হিসেবের গোলমালটি করেছ কি তোমার সব নষ্ট!

ভৈরব দাস ওইটে বোঝে না।

ভৈরব বলে–ধর্ম আবার কী কত্তা? পয়সাকড়ি কামিয়ে গঙ্গাস্নান করে তবে তো ধম্ম করব। এটা তো আপনিই শিখিয়ে দিয়েছেন! এটা কি ধর্ম করবার বয়েস?

দুর হ, দুর হয়।

ষষ্ঠীপদ তাড়া দেয় ভৈরবকে। বলে–তুই নরকে যাবি ভৈরব, ডাহা নরকে যাবি তোর আর মুক্তি নেই রে

কিন্তু সেদিন এক কাণ্ড ঘটল। সকালবেলা ভৈরব আসবার আগেই হিসেবের খাতাগুলো নিয়ে বসেছিল ষষ্ঠীপদ। এমন সময় ভৈরব দৌড়তে দৌড়োতে এল। তখনও হাঁফাচ্ছে। বললে–শিগগির পালান কত্তা, শিগগির পালান–শিগগিরবেভারিজ সাহেব পালিয়েছে, কেল্লার সেপাইরাও পালিয়েছে, লাটসাহেবও পালিয়ে গেছে–আপনি পালান কত্তা, পালান।

সত্যিই ষষ্ঠীপদ প্রথমে বুঝতে পারেনি অতটা। শুধু ষষ্ঠীপদকে দোষ দিয়েই বা কী হবে, কলকাতার কেউই তখন বুঝতে পারেনি। এমন যে হবে, এ-যেন সকলের ধারণার বাইরে। গভর্নর ড্রেক, ক্যাপ্টেন গ্র্যান্ট, জেনারেল লিসবন, বেভারিজ সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল। ষষ্ঠীপদ অনেক দিন ধরে মুনশিগিরির চাকরিটার জন্যে হাঁ করে ছিল। সবে হাতে দুটো মাগনা পয়সা আসতে শুরু করেছিল, এমন সময় এ কী বলে ভৈরব!

পালাব কেন? কী দোষটা করলুম?

ভৈরব বললে–না পালালে আমার কী? আমি পালালুম

বলে ভৈরব নিজের তলপিতলপা নিয়ে চলে যাচ্ছিল। ষষ্ঠীপদ সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়াল। বললে–এই পালাচ্ছিস যে বড়? আমার পাওনাগণ্ডার কী হবে?

আপনার আবার পাওনাগণ্ডার কী মুনশিবাবু, অ্যাদ্দিনের মাইনে নিলুম না, এর মধ্যে আপনার পাওনাগণ্ডাটা হল কীসের? হাতে কি একটা পয়সা পেইছি আমি?

সেই সোরার গদির মধ্যে ষষ্ঠীপদ ভৈরবের গলায় গামছা দিয়ে আটকে ধরেছে।

আজ্ঞে, পাওনাগণ্ডা যা হিসেব হয়, পরে আপনি নেবেন গুনে, এখন তো আগে প্রাণে বাঁচতে দিন।

হঠাৎ এতক্ষণে নজরে পড়ল আধো-অন্ধকারের মধ্যে মাঠের ওপর দিয়ে সব লোক গঙ্গার দিকে দৌড়োচ্ছে। কোলে ছেলে, হাতে পোঁটলা, মাথায় ঝুড়ি। কী হল গো? কী হল? কোথায় যাওয়া হবে? তাদের তখন আর উত্তর দেবার সময় নেই। একদিন বর্গিদের অত্যাচারে গ্রাম থেকে পালিয়ে এসে এখানে ঘরবাড়ি বেঁধে বসবাস শুরু করেছিল, আবার এখান থেকেও নবাবের অত্যাচারে পালিয়ে যেতে হচ্ছে। গরিব প্রজাদের কোথাও গিয়েই শান্তি নেই গো, কোনও যুগেই শান্তি নেই রাজায় রাজায় লড়াই বাধলেই উলুখড়ের প্রাণ যাবে। উলুখড়েরা এ-দেশ থেকে ও-দেশে প্রাণ বাঁচাতে প্রাণান্ত করবে। আর ষষ্ঠীপদরা সেই সুযোগে ভৈরবদের গলায় গামছা দিয়ে টাকাকড়ি সব শুষে নেবে।

আবার ওদিক থেকে কারা যেন সব হইচই করে চেঁচিয়ে উঠল।

ওই শুনুন কত্তা, নবাবের সেপাইরা এসে পড়ল বলে! এখন ছেড়ে দ্যান আমাকে

ষষ্ঠীপদর কী মনে হল। বললে–তবে তোর ট্যাঁকে কী আছে দেখি—

ট্যাঁকে কী থাকবে কত্তা কানাকড়িটাও তাঁকে নেই আজ এই দেখুন

ভৈরব নিজের ট্যাঁক উপুড় করে দেখালে। ট্যাঁকটা ঝেড়ে দেখেও ষষ্ঠীপদর যেন সন্দেহ গেল না। বললে–তা হলে সেদিন যে তোকে তিনটে টাকা দিলুম, সেটা কোথায় গেল?

আজ্ঞে, সে তো আমার হক্কের টাকা, সে আমি খরচা করে ফেলেছি!

এই সাত দিনের মধ্যে তিন টাকা খরচা হয়ে গেল? তুই যে দেখছি বেভারিজ সাহেবের ঘাড়ে…

আজ্ঞে, দেনা ছিল কিছু, তাই শোধ করেছি তিন টাকা!

ততক্ষণে গোলমাল আরও বেড়ে উঠেছে। গঙ্গার ঘাটের দিকে কয়েকটা জাহাজ পাল তুলে দিয়েছে। ফিরিঙ্গি সাহেবরা হুড়মুড় করে উঠছে সবাই তাইতে। দূর গোবিন্দপুরের দিকেও সবাই দৌড়োচ্ছ।

ষষ্ঠীপদর হঠাৎ কী মনে হল। ভৈরবকে একটা লাথি মারলে পা দিয়ে, বললে–যাঃ–তোকে ছেড়ে দিলুম–

তারপর মনে পড়ল এ-সময়ে মাথা ঠিক না রাখলে সব গোলমাল হয়ে যায়। বিপদের দিনে যে মাথা ঠিক রাখতে পারে, সে-ই তো জেতে। তাড়াতাড়ি ষষ্ঠীপদ তহবিলটা ভাল করে দেখলে। সাহেব আগের দিন এসে সব টাকাকড়ি হিসেব করে দিয়ে গিয়েছে। মনে হল, আর তো কিছুক্ষণ, তারপরেই নবাবের ফৌজি সেপাই এসে পড়বে। তখন হয়তো দাউদাউ করে জ্বলবে এই গদি। ষষ্ঠীপদ আর দাঁড়াল না। মালকেঁচা মেরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। এই তো সুযোগ। বর্গিদের সময়েও লোকে যখন গাঁ ছেড়ে পালাত, ষষ্ঠীপদ তখন তাদের সঙ্গে পালাত না। ছেড়ে ফেলে যাওয়া ফাঁকা বাড়িগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ত ষষ্ঠীপদ। ঢুকে খুঁজে বেড়াত কোথায় বাসনকোসন আছে, কোথায় সোনাদানা আছে; এমনি করে অনেকবার অনেক জিনিস পেয়েছে ষষ্ঠীপদ। জীবনের শুধু একটা মানেই জানত সে। টাকা থাকাটাই যে জীবনের একমাত্র থাকা এই চরম জ্ঞানটাই বুঝে নিয়ে ষষ্ঠীপদ রীতিমতো জ্ঞানী হয়ে উঠেছিল। তাই আর দেরি করলে না। সেই ভোর-ভোর অন্ধকারেই ষষ্ঠীপদ চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালাল। তারপর পেছনের দরজা দিয়ে নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এল। সেখান থেকে সোজা একেবারে শেঠের বাগান। শেঠেদের গঙ্গার জল বিক্রি করবার ব্যাবসা। বৈষ্ণবচরণ শেঠ সিলমোহর করা গঙ্গাজল ত্রৈলঙ্গ দেশে মোটা দরে বিক্রি করে অনেক টাকার মালিক হয়েছে। ষষ্ঠীপদ পেছনের খিড়কির দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে রইল। তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠল–আল্লা হো আকবর

ওদিক থেকে পালে পালে যারা আসছিল তারা যেন একটু থমকে দাঁড়াল। কিন্তু অন্য এক দিক থেকে তুমুল চিৎকার উঠল আল্লা হো আকবর

শেঠের বাগানের বুড়ো মুনশি হীরালাল সরকারের আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেছে। চাকরবাকর-বেয়ারা সবাই জেগে উঠেছে। বৈষ্ণব শেঠের এলাহি কারবার। লাখ লাখ টাকার কারবার করে শেঠেরা শেষকালে ফিরিঙ্গি কোম্পানির দালালও হয়েছিল।

হীরালাল মুনশি ষষ্ঠীপদকে দেখে হতবাক।–আরে তুই? তুই এই অসময়ে কোত্থেকে?

যষ্ঠীপদ তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে–হুজুর, সর্বনাশ হয়ে গেছে। নবাব লড়াই শুরু করে দিয়েছে–সেপাই এসে গিয়েছে ওই শুনুন

হীরালাল চারদিকে চেয়ে দেখলেন।

তোদের গদিতে আগুন জ্বলছে না?

হা হুজুর, সাহেব গদিতে ছিল রাত্তিরে, সেপাইরা সাহেবকে খুন করে গদিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, তাই আপনাকেও সাবধান করে দিতে এলাম

ষষ্ঠীপদ আগে থেকেই হাঁফাচ্ছিল, এবার খবরটা শুনে হীরালাল সরকারও থরথর করে কাঁপতে লাগল।

তাই আমি বলতে এলাম আজ্ঞে, যদি কর্তারা কেউ থাকে গদিতে—

তুই বেঁচে থাক বাবা, খবরটা দিলি ভাল করলি! এখন কী করি? তহবিলে যে অনেক টাকা রয়েছে–

ষষ্ঠীপদ বললে–ওগুলো সঙ্গে করে নিয়ে যান টাকা কি ফেলে রেখে যেতে আছে? চাকরবাকরদের বলুন, সিন্দুক খুলে পোঁটলা বেঁধে সঙ্গে নিয়ে যেতে

আরে বাবা, সে-যে অনেক টাকা রে, সে-সব নিতে গেলে যে আর প্রাণে বাঁচবনা-ও থাক, কপালে থাকে তো থাকবে, নয়তো থাকবে না

বৈষ্ণবচরণ শেঠবাবুরা বহুদিনের তাঁতের কারবারি। ফিরিঙ্গি সাহেবরা তাঁতিদের, আরমানিদের, হিন্দুদের, শিখদের সকলকে তোয়াজ করে ভেতরের গুপ্ত কথা আদায় করতে চায়। বেছে বেছে এমন। মুনশি রাখে যারা ফিরিঙ্গিদের দেবতার আসনে বসিয়ে পুজো করবে। এমন লোককে দালালি দেয় যে, বিপদের দিনে ফিরিঙ্গিদের দলে আসবে।

সেদিন শেঠবাবুদের বাগানের গদিবাড়িতেও তাই যখন হীরালাল মুনশি প্রাণের ভয়ে সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে বাঁচল, তখন গদির সম্পত্তি টাকাকড়ি দেখবার জন্যেও কেউ রইল না। যে-আগুন বেভারিজ সাহেবের সোরার গদিতে জ্বল, সে-আগুন বৈষ্ণবচরণ শেঠের গদিতেও লাগল। নবাব ফৌজ নিয়ে আসবার আগেই সমস্ত কলকাতায় আগুন লেগে গেল। যখন সবাই পালিয়েছে, তখন ষষ্ঠীপদই একলা শেঠবাবুদের গদির ভেতর সিন্দুক ভেঙে কোচড় ভরতি করেছে। ষষ্ঠীপদর কাছে নবাবও যা, ফিরিঙ্গি কোম্পানিও তাই। হিন্দুও যা, মুসলমানও তাই। ষষ্ঠীপদরা শুধু টাকাটাই জানে! টাকাই তো আসল জিনিস রে। তোর টাকা হোক ভৈরব, তখন তোর হাতের ছোঁয়া বামুনরাও খাবে, মোছলমানও খাবে, ফিরিঙ্গি বেটারাও খাবে।

ষষ্ঠীপদর মনে হল, সমস্ত কলকাতাটাই যেন সে কিনে নিয়েছে। এত টাকা। এত মোহর, এত সোনা। সোনা দিয়ে আমি কলকাতা মুড়ে দেব। তখন দেখব, জগৎশেঠ তুমি বড়লোক, না আমি। তুমি আর আমি তখন এক জাত। কলকাতা ছেড়ে সবাই পালিয়ে গেছে। আমি কলকাতার নবাব আর সিরাজ-উ-দ্দৌলা মুর্শিদাবাদের নবাব। তোমার যদি বেশি টাকা থাকে তো আমাকে কিনে নাও। আর আমার যদি বেশি টাকা থাকে তো আমিও তোমাকে কিনে নেব কিন্তু। এখন কলকাতার জমিদারির ৫৭৮৬ বিঘে ১৯ কাঠা জমির মালিক আমি। আমি আবার ওই পোড়া কলকাতায় তোমাদের জমি পত্তনি দেব। ফৌজদারি বালাখানা বানাব, তারপর…

ও কত্তা, কত্তা

হঠাৎ ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল ষষ্ঠীপদর। চারদিকে একবার চেয়ে দেখলে। এ তো সেই বেভারিজ সাহেবেরই গদিবাড়ি। তা হলে গদিবাড়ির তক্তপোশের ওপর ছেঁড়া মাদুরে শুয়ে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল নাকি সে। নিজের কেঁচড় দেখলে, নিজের হাত দুটো দেখলে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে। কী আশ্চর্য, কোথাও তো আগুন দেখা যাচ্ছে না। কলকাতা তো সেই কলকাতাই আছে। তার নিজের ধুতিখানাও তো সেই একই ধুতি।

ও কত্তা, কত্তা

দুরতেরিকা! সক্কালবেলা জ্বালাতে এসেছে। কে? কে তুই? তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ভৈরবকে দেখেই মুখটা বেঁকিয়ে উঠল ষষ্ঠীপদ!

ভোরবেলাই তোর মুখটা দেখতে হল তো! আর সময় পেলি না আসবার! দিনটা একেবারে মাটি, তোর জন্যে দেখছি একটা টাকারও মুখ দেখতে পাব না আজকে! তোর জ্বালায় কি আমি বনবাসী হব রে ভৈরব? সক্কালবেলা তোদের মুখ দেখতে আছে?

ভৈরব অবাক হয়ে গিয়েছিল।

কেন হুজুর, আমি তো ভৈরব দাস নই আর, ভৈরব চক্কোত্তি–নমশুদ্র নই কত্তা, বামুন! আমি তো পইতে পরেছি

ষষ্ঠীপদ রেগে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলে। বললে–যা এখন এখান থেকে, ওদিকে মুখ করে দাঁড়া, আমি ঘাটে গিয়ে আগে গঙ্গাজলে মুখ ধুয়ে আসি, তখন আসিস

ষষ্ঠীপদর সমস্ত শরীরটা ঘেন্নায় ঘিনঘিন করতে লাগল। ভোরবেলার স্বপ্ন হয়তো সত্যি হত, কিন্তু বেটার জ্বালায় সব মাটি করে দিলে।

ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে বলে–ও-মুখ করে দাঁড়া শিগগির, দাঁড়িয়েছিস?

আজ্ঞে হ্যাঁ, কত্তা

দেখিস, যেন আমাকে দেখে ফেলিসনি! তোকে রেখে তো দেখছি আমার মহা বিপদ হল। আমি এবার বেরোচ্ছি, বুঝলি?

আজ্ঞে হ্যাঁ, বেরোন, কোনও ভয় নেই কত্তা আপনার

ষষ্ঠীপদ আবার সাবধান করে দিলে। বললে–আমি গঙ্গায় গিয়ে মুখ ধুয়ে গদিতে ফিরে এলে তখন মুখ ফেরাবি, বুঝলি তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ কত্তা, বুঝেছি!

ষষ্ঠীপদ মাথা নিচু করে দরজাটা খুলে গঙ্গার ঘাটের দিকে গেল। তারপর ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নেমে দু’হাতের আঁজলা ভরে জল দিয়ে মুখ ধুতে ধুতে বলতে লাগল–মা, পতিতোৰ্ধারিণী গঙ্গে, রাজা। করো মা আমাকে, রাজা করো–

ওদিকে তখন বোধহয় ভোর হচ্ছে। অন্ধকার কেটে আসছে। গঙ্গার নৌকোগুলোর ভেতরে তখন মাঝিরা জেগে উঠেছে। ফিরিঙ্গি কোম্পানির দু-একটা হাতি তখন ঘাটের ধারে চরতে বেরিয়েছে। ষষ্ঠীপদ চোখ দুটো বুজে আবার তখন মন দিয়ে গঙ্গাস্তব করতে লাগল একমনে। মা, পতিতোদ্ধারিণী, গঙ্গে…

চকবাজারে তখন সন্ধে হয়-হয়। সড়কের দু’ধারের দোকানে দোকানে রোশনাই। খুশবু তেল তৈরি করত সারাফত। সারাফত আলির তিনপুরুষের খুশবু তেলের দোকান। গুলাবি আতর মাখানো তুলে কানের ভেতর লাগিয়ে দোকানে আগরবাতি জ্বেলে দিয়েছে। জ্বেলে দিয়ে গড়গড়ায় তামাক খাচ্ছে। আগরবাতির ধোঁয়া আর তামাকের ধোঁয়া মিশলে আর একরকম নতুন গন্ধের সৃষ্টি হয়। সেই গন্ধতেই মৌতাতটা জমে সারাফত আলির। হঠাৎ তামাক টানতে টানতে একটা স্বপ্নের ঘোর যেন সারাফতের চোখের ওপর নেমে এল। কেয়াবাত কেয়াবাত! সামনে দিয়ে যেন ঝালরদার পালকি চলেছে একটা। আর তার ভেতরে যেন এক জরিদার ওড়নি ঢাকা চাঁদনি চলেছে বাইরে উঁকি দিতে দিতে।

স্বপ্নই বটে! আগরবাতির ধোঁয়ার স্বপ্ন। খুশবু তেলের স্বপ্ন। আগরাইয়া তামাকুর ধোঁয়ার স্বপ্ন। কেয়াবাত! কেয়াবাত।

কিন্তু হঠাৎ নেশাটা কেটে গেছে। স্বপ্ন নয় তো৷ এ যে চলেছে আসলি ঝালরদার পালকি, নবাবের ফৌজি সেপাই চলেছে।

সত্যি আসলি চিজ কিনা জানতে কৌতূহল হল সারাফত আলির। একবার চিল্লিয়ে উঠল-বাদশা, দেখে আয় তো কৌন–

বাদশা সারাফত আলির নৌকর। সারাফত আলির কেনা বান্দা। তাকে বেশি আর বলতে হয় না। সে দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে হাজির। একেবারে তাঞ্জামের সামনে। যাকে সামনে পেলে তাকেই জিজ্ঞেস করলে তাঞ্জাম মে কৌন হ্যায় জি?

সেপাইটা বন্দুক ঘাড়ে করে চলছিল। বললে–নয়াবেগম

নয়াবেগম! কোথায় চলেছে নয়াবেগম এই সাঁঝবেলায়? সন্ধেবেলায় তো বেগমরা রাস্তায় বেরোয় । কোথায় চলেছে গো নয়াবেগম?

জাহান্নম!

বোধহয় রাগ করেই কথাটা বলেছিল সেপাইজি? আর তা ছাড়া রাগ তো হবারই কথা! উল্লুকদের কথার জবাব দিতে সেপাইদের ইজ্জত বাধে।

কী রে, কী বললে–সেপাইজি? কে?

বাদশা বললে–হুজুর নয়াবেগম!

ফিন নয়াবেগম! শালা বেগমে বেগমে ভরে গেল চেহেল সুতুন! তবু শালার বেগমের কমতি নেই! বড় খতরা হয়ে গেল দুনিয়াটা! ব্যাকোয়াশ হয়ে গেল জিন্দিগিটা! মুর্শিদাবাদ আবার ডুববে রে! সঙ্গে আবার কাফের যাচ্ছে একটা! ওটা কে রে? সঙ্গে সঙ্গে ওটা যাচ্ছে কেন রে? আমাদের কান্তবাবুনা?

কান্ত একমনে ভাবতে ভাবতে পালকির পেছন পেছন যাচ্ছিল। পাশ থেকে সারাফত আলির কথাগুলো কানে এল। এতক্ষণে যেন জ্ঞান ফিরে এল কান্তর। এতক্ষণ যেন খেয়ালই ছিল না কোথায় চলেছে, কোথায় এসে পৌঁছেছে। চকবাজার। এখান থেকেই হাতিয়াগড়ে রওনা হয়েছিল সে। এই সেই সড়ক, এখানে এসেই বশিরের সঙ্গে দেখা করেছিল সে! রাস্তার লোকগুলো পর্যন্ত তাকে আজ আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। ওই দেখো নবাবের চর! চর যখন ছিল না, তখনই চর বলে ধরে নিয়েছিল বেভারিজ সাহেব। ষষ্ঠীপদ খুব বাঁচিয়ে দিয়েছে। ষষ্ঠীপদ লোকটা ভাল। বড় সরল। ইচ্ছে করলেই তো তাকে ধরিয়ে দিতে পারত। সাহেবকে গিয়ে চুপি চুপি খবরটা দিলেই পারত যে মুনশিবাবু নিজামতের চর। তখন গোরা-পল্টন এসে কান্তকে ধরে নিয়ে গেলেই বা তার কী বলবার থাকত।

মাথার মধ্যে সমস্ত অতীতটা তোলপাড় করতে লাগল কান্তর। সড়কটা উঁচু নিচু। এখান দিয়ে পালকি যেতে যেতে কতবার বেহারারা পা ভেঙে পড়ে গেছে। দিদিমার সঙ্গে বড়চাতরার রাস্তায় চলতে চলতে এমনি অন্যমনস্ক হয়ে যেত কান্ত। দিদিমা বলত–রাস্তার দিকে নজর দিয়ে চল, পড়ে যাবি যে

অথচ ভাবনা নাম করলে চলে! সারাফত আলি হয়তো তাকে দেখতে পেয়েছে। মৌতাতের মৌজে হয়তো ঠিক চিনতে পারেনি। চিনতে না-পারলেই ভাল। চিনতে পারলেই কাল আবার জিজ্ঞেস করত মিঞাসাহেব কাল তাঞ্জামে চড়িয়ে কাকে নিয়ে যাচ্ছিলে বাবুসাহেব?

কাটোয়ার সেই উদ্ধব দাসও সেপাইদের জিজ্ঞেস করেছিল–পালকিতে কোন বিবিজান যাচ্ছে গো?

সত্যিই বড় অদ্ভুত লোক ওই উদ্ধব দাস। কোনও বিকার নেই কোনও দুঃখ নেই। কেবল ঘোরে। ঘুরে বেড়িয়েই সারা পৃথিবীটা প্রদক্ষিণ করতে চায়। উদ্ধব দাস বলেছিল–আমি মানুষ নই প্রভু, আমি মানুষ নই আমার বউ পালাবে না তো কার বউ পালাবে বলুন?

তারপর বোধহয় কী মনে হয়েছিল, বলেছিল–তোমরা হাসছ সেপাইজান, কিন্তু হাসি নয়, খাঁটি কথা বলছি আমি! বউ পালিয়েছে বেশ করেছে। পালিয়ে গিয়ে বেঁচেছে হে! সে-মেয়ের আমার সঙ্গে বনবে কেন গো? সে মেয়ে যে ঠোঁটে আলতা লাগায়, তাম্বুল-বিহার না হলে মুখে পান রোচে না তার, পাশা খেলে! বাউন্ডুলে বরের সঙ্গে তার বনবে কেন প্রভু?

কান্ত আর থাকতে পারেনি। জিজ্ঞেস করেছিল তোমার বউকে কেমন দেখতে ছিল গো?

উদ্ধব দাস কান্তর দিকে চেয়ে হঠাৎ বলেছিল–আজ্ঞে প্রভু, আপনার সঙ্গে মানাত তার

সেপাই দুটো খুব হেসে উঠেছিল হোহো করে দূর বুড়ো, তুই থাম–

আজ্ঞে না সেপাইজি, আমি ঠিক বলছি, এই বাবুর সঙ্গে খুব মানাত, বাবুও দেখতে সুন্দর, আমার বউও দেখতে সুন্দর, দু’জনে মিলে সংসার আলো করে থাকত

কী ভেবে উদ্ধব দাস সেদিন কথাগুলো বলেছিল কে জানে! হয়তো রসিকতা করেছিল। কিংবা হয়তো রসিকতা করেনি। হয়তো সে সত্যি কথাই বলেছিল। কিন্তু উদ্ধব দাসের কথাটা এখনও ভুলতে পারেনি কান্ত, পরে একবার মরালীকে বলেছিল। মরালী প্রথমে কিছু উত্তর দেয়নি।

কান্ত বলেছিল সত্যি বলছি, তুমি বিশ্বাস করো, সত্যি সত্যিই দাসমশাই আমাকে সেই কথা বলেছিল–

মরালী তখন মরিয়ম বেগম। বলেছিল–তার কথা থাক–

কান্ত আর সে কথা নিয়ে বেশি পীড়াপীড়ি করেনি। শুধু বলেছিল–তার কথা সত্যি হলেই বোধহয় ভাল হত, না গো?

মরালী বলেছিল–ছিঃ, তোমার মুখে দেখছি কোনও কথাই আটকায় না—

কান্ত বলেছিল কিন্তু আমি যে কিছুতেই সে-সব কথা ভুলতে পারি না।

তা ভুলতে চেষ্টাও তো করবে। আমি তো ভুলে গেছি!

