বেগম মেরী বিশ্বাস (Begum Meri Biswas) : 02
সেদিন সেই হাতিয়াগড়ের অন্ধকার ঘরের চারটে দেয়ালের মধ্যে গাঁয়ের একটি মেয়েই শুধু পালিয়ে আসেনি। পালিয়ে এসেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রাণলক্ষ্মীও। মাঠে ঘাটে একদিন যে-লক্ষ্মী বায়ু হয়ে অগ্নি হয়ে জল হয়ে ঘরে ঘরে ক্ষুধা তৃষ্ণা কামনা বাসনা মিটিয়েছে, পৌষের শিশির হয়ে, বৈশাখের রৌদ্র হয়ে, নীড়ের শান্তি, গৃহকোণের স্নেহ, পিতার আশীর্বাদ, মায়ের বাৎসল্য, স্বামী-স্ত্রীর প্রেম হয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রাণরস জুগিয়েছে, তার বুঝি শেষ হল। একদিন ধর্মপাল-দেবপালের দেশে যে সূর্য উঠেছিল, বখতিয়ারের আবির্ভাবে সেই সূর্যই বুঝি মধ্য আকাশে ভাস্বর হয়ে উঠেছিল তারপর। তখনও মানুষকে ঘর ছেড়ে বেরোতে হয়নি। গৌড়ের সিংহাসনে বাংলার প্রাণলক্ষ্মী নিরাপদই ছিল সেদিন। পঞ্চাশ বছরের ইলিয়াস-শাহি বাদশা বাংলার বুকে অচল-অটল হয়ে বসে ছিল। হিন্দুদের হিন্দুত্ব বজায় ছিল, তবু গৌড়ীয় সুলতানদের তাতে কিছু এসে যায়নি। গঙ্গা যমুনার মধ্যে সপ্তগ্রামে এসে জাহাজ। ভিড়ত। তিন দিনারে দুগ্ধবতী একটা গোরু, এক দিরহামে আটটা মুরগি, দুই দিরহামে একটা ভেড়া। দুই দিনারে তিরিশ হাত মসলিন, আর নগদ একটা মোহর দিলে সুন্দরী একটি মেয়ে বাঁদি। যারা এখানে। এসেছে তারা সস্তার বহর দেখে অবাক হয়ে গেছে। এখানে চাঁদ উঠেছে রাত্রে আর ধানের খেতে বাড়ির চালে আর রাজার প্রাসাদে তা সমান হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অম্বুবাচীর দিন সিদ্ধান্তবারিধিরা শাস্ত্রের নির্দেশ দিয়েছেন, রোজার দিন নির্দেশ দিয়েছেন মৌলানা-মৌলবিরা। হাঁচি কাশি টিকটিকি চামচিকে নিয়ে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ নিষ্পন্ন হয়েছে নির্বিঘ্নে। শোক দুঃখ আনন্দ নিয়ে জীবন এগিয়ে গেছে অব্যাহত। কিন্তু তখনও প্রাণলক্ষ্মী চঞ্চল হয়নি। দোল দুর্গোৎসব চড়কের গাজনে বারবার উজ্জীবিত হয়েছে। বাংলার সেই প্রাণরস।
কিন্তু এবারই প্রথম নিরুদ্দেশ হয়েছে সে। সেই মরালী।
বাবুদের পাঁচমহলা গড়বন্দি বাড়িতে সে এসে উঠল এবার। কেউ জানতে পারলে না। না মাধব ঢালি, না হরিপদ, না গোকুল, না শোভারাম, না উদ্ধব দাস, না কান্ত, না বশির মিঞা, কেউ নয়। মেহেদি নেসার, মনসুর আলি, হরিপদ, নয়ানপিসি, এমনকী ছোটমশাইও জানতে পারলে না। সবাই তখন ঘুমিয়ে অজ্ঞান অচৈতন্য।
হঠাৎ শেষ রাত্রের দিকে বড় বউরানি ছোটমশাইয়ের ডাকে দরজা খুলে দিলেন।
কী হল? তুমি? কখন এলে?
এই এখুনি। মিরজাফর আলির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ফিরিঙ্গি হলওয়েল সাহেবও ছিল সেখানে।
জগৎশেঠজি কী বললে?
ছোটমশাই বললেন সব কথা আমি খুলে বললুম। আমি একলা নয়, মিরজাফর সাহেবও তো রেগে আছে নবাবের ওপর, ওকেও সরিয়ে দিয়েছে কিনা নিজামত থেকে। সেই জায়গায় নিজের শালা মোহনলালকে করেছে সিপাহশালার
বউ বউরানি বললেন–সে তো হল, কিন্তু এদিকে পরওয়ানার কথা কী বললে?
জগৎশেঠজি সব শুনলেন। তারপর বললেন, এসব মেহেদি নেসারের কাণ্ড, নবাবকে বলব–
বউ বউরানি রেগে গেলেন। বললেন–নবাবকে বললে–কী হবে? কিচ্ছু হবে না, বললে–না কেন? যেনবাব ইয়ারবকশিদের কথায় চলে তাকে বলে কী লাভ হবে! পরের মেয়েমানুষের দিকে যাদের লোভ তাদের হাতে রাজ্য পড়েছে আজকেও তো ডিহিদার ফৌজের সেপাই পাঠিয়েছিল–
কী বললে?
কী আবার বলবে, সেই পুরনো পরওয়ানা।
–আমি মুর্শিদাবাদে গিয়েছি জানতে পেরেছে নাকি?
বড় বউরানি বললেন–নায়েব মশাইয়ের হাতে পরওয়ানা দিয়ে গেছে, মাধব ঢালিকে জিজ্ঞেস করেছিল ছোটমশাই কোথায় সে বলে দিয়েছে তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ, তখন নায়েব মশাইকে গিয়ে পরওয়ানাটা দিয়েছে–
আমি মুর্শিদাবাদে গিয়েছি তা কেউ জানে না তো?
না, কে আর জানবে! কেউ জানে না।
তা হলে এখন কী হবে?
তা হলে কী যে হবে তাই-ই ক’মাস ধরে ভাবছেন ছোটমশাই। আবওয়াব মাথ আর নজর–এর সঙ্গেই যা-কিছু সম্পর্ক নবাবের। প্রাসাদের সুখসুবিধের দায়িত্ব সব জমিদারদের। নবাবের তা দেখবার দরকার হয় না। দেখবার সময়ও নেই। ডিহিদার, ফৌজদার, পরগনাদার আছে বটে। কিন্তু সে তো শুধু নবাবের স্বার্থ দেখতে। জমিদারদের স্বার্থ দেখতে হবে তাদের নিজেদেরই। এক-একদিন খাতাপত্র সুদ্ধ তলব করেন খাজাঞ্চিমশাইকে। বলেন–বড়মশাইয়ের সময় যেমন সব চলছিল, তেমনই চলা চাই খাজাঞ্চিমশাই
জগা খাজাঞ্চি বলে কিন্তু তেমন যে আর চলছে না–এখন যে সব আইনকানুন বদলে যাচ্ছে। প্রজারাও যে সব একটু জো পেলে চলে যাচ্ছে কলকাতায়। সেখানে সব সেপাইয়ের কাজ দিচ্ছে ফিরিঙ্গিরা
তা নবাব-সরকারে নালিশ করেছ? আমাদের উকিল বরদা মজুমদারকে চিঠি লিখে দাও তুমি, কিংবা সুবেদারের কাছে নালিশ পেশ করতে বলো তাকে
খাজাঞ্চিমশাই বলে–তাতে কিছু হবে না
আগে হত আর এখন হবে না কেন?
শুনছি লড়াই বাধবে।
লড়াই!
হাতিয়াগড় থেকে সব খবর প্রথম দিকে পাওয়া যেত না। তারপরে যেবার মুর্শিদাবাদ গেলেন নজর-পুণ্যাহের সময়, সেখানে গিয়েই সব খবর পেলেন। ফরাসিদের সঙ্গে ইংরেজদের ঝগড়ার কথা শুনলেন। মিরজাফরের সঙ্গে নবাবের ঝগড়ার কথা শুনলেন। উমিচাঁদের ব্যাপার শুনলেন। ওয়াটস্ সাহেবকে নিজামতে ধরে নিয়ে এসে অত্যাচারের কথাও শুনলেন। তারপর নিজের পরওয়ানার কথাও জানলেন। ডিহিদারকে দিয়ে মেহেদি নেসারই এই কাণ্ড করিয়েছে।
ডাকলেন—গোকুল—
গোকুল পেছনেই ছিল। বললেন–যা তো, নায়েবমশাইকে একবার ডেকে নিয়ে আয় তো।
রাত তখন বুঝি পুইয়ে আসছে। বজরায় সারারাত ভাল ঘুম হয়নি। সমস্ত শরীরটা টনটন করছে।
ওদিকে অন্ধকার ঘরের মধ্যে রাত্রি তখনও আকাশ-পাতাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঝনাত করে চাবিতালার শব্দ হতেই দরজা খুলে গেল। দুর্গা বলল–ভয় পেয়েছিলি নাকি মুখপুড়ি? যখন বলেছি তোকে বাঁচাব তখন কোনও ভয় নেই তোর ছোট বউরানিকে তাই বললুম
মরালী জিজ্ঞেস করলে ছোট বউরানি কী বললে–শুনে? বললে, দেখিস দুগগা, যেন সব্বোনাশ না হয়, বউ বউরানি যেন জানতে না পারে। আমি বললাম আমি ঠিক সামলে নেব–এই নে, তোর জন্যে ছোট বউরানির কাছ থেকে শাড়ি চেয়ে নিয়ে এসেছি, চেলি ছেড়ে এইটে পর খাবি কিছু? খিদে পেয়েছে?
মরালীর তখন সত্যিই চোখে জল এসে গেছে। সত্যি, এমন করে কে তার কথা ভাবে? দুর্গা আবার বললে–এখুনি তোর বরকে তোর কাছে এই ঘরে এনে দিতে পারি, দেখবি? মরালী অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে কী করে? কিন্নরসাধন করে। কিন্নরসাধন-মন্তর পড়লে তোর বর এখুনি এসে পড়বে এখানে–মরালী বললে–না দুগগাদি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি। বরের কাছে আমি আর যাব না দুর্গা বললে–দূর, তোর ওবর কেন রে, সেই বর, সেই কলকাতার বর। দেখবি কিন্নরসাধন মন্তর পড়লেই সেই বর এসে একেবারে এই ঘরের মধ্যে হাজির হবে, এসেই তোকে প্রাণেশ্বরী বলে জড়িয়ে ধরবে। তখন দুজনে গলাগলি জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকবি
মরালী বললে–কিন্তু আমার বড় ভয় করছে দুগগাদি, যদি কেউ দেখে ফেলে
দেখতে পাবে কেমন করে? এ-ঘরে কি কেউ আসে? এ-দিক কেউ মাড়ায় না। খিড়কির পুকুরের দিকে এ-ঘর। এখানে চেঁচিয়ে বললেও কেউ টের পাবে না। তোকে আমি এখানে ভাত এনে দেব, তুই থাকবি খাবি ঘুমোবি–তোর বরও থাকবে তুইও থাকবি–
মরালী কী ভাবতে লাগল আবার।
দুর্গা বললে–তোর বর তো এখন অতিথশালায় উঠেছে, এই আমার অতিথশালায়
কোন বর?
তোর কলকাতার বর লো। তুই রোস একটু, আমি ডেকে আনছি
এই ছোটমশাইয়ের অতিথশালায়?
হ্যাঁ লো, হ্যাঁ। এখেনে এসে উঠেছে। ওই বুড়ো ঘটকটা, নাপিত আর তোর বর, দাঁড়া আমি এখুনি ডেকে আনছি
দুর্গা চলে গেল। যাবার সময় আবার দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে গেল। মরালীর মনে হল সব যেন নিস্তব্ধ হয়ে এল চারিদিকে। সব চুপচাপ। জানালার পাশে কোথায় বুঝি একটা ঝিঁঝিপোকা শুধু শব্দের করাত দিয়ে বিকট শব্দ করতে করতে সে-অন্ধকার চিরে খানখান করে ফেলছে। এই সব অন্ধকার রাতেই মুর্শিদাবাদের নবাবের বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্র মুখর হয়ে ওঠে। মতিঝিলের ওপর একটা দোদুল্যমান বাতাস বুঝি এইসব রাতেই কেঁপে কেঁপে প্রহর ঘোষণা করে। মেহেদি নেসার, ইবলিস, মহম্মদ, ইয়ারজান, সফিউল্লা সাহেবরা তখন তাদের কোটর থেকে বেরিয়ে ফণা তুলে ধরে আকাশে। তারা নবাবকে পরামর্শ দেয় কলকাতা একেবারে সোনায় মোড়া জাঁহাপনা, কলকাতা লুঠ করলে চাদি, জহরত, আর মোহরের কোনও কিফায়েত হবে না
তারা বলে–জাঁহাপনার চারদিকে দুশমন, ওদিকে জাঁহাপনার মাসতুতো ভাই শওকত জঙ আর এদিকে ঘসেটি বেগমসাহেবারা আর ফিরিঙ্গিরা, সকলকে ঠান্ডা করে মসনদে বসে মহফিল করবেন
তারা বলে আর মেয়েমানুষ? জেনানা? তাও আমরা জাঁহাপনাকে জোগাড় করে দেব। নবাব সরফরাজ খা’র পনেরোশো বাঁদি বেগম ছিল, জাঁহাপনারও অভাব হবে না জেনানার, একটা ফৈজি বেগম গেছে যাক, আমরা জাঁহাপনাকে আরও হাজার হাজার ফৈজি বেগম জোগাড় করে দেব
নায়েব মশাইয়ের হাত থেকে তখন পরওয়ানাটা নিয়ে ছোটমশাই পড়ছেন–বদরগাহ রসুল নেয়ামত উসুল কোনেন্দা বান্দে নবাব মির্জা মহম্মদ মনসুরউল-মুলুক সিরাজ-উ-দৌল্লা শা কুলি খান বাহাদুর নেবাং জঙ আলমগির বজন্দিগি তোমার খেয়ের খোবি দারুদ সুরাতে বান্দার খোয়ের খোবি সোদ…’
পড়তে পড়তে যেন হাত কাঁপতে লাগল ছোটমশাইয়ের। মনে হল তিনি যেন আর দাঁড়াতে পারছেন না। মাথাও ঘুরতে লাগল। পাশে গোকুল ছিল, নায়েবুমশাই ছিল। তারা হঠাৎ ছোটমশাইকে ধরে ফেললে।
আর ওদিকে কলকাতার কেল্লার মধ্যে হলওয়েল সাহেবও রেডির তেলের আলোর সামনে কেদারায় বসে ডেসপ্যাঁচে লিখে চলেছে
… বাঙালি হিন্দুরা সব আমাদের পক্ষে আছে জানবেন। কলকাতায় এসে তাদের অবস্থাও ভাল করে দিয়েছি আমরা। তারা জানে আমরা তাদের টাকাকড়ি কেড়ে নিই না। দেনার দায়ে তাদের খ্রিস্টান করি না। কাজ করিয়ে ন্যায্য দাম দিই তাদের। বেগার দিতে হয় না এখানে। শহর তাই অনেক বেড়ে গিয়েছে। কারণ সবাই জানে আমরা শুধু এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেই এসেছি। নবাবের মা আমিনা বেগমও আমাদের সঙ্গে মাল বেচা-কেনা করে। উমিচাঁদ আমাদের দলে। নদিয়ার রাজা কিষণচন্দর আমাদের দলে। সম্প্রতি মিরজাফর আলি খাঁ-কে কম্যান্ডার ইন চিফের চাকরি থেকে নবাব তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সেও আমাদের দলে চলে এসেছে। সেদিন আমি ব্যাঙ্কার মহাতাপ জগৎশেঠের বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে দেখা করে এসেছি। সেখানে হাতিয়াগড়ের রাজা হিরণ্যনারায়ণের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সেও আমাদের দলে। তার ছোট রানিকে জোর করে নবাবহারেমে পাঠাবার জন্যে ডিহিদার পরোয়ানা পাঠিয়েছিল। তাই সেও আমাদের দলে যোগ দিতে রাজি হয়েছে। আগে কলকাতায় পাকা বাড়ি কেউ বানাত না, পাছে টাকা হয়েছে মনে করে কেউ কুনজর দেয়। এখন কিছু কিছু পাকাবাড়ি হচ্ছে। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে রেভিনিউ আদায় হত চার হাজার টাকা। এখন বেড়ে সতেরো হাজারে উঠেছে। ট্যাক্স বাবদ আরও নব্বই হাজার টাকা আয় হচ্ছে। আমরা সইয়ে সইয়ে আদায় করছি। নবাবদের মতো জোরজবরদস্তি করি না। আমরা নবাবদের মতো কাফেরদের কাছ থেকে বেশি ট্যাক্স নিই না। আমরা মুসলমান-হিন্দু দু’দলকেই সমান চোখে দেখি। তাই আমাদের ওপর হিন্দুরা খুব খুশি। নবাবের যারা বিশ্বাসী আমির-ওমরাহ তারাও নবাবের ধ্বংসই চায়। এই বাঙালিদের স্বভাবই এইরকম। এদের কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। তাই খুব সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে। আমরা এদের বলেছি যে আমরা ব্যাবসাদার মানুষ, ব্যবসা করে টাকাকড়ি পেলেই খুশি, মসনদে কে বসবে তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। এই বাঙালিরা এত বোকা যে এরা আমাদের সেই কথায় বিশ্বাস করেছে…
দুর্গা হঠাৎ দৌড়োতে দৌড়োতে আবার ঘরে ঢুকেছে, ঢুকেই হাঁপাতে লাগল।
মরালী বললে–কী হল দুগগাদি?
সর্বেনাশ হয়েছে রে। অতিথশালার দিকে যাচ্ছিলুম তোর বরকে ডাকতে, হঠাৎ এক কাণ্ড হয়ে গেছে–
কী কাণ্ড?
ছোটমশাই হঠাৎ মুর্শিদাবাদ থেকে বাড়ি ফিরে নায়েব কাছারির কাছে অজ্ঞান হয়ে গেছে বড় বউরানি তাই শুনে নীচেয় নেমে আসছে–
তারপর একটু থেমে বললে–তুই বোস চুপ করে, আসছি
বলে দুর্গা আবার দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে গেল।
কী রে, তুই?
মতিঝিল থেকে বেরিয়েই হঠাৎ কান্তর সঙ্গে দেখা। বশির মিঞা কান্তর চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেছে। চেহারা শুকিয়ে একেবারে চামড়া হয়ে গেছে।
তোর শাদি হয়ে গেছে? সেদিন যে শাদি করতে গেলি?
না ভাই, আমার দেরি হয়ে গেল যেতে, আর অন্য বরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে তারা। কী করব আর, সেখান থেকে কলকাতায় গিয়েছিলাম। আমার সে চাকরিও নেই আর। তাই তোর খোঁজেই মুর্শিদাবাদে এলুম।
ভাল করেছিস। একটা নোকরি খালি আছে। ছ’টাকা তলব। হাতিয়াগড়ে যেতে হবে তোকে।
হাতিয়াগড়ে? হাতিয়াগড়েই তো বিয়ে করতে গিয়েছিলাম আমি।
তা হলে আবার যা।
কী কাজ?
বশির মিঞা বললে–বলছি তোকে সব। আমার সঙ্গে আয়, সব বলব–হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে তোকে—
সচ্চরিত্র পুরকায়স্থর লজ্জাও নেই। আবার খাতাপত্র নিয়ে পুঁটলি ঘাড়ে করে অন্য জায়গায় ঘটকালি করতে যায়। হাঁটতে হাঁটতে যায়, আবার কোথাও কোনও সরাইখানা থাকলে সেখানে রাতটার মতন জিরোয়। আর যেখানে কোনও জমিদারবাড়িতে অতিথিশালা থাকে, সেখানে দিন দুই বিশ্রাম করে আবার বেরিয়ে পড়ে। আজিমাবাদ হয়ে রাজমহল গিয়ে একেবারে সুতি পর্যন্ত চলে যায়। তারপর সেখান থেকে মুর্শিদাবাদ, জঙ্গি, অগ্রদীপ হয়ে গঙ্গার ওপারের গাজিপুর পর্যন্ত।
কিংবা বর্ধমান থেকে বীরভূম পর্যন্ত গিয়ে মাঝখানে বক্রেশ্বর হয়ে পুবে কাশিমবাজার। তারপর রামপুর বোয়ালিয়ার দক্ষিণে হাজরাহাট দিয়ে করতোয়ার তির ঘেঁষে ঘেঁষে সেরপুর মুরচা পর্যন্ত যায়। বর্ধিষ্ণু একটা গ্রাম দেখলেই একটু জিরিয়ে নেয়। একে ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করে আপনাদের গায়ে ভাল পাত্তোর টাত্তোর আছে মশাই?—
কিন্তু যারা খবরটা পেয়েছে তারা বলে–না বাপু, তোমাকে দিয়ে ঘটকালি করাব না–
কেন আজ্ঞে, আমি কী দোষ করলুম?
দোষ করো নাই? হাতিয়াগড়ের শোভারাম বিশ্বাসের মেয়েটার কী সব্বোনাশ করলে বলল দিকিনি? তার ইহকালও গেল পরকালও গেল
সচ্চরিত্র বোঝে খরবটা জানাজানি হয়ে গেছে। এ-খবর জানাজানি হতে বেশিদিন লাগে না। এক সরকার থেকে আর এক সরকারে লোক যায়, নৌকো যায়, হাতি যায়। সচ্চরিত্র চলতে চলতে হয়তো একেবারে কেষ্টনগর চলে গেছে। কেষ্টনগরে অতিথিশালা আছে। যজমানও কিছু আছে সেখানে সচ্চরিত্রর। তবু কেষ্টনগরের রাজবাড়িতে খাওয়াটা ভাল দেয়। নবদ্বীপের রাজা। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের খাতিরটা হয় ভালমতন।
কেষ্টনগরের কাছাকাছি এলেই লোকে খেপায়। বলে–এই সচ্চরিত্র—
ছেলেছোকরার কথায় না খেপলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু সচ্চরিত্র খেপে ওঠে। খেপে গিয়ে দৌড়োয়। তাদের পেছন পেছন তাড়া করে। বলে–তবে রে হাড়হাবাতের দল
কিন্তু ছেলেছোকরাদের সঙ্গে পারবে কেন সচ্চরিত্র। তারা দৌড়োতে দৌড়োতে কোথায় গিয়ে লুকিয়ে পড়ে তখন আর কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না। এমনি করেই দিন কেটে যায় সচ্চরিত্রর। এমনি করেই শোভারামের মেয়ের বিয়ের ব্যাপারটা ভুলতে চেষ্টা করে। কেষ্টনগর থেকে শিবনিবাস যায়। শিবনিবাস থেকে মোল্লাহাটি। মোল্লাহাটিতে গিয়ে হয়তো একটা পুকুরের ধারে গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নেয়। তারপর পোঁটলাটা মাথায় নিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সেদিন সচ্চরিত্র একেবারে ধড়মড় করে উঠে পড়েছে। কে? কে যেন ডাকলে আমাকে?
মনে হল দূরে যেন কার পালকি যাচ্ছে। পালকির দরজাটা খোলা। কেউ ডাকেনি তাকে। পালকির বেহারাদের হুম হাম শব্দেই হয়তো তন্দ্রাটা ভেঙে গেছে। হয়তো কোনও জমিদার হবে। যাচ্ছে। কেষ্টনগর রাজবাড়িতে। ভাল পাত্রের সন্ধান পেলেও পাওয়া যেতে পারে। তাড়াতাড়ি গিয়ে রাস্তার ওপর দাঁড়াল। কে যায় গো? কে?
পালকি-বেহারারা ঘেমে নেয়ে উঠেছে।
খুব যে গ্যাদা হয়েছে গো। বলি কে আছে ভেতরে? তবু কেউ উত্তর দিলে না। সচ্চরিত্রকে চেনে তারা। পাগল-ছাগলের কথায় উত্তর দেয় না। খিদে পাচ্ছিল খুব। পেটের ভেতর নাড়িভুঁড়িগুলো বাটনা বাটতে শুরু করেছে। পুঁটলিটা নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলে সচ্চরিত্র। মোল্লাহাটির শ্রীধর বাঁড়ুজ্জে মশাইয়ের একটা ছেলে ছিল। বহুদিন আগের কথা। ছেলে তখন সবে জন্মেছে। প্রায় ন’বছর হয়ে গেল। সেই পাত্রটির সন্ধানে গেলে হয়। পুঁটলিটা নিয়ে উঠল সচ্চরিত্র। উঠে আবার পথ চলা। হঠাৎ দূর থেকে আবার দেখা গেল সেই পালকিটা আবার আসছে।
পালকিটা পাশ দিয়ে চলে যাবারই কথা। সচ্চরিত্র রাস্তার একপাশে সরে দাঁড়াল। কিন্তু অবাক কাণ্ড, পালকিটা সামনে এসেই থেমে গেছে।
শিবনিবাসের পথটা কোন দিকে কত্তা?
সচ্চরিত্র বললে–কেন বলতে যাব শুনি? আমার কথার উত্তর দিয়েছিলে তোমরা? আমি ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটকের পুত্র, ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র…
হঠাৎ পালকির ভেতর থেকে একটা মুখ বেরোতেই সচ্চরিত্র একবারে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে করজোড়ে বলে উঠল–ছোটমশাই আপনি? অধীনকে মার্জনা করবেন হুজুর
হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের হয়তো তখন অত কথা শোনবার সময় ছিল না। চেহারাটা কেমন শুকনো-শুকনো। গরমকাল। ছোটমশাইকে হাতিয়াগড়ে অনেকবার দেখেছে সচ্চরিত্র। ছোটমশাইয়ের অতিথিশালাতেও গিয়ে অনেক দিন রাত কাটিয়ে এসেছে। ছোটমশাইয়ের মতো ভালমানুষ ক’টা আছে বাংলাদেশে। শুধু ছোটমশাই কেন, বড়মশাইকেও চিনত সচ্চরিত্র। রথের সময় পুণ্যাহের সময় নতুন কাপড় দিতেন তিনি। সেসব দিনের কথা সচ্চরিত্রর মনে আছে।
ছোটমশাই বললেন–শিবনিবাসের রাস্তা জানো তুমি?
আজ্ঞে, শিবনিবাসের রাস্তা আমি চিনব না? আমি হলুম ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটকের পুত্র, ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র…
ওসব কথা থাক, আমার সময় নেই, শিবনিবাসে যাবার সোজা রাস্তাটা কোন দিকে গেলে পড়ে তুমি গেছ তো ওদিকে!