তোমার মতন মন হলে আমিও হয়তো ভুলতে পারতাম। কিন্তু আমার মনের গড়নটাই যে অন্যরকম। তোমার সঙ্গে তাই আমার কিছুই মেলে না দেখছি।

মরালী বলেছিল–মেলেই তো না। মিললে তুমি বিয়ের দিন ঠিক সময়ে এসে হাজির হতে! আমাকেও আর তা হলে এখানে এসে মরিয়ম বেগম হতে হত না!

কান্ত বলেছিল–তুমি মরিয়ম বেগমই হও আর যে-ই হও, আমার কাছে তুমি কিন্তু সেই মরালীই আছ!

মরালী ভয়ে ভয়ে চারদিকে চেয়ে বলেছিল–অত চেঁচিয়ো না, শেষকালে কেউ শুনে ফেললে মুশকিল হয়ে যাবে

মনে আছে, প্রত্যেক দিন কান্ত লুকিয়ে লুকিয়ে গিয়ে হাজির হত মরালীর কাছে। আর তারপর যখন না এসে উপায় থাকত না তখন পেছনের সুড়ঙ্গ দিয়ে বাইরে চলে আসত। বাইরে এসে আবার সেই সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের পেছনে গিয়ে নিজের আস্তানার মধ্যে চিতপাত হয়ে শুয়ে পড়ত। সে-সব একদিন গেছে। চকবাজারের ছোট্ট একটা দোকানঘরের মধ্যেই কান্তর জীবন-যৌবন-জীবিকা সবকিছু কেটে গিয়েছিল। কাটোয়ার সরাইখানার সামনে সেদিন উদ্ধব দাসের সঙ্গে পরিচয় না-হয়ে গেলে হয়তো এমন হত না। এমন করে ঘনিষ্ঠ হওয়াও যেত না মরালীর সঙ্গে। হয়তো পালকিতে করে রানিবিবিকে চেহেলসূতুনে পৌঁছিয়ে দিয়েই সে একথা ভুলে যেত। একেবারে। তার জীবন অন্য দিকে মোড় ফিরত! কিন্তু উদ্ধব দাসই তার সব বানচাল করে দিলে। উদ্ধব দাসকে দেখে উদ্ধব দাসের সঙ্গে কথা বলেই কান্তর জীবনের গতি অন্য দিকে ঘুরে গেল।

হঠাৎ রানিবিবির ডাকেই কান্ত আবার ফিরে গিয়েছিল সরাইখানার ভেতরে। রানিবিবিও তার জন্যে বোধহয় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল। জিজ্ঞেস করলে–দেখে এলেন? কে ও?

কান্ত বললে–ওর নাম উদ্ধব দাস–অদ্ভুত মানুষ!

কেন? কী করে জানলেন?

কান্ত বললে–আপনি শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, যার সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল, তার সঙ্গেই ওর বিয়ে হয়ে গেছে!

তারপর? ওর বউ কোথায় গেল?

সেই জন্যেই তো বলছি অদ্ভুত মানুষ। আমার ওরকম হলে আমি কিন্তু আত্মহত্যা করতুম। কিন্তু ও বেশ দিব্যি হেসে-খেলে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে–

তা ওর বউ কোথায় পালাল?

তা হলে শুনুন!

কান্ত বলতে লাগল তা হলে শুনুন, তাকে আর পাওয়া যাবে না।

কী করে জানলেন পাওয়া যাবে না?

আমি যেদিন আপনাকে আনতে হাতিয়াগড়ে গিয়েছিলুম না, সেইদিনই দেখলুম সেই বউকে খোঁজবার জন্যে হাতচালা হচ্ছে। আপনাদের বাড়ির ঝি দুর্গাকে চেনেন আপনি? আপনারই তো ঝি সে? চেনেন?

খুব চিনি! সে তুকতাক করে!

হ্যাঁ, দেখি সেই দুগ্যা নয়ানপিসি বলে একজন বিধবার হাত চালাচ্ছে আর বিড়বিড় করে মন্তর পড়ছে। কিন্তু সেই মরালীকে আর পাওয়া গেল না–

মরালী কে?

যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবার কথা হয়েছিল তারই নাম। তা দুগ্যা বললে–সে নাকি পুষ্যানক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় খেয়েছে, তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেবনর-গন্ধর্ব কেউ খুঁজে পাবে না। কথাটা দুগ্যা বললে–বটে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সব বুজরুকি। নিশ্চয়ই সে কোথাও লুকিয়ে আছে। আপনি কি তুকতাকে বিশ্বাস করেন?

কেন করব না। দুগ্যার দেওয়া মাদুলি পরে কত লোকের রোগ সেরে যেতে দেখেছি।

কিন্তু তা বলে অদৃশ্য হয়ে যাবে একেবারে? তাই কখনও হয়? আমি তো উদ্ধব দাসকে বলে এলাম, নিশ্চয়ই সে কোথাও লুকিয়ে আছে, আমি তাকে খুঁজে বার করব। আপনাকে মুর্শিদাবাদে পৌঁছিয়ে দিয়েই আমি আবার হাতিয়াগড়ে ওর বউকে খুঁজতে যাব–

ওর বউয়ের জন্যে আপনার তো দেখছি খুব মাথাব্যথা!

কান্ত বললে–আহা, আমি তো বুঝতে পারি বউ পালিয়ে গেলে মানুষের কীরকম কষ্ট হয়! ও অবশ্য মুখে কিছু বলছে না, হেসে হেসে ছড়া বানাচ্ছে আর গান গাইছে–কিন্তু মনে মনে তো কষ্ট হচ্ছে।

রানিবিবি বললে–ওর কষ্টের চেয়ে দেখছি আপনার কষ্টটাই যেন বেশি।

কিন্তু আমার জন্যেই তো ওর বউ পালাল!

আপনার জন্যে পালিয়েছে কে বললে?

ওই উদ্ধব দাসই তো বললে। বললে–আমার সঙ্গেই নাকি মরালীকে বেশি মানাত! ওর মতে ওকে পছন্দ হয়নি বলেই সে পালিয়েছে। আপনি নিজে রাজরানি, আপনি তো সাধারণ মানুষের মনের খবর রাখেন না।

রানিবিবি বললে–আমি রাজরানি হলেও সাধারণ গরিব ঘরেরই মেয়ে, আমি বুঝি

আপনি সাধারণ ঘরের মেয়ে?

আমি চাকদা’র মুখুটি বংশের মেয়ে। আমাদের বাড়িতে এক-একদিন ভাতই রান্না হত না–এত গরিব ছিলাম আমরা

কেন?

চাল থাকত না বলে। বাবা ছিলেন পণ্ডিত মানুষ। এঁরা আমাকে আমার রূপ দেখে পছন্দ করে বউ করে নিয়ে এসেছিলেন। আমি সাধারণ লোকের দুঃখকষ্ট খুব ভাল করেই বুঝি

কান্ত বললে–অথচ, কাল রাত থেকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভয় করছিল। ভাবছিলাম হয়তো আপনি আমার মতো গরিব লোকদের সঙ্গে কথাই বলবেন না। তাই মাঝিরা যখন কাল রাত্তিরে ডাকাতের ভয় দেখাল তখন আমি আর আপনাকে না ডেকে পারিনি

তারপর একটু থেমে আবার বললে–আচ্ছা, আর একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। কিছু মনে করবেন না–

বলুন না

আপনি কেন মুর্শিদাবাদ যাচ্ছেন? নবাবের ডিহিদার পরওয়ানা দিলে আর আপনিও চললেন? হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই কিছু আপত্তি করলেন না? আমি হলে তো আমার স্ত্রীকে কিছুতেই পরের হাতে তুলে দিতে পারতুম না, প্রাণ গেলেও না। সত্যিই কি নবাবকে আপনাদের এত ভয়?

রানিবিবি একটু হাসলেন। রানিবিবির হাসিটা খুব ভাল লাগল কান্তর। রানিবিবি বললেন–সকলে কি আপনার মতো সাহসী?

কান্ত বললে–সাহসের কথা হচ্ছে না, কেউ যদি কাউকে ভালবাসে তা হলে বিপদের দিনে তাকে ছাড়তে পারে? আর আমার কথা ছেড়ে দিন, চাকরির জন্যেই তো আমাকে এই পাপ করতে হচ্ছে–

পাপ যদি মনে করেন তো এ-চাকরি করতে গেলেন কেন?

আগে কি জানতুম চাকরি নিলে এই পাপ কাজ করতে হবে?

এখন তো জানলেন, এখন ছেড়ে দিন।

কান্ত বললে–ছাড়তে আমি এখনই পারি! না-হয় উপোসই করব। কিন্তু আপনার তাতে তো কোনও লাভ হবে না। আমি না হলে অন্য কেউ আপনাকে নিয়ে গিয়ে পুরে দেবে হারেমের ভেতরে। তখন?

আমার কথা ছেড়ে দিন! আমার যা হবার তা হবেই। আমি সবকিছুর জন্যেই তৈরি

কান্ত বললে–কিন্তু আমি বলছি আপনাকে, আপনি না এলেই ভাল করতেন-নাটোরের মহারানি রানিভবানীর নাম শুনেছেন তো?

হ্যাঁ!

তা হলে চুপি চুপি আপনাকে একটা কথা বলি। কাউকে বলবেন না, তার মেয়েকেও একদিন আপনার মতন ডেকে পাঠিয়েছিল নবাব–তা জানেন?

তাই নাকি?

হ্যাঁ, আমাকে চকবাজারের গন্ধতেলের দোকানের মালিক সারাফত আলি সব বলেছে! নবাব তো লোক ভাল নয়। তা ছাড়া তার ইয়ারবকশি যারা আছে, তারাও খারাপ লোক। সেই রানিভবানী নবাবের পরোয়ানা পেয়েই এক কাণ্ড করলেন–

কিন্তু রানিভবানীর মেয়েকে নবাব দেখলে কী করে?

নবাব নৌকো করে যাচ্ছিল আর ওদিকে রানিভবানীর মেয়ে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে রোদ্দুরে চুল শুকোচ্ছিল, তখনই নবাবের নজরে পড়ে গেছে। তা তারপর রানিভবানী করলেন কী, দু’দিন পরেই শ্মশানে একটা খালি চিতা সাজিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। রটিয়ে দিলেন যে তার মেয়ে হঠাৎ অসুখ হয়ে মারা গেছে আর ওদিকে মেয়েকে এক সাধুর আশ্রমে লুকিয়ে রাখলেন! আপনিও তো সেই রকম কিছু করতে পারতেন। কেন আপনি আসতে গেলেন এমন করে? ওখানে গেলে আপনার ধর্ম থাকবে না তা বলে রাখছি–আপনি হিন্দু আমিও হিন্দু আপনাকে বিশ্বাস করে সব কথা বললুম!

তারপর আবার গলা নিচু করে বললে–দেখুন, এখনও সময় আছে, আপনি পালিয়ে যান

তার মানে?

সামনের দিকে আমগাছতলায় সেপাই দুটো উদ্ধব দাসের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছে। বেহারারাও গা এলিয়ে দিয়েছে সেখানে। আপনি এই পেছনের দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে যান না। ওই বাদিটা আছে, ওকে কোনও কাজের ছুতো করে কোথা থেকে জলটল আনতে বলে দিন। সেই ফাঁকে আপনি বেরিয়ে যান। এখান থেকে সামনে গঙ্গা পাবেন, সেই গঙ্গার পাড় ধরে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যান–আর যদি কেউ আপনার দামি শাড়ি দেখে সন্দেহ করে তো একটা না-হয় ময়লা আটপৌরে শাড়ি পরে নিন। সঙ্গে আটপৌরে শাড়ি নেই আপনার?

কিন্তু তাতে আপনার কিছু ক্ষতি হবে না?

আমার ক্ষতি হোক গে! আপনি তো আগে বাঁচুন! আমি আমার একটা পেট যে-কোনও রকমে হোক চালিয়ে নেব। তার চেয়ে আপনার ধর্মটাই বড়।

বড় দেরিতে আপনার জ্ঞান হল দেখছি।

কান্ত বললে–না, কাল রাত্তিরেই আমার মনে হয়েছিল এ আমি কী করছি। আজ উদ্ধব দাসকে দেখেও এই কথাই আমার মনে হচ্ছিল–এ আমি কী করছি! না, আমি বলছি আপনি পালান ওই খিড়কির দরজাটা খুলে চলে যান, আমি বাইরেটা একবার দেখে আসছি

কিন্তু আপনি? আপনি কী বলবেন ডিহিদারকে? ডিহিদার যখন আপনাকে জিজ্ঞেস করবে রানিবিবি কোথায়, কেমন করে পালাল, তখন!

আমার কথা আমি পরে ভাবব। সে ভাববার অনেক সময় আছে। আপনি আগে যান, আমার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না

রানিবিবি খানিকক্ষণ কী যেন ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন তার চেয়ে দুজনে মিলে একসঙ্গে পালালে কেমন হয়?–আপনিও আমার সঙ্গে চলুন না আপনি থাকলে অনেক সুবিধে হত!

কান্ত একটু মনে মনে ভাবতে লাগল।

কিন্তু আমাকেই বা আপনি বিশ্বাস করতে পারলেন কী করে? আমিও তো আপনার ক্ষতি করতে পারি!

কী ক্ষতি? আপনি আমার কী ক্ষতি করবেন?

না, আমাকে তো আপনি ভাল করে চেনেন না এখনও।

রানিবিবি বললেন–না, আপনাকে আমি চিনি।

আমাকে চেনেন আপনি?

আপনি যে ভোরবেলা নিজের নাম বললেন। আপনার নিজের পরিচয় দিলেন!

কান্ত বললে–সে তো ভারী, সেইটুকুতেই কি একজন মানুষকে চেনা যায়? আর আমি কোথায় নিয়ে যাব আপনাকে? হাতিয়াগড়ে?

রানিবিবি বললেন–না, সেখানে গেলে জানাজানি হয়ে যাবে! তাদের সকলের সর্বনাশ হবে!

তা হলে কোথায় যাবেন?

রানিবিবি বললেন–অন্য যে-কোনও জায়গায়। যেখানে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারব।

কেন? আপনার বাপের বাড়ি নেই? কোনও আত্মীয়স্বজন?

আমি তো বললুম আমি গরিবের মেয়ে। বিয়ের পরই বাবা মারা গেছেন, আর কেউ কোথাও নেই, এক শ্বশুরবাড়ি ছাড়া!

কান্ত যেন মুশকিলে পড়ল। রানবিবিকে নিয়ে কোথায় যাবে সে। তার নিজেরই কি কোনও জায়গা আছে যাবার! এক আছে বড়চাতরা! কিন্তু সেখানে গেলেও হয়তো নবাবের চর পেছন পেছন গিয়ে পৌঁছোবে। আর বড়চাতরার লোকেরাই যদি জিজ্ঞেস করে সঙ্গে কে? তখন কী উত্তর দেবে কান্ত! কী পরিচয় দেবে!

হঠাৎ কান্ত একটা কাণ্ড করে বসল। বললে–দাঁড়ান, আমি বাইরে গিয়ে দেখে আসি ওরা কী করছে। এখন আর খিড়কির দিকটাও দেখে আসি আপনি ততক্ষণে শাড়িটা বদলে নিন–

বলে কান্ত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রাজবাড়ি থেকে তখন ফিরছিল শোভারাম। কাজ থাক আর না-থাক শোভারামকে গিয়ে নিয়ম করে হাজরে দিতে হয়। সকাল থেকে তেল-গামছা নিয়ে ছোটমশাইয়ের জন্যে বসে থাকতে হয়। তারপর গোকুল হোক কি হরিপদ হক, কাউকে দেখলেই জিজ্ঞেস করে হ্যাঁগো, ছোটমশাই নীচেয় নামবেন না?

সেই সেদিন থেকেই ছোটমশাইয়ের অসুখ। কাছারি বাড়িতেও আসেন না। দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া করে আবার আর একবার যায় রাজবাড়িতে। তখন দুপুরবেলা ঘুম থেকে উঠে একবার ছোটমশাই নীচেয় নামেন। কাছারিবাড়িতে আসেন। খাতাপত্র দেখেন। কদিন ধরে তা-ও করছেন না।

পথে দুর্গার সঙ্গে হঠাৎ দেখা। দুর্গাই আগ বাড়িয়ে বললে।

বললে–আর ভাবনা নেই গো শোভারাম, তোমার মেয়েকে পাওয়া গিয়েছে

শোভারাম তো অবাক! এতদিন পরে পাওয়া গেল?

একেবারে দুর্গার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল। কোথায় পেলে গো? কী করে পেলে?

দুর্গা বললে–বড় কষ্ট হয়েছে গো! তিন দিন তিন রাত অষ্টসিদ্ধি জপ করলাম। জপ করতে করতে দেবলোক নরলোক গন্ধর্বলোক সব খুঁজে খুঁজে হয়রান। শেষকালে গেলাম, দৈত্যলোকে, গিয়ে দেখি ছুঁড়ি ঘাপটি মেরে বসে আছে। তখন চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে এলুম। বললুম চল ঘুড়ি চল, তোর বাপ এদিকে কান্নাকাটি করে মরছে, আর তুই এখেনে ঘাপটি মেরে বসে আছিস। চল

কথাগুলো শুনতে শুনতে শোভারাম একেবারে মাটিতে বসে পড়ল। শোভারামের কাণ্ড দেখে এতদিন সবাই তাকে পাগল বলেছে। পাগল ছাড়া আর কী। মেয়ে পালিয়ে গেছে বলে মানুষ বিবাগী হয়েছে এমন ঘটনা কেউ আগে শোনেনি। আর চলে গেছে তো বেশ করেছে। মেয়ে তো গলার কাটা গো। তার বিয়েও দিতে হবে, আবার চিরকাল তার ভালমন্দ দেখতে হবে।

শোভারাম সেই অবস্থাতেই যেন কেঁদে ফেলবার জোগাড় করলে। জিজ্ঞেস করলে–মরি আমার কেমন আছে দুগ্যা? আমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে তো তার?

তা কষ্ট হবে না? বাপ বলে কথা! আমি খুব শুনিয়ে দিলুম তাকে, বললুম-হালা ছুঁড়ি, তোর বাপ ওদিকে কেঁদে কেঁদে হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছে আর তুই এখেনে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছিস? তোর আক্কেল তো খুব লা?

তুমি বললে–তাকে এই কথা?

বলব না তো কি ভয়ে চুপ করে থাকব?

শোভারাম বললে–তা তো বটেই, তা জিজ্ঞেস করলে না কেন যে, পুষ্যানক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় খেতে গেল কেন সে? কেন মরতে ও-বিষ খেতে গিয়েছিল? আমি কী অপরাধটা করেছিলুম?

জিজ্ঞেস করেছি। আমি ছাড়িনি। মুখপুড়িকে আমি জিজ্ঞেস করলুম–তুই আর খাবার জিনিস পেলিনে? পুষ্যানক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তী শেকড় কেউ খায় রে?

তা কী বললে–সে?

কিছুতেই জবাব দেয় না সে কথার। আমাকে তো চেনে না। আমিও তেমনি মেয়ে। আমি তখন স্তম্ভন আরম্ভ করলুম। আমার কাছে দুধ-অপরাজিতার শেকড় ছিল, তাই মুখে পুরে দিয়ে আটবার পরি-সাধন মন্তরটা জপ করতে লাগলুম। তখন যাবে কোথায়, গড়গড় করে সব বলে ফেললে

কী বললে?

বললে–আমি যা ভেবেছি তাই ঠিক–বর পছন্দ হয়নি!

শোভারাম আরও অবাক হয়ে গেল। বললে–তা বর পছন্দ হয়নি বলে নিজের বাপকে ত্যাগ করে গেল সে? অ্যাদ্দিন যে তাকে খাওয়ালুম পরালুম, মানুষ করলুম, তার কিছু দাম নেই রে? আমার কথাও একবার তার মনে পড়ল না? এই যে আমার খাওয়া নেই দাওয়া নেই ঘুম নেই, সেটাও কিছু নয়?

দুর্গা বললে–আমি তাও বলিছি, আমি ছাড়িনি। বললুম–তুই নিজের বাপকে যে এত কষ্ট দিলি এতে কি তোর ভাল হবে ভেবেছিস? তোর মেয়ে হলে তোকেও যে সে এমনি করে ভোগাবে রে!

না না দুগ্যা! আমি যেমন ভুগছি, মরি যেন এমন করে না ভোগে। আমাকে ছেড়ে যদি সে সুখী থাকে তো তাও ভাল। এমন কষ্ট যেন কেউ না পায়। তা থাকগে, মরি কোথায় আছে এখন

দুর্গা বললে–সেই কথাই তো তোমাকে বলছি শোভারাম, মেয়েকে তো তোমার এনেছি, কিন্তু একটা কথা আছে…

কী কথা?

দৈত্যলোক থেকে তোমার মেয়েকে তো ছাড়িয়ে আনছি, এমন সময় দৈত্যরাজ ধরলে আমাকে, বললে–মরালীকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? আমি বললুম–মহারাজ, এর বাপ কান্নাকাটি করছে, একে একবার দেখতে চায় সে। সে বড় দুঃখী মানুষ। এই মেয়ে ছাড়া তার কেউ নেই। অনেক করে বলতে তবে বোধহয় একটু মায়া হল বেটার। বললে–নিয়ে যা তার মেয়েকে, কিন্তু খবরদার বলছি, এর বাপ যদি এর মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখে তো আবার এখেনে টেনে নিয়ে আসব

তা নিজের মেয়ের দিকে মুখ তুলে চাইতে পারব না?

না বাপু না, চাইতেও পারবে না, আর তোমার মেয়েকে যে ফিরে পেয়েছ তাও কাউকে বলতে পারবে না।

শোভারাম কেঁদে ফেললে ও দুগ্যা, তা হলে আমি বাঁচব কী নিয়ে?

দুর্গা বললে–তা হলে তুমি নিজেই বাঁচো, মেয়ের কথা আর মুখে এনো না। আমাকে বাপু দৈত্যরাজ পইপই করে ওই কথা বলে রেখেছে, আমি কী করব, আমি তবু অনেক কষ্ট করে তোমার মেয়েকে যে খুঁজে বার করতে পেরেছি এই-ই যথেষ্ট! আমি এখন চলি গো, আমার অনেক কাজ ওদিকে….

শোভারাম পেছন পেছন গেল। বললে–তা সে কোথায় আছে তা তো বললে–না গো!

কোথায় আবার, রাজবাড়িতে! রাজবাড়িতেই লুকিয়ে রেখেছি, নইলে তো তোমারই বিপদ, তুমি আবার কোনদিন মেয়েকে দেখে ফেলবে তখন তোমারও সব্বোনাশ, মরিরও সব্বোনাশ

তা তার সঙ্গে একবার কথাও বলতে পারব না আমি?

দুর্গা বললে–কথা আমি তার সঙ্গে বলিয়ে দেব, কিন্তু দেখা না করলেই হল!

কখন কথা বলব?

সে তোমায় আমি খবর দেবখন–বলে খরখর করে দুর্গা রাজবাড়ির দিকে চলে গেল। শোভারামও পেছন পেছন গেল, কিন্তু দুর্গার তখন আর সময় নেই। সেই রাজবাড়ির দেউড়ির সামনে দাঁড়িয়েই খানিকক্ষণ বোবার মতন চারদিকে চেয়ে রইল শোভারাম।

জগা খাজাঞ্চি হন্তদন্ত হয়ে আসছিল রাজবাড়ির দিকে। সে শোভারামের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। বললে–কী রে, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছিস, একলা?

শোভারাম তবু উত্তর দেয় না। সে যেন জগা খাজাঞ্চিকে চিনতেই পারলে না। দেখা হলে জগা খাজাঞ্চিকে বরাবর প্রণাম করে এসেছে আগে। আজ যেন জগা খাজাঞ্চি কে-না-কে!

কী রে, কথা বলছিস না কেন? কী হল তোর? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখছিস কী?

তবু উত্তর দেয় না শোভারাম। সরকারমশাই আসছিল খাত্তাপত্তর নিয়ে। সে-ও দাঁড়িয়ে গেল।

শোভারামের কী হয়েছে বলে তো সরকারমশাই? পাগল হয়ে গেল নাকি?

সরকারমশাইও থমকে দাঁড়াল। ভাল করে চেয়ে দেখলে শোভারামের দিকে। জিজ্ঞেস করলে কী রে শোভারাম, কী হয়েছে তোর? অসুখ করেছে?

শোভারাম বিড়বিড় করে বললে–দৈত্যরাজ…

দৈত্যরাজ? সে আবার কে রে বাবা? কোথায় দৈত্যরাজ? দৈত্যরাজ কী করেছে তোর?

দেখতে দেখতে আরও কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে গেল দেউড়ির সামনে। অতিথিশালায় যারা সেদিন এসে জুটেছিল তারাও বাইরে এসে মজা দেখতে লাগল। হরিপদ, গোকুল তারাও এসে দাঁড়াল।

শোভারাম তখন হঠাৎ বলে উঠল–অষ্টসিদ্ধি..

একজন বললে–পাগল বুঝি লোকটা?

আর একজন চিনতে পেরেছে। সে বললে–এ শোভারাম না? সেবার তো এমন ছিল না! এমন হল কী করে?

তা পাগলাকালীর বালা পরিয়ে দেয় না কেন? এর কে আছে গা?

কে আর থাকবে, কেউই নেই। এক মেয়ে ছিল, সে পালিয়ে যাবার পর থেকেই অমনি। এবার বেড়েছে দেখছি। আহা

জগা খাজাঞ্চিবাবু তখন শোভারামের সামনে গিয়ে হাত-মুখ নেড়ে বললে–তুমি বাড়ি যাও শোভারাম, বাড়িতে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকো গে, বুঝলে?

সরকারমশাই বললেইস, মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গেল গো

গোকুলও দেখছিল সব। সামনে এগিয়ে এসে বললে–ও শোভারাম, শোভারাম–

অ্যাঁ?

শোভারাম চাইলে গোকুলের মুখের দিকে।

গোকুল জিজ্ঞেস করলে কী হয়েছে তোমার বলো তো? কী হয়েছে? আমাকে চিনতে পারছ? আমি কে বলো তো?

শোভারাম আবার বিড়বিড় করে বলে উঠল–অষ্টসিদ্ধি.

সরকারমশাই বলে উঠল–এই রে, মাথাটা খেয়েছে একেবারে, যা গোকুল, ওকে বাড়িতে পৌঁছে। দিয়ে আয়

ভিড়ের মধ্যে এতক্ষণ একজন চুপি চুপি সব শুনছিল। অতিথিশালার লোজন, গোকুল, হরিপদ, জগা খাজাঞ্চিবাবু, সরকারমশাই সবাই যখন একবার পর একটা প্রশ্ন করে চলেছে তখন সে লোকটা সকলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখছিল। তারপর যখন গোকুল শোভারামকে নিয়ে তার বাড়ির দিকে পৌঁছিয়ে দিতে গেল তখনও সে-লোকটা সঙ্গে সঙ্গে চলেছে।

গোকুল বলছিল–তুমি একটু মেয়ের কথা ভাবা ছেড়ে দাও দিকিনি ধরে নাও না মেয়ে তোমার মরে গেছে শোভারাম। চিরটা কাল কি আর সবাই বাঁচে। তোমার নিজের শরীরটার দিকেও তো দেখতে হবে। ধরে নাও না মেয়ে তোমার সুখে আছে, ধরে নাও না মেয়েকে তোমার নবাবের লোক চুরি করে নিয়ে গেছে। চুরি কি হয় না? তা হলে তাই নিয়ে ভেবে ভেবে তুমি নিজের মাথাটা খারাপ করবে?

শোভারাম বললে–দৈত্যরাজ…

কী ছাই বাজে কথা বলছ? দৈত্যরাজের মাথায় মারি ঝাটা! কোথায় দৈত্যরাজ? দৈত্যরাজ তোমার মেয়েকে চুরি করে নিয়ে গেছে, কে বললে? কে বলেছে শুনি? বিশু? হরিপদ? দুগ্যা?

শোভারাম হঠাৎ বলে উঠল–দুগ্যা…

গোকুল এক ধমকানি দিলে ধ্যেত, দুগ্যা আর বলবার লোক পেলে না, তোমাকে বলতে গেছে। দুগ্যা কি নবাবকে দেখেছে? দুগ্যার চোদ্দোপুরুষ নবাবকে দেখেছে? আর নবাবের কি মেয়েছেলের অভাব যে তোমার একফেঁটা মেয়েকে চুরি করে নিয়ে যাবে?

শোভারাম আবার দুম করে বলে উঠল–অষ্টসিদ্ধি…

গোকুল সেকথায় কান না দিয়ে বাইরে থেকে ডাকলে ও নয়ানপিসি, পিসি–

ডাকতে ডাকতে দু’জনেই বাড়ির ভেতরে চলে গেল। সঙ্গে অন্য যারা ছিল তারাও সদর পেরিয়ে বাড়ির উঠোনে ঢুকল।

লোকটা এতক্ষণ সব দেখছিল, শুনছিল, তারপর সবাই যখন ভেতরে গেল, তখন সোজা উলটোদিকে চলতে লাগল। তারপর যখন খানিকটা এসে মুসলমান পাড়ায় পা দিয়েছে, তখন আরও জোরে পা চালিয়ে দিয়েছে। তারপর এক দৌড়ে সোজা একেবারে ডিহিদারের দফতরে গিয়ে হাজির। বাইরে ফিরিঙ্গি’কে দেখেই বোঝা গিয়েছিল, রেজা আলি ভেতরে আছে। লোকটা ভেতরে যেতেই রেজা আলি তাকিয়ে দেখলে।

কী রে জনার্দন, হাঁপাচ্ছিস কেন? কেউ তাড়া করেছে?

জনার্দন বললে–হুজুর, খবর আছে

কী খবর? নেসার সাহেবের সঙ্গে মোলাকাত হল?

হয়েছে হুজুর, কিন্তু মুর্শিদাবাদে বড় গোলমাল চলছে। গুজব রটেছে যে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই বাধবে।

রেজা আলি জিজ্ঞেস করল–নবাবের এখন মেজাজ কেমন?

হুজুর, নবাব তো সকলকে তলব দিয়েছিল মতিঝিলে। মেহেদি নেসার সাহেব, মোহনলালজি, মিরমদনজি, মিরজাফর সাহেব, সবাইকে ডেকে একটা ফয়সালা করবার চেষ্টা করেছে। মিরজাফর সাহেবকে খুব বুঝিয়ে বলেছে নবাব যে, তুমি হচ্ছ আমার পুরনো আত্মীয়, আমার ঘরের লোক, তুমি যদি আমার এই বিপদের দিনে না দেখো তো কে দেখবে? তোমার ওপর ভরসা করেই তো আমি মসনদে বসেছি।

মিরজাফর সাহেবের সঙ্গে তা হলে নবাবের দোস্তি হয়ে গেছে আবার?

জনার্দন বললে–হুজুর, আমি তো শুনলুম সকলের সামনে নবাব মিরজাফর সাহেবের হাত ধরে নাকি কেঁদেছে নাকি কাঁদতে কাঁদতে মিরজাফর সাহেবকে দুই হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছে–

এত দূর গড়িয়েছে তা হলে?

হুজুর, নেয়ামত তো তাই আমাকে বললে।

নেয়ামত কে?

আজ্ঞে, মতিঝিলের খিদমদগার। তাকে খুব পান জরদা কাশীর খুশবু কিমাম খাইয়ে তো হাত করেছিলাম। খুব তোয়াজ করে তাকে জিজ্ঞেস করলুম-ইয়ার, সেদিন মতিঝিলের জমায়েতে কী সব সল্লা হল বলল আমাকেও তো সব আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে শোনে, মেহেদি নেসার সাহেবকে তো ও-ই চেহেল্‌-সুতুন থেকে ডেকে এনেছিল। ও বলছিল–মালুম হচ্ছে শায়েদ লড়াই হবে। নবাবের কথায় মিরজাফরের মন টলেছে, নবাবের কান্না দেখে মিরজাফর সাহেব আর চুপ করে থাকতে পারেনি, মিরজাফর সাহেবের চোখ দিয়েও নাকি পানি পড়ছিল–

রেজা আলি কথাটা শুনে নিজের মনেই কী যেন মতলব আঁটতে লাগল।

জনার্দন হঠাৎ আবার বললে–হুজুর, আর একটা কথা

বলে আরও কাছে সরে এল–

আর একটা কথা। কথাটা কারও সামনে বলতে চাই না হুজুর। হুজুরের নিমক খাই, তাই হুজুরকেই। বলছি। হাতিয়াগড়ে এসে দেখি রাজবাড়ির সামনে খুব ভিড়।

কেন? জানাজানি হয়ে গেছে নাকি?

সেই কথাই তো বলছি। সেই যে মেয়েটা পালিয়ে গিয়েছিল বিয়ের রাত্তিরে, শুনেছেন তো? সেই যে সেই মরালী? তার বাপ শোভারাম, সেই শোভারামটা হঠাৎ দেখি পাগল হয়ে গেছে, একেবারে বদ্ধ। পাগল। এতদিন মেয়েটা পালিয়ে গিয়েছে, তাতে কিছু হয়নি, হঠাৎ এখন অ্যাদ্দিন পরে পাগল হল কেন? আমার তো হুজুর একটা সন্দেহ হচ্ছে।

কী?

হুজুর, আমরা সেদিন রানিবিবিকে বজরা করে কাটোয়া পাঠিয়ে দিয়েছি, কিন্তু কাকে পাঠাচ্ছি তা তো পরখ করে দেখিনি হুজুর! অন্ধকারে ঘোমটা দিয়ে তাঞ্জামে তোলবার পর দরওয়াজা বন্ধ করে দিলুম। কিন্তু মুখ তো দেখিনি, যদি ভেজাল মাল পাঠিয়ে থাকে দুশমনি করে?

কে দুশমনি করবে? হাতিয়াগড়ের রাজা? ওটা তো একটা আসলি উজবুক রে। আর ও তো তখন কোঠিতে ছিল না কেষ্টনগরে মহারাজার সঙ্গে সল্লা করতে গিয়েছিল

কিন্তু বড় রানিবিবি তো ছিল হুজুর। সে তো দুশমনি করতে পারে? আর ওই ঝি-টা! দুগ্যা! ওই দুগ্যামাগিটি হুজুর কুটনি! ও সব পারে। ভেজাল মালকে আসল মাল বলে অনায়াসে চালিয়ে দিতে পারে! নইলে শোভারাম হঠাৎ পাগল হয়ে যাবে কেন, হুজুর, তাই বলুন!

রেজা আলি ডিহিদার মানুষ। হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় কাজ করে না কখনও। অনেক দিন থেকে ডিহিদারি করে আসছে। আরও প্রথম জীবনে মুর্শিদাবাদের নিজামতে আমিন কাছারি ছিল। তারপর নিজের বুদ্ধির কেরামতিতে একদিন দারোগা-কাছারি হয়েছিল। তারপর ধাপে ধাপে হুজুর-নবিস, খাসনবিস, মসরেফ, মুস্তোফি হয়ে শেষ পর্যন্ত ডিহিদার। এর পরে যদি ফৌজদার হতে পারে তবেই জিন্দগি খুশ হয়ে যাবে রেজা আলির। সেই পথটাই এতদিন খুঁজে পাচ্ছিল না। জনার্দনের কথায় যেন আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠল মগজের মধ্যে! তোবা! তোবা! এই তো সুযোগ!

আর হুজুর, এত বড় কাণ্ড ঘটে গেল, জগা খাজাঞ্চি কি কানুনগো কাছারির সরকার কিছুই জানতে পারলে না, এতেও আমার বড় সন্দেহ হচ্ছে হুজুর!

তা হলে এক কাজ কর তুই জনার্দন!

কী কাজ, বলুন হুজুর!

রেজা আলি নিজের ডান হাতের একটা আঙুল দিয়ে নিজের কপালে টোকা মারলে। অর্থাৎ মতলবটা মগজে এবার পাকা হয়ে বসে গেছে। বললে–তুই এক কাজ কর,–ওই শোভারাম বেটা তো মস্তানা হয়ে গেছে, ঠিক তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর! আমি নিজের চোখেই তো সেটা দেখে এলুম–

তা হলে ছোটমশাইয়ের নোকোরের কাম করবে কে? ওকে দিয়ে তো আর কাম চলবে না। অন্য নোকর তো দরকার। তুই গিয়ে ওর নোকরিটা নে। আমিও তোর তলব দেব, রাজবাড়ি থেকেও তলব পাবি। দুনো আয় করবি–আর ভেতরের খবর জেনে নিবি–যা–

জনার্দন ভক্তিতে গদগদ হয়ে বারবার মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করতে লাগল রেজা আলিকে হুজুর, দেখবেন হুজুর গরিবকে, এ-গরিব কাফের বটে, কিন্তু হুজুরের নিমক খায়, নিজামতের একটা পাকা নোকরি আমাকে করে দিতে হবে হুজুর, বড় গরিব আমি হুজুর, হুজুর মেহেরবান…।

আচ্ছা তুই এখন যা, দেখি তুই কেমন কাম হাসিল করিস বলে রেজা আলি আবার মৌচে তা’ দিতে লাগল। মনে মনে আবার বলতে লাগল তোবা! তোবা! এই তো সুযোগ! মেহেদি নেসার সাহেবকে কেরামতি দেখাবার এই-ই তো সুযোগ!

বাংলার অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ইতিহাস বড় বেদনার ইতিহাস। মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে, সুজাউদ্দিন, রায়-রায়ান আলমচাঁদ, সরফরাজ খাঁ, আলিবর্দি, হাজি মহম্মদের পর যে-ইতিহাস সে-ইতিহাস নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌল্লা, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ইতিহাস। মিরজাফর, মোহনলাল, ক্লাইভ, ড্রেক, উমিচাঁদ, ম্যানিংহাম, কিলপ্যাট্রিক, ওয়াটস্-এর ইতিহাস। ফরাসি ডাচ পর্তুগিজদেরও ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসই ভারতবর্ষের ইতিহাস। এই শোভারাম জনার্দন, ষষ্ঠীপদ, সচ্চরিত্র, কান্ত, উদ্ধব দাস, মেহেদি নেসার, দুর্গা, নয়ানপিসি, নন্দরানিরাই সে-ইতিহাস সেদিন কালের খাতায় পাতার পর পাতা লিখেছিল। আর উদ্ধব দাস শুধু লিখেছিল বেগম মেরী বিশ্বাস।

আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগের মানুষ আজকের মতোই ভালবেসেছিল, ষড়যন্ত্র করেছিল, খুন করেছিল আর স্বার্থসিদ্ধি করেছিল। সেদিনও দেশের মানুষ এমনি করেই অসহায়ের মতো ভাগ্যের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ মনে করেছিল। যেনবাব সে-দেশের কথা ভাবুক, যে-মন্ত্রী সে-মন্ত্রণা দিক, তোমার আমার কিছু করবার নেই। এসো আমরা সবাই মিলে দুটো পয়সা উপায়ের চেষ্টা দেখি। তুমি রাজা, তুমি আমাকে জায়গির দাও, আমাকে খেতে পরতে দাও, আমি তোমাকে নিয়ে অন্নদামঙ্গল’ মহাকাব্য লিখব। আমি লিখে দেব–ভবানন্দ মজুমদার দেবীর বরপুত্র। তুমি অন্যায় করো, অত্যাচার করো, উৎপীড়ন করো, তাতে কিছু ক্ষতি নেই। আমি আমার মহাকাব্যে তোমাকে। দেবতা করে তুলব।

তাই উদ্ধব দাস বলত–আমিও এক কাব্য লিখব গো, আমিও লিখব—

মোল্লাহাটের মধুসূদন কর্মকার জিজ্ঞেস করত তা তুমিও কি রায়গুণাকর ভারতচন্দোরের মতো অন্নদামঙ্গল লিখবে নাকি?

আজ্ঞে না প্রভু, রায়গুণাকর তো ঘুষ খেয়ে মিথ্যে কথা লিখেছে-

-ঘুষ খেয়ে? তুমি বলছ কী দাসমশাই?

হ্যাঁ গো, আমি ঠিক বলছি। রায়গুণাকর তো ঘরের ভেঁকি কুমির। নইলে প্রতাপাদিত্য গেল, কেদার। রায় গেল, চাঁদ রায় গেল, ভবানন্দ মজুমদারকেই বীরস্য বীর তৈরি করলে রায়গুণাকর।

তা তুমি কাকে নিয়ে লিখবে?

উদ্ধব দাস বলত–তাকে তোমরা জানো না, তার নাম বেগম মেরী বিশ্বাস!

ওমা, সে আবার কে গা?

সে যখন লিখব তখন তোমরা দেখতে পাবে।

উদ্ধব দাস হাসত আর বলত–সেসব কী দিন গেছে, তোমরা তো জানো না, এখন তো ফিরিঙ্গি রাজত্ব, এখন তো তোমরা সে-সব কথা ভুলে গেছ। কিন্তু আমি ভুলিনি গো! সে ভোলবার নয়–

সত্যিই উদ্ধব দাস কিছুই লিখতে ভোলেনি। যা দেখেছে, যা শুনেছে, সব লিখেছে। কাটোয়ার গঙ্গার ঘাট থেকে অনেক দূর যেতে যেতে হঠাৎ মনে হল এদিকে গিয়ে আর লাভ কী! ডিহিদারের লোক পালকি নিয়ে আসতেই উদ্ধব দাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।

আরে এখানে লোকটা কেন? ভাগো, ভাগো হিয়াসে—

ঠিক আছে! উদ্ধব দাসকে খাতির করলেও যা, তাড়িয়ে দিলেও তাই। নির্বিকার। একদিন আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে তোমরা রাজত্ব করছ, আবার একদিন তোমাদের তাড়িয়ে দিয়ে আর-একজনরা রাজত্ব করবে! কেউ এখানে চিরটা কাল রাজত্ব করতে আসেনি। এইটেই যে নিয়ম গো। চিরটা কাল রাজত্ব করবে শুধু সেই একজন। সে-ই মালিক। তা তুই এত বড় ঘুষখোর, সেই আসল মালিককে ছেড়ে দিয়ে ভবানন্দ মজুমদারের গুণ গাইলি?

যশোর নগর ধাম
প্রতাপ আদিত্য নাম
মহারাজ বঙ্গজ কায়স্থ।
নাহি মানে পাতশায়।
কেহ নাহি আঁটে তায়
ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ।
তার খুড়া মহাশয়।
আছিল বসন্ত রায়,
রাজা তারে সবংশে কাটিল।
তার বেটা কচু রায়,
রানি বাঁচাইল তায়,
জাহাঙ্গিরে সে-ই জাঁনাইল।
ক্রোধ হইল পাতশায়
বান্ধিয়া আনিতে তায়
রাজা মানসিংহে পাঠাইলা।
বাইশি লস্কর সঙ্গে
কচু রায় লয়ে বঙ্গে
মানসিংহ বাঙ্গালা আইলা।

কচু লেখা। নিমকহারাম মানসিংহের দাস ভবানন্দকে দেবতা বানিয়ে কী লাভ হল শুনি তোর? সত্যি। কথা লিখলে তোকে উপাধি দেবে না বলে? ছাই, ছাই, উপাধির মুখে ঝাটা মারি! আমি কাকে ভয় করি গো? আমার কাউকে ভয় করতে বয়ে গেছে। আমি লিখব সত্যি কথা। আমি লিখব আর একখানা অন্নদামঙ্গল।

এমনি করেই পাটুলির রাস্তা দিয়ে চলছিল উদ্ধব দাস। হঠাৎ সামনে কাকে দেখে থমকে গেল। কে গো তুমি মশাই। তোমাকে চেনা চেনা ঠেকছে যেন?

উলটো দিক দিয়ে আর একটা নোকও আসছিল। হাতে কতকগুলি পুঁথিপত্র। উদ্ধব দাসকে দেখে মুখটা আড়াল করে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। কী গো? অমন করে আমাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছ কেন?

লোকটা এবার দৌড়োত লাগল। উদ্ধব দাসও দৌড়োতে লাগল। ধরো ধরো ওকে। ধরো!

চিৎকার শুনে খেতের কিছু লোক দৌড়ে এসেছে। তারাই ধরে ফেললে লোকটাকে! লোকটা বুড়ো মতন। ধরতেই কেঁদে ফেলেছে একেবারে হাউহাউ করে। একেবারে অঝোর ধারায় কান্না।

আরে, সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ না?

চিনতে পেরেছে উদ্ধব দাস। এই সচ্চরিত্রই ঘটকালি করেছিল বিয়েটার।

আজ্ঞে আমাকে ছুঁয়ে দিলেন? আমার যে জাত গেছে! আমার জাত কুল-পেশা সব যে গেছে, আমার বউ-ছেলে-মেয়ে সব গেছে–

বলে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল সচ্চরিত্র।

উদ্ধব দাস হেসে উঠল হো হো করে। বললে–কেন গো? কীসে গেল তোমার জাত, শুনি?

সচ্চরিত্র বললে–আমাকে ম্লেচ্ছ-মাংস খাইয়ে দিয়েছে গো ধরে-বেঁধে; আমি খেতে চাইনি গো, জোর করে আমার মুখে পুরে দিয়েছে…

পাটুলির যে-লোকগুলো এতক্ষণ শুনছিল তারা কানে আঙুল দিলে। আস্তে আস্তে সরে পড়বার চেষ্টা করতে লাগল।

আমাকে ছেড়ে দাও গো বাবাজি, আমাকে ছেড়ে দাও

উদ্ধব দাস বললে–তোমার জাত তো বড় ঠুনকো পুরকায়স্থ মশাই, আমি তো যেখানে-সেখানে যা-তা খাই, আমার তো জাত যায়নি। এই তো তোমাকে আবার ঘূচ্ছি, আমার তো জাত যাচ্ছে না, কই

তা হলে আমার কী হবে বাবাজি! আমাকে যে মুর্শিদাবাদের মসজিদের ইমামসাহেব নিজের বাড়িতে রেখে সারিয়ে তুলেছে, আমি যে সেখানে তিন রাত্তির কাটিয়েছি সবাই যে সেকথা জানে। আমার কী হবে?

উদ্ধব দাস বললে–কলা হবে, কচু হবে–

তুমি তো বললে–কলা হবে, কিন্তু আমাকে দিয়ে যে কেউ আর ঘটকালি করাবে না, আমি কী খাব? আমি যে ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র, ইন্দীবর ঘটকের পুত্র…

উদ্ধব দাস বললে–আমাকে কে খাওয়ায়? আমি কার পুত্র? আমি কার পৌত্র?

সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল উদ্ধব দাসের দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলে তা হলে গাঁয়ের লোক আমাকে তাড়িয়ে দিলে কেন? সিদ্ধান্তবারিধি মশাই আমাকে একঘরে করলেন কেন? আমার বউ-ছেলে-মেয়ে আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিলে না কেন? আমি অপরাধ না করলে কি শুধু শুধু তারা আমাকে নাকাল করলে?

উদ্ধব দাস হঠাৎ গান গেয়ে উঠল

তারা, আর কী ক্ষতি হবে।
তুমি নেবে যবে, সবই নেবে, প্রাণকে আমার নেবে।
থাকে থাকবে, যায় যাবে, এ-প্রাণ গেলে যাবে।
যদি অভয় পদে মন থাকে তো কাজ কী আমার ভাবে ।
তুমি নিজেই যদি আপন তরি ডুবাও ভবার্ণবে।
আমি ডুব দিয়ে জল খাব তবু, অভয় পদে ডুবে

সচ্চরিত্র পুরকায়স্থর হাতটা তখনও ধরে আছে উদ্ধব দাস। হঠাৎ একটা ঝটকা মেরে সচ্চরিত্র নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলে। তারপর এক দৌড়ে দূরে পালিয়ে গেল। চেঁচিয়ে বলতে লাগল–আমাকে পাগল পেয়েছ বাবাজি, আমি কি পাগল? আমার সংসারধর্ম নেই? আমাকে পাগল করতে

উদ্ধব দাস হেসে উঠল। চেঁচিয়ে উঠল। বললে–সবাই পাগল গো, সবাই পাগল, এ সংসারে সবাই পাগল, কেউ বিষয়-পাগল, কেউ মেয়েমানুষ-পাগল, কেউ নাম-পাগল। পাগলা বদনাম শুধু এই পাগল উদ্ধব দাসের

কিন্তু যার উদ্দেশে বলা সে তখন পাঁইপাঁই করে দৌড়োচ্ছে। উদ্ধব দাস হেসে উঠল খানিকটা সেই দিকে চেয়ে চেয়ে! গান গাইলেই পাগলামি বলে। আসলে সবাই পাগল হয়ে গেল। দেশটা পাগলে ভরে গেল, তবু উদ্ধব দাসকেই সবাই পাগল ভাবে। তাজ্জব দেশ প্রভু, তাজ্জব দেশ।

সারাদিন খাওয়া হয়নি উদ্ধব দাসের। মাথার ওপর রোদ উঠছে। বড় চড়া রোদ। কাঁধের চাদরটা মাথায় বেঁধে নিয়ে আবার পায়ে হাঁটা দিলে। কিন্তু কিছু দূর যেতেই হঠাৎ আবার কার দপদপ পায়ের শব্দ হল। পেছন ফিরেই দেখে সচ্চরিত্র আবার সেই দিকেই দেীড়োতে দৌড়োতে আসছে। একেবারে ঊর্ধ্বশ্বাসে উদ্ধব দাসের দিকেই দৌড়ে আসছে

উদ্ধব দাস একটু থমকে দাঁড়াল। সচ্চরিত্র কাছাকাছি আসতেই বললে–কী গো, আবার কী হল?

সচ্চরিত্র সে-কথার উত্তর না দিয়ে পাইপাই করে তখনও সামনের দিকেই দৌড়ে আসছে—

কী হল গো? আবার ফিরলে কেন?

এবার সচ্চরিত্র উদ্ধব দাসকে পাশে রেখে সোজা দৌড়োচ্ছ। কথার উত্তর দিলে না। অবাক কাণ্ড! এমন কাণ্ড তো করে না লোকটা! সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেল নাকি নোকটা! দেখতে দেখতে দূরে গাছপালা মাঠের ধুলোর মধ্যে সচ্চরিত্র অদৃশ্য হয়ে গেল। সত্যিই অবাক হবার মতো ঘটনা। পেছনে তো কেউ তাড়া করছে না। তবে?

হঠাৎ অনেক দূরে মনে হল যেন আকাশের গায়ে খুব মেঘ করেছে। কেমন হল? এই দুপুরবেলা কি ঝড় উঠবে নাকি? তাই সচ্চরিত্র পালাচ্ছিল? অনেকক্ষণ দেখতে দেখতে হবে যেন খানিকটা স্পষ্ট হল। প্রথমে মনে হয়েছিল মেঘ। তা নয়। আসলে হাতির পাল। হাতিগুলো সার সার এগিয়ে আসছে। তারপর ঘোড়ার সার। তারপর হাজার হাজার সেপাই। পাটুলির জনকয়েক লোক রাস্তায় নেমে দেখতে এসেছিল। তারাও অবাক।

ও দাসমশাই, দাঁড়িয়ে দেখছ কী? নবাব আসছে, পালিয়ে যাও গো

উদ্ধব দাস জিজ্ঞেস করলে–কেন? পালাব কেন? কী করেছি আমি?