আজ্ঞে, এই তো শিবনিবাস থেকেই আসছি আমি ছোটমশাই। ওভেনে মহারাজ কেষ্টচন্দ্র আছেন, তস্য মন্ত্রী কালীপ্রসাদ সিংহ মশাই আছেন, গোপাল ভাড় মশাই আছেন, রায় গুণাকর কবিভূষণ ভারতচন্দ্র আছেন। আমি গেলুম, মহারাজ আমাকে পাঁচটি টাকা দিলেন, আমাকে খুব স্নেহ করেন কিনা–আর আমি তো যে-সে ঘটক নই ছোটমশাই, ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটকের…
ওসব কথা শোনবার বোধহয় সময় ছিল না ছোটমশাইয়ের। বেহারাদের ইঙ্গিত করতেই তারা চলতে লাগল
সচ্চরিত্র চেঁচিয়ে বলে উঠল–আজ্ঞে, সোজা নাক বরাবর গিয়ে বাঁ দিকে মোড় নেবেন, সেখানে চুয়োডাঙার মধ্যে পড়ে ইচ্ছামতীর পাড় ধরে একেবারে…
ছোটমশাই শুনতে পেলেন কি না কে জানে। পালকিটা হনহন করে চলে গেল। আহা, ছোটমশাইকে ভাল করে পথটা বলে দেওয়া হল না। সচ্চরিত্রর মাথার মধ্যে সবসময় যেন চরকির পাক চলছে। শোভারামের মেয়ের বিয়ের পর থেকেই জিনিসটা হচ্ছে। আর সে-যুগ নেই। এখন যেন ঘটক দেখলে ঠাট্টা করে সবাই। যেন ঠাট্টার বস্তু সচ্চরিত্র। আমি মরছি পেটের জ্বালায়, আর সবাই ঠাট্টা ধরে নিয়েছে। কুলশীল মিলিয়ে, মেলগোত্র যাচাই করে বিবাহ দেওয়া কি যার-তার কাজ কর্তা? আমার পিতা ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটক, পিতামহ কালীবর ঘটক…
হঠাৎ পেছন থেকে কে একজন নবাবি নিজামতের লোক একেবারে চেঁচিয়ে উঠেছে এই পণ্ডিত–পণ্ডিত
মহা মুশকিলে পড়া গেল। সচ্চরিত্রকেও চেনে নাকি! আমার পিতা ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটক, আমার পিতামহ কালীবর ঘটক….
পরিচয় দিতে দিতেই জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। নবাবি কেতায় প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
আমি রে বাবা, আমি! আমি কোথায় যাই তাতে তোমার কীসের দরকার বাপু! তুমি নিজের চাকায় তেল দাও না ভাইসাব! আমি পণ্ডিত নই, আমি ঘটক, ঘটককারিকা আমার মুখস্থ
চলো, মেহেদি নেসার সাহেব তলব দিয়েছে। চলো
সচ্চরিত্রর বুকটা ধক করে উঠেছে মেহেদি নেসার সাহেবের নাম শুনে। এরপর কেঁচোর মতো হয়ে। গেল সচ্চরিত্রর মুখখানা। সেপাইটার পেছন পেছন যেতে হল। মোল্লায় ধরলে মসজিদ পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে তবে ছাড়বে। কোথা দিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। জিজ্ঞেস করবার সাহস পর্যন্ত নেই সচ্চরিত্রর। পুঁটলিটা বগলে করে একেবারে নদীর ধারে নিয়ে গেল। ঘাটে নৌকো বাঁধা। ভেতরে মেহেদি নেসার সাহেব। সঙ্গে ইয়ারবকশি সবাই আছে।
নৌকোর সামনে যেতেই সচ্চরিত্র ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে দিলে।
মেহেদি নেশার মদ খেলেও কাজের কথা ভোলে না।
জিজ্ঞেস করলো–হ্যাঁ রে পণ্ডিত, সড়ক দিয়ে পালকি করে কাউকে যেতে দেখেছিস তুই
দেখেছি হুজুর
মেহেদি নেসার শুধু একলা নয়। ইবলিশ সাহেব, সফিউল্লা সাহেব, ইয়ারজান সাহেব। নবাবের সব শাগরেদরা হুল্লোড় করছে ভেতরে।
বহুত আচ্ছা পণ্ডিত, বহুত আচ্ছা
ইবলিশ সাহেব বললে–ওকে একটু দারু দাও নেসার মিঞা, পণ্ডিতের গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে। ইয়ার
দারু খাবি পণ্ডিত? গলা ভিজিয়ে নিবি?
শুধু মদ নয়, ভেতর থেকে মাংসর গন্ধও আসছে। হো হো করে সবাই হেসে উঠল কথাটায়। সচ্চরিত্র কাপড়টা দিয়ে নাক চাপা দিলে। গন্ধতে পেটের নাড়িভুড়িগুলো পর্যন্ত বমি হয়ে আসছে।
পালকিতে কে ছিল দেখেছিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ, জনাব।
কে?
হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই হুজুর
বলেই সচ্চরিত্র বুঝলে বলাটা ঠিক হয়নি৷ ছোটমশাইয়ের কী ক্ষতি করবে কে জানে!
কোন দিকে গেল?
ততক্ষণে একজন সত্যি সত্যিই গেলাসে মদ ঢেলে টলতে টলতে সামনে নিয়ে এসে মুখে দেয় আর কী। আর একজন মাংসের বাটিটা নিয়ে এসেছে খাওয়াবে বলে।
সচ্চরিত্র তখনও মুখে কাপড় চাপা দিয়ে আছে। কোনওরকমে মুখ ফাঁক করে বললে–ওসব আমি খাই না হুজুর। আমি হিন্দু হুজুর
মেহেদি নেসার জিজ্ঞেস করলে–শিগগির বল, জমিদারবাচ্চা কোন দিকে গেল–তা হলে গোস খাওয়াব না, না বলতে পারলে তোকে গোস খাইয়ে দেব
হুজুর, জমিদারবাবু মোল্লাহাটের দিকে গেল!
মোল্লাহাট?
হ্যাঁ হুজুর, মোল্লাহাটের রাস্তা জিজ্ঞেস করলেন আমাকে আমি তাই রাস্তা বলে দিলুম।
কে জানে, কী সদবুদ্ধি উদয় হল সচ্চরিত্রর মনে। ছোটমশাইয়ের অতিথিশালায় অনেক দিন আশ্রয় পেয়েছে সচ্চরিত্র। হয়তো শিবনিবাসের নাম করলে কোনও সর্বনাশ হবে ছোটমশাইয়ের। কে জানে! এ মিথ্যে কথায় কোনও পাপ নেই।
মোল্লাহাটের নাম শুনে যেন খানিকটা নিশ্চিন্ত হল সবাই। নৌকো আবার মোল্লাহাটের দিকেই ফিরল। মোল্লাহাটে পৌঁছোতে রাত পূইয়ে ভোর হয়ে যাবে। কিন্তু ইয়ারজান ছাড়লে না। বললে–পণ্ডিত উবকার করেছে, তা হলে পণ্ডিতকে একটু দারু খাইয়েই দে ইয়ার, পণ্ডিতের গলা ভিজিয়ে দে–
তারপর সে এক কাণ্ড! তিনজনে মিলেই সচ্চরিত্রকে জাপটে ধরলে। তারপর নাকের কাপড়টা খুলে দিয়ে একজন মুখটা হাঁ করিয়ে মদ ঢেলে দিলে। গলা দিয়ে কিছুতেই ঢোকে না। তারই ওপর আর
একজন মাংস নিয়ে মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে বললে–খা পণ্ডিত, খা খা–
সচ্চরিত্রর মনে হল মাথাটা যেন তার ঘুরছে। হাত থেকে ঘটককারিকার পুঁটলিটা মাটিতে পড়ে গেল। বোধহয় তার তখন আর জ্ঞানই নেই। সেই টাটা করা রোদ, সেই দুপুরবেলা মাথার ব্রহ্মতালু ভেদ করে যেন প্রাণটা বেরিয়ে আসতে চাইল বাইরে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই হো হো করে পৈশাচিক হাসি হেসে উঠেছে।
হঠাৎ অনেকক্ষণ পরে জ্ঞান হতেই চোখ তুলে দেখলে কে যেন তার মাথায় জল দিচ্ছে। চিনতে পারলে না লোকটাকে। একমুখ পাকা দাড়ি। বেশ বুড়ো মানুষ।
সচ্চরিত্র চোখ চাইতেই লোকটা বললে–এমন গরমে কি বেরোতে হয় বাবা। মাথা ঘুরে পড়ে তো যাবেই–
তবু কথা বলছে না দেখে লোকটা বললে–আমি এখানকার মসজিদের ইমামসাহেব বাবা, আমার মসজিদে হেঁটে যেতে পারবে?
সচ্চরিত্রর তখনও ভয় যায়নি। বললে–ইমামসাহেব, ওঁরা কোথায়?
ওঁরা কারা বাবা?
নাম উচ্চারণ করতেও যেন ভয় হল সচ্চরিত্রর। পাশেই বমি পড়ে রয়েছে তার। এতক্ষণে গন্ধটা যেন নতুন করে নাকে লাগল। মনে পড়ল সব ঘটনাগুলো। রাম রাম থুঃ থুঃ–সচ্চরিত্র ছেলেমানুষের মতো হাউহাউ করে কেঁদে ফেললে। আমার সর্বনাশ হয়েছে ইমামসাহেব, আমার জাত গেছে-আমার সব গেছে।
বলতে বলতে কান্নায় আর কথা বলতে পারলে না সচ্চরিত্র। ইমামসাহেব এ-অঞ্চলের বহু পুরনো লোক। এসব জিনিস দেখা আছে। নদী থেকে জল তুলে এনে সচ্চরিত্রর মাথায় দিতে লাগল। সচ্চরিত্রর কান্না যেন কিছুতেই আর থামতে চায় না। আমার যজমানদের কাছে আমি মুখ দেখাব কেমন করে ইমামসাহেব—
শিবের নিবাস বোধহয় শিবনিবাসও। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যখন কোথাও যাবেন একলা যাবেন না। সঙ্গে পারিষদরাও যাবে। লোকে বলত–মহারাজ তো মহারাজ, নদীয়ার মহারাজ। উদ্ধব দাস কতবার ছড়া কেটেছিল কৃষ্ণচন্দ্রকে নিয়ে। একবার ডেকেছিলেন মহারাজ। বলেছিলেন–লোকটাকে একবার আনিস তো আমার কাছে
উদ্ধব দাস গেয়েছিল
আমি রব না ভব-ভবনে!
শুনে হে শিব শ্রবণে!
যে-নারী করে নাথ পতিবক্ষে পদাঘাত
তুমি তারই বশীভূত
আমি তা সব কেমন!
মহারাজ রসিক লোক। বললেন–তার পর? তার পর? কার লেখা? তোমার?
উদ্ধব দাস বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, এই অধীনের রচনা। তারপর গাইতে শুরু করলে
পতি বক্ষে পদ হানি ও হল না কলঙ্কিনী
মন্দ হল মন্দাকিনী ভক্ত হরিদাস ভণে।
আমি রব না ভব-ভবনে।
উদ্ধব দাসের গান শুনে সেবার খুব ভাল লেগেছিল মহারাজার। পাশে মন্ত্রী কালিপ্রসাদ সিংহ বসে ছিলেন। তিনি বললেন–ওর আর একটা গান আছে, সেইটে শোনাও তো দাসমশাই তোমার সেই ছড়াটা?
উদ্ধব দাস বললে–তবে শুনুন আজ্ঞে শোভার কথা
বলি বলে উদ্ধব দাস আরম্ভ করলে–
শুনো শুনো সভাজন অভাজনের নিবেদন।
শোভার কথা সভা মধ্যে করি বিবরণ ॥
ঐরাবতের ইন্দ্র শোভা, যোগীর শোভা জটা ॥
ব্রাহ্মণের পইতে শোভা, কপালের শোভা ফোঁটা ॥
আহা বেশ বেশ বেশ ॥
রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র শুনছিলেন। সভাকবি! তার মুখ দিয়ে হাসি বেরোল। বললেন–বাঃ, বেশ বেশ
উদ্ধব দাস আবার আরম্ভ করলে–
নিশির শোভা শশী আর নভের শোভা তারা।
ব্রজের শোভা কৃষ্ণচন্দ্র, নদের শোভা গোরা ॥
আহা বেশ বেশ বেশ ॥
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র খুব খুশি। বললেন–রায়গুণাকর, এ যে তোমাকেও হার মানালে হে—
উদ্ধব দাস আবার গাইতে শুরু করেছে
যুবতীর পতি শোভা আর।
গৃহের শোভা নারী।
উদ্ধবচন্দ্র দাস বলে যাই বলিহারি–
আহা যাই বলিহারি ॥
আহা বেশ বেশ বেশ ॥
সঙ্গে সঙ্গে যারা শুনছিল সবাই বলে উঠল–আহা বেশ বেশ বেশ–তার পর?
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র হঠাৎ ডাকলেন–ও গোপালবাবু, গোপালবাবু
গোপালবাবু এতক্ষণ একপাশে মুখ চুন করে শুনছিলেন। একটা কথাও বলেননি। কৃষ্ণচন্দ্র বললেন–লোকে তোমাকে ভাঁড় বলে গোপালবাবু, কিন্তু উদ্ধব দাস যে তোমাকে হারিয়ে দিলে দেখছি
উদ্ধব দাসের তখন উৎসাহ বেড়ে গেছে। বললে–তা হলে আমি একটা ছড়া বলব রাজামশাই বলুন তো দেখি কী উত্তর হয়–
সূর্যবংশ জন্ম তার অজ রাজার নাতি।
দশরথ পুত্র বটে নয় সীতাপতি ॥
রাবণের অরি নয় লক্ষ্মণের জ্যেষ্ঠ।
ভণে কবি উদ্ধব দাস হেঁয়ালির শ্রেষ্ঠ।
বলুন তো প্রভু, কী?
মহারাজ গোপালবাবুর দিকে চাইলেন। বললেন–বলো গোপালবাবু, উত্তর দিতে হবে তোমাকে! নইলে তোমার চাকরি থাকবে না আর
গোপালবাবু ক্ষীণ একটু হাসলেন। বললেন–আজ্ঞে, ভরত—
উদ্বব দাস বললে–তা হলে আর একটা বলুন দিকি, কেমন বিদ্যে আপনার দেখি–
পিতৃগৃহে লজ্জাবতী থাকে অতিশয়।
কিন্তু পরগহে গেলে সে ভাব না রয় ॥
মুখেতে করিলে তারে জুড়ায় পরান।
সভাস্থলে সবাকার রাখয়ে সম্মান ॥
রমণী কুলেতে তার কর্ম ভাল জানে।
কী নাম তাহার প্রভু বলো মম স্থানে ॥
গোপালবাবু, চুপ করে রইলে কেন, বলো? উত্তর দাও
মন্ত্রী কালিপ্রসাদ সিংহ বললেন–আমি বলব? পান—
তুমি হেরে গেলে গোপালবাবু–উত্তর দিতে পারলে না—
গোপালবাবু বললেন–তা হলে আমি একটা বলি–উত্তর দাও তো হে–
অলি অলি পাখিগুলি গলি গলি যায়।
সর্ব অঙ্গ ছেড়ে দিয়ে ডোখ খুবলে খায় ॥
উদ্ধব দাস বললে–প্রভু, এ তো সহজ প্রশ্ন, ধোঁয়া—
মহারাজ খুব খুশি। বললেন–তুমি একটা চাকরি নেবে উদ্ধব দাস আমার কাছে?
উদ্ধব দাস গান গেয়ে উঠল–আমি রব না ভব-ভবনে
মহারাজ চাকরকে ডাকলেন–ওরে বৈকুণ্ঠ, এই উদ্ধব দাসকে কিছু খেতে দে–কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? খিদে পেয়েছে? কী খাবে?
উদ্ধব দাস বললে–আজ্ঞে, মুগের ডাল—
কালিপ্রসাদ সিংহ হঠাৎ তাড়াতাড়ি কাছে ঘেঁষে এলেন। কানে কানে বললেন তিনি এসেছেন
কার আসার কথা শুনেই যেন মহারাজ উঠলেন। অনেক দিন এসব ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিলেন না। এসব আগে করা গেছে। ক’মাস থেকেই ভাল লাগছিল না কিছু। দিল্লির বাদশাদের সঙ্গে আপস করে চলতে চলতেই জীবন কেটে গেল। আবার এখন মুর্শিদাবাদের নবাবকে নিয়ে ওরা ঘোঁট পাকিয়ে তুলছে। যেন অনিচ্ছের সঙ্গে বললেন–চলো–আমি আসছি—
বড় বউরানি ছোটমশাইকে ভাল করে সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কী কী কথা বলতে হবে তাও গুছিয়ে শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
বলেছিলেন–তুমি যেন আবার শুধু হাতে এবার ফিরে এসো না—
ছোটমশাই বলেছিলেন–তুমি যে কী বলো! আমি কিছু বলতে পারি না ভেবেছ?
না, ওরকম মিউমিউ করে কথা বললে–চলবে না।
আমি মিউমিউ করে কথা বলি?
তা বলো না? বললে–আজকে এই দশা হয়? এত বড় আস্পর্ধা নবাবের? নবাব হয়েছে বলে কি একেবারে আমাদের মাথা কিনে নিয়েছে? আমি যদি পুরুষ হতুম তো কবে দূর করে দিতুম না গদি থেকে–
ছোটমশাই বলেছিলেন–এসব কাজ কি অত তাড়াহুড়ো করলে চলে? সবাই মিলে পরামর্শ করছি, দেখতে পাচ্ছ তো
তা নিজের বউকে তা হলে দিয়ে এসো নবাবের হাতে তুলে!
তখনও জানাজানি হয়নি ব্যাপারটা। ছোটমশাই ভেবেছিলেন একদিন সব চাপা পড়ে যাবে। একবার যদি ফিরিঙ্গিরা মাথা চাড়া দেয় তো তখন হয়তো সব ওলোটপালট হয়ে যাবে। সেদিন রাত্রে পরওয়ানাটা পড়ে তাই মাথাটা কেমন ঘুরে গিয়েছিল। তারপর থেকেই কী করবেন, কার কাছে যাবেন বুঝতে পারছিলেন না। একবার চিঠি পাঠান মহিমাপুরে। জগা খাজাঞ্চি বুড়ো মানুষ। তাকে দিয়ে সব কাজ হয় না। আর কার কাছেই বা বিশ্বাস করে সব বলা যায়। সে-চিঠি আসার জন্যে হাঁ করে পথের দিকে চেয়ে বসে থাকেন। জগা খাজাঞ্চি খালি হাতে ফিরে আসে। শেঠজি খবর দেন–সব বন্দোবস্ত হচ্ছে। কিন্তু কতদিন আর তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকা যায়।
বউ বউরানি বলেন–আমি কিন্তু বলে রাখছি, কিছুতেই ছোটকে পাঠাব না সেখানে
তা আমিই কি সাধ করে পাঠাচ্ছি! আমার কি কোনও কষ্ট হয় না?
কষ্ট? কষ্টটাই তুমি দেখলে আর মানসম্মানের কথা তো ভাবলে না একবার! তোমার কষ্টটাই তোমার কাছে বড় হল? মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি বলে কি এত অপমান সইতে হবে?
ছোটমশাই বলেছিলেন–তুমি এত চেঁচাচ্ছ কেন, শুনতে পাবে যে
বেশ করব চেঁচাব। হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির মানসম্মান বলে একটা জিনিস নেই! আমি ওকে খুন করব তবু ওকে যেতে দেব না, দেখি ওই মেহেদি নেসার বেটা কী করতে পারে–
আসলে তো মেহেদি নেসার একলা নয়!
একলাই হোক আর দোকলাই হোক, আমি কি ভয় করি নাকি কাউকে–? ভেবেছে গদি পেয়েছে বলে যা ইচ্ছে তাই করবে! ভগবান বলে কেউ নেই নাকি ভেবেছে? পরকাল নেই! পরকালে নরকে গিয়ে জবাবদিহি করতে হবে না এর জন্যে!
বড় বউরানি যখন রাগেন তখন ছোটমশাইয়ের ভয় হয়। চুপ করে থাকেন।
আজ ওকে নিচ্ছে, কাল আবার গাঁয়ের আর কাউকে চাইবে! তখন কী করবে? তোমার মুখের দিকে না চেয়ে আছে সব লোক? তাদের হিত তুমি দেখবে না?
ছোটমশাই বললেন–দেখো, বাড়ির মধ্যে অমন অনেক চেঁচানো যায়, দেশের অবস্থা তো জানো, সবাই ভয়ে ভয়ে কাঁপছে হিন্দু মুসলমান ফিরিঙ্গিরা পর্যন্ত ভয় করে আছে
তারপর বড় বউরানি কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ছোটমশাই বললেন–শুনলুম সেদিন লস্করপুরের তালুকদার কাশিম আলি সাহেব নাকি নিজামত কাছারিতে মকর্দমার তদবির করতে গিয়েছিল, মেহেদি নেসার তাকে ধরে তার পালকিতে জুতে দিয়েছে আবার শুনলাম কাকে নাকি ধরে রাস্তায় কোন হিন্দুকে জোর করে গোরুর মাংস খাইয়ে দিয়েছে
বউ বড়রানি বললেন–তা তো হবেই, জমিদাররা যত হয়েছে ভেড়ার দল
ছোটমশাই বললেন–তুমি তো বলেই খালাস, কিন্তু জলে বাস করে কি কুমিরের সঙ্গে ঝগড়া করা যায়? তা হলে তো সেই লড়াই বেধে যাবে
তা লড়াই করবে! এমন করে গোরু-ভেড়ার মতো বেঁচে থাকার চেয়ে লড়াই করে মরে যাওয়াও যে ভাল
তুমি মেয়েমানুষ বাড়ির মধ্যে থাকো, লড়াইয়ের কী বুঝবে! লড়াই মানেই তো কতকগুলো নিরীহ মানুষ মারা যাবে মাঝখান থেকে
বড় বউরানি খেপে গেলেন–তা কয়েকশো মানুষ মারা যাবে বলে লড়াই না করে অন্যায় সহ্য করবে?
ছোটমশাই আর থাকতে পারলেন না। গলাটা একটু উঁচু করে বললেন–অন্যায় সহ্য করার কথা বারবার বলছ কেন মিছিমিছি? আমি কি আমার কথা বলছি? আমি তোমাদের কথা ভেবেই ভয় পাচ্ছি
তা আমরা কি মরতে জানিনে ভেবেছ? না আমরা কখনও মরিনি? আমার ঠাকুমা আমার ঠাকুরদার চিতেয় উঠে পুড়ে মরেনি? মেয়েরা যা পারে তোমরা তা পারো?
ছোটমশাই বললেন–কেন মিছিমিছি তুমি ওসব কথা তুলছ! এখন কী করা যায় তাই ভাবো
ভেবে আমি ঠিক করে ফেলেছি। আমি ছোটকে খুন করব তবু নবাবের হাতে তুলে দেব না!
সেটা তো একটা কথার মতো কথা হল না। যা করা সম্ভব তাই বলো!
সব সম্ভব! মেয়েমানুষের কাছে কিছুই অসম্ভব নয়।
রেগে যেয়ো না, রেগে গেলে কোনও সমাধান হয় না। ভাল করে ভেবেচিন্তে বলো
বড় বউরানি বললেন–আমি সবদিক ভেবেই বলছি। যেদিন থেকে ডিহিদারের পরওয়ানা এসেছে, সেইদিন থেকেই ভাবছি, আমি মাধব ঢালিকে বলে রেখেছি, এবার ডিহিদারের লোক এলেই আমি আমার কাজ সেরে ফেলব। তারপর দরকার হলে না-হয় আমিও আত্মঘাতী হব। যে-দেশে পুরুষমানুষ। নেই, সে-দেশে মরা ছাড়া আমাদের আর কী গতি আছে বলো?
সত্যি বলছি বড়বউ, এসব কথা আমি সমস্ত বুঝিয়ে বলেছি শেঠজিকে
শেঠজি কী করবে? তার কীসের ভাবনা? তার টাকার জোর আছে, নবাব বাদশা থেকে শুরু করে পাইক-পেয়াদা পর্যন্ত তার দলে। আমাদের কথা শেঠজিরা বুঝবে কেন?
ছোটমশাই বললেন–না না, শেঠজি বুঝেছে সব। সমস্ত তোড়জোড় হচ্ছে। ওদিকে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে ফরাসডাঙার ফিরিঙ্গিদের লড়াই হচ্ছিল বলে এতদিন কিছু করতে পারেনি এবার যে মেমসাহেবদের ধরে নবাবের হারেমে পুরে অপমান করেছে, এবার তাদের গায়েও লেগেছে– ।
কিন্তু ততদিন তো এখানকার ডিহিদার বসে থাকবে না। সে তো আবার এল বলে। তখন তাকে কী বলে ঠেকাবে?
ছোটমশাই বললেন সেই কথাই তো আমি ভাবছি। তা হলে আমি একবার কেষ্টনগরে যাই, বলি গিয়ে মহারাজকে সব খুলে
বড় বউরানি বললেন–সে তোমার যা-খুশি করো গে যাও, আমি কিছু বলতে যাচ্ছি না, তার আগে যদি ডিহিদারের লোক আসে তো একটা রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে তুলব, তা তোমায় বলে রাখছি
ছোটমশাই বললেন কিন্তু সে তুমি তখন যাই করো, এখন যেন তুমি কিছু বলতে যেয়ো না ওকে বড়বউ। তা হলে কেঁদেকেটে একশা করবে ও লোক জানাজানি হয়ে যাবে
বলব না মানে! নিশ্চয়ই বলব, আমি এখুনি গিয়ে বলে আসছি বলে ঘর থেকে বড়বউ তাড়াতাড়ি ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গিয়েছিল–
ছোটমশাই পেছন থেকে ডেকেছিলেন–বড়বউ, শোনো, শুনে যাও–ও বড়বউ বড়বউ
নিজের মহল ছেড়ে বড় বউরানি বারান্দা পেরিয়ে একেবারে সোজা ছোট বউরানির মহলে গিয়ে পড়লেন। কদিন থেকেই মাথার ঠিক ছিল না। ভাল করে পুজোতেও মন বসছিল না তার। এত সাধের সংসার তার। কত সাধ করে ছোটকে এনেছিলেন তিনি। নিজের হাতে ছোটকে তুলে দিলেন স্বামীর হাতে। নিজে পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন–আমার ছেলে হল না। আমি এসেই হাতিয়াগড়কে নির্বংশ করে গেলাম। তুই এলে তবু যদি আবার হাতিয়াগড় বেঁচে ওঠে! অনেকদিন আগে বজরা করে মহালে যেতে যেতে চাকদহের ঘাটে প্রথম দেখেন ছোটকে। দূর থেকে বজরার জানালা। দিয়ে দেখা। ছোট তখন চান করতে নেমেছে ঘাটে। কত আর বয়েস। বউ হয়ে ঘোমটা দিয়ে সংসার। করবার বয়েস তখনও হয়নি ঘোটর। কিন্তু চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল দেখে। কাঁচা হলুদের মতো রং। গায়ের। মাথার চুলগুলো পিঠের ওপর এলিয়ে পড়েছে। বদর মিঞা বজরার হাল ধরে ছিল। বড় বউরানি বদর মিঞাকেই পাঠালেন।
বললেন–দেখে এসো তো বদর, ও মেয়েটি কাদের?