ঠিক আছে, বুঝবে মজাটা। নবাব লড়াই করতে যাচ্ছে কলকাতায় গাঁয়ে যা পাবে সব নেবে, আর কিছু আস্ত রাখবে না–

সত্যিই তাই। পাটুলির লোকরা সব গ্রাম ছেড়ে নবাবের রাস্তার উলটোদিকে একেবারে গঙ্গার ওপারে গিয়ে হাজির। উদ্ধব দাস ঠায় সেখানে পঁড়িয়ে রইল। নির্জন জনহীন রাস্তা দিয়ে নবাবের সৈন্যরা এগিয়ে চলেছে। হাতি, ঘোড়া, কামান, বন্দুক, সেপাই সার সার চলেছে। মুর্শিদাবাদ থেকে সেই কোন রাত থাকতে বেরিয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে চলেছে বাংলাদেশের নবাব। এবার সবাই দেখুক নবাবেরও ক্ষমতা আছে, নবাবেরও সৈন্যসামন্ত আছে। ডাচ, পর্তুগিজ, ফরাসিরাও একটু শিক্ষা পাক। এ-দেশটা যে নবাবের তার প্রমাণ না দিলে সবাই বড় বেড়ে উঠবে। এই সময়েই সকলকে শিক্ষা। দিয়ে দেওয়া ভাল। বুড়ো নবাব আলিবর্দি খাঁ সাহেব যা পারেনি, নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা তাই পেরে দেখিয়ে দেবে।

আর শুধু পাটুলিই নয়। কলকাতাতেও হুলস্থুল কাণ্ড বেধে গেছে। কেল্লার ভেতরে হলওয়েল সাহেব তখন হোমে আর্জেন্ট ডেসপ্যাঁচ লিখছে–এই-ই হয়তো আমাদের শেষ ডেসপ্যাঁচ। আমরা অনেক রকম করে লড়াই ঠেকিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হল না। শুনছি নবাব আর্মি নিয়ে কলকাতার দিকে আসছে। এদিকে চিফ স্পাই রাজারাম সিং একটা চিঠি পাঠিয়েছিল উমিচাঁদের কাছে। সে-চিঠি আমরা ধরেছি। সে-চিঠিতে উমিচাঁদকে কলকাতা ত্যাগ করে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিল। উমিচাঁদ লোকটা একটা আস্ত স্কাউড্রেল। তাকে আমরা অ্যারেস্ট করে ফোর্টে রেখে দিয়েছি। তার প্রপার্টি যাতে কলকাতা থেকে সরিয়ে ফেলতে না পারে সেজন্যেও আমরা কুড়ি জন গার্ড বসিয়েছি তার বাড়িতে। উমিচাঁদের চিফ বরকন্দাজ-জমাদার জগমন্ত সিং সে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল, পাছে আমাদের হাতে পড়ে। বাড়ির জেনানার ভেতরে তেরোজন লেডিকে খুন করে। ফেলেছিল নিজের হাতে, পাছে আমরা তাদের মলেস্ট করি। শেষকালে নিজেও সে সুইসাইড করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমরা তা করতে দিইনি। তাকে ধরে ফেলেছি। ওদিকে রাজা রাজবল্লভের ছেলে কৃষ্ণবল্লভকেও অ্যারেস্ট করে রেখে দিয়েছি। কারণ ইন্ডিয়ানদের বিশ্বাস নেই। এরা ভয়ানক বিশ্বাসঘাতক লোক। আর বাগবাজারের খালের উলটোদিকে হুগলি-রিভারের ওপর একটা জাহাজে আঠারোটা কামান সাজিয়ে রেখেছি। দেখি কী হয়। আমরা যুদ্ধ করবই। এত কষ্ট করে এসে এখান থেকে আমরা সহজে এখন হটব না। কেবল মুশকিল হয়েছে একটা। আমাদের সবই দেশি সোলজার। তাদের ওপর ভরসা, আর ম্যাড্রাস থেকে কিছু ইউরোপীয় সোলজার চেয়ে পাঠিয়েছি। আমাদের আর্মিতে বারোজন সোলজার শুধু ইউরোপীয়ান। তাদের সবাইকে পেরিং-পয়েন্টের পাঁচিল আর ব্রিজ গার্ড দেবার জন্য রাখা হয়েছে। দেখা যাক কী হয়। সবই অনিশ্চিত। যদি আমরা টিকে থাকি তো আবার ডেসপ্যাঁচ পাঠাব। গড সেভ দি কিং।

মুর্শিদাবাদের চকবাজারেও তখন সব গোলমেলে অবস্থা। সকালবেলাও কেউ কিছু জানত না। ভোররাত্রে কখন কী ঘটছে, কেউ কিছু জানে না। বেলা হলে তখন জানা গেল। সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানে মৌতাত তখন বেশ জমে উঠেছে। তামাকের সঙ্গে আফিম মেশালে আর তার সঙ্গে আগরবাতি জ্বালিয়ে দিলে যা মৌতাত হয় তার মজা সারাফত আলিই জানে!

সন্ধেটা কেটে রাত বাড়ল। তখন সারাফত আলির বেশ ঘোর লেগেছে।

হঠাৎ ডাকলে–বাদশা

কান্তও এতদিন ধরে কত রাস্তা হেঁটে সবে একটু বিশ্রাম করবে বলে নিজের আস্তানায় এসে ঢুকেছিল। অন্ধকার ঝুপড়ি ঘর। ঘরের না আছে শ্রী না আছে ছাদ। তা হোক, তবু তো একটা আশয়। আজ হয়তো এখানে আসতেই হত না শেষপর্যন্ত। কায়োয়ায় রানিবিবির সঙ্গে পালিয়ে গেলেই হয়তো ভাল হত। অন্তত রানিবিবিকে এই অপমানের হাত থেকে তো বাঁচানো যেত। উদ্ধব দাসের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার পর থেকেই মনটা কেমন বিকল হয়ে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত কাটোয়ার ডিহিদার সাহেব এসে যাওয়াতে আর পালিয়ে যাওয়া হয়নি। তারপর থেকে রানিবিবির সঙ্গে কথাও হয়নি। দেখাই হয়নি তো কথা হবে কী করে। ডিহিদার সাহেব নিজে তাগাদা দিয়ে সেপাই দিয়ে কড়া পাহারা দিতে বলে মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দিলে।

নিজের ময়লা বিছানার ওপর শুয়েও ভাল করে ঘুম এল না। চকবাজারে ঢুকেই লড়াইয়ের খবরটা শুনেও বেশ খারাপ লেগেছে। বেভাজির সাহেবের সেই সোরার গদিটার কথাও মনে পড়ল। যদি সে-গদি নবাবের কামানের গোলা লেগে পুড়ে যায়! ক’টাই বা সৈন্য আছে ফিরিঙ্গিদের। নবাবের সঙ্গে কেন ঝগড়া করতে গেল। আহা, ষষ্ঠীপদর চাকরিটাও চলে যাবে। কান্ত এখন মুনশি থাকলে কান্তর চাকরিটাও চলে যেত। শুধু চাকরি নয়, প্রাণটাও হয়তো যেতে সেই সঙ্গে সঙ্গে।

বাবুজি।

বাদশার গলা।

কী রে বাদশা?

হুজুর, মালিক আপনাকে একদফে এত্তেলা ভেজিয়েছে।

ধড়মড় করে তাড়াতাড়ি উঠে সারাফত আলির কাছে যেতেই খুশবুর গন্ধতে কান্তর সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে এল।

সড়ক দিয়ে কোথায় যাচ্ছিলি রে? তাঞ্জামে কোন বিবি ছিল? নবাব হারেমের মাল?

সে কথার উত্তর দিতেও যেন ঘেন্না হতে লাগল। চরের চাকরি করে বলে সারাফত আলি সাহেবও তাকে যেন তাচ্ছিল্য করতে শুরু করেছে। শুধু বললে–জি, মিঞাসাহেব!

সারাফত আলি বললে–জাহান্নমে যাবি, তা বলে রাখছি, কান্তবাবু। বেশক জাহান্নমে যাবি, দুশমনের লড়াই ফতে হলে ভাবিসনি জিন্দগি খুশ হয়ে যাবে, জিন্দগির লড়াই ফতে করতে পারিস তো তখন বুঝব তুই বাহাদুরের বেটা

আরও কিছু কথা হয়তো বলত সারাফত আলি সাহেব। কিন্তু নেশার ঝেকে তখন চোখ দুটো বুড়োর লাল জবাফুল হয়ে উঠেছে। বেশি কথা বলার হয়তো ক্ষমতাই নেই মিঞা-সাহেবের।

হঠাৎ ওপাশ থেকে বশির মিঞার গলা শুনে একটু অবাক হয়ে উঠল। বশির মিঞা আবার এত রাত্রে কী জিজ্ঞেস করতে এসেছে। রানিবিবিকে তো চেহেল্‌-সুতুনের হারেমে পৌঁছিয়েই দিয়েছে। আবার কাউকে আনতে হবে নাকি? একটা কাজ হাসিল হতে-না-হতে আবার একটা কাজ?

কী রে? কী করছিলি? আমি ভাবছিলুম ঘুমিয়ে গেছিস

তুই হঠাৎ? আবার কোনও কাজ আছে নাকি?

বশির মিঞা বলল–না রে, না।–তোর সঙ্গে একটা বাত আছে, এখানে কেউ নেই তো?

বলে ঘরটার চারদিকে দেখে নিলে। তারপর গলাটা নিচু করে বললে–একটা বাত বলি তোকে, আজকে যে রানিবিবিকে এনেছিস, ও আসলি রানিবিবি তো? নাকি দুসরা কাউকে পাঠিয়ে দিয়েছে?

কান্ত অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে–কেন?

তাই তো জিজ্ঞেস করছি তোকে।

কান্ত বললে–কেন? অন্য কোনও রানিবিবি এসেছে নাকি তার বদলে? অন্য কোনও মেয়ে?

আরে না, হাতিয়াগড়ের ডিহিদার রেজা আলি শালা বুড়বাক আছে। আমার ফুপাকে খপর পাঠিয়েছে। নাকি রানিবিবির বদলে হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির একটা নফরের ডপকা মেয়েকে পাঠিয়েছে। শোভারাম নাকী তার নাম, তারই নাকি মেয়ে। তুই কিছু জানিস? ফুপা আমাকে গালাগাল করছে। মেহেদি নেসার

সাহেব জানলে তো বেত্তমিজি করবে! জানিস কিছু তুই?

মনে আছে কান্ত সে-রাত্রে ঘুমোতে পারেনি। সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের পেছন দিকে একটা ছোট ঘরে আস্তানা নিয়েছিল কান্ত। আস্তানাটা নামেই আস্তানা। ওর ভেতরে মানুষ কোনওরকমে থাকতেই শুধু পারে, বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু সারাফত লোকটা ভাল। একজন গরিব মানুষকে দেখে দয়া করে থাকতে দিয়েছিল শুধু, কিরায়া নিত না। কতকগুলো কড়ির জার আর মাটির হাঁড়ি-কলসির গুদাম ছিল সেটা। সেটাই মালপত্র সরিয়ে কান্তকে থাকবার জন্য খালি করে দিয়েছিল। সেই অন্ধকার ঘুপসি ঘরের বিছানার ওপর চিতপাত হয়ে গা এলিয়ে দিয়ে আকাশ-পাতাল শুধু চষে বেড়িয়েছিল। যাকে সে রানিবিবি ভেবেছিল সেই-ই তা হলে শোভারামের মেয়ে! আশ্চর্য না আশ্চর্য! একবারও যদি জানতে পারত সে আগে। একবারও যদি কেউ কথাটা বলত তাকে।

ভোরবেলা বড় মসজিদের আজানের শব্দ শুনেই উঠে পড়ল কান্ত। সময় যেন আর কাটতে চায় না। যেন সূর্য আর উঠবে না চকবাজারে।

বশির মিঞা বলেছিল–রেজা আলি শালা ফৌজদার হতে চাইছে, বুঝলি! তাই মেহেদি নেসার সাহেবকে খুশামুদ করতে চাইছে এই করে

কান্ত বলেছিল–তা হলে কি আসল রানিবিবিই এসেছে?

আলবত! হাতিয়াগড়ের জমিনদারের এত বুকের পাটা হবে না যে ঝুটা মাল চালিয়ে দেবে, জমিনদারবেটা জানে যে নবাবের গোঁসা হলে তার জমিনদারিই লোপাট হয়ে যাবে।

কান্ত হঠাৎ বললে–কিন্তু ভাই, আমার মনে হচ্ছে হয়তো ডিহিদারের কথাই ঠিক, ওরা বোধহয় শোভারামের মেয়েকেই পাঠিয়ে দিয়েছে ষড়যন্ত্র করে

দুর, দুর–ওসব রেজা আলির শয়তানি রে! রেজা আলিকে তুই তো চিনিস না। শালা খুব জাঁহাবাজ লোক, কেবল ফৌজদার হতে চাইছে কেরামতি দেখিয়ে

বশির মিঞা চলে যাবার পর সমস্ত রাত ধরে কান্ত কেবল ভেবেছিল। ও রানিবিবি না মরালী! কে? কাকে সঙ্গে করে এনেছে সে? দু’জনের কাউকেই দেখেনি আগে। শোভারামের মেয়ের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধই হয়েছিল শুধু। সেই পর্যন্ত। ঘটক সচ্চরিত্র পুরকায়স্থর মুখের কথা শুনেই বিয়েটায় রাজি হয়েছিল। শুধু শুনেছিল খুব শৌখিন মেয়ে, ঠোঁটে আলতা লাগায়, দিনরাত তাম্বুল-বিহার দিয়ে পান খায়, পাশা খেলতে ভালবাসে। তার বেশি আর কিছু শোনেনি মরালীর সম্বন্ধে। আর হাতিয়াগড়ের ছোটরানি? তার সম্বন্ধেও যা কিছু শুনেছিল সেসবই উদ্ধব দাসের কাছ থেকে। খুব নাকি রসিক বউ। উদ্ধব দাসের মুখে রসের গান শুনতে ভালবাসে। তা ছোটরানিও নিশ্চয়ই সুন্দরী। নইলে এক বউ থাকতে আবার বিয়ে করতে গেলেন কেন ছোটমশাই? গরিবঘর থেকে কেন আনতে গেলেন আবার একটা বউ? সত্যিই কে ও? কাকে এনেছে সে সঙ্গে করে? রানিবিবি, না মরালী?

তখনও সারাফত আলির নাক ডাকছে পাশের ঘর থেকে। বড় মসজিদ থেকে আজানের শব্দ কানে আসছে। কান্ত উঠল বিছানা ছেড়ে। তারপর রাস্তায় বেরোল। কান্তর ধারণা ছিল এ সময়ে চকবাজারের রাস্তায় এমনিতে কেউ থাকে না। এত ভোরে কেউ ঘুম থেকে ওঠে না। কিন্তু তবু দেখা গেল রাস্তায় রাস্তায় কোতোয়ালের লোক পাহারা দিচ্ছে। কাল মুর্শিদাবাদে এসেই শুনেছিল,নবাব ফৌজ নিয়ে লড়াই করতে গেছে। মিরবকশি গেছে, বকশি আহাদিয়ান গেছে, বকশি সুবাজারাও সবাই গেছে। জমাদার, হাজারি কেউই বাদ নেই। ফৌজখানা একেবারে ফাঁকা রেখে গেছে। শুধু আছে কোতোয়ালের লোকরা নগরের তদারকিতে। পেছন থেকে যদি কেউ হঠাৎ মুর্শিদাবাদে হামলা করে তার জন্যেই এই কড়া পাহারা।

একটা রাস্তার চৌমাথায় আসতেই ওধার থেকে হাঁক এল–কৌন? আমি।

আমি বললেও কিছু সুরাহা হল না। কোতোয়ালের লোক সামনে এগিয়ে এল। এসে অন্ধকারের মধ্যেই কান্তর মুখখানা ভাল করে পরখ করে দেখলে। তুম কৌন?

আমি কান্ত সরকার। নিজামতের চর

লোকটা আর কিছু বললে–না। শুধু জিজ্ঞেস করলে-কাহা যানা হ্যায়?

কান্ত বললে–বশির মিঞার বাড়িতে, নিজামতের কাজে

পাঠান নিশ্চয়ই লোকটা। জগৎশেঠজির মহিমাপুরের বাড়িতে যেমভিখু শেখ পাঠান, এও তেমনি। দিল্লি সাজাহানাবাদ আগ্রা থেকে সব বেছে বেছে পাঠানদের এনেছে কোতোয়ালের কাজে। এদের গায়েও যেমন জোর, মনেও তেমনি ভয়-ভীত কিছু নেই। হুকুম করলেই বুকের ওপর গুলি করতে পারে নির্বিচারে। এরা বর্গিদের দলেও কাজ করেছে, আবার মোগলদের দলেও আছে। কান্তর মতোই টাকা পেলে সকলের নিমক খেতে রাজি।

সদর কাছারির পাশে মনসুর আলি মেহের সাহেবের আস্তানা। তার বাড়িতেই বশির থাকে। এত ভোরে সেখানে হয়তো পাঠান পাহারাদার আছে। হয়তো ঢুকতে দেবে না। এত ভোরে না এলেই ভাল হত। কিন্তু মনটা কেবল ছটফট করছিল। বশিরের কাছে কথাটা শোনার পর থেকেই মনে হচ্ছিল যদি আর একবার কোনওরকমে রানিবিবির সঙ্গে দেখা করা যায়। যদি কোনওরকমে একবার চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে যেতে দেয় বশির মিঞা। কিন্তু ঢুকতে দেবেই বা কেন? বাইরের লোককে ঢুকতে দেখলে তো খোজারা কোতল করে ফেলবে তাকে। বাইরে থেকে দেখে তো কিছু বোঝা যায় না। অত বড় প্রাসাদ! মতিঝিল দেখেছে কান্ত, মনসুরগঞ্জ দেখেছে, হিরাঝিলও দেখেছে। কিন্তু চেহেলসুতুনের কথাটা ভাবলেই যেন ভয় লাগে। কত মানুষ, কত বেগম, কত রহস্য, কত রোমাঞ্চ জড়িয়ে আছে চেহেল সুতুনের সঙ্গে। কত গল্প শুনেছে কান্ত। ভেতরে শুধু মহলের পর মহল। কত ষড়যন্ত্র, কত চোখের জল নিয়ে গড়ে উঠেছে চেহেল্‌-সুতুন। মুর্শিদকুলি খাঁর আমলের বাড়ি। ইটের তৈরি। ভেতরে নাকি দরবার ঘর আছে। চল্লিশটা বড় বড় থামের ওপর ছাদটা দাঁড়িয়ে আছে। তারই তলায় দরবার করতেন মুর্শিদকুলি খাঁ। কালো পাথরের বিরাট একটা মসনদ। আকবরনগরের এক মিস্ত্রির তৈরি, বশির মিঞা বলেছিল–মুঙ্গেরের নামজাদা কারিগর বোখারার খাজা নজর নিজে তৈরি করেছিল মসনদটা। মুর্শিদকুলি খাঁর সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় ঘুরেছে সেটা।

বশির মিঞা, বশির মিঞা

হঠাৎ একটা লাঠি ঠোকার শব্দ হল পাশে। বাড়িটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছিল কে একজন। কান্তর গলা শুনেই অন্ধকার থেকে ভূতের মতন সামনে এসে হাজির হয়েছে। লোকটা কান্তর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বোধহয় চিনতে পারলে। বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করলে না। শুধু বললে–মিঞাসাহেব কোঠিতে নেই

কোথায় গেছে? কখন দেখা হবে?

এ-প্রশ্নটা অবান্তর। প্রশ্নটা করেই কান্ত নিজের ভুল বুঝতে পারলে। কে কখন কোথায় যাচ্ছে তা জিজ্ঞেস করতে নেই নিজামতের চাকরিতে। কারণ সবাই নিজের নিজের ধান্ধায় ঘুরছে। আর দিনকাল যা পড়েছে তাতে তো কেউ কাউকে বিশ্বাসই করে না। বিশ্বাস করা উচিতও নয়। কে কার সর্বনাশ করার কথা ভাবছে কে বলতে পারে। সবাই তো নিজের নিজের উন্নতির কথা ভাবছে। রেজা আলি ভাবছে কী করে কার সর্বনাশ করে, কাকে তোয়াজ করে ফৌজদার হওয়া যাবে। মিরজাফর ভাবছে কী করে মোহনলালকে খাটো করতে পারবে। উমিচাঁদ ভাবছে কী করে নবাবের বিরুদ্ধে ফিরিঙ্গিদের উসকে দিয়ে তাদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করবে। জগৎশেঠজি ভাবছে কী করে নবাবকে জব্দ করা যাবে। মুর্শিদাবাদের রাস্তার লোকগুলো পর্যন্ত সোজা করে কথা বলতে জানে না। সবাই যেন কথা চেপে যায়। অথচ কলকাতা এমন নয়। কেন যে এখানে এল চাকরি করতে! না এলেই ভাল হত। বড়চাতরায় গিয়ে নায়েব-নাজিরবাবুদের সেরেস্তায় কাজ নিলেই এর চেয়ে তার অনেক ভাল হত।

বশির মিঞা বলেছিল–এ হল শহর। মুর্শিদাবাদ, এ তো আর তোর কলকাতার মতো পাড়াগাঁ নয়

তা বটে। শহরের লোকগুলোই বোধহয় এমনি। এ-চাকরিটা ছাড়তে পারলেই হয়তো ভাল হত। শুধু শুধু একটি পাপ কাজ করতে হল। অবশ্য পাপটা তার নিজের নয়। কিন্তু যারই হুকুম হোক, এ-পাপের ভাগীদারও তো সে। এ-পাপের কিছু ভাগ তো তার গায়েও লাগবে। রানিবিবিকে চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে পৌঁছে দিয়ে আসা এস্তক মনটা কেমন ভারী হয়ে রয়েছে। কাজটা ভাল করেনি সে। মোটেই ভাল করেনি। রানিবিবি তো পালিয়েই যেতে চেয়েছিলেন তার সঙ্গে। তাকে নিয়ে সেদিন পালিয়ে গেলেই হত। কথার খেলাপ হত বটে। কিন্তু তার চেয়ে তো আরও বড় পাপ করলে তাঁকে এখানে নিয়ে এসে। রানিবিবিই তো পালিয়ে যাবার কথাটা তুলেছিলেন নিজে। কান্তরই শুধু সাহস হয়নি! আর কোতোয়ালের লোকজনও ঠিক সেই সময়ে সেখানে এসে পড়েছিল।

সারা মুর্শিদাবাদ শহরটাই আস্তে আস্তে টহল দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল কান্ত। চেহেল্‌-সুতুনের পুব দিকে তোপখানা। সেদিকটায় শুধু যায়নি। আজ পাহারাদাররা ওদিকে কড়া পাহারা লাগিয়েছে। কাউকে ওদিকে যেতে দেখলেই নানান কথা তুলবে। তার পাশেই জাহানকোষা। বিরাট একটা কামান। তার ওপাশে গঙ্গা। গঙ্গার ধারে গিয়ে দাঁড়াল কান্ত। কিছুই ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছিল এখুনি যদি একবার চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে গিয়ে রানিবিবির সঙ্গে দেখা করে আসতে পারত। রাত্রে কী খেলে, কী করে কাটালে, সব জানতে ইচ্ছে করছে। হিন্দুর জন্যে কি আর আলাদা রান্নার ব্যবস্থা করেছে! কান্ত থাকলে হয়তো কাটোয়ায় যেমন ব্যবস্থা করেছিল, সেই রকম ব্যবস্থা করতে পারত। তারপর শুধু কি খাওয়া? হয়তো রানিবিবিকে বেগমদের মতো ঘাগরা-ওড়নি পরতে হবে। হয়তো মদ খেতেও দেবে!

কিন্তু রানিবিবি না হয়ে সত্যি সত্যি যদি সেই মরালীই হয়, তখন? আর যদি মরালীই হয় তো আসল রানিবিবি কোথায়? হাতিয়াগড়ের জমিদারের সেই ছোট বউরানি? তাকে কোথায় রেখে দিয়েছে? তাকে তো আর বাড়িতে রাখতে পারবে না। তা হলে সবাই তো জেনে ফেলবে। তাকে তো নাটোরের রানি ভবানীর মতো কোনও আশ্রমে কি আখড়ায় লুকিয়ে রাখতে হবে। নইলে ডিহিদার রেজা আলি তো টের পেয়ে যাবে। টের পেয়ে গেলেই আবার ধরে আনবে। তখন তো মরালীকে ছেড়ে দিতে হবে। কিংবা এও হতে পারে, দুজনকেই ধরে রাখবে। দু’জনকেই চেহেল্‌-সুতুনে আটকে রাখবে।

হঠাৎ দূরে কোথায় ঘণ্টা বাজতে লাগল। ঢং ঢং করে দু’বার বাজল।

কেমন যেন সন্দেহ হল। তবে কি রাত দুটো বাজল নাকি! তবে কি ভোর হয়নি? সন্দেহ হতেই আবার নিজের আস্তানার দিকে ফিরল। নিজের ঝুপড়িতে আসতেই বুঝি শব্দ হয়েছে। শব্দ হতেই পাশের ঘর থেকে বাদশা চেঁচিয়ে উঠেছে কৌন?

আমি বাদশা, আমি কান্তবাবু

কোথায় গিয়েছিলেন বাবুজি?

বেড়াতে। আমি ভেবেছিলাম রাত বুঝি কাবার হয়ে গেছে। ঘণ্টা শুনে এখন খেয়াল হল।

বাদশা আর কিছু বলল না। কিন্তু খানিক পরে কান্ত আবার ডাকলে–বাদশা

জি!