চাকদহর শ্রীনিবাস মুখুটির একমাত্র মেয়ে। মা নেই, ভাই নেই, বোন নেই। সংসারে আপন বলতে কেউ নেই।
তা না থাক, সেইখানেই ঘাটে বজরা বাঁধা হল সেদিনকার মতো। শ্রীনিবাস মুখুটি মশাইকে বজরায় ডেকে পাঠানো হল। শ্রীনিবাস মুখুটি প্রথমে বুঝতে পারেননি। পরে বুঝলেন পাত্র হাতিয়াগড়ের রাজা হিরণ্যনারায়ণ রায়। তিনি কেঁদে ফেললেন আনন্দে। আনন্দও হল কষ্টও হল। কুলীন হয়ে অকুলীনের হাতে নিজের মেয়েকে দেবেন। যেন মেয়ের কথা ভেবেই চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে পড়ল।
সেই এতটুকু মেয়ে রাসমণি। সেই এ-বাড়ির ছোট বউরানি। তাকেই আজ ম্লেচ্ছদের হাতে তুলে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি ছোটর মহলে দরজায় গিয়ে ঘা দিতে লাগলেন–ছোট, ও ছোট ওঠ ওঠ–
ঘরের ভেতরে তখন ছোট বউরানি আর মরালী পাশা খেলতে বসেছে। এমন সময় কারও আসবার কথা নয়। দুর্গা গিয়ে ডেকে এনেছিল মরালীকে।
বউ বউরানির গলা পেয়েই ভয়ে সকলের গলা কাঠ হয়ে গেছে।
ওমা, বড় বউরানি যে, কী হবে?
দুর্গা তাড়াতাড়ি মরালীকে পালঙের নীচে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ভেতরে যা শিগগির, বড় বউরানি দেখতে পেলে অনগ্ধ বাধবে—যা–
বড় বউরানি ভেতরে ঢুকেই একেবারে রণচণ্ডী মূর্তি ধরলে।
মুখপুড়ি, তুই নিজেরও মুখ পোড়ালি আর রায় বংশেরও মুখ পোড়ালি! কেন তুই মরতে গিয়েছিলি মুর্শিদাবাদে?
ছোট বউরানি এমনিতে হাসিখুশির মানুষ। কিন্তু বড়দিকে একটু ভয় করে। বড়দিকে দেখেই কেমন চোখ মুখ শুকিয়ে গেল।
বড় বউরানি তখনও বলে চলেছে–এত যদি তোর রূপের দেমাক, তা পরপুরুষকে সেরূপ না দেখালে তোর চলছিল না? পরপুরুষই তোর কাছে এত মিষ্টি হল রে? তুই একবার তোর স্বামীর কথা ভাবলি না, আমার কথা ভাবলি না, এই রায়বংশের কথাও ভাবলি না মুখপুড়ি?
ছোট বউরানির চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।
এখন আমার বাপের বাড়ির লোকের কাছে মুখ দেখাব কেমন করে বল তো? আমার হাতিয়াগড়ের প্রজাদের কাছে আমি কী কৈফিয়তটা দেব? আমি সাধ করে তোকে আস্তাকুঁড় থেকে রাজসিংহাসনে বসালুম, তাতেও তোর মন বসল না? তোর এত দেমাক?
ছোট বউরানি কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল–তুমি আমাকে অমন করে বোকোনাবড়দি, তুমি আমার মায়ের মতন আমার মা নেই–তুমিই আমার মা…
তা মায়ের মুখ খুব রাখলি তো ছোট! মায়ের মুখ একেবারে পুড়িয়ে ছাড়লি তুই–এমন মেয়ে নিয়ে এসেছিলুম সতিন করে যে আমার হাড়মাস পর্যন্ত ছাই করে দিলে! কেন তুই মরতে গিয়েছিলি, বল মুখপুড়ি বল
ছোট বউরানি বললে–তুমি তো জানো বড়দি, আমি যেতে চাইনি–
তুই যেতে চাসনি তো তোকে হাতে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ছোটমশাই? কেন, বাড়ির ভেতর ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে রুপোর পালঙে শুয়েও তোর পিরিত হয় না? এত গরম তোর? তবু যদি বুঝতুম একটা ছেলে বিয়োতে পারতিস–
ছোট বউরানি দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে তখন কাঁদছে।
আবার কাঁদছে। ভেবেছে কাদলে সুরাহা হবে! ছেনালি কান্না রাখ তো তুই। ও কান্নায় আমি ভুলছিনে!
ছোট বউরানি হঠাৎ ডুকরে উঠল–কিন্তু আমার কী দোষ বলো তুমি?
তোর দোষ নয়? কেন তুই নবাবজাদার বিয়েতে মুর্শিদাবাদে গেছলি? আর যদি গেলিই তো কেন নবাবজাদার ইয়ারবকশিদের দিকে চোখ তুলে চাইলি? একলা ছোটমশাইতে তোর মন ভরছিল না–?
ছোট বউরানি আর পারলে না। হঠাৎ বড় বউরানি পায়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। বললে–আর অত বোকো না বড়দি, আমাকে তুমি তার চেয়ে খুন করে ফেলল, আমি সহ্য করতে পারছি না
তোকে খুন করতে পারলেই তো আমি শান্তি পেতাম, কিন্তু.. তা শেষপর্যন্ত হয়তো তাই-ই..
এতক্ষণ দুর্গা একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল চুপ করে। তার দিকে নজর পড়তেই বড় বউরানি ধমক দিলেন–তুই এখেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী শুনছিস; অ্যাঁ? তুই যা এখান থেকে যা
দুর্গা ঘরের বাইরে চলে গেল। তারপর বড় বউরানির হঠাৎ পালঙের তলার দিকে নজর পড়ল। বলে উঠলেন–ওখানে কে রে? কে ওখানে? খাটের তলায়?
ওদিকে শিবনিবাসের একটা ঘরের মধ্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তখন সব শুনছেন; শুনতে শুনতে মুখটা কঠোর হয়ে এল তার। তারপরে হাতের চিঠিটা নিয়ে আর একবার পড়তে লাগলেন।
‘নবদ্বীপাধিপতি মহারাজ শ্রীল শ্রীযুক্ত কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
বরাবরেষু—
বাংলার নবাবের অত্যাচারে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, বিদ্বান, মূর্খ, পণ্ডিত সকলেই স্ব স্ব ঘর-দ্বার ত্যাগ করিয়া পলাইতে উদ্যত। নবাব কাহারও কোনও কথা শুনেইনা। এ-বিষয়ে কী কর্তব্য বুঝিতে না পারিয়া আপনাকে আমরা আহ্বান করিতেছি। আপনি সত্বর আসিয়া সুচিন্তিত মতামত দিয়া সহায়তা করিলে বাংলাদেশ রক্ষা হয়। ইতি—’
নীচে সই করেছেন মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজা দুর্লভরাম, রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণদাস, রাজা হিরণ্যনারায়ণ।
কান্ত কী করবে বুঝতে পারলে না। ষষ্ঠীপদ তাকে যে এমনভাবে ডোবাবে তা সে বুঝতে পারেনি। যতদিন চাকরি করেছে বেভারিজ সাহেবের কাছে, ষষ্ঠীপদ মাথা হেঁট করে সব কাজ করে গেছে। পেটে। পেটে তার যে এমন বুদ্ধি তা জানা যায়নি।
সে-রাতটা সেই হাতিয়াগড়েই কাটল। ওদিকে বিয়েবাড়ির গোলমাল তখন চলছে। রান্নার গন্ধ আসছেনাকে। সচ্চরিত্র নিজেই তিনটে পাতা করে নিয়েছিল। একটা নিজের জন্যে, একটা কান্তর জন্যে, আর একটা নাপিতের জন্যে।
কোথায় যেন একটা ক্ষোভ, একটা লজ্জা, একটা পরাজয়ের কলঙ্ক সারা শরীর আর মনটাকে পিষে থেঁতলে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল।
খেয়ে নাও বাবাজি, খেয়ে নেবে চলো, কলাপাতা পেতে দিয়েছি, বৃহৎ ব্যাপারে কারও ওপর নির্ভর করলে চলে না, নিজেরাই করে নিতে হয়। এখানে লজ্জা করলে নিজেরাই উপোষ করে মরব–
সচ্চরিত্র উৎসাহ দিয়ে কান্তকে চাঙ্গা করতে চেয়েছিল খুব। তারও অন্যায় নেই কিছু। সে এরকম অনেক বিয়ে দেখেছে, অনেক বিয়ে ভাঙতেও দেখেছে। নাপিতও এসব দেখে ঠেকে শিখেছে। বিয়েবাড়িতে খেতে সংকোচ করলে শেষকালে ঠকতে হয়।
আপনারা খেতে বসুন, আমি খাব’খন, আমার খিদে নেই
বিয়ে উপলক্ষে সারাদিনই উপোষ করে ছিল। তবু খিদের কথা যেন মনেই পড়ল না। সঙ্গে ঘোট একটা পোটলা ছিল। একটা বাড়তি ধুতি, আর একটা চাদর। সেই পোঁটলাটা নিয়েই সে সেদিন আবার নৌকোর আশায় নদীর ঘাটে এসে দাঁড়াল। কোথায় এতক্ষণ একটা বাড়ির অন্দরমহলে তাকে ঘিরে আনন্দের কলগুঞ্জন মুখর হয়ে উঠবে, তা নয়, সেই মাঝরাত্রের নির্জন পাথরধাঁধানো ঘাটের ওপরেই বুঝি একটুখানি তন্দ্রা এসেছিল। তারপর শেষরাত্রের দিকে ঘুম ভেঙে যেতেই দেখলে, নদীতে একটা নৌকো চলেছে। গহনার নৌকো। তারপর সেই তাদের বলেকয়ে সোজা কলকাতা। কিন্তু সেখানে যখন গিয়ে পৌঁছোল তখন রীতিমতো দেরি হয়ে গেছে। যার নাম বিকেল।
ষষ্ঠীপদ দেখতে পেয়ে হাঁ হাঁ করে উঠল-হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি ঢুকবেন না কান্তবাবু, সাহেব মানা করে গেছে
মানা করে গেছে মানে!
ষষ্ঠীপদ বললে–আপনি কাল যাবার পরেই যে সাহেব রাত্তিরে এসেছিল। সাহেব একলা নয়, সাহেবের সঙ্গে কেল্লা থেকে পল্টনরাও এসেছিল।
কেন?
আপনাকে ধরতে।
ধরতে মানে? আমি কী করেছি?
ষষ্ঠীপদ বললে–তা তো জানিনে। উমিচাঁদ সাহেবের লোক সাহেবকে বলেছে যে, আপনার কাছে। নাকি মুর্শিদাবাদের চর বশির মিঞা আসে। আপনার কাছ থেকে সব খবর নিয়ে সে মুর্শিদাবাদে পাচার করে।…
কান্ত কেমন অবাক হয়ে গেল। বশির মিঞা যে চর একথা কে বললে! ভাল করে ভেবে দেখল, কবে তাকে কী কথা সে বলেছে। কী কী জানতে চেয়েছে সে। অনেক সময় ষষ্ঠীপদর সামনেও অনেক কথা হয়েছে তার সঙ্গে। বশির মিঞা যে এখানে আসে এ কথা ষষ্ঠীপদ ছাড়া আর কে-ই বা জানে।
তা হলে আমি কি দেখা করব গিয়ে সাহেবের সঙ্গে?
না, তা করবেন না কান্তবাবু। শেষকালে আপনাকে হয়তো কেল্লার ফাটকে পুরে ফেলবে সাহেব। সাহেব বড় রেগে গেছে কিনা। সাহেব আমাকে বলে রেখেছে আপনি এলেই যেন তাকে খবর দিই। তা আমি তেমন নেমকহারাম নই কান্তবাবু। অন্য লোক হলে এত কথা বলত না, সাহেবকে গিয়ে চুপি চুপি খবরটা দিয়ে আসত
তা হলে আমি এখন কী করি বলো তো ষষ্ঠীপদ?
আমি আপনার ছোটভাইয়ের মতো কান্তবাবু, আমি বলছি আপনি এখান থেকে পালিয়ে যান। আপনার ভাবনা কী কান্তবাবু! এ ছোটলোকদের চাকরি কে সাধ করে করে? আমার যদি জানাশোনা থাকত তো আমি কবে নিজামতকাছারিতে গিয়ে চাকরি নিতুম! আপনাকে কত খোশামোদ করছে ওরা আর আপনি কিনা হেলায় হারাচ্ছেন! আপনি না নিন, আমাকে একটা চাকরি করে দিন ওখানে
কান্ত অনেক ভাবল। কাল থেকে খাওয়া নেই। কাল থেকে ঘুম নেই। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। সত্যিই তো৷ ষষ্ঠীপদ তো ঠিক কথাই বলেছে। নবাব মারা গেছে। তারপরেই ফিরিঙ্গি সাহেবদের মধ্যে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। লড়াই-ই বেধে যাবে হয়তো। তখন কোথায় থাকবে ফিরিঙ্গি কোম্পানি আর কোথায়ই বা থাকবে তার চাকরি!
তা হলে আমি আসি ষষ্ঠীপদ।
হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি আর দাঁড়াবেন না, আপনি চলে যান। আপনি থাকলে আমার একটু সুবিধে হত, কিন্তু আমার সুবিধের চেয়ে আপনার সুবিধেটাই বড় বলে মনে করি আমার নিজের কষ্ট হোক, কিন্তু আপনার ভাল হোক, এই আমি চাই কান্তবাবু
কান্ত আর দাঁড়াল না। আর কোনও কথা না বলে সোজা আবার পথে পা বাড়াল পুঁটলিটা হাতে নিয়ে। মিছিমিছি অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল। বিয়ের গায়ে-হলুদের কিছু জিনিসপত্র কিনতে হয়েছিল। নাপিতকেও রাহা খরচ দিতে হয়েছিল। বড়চাতরার বাড়িটা পরিষ্কার করবার জন্যেও নায়েববাবুদের গোমস্তাকে কিছু টাকা পাঠাতে হয়েছিল। একদিন বহু আগে সব ছেড়ে এখানে এই কলকাতায় এসে আশ্রয় পেয়েছিল, আজকে আবার এখান থেকেও চলে যেতে হল। সবাই যখন নিজের নিজের দেশ ছেড়ে কলকাতায় এসে নতুন করে বসবাস পত্তন করতে শুরু করছে, তখন কান্তকেই একলা এ-জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। তবু তো মুর্শিদাবাদ রাজধানী! এই জলা-জঙ্গল ভরা কলকাতার থেকে তো সেই মুর্শিদাবাদ ভাল। মুর্শিদাবাদ হল শহর, আর এ তো গ্রাম। গণ্ডগ্রাম! ভাগ্যে থাকলে হয়তো সেই রাজধানীতে গিয়েই তার ভাগ্য উদয় হবে। কোথায় কবে কেমন করে কার ভাগ্য উদয় হয় কেউ কি বলতে পারে!
আশ্চর্য, কান্ত যদি জানত একদিন তার এই রাজধানীতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ইতিহাস এমন করে বদলে যাবে! যদি জানত একদিন তার ভাগ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাগ্য জড়িয়ে একাকার হয়ে যাবে। যদি জানত শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত ভারতবর্ষের ভাগ্যলক্ষ্মীকে এমন করে পরের হাতে তুলে দেবে!
কান্ত গদি ছেড়ে চলে যাবার পরই বেভারিজ সাহেব এসে হাজির হল। সহজে বেভারিজ সাহেব কাউকে কিছু বলে না। কারবার করতে এসেছে কালাপানি পেরিয়ে। প্রথমে রাইটার হয়ে এসেছিল। তখন বছর কুড়ি বয়েস সাহেবের। নিজের দেশে কিছু হল না। বাপ-মা ছেলের জন্যে ভেবে ভেবে অস্থির। চাকরিবাকরি পায় না। এদিকে বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে ছেলের স্বভাব। মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়ায় দিনরাত। শেষকালে একদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে উঠে ইন্ডিয়ায় এসে হাজির হল। যে বেভারিজ সাহেব নিজের দেশে খেতে পেত না ভাল করে, এই সস্তা-গণ্ডার দেশে এসে তার হাতে টাকা এল, মেয়েমানুষ এল। চাকর বাকর-ঝি-বেয়ারা নিয়ে একেবারে নবাবপুত্তুর হয়ে বসল। গড়গড়ায় তামাক খেতে লাগল। বারুইপুরের পান খেতে লাগল। চুলে তেল মাখতে লাগল। তখন ঘুমোবার সময় দু’জন চাকর পায়ে সুড়সুড়ি দিলে তবে বেভারিজ সাহেবের ঘুম আসে। সে ঘুম ভাঙে পরদিন বেলা বারোটায়! একজন তামাক সাজে, একজন জামা পরিয়ে দেয়, একজন আবার জুতো পরিয়ে দেয়। কুড়িটা চাকর না হলে বেভারিজ সাহেবের অসহায় বলে মনে হয় নিজেকে। তারপর খেয়েদেয়ে নাক ভাকিয়ে ঘুমিয়ে বিকেলবেলা পালকি নিয়ে বেরোয়। বেরিয়ে একবার পেরিন সাহেবের কেল্লায় যায়,
তারপর আসে সোরার গদিতে। সাহেব এলেই কান্ত হিসেবপত্র নিয়ে সাহেবের সামনে ধরে। সাহেব একবার দেখে। তারপর যথাস্থানে সইসাবুদ করে পকেটে টাকাকড়ি পুরে নিয়ে আবার পালকি করে চলে যায়।
কিন্তু সেদিন ষষ্ঠীপদকে দেখে সাহেব অবাক হয়ে গেল। কান্তবাবু কোথায়? হোয়ের ইজ কান্টোবাবু?
ষষ্ঠীপদ বললে–আজ্ঞে হুজুর, কান্তবাবু আসবে না
হোয়াই? কেন?
হুজুর, কান্তবাবু তো চাকরি করতে আসেনি এখানে, অন্য কাজে এসেছিল।
কী কাজ?
আজ্ঞে হুজুর, এতদিন আপনাকে আমি বলিনি, কান্তবাবু নবাবের স্পাই হুজুর!
হোয়াট!
বেভারিজ সাহেব যেন ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠেছে কেদারা থেকে। সামনে কেউটে সাপ দেখলেও কেউ এমন করে চমকে ওঠে না। নবাবের স্পাই এতদিন তার গদিতে কাজ করছে আর সাহেব কিনা কিছুই জানত না।
এতদিন আমাকে বলোনি কেন কিছু?
হুজুর, আমার কসুর হয়ে গেছে। আমি রোজ দেখতাম কান্তবাবুর কাছেনবাবের লোক আসত, এসে গুজগুজ ফিসফিস করত!
সাহেব বুঝতে পারলে না। জিজ্ঞেস করলে গুজগুজ ফিসফিস কী?
আজ্ঞে, এখানকার কেল্লার সব খবর নিত!
কে সে? লোকটার নাম কী?
আজ্ঞে বশির মিঞা! আসলে কান্তবাবু আপনার কাছ থেকেও মাইনে নিত, আবার নবাব-নিজামতের কাছারি থেকেও মাইনে নিত। দুমুখো সাপ হুজুর। তা ছাড়া আপনার গদির টাকাই কি কম মেরেছে। নাকি? আপনি তো কিছু দেখেন না হুজুর, হাজার হাজার টাকা মেরে নিয়েছে তবিল থেকে
স্ট্রেঞ্জ! বেভারিজ সাহেবের যেন চোখ খুলে গেল এতদিনে। হলওয়েল সেদিন বলেছিল বটে যে বাঙালিদের বিশ্বাস করতে নেই।
বলে হিসেবের খাতাটা বার করে খুলে ধরে দেখালে ষষ্ঠীপদ। এই দেখুন, এইখানে একান্ন টাকার খেলাপ লেখা আছে, আর এখানে জমার বেলায় শূন্য। আর এই দেখুন দু’শো তিরাশি টাকা জমা লেখা আছে, আর আয়ের ঘরে জমা করা হয়নি।
বেভারিজ সাহেব দেখলে নজর দিয়ে।
বললে–আগে এসব আমাকে বলেনি কেন?
আজ্ঞে আমি কী করে বলি? মুনশি হল কান্তবাবু, আমি তো গোমস্তা মাত্তোর, আমি খাস মুনশির বিরুদ্ধে বলব?
ঠিক আছে। বেভারিজ সাহেব বললে–ঠিক আছে, কান্তবাবুকে আমি ডিসচার্জ করে দিলাম। তুমিই মুনশির কাজ করবে এবার থেকে। মুনশির কাজ করতে পারবে তুমি?
ষষ্ঠীপদ হাসলে। সাহেব বুঝল সে হাসির মানে। জিজ্ঞেস করলে–মুনশির কে আছে কলকাতায়?
আজ্ঞে কান্তবাবু তো বেওয়ারিশ লোক, কে আর থাকবে? সাত কুলেও কেউ নেই–নো-ওয়ান ইন সেভেন কুল
সাহেব জিজ্ঞেস করলে কুল? হোয়াট ইজ কুল?
হুজুর, কুল মানে খাবার কুল নয়–কুল মানে ইয়ে..মানে…
আর বোঝাতে পারলে না ষষ্ঠীপদ। শেষকালে হাত মুখ নেড়ে বললে–সাত কুল মানে সাতপুরুষ, মানে স্যার সেভেনম্যান
সাহেব বোধহয় কিছুটা বুঝতে পারলে। সেভেন জেনারেশন। আর বুঝতে চাইলে না বিশদ করে। ষষ্ঠীপদ তবু বোঝাতে লাগল। মুর্শিদাবাদে পালিয়ে যাবে বলেই কলকাতায় একটা আস্তানা করেনি কান্তবাবু। আপনার এখান থেকে যত টাকা লুঠ করেছে সেই সমস্ত দিয়ে রাজধানীতে দালান-কোঠা বানিয়েছে, বিবি রেখেছে। আসলে খুলে বলি আপনাকে, কান্তবাবু হিন্দু নয় হুজুর। মুসলমান!
হিন্দু নয়? সাহেব যেন আবার অবাক হয়ে গেল।
না হুজুর। হিন্দু হলে কি আর অত নেমকহারাম হয় হুজুর? দেখছেন না হুজুর, আমি হিন্দু বলে কত অনেস্ট। আমাদের গড হল শিব। আমাদের শিবের গাজন হয়, আপনি দেখেছেন তো–চড়কের সময় পিঠে বান ছুঁড়ে কত কষ্ট করতে হয় বলুন তো
আর তুমি? তুমি শিবপুজো করো?
কী বলছেন হুজুর? করব না? আমি যে ব্রাহ্মণ হুজুর। এই দেখুন–আমার পইতে দেখুন বলে ষষ্ঠীপদ নিজের পইতেটা বুড়ো আঙুলে আটকে রেখে সাহেবের চোখের সামনে ধরলে।
আমি রোজ গঙ্গামাটি দিয়ে এই পইতে পরিষ্কার করি হুজুর। আপনি এবার থেকে যত চাকর রাখবেন সব এই পইতে দেখে রাখবেন, আপনার কোনও জিনিস চুরি হবে না। জাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় জাত হচ্ছেন হুজুর, আপনারা, তারপরেই আমরা, এই ব্রাহ্মণরা। এটা আপনি জেনে রাখবেন হুজুর
ঠিক আছে, আজ থেকেই তুমি তা হলে মুনশির কাজ করো–
সাহেবের বোধহয় খুব তাড়া ছিল। তাড়াতাড়ি হিসেবের খাতায় সই করে, টাকাকড়ি পকেটে পুরে উঠছিল। পেছন থেকে ষষ্ঠীপদ এগিয়ে গিয়ে বললে–হুজুর, তা হলে গোমস্তার কাজ কে করবে? আমি তো মুনশি–
সাহেব বললে–আর একজন খুঁজতে হবে
তার চেয়ে হুজুর, একটা কাজ করি, আমার এক ব্রাদার-ইন-ল আছে, সে একেবারে পিয়োর ব্রাহ্মণ, যাকে বলে হজুর একেবারে খাঁটি ব্রাহ্মণ, তার পইতে আমার চেয়েও সাদা, একেবারে সাদা ধপধপ করছে, তাকে রাখবেন? তারও গড শিব
অলরাইট, তাকেই রাখো, কিন্তু ব্রাহ্মিণ যেন হয়—
বলে সাহেব তাড়াতাড়ি আবার পালকিতে গিয়ে উঠল। নইলে ওদিকেও দেরি হয়ে যাবে। সাহেবের সন্ধেবেলা ড্যান্স চাই, ওয়াইন চাই, ওম্যান চাই। এসব নিয়ে বেশি সময় নষ্ট করবার সময় থাকে না বেভারিজ সাহেবের।
সাহেব চলে যেতেই ভৈরব গুটিগুটি ভেতরে ঢুকল। ষষ্ঠীপদ দেখেই বললে–ঠিক গন্ধ পেয়েছিস তো! তোর চাকরি হয়ে গেল, কাল থেকে এখেনে গোমস্তার কাজ করবি
তা মাইনে? মাইনে কত পাব কত্তা?
কেন, তোর সঙ্গে তো কথা হয়ে আছে। দু’টাকা মাইনে, তার থেকে এক টাকা আমার। কিন্তু কথার খেলাফি যদি করো বাপু এখন, তা হলে কিন্তু তোমার চাকরি হবে না, তা বলে রাখছি। আর ওই যা বলেছিলুম–যা হাতসাফাই করব, তার দশভাগের একভাগ তোমার, বাকিটা সব আমার–রাজি তো? আমি কান্তবাবুকেও ওই কথাই বলেছিলুম, তা কান্তবাবু তো রাজি হয়নি, তাই এখন সরে যেতে হল। আমার সঙ্গে চালাকি করে পারবিনে, তা বলে রাখছি
তারপর একটু থেমে বললে–আর একটা কথা, তোকে বাপু গলায় একটা পইতে দিতে হবে
ভৈরব জিভ কেটেছে। সেকী হুজুর? আমি যে নমশূদ্র
নমশূদ্র তো কী হয়েছে? আমিও তো বাহাত্তরে কায়েত, আমি কী করে পইতে পরি? এ কি আমার দেশ না তোর দেশ? এখেনে বেটা ম্লেচ্ছদের হাতে মাইনে নিলে জাত যায় না, আর পইতে নিলেই একেবারে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? টাকা বড় না জাত বড়? বল, বল তাই আমাকে–
আজ্ঞে টাকা!
তবে? তবে যে পইতে পরতে ভয় পাচ্ছিস? যখন এককাঁড়ি টাকা নিয়ে দেশে-গাঁয়ে যাবি তখন পইতেটা ছুঁড়ে ফেলে দিস, কে দেখতে যাচ্ছে? চিরকাল তো আর ফিরিঙ্গি কোম্পানি থাকবে না, দু’দিনের জন্যে এসেছে, কারবার করছে, আবার একদিন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু টাকাটা তো আর ফিরিয়ে নিতে পারবে না। আমাদের টাকা আমাদেরই থেকে যাবে। তখন টাকা দিয়ে তিনটে বামুন খাইয়ে কালীঘাটে পুজো দিলেই প্রাশ্চিত্তির হয়ে যাবে
কথাটা ভৈরবের তখনও ভাল করে উপলব্ধি হয়নি।
ষষ্ঠীপদ বললে–তিনগাছা ফরসা সুতো নিয়ে গলায় দিয়ে আয়, আজ থেকেই তোর চাকরি হয়ে গেল ধরে নে–আর সাহেব এসে যদি তোর নাম জিজ্ঞেস করে, যেন বলিসনি তোর নাম ভৈরব দাস, বলবি ভৈরব চক্কোত্তি, বুঝলি?
ভৈরব বুঝল কি বুঝল না, কে জানে!