কান্ত জিজ্ঞেস করলে–আচ্ছা বাদশা, তুমি চেহেল-সুতুনের অন্দরে কখনও গেছ?

এত রাত্রে এ-প্রশ্ন শুনে বাদশা বোধহয় অবাকই হয়ে গিয়েছিল। বললে–নেহি জি–নেহি গয়া কাহে?

মানে, তুমি কিছু জানো, ভেতরে কেমন করে জীবন কাটায় বেগমরা? মানে যে-সব হিন্দু বেগম ভেতরে যায় তাদের কি গোরুর মাংস খেতে হয়? ঘাগরাটাগরা পরিয়ে দেয়? মানে তাদের কি খুব কষ্ট?

বাদশার বোধহয় তখন খুব ঘুম পাচ্ছিল। কিংবা হয়তো কান্তর প্রশ্নটা বুঝতে পারল না।

কান্ত এ-ঘর থেকে আবার জিজ্ঞেস করল–মানে, ধরো হিন্দু সধবাদের জন্যে তো আর আলাদা রান্না করবে না তারা! তাই জিজ্ঞেস করছি। শেষ পর্যন্ত বোধহয় মদও খেতে হতে পারে, কী বলে?

কিন্তু ওদিক থেকে বাদশার আর কোনও উত্তর এল না।

কান্ত আবার জিজ্ঞেস করলে–ঘুমুলে নাকি? ও বাদশা, ঘুমিয়ে পড়েছ?

কোনও সাড়াশব্দ নেই। আর খানিক পরেই বাদশার নাক ডাকতে লাগল। তার পাশের ঘরে নেশার ঘঘারে সারাফত আলিরও নাক ডাকছে। দু’জনের নাক ডাকার শব্দে যদিই বা কান্তর একটু ঘুম আসার আশা ছিল, সেটুকুও চলে গেল। কান্ত পাশ ফিরে শুয়ে প্রাণপণে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগল। প্রাণপণে সব ভুলে যাবার চেষ্টা করতে লাগল। রানিবিবির কথা, মরালীর কথা, নিজের দুর্দশার কথা–সমস্ত সমস্ত—

মেহেদি নেসার সাহেবের বন্দোবস্ত কিন্তু সব পাকা। পিরালি খাঁ-ও পাকা ওস্তাদ। বহুকাল থেকে কাজ করে করে আজ খোজাসর্দার এমনিতে হয়নি। বেশ কিছু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। নবাবের পর নবাব এসেছে, বেগমের পর বেগম এসেছে, তাদের সকলের মেজাজ-মর্জি বুঝে অনেক কষ্টে ঘাড়ের ওপর শিরটা খাড়া রাখতে হয়েছে। নইলে চেহেল্‌-সুতুনে শির খাড়া রাখতে পারা সোজা কথা নয়।

যখন নবাবরা লড়াই করতে যায়, তখনও হারেমের নিয়মকানুনের কোনও ইতরবিশেষ হয় না। তখনও ঘড়ির কাঁটায় কাজ চলে। মসজিদে আজান হাঁকে মৌলবি সাহেব। বাঁদিরা ঘুম থেকে উঠে গোসলখানায় গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে তৈরি হয়ে নেয়। তখন বেগমদের নাস্তার বন্দোবস্ত করতে হয়। পেছন দিকের ঝিলের জলে ধোবিখানার ধোবারা তখন ঘাগরা শাড়ি-ওড়নিকাচুলি কাঁচতে শুরু করে। ইনসাফ মিঞা নহবতে আশোয়ারির তান ধরে। তারপর যত বেলা বাড়তে শুরু করে ততই সরগরম পড়ে যায় হারেমের ভেতরে। তোষাখানায়, মশালচিখানায়, বাবুর্চিখানায় হাঁকডাক পড়ে যায়। শহর মুর্শিদাবাদের ভেতরই আর এক শহরের ছোট্ট সংস্করণ গড়ে ওঠে তখন। সেখানেও কেনা-বেচা শুরু হয়, লেন-দেন আরম্ভ হয়। সেখানেও দেনা-পাওনা নিয়ে দর-কষাকষি চলে। জীবন, জন্ম, মৃত্যু, অর্থ, ঐশ্বর্য, বিলাসের দর কষাকষি। সেখানেও কেউ হারে কেউ জেতে। কেউ বেচে কেউ কেনে। কেউ জন্মায় কেউ মরে।

নবাবের জন্যে সবাই এখানে বিকেল থেকে সাজতে শুরু করে। দামি ঘাগরা পরে, কানে আতর দেয়, পায়ে ঘুঙুর বাঁধে, মাথায় বেণী ঝোলায়, আর লুকিয়ে লুকিয়ে আরক খায়। চকবাজারের সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকান থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আরক কিনে আনে নজর মহম্মদ। সে-আরক খেলে সমস্ত শরীর চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মনে হয় বুঝি একেবারে বেহেস্তে চলে গেছি সশরীরে। মনে হয় হারেমের মধ্যে আর বন্দি নই আমি, আমার পাখা গজিয়েছে দুটো, আমি উড়ে চলেছি হুরি-পরিদের মতো। তারপর শেষকালে যখন নবাব আর সত্যি সত্যি আসে না, তখন সেই নেশার ঘোরের মধ্যেই বরকত আলি কি নজর মহম্মদ বাইরের কোনও পেয়ারের লোককে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যায়। তারপর কোথা দিয়ে রাত কাবার হয়ে যায় তা আর টের পায় না কেউ।

হারেমের বেগমদের জীবন এমনি করেই চলে আসছে বরাবর। সেই মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে সুজাউদ্দিন, সরফরাজ, আলিবর্দি খাঁ পর্যন্ত একটানা। পুরনো চালেই হারেমের নিয়মকানুন বাঁধা। আলিবর্দি খাঁ’র সময়ে সে-চাল একটু কমেছিল নানিবেগমের জন্যে। কিন্তু আর ক’দিন। লড়াই করতে করতেই সারাটা জীবন কেটে গেছে তার। এবার এসেছে নাতি নবাব মনসুর-উল-মুলুক শা কুলি খান বাহাদুর মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা হেবাৎ জঙ আলমগির।

সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানে নজর মহম্মদ কি বরকত আলিরা যখন আরক কিনতে আসে তখন লুকিয়ে লুকিয়ে আসে। বাইরে খুশবু তেলের কারবার। আড়ালে আরক। সারাফত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে কী রোগ, কার রোগ। নাম কী রোগীর। ওষুধকেই সারাফত আলি আরক বলে। হাকিমের কাছে গেলে বাইরের লোকের কাছে জানাজানি হবে বলে, নজর মহম্মদরা সারাফত আলির দোকানে আসে। লোকে ভাবে খুশবু তেল কিনতে এসেছে। অনেক রকম আরক আছে সারাফত আলির। সুজাকের আরক, আতশকের আরক।এমন আরক আছে যা একবার খেলে রোজ খেতে ইচ্ছে করে।

নজর মহম্মদরা নতুন বেগমদের সেই আরকই খাওয়াবার চেষ্টা করে। একবার ধরাতে পারলে তখন আর ছাড়বার উপায় নেই, তখন খোজাদের খোশামোদ করতে হয়। কাছে এসে বলে-নজর, আরক ফুরিয়ে গেছে, আর চারটে গুলি এনে দে তুই

সারাফত জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে বেগমসাহেবার?

নজর মহম্মদ বলে–কী জানি মিঞাসায়েব, বেগমসায়েবার দেমাগ খারাপ হয়ে গেছে, বিড়বিড় করছে হরবখত–

বুঝেছি, মালেখুল্লিয়া-দেমাগি হয়েছে

কী করে এমন হল মিঞাসায়েব?

সারাফত বলে–সওদা ধাতুতে দেমাগ ভারী হয়ে গেছে–এই আরকেই আরাম মিলবে–যা

কী কয়েকটা বড়ি দেয় সারাফত আলি, আর দাম দিয়ে ভেতরে নিয়ে চলে যায় নজর মহম্মদ। তারপর সে-রোগ সারল কি সারল না তার আর কেউ খবর রাখে না।

মরালী যেদিন প্রথম এল তার পরদিন নজর মহম্মদ দোকানে আসতেই সারাফত জিজ্ঞেস করলে কাল কোন বেগম এল রে তাঞ্জামে করে?

নজর মহম্মদ বললে–তুমি কী করে জানলে মিঞাসায়েব?

আমি সব জানি। আমার খুলিতে যে একটা কাফেরবাবু থাকে, সেই তো সঙ্গে করে নিয়ে এল দেখলুম

নজর মহম্মদ বললে–লস্করপুরের তালুকদার কাশেম আলির ছোটি লেড়কি। বাপ মরে যাবার পর হারেমের বেগম কনবার শখ হয়েছে

কী নাম হল বেগমসাহেবার?

মরিয়ম বেগম।

আরক খাবে না?

নজর মহম্মদ বললে–না মিঞাসায়েব, এখনও নয়া কিনা, আরক খেতে শেখেনি, আমি পুছেছিলাম, বললে–না, আরক খাই না

সারাফত আলি পাকা গোঁফদাড়ির মধ্যে একটু হাসল। বললে–প্রথম প্রথম তো কেউই খায় না, পরে আবার ওই মরিয়ম বেগমই আরকের খাতিরে তোকে খুশামুদ করবে, দেখে নিস

কথাটা নজর মহম্মদ জানে। ওই পেশমন বেগম, গুলসন বেগম, কেউই আরক খেতে চায়নি প্রথমে। এখন সবাই সারাফতের আরকের বাদি হয়ে গেছে। আর না হলে বেগমসাহেবাদের রাতই কাটে না। প্রথম প্রথম মরালী এসব কিছুই জানত না। প্রথম দিন একটু কৌতূহল ছিল, একটু ভয়ও ছিল। কোথায় কী রকম অবস্থায় কাটাতে হবে, কী করবে, কেমন করে দিন কাটবে, কিছুই জানা ছিল না। হাতিয়াগড় একরকম আর মুর্শিদাবাদ আর এক রকম। নিজামত-হারেম, সে আরও নতুন জায়গা। পালকিটা চেহেল্‌-সুতুনের মধ্যে ঢুকে পড়তেই মনে হল যেন সবকিছু থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কোথায় এতক্ষণ সে বউ হয়ে বড়চাতরায় যাবে, তা না একেবারে চন্দ্র-সূর্যের চোখের আড়ালে এখানে এসে ঢুকল। পালকির দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে দেখবার চেষ্টা করেছিল। যতক্ষণ কাটোয়ার রাস্তায় পালকি চলেছে ততক্ষণ কান্ত পাশে পাশে ছিল। ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, চেয়ে চেয়ে দেখছিল। হয়তো রানিবিবি মনে করে কথা বলতে সাহস করেনি। তা ছাড়া ফৌজি-সেপাইরা ছিল সঙ্গে। তারাও কড়া পাহারা দিতে দিতে চলছিল। কেউ যেন না দেখে রানিবিবির দিকে। অথচ পালিয়ে যাবার কথা শুনেও বেশ খুশি হয়েছিল।

চল্লিশটা থামের নীচে চেহেল্‌-সুতুনের দরবার। এ-রাস্তাটা সেদিকে নয়। একেবারে কোথা দিয়ে ঢুকে কোন সুড়ঙ্গ দিয়ে একটা মসজিদের সামনে এসে থামল পালকিটা। তারপর কয়েকজন অচেনা লোক সামনে এসে মাথা নিচু করে কুর্নিশ করলে। পিরালিই ছিল খোজা সর্দার। সে-ই আসল। সে মসজিদের ভেতরে নিয়ে গেল। বুড়ো দাড়িওয়ালা একজন মৌলবিসাহেব বিড়বিড় করে কী সব উর্দু মন্তর পড়তে লাগল। মরালীর গায়ে দু-একবার জল ছিটিয়ে দিলে। তারপর পিরালিই নিয়ে গিয়ে একটা ঘরের মধ্যে পৌঁছিয়ে দিয়ে গেল।

তারপর?

তারপর তাকে কী করতে হবে তাও জানা ছিল না। এত বড় চেহেল্-সুতুন, কিন্তু কোথাও কোনও সাড়াশব্দ যেন নেই। সমস্ত বাড়িটা যেন নিঃঝুম হয়ে আছে। ঘরের ভেতর একটা বিছানা। মস্ত বড় বিছানা। পাশেই আতরদান, পানদান, গোলাপদান সাজানো। একটা আয়না। নিজের চেহারার ছায়া পড়েছে তাতে। এত বড় আয়না ছোটমশাইয়ের বাড়িতেও নেই। চৌকির ওপর একটা মস্ত রুপোর পিকদান। দেয়ালে কতকগুলো ছবি। মেঝের ওপর গালচে পাতা। পা রাখবার জন্যে বিছানার নীচেয় মখমলের পাপোষ। একটা খোঁজা এসে আতরদানে আতর সাজিয়ে দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গন্ধে ভুরভুর করে উঠল ঘরখানা। গোলাপদানে গোলাপফুল দিয়ে গেল। পানদানে পানের খিলি, এলাচ লবঙ্গ ডালচিনি দিয়ে গেল।

বেগমসাহেবা!

মরালী এতক্ষণ চুপ করে সব দেখছিল। এবার মুখ তুলে চাইলে।

বেগমসাহেবের খেদমতির জন্যে বান্দা হাজির। বেগমসাহেবা যখন মেহেরবানি করে যা হুকুম করবেন, বান্দা সব তামিল করতে তৈয়ার বলে লোকটা মাথা নিচু করে তিনবার মাথায় ডান হাতটা ঠেকিয়ে কুর্নিশ করলে।

মরালী বললে–আমার কিছু দরকার নেই

খানা?

মরালী বললে–না, আমার এখন খিদে নেই—

সরাব?

সরাব কী?

নজর মহম্মদ বললে–যাকে মদ বলে বেগমসাহেবা

না।

তা হলে আরক?

আরক? আরক আবার কী জিনিস!

নজর মহম্মদ বললে–চকবাজারের সারাফত আলির দোকানের আরক বড় বঢ়িয়া চিজ বেগমসাহেবা, খেলে দিল তর হয়ে যায়, ভাল নিদ ভি আসে, তবিয়ৎ ভি আচ্ছা হয়, হুকুম হয় তো বান্দা এনে দিতে পারে বেগমসাহেবাকে।

মরালী বললে–না দরকার নেই

নজর মহম্মদ কিন্তু ছাড়ার পাত্র নয় তবু। বললে–বান্দার নাম নজর মহম্মদ, বেগমসাহেবার জরুরত হলে বান্দাকে যখন খুশি এত্তেলা দেবেন, বান্দা হাজির থাকবে–

মরালী বললে–আমার কিছু দরকার নেই তুমি যাও এখন

নজর মহম্মদ চলেই যাচ্ছিল হয়তো। কিন্তু মরালী আবার ডাকল। বললে–রাত্তিরে আমি বাতি নিভিয়ে শোব? কেউ বিরক্ত করতে আসবে না তো? দরজায় খিল দিয়ে দেব?

জি হা বেগমসাহেবা। বেগমসাহেবা মজেসে নিদ যাবেন, কেউ ঘরে আসবে না

তারপর কী যে হল। কৌতূহলটা আর চেপে রাখতে পারলে না মরালী। জিজ্ঞেস করলে তোমাদের নবাব? নবাব কোথায় তোমাদের?

নজর মহম্মদ বললে–জাঁহাপনা তো লড়াইতে গেছেন বেগমসাহেবা, ফিরিঙ্গি দুশমনদের সঙ্গে লড়াই করতে গেছেন। লড়াই ফতে করে জাঁহাপনা ফিরে আসবেন–

কবে লড়াই শেষ হবে?

আগে লড়াই ফতে হোক বেগমসাহেবা। দু-তিন রোজ লাগবে ফতে হতে। খবর এসেছে কলকাতা শহর পুড়িয়ে দিয়েছেন জাঁহাপনা। ফিরিঙ্গি দুশমনদের কলকাতা থেকে তাড়িয়ে কালাপানি পার করে দিয়েছেন।

মরালী একটু থেমে বললে–এখানে আর কারও গলা শুনতে পাচ্ছিনা, এখানে কি আর কেউ থাকে? অন্য বেগমরা?

জি থাকে। পেশমন বেগম আছে, নুর বেগম আছে, তক্কি বেগম আছে, গুলসন বেগম আছে, নানিবেগম আছে, সবাই আছে এখানে। এ তত বেগমমহল বেগমসাহেবা। বেগমসাহেবাকে যে-মহলে রেখেছি এটা আলখ মহল, এখানে ফিরিঙ্গিদের মেমসাহেবরা ছিল, ওয়াটস মেমসাহেব, কলেট মেমসাহেব সবাই এখানে নবাবের হেফাজতে ছিল। এর ওধারে ঘসেটি বেগমসাহেবা আছে

মরালী জিজ্ঞেস করলে তা আমাকে আলাদা মহলে রাখলে কেন তোমরা?

সে খোজাসর্দার পিরালি খাঁ জানে বেমসাহেবা। মেহেদি নেসার সাহেবের হুকুম

মেহেদি নেসার সাহেব কে?

আমাদের নবাবের পেয়ারের দোস্ত।

এর পরে আর কিছু কথা জানবার ছিল না। মরালী কী জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারলে না। নজর মহম্মদ দাঁড়িয়ে ছিল চুপ করে।

আচ্ছা, তোমাদের এখানে বাইরের লোক এর ভেতরে আসতে পারে? আসবার নিয়ম আছে?

নজর মহম্মদ জিভ কাটলে। বললে–নেহি বেগমসাহেবা, বাইরের লোক, বাইরের মানা ভেতরে আসা গুনাহ–এলে কোতল হয়ে যায়

মরালী কথাটা শুনে শিউরে উঠল। নজর মহম্মদ আরও বললে–শুধু পাঞ্জা থাকলে জেনানারা আর খোজারা আসতে পারে। নানিবেগম খুব কড়া মালকিন পিরালি ভি বড়া কড়া খোজাসর্দার–

কথাগুলো খুব মোলায়েম করে বললে–বটে নজর মহম্মদ, কিন্তু মনে হল যত মোলায়েম করে বললে–সে, জিনিসটা তত মোলায়েম নয়।

আচ্ছা তুমি যাও এখন।

নজর মহম্মদ কুর্নিশ করে চলে গেল। চলে যাবার পরে মরালী আস্তে আস্তে ঘরটা থেকে বেরোল। মসজিদ থেকে বেরোবার পর ঘরে এসে এদের দেওয়া শাড়ি বদলে নিয়েছে। এরা শাড়ি দিয়েছে, ঘাগরা দিয়েছে, ওড়নি দিয়েছে। বাক্স-ভরতি পোশাকআশাক দিয়েছে। একজন বাদি এসে সব গুছিয়ে দিয়ে চলে গেছে। হাতের কাছে একটা ঘোট ঘণ্টা রেখে দিয়ে গিয়েছে। বলে গিয়েছে-ওটা বাজালেইনাকি বাঁদিটা আসবে। কিন্তু আর কাউকে তখন ভাল লাগছিল না মরালীর। ছোটবেলা থেকে কেবল জীবনে বৈচিত্র্য খুঁজত সে। হাতিয়াগড়ের ছোট গ্রামের মধ্যেই ছাতিমতলার ঢিবিটার ওপর দাঁড়িয়ে দূরের আকাশের দূরত্ব মাপতে চাইত। নদীর জলে সাঁতার দিয়ে জলের তলায় পৌঁছোতে চাইত। রাস্তার লোকদের অকারণে রূঢ় কথা বলে আঘাত দিয়ে মজা দেখত। আজ ঘটনাচক্রে একেবারে বৈচিত্র্যের চুড়ায় এসে পৌঁছিয়েছে সে। এ-বৈচিত্র্যের শেষ দেখতে না পেলে যেন তার আর তৃপ্তি হচ্ছে না।

বাইরে টিমটিম করে একটা আলো জ্বলছে কোণের দিকে। সামনে উঠোনের ওপর জাফরি কাটা একটা দেয়াল। তার ওদিকে কী আছে দেখা যায় না। মাথার ওপর আকাশটা তারায় তারায় ভরে গিয়েছে। হঠাৎ কোন দিক থেকে যেন একটা আর্তনাদের শব্দ কানে এল। কে কাঁদছে এমন করে। যেন অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে কেউ। আবার অন্য দিক থেকে যেন গানের আওয়াজও ভেসে এল। উর্দু কি হিন্দুস্থানি গান বোধহয়।

মরালী আরও এগিয়ে গেল। এদিকটা যেন একটু ছাড়া-ছাড়া। আর ওপাশে যেন বেশ অনেক লোকের বাস। কোথাও বেশ মজলিস বসেছে গানের ফুর্তির আর হল্লার। অস্পষ্ট আওয়াজ বটে। কিন্তু মনে হল আনন্দের ফোয়ারা চলেছে সেখানে। আবার ওদিক থেকে কান্নাটা বড় বুকফাটা হয়ে কানে এল। কেন এত কান্না? কীসের কান্না? কে কাঁদছে?

পায়ে পায়ে আরও এগিয়ে গিয়েছিল মরালী। হঠাৎ সামনে একটা মূর্তি দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু কাছে আসতেই চেনা গেল। নজর মহম্মদ।

বেগমসাহেবা!

মরালী থমকে দাঁড়াল।

বেগমসাহেবার কিছু দরকার আছে? খানা? সরাব? আরক? পান? শরবত?

মরালী জড়োসড়ো হয়ে বললে–না—

কিছু দরকার থাকলে বান্দাকে এত্তেলা দেবেন বেগমসাহেবা! ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেই বান্দা বাঁদি সবাই হাজির হবে

মরালী আর এগোল না। আস্তে আস্তে পেছিয়ে এসে আবার নিজের ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। তারপর বিছানাটার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে দিলে। এ কোথায় এল সে! এখানে কি চিরকাল থাকতে হবে? এমনি করেই কি দিন কাটবে, রাত কাটবে? ওই কান্না শুনবে, আর গান শুনবে? এমনি করেই হাসি, গান, ফুর্তি, কান্না আর খানা, সরাব, আরক, পান,শরবত নিয়েই তার পৃথিবী চলবে? আর তারপর যখন লড়াই শেষ করে নবাব মুর্শিদাবাদে ফিরবে, তখন?

নজর মহম্মদ ফিরে আসতেই পিরালি খাঁ জিজ্ঞেস করলে–কী রে, কী খবর?

নজর মহম্মদ বললে–বড়ি দিমাগি জেনানা খাঁসাহেব, বড়ি একলোখখি ছুকরি। ভয়-ডর বিলকুল নেই–বেগমসাহেবা খাসমহলের দিকে আসছিল, সামলে নিয়েছি

কেন? খাসমহলের দিকে আসছিল কেন? ঘণ্টা রেখে দিসনি?

ওই যে বললুম দিমাগি জেনানা। ঘণ্টা রেখে দিয়েছি, তবু বাইরে আসছিল। খানা ভি খাবেনা, সরাব ভি খাবে না, পান ভি খাবে না, আরক ভি খাবে না, শরবত ভি খাবে না–

পিরালি খাঁ বললে–সবে নয়া এসেছে, চেহেলসুতুন দেখে তাজ্জব বনে গেছে আর কী! তা হোক, পোষ মানাতে কোশিস কর,নইলে নেসার সাহেব গোসসা করবে, খুব হুশিয়ার

নজর মহম্মদ বললে–আলবত পোষ মানবে, জরুর পোষ মানবে, দুনিয়ার জেনানাকে পোষ মানালুম, আর এ তো নয়ি ছুকরি খাঁ সাহেব

বলে নজর মহম্মদ নিজের কাজে চলে গেল।

১৭৫৬ সালের ১৫ জুন। ষষ্ঠীপদর স্বপ্নটাই শেষপর্যন্ত বুঝি সত্যি হল। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার ফৌজি-সেপাই বাগবাজারের মুখে হুড়হুড় করে ঢুকে পড়েছিল। নবাবের ফৌজ যে এমন করে সত্যি সত্যিই কলকাতায় এসে পড়বে তা হয়তো কেউই ভাবেনি। পেরিন-পয়েন্ট থেকে শুরু করে সমস্ত সুলতানুটি গোবিন্দপুরের লোকই তখন আবার পালাতে শুরু করেছে। একদিন যে কলকাতা জঙ্গল ছিল, একদিন বর্গির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গঙ্গা পেরিয়ে যারা ফিরিঙ্গিদের আওতায় এসে নিরাপদ নিশ্চিন্তে বসবাস শুরু করেছিল, বাড়িঘর বানিয়ে যে কলকাতাকে শহর বানিয়ে ফেলেছিল, সেই কলকাতা ছেড়েই আবার তারা গঙ্গা পেরিয়ে প্রাণ বাঁচাবার দায়ে বক্সবন্দরের দিকে পাড়ি দিলে।

ষষ্ঠীপদ আর বসে থাকতে পারল না চুপ করে। খানা-খন্দ পেরিয়ে একেবারে সোজা নবাবি ফৌজের তাবুর কাছে গিয়ে হাজির। তখন তিন দিন ধরে কেবল কামান দাগা আর গোলাগুলি চলছে।

হুজুর।

একেবারে সশরীরে গিয়ে হাজির সেপাইদের সামনে। বুকটা দুরদুর করে কাঁপছে। কিন্তু টাকা উপায় করতে গেলে এত ভয়-ভীত থাকলে চলে না।

হুজুর, আপনারা এখানে কেন মিছিমিছি কামান দাগছেন, এদিক দিয়ে তো কিছু সুবিধে হবে না হুজুরদের। শহরে ঢোকবার অন্য রাস্তা আছে, বাদামতলা দিয়ে ঢুকলেন না কেন? ডানকান সাহেবের বস্তির দিকটায় পল্টন ফল্টন কিছু নেই–একেবারে ফাঁকা

তুমি কে?