অত তখন ভাববার সময় নেই ষষ্ঠীপদর। ভৈরব ঘাড় নেড়ে পইতে জোগাড় করতে চলে গেল।
বশির মিঞার ফুপা মনসুর আলি মেহের মোহরারের সঙ্গে কান্তর সেই প্রথম দেখা। বশির মিঞাই নিজে নিয়ে গেল তার কাছে। এলাহি কাণ্ড চারদিকে। এর আগে কখনও নিজামতকাছারি দেখেনি কান্ত। মনটাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। এত সৎভাবে চাকরি করেও চাকরি রইল না তার। সাহেব তাকে ভুল ভাবলে। সাহেব কিনা ভাবলে তার মুনশি নবাবের নিজামতের চর। স্পাই। কলকাতা থেকে হাতিয়াগড়, হাতিয়াগড় থেকে কলকাতা। আবার কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ। হাতে একটা বাড়তি টাকাও নেই।
বশির মিঞা বললে–ফুপা, এই হল আমার দোস্ত–এর কাছ থেকেই ফিরিঙ্গিদের সব খবর পেতাম খুব সাচ্চা আদমি, একেই হাতিয়াগড়ে পাঠাচ্ছি
মনসুর আলি মেহের সাহেব একবার কান্তর আপাদমস্তক দেখে নিলে। সারা বাংলা মুলুক চালাতে হয় মনসুর আলিকে। একদিকে মেহেদি নেসার সাহেব, আর একদিকে মিরজাফর আলি, জগৎশেঠ। দু’বজরায় পা দিয়ে চলতে হচ্ছে। বড় ঝকমারির নতিজা হয়েছে কাছারির কাজ।
কাফের তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ ফুপা, কাফের। হিন্দু কাফের। বেইমানি করবে না।
মনসুর আলি সাহেব কান্তর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলে–পারবে তো কাজ?
কী কাজ তাই জানে না কান্ত, তার আবার পারাপারির কী আছে! আর সাহেবের গদির মুনশিগিরি করে এসেছে এতদিন, কোন কাজটা না পারার আছে
তুই বলেছিস তো ওকে, কাজটা কী?
বশির মিঞা বললে–সে আমি সব সমঝিয়ে দেব, কিন্তু ওকে আমি বলেছি ছ’টাকা তলব দিতে হবে। ইমানদার আদমি যখন, ছ’টাকা তলব দিলে কী আর নুকসান!
এর বেশি আর কথা হল না মনসুর আলির সামনে। তারপর কাছারির বাইরে বেরিয়ে এসে বশির মিঞা সব বুঝিয়ে বললে। সব শুনে কান্তর হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে এল! আবার সেই হাতিয়াগড়ে যেতে হবে!
কিন্তু রানিবিবিকে এখানে কেন আনবে?
তা জেনে তোর ফয়দা কী? তোকে যা হুকুম করছি তাই-ই কর। কী কাম, কেন করতে হবে, এসব কখনও পুছিস না। জাসুসি কাম এই রকম। আর তোর তো কিছু ঝক্কি নেই। তুই শুধু সঙ্গে সঙ্গে থাকবি। তোর সঙ্গে টাকা থাকবে, পাঞ্জা থাকবে, ফৌজি সেপাই থাকবে, বাকি কাজ সব ডিহিদারের আদমি আছে, তারা করে রাখবে। তুই গেলেই হাতিয়াগড়ের বাপের বাপও গররাজি হবার সাহস করবে না।
কিন্তু তুই যাচ্ছিস না কেন?
বশির মিঞা বললে–আরে মেহেদি নেসার সাহেব যে আমাকে দিয়ে ভরসা করতে পারবে না। আমি যদি মেরে দিই? আমি যদি লবাবের মাল লুটেপুটে খাই?
তার মানে?
বশির মিঞা চটে গেল। বললে–তুই ওসব বুঝবি না এখন। আরও দিনকতক কাম কর নিজামতে তখন হালচাল বুঝে ফেলবি। আমরা শালারা আমাদের নিজের জাতের ওপরেই ভরসা করি না হিন্দুদেরও ভরসা করি না, মোসলমানদেরও ভরসা করি না
কিন্তু তোদের দলে তা হলে কে আছে?
মেহেদি নেসার আছে, আর আরও অনেকে আছে
বলে আর কিছু বলতে চায়নি বশির মিঞা। কান্তও জিজ্ঞেস করেনি৷ টাকা নিয়ে পাঞ্জা নিয়ে সোজা হাতিয়াগড়ে এসে পৌঁছেছিল। গরমে টা ঐটা করছে মাটি। আসবার সময় হাঁটা রাস্তা। রানিবিবিকে নিয়ে ফেরবার সময় তখন আর হাঁটা পথে ফিরতে হবে না। তখন ডিহিদার বজরা দেবে, পালকি দেবে। কাশিমবাজার থেকে সোজা পশ্চিম দিকে গেলে বক্রেশ্বর, তারপর বক্রেশ্বর থেকে সোজা বর্ধমান। সেখান থেকে হাতিয়াগড় দেড় দিনের পথ।
যখন হাতিয়াগড় পৌঁছোল কান্ত, তখন বেশ বেলা। ডিহিদারের দফতরে যাবার রাস্তাটা জেনে নিয়েছিল রাস্তার লোকজনদের কাছে। এই ক’দিন আগেই এখানে এসেছিল বিয়ে করতে। আবার এখানেই তাকে আসতে হবে কে জানত। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, তার সঙ্গেই হয়তো শ্বশুরবাড়িতে চলে গেছে সেবউ। হয়তো এতদিন বউভাতও হয়ে গেছে। তারপর হয়তো ধুলো পায়ে লগ্ন সারতে মাথায় সিঁদুর পরে ঘোমটা দিয়ে আবার হাতিয়াগড়েই ফিরে এসেছে, কে জানে!
হ্যাঁগো, এখানে ডিহিদারের দপ্তর কোন পাড়ায় গো?
আপনি কে?
কেমন যেন সন্দেহভরা দৃষ্টি দিয়ে লোকটা তার দিকে চেয়ে দেখলে। তার আসল উদ্দেশ্যটা লোকে জেনে গেছে নাকি! লোকটারও তাড়া ছিল। সেও আর দাঁড়াল না। তখনও বেশ বেলা রয়েছে। সোজা চলতে চলতে নদীর ঘাটে এসে দাঁড়াল। এইখানেই নেমেছিল সেদিন নৌকো থেকে। এইখানেই সেই সচ্চরিত্র ঘটকটা দাঁড়িয়ে ছিল। পুরনো সব কথাগুলো মনে পড়তে লাগল। সেদিন আর এ-দিনে কত তফাত। দূরেই মন্দিরটা দেখা যাচ্ছে। বশির মিঞা বলে দিয়েছিল বুড়ো শিবের মন্দির ওটা। ওরই পেছনে হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ি। কোথাকার কোন রাজার বউকে কোন একনবাবের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। চাকরির এও এক বিড়ম্বনা।
হঠাৎ দূরে যেন একটা ভিড় দেখা গেল।
ওইটেই তো তার সেই শ্বশুরবাড়ি। ওই বাড়িটার সামনেই তো সে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কত লোক উঠোনে খেতে বসেছিল। আজ আবার সেই বাড়িটার সামনেই ভিড়ে ভিড়। আজ আবার ওখানে কী হল।
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগিয়ে গেল কান্ত।
ভিড়ের ঠেলায় ভেতরে কিছু দেখা যায় না। হঠাৎ নজরে পড়ল তার সেই শ্বশুর। শোভারাম বিশ্বাস। চোখ দুটো ছলছল করছে। কাদোক্কাদো মুখ। কী হল আবার এ বাড়িতে! এখন মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এখন তো মুখে হাসি বেরোবার কথা!
হ্যাঁগো, এবাড়িতে কী হয়েছে?
চাষাভুষো লোক একজন। কেন, আপনি জানেন না? আপনি কোন গাঁয়ের লোক? হাতিয়াগড়ের সব লোক জেনে গেছে যে! কোন সরকার থেকে আসছেন আপনি? সাত-গাঁ, না বাজুহা?
আমি পরদেশি, কিছু বিপদআপদ হয়েছে বুঝি?
লোকটা বললে–ওই যে দেখছেন বুড়োপানা লোক, ওর মেয়ে পালিয়ে গিয়েছে, বিয়ের রাত্তিরে। বাসরঘর থেকে কিনে পালিয়ে গেছে!
মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল কান্তর! কোথায় পালিয়ে গেছে?
ভগমান জানে! তাই তো দুগ্যা হাত চালাচ্ছে–দেখছেন না?
দুগ্যা কে?
রাজবাড়ির ঝি দুগ্যা যে গুণ করতে জানে, নয়ানপিসি মাটিতে হাত পেতে আছে, ওই হাত চলতে আরম্ভ করবে
সত্যিই দুর্গা তখন বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে। পুবপাড়া, দক্ষিণপাড়া, তাঁতিপাড়া, কৈবর্তপাড়া, মুসলমানপাড়া–সব পাড়ার লোক হাত-চালা দেখতে এসেছে। উঠোন-দাওয়া-ঘর ভরে গেছে। দুর্গা একটা নতুন থান শাড়ি পরেছে। পুজো তখন সবে বুঝি আরম্ভ হচ্ছে। চালে হলুদে মেখে সাজালে পুজোর জায়গাটা। তারপর জিজ্ঞেস করলে কুলকাঠ কই, কুলকাঠ?
শোভারাম কুলকাঠ একগাছা এগিয়ে দিলে সামনের দিকে। সেই কুলকাঠে আগুন জ্বালানো হল। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল শুকনো কুলকাঠ।
তারপর দুর্গা সেই কুলকাঠের আগুনের ওপর একটু একটু করে চাল ছড়ায় আর মন্ত্র পড়ে
আচাল চাল ওচাল চালম, চালম গোরক্ষনাথ।
পাতালের বাসুকী চালম, চালম পিসির হাত।
নয়ানপিসি এতক্ষণ মাটির ওপর নিজের হাতের পাতাটা উপুড় করে রেখেছিল। দুর্গা গুনে গুনে একশো আটবার তার হাতের ওপর আরও কী সব মন্ত্র পড়তে লাগল। শেষে অবাক কাণ্ড! পিসির হাতখানা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল। উঠোন পেরিয়ে দাওয়ায় গিয়ে উঠল হাত। মানুষের ভিড়ও আস্তে আস্তে এগোতে লাগল। কান্তও এগোল। সামনের ভিড় সরে গেল। ভিড়ের ফাঁক দিয়ে নয়ানপিসিও চলতে লাগল হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে। আর পেছন পেছন দুর্গাও চলতে লাগল সঙ্গে সঙ্গে।
শোভারাম কেমন যেন তখনও বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করলে ও হরিপদ, মাকে আমার পাওয়া যাবে তো?
হরিপদ বললে–তুমি চুপ করো তো, দুগ্যা তোমার মরিকে নির্ঘাত বার করে দেবে–তুমি চুপ করে দেখোনা
নয়ানপিসির হাত দাওয়া ছাড়িয়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকল। ওই ঘরেই মরালীর বাসরঘর হয়েছিল বুঝি। তখনও বাসরঘরের বালিশ-বিছানা তেমনি পড়ে আছে। কেউ হাত দেয়নি।
শোভারামের বুকটা বুঝি ঢিপঢিপ করে উঠল।
কান্ত পাশের লোকটাকে আবার জিজ্ঞেস করলে–যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল, সে কোথায় গো? সে এখেনে আছে?
লোকটার এ কথার উত্তর দেবার সময় নেই তখন। সবাই তখন মজা দেখছে একমনে। কান্তও সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। জানালার আড়াল থেকে অনেক মেয়েমানুষ হাত-চালা দেখতে এসেছে। এখানে না এলে তো এ-খবর জানতেও পারত না কান্ত! তবে কি বর পছন্দ হয়নি। তবে কি আত্মঘাতী হল মনের দুঃখে!
কান্ত দেখলে, নয়ানপিসি বলে সেই বিধবা মেয়েমানুষটা হাত চালিয়ে যেতে যেতে একেবারে খিড়কির দিকের দরজার কাছে এসে আটকে গেছে।
দুর্গা চিৎকার করে উঠল-ইদু পিদু কুড়ি স্বাহা
আর নয়ানপিসি সঙ্গে সঙ্গে সেইখানেই দড়াম করে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। সঁতকপাটি লেগে গেল তার।
দুর্গা এবার শোভারামের দিকে চেয়ে বললে–মাথায় জল ঢালো নয়ান পিসির
কে একজন ঘড়া এনে জল ঢালতে লাগল নয়ান পিসির মাথায়।
শোভারাম ভয় পেয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে কী হল দুগ্যা? পেলে না?
দুর্গা বললে–মেয়েকে তোমার পাওয়া যাবে না শোভারাম
শোভারামের যেন তখন মাথায় বজ্রাঘাত হল। পাওয়া যাবে না?
ততক্ষণে দুর্গা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বললে–না
কোথায় গেল?
দুর্গা বললে–দেব-নর-গন্ধর্ব কারও সাধ্যি নেই জানতে পারে।
তবু শোভারামের সন্দেহ গেল না। জিজ্ঞেস করলে কেন?
দুর্গা বললে–তোমার মেয়ে পুষ্যানক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় খেয়েছে তার সন্ধান আর কেউ পাবে না
কথাটা শুনে শোভারাম হাউহাউ করে কেঁদে ফেললে। আশেপাশের লোকজনও এতক্ষণ শুনছিল। তাদেরও মন বুঝি ভারী হয়ে এল। শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় তাকে বাসরঘরে কে এনে দিতে গেল কে জানে। আর তখন যে পুষ্যানক্ষত্র ছিল তাই বা কার জানার কথা!
শোভারাম কেঁদে পড়ল। বললে–তুমি যেমন করে পারো আমার মেয়েকে বার করে দাও দুগ্যা
দুর্গা বললে–আমি তো আমি, আমার চোদ্দোপুরুষের সাধ্যি নেই তাকে খুঁজে বার করে–ছোটমশাই আজ রাত্তিরে বাড়ি নেই, আমার অনেক কাজ, আমি চলি–
একটা কিছু ব্যবস্থা করবে না দুগ্যা? আমার যে ওই এক মেয়ে
দেখি কী করতে পারি, পরে ভেবে বলব
বলে দুর্গা কোমর দুলিয়ে রাজবাড়ির দিকে হনহন করে চলে গেল
ওদিকে শিবনিবাসের প্রাসাদে গোপালবাবু তখনও উদ্ধব দাসকে নিয়ে মশকরা করছিল। বলছিল তা বউ তোমার পালাল কেন হে উদ্ধব দাস?
উদ্ধব দাস গান গেয়ে উঠল। হাত মুখ নেড়ে বললে–
কেন শ্যামা গো তোর পদতলে স্বামী।
তুই সতী হয়ে পতি-পরে করিলি বদনামী ॥
পাশের ঘর থেকে উদ্ধব দাসের গানের সুরটা কানে আসতেই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। তারপর চিঠি থেকে মুখ তুললেন।
ছোটমশাই অধীর হয়ে একটা কিছু উত্তর শোনবার প্রতীক্ষায় ছিলেন।
এবার বললেন–তা হলে আমি এখন কী করি বলুন আপনি?
একটা উপায় আছে।
কী উপায়? আমার যে আর সময় নেই। আজ নবাব আমার স্ত্রীর দিকে নজর দিয়েছে, কাল হয়তো আবার আর কারও স্ত্রীর দিকে নজর দেবে, তখন? তা ছাড়া, আমি হয়তো ফিরে গিয়েই দেখব। ডিহিদারের লোক এসে গেছে
কী করে জানলেন?
ছোটমশাই বললেন–মুর্শিদাবাদে মিরজাফর আলি সাহেবের কাছে শুনলাম, মেহেদি নেসার নাকি একজন হিন্দুকে ভার দিয়ে দিয়েছে তাকে আনবার জন্যে।
কেন, হিন্দুকে কেন?
মুসলমানদের যে মেহেদি নেসার বিশ্বাস করে না। দেখলেন না মিরজাফরকে তাড়িয়ে দিয়ে সেই জায়গায় দেওয়ান-ই-আলা করে দিলে মোহনলালকে
পাশের ঘরে তখন উদ্ধব দাসের গলা আবার শোনা গেল। উদ্ধব দাস বলছে এই হেঁয়ালিটার সমাধান করুন তো প্রভু
ব্যবসায় ছয়গুণ হয় যেই জন।
পুরুষ অপেক্ষা করে দ্বিগুণ ভোজন।
বুদ্ধিতে যে চারিগুণ অসত্য এ নয়।
রমণেতে আটগুণ জানহ নিশ্চয়
পুরুষ অপেক্ষা যারা এত গুণ ধরে।
তত্ৰাচ জগৎ তারে অবিশ্বাস করে ॥
বলুন তো প্রভু, কী?
ডিহিদার সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল। ডিহিদার রেজা আলি দোর্দণ্ডপ্রতাপ লোক। মেহেদি নেসার সাহেবের দূরসম্পর্কের রিস্তাদার। কোথায় কার টাকা হল, কে কারবার করে দুটো পয়সা উপার্জন করেছে, সেদিকে খবর রাখাই তার আসল কাজ। মেহেদি নেসার মেহেরবানি করলে একদিন রেজা। আলি ফৌজদার পর্যন্ত উঠতে পারে। কাগজে কলমে ফৌজদাররা দিল্লির বাদশার লোক হলেও, আসলে তো নবাবই সব। তারপর আল্লার দোয়া থাকে তো সুবাদার হতেও আটকাবে না। তখন এক-হাজারি থেকে দশ-হাজারি মনসবদারি পর্যন্ত সবকিছুই রেজা আলির মুঠোর মধ্যে। তখন নবাবও যা, রেজা আলিও তাই। তখন রেজা আলি চেহেল্-সুতুনে নবাবের সামনে গিয়ে কুর্নিশ করে কথা বলবে। তখনকার কথা ভেবেই রেজা আলি নিজের দফতরে বসে মৌচে তা দেয়। তখনকার কথা ভেবেই রেজা আলি নিজের ঘোড়াটার পিঠে সপাং করে চাবুক কষিয়ে দেয়। বলে জোর কদম ফিরিঙ্গি
রেজা আলি আদর করে নিজের ঘোড়ার নাম দিয়েছে ফিরিঙ্গি।
সেদিন সন্ধেবেলাও রেজা আলি নিজের এলাকায় টহল দিয়ে ফিরে এসেছে। ফিরে এসেই দফতরে একজন কাফেরকে দেখে জিজ্ঞেস করলে–তুমি কে? তুম কৌন?
কান্তর কাছে সবই ছিল। পরিচয় দেবার যা যা সরঞ্জাম, সমস্তই মনসুর আলি মেহের সাহেবের কাছ থেকে জুগিয়েছিল বশির মিঞা। একটা খও দিয়ে দিয়েছিল সঙ্গে। কিছু অসুবিধে হবার কথা নয়। নবাবি নিজামতে সব পাকা কাজ। রেজা আলি সমস্ত দেখলে, ঠিক আছে। মেহেদি নেসার সাহেব এত লোক থাকতে কেন একজন কাফেরকে পাঠিয়েছে, তাও বুঝতে পারলে। মেহেদি নেসার সাহেবের এই এক গলত। সব কাজে নিজের জাতভাইকে সন্দেহ করবে। কিন্তু রেজা আলির মনে হয়, কাফেরদের এত বিশ্বাস করা ভাল নয়। নবাব আলিবর্দি খাঁ সাহেবেরও এই দোষ ছিল। জগৎশেঠজিকে বড় বেশি বিশ্বাস করেছে। এখন? এখন সেই জগৎশেঠজি যে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে দহরমমহরম করছে, কারবার চালাচ্ছে!
ঠিক আছে, তুমি তৈরি থাকবে, আমার পালকি তৈরি আছে, বজরা আছে, ভোরাত্রেই কাম ফতে হয়ে যাবে!
কান্ত তো তৈরিই ছিল। নতুন করে আর কী তৈরি হবে। নবাবি-নোকরিতে যখন যেখানে পাঠাবে, সেখানেই যাবার জন্যে তৈরি হয়ে থাকতে হবে। আজ বলবে ইসলামাবাদ যাও, কালই হয়তো আবার জেলালগড়। আকবরনগরই হোক আর বক্সবন্দরই হোক, কিংবা দিল্লিই হোক, কান্ত সবসময়ই তৈরি।
সেই ডিহিদারের দফতরের একপাশেই সারাটা রাত একরকম জেগেই কাটল তার। শুয়ে শুয়েও কেবল মনে পড়তে লাগল সেই বিকেলবেলার ঘটনাটা। কোথায় গেল মেয়েটা। আর বিয়ের বাসর থেকে পালালই বা কেন? মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল নাকি? যার তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বলে রাগ করে পালিয়েছে? দেবনর-গন্ধর্ব কেউ টের পাবে না, এই-ই বা কেমন পালানো! পুষ্যানক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় খেলে কি কেউ খুঁজে পাবে না? কান্তরও যেন কেমন পালাতে ইচ্ছে করল। কেউ টের পাবে না, সে বেশ হবে! বেশ পেট চালানোর দায়িত্ব থেকে বেঁচে যাবে। সে এর থেকে অনেক ভাল। কোথাকার কোন রাজার রানি তাকে নিয়ে যাবার দুর্ভোগ থেকে তো অন্তত বাঁচবে।
মনে আছে, তখন অনেক রাত। শেষ রাতের তারাটা তখন ডিহিদারের দফতরের জানালা দিয়ে স্পষ্ট উঁকি মারছিল। একজন সেপাইয়ের ডাকে কান্ত ধড়মড় করে উঠে পড়ল।
ভাইয়া, উঠো উঠো, জলদি উঠো
রেজা আলির কাজ পাকা কাজ। সব বন্দোবস্ত করে রেখে তবে খবর দিয়েছে। দু’জন সেপাই, একটা বজরা নদীর ঘাটে তৈরি। সেই মাঝরাতেই কখন যে সব সেপাইরা রাজবাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছে, কখন। তারা তোড়জোড় করে সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে, কেউ টের পায়নি। হাতিয়াগড়ের প্রজা-পাঠকরা তখন সবাই সারাদিন খেত-খামারে খেটে ঘুমে অচৈতন্য। তারা জানতেও পারলে না, কোথায় কখন কার কলকাঠিতে অত বড় রাজবাড়ির সাতমহল থেকে কী রাহাজানি হয়ে গেল। যে-হাতিয়াগড়ের বড়মশাই একদিন খাজনা দিয়ে, নবাবের বিপদে-আপদে, অর্থ-ঐশ্বর্য-স্বার্থ দিয়ে বাংলায় নবাবি মসনদ কায়েম করে দিয়েছিল, তারই প্রাসাদ থেকে আর-এক নবাব তার লজ্জা-সম্মান-সম্ভ্রম সমস্ত অপহরণ করে নিয়ে গেল।
বুড়োশিবের মন্দিরের তলায় অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়াল কান্ত।
সেপাই দুটো সিংদরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। কান্তর দিকে চেয়ে বললে–আরে উধার কাহে, ইধার আও, ডরনা মাত
ডিহিদার রেজা আলি নিজে তখন সরকারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে ভেতরে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়েই দু’জনে কী কথা হচ্ছে ওদের। রেজা আলির ফিরিঙ্গি’দরজার সামনে দু-একবার পা ঠুকল। তার যেন আর দেরি সইছে না। সেও যেন অস্থির হয়ে উঠেছে মেহেদি নেসারের মতো। সেও যেন পা-কে বলছে–আর দেরি কোরো না-নবাবের শান্তির দরকার,নবাবের একটু মহফিলের দরকার। নবাব মসনদে বসে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার চারদিকে দুশমন। তাড়াতাড়ি তোমার রানিবিবিকে পাঠিয়ে দাও। নতুন মেয়েমানুষ দিয়ে তাকে আমরা ঠান্ডা রাখব। আমরা তাকে শান্তি দেব। মনসুর-উল-মুলক খেলাৎ মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা শা কুলি খান বাহাদুর খুশি থাকলে তবেই তো আমরা খুশি থাকব। আমরা খুশি থাকলে তবে তো বাংলা মুলুক খুশি থাকবে। বাংলা মুলুক খুশি থাকলে। দিল্লির বাদশা শাহানশাও খুশি থাকবে। তখন যত ইচ্ছে ফুর্তি করো, মহফিল করো, আমরা কাউকে কিছু বলব না।
সেই অন্ধকার রাতে রাজবাড়ির কোথায় বুঝি কোন কোণে একবার একটু চাপা মেয়েলি গলার শব্দ হল। একটা অস্ফুট আর্তনাদ। মহলে মহলে বুঝি একটা ত্রস্ত পদক্ষেপ। তারপর পালকিটা ঢুকে গেল সিংদরজার ভেতরের চবুতরে। একটা ফিসফিস শব্দ। অস্পষ্ট অনুচ্চারিত একটা দীর্ঘশ্বাস। কাউকে জানাবার দরকার নেই কী দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কাল সকালে বাড়ির ভেতরে বাইরে কেউ যেন টের না পায়। যেমন খাজাঞ্চিখানায় রোজ সকালবেলায় খাতক-প্রজা-পাইকের ভিড় থাকে, কালও তেমনই ভিড় থাকবে। রোজ সকালবেলা শোভারাম যেমন ছোটমশাইকে স্নান করাতে আসে, তেমনই আসবে। ছোটমশাইয়ের জলচৌকিটার ধারে দাঁড়িয়ে বুকে-পিঠে-পায়ে সরষের তেল মাখিয়ে দেবে। কাল সকালেও বিশু পরামানিক এসে খেউরি করে দিয়ে যাবে ছোটমশাইকে। কাল সকালেও বড় বউরানি সাজিতে করে ফুল সাজিয়ে বুড়োশিবের মন্দিরে পুজো করতে যাবেন গলায় আঁচল দিয়ে। কেউ জানবে না, কোথায় কখন কী ব্যতিক্রম হল। হাতিয়াগড়ের প্রজারা আজ মাঝরাত্রে যেমন ঘুমিয়ে আছে, কাল দিনের প্রখর সূর্যের আলোতেও তেমনি করেই ঘুমিয়ে থাকবে।
অন্ধকারের সুড়ঙ্গ বেয়ে দুটো আলতা-পরা পা আর জাহাঙ্গিরাবাদের জরি-পাড় শাড়ি দিয়ে মোড়া একটি যৌবন পালকির ভেতরে এসে ঢুকল আর পালকির দরজার দুটো পাল্লা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকারের সুড়ঙ্গ বেয়েই আবার সে-যৌবন বেহারাদের কাঁধে চড়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল আর এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে। সে-সুড়ঙ্গে পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্ম সব একাকার হয়ে গেছে। সে সুড়ঙ্গের ভেতরে ষড়যন্ত্র আর ষড়যন্ত্রণা নিঃশব্দ আর্তনাদ করে মাথা কুটে মরলেও কেউ প্রতিকার করবার নেই। সেখানেই তার ভূমি-সমাধি হয়ে যাবে চিরকালের মতো। তাকে আর কেউ চিনবে না, জানবে না। বাইরের পৃথিবীতে তার নাম-ধামকুল-গোত্র-পরিচয় চিরকালের মতো মুছে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
অন্ধকারে কেউ সেদিন শাঁখও বাজাল না, উলুও দিল না। একদিন যে এ-বাড়িতে বধূ হয়ে এসেছিল, অনেক আচার-অনুষ্ঠানের অনেক মাঙ্গলিক-মন্ত্রের অনুশাসন পালন করে, সে-ই আবার আজ নিঃশব্দে গোপনে সিংদরজা পেরিয়ে উলটোপথে বাড়ির বাইরে চলে গেল। তাকে বার করে দিয়েই, তাকে দূরে তাড়িয়ে দিয়েই যেন এই হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির পবিত্রতা সুনাম সম্মান বেঁচে গেল। তার ছোঁয়াচ থেকে এবাড়ির প্রত্যেকটা পাথর, প্রত্যেকটা ইট, প্রত্যেকটা প্রাণী যেন নিরুপদ্রব হল।
সেদিন সেই রাত্রের পঞ্চম প্রহরে কোথায় কোন গাছের কোটর থেকে একটা তক্ষক হঠাৎ কর্কশ স্বরে ডেকে রাত্রির স্তব্ধতাকে ভেঙেচুরে খানখান করে দিলে। আর সে-ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল শুধু বুঝি সেই নিস্তব্ধ রাত্রির একটা তক্ষক। আর কেউ নয়। আর যদি কেউ কিছু শুনে থাকো, কিছু দেখে থাকো, কিছু বুঝে থাকো তো সমস্ত ভুলে যাও। এ-ঘটনা যদি কখনও তোমার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয় তো সেদিন বুঝবে, তোমারও চরম সর্বনাশ। সেদিন তোমাকেও এ-পৃথিবী থেকে সেই অবধারিত সুড়ঙ্গের অন্ধকারে নির্বাসনদণ্ড ভোগ করতে হবে। তুমিও এই আজকের রানিবিবির মতো নাম-ধাম-গোত্র পরিচয়হীন হয়ে মুর্শিদাবাদের হারেমের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যাবে!
হঠাৎ যেন একটা শব্দে কান্ত চমকে উঠল।
চুপ করে খাড়া রইলে কেন বাবুজি, চলো, চলো
সেপাই দুটোর কথায় যেন এতক্ষণে ঘুম ভাঙল কান্তর। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই যেন এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল সে৷ তারপর স্বপ্নের ঘোরেই আবার সকলের পেছন পেছন চলতে লাগল। যেখানে বর্তমান মুহূর্ত ইহকালে গিয়ে মিশেছে, যেখানে আজকের বাস্তবতা আগামীকালের ইতিহাস হয়ে উঠেছে, সেইদিকে লক্ষ করেই যেন চলতে লাগল কান্ত। সেই বুড়োশিবের মন্দির পেরিয়ে ছোটমশাইয়ের তরকারির খেত, তার পাশ দিয়েই রাস্তা। সেই রাস্তা পেরিয়েই ছাতিমতলার ঢিবি। তারপর জায়গাটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে সোজা একেবারে নদীর ঘাটে। সেখানে ডিহিদারের বজরা দাঁড়িয়ে আছে। বজরার পাল খাঁটিয়ে মাঝিমাল্লারা তৈরি। রানিবিবি বজরায় উঠলেই তারা বদর-বদর বলে কাছি খুলে দেবে। আর ইতিহাসের পাখায় ভর করে হাতিয়াগড়ের যৌবন নিরুদ্দেশের দিকে উধাও হয়ে যাবে
একটু দাঁড়ান, শাড়িটা আটকে গেছে। ঘাট থেকে বজরায় ঠিকই উঠেছিল রানিবিবি। কিন্তু বজরায় উঠে ছই-ঢাকা ঘরের মধ্যে ঢুকতে গিয়েই জাহাঙ্গিরাবাদের শাড়ির জরির পাড়টা আটকে গেছে ছইয়ের বাঁশের খোঁচায়।
কান্ত তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে শাড়িটা খুলে দিলে। সেই অন্ধকারেও নজরে পড়ল সুগোল একটা টুকটুকে ফরসা পায়ের গোছ, আর সেই পায়ের পাতারই চারপাশ ঘিরে টাটকা আলতার রেখা।
রানিবিবি বোধহয় একটু লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল। লজ্জায় মাথার ঘোমটাটা আর একটু টেনে দিয়ে ভেতরে গিয়ে ঢুকে পড়ল। তারপর বজরা ছেড়ে দিলে।
এ-ঘটনার অনেকদিন পরে কান্ত যখন রানিবিবির জীবনের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের জালে আরও জড়িয়ে গিয়েছিল, তখন একদিন বলেছিল–জানো, সেদিন তোমার পা দেখে আমার খুব ভাল লেগেছিল
আমার পা?
কথাটা শুনে রানিবিবি প্রথমটায় অবাক হয়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ, তোমার পা। তোমার শাড়ির জরির পাড়টা বাঁশের খোঁচায় আটকে যেতেই আমি ধরে ফেলেছিলাম, নইলে দামি শাড়িটা সেদিন ছিঁড়ে যেত–
রানিবিবি বলেছিল–কিন্তু পা কখন দেখলে তুমি?
তখনই তো। তোমার শাড়িটা আটকে যেতেই খানিকটা পা বেরিয়ে পড়েছিল, নজরে পড়ল তোমার আলতা-পরা একটা পায়ের পাতা আর গোল পায়ের গোছ, সেদিন এত ভাল লেগেছিল যে কী বলব…
রানিবিবি বলেছিল–ছিঃ, ওকথা বলতে নেই–অমন করে বোলো না
কান্ত বলেছিল–বলতুম না, কিন্তু তখন তো জানতুম না তুমি কে, তোমার আসল পরিচয় কী! তখন জানতুম, হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকেই বুঝি নিয়ে চলেছি আমি! অথচ দেখো, তোমাকে নিয়ে যাবার ভার আর কারও ওপর পড়তেও তো পারত, তা না পড়ে কপালের দোষে আমার ওপরই বা সে-ভার পড়ল কেন?
তা কপালের দোষ বলছ কেন?
কপালের দোষ নয়? কপালের দোষ না থাকলে কেউ বিয়ে করতে গিয়ে দেরি করে ফেলে? কপালের দোষ না থাকলে কারও নিজের ঠিক করা বউয়ের সঙ্গে অন্য লোকের বিয়ে হয়ে যায়?
কপালের দোষ না থাকলে এত চাকরি থাকতে শেষকালে আমাকে এই চরের চাকরি করতে হয়? আর তা ছাড়া কপালের দোষ না থাকলে…
রানিবিবি বলেছিল–থাক, আর কপালের দোষ দিতে হবে না–আমি অত কপালটপাল মানিনে তোমার মতো!
কান্ত বলেছিল–তা মানবে কেন? তোমাকে তো আর ভুগতে হয়নি আমার মতো! আমার মতো কষ্ট পেলে তুমিও কপাল মানতে
রানিবিবি বলেছিল–কিন্তু মনে কষ্ট পুষে রেখে মুখে হাসি ফোঁটানো যে কত শক্ত তা যদি তুমি জানতে গো!
কান্ত তখন সাহস পেয়ে আরও কাছে ঘেঁষে বসেছিল। বলেছিল–সত্যি? তোমারও কষ্ট হয়? সত্যি বলল না, তোমারও কষ্ট হয় তা হলে আমার মতো?
রানিবিবি এবার যেন একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বলেছিল–না বাপু, তুমি একটু সরে বোসো, আমার ভয় করে, অত বাড়াবাড়ি ভাল নয়, শেষকালে তুমি দেখছি আমার গা ছুঁয়ে ফেলবে
ছুঁয়ে ফেললেই বা, তাতে কি খুব অন্যায় হবে?
রানিবিবি রেগে গিয়েছিল। বলেছিল–আবার ওইসব কথা? আমি বলেছি না ওসব কথা বললে–আর তোমাকে আমার কাছেই আসতে হবে না–
আচ্ছা আচ্ছা, এই আমি সরে বসলুম! কিন্তু আমি যে কিছুতেই ভুলতে পারি না।
কী ভুলতে পারো না?
কান্ত বলেছিল–সেদিনের সেই তোমাকে বজরায় করে নিয়ে আসার মুখে তোমার সেই শাড়ির পাড় আটকে যাওয়া, আর সেই তোমার শাড়িটা খুলে দিতে গিয়ে তোমার সেই পা…
আবার?
বলে রানিবিবি খপ করে কান্তর মুখখানা নিজের নরম হাত দিয়ে চাপা দিয়ে দিয়েছে।
রেগে গিয়ে বললে–বলেছি না, ওসব আমার শুনতে ভাল লাগে না, ওসব কথা আমাকে বলতে নেই, ওসব কথা আমার শোনাও পাপ
কিন্তু কান্ত যেন তখন নিজের শরীরের মধ্যেই হঠাৎ নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। রানিবিবি তার মুখটা ছেড়ে দেওয়ার পরও যেন অনেকক্ষণ অভিভূত হয়ে পড়েছিল। তারপর একটু জ্ঞান ফিরে পেয়েই বলেছিল–এই তো তুমি আমার গা ছুঁলে মরালী, আর আমি তোমাকে ছুঁলেই যত দোষ? আমি ছুঁলেই তুমি অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
তা তুমি এই সহজ কথাটাও কেন বোঝে না যে আমার সিঁথিতে সিঁদুর রয়েছে, আমি পরের বউ?
তা এই এখানেও কি তুমি পরের বউ? এই নবাবের হারেমের মধ্যে? এই মদ, জুয়া, জাল, জোচ্চুরি, রেষারেষি আর বেলেল্লাগিরির মধ্যেও তুমি কি মনে করো তুমি পরের বউ হয়ে নিজেকে বাঁচাতে পারছ?
খবরদার বলছি, মুখ সামলে কথা বলো!
কান্ত আর পারেনি। চিৎকার করে বলে ফেলেছিল কিন্তু সেই-ই যদি বাসরঘর ছেড়ে পালালে তো আর একটু আগে পালাতে পারলে না তুমি? সম্প্রদান হবার আগে পালাতে পারলে না? লগ্ন বয়ে গেলে কি এর চেয়েও বেশি সর্বনাশ হত? তা হলে কি তোমাকেই আজ সিথির সিঁদুর নিয়ে এই পাপপুরীর মধ্যে আসতে হত, না ভদ্রঘরের ছেলে হয়ে আমাকেই এই নবাবের চরের কাজ করে টাকা রোজগার করতে হত, বলো?
কথাটা যে কত চেঁচিয়ে বলেছিল কান্ত তা তার খেয়াল ছিল না। হারেমের দেয়ালের ইটগুলোরও যে এক একটা করে কান আছে, তাই বোধহয় ভুলে গিয়েছিল সে। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে। নবাব আলিবর্দি খাঁ পর্যন্ত যত খুন, যত অত্যাচার, যত পাপ, যত কলঙ্ক জমা হয়ে ছিল মাটির তলায়, সেই সমস্ত দিয়েই যেন ইট তৈরি করে, সেই ইট দিয়ে গেঁথে গেঁথে তৈরি হয়েছিল এই চেহেল্-সুতুন। প্রত্যেকটা অলিন্দে অলিন্দে, প্রত্যেকটা কোটরে কোটরে, প্রত্যেকটা প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে, প্রত্যেকটা গবাক্ষে গবাক্ষে কান্তর সেদিনকার হাহাকার যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে বারবার নিজের ভাগ্যের রাজয়ের
প্রতিশোধ নিজের হাতেই নিতে চেয়েছিল। আর শব্দটা কানে যেতেই ওদিক থেকে দৌড়ে এসেছিল পিরালি খাঁ। পিরালি খাঁ খোজা সর্দার। ঘরের ভেতরে ঢুকেই…
কিন্তু সে কথা এখন থাক। পরের কথা পরে বলাই তো ভাল।
সেই অন্ধকারে দক্ষিণের হাওয়ায় বজরায় পাল তুলে দিয়ে তখন মাঝিমাল্লারাও তন্দ্রায় ঢুলছে। মাথার ওপর চিরকালের একঘেয়ে আকাশটা রোজকার মতো তারাফুল ফুটিয়ে নির্জীব নিঃসাড় হয়ে আছে। সেপাই দুটো বন্দুক নিয়ে সামনেই ঘুমে অজ্ঞান অচৈতন্য। ছই-ঢাকা ঘরটার মধ্যে রানিবিবিও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কে জানে! হয়তো কেন, নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে। সেদিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই একটুকু! শুধু কান্ত একলা আকাশ-পাতাল তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। সেইখানে সেই বজরার গলুইতে হেলান দিয়ে বসে বসে নিজের সমস্তটা জীবন পরিক্রমা করছে বারবার। এ কেমন চাকরি তার। এ কেমন পেশা! কাকে ধরে নিয়ে চলেছে সে! কার সম্পত্তি কার হাতে তুলে দেবে। কেন তুলে দেবে? ছটা টাকার জন্যে? ছটা টাকার এত দাম? ছ’টা টাকার দাম দিয়ে সে আর একজন পুরুষের শান্তি হরণ করবে? আর একজনের অভিশাপ বরণ করবে? আর একজনের সর্বনাশ করে সে তার নিজের খোরাকি রোজগার করবে? কত কথা তার মনে পড়েছিল সেদিন। এক-একবার কল্পনা করতেও ইচ্ছে হচ্ছিল রানিবিবির মুখখানা। জাহাঙ্গিরাবাদের জরি-পাড় শাড়ির ঘোমটা দিয়ে ঢাকা ছিল সর্বাঙ্গ। শুধু দৈবাৎ একটা পায়ের একটুখানি অংশ নজরে পড়েছিল। তাও এক মুহূর্তের জন্যে। কিন্তু মনে পড়তেই ভাবনাটা মন থেকে দূর করে দিয়েছিল। এ অন্যায়, এ পাপ! রানিবিবির কথা ভাবাও পাপ। চাকরির জন্যে এ-পাপের যতটুকু অংশীদার হবার দায় তার, তার বেশি দায়িত্ব তার নেই। তার চেয়ে যেন বেশি সে কিছু না ভাবে। মুর্শিদাবাদের নবাবের যা সাজে, কান্তর তা সাজে না।
বাবুজি, হুশিয়ার!
চমকে উঠেছে কান্ত! বুড়ো মাঝিটা এতক্ষণ ঢুলছিল। এবার বুঝি সজাগ হয়েছে। কেন? হুঁশিয়ার কেন?
বাবুজি, দাঁড়ের ঝপঝপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন না! বদরগঞ্জের কাছে এসেছি, এটা ডাকাতের আচ্ছা!
কান্ত মাঝির নির্দেশ লক্ষ করে দূরের দিকে চেয়ে দেখলে। অনেক অনেক দূরে অন্ধকারের বুক চিরে যেন একটা আলোর বিন্দুর মতো কী দেখা গেল। একেবারে নদীর বুক বরাবর। আলোটা যেন ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে।
সেপাই দুটো তখনও ঘুমোচ্ছে।
কান্ত বললে–ওদের ডেকে দেব? ওদের কাছে বন্দুক আছে
কিন্তু ডাকতে হল না। তারা নিজের থেকেই উঠে পড়ল। এ যেন তারা জানত। বদরগঞ্জে অনেকবার ডাকাতি হয়েছে। অনেকবার ডাকাতদের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি সওয়াল করতে হয়েছে। তারা উঠেই বন্দুক তাগ করে তৈরি হয়ে রইল। ঈড় ফেলার ঝপঝপ শব্দ ক্রমেই আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে। যেন তাড়াতাড়ি ঝড়ের গতিতে কাছে এগিয়ে আসতে চাইছে।
কান্তর কেমন ভয় করতে লাগল। যদি সত্যিই ডাকাত পড়ে, তা হলে রানিবিবির কী হবে! রানিবিবি হয়তো কিছুই টের পাচ্ছে না, অঘোরে ঘুমোচ্ছে!
কান্ত ছইয়ের দরজার কাছে গিয়ে ডাকতে লাগল–শুনছেন–
ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ এল না। হয়তো শুনতে পায়নি। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে একলা রয়েছে।
কান্ত এবার দরজায় টোকা দিতে লাগল–শুনছেন–শুনছেন–আমি কান্ত-শুনছেন—
মুর্শিদাবাদে তখনও মতিঝিল থেকে মির্জা ফেরেনি। রাত শেষ হয়ে আসছে। চেহেল্-সুতুনের অন্দরমহলে সব আলো নিভে গেছে। কিন্তু নানিবেগমের ঘরে তখনও একটা আলো জ্বলছে টিমটিম করে।
বাইরে থেকে ডাক এল–বেগমসাহেবা
সন্ধে থেকেই নানিবেগমের খারাপ লাগছিল। লুৎফাও ঘুমোতে পারে না, নানিবেগমও ঘুমোতে পারে না। চেহেল্-সুতুনের ভেতরে একবার এলে ঘুম না-হওয়া যেন রোগে দাঁড়ায়। ছোট্ট রোগা রোগা মেয়েটা। তার দিকে চাইলেই নানিবেগমের বুকটা হুহু করে ওঠে। এমন বউ যেন এখানে মানায় না। নানিবেগম বউকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মাঝে মাঝে। যখনই সব পুরনো কথা মনে পড়ে যায়, তখন আর কাউকে ভাল লাগে না। নিজের পেটের মেয়েরাও তখন যেন বিষ হয়ে ওঠে নানিবেগমের চোখে। মেয়ে নয়তো, সব কাটা। এক-একটা কাটা হয়ে সব নানিবেগমের বুকে ফুটে আছে। তোরা সব মানুষ না কী? তোদের মান-ইজ্জৎ-সম্মান-মর্যাদা কিছু নেই? তবুনানিবেগমের যদি নিজের ছেলে থাকত তো আজ ভাবনা! সারা জীবনটাই তো নানিবেগমের কেটে গেছে আলিবর্দি সাহেবের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে। একটা দিনের জন্যে নানিবেগম মনে শান্তি পায়নি। চেহেল্-সুতুনের মধ্যে রাতের পর রাত কেটে যায় সেই সব পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে। পাশে কেউ বিশেষ থাকে না। শুধু লুৎফা কাছে আসে। কাছে। এসে বসে আর কাঁদে।
নানিবেগম বলে-তুই কেন কাঁদিস মা, কেন আমার পেছন পেছন ঘুরিস?
মেয়েটা কথাও বলে না বেশি, কথা বললেই যেন সে কেঁদে ভাসিয়ে দেবে। এখানেই একদিন নাচতে এসেছিল এই মেয়ে এই মুর্শিদাবাদে। সেই মেয়ে যে তার নাতবউ হবে তা-ই বা কে ভেবেছিল।
নানি বলত–দেখলি তো এখন নবাবি হারেমে কত সুখ! আমারও এক এক সময় মনে হয় মা, বোধহয় মুর্শিদাবাদের গরিব প্রজার ঘরে জন্মালে এর চেয়ে অনেক সুখ পেতাম
লুৎফা সব শোনে। শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে নানির বুকে মাথা গুঁজে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে।
হারেমের ওপাশে যখন সারেঙ্গি বাজে, ঘুঙুর বাজে, সরাবের হা চলে, পেশমন বেগম, দুলহান বেগম, বব্বু বেগম সবাই মিলে যখন পাশা খেলে ঘুটি খেলে রাত কাবার করে দেয়, তখন নানিবেগমের ঘরের ভেতরে দুটি প্রাণী শুধু প্রহর গোনে। কখন মির্জা আসবে তার তো ঠিক নেই। গদিতে বসবার পর থেকেই ইয়ারবকশিরা নাতিকে আরও ঘিরে রেখে দিয়েছে। নানিবেগমের সঙ্গে দেখা করবারই সময় হয় না তার। একবার যদিই বা আসে, একটুখানির জন্যে এসেই আবার চলে যায়। বলে আমি আবার আসব নানি
কিন্তু, কী নিয়ে আবার এত ব্যস্ত তুই? তুই কি একদণ্ড শান্তিতে ঘুমোতে পারবিনে?
মির্জা বলে কিন্তু সবাই মিলে যে আমার দুশমনি করছে নানি, আমি কী করব?
তা তোর নানার কি দুশমন ছিল না? তোর নানা আমার সঙ্গে দেখা করবার ফুরসুত পেত কী করে?
মির্জা বলত–সে জমানা আর নেই নানি, তোমার মেয়েরাই আমার সবচেয়ে বড় দুশমন! নিজের ঘরের মধ্যে যার দুশমন, তার শান্তি কী করে হবে? আমার যে ঘরে-বাইরে দুশমন!
কথা বলে আর দাঁড়াত না মির্জা। আবার কোথায় বেরিয়ে চলে যেত।
আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লুৎফা সব শুনত। এক ফোঁটা মেয়েটা পাতলা লিকলিকে চেহারা, তাকে দেখতে পেয়েই নানিবেগম বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরত। কিছু ভাবিসনে মা, নবাবের বিবি হলে সুখ হতে নেই। নবাবের বেগমদের ওপর খোদাতালার অভিশাপ আছে। সাজাহানাবাদের বেগমদেরও সুখ হয়নি জীবনে। আকবর বাদশা, জাহাঙ্গির বাদশা, শাহজাহান বাদশা, ঔরঙ্গজেব বাদশা–সকলের বেগমেই কেঁদে কেঁদে কাটাতে হয়েছে
বেগমসাহেবা!
বাঁদি এসে বললে–মেহেদি নেসার সাহেব সেলাম ভেজিয়েছেন
ডাক এখেনে, ডেকে আন।
মেহেদি নেসারকে আজ ডেকে পাঠিয়েছিল নানিবেগম। ডেকে না পাঠালেও মেহেদি নেসার সাহেব নানিবেগমকে সেলাম জানিয়ে যায় মাঝে মাঝে। নবাবের নানি, তাকে হাতে রাখা ভাল। এসে বলে বন্দেগি বেগমসাহেবা
এসব বিনয়ের ব্যাপারে মেহেদি নেসারের আবার জুড়ি নেই। কোনও কাজ থাকলেও মেহেদি নেসার আসে, আবার না থাকলেও আসে। এসে বলে গোস্তাকি মাফি হয় বেগমসাহেবা। আমি বেগমসাহেবার খিদমদগার। বান্দাকে একটু দোয়া করবেন হুজুরাইন। নানান ভাষায়, নানান কায়দায় সেলাম জানাতে মেহেদি নেসার ওস্তাদ! ঘরের ভেতরে রদার আড়ালে নানিবেগম থাকে আর বাইরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে কথা বলে। মাঝখানে দরওয়াজার মধ্যে থাকে নানিবেগমের খাস বাঁদি আর খোজা সর্দার পিরালি খাঁ। দু’তরফের কথা সেই বলে শোনায়।
জিজ্ঞেস করো মেহেদি নেসার সাহেবকে, কী দরকার।
পিরালি বলে–বেগমসাহেবা জিজ্ঞেস করছেন আপনার কী দরকার–
মেহেদি নেসার মাথা নিচু করে বলে বলল, দরকার আমার কিছু নেই, শুধু রোজার দিনে বেগমসাহেবার দোয়া নিতে এলাম। বেগমসাহেবার দোয়া না পেলে তো আমি রোজা ভাঙতে পারি না–
তারপর সেই নানিবেগমের দোয়া পাবার পর মেহেদি নেসার সেই মেঝের শ্বেত পাথরের ওপরেই নিজের নাক চুঁইয়ে কুর্নিশ করতে করতে চলে যায়।
এক-একদিন নানিবেগম বলত–মির্জাকে তোমরা একটু শোধরাতে পারো না বাবা, দিনরাত এত মদ খেলে তবিয়ত টিকবে কী করে, দেমাক যে বরবাদ হয়ে যাবে। বয়েস তো বেশি নয়–
মেহেদি নেসার বলত–না বেগমসাহেবা, আমরা তো বোঝাই তাই ওকে! আমরা তো বলি এখন আপনি মুর্শিদাবাদের নবাব জাঁহাপনা, এখন কি আর আগের মতো ছেলেমানুষি করা পোয়! আমরা তো ওকে বারবার সেই কথাই বলি
আমার ওই একটি নাতি বাবা, তোমরা ওর ইয়ার, তোমরা যদি ওকে না দেখো তো কে দেখবে? আমার সঙ্গে তো দেখাই হয় না মির্জার, আমার কথা শোনেই না, তোমাদের সঙ্গে মেশে, তোমাদের কথা শুনেই ও চলে। তোমরা একটু সৎ পরামর্শ দিয়ে বাবা ওকে–
তাই তো দিই বেগমসাহেবা! আমরা ওকে কোরান পড়তে বলি–ও তো নানার সামনে বাত দিয়েছিল সরাব আর খাবে না, সরাব তো আর ছোয়ও না ও। আমরা বলেছি ওকে–কোরান পড়লে দেমাক ঠিক হয়ে যাবে। এই দেখুন না বেগমসাহেবা, আমার কাছেই তো কোরান রয়েছে।
বলে নিজের জোব্বার জেব থেকে কোরানটা বার করে দেখালে। বললে–এই আজকেও ওকে কোরান পড়িয়েছি বেগমসাহেবা, এই জায়গাটা অনেক বার করে পড়িয়েছি–লা এলাহি এল আল্লা মহম্মদ রসুল আল্লা…
তারপর যাবার সময় বলত–তা হলে বান্দা এবার আসছে বেগমসাহেবা—
আচ্ছা, যাও বাবা তুমি, যাও ।
এমনি করেই মেহেদি নেসার এখানে বহুদিন এসেছে, বহুবার বেগমসাহেবার দোয়া নিয়ে চলে গেছে। এবার শেষ রাত্রের দিকে হঠাৎ ডাক পেয়ে মেহেদি নেসার সত্যিই তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল। এমন অসময়ে তো নানিবেগম কখনও মেহেদি নেসারকে এত্তেলা দেয় না।
আমাকে ডেকেছিলেন বেগমসাহেবা?
নানিবেগম ভেতর থেকে উত্তর দিলে হ্যাঁ, শুনছি আবার নাকি কোন জমিদারের বউকে মতিঝিলে আনবার ব্যবস্থা করেছ তোমরা?
মেহেদি নেসার বাইরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
শুনছি, আমাদের হাতিয়াগড় সরকারের জমিদারের দোসরা তরফের রানিবিবিকে আনবার জন্যে এখান থেকে ডিহিদারকে পরওয়ানা পাঠাতে বলা হয়েছে। নাকি লোকও চলে গেছে আনতে? এটা কি সত্যি? জবাব দিচ্ছ না কেন, উত্তর দাও
সেকী? হাতিয়াগড়ের রানিবিবি?
হ্যাঁ! তাকে এনে তোমরা আমার নাতির মাথা খাবে বলে মতলব করেছ! একজন হিন্দুকে পাঠিয়েছ তাকে আনতে! মির্জার মন ভোলাবার জন্যে তোমরা সবাই মিলে পরামর্শ করে এই কাজ করেছ! ভেবো না আমি হারেমের ভেতরে থাকি বলে আমার কানে কোনও খবর পৌঁছোয় না। তোমরা তার ইয়ার হয়ে কোথায় সৎ পরামর্শ দেবে, না এইসব করে নবাববংশ ছারখার করে দিতে চাও? তোমরা কি চাও মুর্শিদাবাদের গদি আবার অন্য কারও হাতে চলে যাক? আমি তার নানি, আমি বেঁচে থাকতে থাকতেই তোমরা আমার এই সর্বনাশ করে যাবে?
মেহেদি নেসারকে এবার বড় শক্ত পালা অভিনয় করতে হল।
বললে–আমি আপনার বান্দা বেগমসাহেবা, এসব আপনি কী বলছেন আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে আনব আমি?
তুমি নয়, তোমার দলবল! ও একই কথা! এমনি করে একদিন সরফরাজের নবাবি গিয়েছে, আমার নাতির নবাবিও তোমরা এমনি করে খোয়াতে চাও? চারদিকে যখন সবাই আমার নাতির বিরুদ্ধে, তখন তোমরাও আমার নাতিকে পথে বসাবে? আর আমাকে বেঁচে থেকে সেই সর্বনাশ দেখে যেতে হবে এই-ই তোমরা চাও!