আমি হুজুর বেভারিজ সাহেবের খাস মুনশি ষষ্ঠীপদ আমরা বাহাত্তরে কায়েত

রাজা মানিকচাঁদের কাছে খবরটা গেল। নবাবের সঙ্গে তখন শলা-পরামর্শ চলছিল ভেতরে। মিরজাফর, মিরমদন, মোহনলাল সবাই মিলে আলোচনা চলছে। নবাব ফৌজের সামনের দিকের চার হাজার সেপাই, আর চারটে কামান বিকেল তিনটে থেকে রাত পর্যন্ত কেবল গুলিগোলা ছুড়ছে। কিন্তু কিছুই ফল হয়নি। ফিরিঙ্গিরাও সমানে গোলাগুলি ছুঁড়েছে। এরপর কী করা হবে সেই কথাই হচ্ছিল। এমন সময় ষষ্ঠীপদ গিয়ে হাজির।

রাজা মানিকচাঁদ বাইরে এসে লোকটার দিকে চেয়ে দেখলেন ভাল করে।

বললেন–তা তুমি তো ফিরিঙ্গি কোম্পানিতে চাকরি করো, ওদের তোড়জোড় কী রকম দেখেছ?

আজ্ঞে নস্যি নস্যি, কিচ্ছু নেই, আমার সাহেব তো ভয়ে একেবারে কাপড়েচোপড়ে হয়ে গেছে, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তাই খবরটা আপনাদের দিতে এসেছি হুজুর, আপনি যেন আমার নাম ফাস করে দেবেন না, তা হলে হুজুর আমাকে ওরা কেটে দু’খানা করে ফেলবে

রাজা মানিকচাঁদ বললেন–ঠিক আছে, তোমার কথা সত্যি হলে বকশিশ পাবে

হুজুর, তা হলে এক কাজ করুন, আমার ভয় করছে বড়, আমাকে একজন সেপাই দিয়ে একটু নিরাপদ জায়গায় পৌঁছিয়ে দিন, আপনাদের জয় নির্ঘাত

কথাটা বললে–বটে, কিন্তু মনে মনে ভয়ও ছিল। কেউ যদি দেখে ফেলে তা হলেই কর্ম ফতে। খানিক দূর এসেই বললে–সেপাইজি, তুমি এবার যাও, আমি এবার নিজেই ঠিক রাস্তা চিনে নেব

রাস্তা চেনার কথাটা বাজে। ওরকম বলতে হয়। সেপাইটা চলে যেতেই ষষ্ঠীপদ উলটোপথ ধরলে। কলকাতায় তখন নিশুতি। যে যেখান দিয়ে পারছে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। পালাক, সবাই পালাক। তাতেই ষষ্ঠীপদদের সুবিধে। সেখান থেকে সোজা একেবারে ফিরিঙ্গিদের কেল্লার গেটে এসে হাজির।

স্যার, বেভারিজ সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করতে দেবেন?

হু আর ইউ? তুমি কে?

কেল্লার গোরা পাহারাদাররা বড় কড়া পাহারা লাগিয়েছে তখন। ষষ্ঠীপদ বললে–আমি স্যার ষষ্ঠীপদ, ব্রাহ্মণ–গরিব বামুনের ছেলে, বেভারিজ সাহেবের সোরার গদির খাসমুনশি বড় বিপদে পড়ে আমার সাহেবকে একটা খবর দিতে এসেছি

কেল্লার ভেতরে তখন ক্যাপ্টেন ড্রেক, কুটস, ম্যানিংহ্যাম, হলওয়েল সবাই সলাপরামর্শ চালাচ্ছে। নবাবের ফৌজি সেপাই কত, তাই নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। হোমে ডেসপ্যাঁচ পাঠিয়ে দিয়েছে হলওয়েল সাহেব। হয়তো এই-ই শেষ। হয়তো চিরকালের মতো ক্যালকাটার কুঠি উঠিয়ে দিতে হবে। শেষপর্যন্ত ম্যাড্রাস গিয়েই সেটেল করতে হবে। ঠিক এমন সময় ষষ্ঠীপদ গিয়ে হাজির।

কী মুনশি? এত রাত্তিরে তুমি? আমি ভাবলুম, তুমিও পালিয়ে গেছ?

সেকী হুজুর, আপনার নুন খাই, আপনার সঙ্গে আমি নিমকহারামি করতে পারি কখনও? আপনাকে তো বলেছি হুজুর, আমি খাঁটি বামুন, আমার পইতে আছে। রোজ গঙ্গামাটি দিয়ে সে-পইতে পরিষ্কার করি, আমি কি আপনাকে ছেড়ে পালাতে পারি হুজুর কখনও?

কিন্তু কী খবর? এখন আমরা খুব ব্যস্ত আছি…।

ষষ্ঠীপদ বললে–হুজুর, সেই কথাই তো বলতে এসেছি, আমি আমার মামার বাড়ি থেকে আসছিলুম, হঠাৎ পেরিন-পয়েন্টের কাছে দেখি নবাব ফৌজটৌজ নিয়ে হাজির, লড়াই করতে এসেছে হুজুরদের সঙ্গে —

সে আর নতুন কী, সে তো সবাই জানে! ওসব বাজে কথা শোনবার এখন সময় নেই আমাদের

হুজুর, বাজে কথা নয়, আমি যে লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের সব দেখে এলুম

বেভারিজ সাহেব এতক্ষণে যেন একটু সজাগ হল। বললে–কী দেখলে? ক’হাজার সোলজার আছে কিছু জানতে পারলে? ওদের তোড়জোড় কী রকম দেখলে?

ষষ্ঠীপদ বললে–আজ্ঞে, নস্যি নস্যি—

নস্যি মানে?

ওই যা নাকে দেন আপনারা! তামাকের গুঁড়ো–তাই। একেবারে ফাঁকা আওয়াজ, নবাব তো শুনলুম ভয়ে একেবারে কাপড়েচোপড়ে হয়ে গেছে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তাই খবরটা আপনাকে দিতে এলুম হুজুর দেখবেন যেন কথাটা ফাস না হয় হুজুর, নইলে আমাকে ওরা কেটে একেবারে দুখানা করে ফেলবে–আমাদের সেই কাতাবু, আপনার মুনশি ছিল, সেনবাবের চরের চাকরি করছে কিনা–আমার ওপর তার রাগ আছে–

কান্তর নাম শুনেই বেভারিজ সাহেবের মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরোল–স্কাউড্রেল—

ষষ্ঠীপদ বললে–শুধু স্কাউড্রেল নয় হুজুর, আবার রাসকেল

বেভারিজ সাহেব কী যেন ভাবতে লাগল।

ষষ্ঠীপদ বললে–মিছিমিছি ভাববেন না হুজুর, আমি বলছি আপনাদের জয় নির্ঘাত

সাহেব আর দাঁড়াল না। কথাটা ক্যাপ্টেন ড্রেককে বলতে হবে। তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল। ষষ্ঠীপদও সোজা আবার অন্য পথ ধরলে। অন্ধকার রাত। সব লোজন পালাচ্ছে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে। ষষ্ঠীপদ একেবারে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে হাজির। ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নীচেয় নেমে গঙ্গাজল নিয়ে নিজের মাথায় ছিটোতে লাগল। মা, লড়াইটা বাধিয়ে দাও মা, সর এলোমেলো করে দাও–একবার প্রাণ ভরে লুটপাট করে নিই–তখন মা এই কলকাতার ৫৭৮৬ বিঘে ১৯ কাঠা জমির মালিক হতে পারব–তখন আর কাউকে পরোয়া করব না মা, তখন আর পরের চাকরি করতে হবে না মা-মা তুমি পতিতোদ্ধারিণী, পতিতকে উদ্ধার করে দাও মা আমাকে রাজা করো–রাজা করে দাও মা আমাকে–

তখন অল্প অল্প ভোর হচ্ছে।

হঠাৎ পুব দিক থেকে যেন একটা গুমগুম শব্দ হতে লাগল। ষষ্ঠীপদ সেইদিকে কান পেতে রইল। তা হলে মা তার ইচ্ছে পূর্ণ করেছেন। এই বাদামতলার দিক দিয়ে, ডানকান সাহেবের বস্তির দিক দিয়ে, নবাবি ফৌজ কলকাতায় ঢুকছে! জয় মা কালী! মা, তা হলে পতিতকে উদ্ধার করলে–আমাকে রাজা করলে—

চকবাজারের সারাফত আলির দোকানের ভেতরে তখন সবে কান্ত ঘুম থেকে উঠেছে। হঠাৎ বশির। মিঞা এসে হাজির। বললে–উঠেছিস, তোকে খবরটা দিতে এলুম–আমি এখনই কলকাতা থেকে এলুম–লড়াই ফতে রে–লড়াই ফতে হয়ে গেছে

সেকথায় কান্ত বিশেষ কান দিলে না। বললে–তোর বাড়িতে তোকে খুঁজতে গিয়েছিলুম

কেন? আমি তো ছিলুম না, কলকাতায় গিয়েছিলুম

সেই জন্যেই তো ভাবনায় পড়েছিলুম খুব।

কীসের ভাবনা?

কান্ত বললে–তোকে একটা কাজ করতে হবে ভাই, যে করে তোক করতেই হবে, আমাকে একবার রানিবিবির সঙ্গে হারেমের ভেতরে দেখা করিয়ে দিতেই হবে। তোর পায়ে পড়ি ভাই, দেখা করিয়ে দিতেই হবে, কাল সারারাত ভাই ভেবে ভেবে আমার ঘুম হয়নি।

বশির মিঞা অবাক হয়ে গেল। বললে–তুই বলছিস কী? তুই কি মস্তানা হয়ে গেছিস? দেখছিস শহর এখন মিরবকশির তাবে। ওদিক থেকে নবাবের ভাইরা এসে কোনদিন মসনদ লুটে নেবার তাল করছে। এখন চেহেল্‌-সুতুনে কড়া পাহারা বসে গেছে। খবরদার, ও-আবদার করিসনি। তুইও ফাটকে ঝুলবি আমাকেও ফাটকে ঝোলাবি ওসব আবদার ছাড় তুই

কান্ত বললে–তুই একটু চেষ্টা করে দেখ না—

ওরে বাবা, কেউ যদি জানতে পারে তো আমার জান নিকলে যাবে

বলে বশির মিঞা বাইরে চলতে আরম্ভ করল। বললে–সে জমানা আর নেই রে, নইলে তোকে ঢুকিয়ে দিতুম, এখন নানিবেগম খুব হুঁশিয়ার হয়ে গেছে। পিরালি খাঁ, নজর মহম্মদ, বরকত আলিরা এখন নিজেদের জান নিয়ে পাগল।

কিন্তু ভেতরে কোনও রকমেই যাওয়ার উপায় নেই? আমি একবার শুধু যাব, রানিবিবির সঙ্গে শুধু একটা কথা বলে চলে আসব শুধু একবার।

কেন, রানিবিবির সঙ্গে তোর কীসের কারবার?

কান্ত বললে–শুধু একটা কথা বলে আসব রানিবিবিকে

কী কথা?

কান্ত বললে–কাটোয়ার সরাইখানায় আমাকে রানিবিবি একটা খবর জানতে বলেছিল, সেটা বলা হয়নি আর। কোতোয়াল আর কথা বলতে দেয়নি

কী কথা?

বলেছিল একটা পাগলের নাম জেনে আসতে। পাগলটা গান গাইছিল সরাইখানার সামনে।

বশির বললে–উদ্ধব দাস? উদ্ধব দাসের কথা বলছিস?

তুই চিনিস উদ্ধব দাসকে?

খুব চিনি। আরে, লোকটা বেকাম লোক। আমি ওকে কাম দিতে চেয়েছিলুম। ও তো দুনিয়া টহল দিয়ে বেড়ায়, বলেছিলুম জাসুসি কাম করতে। তামাম বাংলা-মুলুকে এখন আমাদের জাসুস দরকার, ঘসেটি বেগমসাহেবাকে তো পাকড়ে রাখা হয়েছে, কিন্তু তবু দুশমনের তো কমতি নেই–

কান্তর ওসব কথা শুনতে ভাল লাগছিল না। ছোটবেলা থেকে কান্ত দেখে এসেছে ওসব দুশমন সকলেরই আছে। টাকাপয়সা প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তি থাকলেই দুশমন থাকবে। যত বেশি টাকা থাকবে, তত বেশি দুশমন থাকবে। বড়চাতরার নায়েব নাজিমবাবুদের মালখানা পাহারা দিত পাহারাদাররা বন্দুক নিয়ে।

কান্ত হঠাৎ কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললে–তা হলে দেখা করা হবে না রানিবিবির সঙ্গে?

না না, ওকথা বলিসনি এখন, অন্য কথা বল। তোকে এবার অন্য একটা কাজ দেব

কী কাজ?

একটা চিঠি দেব, সেই মহারাজ কিস্টোচন্দরকে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে

কার চিঠি?

ওসব পুছিসনি। তোকে যা কাম দেব তাই করবি–তা তার দেরি আছে, বখত হলেই বলব

বলে বশির মিঞা চলে গেল। কান্ত অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেও কী করবে তার কূল-কিনারা করতে পারলে না। আবার ফিরে এল সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানে। ক’দিন থেকেই এই দোকানের পেছনে থেকে থেকে কান্ত একটা জিনিস বুঝে নিয়েছিল যে, সারাফত আলির কাছে। মুর্শিদাবাদের নানান ধরনের লোক নানান কাজে আসে। সারাফতকে সবাই যেন একটু মান্যগণ্য করে। মিঞাসাহেবের টাকাও আছে বেশ। আসলে টাকা উপায় করবার জন্যে কারবার করলেও সারাফত আলির যেন অন্য আর-একটা দিকও আছে। সেটা যে কী তা কান্ত এতদিন মিশেও বুঝতে পারেনি। মাঝে মাঝে বুড়ো কান্তকে ডাকে। জিজ্ঞেস করে-কাস্তর সংসারে কে কে আছে। কেন মুর্শিদাবাদে চাকরি করতে এসেছে। দিনেরবেলা যখন নেশা থাকে না মিঞাসাহেবের তখন ভাল ভাল উপদেশ দেয়। বলে–এ বড় আজব শহর, এখান থেকে ভাগ তুই কান্তবাবু। নবাব একদিন ডুববেই, মুর্শিদাবাদও একদিন ডুববে, তখন তুইও ডুববি

কান্ত বসে বসে বুড়োর কথাগুলো শুনত। দুপুরবেলা যখন খদ্দের থাকত না দোকানে, চকবাজারের রাস্তাটা যখন খাঁখাঁ করত, তখন বুড়ো নেশা করত না। ওই শুধু গড়গড়াটা টানত ভুভুক ভুড়ুক করে। কান্ত থাকবার জন্যে ঘরখানার ভাড়া দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বুড়ো নেয়নি। কান্ত জোর করে বুড়োর হাতে কড়ি খুঁজে দিতে চেয়েছিল। বুড়ো সেকড়ি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল চকবাজারের রাস্তায়। বলেছিল–তোর কাছ থেকে আমি কেরায়া নেব? তুই কি ভেবেছিস আমি রুপিয়ার কাঙাল?

তারপর থেকে আর কেরায়ার কথাও ওঠেনি, কান্তও কেরায়া দেয়নি। কিন্তু মনে হত কী যেন একটা রহস্য লুকিয়ে আছে সারাফত আলির জীবনের পেছনে। নইলে নিজামতকে অত গালাগালি দেয় কেন দিনরাত। কেন উঠতে বসতে নবাবকে গালমন্দ করে?

কান্ত জিজ্ঞেস করত–চাকরি না করলে আমি খাব কী? বাঁচব কী করে?

সারাফত আলি বলত–যারা চাকরি করে না তারা খেতে পায় না? তারা বেঁচে নেই?

কিন্তু আমার যে কেউ নেই, কিছু নেই মিঞাসায়েব।

বুড়ো বলত–আমার কে আছে? আমাকে কে খিলাচ্ছে? খিলানোর মালিক যদি খিলায় তো নবাবের চৌদ্দহ-পুরুষের সাধ্যি আছে তোকে মারে?

তারপর কান্ত বুঝি আর কৌতূহলটা চেপে রাখতে পারত না। জিজ্ঞেস করত–মিাসায়েব, আপনি কেন বুড়ো বয়সে এত খাটছেন? এত কারবার করে পরশান হচ্ছেন? কার জন্যে? আপনার এত টাকা খাবে কে?

একথার উত্তর দিতে বুড়ো বুঝি একটু থতমত খেয়ে থমকে যেত। উত্তর দিতে গিয়েও থেমে যেত। তারপর গড়গড়ার নলটা নিয়ে ভুড়ভুড় করে টানতে শুরু করত। আর কোনও কথার জবাব দিত না। অন্য কথা বলত।

সেদিন দোকানের ভেতরে চুপি চুপি কার সঙ্গে বুড়োর কথা হচ্ছিল। কান্ত পেছনের ঘর থেকে সব শুনছিল।

মিঞাসাহেব জিজ্ঞেস করলে–কী রে নজর মহম্মদ, বিবিজানের দিমাগ কিসতরহ হ্যায়?

লোকটা বললে–ওইসাহি হ্যায়, বহোত রো রাহি হ্যায় খুব কাঁদছে মিঞাসাহেব-ইলাজ করছি, তবু কিছু আরাম হচ্ছে না

মিঞাসাহেব বললে–আরাম হবে না

নজর মহম্মদ বললে–কেও মিঞাসাহেব?

সরাফত আলি সাহেব চিৎকার করে উঠল মালেখুল্লিয়া দিমাগি কভি আচ্ছা নেহি হোনেওয়ালি, আরাম ভি নেহি হোগা, ঔর ইলাজ ভি কোই নেহি বানানে সেকেঙ্গে, তুমহারা হারেম ভি জাহান্নমমে যানেওয়ালা–যাও, আরক নেহি মিলেগা মেরে পাস, যাও-নিকাল যাও ইহাসে

বুড়ো সারাফত আলি যখন রেগে যায় তখন কাউকেই আর পরোয়া করে না। তখন যাকে-তাকে যা-তা বলতে শুরু করে। নজর মহম্মদও তা জানে। জানে বলেই হয়তো কিছু বললে–না। সওদা নিয়ে চলে গেল হাসতে হাসতে।

কথাটা মনে ছিল কান্তর। সেদিন যখন সারাফত আলির নেশা কেটে গেছে, তখন আবার ডেকে পাঠিয়েছে কান্তকে। কান্ত কাছে যেতেই বুড়ো জিজ্ঞেস করলে-কাল তাঞ্জামে কাকে নিয়ে এলি তুই, কান্তবাবু? কোন বিবিজানকে?

কান্ত চুপ করে আছে দেখে বুড়ো আবার জিজ্ঞেস করলে বল, কাকে নিয়ে এলি? আমি সব জানি। আমার কাছে লুকোসনি। আমি কাউকে বলব না–

কান্ত বললে–হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে।

কথাটা শুনেই বিনা নেশাতেই সারাফত আলির চোখ দুটো লাল হয়ে উঠল–উল্লুকা-পাট্টা

কান্ত বুঝল মিঞাসাহেব রেগে লাল হয়ে গেছে। কথা না বলে মিঞাসাহেব ঘন ঘন গড়গড়ার নলে খুব টান দিতে লাগল। তারপর অনেকক্ষণ পরে বললে–কেন নিয়ে এলি?

কান্ত বললে–আমি শুধু হুকুম তামিল করেছি মিঞাসাহেব, আমার কোনও দোষ নেই

দোষ নেই? তোরই তো দোষ। কেন তুই হিন্দুর বিবিকে মুসলমানের হারেমে আনলি? চেহেলসূতুনে জেনানার ইজ্জত থাকবে? তুই তো জাহান্নমে যাবি, তোদের কাফেরদের তো নরক আছে, সেখানে যাবি তুই বেশক

কান্ত চুপ করে রইল। বুড়োও খানিকক্ষণ গড়গড়া টানতে লাগল একমনে।

কান্ত একবার হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে–আচ্ছা মিঞাসাহেব, ওই যে কাল আপনার কাছে এসেছিল, নজর মহম্মদ নাম, ও কে? ও কি চেহেল্‌-সুতুনের লোক?

হ্যাঁ, খোঁজা মহম্মদ।

আচ্ছা, ওকে বললে–আমাকে একবার চেহেল্‌-সুতুনে ঢুকিয়ে দিতে পারে না? হাতিয়াগড়ের রানিবিবির সঙ্গে মুলাকাত করিয়ে দিতে পারে না?

কেন? মুলাকাত করবি কেন? কী কাম তোর রানিবিবির সঙ্গে?

কান্ত বললে–রানিবিবি পালিয়ে যেতে চেয়েছিল রাস্তায়। তখন আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কাটোয়ার ডিহিদারের লোক আসাতে আর পালানো হয়নি। এবার দেখা করে ভাবছি কথাটা তুলব–

বিবিকে নিয়ে পালিয়ে যাবি চেহেল্-সুতুন থেকে?

কান্ত বললে–হ্যাঁ মিঞাসাহেব, আমি বুঝতে পেরেছি আমি পাপ করেছি, আমি সে-পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই মিঞাসাহেব, আমার রাত্তিরে ঘুম হচ্ছে না ক’দিন থেকে

সারাফত আমি এবার মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে কান্তকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখলো যেন মনে হল কান্তকে পরখ করছে একদৃষ্টে।

তারপর বললে–পারবি তুই কান্তবাবু? তোর কলিজার জোর আছে?

কান্ত বললে–পারব মিঞাসাহেব। রানিবিবি যদি রাজি থাকে তো আমার সাহসের অভাব হবে না। আমি বলছি, আমি পারব

ঠিক পারবি?

সারাফত আলির যেন সন্দেহ হল। পারবি তত ঠিক? ভয় করবে না তো তোর?

হ্যাঁ, বলছি তো পারব মিঞাসাহেব। নিশ্চয় পারব।

চেহেল সুতুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে পারবি? ভেঙেচুরে একেবারে গোরস্থান বানিয়ে দিতে পারবি? যেন হাজি মহম্মদের বংশের হাড়টা পর্যন্ত কবরের ভেতরে ভয়ে কেঁপে ওঠে, এমন করে নবাব-হারেমের প্রত্যেকটা ইট গুঁড়িয়ে পিষে ফেলতে পারবি? সত্যি বলছিস, তুই পারবি?

বুডোর গলাটা যেন কেমন করুণ শোনাল বড়।

কান্ত বললে–হ্যাঁ পারব মিঞাসাহেব! আপনি যদি একটু মদত দেন তো নিশ্চয় পারব—

বুড়ো এবার কান্তকে একহাত দিয়ে একেবারে জড়িয়ে ধরলে। এরকম কখনও করে না সারাফত আলি। বুড়োর চোখ দিয়ে এর আগে কখনও জল পড়তেও দেখেনি কান্ত। এ কী হল বুড়োর!

আমি পারিনি রে কান্তবাবু! আমি কোশিস করেছিলুম, কিন্তু পারিনি। আমার কলিজা ভেঙে দিয়েছে ওরা, আমাকে নেশা ধরিয়েছে ওরা, আমাকে দিওয়ানা করেছে ওরা, তাই আজ আমি আফিং মিশিয়ে তাম্বাকুর ধোঁয়া টানি, আফিং খাই, চরস খাই, ওদের পোড়াতে গিয়ে আমি নিজেই পুড়ে আজ খাক হয়ে গেছি কান্তবাবু…

বলতে বলতে সারাফত আলি সাহেব হঠাৎ মাঝপথে থেমে গেল। হয়তো বুঝতে পেরেছে এত কথা বলা কান্তর সামনে উচিত হয়নি। কিন্তু না, সেই লোকটা আবার এসে হাজির। সেই নজর মহম্মদ! নজর মহম্মদকে দেখেই সারাফত আলি সামলে নিয়েছে নিজেকে। নজর মহম্মদও একজন অচেনা লোককে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে।

সারাফত আলি কান্তর দিকে চেয়ে বললে–তুই এখন যা কান্তবাবু, আমার খদ্দের এসেছে

কান্ত চলে যেতেই সারাফত নজর মহম্মদকে খাতির করে দোকানের গদিতে বসাল। তাকিয়া এগিয়ে দিলে। বললে–ইলাজ হল নজর মিঞা?

নজর মহম্মদ সে-কথার উত্তর না দিয়ে বললেও কে মিঞাসাহেব? কাফের আদমি মালুম হচ্ছে?

সারাফত আলি বললে–তোমার সঙ্গে একটা বাত আছে নজর মিঞা, একটা কাম করতে পারবে আমার? একটা উপকার?

বলুন মিঞাসাহেব?

তোমাদের চেহেল্‌-সুতুনে হাতিয়াগড়ের রানিবিবি এসেছে না?

নজর মহম্মদ কথাটা শুনেই শিউরে উঠল। সর্বনাশ। তার পরেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললে–হাতিয়াগড়ের রানিবিবি! কই, না তো মিঞাসাহেব! নইবেগম যে এসেছে সে তো লস্করপুরের তালুকদারের লেড়কি মরিয়ম বেগম

আমার কাছে ঝুট বোলো না নজর মিঞা, আমার সব মালুম আছে–

নজর মহম্মদ একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। সারাফত আলি আবার বলতে লাগল আর যার কাছে যা বলো তুমি, আমার সঙ্গে দিল্লাগি করতে যেয়ো না। হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে যে-আদমি এনেছে সে আমার খুলিতে আছে, আমি সব জানি

নজর মহম্মদ আর কোনও কথা বলতে পারলে না।

সারাফত আলি বললে–আমার একটা কাম করতে হবে তোমাকে নজর

কী কাম?