মেহেদি নেসার হঠাৎ কোরান ছুঁয়ে বললে–এই কোরান ছুঁয়ে বলছি বেগমসাহেবা, আমি এর কিছুই জানি না। আমি আপনাদের নিমক খেয়ে আপনাদেরই নিমকহারামি করব, এ কখনও হতে পারে?
তা হলে আমি যা শুনেছি, সব মিথ্যে!
ডাহা মিথ্যে কথা বেগমসাহেবা! জলজ্যান্ত মিথ্যে কথা! কে এসব আপনাকে বলেছে? আমাদের তো দুশমন আছে চারদিকে, তারাই হয়তো আপনাকে এইসব বলে গিয়েছে।
নানিবেগম বললে–না, আমার কাছে খত আছে, আমার কাছে চিঠি আছে, তাতেই সব লেখা আছে—
কার চিঠি? কে লিখেছে বেগমসাহেবা? নাম কী তার?
হাতিয়াগড়ের বড়রানি! বেচারা কোনও উপায় না পেয়ে আমাকে চিঠি দিয়েছে।
দেখি বেগমসাহেবা, চিঠিখানা দেখি। চিঠিখানা জাল কিনা দেখি!
না, এ-চিঠি তোমরা পাবে না। এ যদি সত্যি হয় তো সেদিন তোমাকে এর জবাবদিহি করতে হবে মনে রেখো। একদিন এমনি করে ওই পেশমন বেগমকে এনেছ এখানে, গুলসন বেগমকে এনেছ, তক্কি বেগমকে এনেছ, নুর বেগম, জিন্নত বেগম, আরও একগাদা বেগমকে এনেছ আবার আর একটা বেগমকে আনতে চাও? আবার আর একজনের সর্বনাশ করতে চাও? এততেও তোমাদের আশ মেটেনি? আমার মির্জাকে না খুন করে কি…
মেহেদি নেসার বললে–নবাবদের তো বেগম থাকেই বেগমসাহেবা, সে তো নতুন কিছু নয়। নবাব সরফরাজ খাঁর পনেরোশো বেগম ছিল কিন্তু আমাদের কেন দায়ী করছেন তার জন্যে বেগমসাহেবা!
হঠাৎ কথা শেষ হবার আগেই দূর থেকে খোজা বরকত আলির ঘোষণা শোনা গেল–নবাব মনসুর-উল-মুস্ক শা কুলি খান বাহাদুর মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা হেবৎ জঙ আলমগির-র-র-র-র…
কথাটা কানে যেতেই লুৎফুন্নিসা নানিবেগমের কোল থেকে উঠে নিজের মহলের দিকে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
ওই মির্জা আসছে, ওকেই আমি চিঠিটা দেখাচ্ছি, তুমি এখন যাও বাবা এখান থেকে যাও তুমি
মেহেদি নেসার আ-ভূমি মাথা ঠেকিয়ে ঠিক আগেকার মতোই কুর্নিশ করতে করতে পেছনে হটে অন্য দিক দিয়ে চলে গেল। চলে গিয়ে যেন বাঁচল সে। হাতিয়াগড়ের বউরানি খত্ লিখেছে? এত বড় বেড়েছে কাফেরের বাঁদি?
শুনছেন! শুনছেন!
তখন সকাল হয়ে গেছে বেশ! বদরগঞ্জ পেরিয়ে মিরপুরে এসে ডিহিদারের বজরা থামবে। সেখানেই সব ব্যবস্থা করা আছে। পুরনো সেপাই ছেড়ে দিয়ে নতুন দু’জন সেপাই এসে উঠবে। রানিবিবির দরজা তখনও খোলেনি। দরজায় ঠেলা দিতেও সংকোচ হতে লাগল। রাত্তিরে একফোঁটা ঘুম হয়নি কান্তর। অথচ রানিবিবিকে ডাকতেই হবে। কত দরকার থাকতে পারে। মিরপুরের ঘাটে এখানকার ডিহিদারের লোক খাবারের ব্যবস্থা করবে।
শুনছেন! আমি কান্ত। শুনছেন!
সত্যিই রাত্তিরে বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিল কান্ত। ডাকাতি হয় বদরগঞ্জে এটা জানা কথা। বদরগঞ্জে অনেকবার অনেক বজরা লুঠপাট করে নিয়েছে তারা। আলোটা কাছে আসতেই সেপাই দুটো বন্দুক তাক করে রেখেছিল। নৌকোটা কাছে আসতেই সেদিকের মাঝিরা হাঁক দিলে-কার বজরা?
কান্তদের বুড়ো মাঝি হাঁক দিলে ডিহিদারের তোমরা?
হাতিয়াগড় সরকার।
কথা বলতে বলতেই নৌকোটা তিরের গতিতে এগিয়ে চলে গেল। আটজন মাঝি প্রাণপণে বজরা নিয়ে দাঁড় ফেলতে ফেলতে যাচ্ছে! যাক, তখন যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল কান্ত। কিন্তু হাতিয়াগড়ের জমিদার যদি জানতে পারতেন, এবজরাতেই তার রানিবিবি আছে।
শুনছেন! শুনছেন!
মাঝিটা বললে–হুই মিরপুরের বাঁধাঘাট দেখা যাচ্ছে–হুই যে
এতক্ষণে দরজাটা খোলবার একটা শব্দ হল–খুট!
দরজার সামান্য একটু ফঁক দিয়ে দেখা গেল সেই শাড়িটা। রাত্রের সেই জরিপাড় জাহাঙ্গিরাবাদের শাড়ির আঁচলটা।
কান্ত সেই আড়াল থেকে দাঁড়িয়েই বললে–আমরা মিরপুরে এসে গেছি, এখানে আমরা নৌকো বাঁধব। আপনার জলটল কিছু দরকার থাকলে আমাকে বলতে পারেন। আমি নিজে হিন্দু, আপনার কিছু ভয় করবার নেই–আমার নাম কান্ত সরকার
আর ওদিকে হাতিয়াগড়ের রাজবাড়িতে তখন সবে ভোর হয়েছে। বড় বউরানির দরজায় টোকা পড়তেই বড় বউরানি উঠে পড়েছেন।
একী, তুমি? তুমি কখন এলে?
এই তো এখন! মহারাজকে সব বলে এলাম। আর কোনও ভাবনা নেই। মহারাজ এবার নিজে এর সমস্ত ভার নিলেন। আমাকে বললেন–আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন রায়মশায়, মিরজাফর যখন আমাদের দলে আছে, তখন আমি এর একটা বিহিত করবই
তবু বড় বউরানি কোনও কথা বললেন না।
মহারাজ আজই মহিমাপুরে গিয়ে জগৎশেঠের সঙ্গে দেখা করবেন বললেন, তারপর সেখান থেকে কালীঘাটে পুজো দেবার নাম করে হলওয়েল সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন, উমিচাঁদের সঙ্গে দেখা করবেন, ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে একটা পাকা বন্দোবস্ত করে আর ফিরবেন না আমাকে কথা দিলেন।
তারপর বড় বউরানির মুখের দিকে চেয়ে বললেন–কী, তুমি কিছু কথা বলছ না যে?
বড় বউরানি তবু কিছু কথা বললেন না।
কী হল তোমার, শরীর খারাপ? না, আমার কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না! কথা বলো, অমন চুপ করে রইলে কেন? ছোটবউ কোথায়? ছোটবউ কেমন আছে? আমি তো মহারাজের সঙ্গে মহিমাপুরেই যাচ্ছিলুম, কিন্তু তোমাদের একা ফেলে গেছি ভেবে তাড়াতাড়ি চলে এলুম। ডিহিদারের লোক আর এসেছিল নাকি?
এতক্ষণে বড় বউরানির মুখ দিয়ে কথা বেরুল। বললে–হ্যাঁ!
তারপর? কী বলে গেল? কোনও হিন্দু এসেছিল সঙ্গে? তুমি কী বললে?
বড় বউরানি যেন পাথর হয়ে গেছে। পাথরের মতো শুকনো গলায় বললে–আমি ছোটবউকে খুন করে ফেলেছি।
চেহেল্-সুতুনের ভেতর রাত্রির যে-চেহারা, হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির রাতের চেহারা সেরকম নয়। মুর্শিদাবাদের হারেমে যখন রাত তখন বাংলাদেশের সমস্ত ষড়যন্ত্র সেখানে সজাগ হয়ে ওঠে। জাহাঙ্গিরাবাদ থেকে যেদিন মুর্শিদকুলি খাঁ মুর্শিদাবাদে এসে রাজধানী বসালেন সেইদিন থেকেই সেখানে দিন রাত একাকার হয়ে গেল। ভোরবেলা যখন ইনসাফ মিঞা নহবতে ভৈরোর তান ধরে, তার অনেক আগে থেকেই সকলে জেগে ওঠে। কবর থেকে উঠে আসে নবাববাদশাদের কঙ্কাল। তারা একে একে এসে আবার এখানে পদচারণা শুরু করে। এ-মহল থেকে ও-মহলে যায়। তারপর আর-এক মহলে। এক একটা দৃশ্য দেখে আর মুখ ফিরিয়ে নেয় আতঙ্কে। বহু যুগ আগে মোগলদের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আমরা যা-কিছু শুরু করেছিলাম, এখনও ঠিক তাই। মদের গেলাস মেঝের ওপর গড়াগড়ি চলেছে আর তারই পাশে নেশায় অসাড় হয়ে পড়ে আছে পেশমন বেগম। তার গায়ের ওড়নি আর কোমরের ঘাগরা বেসামাল। আলো নিভোতে ভুলে গেছে তার ইরানি বাঁদি।
হঠাৎ স্বপ্নের ঘোরেই কেউ বা হেসে ওঠে খিলখিল করে। কেউ বা আবার কেঁদে ওঠে। হাসিকান্নার পান্না-মুক্তোর ঝলসানি লেগে ছাদের ঝাড়লণ্ঠনগুলো পর্যন্ত যেন লজ্জা পায়। খোজা সর্দার পিরালি এক-একদিন নিজেই তদারক করতে বেরোয়। কার ঘরে কে ঢুকেছে, কে জেগে আছে, কে ঘুমায়নি, কে হাসছে, কে কাঁদছে, সব দেখে বেড়ায়। কারও ঘাগরাটা পরিয়ে দিয়ে বলে। বেগমসাহেবা, রাত হয়েছে, দরওয়াজা বন্ধ করে দিন
আবার কারও ঘরে যেতেই সেতারের তার ছিঁড়ে বাজনা বন্ধ হয়ে যায়।
নিদ নেই বেগমসাহেবা?
সারাদিন সারারাত অবসর যেখানে, সেখানে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ কী! ঘুমোবার জন্যে তো আল্লা রাত পয়দা করেনি। রাত তো ফুর্তি করবার জন্যে। দুনিয়ার মালিক যাদের অটুট যৌবন দিয়েছে, অফুরন্ত অবসর দিয়েছে, তাদের ঘুমোবার দরকার কী! কিন্তু তবু পিরালি খাঁ-কে সমীহ করে চলতে হয় সকলের। কার কখন কী দরকার পড়ে কে বলতে পারে। পিরালিই তো চেহেল্-সুতুনের জাগ্রত আল্লা!
পিরালির যারা শাগরেদ তারা বেগমসাহেবাদের কাছ থেকে মোহর নেয়, টাকা নেয়, তার বদলে তাদের অনেক বেআইনি কাজ করে দেয়। বাইরের লোককে সুড়ঙ্গ দিয়ে লুকিয়ে ভেতরে আনতে হবে, তাতে বেশি কিছু করতে হবে না। বরকত আলি কি নজর মহম্মদের বাঁহাতে একটা কিছু গুঁজে দিলেই চলবে। সঙ্গে সঙ্গে রাত গম্ভীর হয়ে আসবার পরই ঘরের ভেতর এসে হাজির হবে মুর্শিদাবাদের নতুন কোনও উঠতি জওয়ান। সারারাত এ চেহেলসূতুনে কাটিয়ে আবার ভোর হবার আগেই সে নিঃশব্দে সুড়ঙ্গ পথে বাইরে চলে যাবে। হারেমের টিকটিকি আরশোলা কিংবা মাছিটা পর্যন্ত তা টের পাবে না। এখানে যত কড়াকড়ি তত ফসকা গেরো। এখানে বসে যদি কেউ বাইরের জগতের সঙ্গে কারবার করতে চায় তো তাতেও কিছু আটকাবে না। এখানে বসেই বেগমসাহেবারা পূর্ণিয়া থেকে সোরা কিনবে, গন্ধক কিনবে, এখান থেকেই সেই কেনার টাকা যাবে। আবার সেই সোরা সেই গন্ধক কলকাতায় বেভারিজ সাহেবের গদিতে বিক্রি হয়ে যাবে। সেই বিক্রির টাকা আবার যথাস্থান দিয়ে বেগমসাহেবার হাতে এসে পৌঁছোবে। নবাবের বাবারও সাধ্যি নেই তা টের পায়। এখান থেকে টাকা যায় জগৎশেঠজির বাড়িতে সুদে খাটাবার জন্যে, এখান থেকে হিরে-মুক্তো-পান্নার গয়না যায় শেঠবাড়িতে বন্ধক রাখবার জন্যে। সেই বন্ধকি মাল আবার ছাড়ান পেয়ে চলে আসবে সকলের চোখের আড়ালে। জানলে শুধু জানবে পিরালি কি বরকত আলি কিনজর মহম্মদ, কি তাদের মধ্যে কয়েকজন।
কিন্তু সেই পিরালিই যখন আবার নানিবেগমের মহলে আসে তখন সে অন্য মানুষ। তখন তাকে দেখলে আর চেনা যায় না। যদি দেখে নানিবেগম কোরান পড়ছে, সকলকে গিয়ে সাবধান করে দেয়। বলে চিল্লাও মাত, চিল্লাও মাত, চিল্লাচিল্লি কোরো না কেউ
ওমহলের সারেঙ্গির শব্দ এ-মহলে এলে গিয়ে জোর করে থামিয়ে দেয়। বলে আভি বন্ধ কিজিয়ে, বেগমসাহেবা কোরান পড়ছে।
বিধবা হবার পর থেকেই নানিবেগমের যেন কোরান পড়ার হিড়িক পড়ে গেছে। সারাজীবন নবাবের সঙ্গে কাটিয়ে এসে এখন এই বয়েসে চেহেল্-সুতুনের দুরবস্থা দেখে কোনও প্রতিকার করতে পারে না। নিজের মেয়েরা কী করে, কী ভাবে জীবন কাটায় সব জানতে পারে। জেনেও যখন তার কথা কেউ শোনে না, তখন বোধহয় খোদাতালার দরবারে নিজের আর্জি পেশ করে মনটার মধ্যে শান্তি খোঁজে।
পিরালি বুড়ো হয়ে গেছে এসব দেখতে দেখতে। কিন্তু তার কাছে কোরানও যা, মোহরও তাই। তাকে একটা মোহর দাও সে তোমাকে যা চাইবে তাই-ই দেবে। আবার কোরান ছুঁয়েও যদি প্রতিজ্ঞা করে যে তোমার কথা কাউকে বলবেনা, একটা মোহর পেলে আবার সেই কথাই সে পাচার করে দেবে তোমার দুশমনের কাছে।
নানিবেগম বলত–মেহেরুন্নিসার মহলটা দেখছিস তো ভাল করে?
দেখছি বেগমসাহেবা, কড়া নজর রাখছি!
শুধু কড়া নজর রাখা নয়, মির্জার হুকুম ছিল ঘসেটি বেগমের সঙ্গে কেউ যেন মুলাকাত না করে। সে যে-মহলে আছে সেখানে যেন জনপ্রাণীটি না যেতে পারে।
কেউ আসে না তো তার মহলে?
না, বেগমসাহেবা!
দেখিস, নইলে মির্জা বড় গোঁসা করবে।
না বেগমসাহেবা, আমি কোরান ছুঁয়ে বলতে পারি কেউ আসে না সেখানে।
হুঁ, দেখিস, খুব হুঁশিয়ার।
কিন্তু যখন অনেক রাত হয় তখন রাজা রাজবল্লভ কতদিন পিরালির হাতে মোহর গুঁজে দিয়ে ঘসেটি বেগমের ঘরে ঢুকেছে। দিনের পর দিন এক ঘরে বসে এক ডিবেতে পান খেয়েছে, এক গড়গড়ায় তামাকু খেয়েছে, তারপর যখন নেশা হয়েছে এক বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি দিয়েছে। তবু কেউ জানতে পারেনি। মোহরের এমনই মোহ যে পিরালি মহলের দরজায় জেঁকের মতো বসে বসে পাহারা দিয়েছে।
কিন্তু মেহেদি নেসারের কথা আলাদা। তাকে মোহর দিতে হয় না। মেহেদি নেসার চেহেল্-সুতুনে এলেই পিরালি খাঁ সসম্ভ্রমে তাকে আদাব দেয়। বলে-বন্দেগি জনাব
মেহেদি নেসার সেদিন আবার এল। এসেই পিরালিকে ডাকলে।
একটা কাজ করতে পারবে পিরালি?
বান্দা জনাবের কোন কাজ করেনি?
না পিরালি, আগেকার জমানার কথা গুলি মারো, এখন জমানা বদলে গিয়েছে। কেউ যেন জানতে পারে, নানিবেগমও যেন টের না পায়–
বলুন জনাব, কেউ জানতে পারবে না। জান থাকতে বান্দা কাউকে বলবে না, বলেন তো কোরান ছুঁয়ে জবান দিতে পারি
না না, তোমাকে আমি চিনি, কোরান ছুঁতে হবে না, একজন রানিবিবি আসবে চেহেল্-সুতুনে, তোমার কোনও নতুন মহল খালি আছে?
পিরালি বললে–জনাব, ক’টা খালি মহল বলুন না, ক’টা রানিবিবি আনবেন?
ক’টা নয়, একটা। কাফের রানিবিবি
পিরালি বললে–কাফের হোক আর মুসলমান হোক, আমার কাছে জনাব সব বিলকুল সমান–বান্দা তামাম দুনিয়ার নোকর
কোন মহলটা দেবে তাকে?
কেন জনাব, কাশিমবাজার কোঠির মেমসাহেবদের যে-মহলে রেখেছিলাম, সেই মহলে রাখব। ওয়াট মেমসাহেব, কলেট মেমসাহেব সবাই তো ওই মহলেই ছিল জনাব–। মহলটার পেছন দিয়ে গুপ্তি সড়ক আছে, বাইরে যাবার
কিন্তু একটা বাত আছে, নানিবেগমসাহেবা যেন টের না পায়।
পিরালি এবার জবাব দিতে দেরি করলে। নানিবেগমের কাছ থেকে খবর লুকিয়ে রাখা একটু শক্ত। সব দিকেই যেন নানিবেগমের কড়া নজর। নানিবেগম যে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খবর জেনে নিতে চায়। কোথায় কে রাত্রে কার ঘরে গিয়ে কী ষড়যন্ত্র করছে, কার কীসের কষ্ট, কার কী অসুখ, কী দুঃখ, কে হারেমের ভেতরে লুকিয়ে লুকিয়ে কোম্পানির সাহেবদের সঙ্গে কারবার করছে, জগৎশেঠজির কাছ থেকে হুন্ডি কাটছে, সব নানিবেগমের নখদর্পণে। কোরান নিয়ে পড়লে কী হবে, সমস্ত চেহে সুতুনটা যেন নানিবেগমের সংসার। কে বেশি মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে আছে, কে গোসা করে উপোস করছে, কে রোজার দিন লুকিয়ে-ছাপিয়ে কী খাচ্ছে, তারও খবর চাই নানিবেগমের!
কিন্তু এ-খবর যদি নানিবেগমসাহেবা জানতে পারে তো তোমার নোকরি থাকবে না পিরালি।
জনাব খোদাবন্দ, বান্দা তো নবাবের নিমক খায়, নিমকহারামি কী করে করবে জনাব?
তা রানিবিবি তো নবাবের খেদমতের জন্যেই আসছে, তুমি যেমন নবাবের খিদমদগার, বেগমরাও তো খিদমদগার ছাড়া আর কিছু নয়!
তা তো বটেই হুজুর। নবাবের খেদমতি করতেই তো বেগমদের পয়দা হয়েছে। খোজাদেরও পয়দা হয়েছে।
তা হলে সেই কথাই রইল!
পিরালি জিজ্ঞেস করলে রানিবিবি কবে নাগাইদ আসবে হুজুর?
আর দু-তিন রোজের মধ্যেই এসে যাবে। হাতিয়াগড় থেকে আসতে তার বেশি সময় লাগবে না, তারা সেখান থেকে রওয়ানা করে দিয়েছে। আমি খবর পেয়ে গিয়েছি ডিহিদারের কাছ থেকে–।
তা হলে জনাব এক কাজ করুন। কাফের বিবি তো? মসজিদের ইমাম সাহেবকে দিয়ে শুরুতেই কলমা পড়িয়ে আগে মুসলমান বানিয়ে নিন। নাম ভি বদলে দিন–নাম দিয়ে দিন মরিয়ম বেগম
শোহনআল্লা! তোমার তো খুব বুদ্ধি পিরালি
তা না থাকলে এতদিন বান্দার ঘাড়ের ওপর শিরটা আছে কেমন করে জনাব?
তা হলে নানিবেগম যদি জিজ্ঞেস করে, ও কে, কোথা থেকে এল? তুমি কী জবাব দেবে পিরালি?
আমি বলব ও মরিয়ম বেগম, লস্করপুরের তালুকদার কাশিম আলির লেড়কি, বেগম বনবার জন্যে নবাবের কাছে দরবার করেছিল
বহুত আচ্ছা, তা হলে এক কাম করো…
কথাগুলো ফিসফিস করেই হচ্ছিল, হঠাৎ দেয়ালের ওপাশে যেন কার গলার আওয়াজ শোনা গেল–উধার কৌন? পিরালি?
জি বেগমসাহেবা!
একেবারে খাস নানিবেগম! কিন্তু ততক্ষণে মেহেদি নেসার জাফরির থামের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে। নানিবেগমসাহেবা সারা রাতই হয়তো কোরান পড়ে কাটিয়েছে। তারপর মসজিদে গিয়েছিল নমাজ করতে। এখন ফিরছে।
কার সঙ্গে বাতচিত করছিলে পিরালি?
বরকত আলির সঙ্গে বেগমসাহেবা। আজকে রাত-পাহারা ছিল বরকত আলির, বেতমিজটা ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই বকাবকি করছিলুম। কেউ পাহারায় গাফিলতি করলে মেজাজ শরিফ থাকে?
মনে হল নানিবেগম যেন খুশ হল কথাটা শুনে।
আমার মেহেরুন্নিসা শরবত খেয়েছে? গোঁসা কেটেছে মেয়ের?
খেয়েছেন বেগমসাহেবা। বড্ড গোঁসা হয়েছিল, আমি বুঝিয়ে-সুজিয়ে খাইয়ে এসেছি। এখন আরামসে ঘুমোচ্ছেন দেখে এসেছি–আপনি কিছু ভাববেন না বেগমসাহেবা।
আর পেশমন? সেই ছোঁড়াটা আসে না তো আর পেশমনের কাছে?
তাকে তো কোতল করা হয়ে গেছে বেগমসাহেব! বাঘের বাচ্চাকে কি জিন্দা রাখতে আছে?
তারপর আরও অনেক খবর নিলে নানিবেগম। গোসলমহলে পানি ঠিক আছে কিনা, তকিবেগমের তবিয়ত কেমন আছে, আমিনার গয়না খোয়া গিয়েছিল সেটা সে পেয়েছে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক খবর। তারপর খুশি হয়ে নামিবেগম চলে গেল। আস্তে আস্তে ভোর হচ্ছে। চেহেল্-সুতুনের বাইরে যখন ভোর হয় তখনও এর ভেতরে গভীর রাত, সেই সময়েই নহবতখানার ওপর থেকে ইনসাফ মিঞা ভৈরবীর তান ধরে নহবতেএকেবারে উদারার কোমল রেখাব থেকে মোচড় দিতে দিতে কোমল। গান্ধার ছুঁয়েই আবার নেমে যায় উদারার সুরে। তারপর আস্তে আস্তে মুদারার কোমল ধৈবতটা একটুখানি ছুঁয়ে এসেই জমে যায় কোমল গান্ধারে। এইরকম করতে করতে ভোর হয়। গঙ্গার ওপারে কাশিমবাজারের দিক থেকে সূর্যের আলোটা ঠিকরে এসে পড়ে চেহেলসূতুনের মিনারের চূড়ায়। তখন নানিবেগমের কোরান পড়া শেষ হয়ে গিয়েছে। তখন আড়মোড়া খেয়ে ঘুম ভাঙে চেহেলসুতুনের।
মেহেদি নেসার বাইরে আসতেই খাস-দরবারের কাছেই নেয়ামত দৌড়োত দৌড়োত এসেছে।
হুজুর, নবাব এত্তেলা দিয়েছে।
সেকী! মেহেদি নেসার অবাক হয়ে গেছে। এত সকালেই মির্জা মতিঝিলে পৌঁছে গেছে?
নবাব একলা, মা আর কেউ আছে?
হুজুর, সফিউল্লা সাহেব আছে, ইয়ারজান সাহেব আছে, মোহনলালজি আছে, মিরমদন সাহেব ভি আছে
নেয়ামত মতিঝিলের খিদমদগার। সে সবাইকে চেনে। কিন্তু এত সকালে তো মির্জার আসার কথা নয়। চল, চল, জলদি চল। মির্জার তলব মানে যে খোদাতালার তলব!
জনাব, আর একটা বাত, মিরবকশিকে যখন নবাব তলব দিয়েছে, তখন মালুম হচ্ছে শায়েদ লড়াই হবে।
লড়াই? মেহেদি নেসার ফুঃ শব্দ করলে মুখ দিয়ে। লড়াই হবে কী রে! এখন সবে হাতিয়াগড়ের রানিববিকে এনে মরিয়ম বেগম বানাচ্ছি, এখন লড়াই করতেই দেব না মির্জাকে। এখন লড়াই করবার ফুরসত কোথায়?
বলে বাইরে দাঁড়ানো পালকির ভেতর উঠে বসল মেহেদি নেসার। বললে–জলদি হাঁকা—
ছোটমশাই আসার খবর পেয়েই বিশু পরামানিক এসে সকাল থেকে বসে ছিল। এখানকার ভোর হওয়ারও একটা রীতি আছে। সে মুর্শিদাবাদের চেহেল-সূতুনের ভোর হওয়া নয়। এখানে সমস্ত শান্ত। বড় পুকুরঘাটের ওপর আমগাছটার ছায়া আস্তে আস্তে হেলে যায় পশ্চিমদিকে। খোলা মাঠময় রোদ ছড়িয়ে পড়ে রাজবাড়ির ছাদে, দরদালানে, খাজাঞ্চিখানায়, কাছারিবাড়িতে, অতিথিশালার উঠোনে, আর পুকুরঘাটের পাথর-বাঁধানো পইঠের ওপর। বিশু পরামানিক বড়মশাইকে খেউরি করবার জন্যেও ঠিক ওইখানে এসে বরাবর বসে থাকত। তারপর গোকুলকে দেখলেই জিজ্ঞেস করত–ও গোকুল, বড়মশাই উঠেছেন নাকি?
তারপর আসত শোভারাম। গোকুল সরষের তেলের পাথরবাটি এনে দিত। গামছা, তেল, দাঁতন জোগান নিয়ে শোভারামের অপেক্ষা করে থাকাই কাজ।
খবর এসে গিয়েছিল ছোটমশাই শেষরাত্রের দিকে বাড়ি ফিরেছেন। দু’জনে বসে আছে তো বসেই আছে ঠায়।
বিশু পরামানিক জিজ্ঞেস করে-কী গো শোভারাম, তোমার মেয়ের কিছু হদিশ পেলে?
একথা শুনে শুনে আর একথার জবাব দিয়ে দিয়ে মুখ পচে গেছে শোভারামের। তবু মানুষের যেখানটায় ব্যথা সেইখানেই ঘা দেওয়া যেন মানুষের স্বভাব। কেন বাপু, অন্য কথা বললেই হয়। আর কি কোনও কথা নেই?
যেকদিন ছোটমশাই ছিলেন না সেকদিন বিশু পরামানিকেরও এখানে আসতে হয়নি, শোভারামকেও আসতে হয়নি। কোনও ঝঞ্জাটই ছিল না কোথাও। শোভারাম নিজের ঘরের মধ্যে খিল এঁটে পড়ে থাকত। সেই মরালী পালিয়ে যাবার পর থেকেই এমনি। শুধু আর একদিন গিয়েছিল দুর্গার কাছে। দুর্গা বলেছিল–না বাপু, মেয়েকে তোমার পাওয়া যাবে না শোভারাম, ও দেবের অসাধ্যি
শোভারাম বলেছিল–তা জলজ্যান্ত মেয়েটা তো আর আকাশে উড়ে যেতে পারে না তাই বলে?
দুর্গা বলেছিল–কেন পারবে না, তুমি বলো না, তোমাকেই আমি আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছি বকভৈরবী মন্তর পড়ে-মন্তরের ওপর তোমার অত অচ্ছেদ্দা বলেই মেয়ে তোমার পালিয়ে গেছে, তা জানো
তা হলে মন্তর পড়েই আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দে দুগ্যা–আমি যে একদণ্ড সুস্থির থাকতে পারছিনে।
এইরকম করেই বলত রোজ শোভারাম। আর ঠিক তার পরেই সেই কাণ্ড ঘটল। ছোট বউরানির সঙ্গে পাশা খেলতে খেলতে হঠাৎ বড় বউরানি একেবারে পালঙের তলা থেকে হাতেনাতে ধরে ফেললে মরালীকে!
এ কে? কে এখেনে?
ছোট বউরানি তখন বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছে। বললে–ওর সঙ্গে আমি পাশা খেলছিলুম বড়দি
বড় বউরানি ধমক দিয়ে উঠল–ওলো, তা আমি দেখতে পাচ্ছি, আমি এখনও চোখের মাথা খাইনি, কিন্তু কে এ?
দুর্গা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। বললে–ওকে কিছু বোলোনা বড় বউরানি, আমি ওকে নিয়ে এইচি এখেনে, ও বড় দুঃখী!
তবু সেই এক কথা! আমি জিজ্ঞেস করছি, এ কে, তার জবাব দিবি তো?
দুর্গা তখন বড় বউরানির পা দুটো জড়িয়ে ধরেছে। বললে–তুমি কাউকে বলতে পারবে না বউ বউরানি, ও আমাদের শোভারামের মেয়ে, বিয়ের সময় বর পছন্দ হয়নি বলে পোড়ারমুখি আত্মঘাতী হতে যাচ্ছিল, আমিই ওকে এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছি, ও-বেচারির কোনও দোষ নেই–ওর কোনও দোষ নেই
তা ওর বাপ যদি টের পায়?
শোভারামকে আমি বলেছি তার মেয়েকে আর পাওয়া যাবে না, পুষ্যানক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় খেয়ে হাওয়ায় উড়ে গেছে
রাখ তোর বুজরুকি! ধমক দিয়ে উঠল বড় বউরানি।
বুজরুকি নয়, বড় বউরানি, পুষ্যা নক্ষত্রে শ্বেতজয়ন্তীর শেকড় খেলে সত্যি সত্যি উড়ে যায়—
থাম তুই! ওর বর কোথায়?
বরের কাছে ও যাবে না, বর আসতে দেরি হয়েছিল বলে আমাদের অতিথশালা থেকে একটা পাগলা-ছাগলা মানুষের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছে ওর বাপ এখন বাপের কাছে পাঠালেই ওর বাপ সেই পাগলা বরের কাছে পাঠিয়ে দেবে
বড় বউরানি কী যেন ভাবলে খানিকক্ষণ। একবার ছোট বউয়ের দিকে তাকালে, আর একবার মরালীর দিকে তাকালে। তারপর বললে–এ যে এ বাড়িতে লুকিয়ে আছে তা কেউ জানে?
না বড় বউরানি, মা কালির দিব্যি, বলছি কেউ জানে না। আমি জানি আর ছোট বউরানি জানে!
ওর নাম কী?
মরালী। ছোটমশাই ওই নাম রেখেছিলেন ওর
তারপর একটু থেমে বড় বউরানি বললেন–তা হলে ওকে তুই আমার মহলে পাঠিয়ে দে, তোকে আসতে হবে না–ও একলা আমার ঘরে আসুক–
বলে বড় বউরানি চলে গেলেন। চলে যেতেই মরালী বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বলেছিল–কী হবে দুগ্যাদি?
কী আর হবে! কচুপোড়া হবে। আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ তোর ভয় কী?
আমাকে যদি বরের কাছে পাঠিয়ে দেয়?
ওমনি পাঠিয়ে দিলেই হল? আমি উচাটন করব না? তোর কোনও ভয় নেই, তুই যা—
মরালী তবু নড়ে না। বললে–কিন্তু আমার বড় ভয় করছে যে দুগ্যাদি—
তবে আয়, উচাটন করে দিই
বলে মরালীকে হাত ধরে কাছে টেনে আনলে। বললে–তোর মাথার একগাছা চুল দেখি—
মরালী দুর্গার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। দুর্গা তার মাথা থেকে একগাছা চুল ছিঁড়ে নিয়ে তাতে কী সব মন্ত্র পড়তে লাগল। ওঁ নমো ভগবতে রুদ্রায় দংষ্ট্রাকরালায় উদ্ধব দাসৈঃ হনহন দহদহ পচপচ উচ্চাটায় উচ্চাটায় হুঁ ফট স্বাহা ঠং ঠঃ। মন্ত্রটা অনেকবার বলতে লাগল বিড়বিড় করে। তারপর সেই একগাছ চুল পুঁটলি পাকিয়ে তার ওপর একদলা থুতু দিয়ে মাথার খোঁপার মধ্যে বেঁধে দিলে।
বললে–যাঃ, উচাটন করে দিলাম। যে তোর ক্ষেতি করতে যাবে তার সব্বোনাশ নিঘ্যাত যাঃ, চলে যা, কিচ্ছু ভয় নেই–আমি উচাটন করে দিয়েছি, আর কীসের ভয় তোর–
বলে ঠেলে ঠেলে নিয়ে গেল বড় বউরানির মহলের দিকে। ঘরের ভেতর যেতেই বড় বউরানি ঘরের দরজায় খিল লাগিয়ে দিয়েছে।
তারপর যখন সন্ধে হয়ে এসেছে, পুজোবাড়িতে কাঁসর-ঘণ্টা বেজে উঠেছে, তখনও ছোট বউরানির ভয় যায়নি। তখনও ঘর থেকে বেরোয় না কেউ। দুর্গাও ছিল। ছোট বউরানির জলখাবার এনে দিলে। ছোট বউরানিকে খাইয়ে দাইয়ে রোজকার মতো পা ধুইয়ে আলতা পরিয়ে চুল বেঁধে দিলে, তখনও বড়। বউরানির মহল থেকে কোনও সাড়া শব্দ নেই।
ছোট বউরানি জিজ্ঞেস করলে কী হল রে দুগ্যা, মেয়েটাকে খুন করে ফেললে নাকি বড়দি?
খেপেছ তুমি? আমি উচাটন করে দিয়েছিনা। দেখো তুমি, মরি’র কোনও ক্ষতি কেউ করতে পারবে না —
এতক্ষণ ধরে কী করছে ঘরের দরজা বন্ধ করে? যদি ওকে ওর বাপের কাছে পাঠিয়ে দেয়? তুই একবার গিয়ে দেখে আয় না
দুর্গা যাচ্ছিল, কিন্তু ওদিক থেকে তরঙ্গিনীও আসছিল এদিকে। তরঙ্গিনী বললে–ছোট বউরানিকে একবার ডেকে দে তো দুগ্যা–ডাকছে বড় বউরানি
সেখানেই সেই দিন সেই বন্ধ ঘরের মধ্যে বাংলাদেশের সেই মেয়ে এক অমোঘ প্রতিজ্ঞা করে বসল! এর চেয়ে যে সে-মৃত্যু অনেক ভাল। মৃত্যুর মধ্যেও তো ছোট মৃত্যু আর মহৎ মৃত্যু আছে। যে মৃত্যু মহৎ তার কাছে জীবন তত তুচ্ছ। যে-জীবন শুধু খাওয়া-পরা সাজাগোজার নামান্তর, সে জীবন তো মরালীর কাছে বিড়ম্বনা। মৃত্যুই তো সে কামনা করেছিল, বিষ খেয়েই তো সে জীবনকে আত্মসাৎ করতে চেয়েছিল। তার চেয়ে এ যে অনেক বেশি ভাল হল। যখন একবার ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি, তখন সসাগরা পৃথিবীই তো আমার ঘর। আমি ওই অনন্তদিদি আর রাধারানিদিদির মতো সংসার করতে যে চাইনি। চাইনি বলেই তো পালিয়ে এসেছিলাম এখানে। এখানেও আমি এমন থাকতে পারতুম না। একদিন আমাকে এখান থেকেও বেরোতে হত, এখান থেকেও পালাতে হত। একদিন আমি এই হাতিয়াগড়ের ছাতিমতলায় ঢিবির ওপর ছুটোছুটি করে খেলে বেড়িয়েছি, এখন না হয় পৃথিবীর ঢিবিটার ওপরেই খেলে বেড়াব। ওরা আমাকে মদ খাওয়াবে? ওরা আমার গায়ে হাত দেবে? আমাকে গোরুর মাংস খাওয়াবে? খাওয়াক না, ওরা তো তাতে আর আমাকে পাবে না, পাবে আর একজনকে, সে-মেয়েটা যতই কলমা পড়ুক, তাতে আমি তো আমিই থেকে যাব। তবু তো মনে মনে জানব আমি আর একজনকে বাঁচিয়েছি। আর একজনের সুখের কারণ হয়েছি। একদিন বেহুলা যেমন করে তার স্বামীর শব নিয়ে মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিল, আমি না হয় আমার শবটা নিয়ে তেমনি করে মহাজীবন পাড়ি দেব! যদি নিজের এই শবদেহটাকে বেহুলার মতো কোনওদিন বাঁচিয়ে তুলতে পারি, সেদিন তো তবু আমার শব-সাধনা সার্থক হবে!
তা হলে আমার কাছে কথা দে, প্রাণ গেলেও কারও কাছে নিজের নাম বলবিনে?
মরালী বললে–এই তোমার পা ছুঁয়ে দিব্যি গালছি বড় বউরানি, প্রাণ গেলেও আমি তোমাদের কাউকে দায়ী করব না, এই তোমার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে দিব্যি গালছি
তারপর ছোট বউরানির দিকে চেয়ে বড় বউরানি জিজ্ঞেস করলেন–আর তুই?
মরালী বললে–কাক-পক্ষীতেও জানতে পারবে না বড় বউরানি আমি মরালী, সবাই জানবে আমি হাতিয়াগড়ের ছোট বউরানি–
আর ও? ওই মুখপুড়ি?
ছোট বউরানি তখন আঁচলে চোখ ঢেকে কাঁদছে। দুর্গা বললে–ছোট বউরানিকে আমি দেখব, ছোট বউরানিকে আমি লুকিয়ে রাখব মন্তর পড়ে–তুমি কিছু ভেবো না বড় বউরানি
আবার তোর ওই বুজরুকি?
বিশ্বাস করো বড় বউরানি। ছোট বউরানির গায়ে কারও আঁচড় লাগবে না–আমি উচাটন করব
কিন্তু তার আগে ছোটমশাই এলে কী বলব তাই বল–ছোটমশাই হয়তো আজই এসে যাবেন–
তুমি বোলো ছোট বউরানিকে তুমি খুন করে ফেলেছ
তার মানে?
তুমি তাই-ই বলো না, তারপর আমি তো আছি
যদি জিজ্ঞেস করেন লাশ কোথায় গেল?
বোলো নদীতে লাশ ভাসিয়ে দিয়েছ!
বড় বউরানি রেগে গেল–তা মাথা-মুন্ডু যাহোক একটা কিছু বললেই হল? নবাব টের পাবে না? নবাবের শাগরেদরা যদি কাউকে বলে দেয়?
নবাবের হারেমে একবার গেলে কি আর তাকে কাক-পক্ষীতে দেখতে পায় বউরানি! তখন কি আর তার নামধাম কোথাও লেখা থাকে? তখন যে তার কুলুজি পর্যন্ত ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় তখন কি আর কেউ জানতে পারবে যে ও হাতিয়াগড়ের না লস্করপুরের, কোথাকার?
কিন্তু ছোটমশাইকে ছেড়ে ও-মুখপুড়ি থাকতে পারবে? ও যে একদিন এক বিছানায় শুতে না পারলে হাঁসফাস করে–
তা কিছুদিন একটু কষ্ট করুক না বউরানি, প্রাণের চেয়ে সে তবু তো ভাল।
কী রে, তুই ছোটমশাইকে ছেড়ে থাকতে পারবি মুখপুড়ি?
মুখপুড়ি তখন চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছে।
দুর্গা বললে–সে তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও বড় বউরানি, আমি সামলে রাখব সব–এ-ছাড়া তো আর গতিই নেই–
তারপর সেই রাজবাড়িতে রাত আরও গম্ভীর হয়ে এল। আমগাছটার কোটরে তক্ষক সাপটা কয়েকবার কটকটকটাস করে ডেকে উঠল। তারপর রাত যখন আরও গম্ভীর হল, রাজবাড়ির সদর মহলে ডিহিদারের লোক এল পালকি নিয়ে। বড় বউরানি দুর্গাকে ডাকলেন নিঃশব্দে। দুর্গাও ঘুমোয়নি। ছোট বউরানিকে ডেকে আস্তে আস্তে সিঁড়ির নীচের ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় চাবি বন্ধ করে দিয়ে এল।
ছোট বউরানি একবার শুধু জিজ্ঞেস করলে আমি এখানে কী করে থাকব দুগ্যা
তুমি থাকো না ছোট বউরানি, আমি তো আছি, আমি থাকতে তোমার ভাবনাটা কী!
কিন্তু কতদিন থাকতে হবে?
দুর্গা বললে–দেখো না, আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি, তুমি যেন আবার কথাটথা বোলো না, ডিহিদারের সেপাইরা চলে যাক, তখন আমি আবার আসব–
ছোটমশাই যদি আজ এসে আমাকে খোঁজে?
দুর্গা রেগে গেল। বললে–তা হলে তুমি চলো, তোমাকেই আমি ডিহিদারের পালকিতে তুলে দিয়ে আসছি
না না, তুই রাগ করছিস কেন দুগ্যা? আমি কি তাই বলেছি?
তা একটা রাত আর আলাদা কাটাতে পারবে না তুমি? তোমার ভালর জন্যেই তো এসব করছি গো!
ছোট বউরানি বললে–যদি ওই মেয়েটা ধরা পড়ে?
ধরা পড়বে কেন? তার জন্যে তো আমি দায়িক আছি। আমি তো উচাটন করে দিয়েছি ওকে, দেখলে না ওর মাথার চুল ছিঁড়ে থুতু দিয়ে মন্তর পড়ে দিয়েছি। দেবনর-গন্ধর্ব কেউ ওর কিছু করতে পারবে
তা আমাকেও তাই কর না-তুই! আমিও বেঁচে যাই তা হলে?
দুর্গা বললে–তা আমি যা বলব, তাই করবে তুমি?
তাই করব রে, তাই করব। তুই আমাকে বাঁচা!
দুর্গা বললে–তা হলে তুমি একটু বোসো, আমি মরালীকে পালকিতে তুলে দিয়ে আসি
তারপর সেই অন্ধকারের আড়ালে জাহাঙ্গিরাবাদের জরিপাড় শাড়ি-ঢাকা একটি যৌবন এসে পালকিতে উঠল। কে উঠল, কেন উঠল, তা কেউ জানল না। মাধব ঢালির পাহারা দেওয়া কাজ; সে শুধু জানল ভেতরবাড়ির রানিমহল থেকে কেউ উঠে চলে গেল। কে গেল, কেন গেল তা প্রশ্ন করা পাহারাদারের কাজ নয়। রাজা-রানির ব্যাপারে মাথা ঘামানো তার কাজ নয়। দুর্গা যখন নিজে এসেছে, তখন কৌতূহল প্রকাশ করা তার এক্তিয়ারের বাইরে।
আর ঠিক তার কিছুক্ষণ পরেই আবার ছোটমশাই এসে হাজির।
গোকুলকে দেখেই ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছিল মাধব ঢালি। সিংদরজাটা ফাঁক করে পাশে দাঁড়িয়ে সেলাম করলে।
সরে দাঁড়া না, দেখছিস ছোটমশাই এসেছেন।
ছোটমশাই ভাবতে ভাবতেই আসছিলেন সারা রাস্তা। মাধব ঢালিকে দেখেই আর কৌতূহল চাপতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন–কেমন আছিস সব?
আজ্ঞে, ভাল ছোটমশাই।
কোনও গণ্ডগোল টণ্ডগোল ঘটেনি তো?
আজ্ঞে, গণ্ডগোল হবে কেন? আমি আছি কী করতে?
এরপর আর দাঁড়ালেন না। গোকুলের পেছন পেছন ভেতরে ঢুকে গেলেন। আসবার সময়। বদরগঞ্জের কাছে ডাকাতের উৎপাতের ভয় ছিল। তাই তাড়াতাড়ি বজরা চালিয়ে আসতে বলেছিলেন। বাড়ির ভেতর ঢুকে যেন নিশ্চিন্তির নিশ্বাস ফেললেন একটা। তখনও কেউ জাগেনি। ছোটবউয়ের মহলের দিকটায় অন্ধকার। ওদিকে পরে গেলেই চলবে। তার আগে বড়বউকে খবরটা দেওয়া দরকার। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নিজে কালীঘাটে যাচ্ছেন, গিয়ে একটা কিছু ব্যবস্থা করবেন কথা দিয়েছেন।
বউবউয়ের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলেন–বড়বউ, বড়বউ–আমি…
ওদিকে কালীঘাটের মন্দিরের ঘাটেও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বজরা এসে ভিড়েছে। এখানে পুজোর ভিড় লেগেই আছে। শুধু কালীঘাটে নয়। কালীমন্দির আরও আছে। সেখানেও লোকেরা পুজো দেয়। রাত যখন গম্ভীর হয়, চিৎপুরের খালটা পেরিয়ে পেরিন সাহেবের বাগানটা ছাড়িয়ে আরও দূরে অন্ধকারের মধ্যে কারা যেন নিঃশব্দে কালীমন্দিরটায় গিয়ে ঢোকে। অন্ধকারের মধ্যেই তারা হড়িকাটের সামনে কাকে যেন ধরে নিয়ে আসে। গঙ্গাজল এনে তাকে স্নান করায়। টু শব্দটি পর্যন্ত করবার উপায় থাকে না। তার। চোখ-মুখ-কান-নাক কাপড়ের ফেটি দিয়ে বাঁধা। তারপর যখন সব শেষ হয়ে যায়, সবাই রক্তের ফোঁটা কপালে লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চণ্ডালের রক্ত। হাতে থাকে সড়কি বল্লম বর্শা আর রণ-পা। ঘোড়ার চেয়েও জোরে ছুটে চলে তারা সেই রণ-পা দিয়ে। তারপর সকালের সুতোনুটির লোক অবাক হয়ে দেখে কাণ্ডকারখানা। চিত্রেশ্বরী মন্দিরের মধ্যে সকালবেলা পুজো দিতে গিয়ে সাত হাত পেছিয়ে আসে পুরোহিত। নরবলি। নরবলিতে শান্ত হবার বদলে মায়ের জিভ আরও লকলক করে ওঠে। ফিরিঙ্গিদের সেপাই সান্ত্রি আরও তৎপর হয়ে ওঠে। পেরিন সাহেবের বাগানের বাদুড় আর চামচিকেরা। আরও কিচমিচ করে ওঠে।
কিন্তু সকাল হলেই আবার অন্য দৃশ্য। সাহেবরা যখন পুজো দিতে আসে তখন বড় জাকজমক হয়। সেদিন গণ্ডা গণ্ডা পাঁঠা বলি হয়। প্রসাদের পুষ্পবৃষ্টি লেগে যায়। চিৎপুরে কালীঘাটে পাণ্ডাদের পাড়ায় হাঁকডাক পড়ে যায়। এ-পাড়া ও-পাড়া সরগরম হয়ে যায়। চেতলা থেকে গঙ্গা পেরিয়ে সাঁতরে সবাই ও-পারে গিয়ে হাজির হয়।
কীসের পুজো গো? কীসের পুজো?
সাহেবরা পুজুরিদের ডেকে গণেশ পুজো করে, সরস্বতী পুজো করে। গোবিন্দপুর সুতানুটির লোক সে-প্রসাদ ভক্তিভরে মাথায় চুঁইয়ে খায়। বলে বেঁচে থাকো বাবা কোম্পানির সাহেব, অক্ষয় পেরমায়ু হোক সাহেব কোম্পানির
কিন্তু এবার আরও জাঁক। এবার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এসেছেন কেষ্টনগর থেকে মায়ের পুজো দিতে। সঙ্গে সাত-সাতটা বজরা। এক হাজার পাঁঠা বলি হবে। বহুদিন আগে মহারাজার মানত ছিল, তারই উদ্যাপন। দান-ধ্যান-দক্ষিণার ছড়াছড়ি হবে। যে যত পারো কুড়িয়ে নাও। সঙ্গে সবাই এসেছে। রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র এসেছেন, গোপাল ভাড় মশাই এসেছেন। কিন্তু মহারাজ তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। কালীপ্রসাদ সিংহ তখনও আসেননি। বারবার খবর নিচ্ছেন তার।
বেলা পুইয়ে যখন তিন প্রহর তখন কালীপ্রসাদ সিংহ এলেন। মুর্শিদাবাদ থেকে সোজা নদীপথে এসে হাজির।
মন্ত্রীকে দেখেই আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন-কী খবর?
খবর খুব খারাপ শুনে এলুম। আপনার কথা সব বুঝিয়ে বলে এলুম। বললুম ইংরেজদের সাহায্যটা বড় কথা নয়, যদি মিরজাফর দলে থাকে সত্যি সত্যি তবেই ভরসা
শুনে শেঠজি কী বললেন?
শেঠজি বললেন, মিরজাফরকে অপমান করেছ নবাব, সে দলে থাকবেই।
কী অপমান করেছে?
মিরজাফরকে নবাব হুকুম দিয়েছিল মোহনলালকে দেখলেই সেলাম করতে হবে।
শুনে মহারাজ কী যেন ভাবতে লাগলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন–আর হাতিয়াগড়ের জমিদার? তার সেই খবরটা সত্যি?
সত্যি বলেই তো শুনলুম। শুনলুম, ডিহিদারের লোক গিয়ে তাঁর দ্বিতীয়পক্ষের বউকে নাকি নিয়ে এসেছে
নিয়ে এসেছে মানে?
মানে, খবর পেলুম তাদের বজরা নাকি এতক্ষণে কাটোয়ায় পৌঁছে গেছে
মহারাজ গম্ভীর হয়ে গেলেন আরও। তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন–তুমি এক কাজ করো, উমিচাঁদকে খবর দাও যে, আমি এখানে এসে গেছি, আর রাজবল্লভ সেনকেও একবার দেখা করতে বলল আমার সঙ্গে দেখো, খুব সাবধানে যাবে, কেউ যেন টের না পায়–
দুটো নদী এসে মিশেছে কাটোয়াতে। একদিকে অজয় আর একদিকে গঙ্গা। ডিহিদারের বজরা এসে পঁড়াল। এখান থেকে পালকিতে যেতে হবে। ডিহিদারের বজরা আবার খালি ফিরে যাবে ডিহিদারের কাছে। এবার আবার নতুন সেপাই, নতুন বন্দুক নিয়ে এসে হাজির হয়েছিল নতুন ডিহিদার।
কিছু কিছু লোক বজরা থেকে মেয়েমানুষ নামতে দেখে ভিড় করেছিল। ডিহিদারকে দেখে তারা সরে গেল।
তারপর সরাইখানার ভেতর রানিবিবি ঢুকে গিয়েছিল। সে এক অস্বস্তিকর অবস্থায় কেটেছে। নদীর ঘাটে, রাস্তায় যে দেখেছে সে-ই কেবল জিজ্ঞেস করেছে–পালকিতে কাদের বউ যাচ্ছে গো?
কান্ত কোনও উত্তর দেয়নি। সেপাইরা, পালকির বেহারারাও কোনও উত্তর দেয়নি। হাতিয়াগড় থেকে বেরিয়ে সমস্তটা রাস্তা ঘুম হয়নি কান্তর। সরাইখানার একদিকটা জেনানামহল, আর একদিকটা মর্দানাদের জন্যে। বোরখাপরা বাঁদির ব্যবস্থাও করে রেখেছিল কোতোয়াল সাহেব। আগে দেখেছিল শুধু রানিবিবির একটা পায়ের গোছ। পালকি থেকে নামবার সময় দেখা গেছে। কিন্তু আজ পালকি থেকে নামবার সময় দেখা গেল মুখখানা। পালকি থেকে মাথা নিচু করে নামতে গিয়েই ঘোমটাটা খসে গিয়েছিল মাথা থেকে। কাটোয়ার সেই খাঁ খাঁ দুপুরের রোদে মুখখানা বুঝি আরও লাল হয়ে গেছে।
হঠাৎ বাঁদিটা এসে ডাকতেই কান্ত অবাক হয়ে গিয়েছিল। ধড়মড় করে বসে জিজ্ঞেস করেছিল আমায় ডেকেছেন? কেন?
তা জানিনে হুজুর।
তুমি ঠিক বলছ?
জি হাঁ।
তারপরে পেছন পেছন গিয়ে যেখানে পৌঁছুল সেখানে আর কেউ নেই। ঘরের মধ্যে একটা গালচের ওপর রানিবিবি একা বসে ছিল। কান্ত দরজার সামনে গিয়ে বললে–আপনি আমায় ডেকেছেন?
রানিবিবি পানের ডিবেটা হাতে তুলে নিয়ে বললো, কাল রাত্তিরে আমাকে ডাকছিলেন কেন?
কান্ত বললে–ডাকতুম না, আপনি আরাম করে ঘুমোচ্ছিলেন, আমার ডাকতে সত্যিই ইচ্ছে হচ্ছিল না, কিন্তু আমার ভয় হচ্ছিল হয়তো ডাকাত পড়বে, বদরগঞ্জের কাছে খুব ডাকাতির ভয় কিনা–তাই আপনাকে ডেকেছিলুম
ডাকাত? ডাকাতের কথা শুনে রানিবিবি যেন একটু হাসলেন।
আপনি হয়তো বিশ্বাস করছেন না, কিন্তু সত্যিই আমি বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম
কিন্তু ভয় পেয়েছিলেন কার জন্যে? আমার জন্যে না আপনার জন্যে?
এর উত্তর দিতে গিয়ে কান্ত একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। বললে–আপনার জন্যে?
রানিবিবি হাসতে হাসতে বললে–আমার জন্যে? আমার আবার ভয় কী? আমি তো এক ডাকাতের হাতেই যাচ্ছি, তা বদলে না-হয় বদরগঞ্জের ডাকাতের হাতেই যেতাম। আমার কাছে মুর্শিদাবাদের ডাকাতও যা, বদরগঞ্জের ডাকাতও তাই। বদরগঞ্জের ডাকাতরা কি আর বেশি খারাপ
কান্ত কথাটার ইঙ্গিত বুঝল।
বললে–দেখুন, আপনি হয়তো আমাকেও সেই ডাকাতদের দলে ফেলেছেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি শুধু হুকুম তামিল করতে এসেছি, আমার মাত্র সাত দিনের চাকরি, পেটের দায়ে আমাকে এই চাকরি নিতে হয়েছে–আগে জানলে আমি একাজ নিতুমই না, কাল সারারাত আমি কেবল এই কথাই ভেবেছি
কেন? আপনি ঘুমোননি? সারারাত জেগে ছিলেন?
কান্ত বললে–ঘুম যে এল না, আমি কী করব? আমার কেবল মনে হচ্ছিল ক’টা টাকার জন্যে আমি হয়তো আপনার সর্বনাশ করছি
রানিবিবি পানের ডিবেটা খুলে একটা পান তুলে নিলেন।
কান্ত আবার বললে–ফিরিঙ্গি কোম্পানির চাকরিটা থাকলে, আমি সত্যি বলছি, এ চাকরিটা নিতুম । তা ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই যে, তার কাছে গিয়ে থাকব! এক বুড়ি দিদিমা ছিল, বর্গিদের হাতে সে-দিদিমাও মারা গিয়েছে, তাই আমার এ-চাকরি নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না
তারপর একটু থেমে বললে–আমার কথায় যদি বিশ্বাস না হয় তো আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন! বশির মিঞা সব জানে!
বশির মিঞা? সে কে?
নিজামতের চর, সে-ই তো আমাকে এ চাকরিটা করে দিলে। কিন্তু আপনি মেয়েমানুষ, জিজ্ঞেস করবেনই বা কী করে। নইলে জানতে পারতেন আমার কথা সত্যি কি না। সে সব জানে! তাকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারতেন, আমি বেভারিজ সাহেবের সোরার গদিতে মুনশির কাজ করতাম, তিন টাকা মাইনে পেতাম, আমার নামও জানে সে, আমি মুসলমান নই, হিন্দু। আমরা বড়চাতরার সরকার, আমার বাবার নাম ঈশ্বর শশধর সরকার, আমার নাম কান্ত সরকার
কী নাম?
কান্ত আবার বললে–কান্ত সরকার
সঙ্গে সঙ্গে রানিবিবির হাত থেকে পানের ডিবেটা পাথরের মেঝের ওপর পড়ে ঝনঝন আওয়াজ করে উঠল। কান্তর মনে হল কাছাকাছি কোথাও কেউ তার নামটা শুনে আর্তনাদ করে উঠল যেন।
সরাইখানার সামনে তখন বেশ ছায়া-ছায়া। সোজা কেষ্টনগর থেকে হাঁটতে হাঁটতে সেদিন উদ্ধব দাস সেখানে এসে হাজির। উদ্ধব দাসের এই-ই নিয়ম। যখন যেখানে থাকে সেখানেই তার ঘর। গাছতলাই হোক আর একটা বোস্টমদের আখড়াই হোক, কিংবা রাজবাড়ির অতিথিশালাই হোক, একটা কিছু হলেই হল। না-হলেও কিছু আসে-যায় না। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র একবার বলেছিলেন–উদ্ধব, একটা চাকরি নেবে নাকি হে
উদ্ধব বলেছিল–চাকরি তো করি আমি মহারাজ
তার মানে?
উদ্ধব বলেছিল–আমি আপনার এখানে পড়ে থাকি বলে আপনি কি ভাবেন আমি বেকার? আমি যেখানে যাব সেখানেই সবাই আমার গান শুনে আমায় ঠাই দেবে–
তা নয়, আমার কাছে চাকরি করলে তোমাকে আর চিরকাল এরকম টো টো করে ঘুরে বেড়াতে হবে না–এই দেখো না, ভারতচন্দ্রকে রায়গুণাকর উপাধি দিয়েছি, মুলাজোড়ে ছ’শো টাকা আয়ের সম্পত্তি ইজারা দিয়ে দিয়েছি, সে আয়েশ করে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে বসে বিদ্যাসুন্দর লিখেছে, অন্নদামঙ্গল লিখেছে–
উদ্ধব বলেছিল–কিন্তু আমি তো আপনার খোশামোদ করতে পারব না ভারতচন্দ্রের মতো
তা ভারতচন্দ্র কি আমায় খোশামোদই করে বলতে চাও?
না করলে তার চাকরি আছে কী করে? আপনি তো আর মিছিমিছি তাকে তার গুণ দেখে উপাধি দেননি!
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মজা পেয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন–শুধু গুণের বুঝি কদর নেই?
আজ্ঞে আপনি নিজেই তা ভালরকম জানেন, দিল্লির বাদশার খোশামোদ না করলে কি আপনিই মহারাজ হতে পারতেন।
তুমি তো বড় মুখফোঁড় হে!
না হুজুর, আমি যার কাছে চাকরি করি, তাকে খোশামোদ করতে হয় না, খোশামোদনা করেই আমি উপাধি পেয়েছি একটা।
তোমার আবার উপাধি আছে নাকি? তাজ্জব কথা তো! কী উপাধি?
আজ্ঞে, আমার উপাধি ভক্ত-হরিদাস!
তোমার মালিক কে?
উদ্ধব দাস এবার গেয়ে উঠল
ওই দেখো শ্যামনবঘন উদয় গগনে।
এলেন আমার জগবন্ধু রথ-আরোহণে ॥
ওই-পদে রেখেছে মতি, ব্রহ্মা ইন্দ্র পশুপতি।
ভবভার্যা ভাগীরথীর জন্ম ওই চরণে ॥
গলে বনফুল হার, শিরে শিখিপুচ্ছ যার,
দ্বিভুজ মুরলীধর পীতবাস পরনে ॥
গান থামিয়ে উদ্ধব দাস বললে–শুনলেন তো প্রভু, আমার মালিক কে? সেইজন্যে আমি কারও কাছে কিছু চাই না প্রভু, চাইলে চাই মুগের ডাল, কিংবা পান্তা ভাত, কি একদলা নুন
যেখানে যেত উদ্ধব দাস, সেখানেই এইরকম করে কথা বলত। খলু সংসারে কে কাকে কী দিতে পারে গো! তোমরা সবাই খেতাব চাও, মনসবদারি চাও, টাকা চাও, মেয়েমানুষ চাও, আর আমি কিছুই চাই না। চাইলেই দুঃখ, না-চাইলেই সুখ। আমি কিছুই চাই না, তাই সব পাই। তোমরা সব কিছু চাও বলেই তোমাদের কষ্টের আর শেষ নেই।
মোল্লাহাটির মধুসূদন কর্মকার বলেছিল–তা হলে তুমি বিয়ে করতে গেলে কেন দাসমশাই?
উদ্ধব দাস বলেছিল-মতিভ্রম ভায়া, মতিভ্রম-
-তা তোমার কষ্ট হয় না মাগের জন্যে!
হয় বই কী!
কী রকম কষ্ট হয়?
উদ্ধব দাসের তখনই আবার ছড়া পেয়ে যায়। বলে তবে শোনো হে ভায়া–
বিষয়-শূন্য নরবর, বারি-শূন্য সরোবর, বস্ত্র-শূন্য বেশ।
দেবীশূন্য মণ্ডপ, কৃষ্ণশূন্য পাণ্ডব, গা-শূন্য দেশ ।
জলশূন্য ঘট, শিব-শূন্য গেহ, কর্পূর-শূন্য ভাণ্ড ॥
শিকল-শূন্য তালা, ভজনশূন্য মালা, দৃষ্টি শূন্য নয়ন।
ভূমি-শূন্য রাজার রাজ্য, বিদ্যা শূন্য ভট্টাচার্য, নিদ্রা-শূন্য শয়ন । ছড়াটা বলেই উদ্ধব দাস হোহো করে হেসে উঠল। বললে–দেখলে তো, আমি খোশামোদ করিনে তাই, নইলে আমিও রায়গুণাকর হতে পারতাম গো। আমারও বিদ্যে আছে–
তারপর হঠাৎ পোঁটলটা বগলে নিয়ে উঠে বললে–যাই গো অনেক দূর যেতে হবে
কোথায় যাবে, এত সকালে?
যেখানে দু’চোখ যায়। শ্বশুরবাড়ি নেই বলে কি খলু সংসারে যাবার জায়গার অভাব আছে ভায়া?
সেই হাঁটতে হাঁটতেই এখানে এসে পড়েছিল উদ্ধব দাস। এই কাটোয়ার সরাইখানার সামনে। তখন সরাইখানার সামনে সেপাই দুটো গাছতলায় খেয়েদেয়ে জিরোচ্ছে। বন্দুকটা পাশে রেখে সেপাই দুটো মাটিতে চিতপাত হয়ে শুয়ে পড়েছে।
উদ্ধব দাসের পেট তখন খিদেয় চো চো করছে। বললে–কী গো, সেপাই বাবাজীবন, কার পালকি? কোন বিবিজান চলেছে?
সেপাইরা উদ্ধব দাসকে চিনত। বেশ মানুষ। গান না শুনতে চাইলেও গান গাইবে, কিংবা ছড়া কাটবে, হেঁয়ালি বলবে। খেতে দাও আর না-দাও হৃক্ষেপ নেই। উদ্ধব দাস কাউকে হৃক্ষেপ করে না। তার কাছে রাজা-মহারাজ নবাব বাদশাও যা, রাস্তার বোস্টম ভিখিরিও তাই। একেবারে বলা-নেই কওয়া-নেই সটান তাদের মধ্যেই বসে পড়ে বললে–একটা নতুন গান বানিয়েছি—শোনো–
বলে আরম্ভ করলে
আমি রব না ভব-ভবনে
শুনো হে শিব শ্রবণে ॥
যে-নারী করে নাথ হৃদিপদ্মে পদাঘাত
তুমি তারই বশীভূত আমি তা সব কেমনে।
একজন সেপাই বলে উঠল–আরে দাসমশাই যে আবার খেদের গান গাইছে, কেউ বুঝি তোমার বুকে লাথি মেরেছে গো?
আর একজন বললে–তা জানিস না বুঝি, ওর বউ যে বাসরঘর থেকে পালিয়ে গেছে!
তাই নাকি? তারপর? তারপর?
পতিবক্ষে পদ হানি ও হল না কলঙ্কিনী
মন্দ হল মন্দাকিনী ভক্ত হরিদাস ভণে।
গান তখন বেশ জমে উঠেছে। সেপাইরা শুনছে আর হাতে তাল দিচ্ছে। আশপাশের গাঁয়ের লোকও জুটেছে। পালকি-বেহারারাও জুটেছে। কান্ত ঠিক সেই সময়ে এসে হাজির হল। রানিবিবির ঘরে এতক্ষণ কথা বলতে বলতেই গানটা কানে গিয়েছিল। বলেছিল–দেখে আসুন তো কে গান গাইছে ওখানে?
বেড়ে গান বানিয়েছ তো দাসমশাই! তা তোমার বউ পালাল কেন হে?
কান্তর কানে কথাটা গিয়েছিল। সোজা গিয়ে জিজ্ঞেস করলে কার বউ পালিয়েছে বললে–সেপাইজি?
উদ্ধব দাস হাসতে হাসতে বললে–আমার আজ্ঞে।
সেপাইটা তার আগেই বললে–হুজুর, ও পাগলা-ছাগলা লোক, ও গিয়েছে বিয়ে করতে! তা ওর বউ পালাবে না তো কার বউ পালাবে!
উদ্ধব দাস হাসতে হাসতে বললে–তা পালিয়েছে বেশ করেছে, আমার বউ পালিয়েছে তোত তোমাদের কী? বউ না পালালে কি এমন গান বাঁধতে পারতুম?
কান্ত জিজ্ঞেস করলে কোথায় বিয়ে করতে গিয়েছিলে তুমি?
আজ্ঞে হাতিয়াগড়ে!
হাতিয়াগড়ের নামটা শুনেই কান্তর বুকটা ধক করে বেজে উঠল।
আমি কি বিয়ে করতে গিছলাম বাবাজীবন, আমি গিছলাম রাজবাড়ির অতিথশালায় দুটো খেতে আর হাতিয়াগড়ের ছোটরানি আছেন, তাকে দুটো রসের গান শোনাতে!
হাতিয়াগড়ের ছোটরানি?
কান্ত আরও অবাক হয়ে গিয়েছে। যেন এক মুহূর্তে উদ্ধব দাস কান্তর একান্ত আপন লোক হয়ে গেল। কান্ত এবার আরও কাছে সরে এল। তারপর উঁচু হয়ে সামনে বসে পড়ল। বললেছোটরানি বুঝি রসের গান শুনতে ভালবাসে?
খুব ভালবাসে! রসের গান শুনতে কার না ভাল লাগে আজ্ঞে! আমি রসের গান শুনিয়েছিলুম পিরিতের কথা আর বোলো না, দ্বিতীয় পক্ষের রানি যে! বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা যে, ও কম্মে তো ঢুঁ ঢুঁ, তাই কেবল রসের গান শুনেই পেট ভরায়
তুমি দেখেছ ছোটরানিকে?
আমি কী করে দেখব আজ্ঞে, আমি যে অতি দীন-হীন ব্যক্তি
বলেই হঠাৎ গান গেয়ে উঠল–
আমি মা অতি দীন, তনু ক্ষীণ, হল দশার শেষ।
কোন দিন মা রবি-সুতে ধরবে এসে কেশ!
কান্ত ততক্ষণে অধীর হয়ে উঠেছে। বললে–তোমার গান থামাও, আমার কথার উত্তর দাও। আগে–ছোটরানিকে তুমি দেখেছ?
দেখিনি, হরিপদর কাছে ছোটরানির কথা শুনিচি।
কী শুনেছ?
উদ্ধব দাস সেই সব পুরনো কথা বলে গেল। হরিপদর কাছেই কথাগুলো শোনা। চাকদহর শ্রীনিবাস মুখুটির একমাত্র মেয়ে রাসমণি! ছোটমশাই বজরায় করে যাচ্ছিলেন। এমন সময় বড় বউরানির নজর পড়ল ঘাটের দিকে। ঘাটে তখন চান করছিল রাসমণি। মা নেই, ভাই নেই, বোন নেই। সংসারে আপন বলতে আর কেউ নেই। সেই বউ শ্বশুরবাড়ি এসে পর্যন্ত আর বাপের বাড়ি যেতে পায়নি। বাপ শ্রীনিবাস মুখুটি মেয়ের বিয়ের পরই মারা গিয়েছিল। তারপর সেই যে ছোটরানি হাতিয়াগড়ের রাজবাড়িতে এসে ঢুকল, আর বেরোতে পারেনি। একবার শুধু কী শখ হয়েছিল, ছোমশাইয়ের সঙ্গে মুর্শিদাবাদে গিয়েছিল নবাবের নাতির বিয়েতে। সেই তখন থেকেই দুর্গা আছে সঙ্গে। দুর্গাই চুল বেঁধে দেয়, দুর্গাই ছোটরানিকে পুতুলের মতো দিনরাত সাজাত গোজাত।
দুর্গা ছোটরানির চুল বাঁধতে বাঁধতে বলত–কী চুলই হয়েছে তোমার বউরানি, যেন মেঘ, মেঘলা চুল তোমার
পিঠের ওপরে কাপড়টা সরে যেতেই দুর্গা একদিন বললে–ওমা, দেখি দেখি, পিঠে তোমার দাগ কীসের বউরানি?
ছোটরানি খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। বলেছিল–ও আর তোকে দেখতে হবে না, তুই চুল বাঁধ
ওমা, এ যে দাঁতের দাগ গো!
ছোট বউরানি হাসছে দেখে দুর্গা বলেছিল–ছোটমশাই কি তোমার পিঠেও দাঁত বসায় নাকি গো?
ছোট বউরানি বলেছিল–তোর ছোটমশাইয়ের গুণের ঘাট নেই তো
দুর্গা বলেছিল–আহা, তুমি আদর চেইছিলে, জন্ম জন্ম এমন আদর পাও তুমি বউরানি! সোয়ামির আদর কি যে-সে জিনিস গো, বলে সোয়ামি হেন জিনিস যে হতভাগী পায়নি সে এর কদর কেমন করে বুঝবে বলো–
বউরানি বলেছিল–মোটে ঘুমুতে দেয় না তোর ছোটমশাই, এমন বজ্জাতি করে—
আহা, তা না-ই বা দিলে ঘুমোতে, এয়োতি মানুষ, মেয়েমানুষের আর কী চাই?
তা ঘুম না হলে মানুষ বাঁচে? তাই তো সকালবেলা গা ম্যাজম্যাজ করে, উঠতে পারিনে বিছানা ছেড়ে
কান্তর শুনতে খুব ভাল লাগছিল। বললে–তারপর?
আজ্ঞে, হরিপদর তো কোনও কাজ নেই, আমি অতিথিশালায় গেলেই আমার কাছে এসে গল্প করত। আমি বলতাম–বাড়ির ভেতরের গল্প আমার কাছে কেন করো বলল তো? তা হরিপদ বলত–দুর্গা যে আমাকে সব এসে বলে গো, আর শুনে কারও কাছে তো বলা চাই! তা ওই সব শুনতাম আর রসের গান বাঁধতুম! কিন্তু একদিন নিজেই বাঁধা পড়ে গেলুম–
সেপাইরা এ-গল্প আগেই শুনেছিল। কান্ত জিজ্ঞেস করলে–কী রকম?
সে এক কাণ্ড প্রভু। একদিন ছোটমশাইয়ের নফর শোভারামের মেয়ের বিয়ে। বর আসবার কথা ছিল কলকাতা থেকে, সেবর ঠিক সময়ে আসতে পারেনি।
কেন? আসতে পারেনি কেন?
উদ্ধব দাস বললে–না এলে যে আমার সর্বনাশ হয় তাই আসতে পারেনি। আমি ঘুমোচ্ছিলাম অতিথশালার দাওয়ায়, সে-ই আমাকে এসে ডেকে নিয়ে গিয়ে সেই মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলে সেই রাত্তিরে–! কপালের গেরো না থাকলে এমন সর্বনাশ হয় কারও প্রভু?
তা তুমি তাকে বিয়ে করলে?
আজ্ঞে, সে প্রভু ওই নামে মাত্তরই বিয়ে। সম্প্রদানটাই শুধু হল, তারপর বাসরঘরে একপাল মেয়ের মধ্যে বসে আছি, আমাকে প্রভু তারা সবাই বললে–কিনা বউকে কোলে করতে
তারপর? তুমি কোলে করলে নাকি?
উদ্ধব দাস বললে–আত্তে প্রভু, আমি তখন ভাবছি, কার ভোগ্য জিনিস কে ভোগ করবে। অমন সুন্দর বউ কি বাঁদরের গলায় মানায় প্রভু? আপনিই বলুন?
তা তুমি কোলে করলে কি না তাই বলো না!
কোলে করব কী করে আজ্ঞে, তার আগেই দেখি কী বউ তখন হাপুস নয়নে কাঁদছে গো
কাঁদছে? কাঁদছে কেন?
প্রভুই জানে কেন কাঁদছে। ওই কান্না দেখে কি আর তখন বউকে কোলে করতে কারও ইচ্ছে করে আজ্ঞে? আমারও তো মন বলে একটা পদার্থ আছে! কান্না দেখে আমার বড় মায়া হল প্রভু! আবার লোভও হল!
লোভ হল কেন?
আজ্ঞে, লোভ হবে না? আমি কুচ্ছিত হলে কী হবে, আমারও তো কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ মদ-মাৎসর্য আছে! অমন গোলাপ ফুলের মতো বউ পাশে বসে কাদবে আর আমি চুপ করে দেখব? আমার বুঝি কান্না আসতে নেই?
উদ্ধব দাস জীবনে কখনও কাঁদে না। কথা বলতে বলতে তারও হয়তো চোখ দুটো ছলছল করে উঠছিল। হঠাৎ হেসে ফেললে। বললে–আমি তখন মনে মনে ওই গানটা বাঁধলুম আজ্ঞে আমি রব না ভব-ভবনে–
তারপর?
তারপর প্রভু, ভাবলুম আমাকে পছন্দ হয়নি বউয়ের। আমাকে তো আজ্ঞে কারওই পছন্দ হয় না, আমার পছন্দ হবারই কিছু নেই। আবার ভাবলুম হয়তো কলকাতার বরের জন্যে মন-কেমন করছে
কেন? কলকাতার বরকে বুঝি ভাল দেখতে?
আমার চেয়ে সবাইকে ভাল দেখতে প্রভু! আমি কি মানুষ আজ্ঞে, আমার না আছে চাল, না আছে চুলো। আমি মানুষই নই। তাই বউটা পালিয়ে যাবার পরই প্রভু আমি রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম। সোজা কেষ্টনগরে গিয়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় গেলুম। শিবনিবাসে নিয়ে গেলেন মহারাজ বললেন, চাকরি নেবে তুমি উদ্ধব দাস? আমি বললুম-আমার বউ পালিয়ে গেছে, চাকরি আমি কার জন্যে নেব প্রভু? কার জন্যে দাস বৃত্তি করব। সেখানে গিয়ে গোপাল ভাঁড় মশাইকে হেঁয়ালিতে হারিয়ে দিলুম, রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র আমার ছড়ার তারিফ করলেন। আমাকে মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন-তুমি কী চাও উদ্ধব! আমি বললুম-মুগের ডাল
সেপাই দু’জন হো হো করে হেসে উঠেছে।
তুমি মহারাজের কাছে কিনা চাইতে গেলে মুগের ডাল? আর কোনও দামি চিজ চাইতে পারলে না দাসমশাই?
উদ্ধব দাস বললে–আমার কাছে সেপাইজি মুগের ডালও যা নবাবের নবাবিও তাই। মুগের ডাল খেয়ে আরাম করে আমি তো তবু ঘুমিয়ে পড়তে পারি, কিন্তু নবাবি? নবাবি পেলে কি কারও ঘুম থাকে আজ্ঞে? বশির মিঞাকে তো তাই বলেছিলুম
কান্ত যেন লাফিয়ে উঠেছে বশির মিঞাকে তুমি চেনো?
চিনব না? আমিও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই, বশির মিঞাও ঘুরে বেড়ায়। আমাকে বশির মিঞা বললে–তুমি তো হিল্লি দিল্লি ঘুরে বেড়াও উদ্ধব দাস, চরের চাকরি নেবে? আমি জিজ্ঞেস করলাম–কীসের চাকরি? বশির বললে–নিজামতের চরের চাকরি! শুনে আমি বললাম আমি তোর চাকরির মুখে পেচ্ছাব করে দিই!
সেপাই দুটো ভয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলে। কেউ শুনতে পায়নি তো!
জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁগো, তুমি বললে–ওই কথা?
তা বলব না? আমি কি কাউকে ভয় করি নাকি? আমি ভয় করতে যাব কোন দুঃখে শুনি? আমার মাগ আছে, না ছেলেপুলে আছে যে ভয় করতে যাব? শেষকালে কোন দিন হুকুম হবে–যাও, মহারাজ কেষ্টচন্দ্রের দ্বিতীয় পক্ষের বউকে ধরে নিয়ে এসো গে। তখন?
উদ্ধব দাসের কথাগুলো শুনতে শুনতে কান্তর যেন কেমন নিজেকে বড় নিঃসহায় নিঃসম্বল মনে হল। মনে হল এই উদ্ধব দাসও হয়তো তার চেয়েও সুখী! এই উদ্ধব দাসও জীবনের সার তত্ত্বটা জেনে গেছে। উদ্ধব দাসের কিছু না থেকেও যেন সে সকলের সব থাকার গৌরবকে ম্লান করে দিয়েছে। যে-চাকরি সে বশির মিঞার কাছে সেধে নিয়েছে, সেই চাকরিই উদ্ধব দাস লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। উদ্ধব দাসের বাইরের ভাড়ামির আড়ালে যেন আর একটা নিরাসক্ত মানুষ বড় বড় দুটো চোখ নিয়ে পৃথিবীকে দেখতে বেরিয়েছে। উদ্ধব দাসের এই ঘুরে বেড়ানোও যেন তার আর একরকমের দর্শন। সে পৃথিবীকে দেখে দেখে যেন আরও অনেক কিছু জানতে চায়।
উদ্ধব দাসকে আড়ালে ডাকলে কান্ত। আড়ালে ডেকে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলে একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম উদ্ধব দাস। তুমি ঠিক ঠিক উত্তর দেবে?
বলুন প্রভু?
আমার মনে হচ্ছে, তোমার বউ কোথাও পালায়নি উদ্ধব দাস, নিশ্চয় কোথাও লুকিয়ে আছে। কারও বাড়িতে কি কোনও আত্মীয়স্বজনের কাছে। একদিন না একদিন সে বেরোবেই। ধরো যদি কখনও তাকে খুঁজে পাও, তখন তুমি তাকে নেবে?
উদ্ধব দাস যেন এতক্ষণে স্পষ্ট করে প্রথম কান্তর দিকে চেয়ে দেখল।
কিন্তু আপনি কে প্রভু? আপনি কেন একথা জিজ্ঞেস করছেন?
কান্ত একটু ভেবে বললে–আমার স্বার্থ আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি
কিন্তু সবাই তো প্রভু আমার বউ পালিয়ে গেছে বলে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করে, কেউ তো এমন করে বলেনি কখনও
তা না বলুক, তাদের কথা আলাদা! তুমি নেবে কি না বলো! আমি একটা কাজে এখন মুর্শিদাবাদে যাচ্ছি। তারপরই হাতিয়াগড়ে যাব, তখন যদি খুঁজে পাই তো তুমি তাকে নেবে?
কিন্তু আপনি প্রভু কেন আমার জন্যে খামোক কষ্ট করতে যাবেন? আপনার কীসের দায়? বউ পালিয়ে গেছে বলে তো আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে না–
কান্ত বললে–তোমার কষ্ট না হোক, তোমার সেই বউয়ের তো কষ্ট হতে পারে। তার জীবনটা তো চিরকালের মতো নষ্ট হয়ে গেল
তার জীবন নষ্ট হয়ে গেলে আপনার কীসের দায় প্রভু?
কান্ত একটু ভেবে বললে–দায় আছে বলেই তো বলছি তোমাকে, তোমাদের দুজনের চেয়ে আমারই যে বেশি দায়?
কেন? আপনার দায় কেন প্রভু?
হঠাৎ পেছন থেকে ডাক এল-রানিবিবি আপনাকে এত্তেলা দিয়েছেন বাবুজি!
রানিবিবি! কান্ত উদ্ধব দাসকে বললে–তুমি এখানে একটু দাঁড়াও দাসমশাই, আমি এক্ষুনি আসছি বুঝতেই তো পারছ নিজামতের চাকরি, আমি আসছি এখুনি
বলে কান্ত সরাইখানার ভেতরে চলে গেল।