আমার আদমিকে চেহেল্‌-সুতুনের হারেমের অন্দরে নিয়ে যেতে হবে একদফে, রানিবিবির সঙ্গে তার মুলাকাত করিয়ে দিতে হবে

নজর মহম্মদ ভয় পেয়ে গেল। চারিদিকে চেয়ে গলা নিচু করে বললে–এ আপনি কী বলছেন মিঞাসাহেব? আমি কি হারেমের মালিক, মালিক তো নানিবেগম

সারাফত আলি বললে–ওকথা তুমি দুসরা কাউকে বোলো নজর, আমাকে বলতে এসো না–আসলি মালিক কে তা আমি জানি

আসলি মালিক তো পিরালি মিঞাসাহেব।

তা হলে এতক্ষণ ঝুটমুট কথা বাড়াচ্ছিলে কেন? আমার এ কাজটা করতেই হবে। পিরালিই মালিক হোক আর যে-ই মালিক হোক, তুমিই তো সব। নজরানা কত লাগবে বলো?

কীসের নজরানা?

সারাফত আলি হেসে উঠল। বললে–ঘুষ, রিশশোয়াত। বেগম-নজরানাতে তো হারেমের খোজারা কিছু করে না, তাই জিজ্ঞেস করছি! কত নেবে তুমি?

নজর লজ্জায় পড়ল। বললে–আপনার কাছে কী নেব মিঞাসাহেব?

না, তোমাকে নিতে হবে। তোমার যা মামুলি পাওনা আছে, তা আমি আমার নিজের ভবিল থেকে দেব। এক মোহর?

নজর বললে–সে আপনার যা খুশি দেবেন—

কথাটা শুনেই সারাফত আলি চিৎকার করে ডাকলে কান্তবাবু, ইধর আ–

এতক্ষণ পেছনের ঘরে দাঁড়িয়ে কান্ত সবই শুনছিল। এবার সামনে এসে দাঁড়াতেই সারাফত আলি তাকে দেখিয়ে নজর মহম্মদকে বললে–এই আমার আদমি, এ যাবে

নজর মহম্মদ ভাল করে দেখে নিলে কান্তকে। তারপর বললে–ঠিক আছে মিঞাসাহেব, আপনি যখন বলছেন, তখন ঠিক আছে, লেকিন কেউ যেন জানতে না পারে–

সারাফত বললে–কেউ জানবে না, কৌয়া-চিড়িয়া ভি জানবে না–

নজর মহম্মদ বললে–তা হলে আমি সামকা বখত আসব মিঞাসাহেব, বাবুজিকে মেরে সাথ লিয়ে চলব–বলে সেলাম করে নজর মহম্মদ চলে গেল।

নজর মহম্মদ চলে যেতেই সারাফত আলি কান্তর দিকে ফিরল। বললে–তা হলে তৈয়ার থাকবি কান্তবাবু, কিন্তু যা বললুম তা পারবি তো? চেহেল-সুতুন ভেঙে গুঁড়িয়ে পিষে গোরস্থান বানাতে পারবি তো? আমি যা পারিনি তুই তা পারবি তো?

মনে আছে কান্ত সেদিন বুড়োর এই কথাগুলো শুনে বড় অবাক হয়ে গিয়েছিল। চেহেল্‌-সুতুনের ওপর বুড়ো সারাফত আলির কীসের এত রাগ? কেন এত অভিযোগ! কী করেছে বুড়োর চেহেল-সুতুন? কী এমন অপরাধ করেছে যার জন্যে নিজের গাঁটের মোহর খরচ করে কান্তকে হারেমের ভেতরে যাবার ব্যবস্থা করে দিলে?

হাতিয়াগড়ের রাজবাড়িতে জনার্দন আসার পর থেকেই জগা খাজাঞ্চিমশাই বলে দিয়েছিল–দেখো বাপু, তুমি নতুন লোক, তোমাকে বলে রাখাই ভাল, ছোটমশাইয়ের মেজাজ বড় কড়া। ভাল করে কাজ চাই কিন্তুক, নইলে অন্য লোক দেখব

কিন্তু জনার্দনের কাজকর্ম দেখে সবাই অবাক। বরাবর শোভারামই একাজ করে এসেছে। সেই গদাইলশকরি চালে আসত। তারপরে গোকুল তেল এনে দেবে, গামছা এনে দেবে, শোভারাম তখন ছোটমশাইকে তেল মাখাতে শুরু করবে। তারপর সোহাগের মেয়ে মরালী। মেয়ের খেদমত করবে, না ছোটমশাইয়ের খেদমত করবে! মেয়ের জন্যে কাজে মনই ছিল না শোভারামের। তারপর শোভারামের নিজের কোফা জমি ছিল। তাতে জন খাঁটিয়ে বেগুনটা উচ্ছেটা চাষ করত। তারপর আছে কান্নাকাটি। জগা খাজাঞ্চিবাবুর কাছে এসে প্রায়ই হাত পাতত। বলত–খাজাঞ্চিবাবু, দুটো টাকা হাওলাত দ্যান, আর পারিনে

এই রকম হাওলাত নিয়ে নিয়ে যে কত টাকা বাকি পড়েছিল তার আর হিসেব ছিল না। একদিন জগা খাজাঞ্চিবাবু আর পারলে না। সোজা গিয়ে ছোটমশাইকে বললে–শোভারামের কাছে কাছারির ছ’টাকা তেরো গণ্ডা দামড়ি বকেয়া পাওনা, তাগাদা দিয়ে দিয়েও আর পাচ্ছি না, কী করব তাই হুকুম দেন

ছোটমশাইও যেমন। আদর দিয়ে দিয়ে একেবারে মাথায় তুলেছিলেন। বললেন–ওর কি আর দেবার ক্ষমতা আছে খাজাঞ্চিমশাই, ওটা আমার নামেই খয়রাত দেখিয়ে দাও খাতায়–

কিন্তু এবার জনার্দন আসতেই জগা খাজাঞ্চিবাবু আগেভাগে কথা বলে নিয়েছিল দেখো বাপু, তোমার আবার শোভারামের মতো সোহাগের মেয়েটেয়ে নেই তো?

জনার্দন হাতজোড় করে বলেছিল–না

আগে কোথাও কাজকাম করেছ?

আজ্ঞে না, হুজুর।

দেশ কোথায়?

ছিন্নাথপুর।

শুধু ছিন্নাথপুর বললে–আমি কী বুঝব। কোন ছিন্নাথপুর? নদের ছিন্নাথপুর না ঝিনেদের ছিন্নাথপুর।

আজ্ঞে ঝিনেদের ছিন্নাথপুর।

জগা খাজাঞ্চিবাবু জনার্জনের নাম-ধামকুলজি লিখে নিলে খাতায়। যদি তেমন মন দিয়ে কাজ করতে পারো তো তোমাকেও কোফা প্রজা করে নেব। ছোটমশাইকে তেল মালিশ করে চান করিয়ে দিতে হবে রোজ। তারপর ফাইফরমাশটাও খাটতে হবে। ছোটমশাইয়ের সঙ্গে দরকার পড়লে মহলে যেতে হবে।

সবতাতেই জনার্দন রাজি। যে-কোনও মাইনে, যে-কোনও কাজ, কিছুতেই না বলেনি জনার্দন। ছোটমশাই তখন নিজের মহলে বেরোনই না। শরীরটা খারাপ। নীচে নামাও তার বারণ। কবিরাজ মশাই আসেন, ভেতরে গিয়ে তাকে দেখে আসেন, তারপর চলে যান ওষুধ দিয়ে।

একদিন জনার্দন গোকুলকে জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁগো, কী ব্যামো ছোটমশাইয়ের?

গোকুল বললে–বড় ভারী ব্যামো গো, বড় ভারী ব্যামো

তা কবিরাজ মশাই কী বলছেন? কদ্দিন লাগবে সারতে?

তা লাগবে অনেকদিন। এ তো তোর-আমার মতো গরিবের ব্যামো নয়,

জনার্দন তবু যেন খুশি হল না। জিজ্ঞেস করলে ব্যামোটা হল কেন হঠাৎ?

গোকুল রেগে উঠল।–তা মানুষের ব্যামো হবে না? রোগ ব্যামো না হলে কবিরাজ-বদ্যি-হাকিম কী করতে আছে? তারা কী খাবে?

তা বটে। কথাটা বোধহয় বুঝল জনার্দন। কিন্তু বুঝেও সময় পেলেই অকারণ প্রশ্ন করা স্বভাব জনার্দনের।

গোকুল রেগে যায়। বলে–তোর অত কথা জানবার ইচ্ছে কেন বল তো জনার্দন? তোর খেতে পাওয়া নিয়ে কথা। দু’বেলা অতিথিশালায় খাবি আর কাজ করবি। আর কাজ না থাকে তো পায়ের ওপর পা দিয়ে আয়েশ করে বসে থাকবি। তোর সব কথায় থাকার দরকারটা কী?

জনার্দন বললে–তা যা বলেছ গোকুল, আমার কীসের মাথাব্যথা। দু’বেলা দুটো খাব আর কাজ থাকে পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশ করে বসে থাকব। কী বলে?

কিন্তু তবু চুপ করে থাকতে পারে না জনার্দন। দরকার না থাকলেও কানুনগো কাছারিতে গিয়ে বসে। এটা ওটা জানতে চায়। জগা খাজাঞ্চির ওপর অগাধ ভক্তি আবার। দেখলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মাথায় হাত ঠেকায়।

জগা খাজাঞ্চিবাবু বলে লোকটার দেবদ্বিজে ভক্তিটক্তি আছে দেখছি, শোভারামের মতো নয়

জনার্দন বলে শুধু বসে বসে ভাত গিলছি খাজাঞ্চিমশাই, একটা কিছু কাজকাম দেন, আর ভাল্লাগছে না–

কী কাজ করবি তুই? কী কাজ জানিস?

আজ্ঞি হুজুর, সব কাজ জানি। জল তুলতে জানি, বাটনা বাটতে জানি। ঘর ঝাড় দিতে জানি, পা টিপে দিতে জানি। জানি সব কাজই খাজাঞ্চিবাবু, ছোটমশাই যদ্দিন ব্যায়োতে আছেন, তদ্দিন না হয় অন্য কাজ করি। কাজ না করে করে যে গায়ে-গতরে ব্যথা হয়ে গেল আমার

এমন উৎসাহী লোক জগা খাজাঞ্চিবাবু জীবনে দেখেনি আগে। একটু অবাক হয়ে গেল। তারপর বললে–আচ্ছা ঠিক আছে, আমার পা দুটো একটু টিপে দে দিকিনি, দেখি তোর কেমন কেরামতি

তা সেদিন থেকে সেই কাজই করতে লাগল জনার্দন। যতদিন ছোটমশাই না নীচেয় নামেন ততদিন জনার্দনকে দিয়ে নিজের পা টিপিয়ে নিতে লাগল জগা খাজাঞ্চিবাবু। তারপর সময় পেলেই অতিথিশালায় গিয়ে ঢোকে। গোকুলের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়। গোকুলের সঙ্গে বারবাড়ি পেরিয়ে ভেতরবাড়ি পর্যন্ত যাবার চেষ্টা করে। ভেতরবাড়িতে একলা গিয়ে গোকুলের নাম করে এদিক-ওদিক উঁকি মেরে দেখে।

কেউ দেখলে জিজ্ঞেস করে–কে গো তুমি?

আজ্ঞে আমি জনার্দন।

তা ভেতরবাড়িতে কেন?

আজ্ঞে গোকুলকে ডাকতে যাচ্ছি

তারপর আর কেউ তেমন আপত্তি করে না। শোভারামও এমনি মাঝে মাঝে ভেতরে যেত। দু’-একদিন ভেতরে গিয়ে গিয়ে রাস্তাঘাটও চিনে নিলে। বাড়ির ভেতর বিরাট মহল। এক মহল পেরিয়ে আর এক মহলের সামনে গিয়ে এদিক-ওদিক উঁকি মারে। তারপর পাছে কারও সন্দেহ হয় তাই ডাকে–গোকুল, ও গোকুল

কে গা?

তরঙ্গিনী একদিন দেখতে পেয়েছে। নতুন মুখ দেখে ঘোমটা দিয়ে দিয়েছে মাথায়।

আমি জনার্দন মা, গোকুল আছে ইদিকে?

না বাবা, গোকুল এ-মহলে তো থাকে না, ও-মহলের ভেতর-দরজায় গিয়ে ডাকো

এমনি করে ক’দিনের মধ্যেই জনার্দনের বেশ চেনাশোনা হয়ে গেল সব। অন্ধকারে চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলেও বেশ অনায়াসে বেরিয়ে আসতে পারে। দুপুরবেলা যখন সবাই খাওয়াদাওয়ার পর গা-আলগা দিয়েছে, জনার্দন তখনও চুপচাপ থাকে না। রেজা আলির কাছেও মাইনে নিচ্ছে, ছোটমশাইয়ের কাছেও মাইনে নিচ্ছে। কিছু কাজ না দেখাতে পারলে রেজা আলি আর কতদিন চাকরিতে রাখবে!

গোকুলকে জিজ্ঞেস করলেহ্যাঁগা, তা তোমাদের শোভারাম পাগল হয়ে গেল কেন গা?

গোকুল বলে–মেয়ের শোকে আর কীসে?

তা মেয়ে গেল কোথায়?

মেয়েছেলের চরিত্তিরের কথা কে বলতে পারে বল! ভগবানও বলতে পারে না, আমি তো কোন ছার

তার পরেই হঠাৎ জনার্দন জিজ্ঞেস করে বসে–ছোটমশাইয়ের বুঝি দুটো বিয়ে গো গোকুল?

গোকুল চাইলে জনার্দনের দিকে। সন্দেহ করলে নাকি!

জনার্দন বলে কিছু মনে করলে না তো ভাই! শুনেছি কিনা যে ছোটমশাইয়ের দুটো বিয়ে, তাই জিজ্ঞেস করলুম

তারপর নিজেই আবার বলে–তা দুটো বিয়েই হোক আর তিনটে বিয়েই হোক, আর ছ’টা বিয়েই হোক, আমরা চাকর-মনিষ্যি, আমাদের ওসব খোঁজ নিয়ে কী দরকার বলো না! খেতে পাচ্ছি পেট ভরে, তাই বলে বাপের ভাগ্যি

তারপর রাত যখন গম্ভীর হয়, যখন সব নিশুতি, তখনও জনার্দন জেগে থাকে। জেগে বসে কানটা খাড়া করে রাখে। কোথায় যেন একটা শব্দ হল না? কে যেন ফিসফিস করে কোথায় কথা বলছে না? কোথায় যেন ঝনঝন শব্দে শেকল খুলে গেল। আস্তে আস্তে অতিথিশালাটা পেরিয়ে ভেতরবাড়ির খিলেনের তলা দিয়ে টিপি টিপি পায়ে এগিয়ে গেল। মনে হল ওদিকের বারান্দায় যেন একটা কার পায়ের শব্দ হচ্ছে। শব্দটা আরও কাছের দিকে আসছে। ভূতের বাড়ি নাকি?

কে র‍্যা?

একেবারে দুর্গার মুখোমুখি পড়ে গেছে জনার্দন। অন্ধকারে ভাল দেখা যাচ্ছে না। দূরে এককোণে একটা আলো জ্বলছিল। তার আলোটা মুখে এসে পড়তেই একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে। দুর্গা এসেই একেবারে জনার্দনের হাতটা চেপে ধরেছে।

কে র‍্যা তুই মুখপোড়া?

জনার্দন বলে উঠল–আমি মা, আমি

দুর্গা তবু ছাড়বার পাত্রী নয়। আমি কে? আমি-র নাম নেই রে মুখপোড়া? একেবারে ভেতরে এসে ঢুকে পড়েছ? ডাকব মাধব ঢালিকে?–অ মাধব, মাধব

দুর্গার চিৎকারে সবাই জেগে উঠেছে। ঝি-চাকর সবাই এসে হাজির। গোকুলও এসে হাজির। দুর্গা তখন চিৎকার করে উঠেছে–ডাক তো গোকুল মাধব ঢালিকে ডাক তো

জনার্দনের মুখখানা দেখে গোকুল অবাক। আরে, তুই জনার্দন? তুই এত রাত্তিরে ভেতরবাড়িতে কী করতে?

জনার্দন তখন কেঁদে ফেলেছে একেবারে। কাঁদতে কাঁদতে বললে–আমি অন্ধকারে ঠাওর করতে পারিনি মা, আমাকে ছেড়ে দেন

গোকুল বললে–ও দুগ্যা, এ যে আমাদের জনার্দন গো

তা জনার্দন তোক আর গোবর্ধন হোক, ভেতরবাড়িতে মেয়েমহলে কী করতে আসে হারামজাদা। বড় বউরানিকে ডাকব?

গোকুল বললে–ছেড়ে দাও দুগ্যা ওকে, ও নতুন লোক, মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়েছিল, আর ফিরে এসে পথ চিনতে পারেনি, ভেতরে ঢুকে পড়েছে ছেড়ে দাও

দুর্গা জনার্দনের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললে–যা এখান থেকে, আর যদি কখনও ভেতরমহলে ঢুকবি তো তোকে খুন করে ফেলব হারামজাদা, আমার কাছে ছেনালিপনা করতে এসেছ?

গোকুল বুঝিয়েসুঝিয়ে আবার জনার্দনকে বাইরে নিয়ে গেল। ঝি-চাকর আবার যে-ার জায়গায় শুতে চলে গেল। দুর্গা আস্তে আস্তে সিঁড়ির তলার ঘরখানার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আবার সব নিঃঝুম। হয়ে গেছে। সিঁড়ির তলার ঘরখানার কুলুপ খুলে ভেতরে ঢুকতেই ছোট বউরানি কথা বলতে যাচ্ছিল।

দুর্গা ফিসফিস করে বললে–চুপ করে বউরানি, চুপ করো–

ছোট বউরানি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলে–অত চেঁচাচ্ছিলি কেন রে? কী হয়েছিল?

শয়তান ঢুকেছে গো বাড়ির মধ্যে।

শয়তান? কী বলছিস তুই?

হ্যাঁ ছোট বউরানি, পিরের কাছে মামদোবাজি করতে এসেছে। মর মুখপোড়া। দুগ্যাকে এখনও চেনেনি, হারামজাদা মিনসে।

ছোট বউরানি বুঝতে পারছিল না কিছু। বললে–কার কথা বলছিস তুই? কে?

দুর্গা বললে–আমি কদিন থেকে দেখছি মিনসেকে, শোভারামের বদলা কাজ করতে এসেছে, কেবল ভেতরবাড়ির দিকে উঁকিঝুঁকি মারে। আজ রাত্তিরে একেবারে খালি পেয়ে এ-মহলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে

ছোট বউরানি জিজ্ঞেস করলে–কেন রে? ঢুকে পড়েছে কেন?

ও নির্ঘাত চর, ডিহিদারের চর। আমার চোখকে ভোলাবে মিনসে তেমন বাপের জম্মিত নই আমি। আমি মিনসের চোদ্দপুরুষের মুন্ডু ঘুরিয়ে দেব না!

ছোট বউরানি হঠাৎ বললে–ওকথা থাক, আর কিছু খবর পেলি তুই? মরালী গিয়ে মুর্শিদাবাদে পৌঁছেছে?

দুর্গা বললে–হ্যাঁ, ভালয় ভালয় পৌঁছে গেছে, কেউ টের পায়নি

তা হলে আর কদ্দিন এরকমভাবে থাকব এখানে?

দুর্গা বললে–আর ক’টা দিন, নবাব তো কলকাতায় ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে গেছে, যদি বেটা সেখানেই ফিরিঙ্গিদের গোলা লেগে মরে যায় তো বুড়ো শিবের মন্দিরে পুজো দেব বউরানি, মানত করে রেখেছি; তখন আবার তোমাকে ওপরে নিয়ে গিয়ে ছোটমশাইয়ের পাশে শুইয়ে দিয়ে আসব, আর ক’টা দিন সবুর করো না

ছোটমশাই আমার কথা বলে না আর?

দুর্গা বললে–বলেন না আবার? তোমার জন্যে দাঁতে একটা কুটো পর্যন্ত কাটছেন না এ কদিন। নীচেয় পর্যন্ত নামছেন না। শুনেছেন তো তোমাকে খুন করে ফেলা হয়েছে, সেই কথা শোনার পর থেকেই শয্যাশায়ী

তারপর একটু থেমে আবার বললে–এদিকে এই নতুন ঝাটে আবার মাথাটা গরম হয়ে গেছে আমার। এ-মিনসেকে না শায়েস্তা করলে আর চলছে না। দাঁড়াও না, এ-বেটাকে এবার উচাটন করবই–তুমি দেখে নিয়ো, ঠিক করব, তেমন বাপের জম্মিত আমি নই, না-যদি করি তো আমার নাম দুগ্যাই নয়

নবাবের সেপাইরা সেদিন হুড়মুড় করে কেল্লার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। একদিন যে জেনারেল ড্রেককে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে নতুন এম্পায়ার গড়বার স্বপ্ন দেখেছিল, সেই জেনারেল তখন গঙ্গায় জাহাজ ভাসিয়ে ভাগীরথীর বুক বেয়ে অনেক দূর চলে গেছে। শুধু ড্রেক নয়, মিস্টার মার্কেট, মিস্টার বেভারিজ মিনুচিন, ক্যাপ্টেন গ্র্যান্ট সবাই। কেল্লার মধ্যের ফিরিঙ্গিরা, যারা পালাতে পারেনি, তারা কান্না জুড়ে দিয়েছে হাউমাউ করে। হলওয়েল সাহেব দৌড়ে গিয়ে হাজির হল উমিচাঁদের কাছে। হলওয়েল থরথর করে কাঁপছে। গলার আওয়াজ বেরোচ্ছে না। এখন কী হবে উমিচাঁদজি?

উমিচাঁদ বললে–দাঁড়াও সাহেব, আমি উপায় করছি

বলে সেখানে বসেই একটা চিঠি লিখলে নবাবের জেনারেল রাজা মানিকচাঁদের নামে। লিখলে ফিরিঙ্গিরা আপনার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত। আপনি যা শাস্তি তাদের দেবেন, তাই-ই তারা মাথা পেতে নেবে। এখনই যুদ্ধ বন্ধ করুন। নইলে আমরা সবাই সদলবলে ধ্বংস হয়ে যাব।’

চিঠিটা কেল্লার পাঁচিলের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল। অনেকক্ষণ ধরে সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। এইবার হয়তো চিঠির উত্তর আসবে। হয়তো এইবার। শেষপর্যন্ত সে-উত্তর এল সশরীরে। ভোরবেলা সশরীরে হাজির হল রাজা মানিকচাঁদ, মিরজাফর, মোহনলাল, আর সকলের শেষে সশরীরে এসে হাজির হলেন নবাব। নবাব মনসুর-উল-মুলক শা কুলি খান মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌল্লা হেবাৎ জঙ আলমগির…

কান্নার রোল পড়ে গেল চারদিকে।

নবাব ফিরিঙ্গি কেল্লার ভেতরে ঢুকে অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। এত বড় কেল্লা বানিয়েছে ফিরিঙ্গি বাচ্চারা। এত তাদের ষড়যন্ত্র!

বললেন–উমিচাঁদ কোথায়? রাজা রাজবল্লভের ছেলে কৃষ্ণবল্লভ!

ভয়ে ভয়ে দু’জনে এসে হাজির হল সামনে। ফিরিঙ্গিদের কেল্লায় তারা বন্দি হয়ে ছিল এ ক’দিন। এবার বোধহয় মুর্শিদাবাদের কেল্লায় তাদের বন্দি করা হবে।

আর হলওয়েল? মিস্টার হলওয়েল কোথায়?

কান্নায় তখন ভারী হয়ে এসেছে কলকাতার বাতাস। অষ্টাদশ শতাব্দীর এক অস্বস্তিকর বিচারশালায় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের অনুগ্রহের আশায় মাথা নিচু করে নিঃশব্দে ক্ষমা চাইতে লাগল। আমাদের ক্ষমা করুন জাঁহাপনা। আমরা অপরাধী। এবার থেকে আপনার আশ্রয়ে থেকে আপনার হুকুম তামিল করে আপনার মসনদের মর্যাদা রাখব কথা দিলাম।

আর ওদিকে সেইদিন সন্ধেবেলাই সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানে ঠিক সময়েই এসে হাজির হয়েছে খোজা নজর মহম্মদ। নজর মহম্মদ তার কথা রেখেছে। মোহরের মর্যাদা সে লঙ্ঘন করতে পারেনি।

কান্তও তৈরি ছিল।

কান্তকে দেখে নজর মহম্মদ বললে–চলিয়ে জনাব চলিয়ে

রোজ রাত্রে যে-শব্দগুলো চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে তোলপাড় করে বেড়ায়, যে-ভাবনাগুলো হারেমের হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, তার খবর একদিনেই পেয়ে গেছে মরালী। নজর মহম্মদ যতই পাহারা দিক, পিরালি খাঁ যতই তদারকি করুক, মরালীকে আর কেউ আটকে রাখতে পারেনি চারটে দেয়াল আর একটা ছাদের জেলখানায়।

মরালী জেনে গেছে সে হাতিয়াগড়ের রানিবিবি আর নয় আজ, সে এখন লস্করপুরের তালুকদার কাশিম আলির লেড়কি মরিয়ম বেগম। তাকে সবাই জিজ্ঞেস করেছে–তুমি কেন মরতে এলে ভাই এখেনে?

মরালী বলেছে–এখানে এলে খুব যে আরাম শুনেছিলুম

ছাই, ছাই, ছাই আরাম-নবাবের নিজের মাসি, তার দুর্দশা যদি দেখো

ঘসেটি বেগম?

হ্যাঁ, ওর ডাকনাম মেহেরুন্নিসা, আমাদের এখানে পিরালি খাঁ আছে খোজা সর্দার, সে বলে মতিঝিলের বেগম

কেন?

মতিঝিল তো ঘসেটিবিবিই বানিয়েছিল কিনা। নবাব মতিঝিল থেকে গ্রেফতার করে এনে এখানে নজরবন্দি করে রেখেছে তাকে। আমাদের কারও সঙ্গে দেখা করতে দেয় না, আমাদের কারও সঙ্গে মিশতে দেয় না ঘসেটিবিবি বড় কষ্টে আছে ভাই–

মরালী জিজ্ঞেস করে–তুমি বুঝি হিন্দু? তুমি কী করে এখেনে এলে?

গুলসন বেগম বলে–আমি কি ভাই নিজে সাধ করে এসেছি তোমার মতো? আমাকে প্যায়দায় টেনে এনেছে। ওই যে মেহেদি নেসার সাহেব, চেনো তো?

না।

সেকী, মেহেদি নেসার সাহেবের নামই শোনননি? ওই বেটাই তো সব। নবাব শুধু নামে নবাব। নবাবের ইয়ারবকশিরাই তো ছারখার করে দেবে সব। আমার বর ভাই আমাকে নিত না আমি বরকে সেই বিয়ের রাত্তিরে যা একটুখানি দেখেছিলুম, তারপর আর আসেনি আমাদের বাড়িতে, কেবল বাবার কাছে টাকা চাইত। আমার বাবা টাকা কোথায় পাবে টাকা তো চাইলেই কেউ দিতে পারে না। বাবা তো পুজোরি বামুন–যজমানরা টাকা দিলে তবে তো বাবা হাতে পাবে

তোমরা বামুন নাকি?

অদ্ভুত মেয়ে ওই গুলসন বেগম। বামুনের মেয়ে, কিন্তু চেহারা দেখলে আর চেনাই যায় না। বেশ নাকে বেশর, কানে কনকচুড়, মাথায় মুসলমান মেয়েদের মতো জরির ফিতে বাঁধা বেড়ি, চোখে সুরমা, ঠোঁটে আর আঙুলের নখে মেহেদি রং, বুকে কঁচুলি, পরনে বুটিদার ঘাগরা। বোঝাই যায় না যে গুলসন। বামুনের মেয়ে।

তারপর পুকুরঘাটে একদিন চান করছিলুম ভাই, হঠাৎ কোত্থেকে কে একজন এসে মুখে গামছা পুরে দিয়ে একেবারে চ্যাংদোলা করে তুলে এখানে নিয়ে এল। এসে কলমা পড়িয়ে জাত নিয়ে নিলে। তারপর কোথায় রইল বাবা, আর কোথায়ই বা রইল মা, ছোট ছোট বোনগুলোর জন্যে বড় মন কেমন করে ভাই

বলতে বলতে হয়তো গুলসনের বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়। চোখ দুটো মুছে নেয় ওড়না দিয়ে। বলে–এই তো জষ্টি মাস, জষ্টি মাসে আমরা ভাই-বোনেরা মিলে আম কুড়োতে যেতুম, সে যে কত আম ভাই, তোমাকে কী বলব। এক-একটা আম কী মিষ্টি যে কী বলব। পাথরবাটিতে আম আর কাঠালের রস করে সেই খেতাম পান্তা ভাত দিয়ে, এখানে কত কালিয়া কাবাব-কোপ্তা খাচ্ছি, কিন্তু সেরকম তার আর পেলাম না।

তারপর বলে–এতদিন রইছি ভাই এখেনে, কিন্তু তবু সেসব কথা ভুলতে পারিনি। আচ্ছা তুমিই বলল না ভাই, ভাই-বোন বাপ-মা’র কথা কেউ কখনও ভুলতে পারে? তাই সেদিন যখন শুনলুম যে আর একজন মেয়ে আসছে এখেনে, শুনে ভাবলুম, আবার বুঝি কোন মেয়ের কপাল ভাঙল। তখন থেকে তোমার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করছি

কার কাছে শুনলে আমি আসছি?

গুলসন বললে–এখেনে ভাই কেউ কি কিছু বলে? কেউ কাউকে কিছু বিশ্বাস করে না, সবাই ভাই সবাইকে সন্দেহ করে। নানিবেগম পর্যন্ত…

নানিবেগম কে?

ওমা, নানিবেগমকেই চেনো না? নানিবেগমই যে এখানকার বেগমদের মাথা। নবাবের নানি কিনা, তাই তাকে সবাই নানিবেগমসাহেবা বলে ডাকে।

নবাবের নানি মানে?

নানি বলে এরা দিদিমাকে। আমরা যাকে বলি দিদিমা, তাকেই এরা বলে নানি। প্রথম প্রথম ভাই আমিও এদের কথাবার্তা বুঝতে পারতুম না। যা খেতুম গা বমিবমি করত। এত ঝাল-গরমমশলা তেল-ঘি দিয়ে রাঁধে যে মুখে কিছু রুচত না। শেষকালে আস্তে আস্তে সব অব্যেস হয়ে গেল। তা তুমি খেতে পারছ?

মরালী বললেন–না

তা এখন তো পারবেই না, কিন্তু কেমে কেমে সব সহ্য হয়ে যাবে।

মরালী হঠাৎ বললে–আচ্ছা, এখানে গান গায় কে?

ওমা, গান তো সব্বাই গায়। গান যে শিখতে হয় আমাদের। তোমাকেও শিখতে হবে। গানের ওস্তাদজি আসে যে গান শেখাবার জন্যে

কিন্তু আমি তো গান কখনও গাইনি।

গান না পারলে বাজনা শেখাবে। সেতার শেখাবে। বীণ শেখাবে। ওস্তাদজি যে সব বাজনা বাজাতে পারে ভাই। তারপর নাচতে পারলে আরও ভাল হয়–নাচ যদি একবার শিখতে পারো ভাই তো তখন তুমি একেবারে নবাবের পেয়ারের বেগম হয়ে যাবে তখন আর তোমাকে পায় কে! এখানে তো সব্বাই তাই নবাবের পেয়ারের বেগম হতে চাইছে–

গুলসন বেগমের কথা বেশি বলা স্বভাব। যখন বকে যায় তখন আর রাশ থাকে না মুখের।

মরালী বললে–আর রোজ কাঁদে কে? রাত্তিরে যে প্রায়ই কান্না শুনতে পাই

ও পেশমন, ওর কথা আর বোলো না

কেন? কী হয়েছে ওর? কেন কাঁদে?

ও ভাই তোমার মতোই মুসলমানের মেয়ে। ওরা পাঠানি মুসলমান। ওর এক বিচ্ছিরি রোগ হয়েছে

রোগের নাম শুনেই মরালী চমকে উঠল। আহা গো!

সে বড় বিচ্ছিরি রোগ ভাই। দেখলে তোমারও মায়া হবে। যন্তরনা যখন হয় তখন আর চেপে রাখতে পারে না, খুব চেঁচায়–

তা কবিরাজকে দেখায় না কেন?

কবিরাজকে দেখায় না ভাই। এরা হেকিমি দাওয়াই এনে দেয়। কিন্তু আমি বলছি ভাই ও-রোগ ওর সারবে না। ও-রোগ একবার হলে আর সারে না।

রোগটা কী?

গুলসন বলে–এরা বলে সুজাক। এরা বলে মালেখুলিয়া দিমাগি। ওসব মুসলমানি রোগের মাথামুণ্ডু কিছু বুঝিনে ভাই। তুমি যদি তাকে দেখো তা হলে তোমারও কান্না পাবে। আমি বলি আসলে ভাই ওরই দোষ!

কেন?

দোষ নয়? তোর সকলকে টেক্কা দেবার দরকার কী ছিল? এতগুলো বেগম রয়েছে, তারা আগে না তুই আগে? ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে যাওয়ার দরকার কী ছিল শুনি? তা ছাড়া ভাই নবাবের নিজের শাদি করা বউও তো রয়েছে। তার মনে কষ্ট দিলে তোর কি ভাল হয় কখনও? বলো ভাই, তুমিই বলো।

মরালী এসব কথা অবাক হয়ে শোনে। এ এক বিচিত্র জগৎ। এ-জগতের খবর একদিন সে জানতই একেবারে। এই জগতের মধ্যে এতগুলো মেয়ে এসে জমা হয়েছে। এদের সুখ-দুঃখ-হাসি কান্না সমস্তই যেন একজন পুরুষকে কেন্দ্র করে। সেই মানুষটির কাছে কে কেমন করে সকলের চেয়ে প্রিয় হবে সেইটেই এদের একমাত্র সমস্যা। কে গান শুনিয়ে তাকে মুগ্ধ করবে, কে নেচে তাকে নিজের তাবে আনবে, তারই প্রতিযোগিতা চলে দিনরাত। গুলসনের কাছে সব গল্প শুনে শুনে এই ক’দিনের মধ্যেই মরালীর সব চেহেল-সুতুনটা যেন দেখা হয়ে গিয়েছিল? সে যেন চোখ বুজেই বলে দিতে পারে কোন দিকে নানিবেগম থাকে, কী করে। বলে দিতে পারে লুৎফা বেগমের রাত কাটে কেমন করে। পেশমন বেগম কেন কাঁদে। বব্বু বেগম কেন অত মন দিয়ে গান শেখে, তক্কি বেগম কেন নাচ শেখে মনপ্রাণ দিয়ে। একদিন এমনি করেই যদি নবাবের নজরে একবার পড়ে যেতে পারে কেউ তো তখন তাকে আর কে পাবে? তখন মতিঝিলের মতো তার একটা বাড়ি হবে, তখন তার জন্যে সাজাহানাবাদ থেকে হিরের গয়না আসবে, জয়পুর থেকে সাচ্চা মোতির মালা আসবে। তখন রুপোর বদলে সোনার গেলাসে সে শরবত খাবে। তখন তার খেদমত করবে দশটা খোঁজা, বিশটা বাঁদি। তখন আর তাকে নানিবেগমের ধমক খেতে হবে না, তখন সে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে হুকুম করবে সবাইকে।

এই যে তোমার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে গল্প করতে আসি-না, নজর মহম্মদ যদি জানতে পারে তো আমাকে আর আস্ত রাখবে না ভাই, তাই রাত্তিরবেলা লুকিয়ে-ছুপিয়ে আসি!

কেন? আমি কী দোষ করেছি? আমাকে মিশতে দেয় না কেন তোমাদের সঙ্গে?

গুলসন বলে–ও প্রথম প্রথম আমাদেরও ওইরকম কারও সঙ্গে মিশতে দিত না, পোষ মানাবার চেষ্টা করত। তা এখেনে পোষ না-মেনে তো উপায়ও নেই ভাই। পোষ না-মেনে করবই বা কী! আর তো করবারও কিছু নেই আমাদের সারাজীবন যখন এখেনেই কাটাতে হবে তখন সবকিছু মেনে নেওয়াই ভাল

সারাজীবন কাটাতে হবে? সারাজীবন আর কোথাও বেরোতে পারব না?

গুলসন বলে-না, সেই জন্যেই তো এখেনে এলে সব্বাই নেশা করে

তুমিও নেশা করো?

হ্যাঁ, নেশা না করলে যে ভাই থাকা যায় না। দম আটকে আসে। আমরা যে বেঁচে আছি এটা যে ভুলতে পারিনে। সেটা ভোলবার জন্যেই তো নেশা করি। তুমিও ভাই দেখো, ঠিক নেশা ধরবে, তুমিও একদিন নেশা না করে থাকতে পারবে না আমাদের মতো

কী নেশা করো?

গুলসন বললে–নেশা কি আর একরকমের ভাই। হাজার রকমের নেশা আছে। আফিম, চরস, কত কী! একরকম সাপের বিষ আছে…

সাপের বিষ?

সে-সাপের বিষ খেলে মরবে না, কিন্তু অসাড় হয়ে পড়ে থাকবে দু’দিন। সেটা খেলে খুব আরাম, আমি একবার খেয়েছিলুম–

মরালী জিজ্ঞেস করলে–এসব নেশার জিনিস কোত্থেকে আসে?

এসব খোজারা এনে দেয়। নানিবেগম জানতেও পারে না। জানলে অনাচ্ছিষ্টি করবে। পিরালি খাঁ, নজর মহম্মদ, বরকত আলি ওরা লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের সব জোগায়

ওরা কোত্থেকে পায়?

সে ভারী মজার ব্যাপার। চেহেল্‌-সুতুনের বাইরে চকবাজার বলে নাকি একটা জায়গা আছে, সেখানে সারাফত আলি বলে এক বুড়োর দোকানে ওগুলো কিনতে পাওয়া যায়। আসলে গন্ধতেলের দোকান, কিন্তু ভেতরে ভেতরে এইসব বিষ বেচে সে। নজর মহম্মদ তোমাকে আরকের কথা বলেনি?

মরালী বললো, প্রথম দিনেই তো বলেছিল আরক চাই কিনা–

ওই তো! ওর নামই তো বিষ। ওই বিষ খাইয়ে খাইয়েই তো আমাদের পোষ মানায়। নইলে তো কান্নাকাটি করে প্রথম প্রথম সবাই ভাসিয়ে দেয়। তারপরে যখন নেশাটা ধরে তখন যা বলবে তাই। করতে হয়। তাই করতে ভালও লাগে। প্রথম প্রথম ভাই আমারও লজ্জা করত। লজ্জা লাগবে না? তুমিই বলো? সবে গা ছেড়ে এসেছি, গায়ের কাপড় টানাটানি করলে লজ্জা লাগবে না? চেনা নেই শোনা নেই অচেনা পরপুরুষের সামনে খালি-গা হওয়া যায়?

মরালী জিজ্ঞেস করলে কে? পরপুরুষ কে?

গুলসন উত্তর দিতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ ওদিকে বোধহয় কার পায়ের শব্দ হল। শব্দ হতেই গুলসন ফস করে সরে গেছে। যাবার সময় বলে গেল–বোধহয় নজর মহম্মদ আসছে, আমি ভাই পালাই, কাল আসব–আবার

অন্ধকারে বাইরে সত্যিই পায়ের শব্দ হয়েছিল। মরালী অতটা টের পায়নি। কিন্তু গুলসনের কান সজাগ।

সে এমন করে পালিয়ে গেল যে, মরালীও যেন হঠাৎ বুঝতে পারলে না কখন পালাল। আর ঠিক তার পরেই নজর মহম্মদ ঘরে ঢুকেছে–কসুর মাফ কিজিয়ে বেগমসাহেবা।

বলে তিনবার কুর্নিশ করলে মাথা নিচু করে করে।

মরালী কোনও উত্তর দিলে না। নজর মহম্মদ নিজেই জিজ্ঞেস করলে বেগমসাহেবার কিছু তকলিফ হয়েছে কিনা। শরবত পান কিমাম জর্দা কিছু দরকার কিনা। আরক জরুরত আছে কিনা। বাঁদি কিছু কসুর করেছে কিনা। হাজারো রকমের বাঁধা প্রশ্ন। এ কদিন ধরে মরালী দেখে আসছে, এমনি করে কথা বলাই এদের রেওয়াজ। এর উত্তর তারা চায় না, এর উত্তর তারা হয়তো আশাও করে না। এতদিন ধরে এখানে এই একঘেয়ে দিন কাটানোর সময়ে কারও সঙ্গে মরালী কথাও বলেনি। ঘর ছেড়ে বাইরে যাবার চেষ্টাও করেনি। চেষ্টা করলেই কোত্থেকে নজর মহম্মদের আবির্ভাব হয়েছে, আর অন্য কোথাও যেতে মানা করেছে। ভোরবেলা সূর্য ওঠাটা টের পাওয়া যায় রোদ দেখলে। তারপর কোথাকার কোন মসদিজ থেকে আজানের টানা টানা সুর কানে এসেছে। আর কানে এসেছে নহবতের রাগরাগিনী। ছোটমশাইয়ের বাড়িতেও আগে নহবত বাজানো হত। পরে আর হত না। তারপর একটা বাদি আসে। বেশি কথা বলে না বাঁদিটা। হয়তো বোবা। সোজা নিয়ে যায় গোসলখানায়। সে মরালীর গায়ে কী রকম। তেল মাখিয়ে দেয়। প্রথম প্রথম লজ্জা করত মরালীর। কিন্তু বাঁদিটার লজ্জাশরম কিছু নেই। সে তেলটা, মাখিয়ে গা-শরীর-পা সর্বাঙ্গ মালিশ করে দেয়। তারপর গরম জল দিয়ে ঘষে ঘষে গা-হাত-পা পরিষ্কার করে দেয়। তারপর চুলে তেল মাখায়। চুলটা নিয়ে কসরত করতেই বেশি সময় লাগে তার। তারপর শরীরটা আগাপাশতলা মুছিয়ে দিয়ে নতুন কাঁচা পোশাক পরিয়ে দিয়ে ঘরে আনে। চুলটা হাওয়া দিয়ে দিয়ে শুকোয়। তখন আসে নাস্তা। ফল, বাদাম, দুধ, মাখন। ওসব খেতে ভাল লাগে না মরালীর। এরা মুড়ি-চিঁড়ে দিলে বোধহয় বেশি ভাল লাগত তার। কিন্তু কে বলে সেসব কথা। তারপর সেই খাওয়ার পরই আসে পান, জর্দা, কিমাম, তাম্বুল-বিহার, এলাচ, লবঙ্গ। তারপর পাশার ছকটা নিয়ে এসে মরালীকে পাশা খেলায় ভুলিয়ে রাখতে চায়। মরালী বলে না, তুমি যাও এখন, আমি পাশা খেলব

এমনি করেই দিন কাটাতে কাটাতে হঠাৎ একদিন ওই গুলসন মেয়েটা এসে আলাপ করে গিয়েছিল লুকিয়ে লুকিয়ে। তারপর থেকে ফাঁক পেলেই চলে আসে। এসে নানারকম গল্প শোনায়। এই চেহেল্‌-সুতুনের গল্প। এই নবাব আর নবাবজাদিদের গল্প। শুনতে বেশ লাগত মরালীর। আর হঠাৎ কারও পায়ের শব্দ শুনলেই কোথায় কোন সুড়ঙ্গপথ দিয়ে সুড়ত করে পালিয়ে যেত।

নজর মহম্মদ চলে যাবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ নহবতখানা থেকে অসময়ে নবৃত বেজে উঠল।

মরালী অবাক হয়ে গেল। এসময়ে তো কোনওদিন নবত বাজে না। জিজ্ঞেস করলে–নবত বাজছে কেন এই অসময়ে?

খবর এসেছে, জাঁহাপনা কলকাতার লড়াই ফতে করে দিয়েছে। কলকাতার নাম বদলে আলিনগর–রাখা হয়েছে। কলকাতায় আগ লাগিয়ে দিয়েছে জাঁহাপনা। ফিরিঙ্গি লোগ ভি কলকাতার কেল্লা ছেড়ে ভেগে পালিয়েছে।

মরালী জিজ্ঞেস করলে–তাই বুঝি খুব খুশি হয়েছে মুর্শিদাবাদের লোক?

জি বেগমসাহেবা! মেহেদি নেসার সাহেব হুকুম ভেজিয়েছে আলিনগর থেকে মুর্শিদাবাদের লোককে খবরটা ওয়াকিবহাল করতে।

ও!

নজর মহম্মদ তবু নড়ল না। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল তবু

মুরালী জিজ্ঞেস করলে–সঁহাপনা কি এইবার মুর্শিদাবাদে ফিরে আসছেন?

জি বেগমসাহেবা! ঔর তিন-রোজের ভেতরেই ফিরে আসছেন–

এবার মরালীর বুকটা যেন কেমন কেঁপে উঠল। এতদিন বেশ ছিল মরালী। কিন্তু এবার? এবার যদি নবাবের সামনে যেতে হুকুম করে? এবার যদি পরীক্ষা দিতে হয় তাকে।

বেগমসাহেবা, একটা কথা ছিল।

মরালী মুখ তুলে তাকাল।

একঠো জওয়ান ছোকরা বেগমসাহেবার সঙ্গে মুলাকাত করতে চায়—

কে সে? আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়? কেন?

বান্দা তা কিছু জানে না বেগমসাহেব! তার বড় জরুরি কাম আছে বেগমসাহেবার সঙ্গে।

আমার সঙ্গে কাজ আছে? আমার সঙ্গে তার কী কাজ থাকতে পারে? কে সে?

বান্দা তা জানে না বেগমসাহেবা। জওয়ান নাছোড়বান্দা। বেগমসাহেবার সঙ্গে তার জান-পছান আছে। বেগমসাহেবাকে হাতিয়াগড় থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল এখানে।

মরালী নিজেকে সামলে নিলে। মুখে বললে–কে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল আমি জানি । কারও সঙ্গে আমার চেনা-জানা নেই। আমি কারও সঙ্গে দেখা করব না এখন। তুমি তাকে বলে দিয়ো। বলে দিয়ে এখানে পুরুষমানুষদের আসা-যাওয়ার নিয়ম নেই।

জি, বেগমসাহেবা। আমি তা হলে তাকে তাই-ই বলে দেব।

হ্যাঁ, তাই বলে দিয়ো

নজর মহম্মদ তবু পঁড়িয়ে রইল। ফিরতে গিয়েও তার ফেরা হল না। তারপর সোজা ফিরে দাঁড়িয়ে বললে–বেগমসাহেবা, আপনি যদি তার সঙ্গে মুলাকাত করতে চান তো কেউ জানতে পারবে না। কৌয়া-চিড়িয়া ভি টের পাবে না। আমি খুদ এখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দেব, কোনও গুণাহ হবে না

মরালী কী বলবে বুঝতে পারলে না। নজর মহম্মদ কি তাকে পরীক্ষা করছে। শেষকালে যদি কোনও বিপদ হয়। গুলসনকে জিজ্ঞেস করলে ভাল হত। সে কিছু পরামর্শ দিতে পারত। মরালীর সমস্ত শরীরটা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। এমন যে হবে তা তো ভাবতে পারেনি সে। সে যদি ধরা পড়ে। যদি কোতল হয়ে যায়। মরালীর জন্যে কান্তর যদি কোনও ক্ষতি হয়।

মনের কথাও যেন নজর মহম্মদ বুঝতে পারলে। বললে–কোনও ডর নেহি বেগমসাহেবা, বান্দা তো জিম্মাদার রইল

বলেই চলে যাচ্ছিল। যাবার সময় বললে–বান্দা এখুনি তাকে এত্তেলা দিচ্ছে

এখুনি? এত রাত্তিরে?

কিন্তু নজর মহম্মদ ততক্ষণে ঘরের বাইরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। এখুনি হয়তো কান্তকে ডেকে নিয়ে আসবে। এলে কী বলবে মরালী! কী বলে কথা আরম্ভ করবে।

লুকিয়ে লুকিয়ে আবার গুলসন এসে হাজির।

কী বলছিল ভাই নজর তোমাকে? আরক খেতে বলছিল বুঝি? খবরদার খবরদার, আরক খেয়ো না যেন ভাই তুমি! ও একেবারে সর্বনেশে বিষ। একবার ধরেছ কি আর তোমার ছাড়ান-ছোড়ন নেই। কিছুতেই খেয়ো না তুমি। যে খেয়েছে, সে-ই পস্তাচ্ছে। যদি জোর করে খাওয়াতে আসে তো নানিবেগমকে বলে দেবে, বুঝলে? নানিবেগম ওসব পছন্দ করে না মোটে!

মরালী বললে–না, আরক নয়…।

আরক নয় তো কী? পান? পানও খেয়ো না তুমি ওদের হাত থেকে। পানের খিলি নিজে সেজে খাবে, নইলে পানের খিলির ভেতরেও ওইসব বিষ পুরে দেয় পোষ মানাবার জন্যে।

না, পানও নয়। আমি বুঝতে পারছি না ভাল করলাম কি মন্দ করলুম।

কেন? কী হয়েছে কী?

নজর মহম্মদ বলছিল কে-একজন নাকি দেখা করতে চায় আমার সঙ্গে। তাকে এখানে নিয়ে আসবে। আমি প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। বলেছিলুম-না, আনতে হবে না। কিন্তু আমার কথা শুনলে না, তাকে ডেকে আনতে গেল

সর্বনাশ করেছ। লোকটা কে? কী জন্যে দেখা করবে?

তা জানি না।

তা হলে এক্ষুনি গিয়ে মানা করে এসো ভাই। তোমাকে বিপদে ফেলবে। ওরা ওইরকম করে প্রথম প্রথম পরখ করে নেয়। ওরা দেখে কী রকম চরিত্তিরের মেয়ে তুমি। তুমি যদি একবার বলে দাও হ্যাঁ, তখন পেয়ে বসবে, তখন তোমাকে যা-তা করবে। তুমি এক্ষুনি গিয়ে মানা করে এসো

মরালী বললে–কিন্তু ও যে চলে গেল–

তুমি দৌড়ে যাও না! এখনও সময় আছে। যাও যাও–ওসব ওদের ছল, ওই করে ওরা পোষ মানায়, একবার ওদের হাতের কবজার মধ্যে পড়ে গেলে তখন তুমি একেবারে মরবে যাও

মরালী কী করবে বুঝতে পারলে না। তারপর বেরোল ঘর থেকে। যে-দিকে নজর মহম্মদ গেছে সেই দিক লক্ষ করেই বেরোল। তারপর অন্ধকার পেরিয়ে একবার চিৎকার করে ডাকতে চেষ্টা করলে–নজর মহম্মদ-নজর মহম্মদ

কিন্তু মরালীর গলা দিয়ে এতটুকু শব্দ বেরোল না। তার মনে হল কে যেন তার গলা টিপে ধরেছে। সেই অন্ধকার চেহেল্‌-সুতুনের ভুলভুলাইয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে সে যেন দিশেহারা হয়ে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress