Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বেগম মেরী বিশ্বাস || Bimal Mitra » Page 2

বেগম মেরী বিশ্বাস || Bimal Mitra

সর্বজনের শোনবার মতোই কাহিনী বটে। উদ্ধব দাস যেকাহিনী তার পুঁথিতে লিখে গেছেন তার। সত্যি-মিথ্যে ঈশ্বর জানেন। এই কাহিনীর দায়-দায়িত্ব সবই তার। আমি শুধু কথক। তাঁর পুঁথি পাঠ করব আর আপনাদের শোনাব। ওই হাতিয়াগড়ের নামও আমি জানতাম না। হাতিয়াগড় কোথায় তাও আমার জানবার কথা নয়। আমি কলকাতার মানুষ, ককাতার কথাই এতদিন লিখে এসেছি, এবার হাতিয়াগড়। হাতিয়াগড় থেকে মুর্শিদাবাদ, মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকা সুতানুটি দিল্লি সব জায়গাতেই যেতে হবে। উদ্ধব। দাস সব জায়গাতেই নিজে গিয়েছেন। ওই যে হাতিয়াগড়ের বড় রাজবাড়ি, ওর ভেতরে যে অতিথিশালা, ওখানেও উদ্ধব দাস কত দিন রাত কাটিয়েছেন। ওই যে গড়ের দিঘি, ওই গড়ের দিঘির ওপারে শোভারামের ঘর, ওখানেও গিয়েছিলেন। ওই যে গড়ের দিঘির পাশেই উঁচু ঢিবিটা ওর নাম ছাতিমতলার ঢিবি। ছাতিম গাছটা এখন আর নেই, কিন্তু ঢিবিটা আছে। শোভারাম গাই-গোরুটাকে ওখানে গিয়ে বেঁধে দিয়ে আসত। আদর করে আবার তার নাম দিয়েছিল–আদুরি। লোকে বলত আদুরি গোরু নয় গো, শোভারামের মেয়ে। তা আদুরি শোভারামের মেয়েও বটে আবার গোরুও বটে। আদুরিকে শোভারাম মেয়ের আদরে মানুষ করেছিল।

কিন্তু সেই আদুরিই সেবার হঠাৎ মারা গেল।

চোত-বোশেখ মাসে হাতিয়াগড়ের খাল-বিল শুকিয়ে যায়। আগের বর্ষাতেও তেমন বৃষ্টি হয়নি। শোভারাম ছাতিম গাছতলাটায় গিয়ে আদুরিকে বেঁধে রেখে এসেছিল। বেঁধে না রাখলে আবার বড়মশাইয়ের মুসুরির খেতে গিয়ে মুখ দেবে। বিকেল নাগাদ বড়মশাইয়ের বাড়ি থেকে কাজ সেরে এসে আদুরিকে আনতে গিয়ে দেখে আদুরি মরে পড়ে আছে।

ব্যাপারটা সহজে মিটল না। একে গাই-গোরুটা গেল, তার ওপর বড়মশাইয়ের বকুনি। গোবধ গোহত্যার দরুন প্রায়শ্চিত্ত যা করার সবই করতে হল শোভারামকে, কিন্তু তাতেও দুর্গতির শেষ হল না। বউটাও মারা গেল দু’মাস বাদে। পরের আষাঢ়ে। বউ মরল তাতে ক্ষতি নেই, একটা ছ’মাসের মেয়ে রেখে শোভারামকে একেবারে অনাথ করে চলে গেল।

এ-সব এ-গল্প আরম্ভ করার বহু আগের ঘটনা।

হাতিয়াগড়ে এখন সে-সব দিন বদলে গেছে। সে বড়মশাইও নেই। বলতে গেলে বড়মশাই চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সে-হাতিয়াগড়ও আর সে-হাতিয়াগড় নেই। এখন ছোটমশাই আছে, বড়মা আছে, আর ছোটমা আছে। সেই রাজবাড়িটাও আছে, সেই কেল্লাফটকও আছে, সেই ছাতিমতলার ঢিবি আছে, সেই গড়ের দিঘি আছে। আর আছে শোভারাম। আর আছে শোভারামের মেয়েটা।

ছোটমশাই জিজ্ঞেস করেছিলেন–মেয়ের কী নাম রাখলি শোভারাম?

শোভারাম বলেছিল–আজ্ঞে ছোটমশাই, ওর নাম আর কী রাখব, ও মাকে খেয়েছে, আমাকেও খেয়ে তবে ছাড়বে–তাই ওর নাম আর কিছু রাখিনি–

তা ডাকিস কী বলে?

খুকি বলে!

তা হোক, আমি ওর নাম রাখলাম বিন্দুমতী!

শোভারাম বলেছিল–আজ্ঞে ও-নাম আমি উশ্চারণ করতে পারব না ছোটমশাই—

তা উচ্চারণ না করতে পারিস তো বিন্দু বলে ডাকিস!

কী আর করা যাবে, ছোটমশাইয়ের দেওয়া নাম তো আর অপছন্দ করা যায় না। তা তাই-ই সই। বিন্দু বিন্দুই সই। বিন্দুবালা দাসীই না-হয় নাম হল। শোভারাম ভেবেছিল ভারী তো একটো একটা মা-মরা বুড়ো বয়সের মেয়ে, তার আবার অত নামের বাহারেরই বা দরকার কী। কিন্তু পরের দিনই ছোটমশাই আবার ডেকে বললেন–ওরে শোভারাম, ও বিন্দুমতীনামটা চলবে না রে তোর মেয়ের–

কেন হুজুর?

কেন যে বিন্দুমতী নাম চলবে না তা আর খুলে বললেন না ছোটমশাই। রাত্রিবেলাই বড়গিন্নি শুনে বলেছিলেন–সেকী? বিন্দুমতী যে আমার দিদিমার বোনের নাম, নফরের মেয়ের সেই একই নাম দিলে তুমি?

ছোটমশাই বলেছিলেন–তাতে কী হয়েছে? আর সে কি আমার মনে আছে, না কারও মনে থাকে–

বড়মা বলেছিলেন–না না, ছি, ও-নাম দিতে পারবে না, ওকে ডেকে তুমি বলে দিয়ো—

তা শেষপর্যন্ত নাম দেওয়া হল–মরালী!

বড়গিন্নিকে ডেকে ছোটমশাই জিজ্ঞেস করলেন–মরালী বলে তোেমাদের বংশে কারও নাম ছিল তো?

বড়গিন্নি বললেন–না—

ছোটগিন্নিকেও ডাকা হল। তিনিও বললেন–না, ওনামে আমাদের কেউ নেই—

রাজবাড়ির পূর্বপুরুষের কোথাও কোনও কুলে কারও ওনাম পাওয়া গেল না। রাজবাড়ির বউদের সাতকুলেও ওনামের কেউ নেই। সুতরাং আর কোনও আপত্তি নেই। শোভারামের মেয়ের ওই নামই বহাল রইল। সেই মরালী থেকে ক্রমে মরো হল, তারপর হল মরি। ভারী তো রাজবাড়ির নফর শোভারাম। ছোটমশাইয়ের চানের জল জোগানো আর তেল মাখানো কাজ। আর সন্ধেবেলা ছোটমশাই যখন বৈঠকখানায় বসেন, তখন তাঁর পায়ের কাছে বসে পা-হাত-মাথা-পিঠ টিপে দেওয়া। সেই তারই কিনা মেয়ে। তার নাম মরালী’ই হোক কি মরো’ই হোক, কিংবা মরিই হোক, তাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের কিছুই হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না। তাতে দিল্লির বাদশারও কিছু এসে যায় না, নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলারও কিছু এসে যায় না, লর্ড ক্লাইভ কিংবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কারওই কিছু এসে যায় না। এমনকী তাতে হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই হিরণ্যনারায়ণেরও কিছু আসে যায় না।

কিন্তু ওই মেয়েটাই শেষকালে এক সর্বনেশে কাণ্ড ঘটিয়ে বসল।

অষ্টাদশ শতাব্দীর সমস্ত প্রচ্ছদপটটাই একদিন ওই মরালী যে বদলে দিয়ে যাবে তা যেন কেউই কল্পনা করতে পারেনি। একটা ইতিহাসের আড়ালে যে আর একটা ইতিহাস সৃষ্টি করে বসবে হাতিয়াগড়ের সেই নগণ্য নফর শোভারামের নগণ্যতর মেয়ে মরালীবালা দাসী, তা যেন কারও মাথাতেই আসেনি।

সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ যখন বলেছিলেন নামটা তখন যেন খটকা লেগেছিল প্রথমটায়। এনাম আবার কেমন নাম। এনাম আবার কারও থাকে নাকি। নাম হবে সুরবালা, নাম হবে ব্রজবালা, নাম হবে তরঙ্গিনী। যেমন আর পাঁচজনের নাম হয় আর কী। কিন্তু ছোটমশাই হলেন অন্নদাতা, তার দেওয়া নাম তো আর খামোকা বদলানো যায় না। ও-মেয়ে আদুরিকে খেয়েছে, মাকে খেয়েছে, ও-মেয়ে যে নিজেকেও একদিন খাবে সে সম্বন্ধে শোভারামের আর কোনও সন্দেহ ছিল না। তাই কখনও মরো’ বলে ডাকত, কখনও বা মরি’।

কিন্তু বিয়ের দিনেই নতুন করে নামটা উঠল। পুরুতমশাইকে ওই নামটা উচ্চারণ করতে হবে। সম্প্রদানের সময় কন্যার নামটা দরকার। বরকনের নাম না হলে বিয়ে হয় কী করে। শুধু নাম নয়–গোত্র, বংশ, কুলুজি সবই দরকার হয়।

সন্ধে পেরিয়ে গেছে তখন। রাত দশটায় লগ্ন। একে একে সবাই জুটেছে। শোভারামের মেয়ের বিয়ে। দশটা নয় পাঁচটা নয়, একটিমাত্র মেয়ে। মেয়ে বলো ছেলে বলো ওই এক মরালী। শোভারাম। সকলের বাড়িতে গিয়ে গলবস্ত্র হয়ে সবাইকে নেমন্তন্ন করে এসেছে। সদগোপপাড়া, বামুনপাড়া, কর্মকারপাড়া, মুসলমানপাড়া, সব পাড়ার লোককেই নেমন্তন্ন করা নিয়ম।

শোভারাম বলেছিল–দয়া করে দায় উদ্ধার করবেন হাশেমসাহেব, বুঝতেই তো পারছেন আমার কন্যাদায়–

এরকম চলে। হাশেম আলি হাতিয়াগড়ের পুরনো লোক। দায়ুদ খাঁ’র আমলে বাংলাদেশে এসেছিলেন তার পূর্বপুরুষরা। তারপর মোগল আমলে সরকারি চাকরি চলে যাবার পর থেকে বংশপরম্পরায় ব্যাবসা শুরু করেন। সেই থেকে বংশ-পরম্পরায় এঁরা হাতিয়াগড়ে তুলোর ব্যাবসা করেন। একেবারে বাঙালি হয়ে গেছেন।

বললেন–যাব বই কী শোভারাম, নিশ্চয়ই যাব–তোমার মেয়ের বিয়েতে যাব না!

আবার হাশেম সাহেবের বাড়ির কোনও উৎসবেও অমনি করে শোভারামের বাড়িতে এসে তিনি গলবস্ত্র হয়ে নেমন্তন্ন করে যান। বলেন–এসো কিন্তু ঠিক শোভারাম, বুঝতেই তো পারছ আমার কন্যাদায়–

নিমন্ত্রণ পরস্পর পরস্পরকেই করে। যায়ও। তবে খাওয়াটা চলে না। নিমন্ত্রণে আপত্তি নেই। আপত্তিটা খাওয়ায়। সেই হাশেমসাহেব এসেছিলেন শোভারামের মেয়ের বিয়েতে। শোভারামের খড়ের চালের ঘর। তিনখানা ঘর, সামনে উঠোন, উঠোনটা ঘিরে লোকজনের আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়েছিল। হাশেমসাহেব এসেছিলেন জাব্বাজোব্বা পরে। যেমন ভাবে আসার রীতি। সকলকে আদাব জানালেন। আয়োজন কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করলেন। ছোটমশাই এসেছেন কিনা তাও জিজ্ঞেস করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন–বর এসেছে নাকি?

আজ্ঞে এই এল বলে। সেই অনেক দূর থেকে আসবে কিনা, তাই একটু দেরি হচ্ছে—

বর কোথায় থাকে?

আজ্ঞে ফিরিঙ্গি কোম্পানির দফতরে চাকরি করে। বিয়ের লগ্ন তো সেই দুই পহরে, তাই একটু দেরি হচ্ছে আর কী–

ভাল ভাল, বেশ–বলে হাশেমসাহেব সব শুনে গেলেন। মুসলমানপাড়া থেকে আরও কয়েকজন এসেছিলেন তারাও নিয়ম রক্ষা করে গেলেন। উঠোনের ওপর তখন খাওয়ার হুড়োহুড়ি চলছে। শোভারাম আয়োজন করেছে ভাল। পাকা ফলার কাঁচা ফলার দু’রকমের বন্দোবস্তই করেছে।

পুরকায়স্থ মশাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে।

কী গো সচ্চরিত্র, তোমার বর কোথায়?

বর আসছে বিশ্বাসমশাই, আপনি কিছু ভাববেন না, বাবাজির সাহেবের গদিতে মালখালাস করতেই দেরি হয়ে গেল, তাই আমি তড়িঘড়ি চলে এলাম, পাছে আপনি আবার ভাবেন!

তা বর কার সঙ্গে আসছে?

নাপিত বেটাকে রেখে এসেছি, নৌকোও তৈরি হয়ে আছে। আমি বাবাজীবনকে বলে এসেছি দরকার হলে কাজকম্ম ফেলে তুমি চলে আসবে। চাকরি তোমার অনেক হতে পারে, বিয়েটা তো আর রোজ রোজ হয় না কারও–

পুরকায়স্থ মশাই এক জায়গায় চুপ করে থাকার মানুষ নয়। আজ যাচ্ছে মুর্শিদাবাদে, তারপর দিনই আবার ঢাকা। আবার তার পরই বর্ধমান। হাতে খাতাপত্র, খালি-পা। সোজা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যেখানে একটু আশ্রয় মিলল সেখানেই রাতটা কাটিয়ে নিলে। তারপর আবার রওনা। নৌকোর মাঝিদের ডেকে হয়তো তাতেই উঠে পড়ল। তারপর সে-নৌকো যেখানে যাবে সেখানেই গিয়ে ওঠা। এমনি করেই জীবনটা কাটিয়ে দিলে সচ্চরিত্র।

তবু ভয় গেল না শোভারামের। জিজ্ঞেস করলে–বাবাজীবন ঠিক আসবে তো? মেয়ের বিয়ে আমার, বুঝতেই তো পারছ–

সচ্চরিত্র বললে–ঘটকালি করে করে আমার টাক পড়ে গেল বিশ্বাসমশাই, আর আমাকে আপনি শেখাচ্ছেন–

তা হলে তুমি এগিয়ে যাও সচ্চরিত্র, একটু এগিয়ে গিয়ে দেখো বর আসছে কি না—

তা হলে চটপট খাওয়াটা খেয়ে নিয়ে তারপর না হয় দেখছি! কী আয়োজন হয়েছে?

শোভারাম রেগে গেল। বললে–আগেই তোমার খাওয়া? বিয়ে না হতেই তোমার খাওয়ার দিকে নোলা?

ওদিকে তখন চিঁড়ে-দই পড়ে গেছে। হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তেলিপাড়ার লোক। সেই দিকে চাইতে চাইতে সচ্চরিত্র খাতা বগলে করে ছাতিমতলার ঢিবির দিকে বেরিয়ে গেল।

চালাঘরের ভেতরে তখন পাড়ার মেয়েরা মরালীকে নিয়ে পড়েছে। সকালবেলা গায়েহলুদ হয়ে গেছে। তখন থেকেই মেয়েদের ভিড়। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে সবাই। এখন বিয়ের কনে হিসেবে সবাই নতুন করে দেখছে।

কী গো, কনে কোথায়?

কথাটা কানে যেতেই সবাই পেছন ফিরল। ওই দুগগা এসেছে। দুর্গাবালা। ছোটমশাইয়ের বড়রানির

নয়ানপিসি বললে–হ্যাঁগো দুগগা, এই তোমার আসবার সময় হল গা?

দুগগা বললে–আমার কি একটা ঝামেলা দিদি, বড়রানিকে দুধ খাইয়ে এখন এলাম–দুগগাকে তোমাদের বলতে হবে না, দুগগা সকালবেলা এসে কনেকে নিয়ে রাজবাড়িতে ছোটমশাইকে দেখিয়ে নিয়ে এসেছে–

ছোটমশাই মুখ দেখে কী দিলে?

ছোটমশাই একজোড়া কঙ্কণ গড়িয়ে রেখেছিল। বড়মশাইয়ের আমলের নফর শোভারাম। তার মেয়ের বিয়েতে ভাল কিছু না দিলে চলে না। ছোটমশাইয়েরও এখন আর সে-অবস্থা নেই। নবাব সরকারের খাজনা আরও বেড়ে গেছে। খালসা সেরেস্তায় কানুনগোর ডাক পড়ে এখন। ছোটমশাইয়ের জমিদারি থেকে পুণ্যাহের দিন নবাব-সরকারের লোক যায়। গুণে গুণে মোহর দিয়ে নবাবের পায়ে নজর-পুণ্যাহ দিতে হয়। আর নজরানা কি একরকমের। মাথট চাই। আলগা খাজনা চাই। বয়খেলাৎ চাই। পোস্তাবন্দি চাই। তারপর আছে পাটোয়ারি, কানুনগো, মুনশি, মুহুরির পাওনা। নবাব সরকারের খাজনা দিতে গেলে শুধু মুখের কথায় হবে না। নবাবি কেল্লার সামনে আর লালবাগে ভাগীরথীতে পোস্তা বাঁধতে হবে–তার জন্যে পোস্তাবন্দি দাও। নবাবের ছেলের শাদি, নাতির শাদি, নাতনির শাদি হবে, সব খরচা দিতে হবে জমিদারদের। অথচ বড়মশাইয়ের সময়ে আগে শুধু ছিল আবওয়া খাসনবিশি। খালসা সেরেস্তার আমিন মুৎসুদ্দিদের পার্বনির নাম করে সেটা নেওয়া হত। তারপর দফায় দফায় বাড়তে লাগল। শেষে কিছু আর বাদ রইল না। কত রকমের আবওয়াব। কত তার দাপট। সরকারি পিলখানার খরচ হিসেবে দাও মাথট পিলখানা। হ্যাঁন ত্যান–কত কী!

যখন আদুরি ছিল, যখন বউ ছিল, তখন শোভারামের এমন দুরবস্থা ছিল না। তখন গায়ের জোর ছিল। তখন শোভারাম বড়মশাইয়ের কোরফা-প্রজা ছিল। কিন্তু তাও সময়মতো খাজনা দিতে না-পারায় ইস্তফাপত্র দিয়ে আসতে হল সেরেস্তায়। টাকায় তিন-চার গুণ চালের দর। খাজনা দেব কী দিয়ে। তারপর একদিন কেঁদে গিয়ে পড়ল বড়মশাইয়ের কাছে। বড়মশাইয়ের মান ছিল খাতির ছিল। প্রজাদের ওপর দয়া-মায়া ছিল। বড়মশাই বললেন–কোরফা ইস্তফা দিয়ে তুমি খাবে কী শোভারাম?

শোভারাম হাত-জোড় করে বড়মশাইয়ের পায়ের কাছে মাথা নিচু করে বলেছিল–হুজুরই আমার মা বাপ, হুজুরের পায়ের তলাতেই পড়ে থাকব–

কাজকর্ম কী জানো?

হুজুর যে-কাজ বলবেন তাই পারব!

তা পাইকের কাজ পারবে?

শোভারাম বলেছিল–আজ্ঞে বয়েস হয়েছে, এখন কি আর তেমন দৌড়ঝাঁপ করতে পারব?

বড়মশাই বলেছিলেন–আগের দিন হলে তোমার খাজনা মকুব করতে পারতাম শোভারাম, এখন নবাব-সরকার থেকে রোজই চিঠি আসছে মাথট দাও, মাথট না দিলে জমিদারি থাকবে না, পাটোয়ারি আর কানুনগোদের যা অত্যাচার–

বহুদিনের লোক শোভারাম। গড়বন্দি যখন মজবুত ছিল তখন থেকেই শোভারাম আছে হুজুরের কাছে। বাড়ির ভেতরে রানিমাদের কাছেও যাবার অধিকার আছে শোভারামের। কতবার রানিমার কাছে গিয়ে হাত-জোড় করে খাজনা মকুব করে এসেছে। সে মা-রানি আর নেই। এখন আর কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে।

বড়মশাই বলেছিলেন–তোমায় চাকরান জমি দেব, এখন থেকে তুমি আমার ঘরের কাজই করবে, বুড়ো বয়সে তোমার আর মেহনত করতে হবে না–

বড়মশাইয়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে গিয়ে সেদিন কেঁদে ফেলেছিল শোভারাম। সে বড়মশাই এখন আর নেই। শেষ জীবনে তীর্থে চলে গিয়েছিলেন। যাবার সময় হাতিয়াগড়ের কাউকে আর অসন্তুষ্ট রেখে যাননি। বড়মশাইয়ের তীর্থে যাবার কথাটা রটে যেতেই সবাই এসে হাজির। যার যা চাইবার চেয়ে নিয়ে গেল। বড়মশাই সামনে বসে থাকতেন নামাবলি গায়ে দিয়ে। পাশে জগা খাজাঞ্চিবাবু টাকার থলি নিয়ে বসে আছে।

কী রে, কী চাই তোর?

মাধব ঢালি মাথায় তেলকুচকুচে চুল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। নিচু হয়ে প্রণাম করল। বললে–কিছু চাইনে আজ্ঞে, বড়মশাইকে পেন্নাম করতে এসেছি–

ডাকাতি করছিস কেমন?

মাধব ঢালি লজ্জায় মাথা নিচু করল। বললে–হুজুর, ডাকাতি করবার কি আর জো আছে—

কেন, কী হল আবার?

আজ্ঞে, ডাকাতদের ধরে ধরে একেবারে আস্ত কোতল করছে, গোবিন্দপুরে আমাদের আর ঢোকবার সাহসবল নেই–

কেন, গোবিন্দপুরের হোগলাবনেই তো তোদের আড্ডা ছিল। কারা কোতল করছে?

হুজুর ফিরিঙ্গি কোম্পানি! ও-দিকটায় বন কেটে শহর করতে লেগেছে সব, আমাদের অন্ন গেল আজ্ঞে–

বড়মশাই জগা খাজাঞ্চির দিকে চেয়ে বললেন–জগা, মাধব ঢালিকে পাঁচটা মোহর আর পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে দাও তো

প্রণাম করে চলে যাচ্ছিল মাধব ঢালি। বড়মশাই বললেন–দেখিস মাধব, আমি কাশী চলে যাচ্ছি, ছোটমশাই রইল তোদের, তোদের হাতেই ছেড়ে দিয়ে গেলাম–

তারপর এল বিশু পরামানিক।

বিশু পরামানিককে কিছু বলতেই হল না। বড়মশাই বললেন–জগা, বিশুর নামে বিলের ধারের দু’বিঘে চাকরান জমি লিখে দাও তো, ওর বাপ আমাদের কামিয়েছে, ছেলেকে রেখে গেলাম রে, দেখিস তোরা, বুঝলি–

বিশু পরামানিক চলে গেল।

তারপর এল শোভারাম।

বড়মশাই বললেন–তোর কী চাই রে শোভারাম?

আজ্ঞে চাইনে কিছু!

বড়মশাই হাসলেন। বললেন–বউ মরে গেছে বলে তুই বিবাগী হয়ে যাবি নাকি? তোর মেয়ে মরালী রয়েছে না? তার বিয়ে দিতে হবে না? কত বয়েস হল মেয়ের?

আজ্ঞে, এই গেল চোত-কিস্তির সময়ে সাত বছরে পা দিয়েছে।

তা হলে? আর দেরি কেন? বিয়ে দিয়ে ফেল? মেয়ে দেখতে কেমন হয়েছে?

আজ্ঞে, বাপ হয়ে আর কোন মুখে বলব?

জগা খাজাঞ্চিবাবু পাশ থেকে বললে–আমি দেখেছি বড়মশাই, খুব সুন্দরী

তবে তো আর ঘরে রাখা ঠিক নয় রে। এখন নবাবি আমল, এ আমলে টাকাই বলো আর মেয়েমানুষই বলো, লুকিয়ে রাখতে না পারলেই সব বেহাত হয়ে যাবে, তুই বিয়ে দিয়ে ফেল–

শোভারাম বলেছিল–বিয়ে দিতে পারলে আমিও বাঁচি হুজুর, ভালমতন একটা পাত্তোর যে পাচ্ছিনে–

তা তোর যেমন অবস্থা তেমনই ঘরে দে, রাজা-মহারাজা খুঁজলে চলবে কেন?

শোভারাম বলেছিল-হুজুর, মেয়ের আমার খুব বুদ্ধি, একটা ভাল বুদ্ধিমান পাত্তোর পেলেই দু’হাত এক করে দেব–

কী নাম রেখেছিস মেয়ের?

ছোটমশাই নাম রেখেছেন মরালী। মরালীবালা।

বড়মশাই বলেছিলেন–মা-মরা মেয়ের অত নামের বাহার তো ভাল নয় রে, ওতে যে মেয়ের অকল্যণ হয়। ওকে মরুনি বলে ডাকিস, তাতে মেয়ে বেঁচে থাকবে, মেয়ের পরমাই বাড়বে—

তা সেই মেয়েরই আজ বিয়ে। বড়মশাই বেঁচে থাকলে আজ আনন্দ করতেন খুব। তীর্থ করতে তিনি সেই যে কাশীধামে চলে গেলেন তারপর বেশিদিন বাঁচলেন না আর। আর চিরকাল কে আর বেঁচে থাকতে এসেছে সংসারে। শোভারামও একদিন চলে যাবে। মেয়ের বিয়েটা দিয়ে দিলেই তার কাজ শেষ। তারপর ঝাড়া হাত-পা। কারও আর পরোয়া করবার দরকার নেই।

শোভারামের সেই বিয়েবাড়ির হুজুগের মধ্যেই সেইসব দিনের কথা মনে পড়তে লাগল।

যাবার সাতদিন আগে থেকে হাতিয়াগড়ের হাটের আটচালার নীচে জগা খাজাঞ্চিবাবু থলি-ভরতি টাকাকড়ি নিয়ে বসে থাকত।

চিৎকার করে বলত–হুজুরের কাছে কার কী পাওনা আছে, বলো গো তোমরা–

দেনা রেখে তীর্থে যেতে নেই তাই এই ব্যবস্থা। লেখাপড়া না থাক, হাতচিটেনা থাক, নথিপত্র দলিল দস্তাবেজ কিছুই দাখিল করতে হবে না। শুধু মুখ ফুটে চাইলেই জগা খাজাঞ্চি দিয়ে দেবে। কিন্তু একটা লোকও আসত না টাকা নিতে।

জগা খাজাঞ্চি ডাকত–ও মোড়লের পো, তোমার কিছু পাওনা আছে নাকি গো?

মোড়লের পো জিভ কাটত। বলত–কী যে বলেন খাজাঞ্চিমশাই, মিথ্যে বলে কি নরকে যাব নাকি?

কেউ কিছু নিতে এল না। এমনি করে একদিন তীর্থে চলে গেলেন বড়মশাই। হুজুরের সঙ্গে সঙ্গে যেন গাঁয়ের হাওয়াও বদলে গেল। এখান থেকে গঙ্গার পথ ধরে বজরা ছেড়ে দিলে। ঘাটের ধারে এসে দাঁড়াল সবাই। তর্কপঞ্চানন মশাই সংস্কৃতে কী সব বললেন। আশীর্বাদ করলেন। সঙ্গে মা-রানি। তিনিও মাথায় ঘোমটা দিয়ে বজরার ভেতরে গিয়ে বসলেন। সঙ্গে ঝি-চাকর-দরোয়ান গেল অন্য নৌকোতে।

শোভারাম গিয়ে বড়মশাইয়ের পায়ে হাত দিলে।

বড়মশাই বললেন–কে রে? শোভারাম বুঝি?

তারপর হাসতে হাসতে বললেন–মরুনির বিয়ের সময় নেমন্তন্ন করতে ভুলিসনে রে শোভারাম–

শেষদিকে বড়মশাইয়ের পা-টেপা থেকে শুরু করে তেল-মাখানো পর্যন্ত সমস্ত করত শোভারাম। মা-রানি শোভারামের সামনে বেরোতেন। বলতেন–তোমার মেয়েকে একদিন নিয়ে এসো শোভারাম, দেখব–

তা মরালীকে দেখে মা-রানির কী আহ্লাদ!

বললেন–এ যে দুগগো প্রতিমে রে শোভারাম, এই তোর মেয়ে?

হ্যাঁ, মা-জননী!

তারপর মরালীর দিকে চেয়ে শোভারাম বলেছিল–প্রেনাম কর মা-জননীকে, বল আশীর্বাদ করো মা, যেন তোমার মতো পুণ্যবতী হই, ভাল করে প্রেনাম কর, মাথা ঠেকিয়ে প্রেনাম কর–

নিজের মেয়ে হয়নি বলে মা-রানি বড় আদর করেছিলেন মরালীকে।

বলেছিলেন–এ মেয়ে তোর খুব সুলক্ষণা রে, মেয়েকে যত্ন করিস–

যত্ন আর কী করবে শোভারাম! জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনিই। মেয়ে নিজেই খুব সেয়ানা হয়ে উঠল বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে। সাত বছর যখন মরালীর বয়েস, তখন থেকেই সাজবার শখ। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে পাড়ায় পাড়ায় বেড়াত। রাস্তায় যাকে দেখবে তাকেই ডাকবে। বলবে-ও বিদ্যেধর, বিদ্যেধর।

বুড়ো মানুষ বিদ্যেধর। বড়মশাইয়ের বাড়িতে মাটির হাঁড়িকুড়ি জোগান দেয়। কুমোরপাড়ায় সাত পুরুষের বাস। বাপের বয়েসি মানুষ। ভালমানুষ গোছের চেহারা। সেও অবাক হয়ে যায়।

মরালী বললে–তুমি অমন করে আমার পানে চাইছ কেন গা?

ওমা, তোমার দিকে আবার কখন চাইলাম গো দিদি?

মরালী বললে–না, চেয়োনা, মেয়েমানুষের পানে অমন করে তাকাতে নেই—

বিদ্যাধর তো অবাক হয়ে গেল।

মরালী আবার বললে–তোমরা কেমন বেটাছেলে গা, গাঁয়ে আর দেখবার জিনিস নেই, মেয়েছেলের পানে চাওয়া?

শোভারামের কাছে গিয়েও অনেকে বলত–এ-মেয়ে তোমায় জ্বালাবে অনেক, মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলো শিগগির

তা বিয়ে অমনি দেব বললেই কি দেওয়া যায়। কথায় বলে হাজার এক কথায় বিয়ে। জাত-কুলবংশ-স্বভাব সবকিছুই দেখতে হবে তো! বড়মশাই জাত নিয়ে বড় মাথা ঘামাতেন। বলতেন–তোরা কী জাত রে শোভারাম?

শোভারাম বলত–আমরা সৎশূদ্র বড়মশাই—

সৎশূদ্র? সে আবার কী রে?

সিদ্ধান্তবারিধি মশাই পাশেই থাকতেন। তিনি বলতেন–আজ্ঞে সৎশূদ্র কথাটা বড় গোলমেলে বড়মশাই, শাস্ত্রে আছে

গোপো মালী চ কাংসার তন্দ্রিসাংখিকাঃ।
কুনাল কর্মকারশ্চ নাপিতো নব শায়কাঃ।
তৈলিকো গান্ধিকো বৈদ্য সচ্ছুদ্রাশ্চ প্রকীর্তিতা।
সচ্ছুদ্রানান্ত সকৈষাং কায়স্থ উত্তম সৃতঃ—

বড়মশাই জিজ্ঞেস করতেন–অর্থ?

ওর অর্থ বড় গোলমেলে বড়মশাই, অর্থাৎ আপনিও যা ও-ও তাই, তবে ওর বাড়িতে ক্রিয়াকর্মে আমরা দক্ষিনে নেব, কিন্তু সিধা গ্রহণ নিষেধ, তার জন্যে অর্থমূল্য ধরে দিতে হবে, আর আপনার বাড়িতে সিধাও নেব, কিন্তু অর্থমূল্যের পরিবর্তে স্বর্ণমূল্য! হিন্দুধর্মের ওই তো মজা হুজুর, এখানে অনাচারটি পাবেন না–

সেই জন্যেই বুঝি তোর মেয়ের পাত্র পাচ্ছিসনে?

শোভারাম বলত–আজ্ঞে পাত্র পাচ্ছি, সুলতানুটিতে আমাদের স্বঘরের একটি পাত্র পাচ্ছি– আপনি যদি হুকুম করেন…

কথা শেষ হবার আগেই বড়মশাই খেপে উঠতেন। ম্লেচ্ছদের সঙ্গে ওঠাবসা করে তাদের কি জাত আছে নাকি? ম্লেচ্ছদের ছোঁয়া জল খায়, ম্লেচ্ছদের কাছে চাকরি করে, তার সঙ্গে শোভারাম মেয়ের বিয়ে দেবে? বরাবর বড়মশাই তাতে বাধা দিয়েছেন। আর পাত্র পেলি না?

তা এখন সেই বড়মশাইও নেই, এদিকে মেয়েরও বয়েস বেড়ে যাচ্ছে। শেষকালে মেয়ের সামনে শোভারামের গলা দিয়ে আর ভাত নামত না। গাঁয়ের লোক শেষকালে শোভারামকে একঘরে করেই ছাড়ত। নেহাত ছোটমশাই ছিলেন বলে এতদিন কেউ ধোপা-নাপিত বন্ধ করেনি। যাক, এতদিনে শোভারামের গলা থেকে কাটা নামল। এখন ভালয় ভালয় সম্প্রদানটা হয়ে গেলে হয়।

হঠাৎ দৌড়োতে দৌড়োতে হরিপদ এসে হাজির।

দাদা, ওদিকে সব্বনাশ হয়েছে–

কী সব্বনাশ রে? বর আসেনি? বরকে দেখলিনে?

হরিপদর মুখের কথা তখন আটকে গেছে। বললে–তুমি একবার ছোটমশাইয়ের কাছে চলো, বিপদ হয়েছে ওদিকে–

বিপদ? বিপদটা আবার দেখলি কোথায়? বর না এলে যে পাতক হয়ে যাব রে! বলছিস কী তুই?

হরিপদ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললে–সেপাই দেখে আমরা বড্ড ভয় পেয়ে গেছি দাদা! ফৌজদারের সেপাই!

ফৌজদারের সেপাই!

হ্যাঁ দাদা, ছোটমশাইয়ের বাড়ির নিশেনা চাইলে আমাদের কাছে, ঘোড়া ছুটিয়ে আসছিল।

তা ফৌজদারের সেপাই ঘোড়া ছুটিয়ে এল তো আমার কী! আমি কি খাতক না উঠবন্দি প্ৰেজা যে, বাকি খাজনার দায়ে আমায় নিজামতি-কাছারিতে টেনে নিয়ে যাবে! সচ্চরিত্র কোথায় গেল? সে বেটারই তো যত নষ্টামি। সে বরকে সঙ্গে না-নিয়ে আসে কেন? সে কি নেমন্তন্ন খেতে এসেছে? কোথায় গেল সে?

চেঁচামেচিতে কিছু লোকজন এসে দাঁড়াল। কী হল শোভারাম! বর আসছে না? নয়ান পিসিও গোলমাল শুনে এসে হাজির। দুগগাও এসে সব শুনল। গালে হাত দিয়ে বসল সবাই। সর্বনাশের মাথায়। পা। এখন যদি বর সত্যি-সত্যি না-আসে তো কী হবে। শোভারামের জাত কুল কী করে থাকবে। শোভারামের মেয়ের অবস্থাটা কী হবে! এর পর কেউ কি আর তার হাতের ছোঁয়া জল খাবে! কেউ তার মুখদর্শন করবে? আহা গো, বড় যে তার ভাতারের শখ! সেই তোর কপালেই এমন হতে হয়। চারদিকে মরাকান্নার রোল উঠল। জাত-কুল-জন্ম-ধর্মকর্ম সব যে রসাতলে গেল পোড়াকপালির।

পুরুতমশাইও সব শুনছিলেন। তিনি এবার এগিয়ে এলেন শোভারামের কাছে। বললেন–কী করবে এখন ভাবো বাবাজি, এ তো সহজ কথা নয়–।

শোভারামের তখন আর মাথার ঠিক নেই, বললে–দেখি, সেই সচ্চরিত্র ঘটকবেটা কোথায় গেল, বেটা নামেই সচ্চরিত্র কেবল–

পুরুতমশাই বললেন–তাকে পরে খুঁজলে চলবে, এখন লগ্ন বয়ে যাচ্ছে। মেয়ের সদগতি কীসে হবে তাই আগে ভাবো তুমি গাঁয়ে আর পাত্র নেই?

নতুন পাত্র এক্ষুনি কোথায় পাই?

কেন, হরিশ তো রয়েছে, কুমোরপাড়ার হরিশ জোয়াদ্দার—

শোভারাম আগুন হয়ে উঠল–তার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেব, আপনি বলছেন কী? তার ছটা বউ, তা জানেন–

তা ছ’টা বউ আছে, না-হয় সাতটাই হবে, সে-সব এখন ভাবলে চলে? আগে জাত, না আগে মান!

তার চেয়ে আমার মেয়েকে আমি জলে ডুবিয়ে মারব না! সাতটা নয় পাঁচটা নয়, ওই আমার একটা মাত্তর মেয়ে। আমি কি জেনেশুনে মেয়েকে মেরে ফেলব?

তা হলে তুমি যা ভাল বোঝো তাই করো! তোমার বাড়িতে তা হলে কিন্তু যাগ-যজ্ঞ ক্রিয়াকলাপ সব আমাদের বন্ধ–আমি তা হলে আসি–

শোভারামের মাথায় তখন বজ্রাঘাত হলেও বুঝি ভাল ছিল। তাড়াতাড়ি পুরুতমশাইয়ের সামনে হাতজোড় করে বললে–আপনি আমাকে একটু ভাবতে দিন ঠাকুরমশাই, আমি একবার নিজে গিয়ে দেখি বর আসছে কিনা–

পুরুতমশাই বললেন–কিন্তু লগ্ন তো আর তোমার মেয়ের জন্যে বসে থাকবে না বাবাজি–লগ্ন উতরে গেলে যে মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে, তার খেয়াল আছে–

কিন্তু পাত্র তো খুঁজে বার করতে হবে, তাতেও তো সময় লাগে–

পুরুতমশাই বললেন–পাত্রের কি অভাব, ছোটমশাইয়ের অতিথিশালায় গিয়ে একবার খোঁজ করে কাউকে ধরে-বেঁধে নিয়ে এসো না–আগে জাতটা তো রক্ষে হোক, তারপরে না-হয় স্বভাব-চরিত্র বংশকুলুজি দেখবে–

হরিপদর মাথায় আসেনি কথাটা। তাড়াতাড়ি বলে উঠল–তাই যাই দাদা, অতিথিশালাটা একবার দেখে আসি–

বলে আর কারও কথায় কান না দিয়ে হরিপদ সোজা রাজবাড়ির দিকে ছুটল।

হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের বাড়িতে অতিথিশালা ছিল। বড়মশাইয়ের আমলেই নতুন করে অতিথিশালাটা সারিয়ে বড় করা হয়। বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে হাঁটা-পথে যে-সব বাউল-ফকির-উদাসী-ভবঘুরে লোক হাতিয়াগড়ে আসত তাদের থাবার জন্যে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তারা সিধে পেত। মাথাপিছু ডাল-চাল-কাঁচকলা-নুন-তেল কাঠ-হাঁড়ি-মশলা সবই বরাদ্দ ছিল।

বড়মশাইয়ের জগা খাজাঞ্চিবাবুকে রোজকার হিসেব দিতে হত। রামেশ্বর সরকার নিজে গিয়ে সামনে বসে হিসেব বুঝিয়ে দিত জগা খাজাঞ্চিবাবুকে।

আজ ক’জন?

আজ্ঞে, আজ এককুড়ি দু’জন।

তা এককুড়ি দু’জনে আমন চাল খেয়ে ফেললে?

বড়মশাই বলতেন–থাক জগা, ও নিয়ে আর তুমি সময় নষ্ট কোরো না, রামেশ্বর তো মিছে কথা বলছে না।

আজ্ঞে হুজুর, আধমন চালে যে পরশুদিন চল্লিশজন লোক ভাত খেয়েছিল।

তা খাক, দুটো পেটে খাবে তাও দিতে পারব না আমি? পেটেই তো খেয়েছে, কোচড়ে করে তো বাড়ি নিয়ে যায়নি।

আবার এক-একদিন হয়তো কেউ-ই আসত না। সেদিন অতিথিশালা খাখা করত। অতিথিশালার দাসী-মুনিষরা সেদিন কেউ রোদ্দুরে পা ছড়িয়ে কথা সেলাই করত, কেউ বা চাল-ডাল বাছতে বসত। বিরাট রাজবাড়ি। এ-মহল থেকে ও-মহলে যেতে গেলে পাড়া-বেড়ানো হয়ে যায়। কিন্তু এক-একদিন যখন অতিথিশালায় ঝগড়া বাধে সেদিন বাড়ির ভেতরে সকলের কানেই যায়। ঝগড়া বাধে অতিথিদের মধ্যেই। কর্তাভজার সঙ্গে হয়তো ঝগড়া বাধে বলরামভজার দলের। কিংবা সাহেব-ধনীদের সঙ্গে আউলাদের দলের ঝগড়া। কত রকম সাধু কত রকম ধর্ম। ধর্মের বিচার অত সহজ নয়। কর্তাভজারা বলে—’লোকের মধ্যে লোকাচার, সদ্গুরুর মধ্যে একাকার।’

লোকে জিজ্ঞেস করত–আপনি কে গো?

তারা বলত–আমরা কর্তাভজা বাবা–আমরা হলাম বরাতি—

বরাতি মানে?

বাউলরা বলত–ওদের কথা ছেড়ে দাও বাবাজি, ওদের মধ্যে ওইসব আছে, কে গুরু কে বরাতি তাই নিয়ে ওরা মাথা ঘামায়–আমাদের ওসব বালাই নেই–

ওসব নেই বটে, কিন্তু ঝগড়া যখন বাধে তখন হয়তো একটা সামান্য জিনিস নিয়েই বাধে। একই উঠোনের মধ্যে কেউ আলখাল্লা কেচে শুকোতে দিয়েছে, তা আর পাওয়া যায় না। সামান্য একটা আলখাল্লা। ভেঁড়া তালিমারা জিনিস। কারটা একদিন কে গায়ে দিয়ে ভোর-ভোর অতিথিশালা ছেড়ে চলে গিয়েছে। তখন সেই নিয়েই চিৎকার শুরু হয়ে যায়। গলা ছেড়ে চিৎকার করে–যত বেটা চোর-ছ্যাঁচড়ের আমদানি হয়েছে অতিথিশালায়,–সাধু-সন্নিসীদের আর থাকা যায় না এখেনে–

আর একজন এককোণে এতক্ষণ শুয়ে ছিল। সে চেঁচিয়ে উঠল–চোর-ছ্যাঁচড় বলছ কাকে শুনি, আমি চোর–?

তুমি চুপ করো তো হে, তুমি তো বলরামভজার লোক—

লোকটা আউলচাঁদের দলের। চিৎকার করে ঘুষি বাগিয়ে লাফিয়ে আসে–তবে রে শালা–

তারপর সেই অতিথিশালার মধ্যে যে কাণ্ড শুরু হয় তাতে সকলের জড়ো হবার পালা। হাতাহাতি মারামারি পর্যন্ত গিয়ে ওঠে। কর্তাভজার সঙ্গে বলরামভজার, আউলচাঁদের সঙ্গে সাহেবধনীর ঝগড়া। তখন সকলের ভেতরের মানুষটা বেরিয়ে আসে। এমনিতে কেউ কারও ছোঁয়া খায় না, ছায়া মাড়ায় না। কিন্তু মারামারি হলে তখন আর জ্ঞানগম্যি থাকে না কারও। তখন জগা খাজাঞ্চিবাবু পর্যন্ত দৌড়ে আসে। বলে–বেরোও এখান থেকে, বেরোও–

একজন বলে আমি কেন বেরোব, আমি কি জাত ভাঁড়িয়ে বোষ্টম? ও আগে চাড়াল ছিল তা জানেন খাজাঞ্চিবাবু? ওর মেসো এখনও ঢাকায় শ্মশানঘাটে মড়া পোড়ায়–

আর তুই বুঝি ভাল জাত? তুই যে পোদ! পোদ থেকে হইছিস কর্তাভজা? পোদের জল চলে? বলুন তো খাজাঞ্চিবাবু, পোদের জল চলে?

যেদিন উদ্ধব দাস থাকে, সেদিন সবাই তাকে সাক্ষী মানে। বলে–তুমি বলো তো বাবা, তুমি বলো তো, পোদ কি ছোট জাত?

তা চাঁড়ালের থেকে তো ছোট বটে! বলো না উদ্ধব দাস, বলো না—

উদ্ধব দাস শুধু হাসে। অনেক পীড়াপীড়ি করলে বলে–আমার এখন খিদে পেয়েছে ভাই, এখন ঝগড়া করবার ক্ষেমতা নেই তোমরা ঝগড়া করো আমি শুনি–

তারপর হঠাৎ গান গেয়ে ওঠে–

হরি কে বুঝে তোমার লীলে।
ভাল প্রেম করিলে।
হইয়ে ভূপতি, কুবুজা যুবতী পাইয়ে শ্রীপতি,
শ্ৰীমতী রাধারে রহিলে ভুলে।
শ্যাম সেজেছ হে বেশ, ওহে হৃষীকেশ,
রাখালের বেশ এখন কোথা লুকালে।
মাতুল বধিলে প্রতুল করিলে।
গোপ-গোপীকুলে, অকূলে ভাসায়ে দিলে ।।

উদ্ধব দাস গান গাইলে সবার ঝগড়া থেমে যায়। উদ্ধব দাসের গানের আদর সর্বত্র। ওই গানের জন্যেই তার খাতির। একটা যন্ত্র নেই, ডুগি-তবলা নেই, একতারাও নেই। শুধু-গলায় গান গায় উদ্ধব দাস। উদ্ধব দাস বামুনও নয়, চাঁড়ালও নয়, পোদও নয়। উদ্ধব দাস বলে আমি কর্তাভজা-বলরামভজা আউল-বাউল-সাহেবধনী কিছুই নই গো

তা হলে তুমি কী?

আজ্ঞে আমি উদ্ধব দাস। হরির দাস–

শুধুই উদ্ধব দাস! অতিথশালায় এলে কেউ জিজ্ঞেস করলেই ওই নামটা শুধু বলে। কোত্থেকে আসছ, কোথায় যাবে, তারও উত্তর নেই। কোথায় যাব তা কি কেউ বলতে পারে ঠাকুর? আজকে এখানে এসেছি, কাল বাঁচব কি না কে বলতে পারে?

এই অতিথিশালাতেই হরিপদর সঙ্গে ভাব হয়ে গিয়েছিল উদ্ধব দাসের। উদ্ধব দাসের না আছে। কোনও শখ, না আছে কোনও বিকার। যা দাও তাই খাবে। দুটি খেতে পেলে আর কিছু চায় না। এইখানেই হরিপদ প্রথম দিন এসে ধরেছিল উদ্ধব দাসকে।

বলেছিল–তুমি কে গো?

আমি উদ্ধব দাস।

হরিপদ বলেছিল–শুধু উদ্ধব দাস বললে–চলবে না, তোমার বাড়ি কোথায়, তুমি কী করো–

উদ্ধব দাস রেগে গিয়ে বলেছিল–এই দেখো, তুমি তো আমাকে জ্বালালে হে! যখন যেখানে থাকি। সেই-ই আমার বাড়ি, সেই আমার ঘর।

কী করো তুমি?

দুনিয়াতে কে কী করে শুনি? করনেওয়ালা তো মাথার ওপর। সে যা করাচ্ছে তাই সবাই করছি। আকবর বাদশা যা করে গেছে, তোমার ছোটমশাই যা করছে, আমিও তাই করছি–খাচ্ছি দাচ্ছি আর ভ্যারেন্ডা ভাজছি–

সেই থেকেই হরিপদ মজা করত উদ্ধব দাসকে নিয়ে। অতিথিশালায় যারা আসে তাদের মতো জ্বালাতন করে না হরিপদকে। দাও খাব, না-দাও খাব না। খুশি হয়ে একখানা গান শুনিয়েছিল উদ্ধব দাস। তার পরদিনই হরিপদ এসে বললে–দাসমশাই, তোমাকে চুপি চুপি একটা কথা বলব, সেই গানটা একবার গাইতে হবে–

কী গান?

ওই যে কালকে গেয়েছিলে? আমাদের দুগগা তোমার গানটা শুনতে চেয়েছে!

দুগগা? দুগগা কে গো? মা-দুগগা?

আরে দুর, আমাদের দূগগা। আমাদের বড়রানির পেয়ারের ঝি।

দুগগার কথা সেই প্রথম শুনল উদ্ধব দাস। দুগগা হল রাজবাড়ির পাট-ঝি। দুগগা না হলে কোনও কাজই হবে না অন্দরমহলে। বড়রানির বিয়ের সময় বাপের বাড়ির থেকে নতুন বউয়ের সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। তারপর ছোটমশাই আবার একটা বিয়ে করেছে, কিন্তু সেই ছোটরানিও দুগার হাতের মুঠোর মধ্যে।

উদ্ধব দাস বললে–তা সেটা যে রসের গান গো হরিপদ, সে গান মেয়েছেলে শুনবে?

হরিপদ চোখ মটকে বলেছিল রসের গান বলেই তো শুনবে। তুমি তো জানোনা দাসমশাই, দুগগার বড় রস–

কী রকম?

হ্যাঁ, যা বলছি তাই। ওই রসেই তো একেবারে মজিয়ে দিয়েছে রানিদের। তুমি বিয়েথা করোনি। ওসব বুঝবে না–

তা সেইদিন দুপুরবেলাই ব্যবস্থা হয়েছিল গানের। কেউ ছিল না তখন। রান্নাশালার বামুনঠাকুর কাজকর্ম সেরে বাইরে গিয়েছে। বেশ করে কড়াইয়ের ডাল দিয়ে ভাত মেখে পেট ভরে খেয়ে একটু তন্দ্রা মতন এসেছিল, এমন সময় হরিপদ এসে ঠেলা মারলে। বললে–ওঠো দাসমশাই চলো–

কোথায় গো?

চলো, দেরি কোরো না, ছোটরানি গান শুনবে বলে বসে আছে দরদালানে–

উদ্ধব দাস এমনিতে উদাসী মানুষ কিন্তু কথাটা শুনে ভয় পেয়ে গেল। রসের গান শুনে যদি ছোটমশাই রাগ করে। রসের গান কি যাকে-তাকে শোনানো যায়। রসিক ছাড়া কি রস বোঝে কেউ?

হরিপদ বললে–আরে, রসের গান শুনতেই তো ছোটরানি চায়, ওই তোমার ভক্তিরসের গান নয়, ছোটরানির কাঁচা বয়েস এখন, রস করবে না তো কি হরিনামের মালা জপবে?

ছোটরানির কাঁচা বয়েস?

হরিপদ বলেছিল–কাঁচা বয়েস হবে না? ছোটমশাইয়ের যে দ্বিতীয় পক্ষের বউ–বড়রানির ছেলে হল না, তাই তো ছোটরানিকে ঘরে এনে তুলেছে–

ছোটরানির ছেলে হয়েছে?

এবার বিরক্ত হয়ে গেল হরিপদ। কথা যদি বলবে তো গান গাইবে কখন দাসমশাই। ততক্ষণে ভেতর-বাড়ি পেরিয়ে রানিবিবি এসে গেছে। সেই কোথায় অন্দরমহল। একটা মহলের পর আর একটা মহল। এমনি সাতটা মহল পেরিয়ে তবে অতিথিশালার দোতলার দরদালানে আসতে হয়। সেখানে পঙ্খের কাজ করা ইটের জাফরির ফাঁক দিয়ে উঠোনের ভেতরটা সব দেখা যায়। ভেতর থেকে কার গলা শোনা গেল–কই রে হরিপদ, গান করতে বলো–

হরিপদ বললে–ওই দুগা আরম্ভ করে দাও গো ছোটরানি দরদালানে এসে হাজির হয়েছে–

কোন গানটা গাইব?

রসের গান, মেয়েছেলেরা রসের গানই চায় যে দাসমশাই—

উদ্ধব দাস আরম্ভ করলে প্রাণ রে, পিরিতের কথা আর বোলো না–

হরিপদ বাহবা দিয়ে উঠল–বাঃ বাঃ, খাসা–

প্রাণ রে, পিরিতের কথা আর বোলো না।
পিরিত করলাম প্রাণ জুড়াতে
বুকে ধরলাম প্রাণনাথে
তাতে আমার বুকের জ্বালা বাড়ল বই কমল না।
প্রাণ রে পিরিতের কথা আর বোলো না।

হরিপদ আর থাকতে পারল না। চিৎকার করে উঠল–বা দাসমশাই, বেশ—বেশ–

প্রাণ রে, তুষের আগুন ছিল ভাল।
আমিও ছিলাম প্রাণও ছিল।
এই যে আমিও গেলাম প্রাণও গেল
সবই হল ভস্মীভূত, আমার কিছুই রইল না।
প্রাণ রে, পিরিতের কথা আর বোলো না।

হরিপদ আবার বাহবা দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই উদ্ধব দাস গান থামিয়ে দিয়েছে। মুখ ফিরিয়ে বললে–গড় হই গো খাজাঞ্চিমশাই—

কে তুই?

জগা খাজাঞ্চিবাবু এমনিতে এখানে আসে না। কিন্তু হয়তো নির্জন দুপুরবেলায় গানের শব্দ শুনে ঢুকে পড়েছে।

নটবর বললে–ও উদ্ধব দাস, খাজাঞ্চিমশাই–

খাজাঞ্চিমশাই বললে–ওইসব গান দুপুরবেলা এখানে কে গাইতে বলেছে তোকে, বেরো এখান থেকে বেরিয়ে যা–কে ঢুকতে দিয়েছে তোকে–

উদ্ধব দাস বললে–অভাজনের নিবেদন শুনুন প্রভু–

শুনো ভাই সভাজন, অভাজনের নিবেদন।
একে একে শ্রীরামচন্দ্রের কহি বিবরণ।
দেখো ভাই শ্রীরামচন্দ্র জগৎচন্দ্র কোথা হবেন রাজা।
তাহাতে কৈকেয়ী মাগি দিলেন আচ্ছা সাজা।
পরিয়ে জটা বাকল আর সকল ত্যজি অলংকার।
পাঠাইল অরণ্যেতে চতুর্দশ বৎসর।
রাম নিজ গুণে ভ্রমেণ বনে যথায় তথায়।
সীতা সতী গুণবতী দারুণ কষ্ট পায়।
শুনো একদিন দৈবাধীন আসি বসুন্ধরা…

খাজাঞ্চিবাবু আর থাকতে পারলে না। বললে–ওরে বাবা, এ যে আবার ছড়া কাটে রে—

হরিপদ বললে–আজ্ঞে, কালকে ও আমাদের মানভঞ্জনের পালা শুনিয়েছে–

উদ্ধব দাস বললে–আমি মানভঞ্জন পালা গাইতে পারি, কালীয়দমন পালা গাইতে পারি, অধীনের গুণের সীমে নাই প্রভু, আজ্ঞা হয় তো গাই এখন–

খাজাঞ্চিবাবুর তখন অত সময় নেই। বললে–এ কোত্থেকে আমদানি হল রে হরিপদ?

হরিপদ বললে–আজ্ঞে সেবার সেই এক সন আগে একবার এসেছিল, আবার এসে জুটেছে, গানটান গায় বলে আর তাড়িয়ে দিইনি, ভারী নির্ঞ্ঝাট লোক, দুটো ভাত পেলেই খুশি আর অতিথিশালায় পড়ে থাকে–

তারপর উদ্ধব দাসের দিকে চেয়ে বললে–দাসমশাই, তোমার সেই মাথুরটা শোনাও না একবার খাজাঞ্চিমশাইকে–

উদ্ধব দাসকে আর দু’বার বলতে হয় না। বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে এক কানে হাত চাপা দিয়ে গায়–

এ যমুনা পারে কে আনিতে পারে
আমরা ব্রজের কুলবালা।

খাজাঞ্চিমশাই চেঁচিয়ে উঠলদুর হ, দুর হ-বড় বউরানির কানে গেলে হয়েছে আর কী—

উদ্ধব দাস বললে–সবই আমার নিজের তৈরি প্রভু—

হরিপদ বললো খাজাঞ্চিবাবু, মুখে মুখে হেঁয়ালি বানায় আবার—

উদ্ধব দাস বলতে লাগল বলুন তো প্রভু কী?

সূর্য বংশে জন্ম তার অজ রাজার নাতি।
দশরথ পুত্র বটে নয় সীতাপতি।
রাবণের অরি নয় লক্ষ্মণের জ্যেষ্ঠ।
ভনে কবি উদ্ধব দাস হেঁয়ালির শ্রেষ্ঠ।

হরিপদ জিজ্ঞেস করলে–-বলুন তো খাজাঞ্চিমশাই, এর উত্তর কী হবে?

খাজাঞ্চিমশাই বললে–দুর, এসব ভাববার সময় আছে আমার! তোর দেশ কোথায়?

উদ্ধব দাস ছড়া কেটে উঠল–

আমার কাজ কী সংসারে হরি।
আমি রাধার দুঃখে গোকুল ছেড়ে হইলাম দেশান্তরী।

দেখলেন তো খাজাঞ্চিমশাই, ছড়ার নমুনা দেখলেন তো। গরিব লোক, অতিথিশালায় উঠেছে, থাক না ক’দিন, আপনি যেন আর কিছু বলবেন না—

খাজাঞ্চিবাবু আর কিছু বললে না। ব্যাজার হয়ে চলে গেল। সব রস মাটি। ভেতরে দুগাও বোধহয় ছোটরানিকে নিয়ে অন্দরমহলে চলে গিয়েছে। সেদিক থেকেও আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। আর গান জমবে না।

উদ্ধব দাস বললে–আমিও যাই হে—

কেন? তুমি আবার যাবে কী করতে?

নেমন্তন্ন খেতে ইচ্ছে করছে। অনেক দিন নেমন্তন্ন খাইনি—

তা কী খাবে বলো না; ভোগবাড়িতে বলে দিচ্ছি, রান্না করে দেবে!

উদ্ধব দাস বললে–মুগের ডাল—

আরে এই সামান্য কথা, তার জন্যে ভাবনা, আজই মুগের ডাল বেঁধে দেব তোমায়—

উদ্ধব দাস পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে উঠল। বললে–দুর, তোমাদের মুগের ডাল আর খাচ্ছি আমি, আমি চললুম

কী গো? সত্যি সত্যিই যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ?

কেষ্টনগরে।

হঠাৎ কেষ্টনগরে কেন?

ওই যে মুগের ডালের কথা মনে পড়ে গেল, যাই, কেষ্টনগরের রাজাবাবুদের বাড়ি যাই, অমন মুগের ডাল কোত্থাও খাইনি গো–

এমনি করে উদ্ধব দাস এই হাতিয়াগড়ের অতিথিশালায় অনেকবার এসেছে গেছে। হরিপদর সঙ্গে হাসিতামাশা করেছে। বাড়ির ছোটরানিকে গানও শুনিয়েছে। যেমন মুগের ডাল খেতে একদিন হঠাৎ কেষ্টনগরে চলে যায়, তেমনই আবার হয়তো কয়েকদিন এখানেই পড়ে থাকে। অতিথিশালায় দুটো ভাত পেলেই খুশি। তাড়িয়ে দিলেও ব্যাজার নেই। আবার হয়তো একদিন পোটলা-পুঁটলি নিয়ে কোথায় বেরিয়ে পড়ে। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে–কী গো, কোথায় চললে দাসমশাই–

উদ্ধব দাস বলে–গুপ্তিপাড়ায়–

গুপ্তিপাড়ায় কেন গো?

গুপ্তিপাড়ায় চড়ক দেখে আসি—

তা আমাদের পাড়াতেও তো চড়ক হবে, থাকো না–

উদ্ধব দাস বলে–না গো, সেখানে মূল সন্নিসি এবার পিঠে বাণ ফুড়বে, পিঠে বাণ ছুঁড়ে চড়ক গাছে উঠে ঘুরপাক খাবে, যেতে বলেছে–

তারপর আবার বহুদিন উদ্ধব দাসের দেখা নেই।

তা উদ্ধব দাস এইরকম। শোভারামের মেয়ের বিয়েতে অতিথিশালার কথাটা উঠতেই হঠাৎ উদ্ধব দাসের কথাটা মনে পড়ল হরিপদর। রাত তখন অনেক। দাসমশাই তখন হয়তো খেয়েদেয়ে নাক ডাকাচ্ছে।

অতিথিশালার উঠোনের পাশে খালি বোয়াকের ওপর অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হরিপদ এসে গায়ে ঠেলা দিলে।

ও দাসমশাই, ওঠো ওঠো—

ধড়মড় করে উঠে বসেছে উদ্ধব দাস। উঠে বসেই সামনে চেয়ে দেখে দু’জন লোক। হাতে মশাল জ্বলছে। প্রথমটায় চিনতে পারেনি। কারা আবার এল বিরক্ত করতে। চোখ দুটো রগড়ে ঠিক করে দেখলে।

আমি গো দাসমশাই, আমি। আমি হরিপদ, তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি।

শোভারাম তখন একদৃষ্টে চেয়ে দেখছে উদ্ধব দাসের দিকে। এই তার জামাই। তার যে একমাত্র মেয়ে। মেয়েকে যে অনেক আদরে মানুষ করেছে শোভারাম। সেই মেয়েকে এই এর হাতে তুলে দেবে শেষকালে!

হরিপদ শোভারামকে সান্ত্বনা দিয়ে বললে–উদ্ধব দাস আমাদের সৎসুস্থ, কোনও কিছুতে আটকাবে না দাদা, আমি বলে দিচ্ছি তোমার মেয়ে সুখে থাকবে—

শোভারামের তখন জীবন-মরণ সমস্যা। তার তখন আর ভাববার সময় নেই। বললে–আমি আর ভাবতে পারছিনে হরিপদ, যাতে আমার জাতটা থাকে তাই দেখো–

হরিপদ উদ্ধব দাসের সামনে নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করলে–নতুন কাপড় পরতে হবে তোমাকে দাসমশাই, তোমার নতুন কাপড় আছে?

উদ্ধব দাস বললে–নতুন কাপড় কী হবে?

শোভারাম বললে–থাক থাক, আমার কাছে নতুন কাপড় আছে, আমি নতুন কাপড় দেবো’খন–চলো, চলো–

উদ্ধব দাস তবু জিজ্ঞেস করলে–নতুন কাপড় কী হবে তাই বলো না—

হরিপদ বললে–হবে আবার কী ছাই, যা বলছি করো, চলো আমাদের সঙ্গে, আর সময় নেই–

অথচ এই কালই শোভারাম মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছিল। ভোরবেলা তখনও ঘুম থেকে ওঠেননি ছোটমশাই। গোকুল দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল–কে? শোভারাম? এত সকালে কী করতে?

এই মরালীর বিয়ে কিনা আজ, তাই নিয়ে এলাম, ছোটমশাইকে প্রেম করে যাবে—

মরালীকে শাড়ি পরিয়ে আলতা পরিয়ে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। মরালীরও ভয়-ভয় করছিল। এত বড় বাড়ি। কত গড় কত মহল পেরিয়ে রাজবাড়ির ভেতরে আসতে হয়। গড়জাত পেরিয়ে বুড়োশিবের মন্দির। পাশে ঠাকুরবাড়ি। আর তার পাশেই ছোট একটা পুকুর। ভেতরের গড়ের দিকে কেল্লা। এই দুই গড়ের মাঝখানের জমিতে কানুনগো কাছারি। বড় গড় পেরিয়েই সামনের সিংদরজা। সিংদরজার মধ্যে ছোট দরজাটা খুলে লোলাকজন যাতায়াত করে। তারপরেই উঠোন। উঠোনের উত্তর দিকে একটা দক্ষিণদ্বারী একতলা কোঠা। এই কোঠার সামনে খাঁজকাটা খিলেন দেওয়া বারান্দা। আর উঠোনের দক্ষিণ দিকে একটা মন্দির। মন্দির পেরিয়ে পুব দিকের দেয়ালের মাঝখানে একটা দরজা। এই দরজা পেরিয়ে ভেতরে গেলেই আর একটা উঠোন। সে উঠোনের এক পাশে ভোগ রাঁধবার রান্নাবাড়ি আর একদিকে অতিথিশালা। তারপর পুবের দরজা দিয়ে সামনাসামনি ঢুকলে ভেতরের গড়। এই গড়ের ওপরেই ছোটমশাইয়ের বসতবাড়ি। বসতবাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ভেতরের দরজা খোলা দেখা যাবে। সেখান দিয়ে ভেতরবাড়ির লোক আসা-যাওয়া করে। ভেতরের গড়ের মধ্যে বিরাট রাজবাড়ি। এ-দিগর থেকে ও-দিগর পর্যন্ত লোক আর জন। মহলের পর মহল। প্রথম মহলের পর বড় বউরানির মহল পড়বে।

ওধার থেকে কেউ প্রশ্ন করবে–কে?

শোভারাম বলবে–আমি শোভারাম–

তারপর পরের মহলের সীমানায় গিয়ে সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সেখানে বাঁধানো চাতাল আছে। পাশেই পুকুর। পুকুরের শান বাঁধানো ঘাট। এইখানে এই চাতালেই আগে বড়মশাই তেল মাখতে বসতেন। আর খেউরি করত বিশু পরামানিক। তারপর পুকুরের মধ্যে অনেকক্ষণ ডুবে ডুবে চান করবার পর গা মুছতেন রোদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

কাল সকালেও এইখানে এসে ছোটমশাইকে প্রণাম করেছিল।

মরালীকে চুপি চুপি বলেছিল–আজকে বড়রানি ছোটরানি সকলকে পেন্নাম করে আসবি জানিস, বলবি–কাল আমার বিয়ে–

এইখান দিয়েই মরালী এই গড়বন্দির মধ্যে ঢুকেছিল।

শোভারাম বলেছিল–যাও মা যাও, ভেতরে গিয়ে রানিমাদের পেন্নাম করে এসো–

কোথা দিয়ে ঢুকে কোথা দিয়ে ভেতরে গিয়েছিল তা আর মনে নেই। ওই দুগগাই প্রথমে দেখতে পেয়েছিল তাকে। ওমা, ওমা, এ যে শোভারামের মেয়ে গো–

চিবুকে ছোঁয়া লাগতেই চোখ খুলে গেল। মরালী দেখলে সামনেই ছোটরানি দাঁড়িয়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ফেললে।

ওমা, গড় করছ কেন আমাকে?

দুর্গা বললে–তা করুক না রানিমা, তোমাকে গড় করবে না তো কাকে করবে! কাল ওর বিয়ে, সুলতানুটি থেকে ওর বর আসছে, আশীর্বাদ করো যেন সতীলক্ষ্মী হয়ে সিথির সিঁদুর নিয়ে সোয়ামির সংসার করে–

না না, আমাকে গড় করতে হবে না, আমি তো তোমার চেয়ে বড় নই—

মরালী বললে–আমার বাবা যে বলে দিয়েছে—

তা দিক বলে–তোমার-আমার তো সমানই বয়েস, কী বল দুগগা?

দুর্গা বলেছিল–এই মেয়েকে তো এখন দেখছ এমনি, আগে কী দজ্জাল ছিল মা, রাস্তার লোক দেখলে খোয়র করত, বিয়ের জল পড়তে না পড়তেই একেবারে ঠান্ডা হয়ে এসেছে, বিয়ে বলে এমনি জিনিস–

এতক্ষণে ঘরের চারপাশটা দেখে নেবার শক্তি হয়েছে মরালীর। দুটো পালঙ। দুটো হাতি দু’পাশ থেকে শুড় ঠেকিয়ে আছে মাথার দিকে। বিছানার ওপর দুটো মাথার বালিশ। পাশাপাশি রাখা। ছোটমশাই আর ছোটরানি পাশাপাশি শোয়। মাথার কাছে ফুল ছড়ানো। বাগান থেকে ফুল দিয়ে যায়। মালীরা। অনেকক্ষণ ধরে দেখতে লাগল মরালী। কী সুখই না বড়মানুষের বউদের। দেয়ালে দেয়ালে পট টাঙানো। নল-দময়ন্তী, রাম-সীতা, হর-পার্বতী, আর সাবিত্রী-সত্যবানের পট।

দুর্গা বললে–কী দেখছিস লা মেয়ে, তোরও হবে এমনি, বরের সঙ্গে এমনি পাশাপাশি শুবি, বরের সঙ্গে গপপো করে কোথা দিয়ে রাত পুইয়ে যাবে টের পাবিনে–

শুনতে শুনতে যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সমস্ত শরীরে। লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে উঠল মরালীর।

দুর্গা বলতে লাগল–বরকে আঁচলে গেরো দিয়ে রাখবি লা, নইলে ফসকে পালিয়ে যাবে, এই বলে রাখলাম মেয়ে, রাতের বেলায় সোহাগ করবি, দিনের বেলা শাসন করবি, তবে বেটাছেলে বশে থাকবে–

ছোটরানি ধমক দিলে–তুই চুপ কর দুগগা–

দুর্গা বললে–কেন চুপ করব ছোটরানি, বিয়ের আগে আমরা শিখিয়ে পড়িয়ে না দিলে কে দেবে বলল, মুখপুড়ি যে মাকেও খেয়েছে–

হঠাৎ এই পরিস্থিতিতে মার কথা মনে আসতেই যেন ছাত করে উঠল বুকটা। এমন করে কেউ তো তাকে শোনায়নি। নয়ানপিসি অনেক কথা বলেছিল। অনেক দিন অনেক উপদেশ দিয়েছে, অনেক ব্রতকথা মুখস্থ করিয়েছে, কিন্তু এসব কথা এমন করে তো কেউ বলেনি।

দুর্গা বলতে লাগল–আমাদের গাঁয়ে, জানো ছোটরানি, এক বেনের মেয়ের সতিনের ঘরে পড়ে কী হল। মা ছিল না তো, কেউ শিখিয়ে দেয়নি, সোয়ামি সতিনের ঘরে শুত, আর ছুঁড়িটা সোনাদানা পেয়ে খুশি থাকত। শেষে যখন ঘুড়ির বয়েস হল, জ্ঞানগম্যি হল, সতিনাটা বুঝতে শিখলে, তখন সোয়ামিকে বললে–সতিনের ঘরে তোমাকে এবার থেকে শুতে দেব না–

ছোটরানি বললে–রাখ তোর কেচ্ছা দুগগা, বড় বউরানির ঘরে নিয়ে যা একে—

বলে মরালীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললে–এই নাও ভাই, পান খাও–

তারপর দুর্গাই মরালীর হাত ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে এল। বললে–চল, বড় বউরানিকে গড় করে আসবি চল–

বড় বউরানি! বড় বউরানির নাম শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিল মরালী! সে আবার কে!

সতিন লো সতিন, ছোট বউরানির সতিন!

এবার দরজা পেরিয়ে পাশের বারান্দায় যেতে হল। এ কত বড় বাড়ি। এবারান্দা ওবারান্দা। দূরে বুড়োশিবের মন্দিরটা দেখা যায় জাফরির ফোকর দিয়ে। বড়মশাইয়ের বাবা বুড়ো শিবের মন্দিরের চুড়োটা সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন ছেলে হবে বলে। এই ছোটমশাই তখন হননি। যেবার বর্গিরা এসে ভাগীরথীর পশ্চিম পারে হানা দিয়েছিল তখন লাঠিয়ালরা পাহারা দিয়েছিল এই মন্দির। কাল যখন মরালী বিয়ের পর বরের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাবে তখন ওই বুড়োশিবের মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করে যাবে। এই-ই রীতি। ছোটমশাইয়ের যখন বিয়ে হয়েছে তখনও বউ নিয়ে এসে ওই বুড়োশিবের মন্দিরে প্রণাম করে তবে বাড়িতে ঢুকেছে।

দুর্গা বলেছিল–খুব ভাল করে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে গড় করবি বড় বউরানিকে, বড় কড়া মানুষ, বুঝলি?

মরালী জিজ্ঞেস করলে–আমার ওপর রাগ করবে না তো?

রাগ করবে কেন? তুই কি তার সতিন যে রাগ করবে তোর ওপর?

তবে? ছোটরানির ওপর খুব রাগ নাকি?

দুর্গা বললে–রাগ না পিন্ডি। পিরিত লো পিরিত। ছোটমশাইকে খোসামোদ করতে সতিন আনালে–বললে–দেখো আমি কত সতী। তোর যখন সোয়ামি হবে তখন তুইও বুঝবি, তাই তো তোকে অত শেখালুম পড়লুম। রোজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বাসিমুখে বলবি ময়না ময়না ময়না, সতিন যেন হয় না–তা হলে আর সতিন হবে না তোর–

চলতে চলতে মরালী বললে–ছোট বউরানির বুঝি তাই খুব কষ্ট?

দূর পাগলি, দেখলিনে, বিছানার ওপর দুটো মাথার বালিশ, ফুলের তোড়া, রাত্তিরবেলা আবার আতর-গোলাপজল ছিটিয়ে দিই বিছানায়। তারপরে ছোট বউরানিকে যা এনে দিয়েছি তোকেও তাই এনে দেব, দরকার হলে আমাকে বলিস–

কী?

তোর ভাতার যদি তোকে অপগেরাহ্যি করে কি সতিন ঘরে আনে তো তোকেও দেব—

মরালী আবার জিজ্ঞেস করলে, কী, জিনিসটা কী?

ছোট বউমাকে তাই এনে দিয়েছি বলেই তো আর সোহাগের সীমে নেই ছোট বউরানির, ছোটমশাই এক-পা ঘরের বাইরে যায় না, মুখে মুখ দিয়ে পড়ে থাকে দিন রাত। বিছানায় তো দেখলি এক রাশ ফুল, ওই সব হয়েছে আমার জন্যে–

মরালী আবার জিজ্ঞেস করলে–কী করে হল? কী দিয়েছিলে তুমি?

সে বলব’খন তোকে, মন্তর আছে তার আর শুধু একটু করে আদা আর আকের গুড় লাগে যে-মেয়েমানুষ সোয়ামির কাছে শুতে ভয় পায়, কি যে-সোয়ামি মাগের কাছে শুতে আসে না–

তারপর হঠাৎ থেমে গম্ভীর হয়ে বললে–চুপ কর, বড় বউরানি আসছে–

সত্যি, বড় বউরানিকে দেখে কেমন যেন মনে হল মরালীর। একটু বয়েস হয়েছে। পুজো করে আসছিলেন বোধহয়। রেশমের শাড়ি। লাল পাড়। বাঁ হাতে পুজোর থালা।

দুর্গা বললে–এই তোমাকে গড় করতে এসেছে বউরানি, শোভারামের মেয়ে, কাল ওর বিয়ে—

শান্ত ঠান্ডা গলার স্বর। মাথায় হাত দিলেন মরালীর। বললেন–বেঁচে থাকো মা, স্বামীর সংসারে অচলা হয়ে থাকো–

কেমন যেন জুড়িয়ে গেল সমস্ত শরীরটা। বড় শান্ত সুখী মানুষটা। আবার বললেন–হ্যাঁ রে দুগগগা, ছোটমশাই উঠেছে রে? উঠলে আমার ঘরে একবার ডেকে দিস তো–

বলে যেমন আসছিলেন তেমনই আবার চলে গেলেন।

গরান কাঠের খুঁটি আর গোলপাতার ছাউনি দেওয়া ঘরের ভেতর মরালী তখনও চুপ করে বসে ছিল। পাটের শাড়িতে ঘেমে নেয়ে চান করে উঠেছিল। কাল সকালবেলার সেই সব কথাই মনে পড়ছিল। বাইরে লোকজনের গলা শোনা যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে এতক্ষণ নয়ানপিসি ছিল, অনন্তদিদি ছিল, পাড়ার সবাই ছিল। তারা সবাই বাইরে চলে গেছে। বর আসেনি লগ্ন বয়ে যাচ্ছে। বর যদি না আসে তো কী হবে?

হঠাৎ কানে এল–বর এসেছে, বর এসেছে—

তা বিপদ কি শুধু শোভারামের মেয়ের একলার। বিপদ সকলের। রাজবাড়িতে তখন সব অন্ধকার। অতিথিশালার ভেতরে সেদিন তেমন লোক ছিল না। যা দু-একজন এসেছিল তারা দিনমানে-দিনমানে চলে গেছে। রেড়ির তেলের পিদিমটা নিভে গিয়েছিল প্রথম রাত্রেই। কাছারির লোক কিছু কিছু এপাশে-ওপাশে শুয়ে ছিল। তাদের পাশ কাটিয়ে উদ্ধব দাস, হরিপদ আর শোভারাম দরজার কাছ পর্যন্ত এল।

উদ্ধব দাস আবার জিজ্ঞেস করলে–সত্যি বলো না গো, নতুন কাপড় কী হবে?

হরিপদ বললে–হবে আবার কী ছাই, যা বলছি করো–আর সময় নেই–

সেদিন হরিপদ যে কী বিপদেই ফেলেছিল। সন্ধেবেলাও কিছু বলেনি হরিপদ। উদ্ধব দাস নেচেছে, গেয়েছে। কড়াইয়ের ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছে কলাপাতায়। ছড়া কেটেও শুনিয়েছে।

সেদিনও হরিপদ জিজ্ঞেস করেছিল–নতুন রসের গান বানিয়েছ নাকি দাসমশাই?

উদ্ধব দাস জিজ্ঞেস করেছিল–কেন, তোমাদের দুগগা জানে নাকি আমি এইচি?

তা আর জানে না? তবে আজকে আর গান শুনবে না

কেন? আজ কী হল?

আজ এ-পাড়ায় আমাদের শোভারামের মেয়ের বিয়ে, সেখানে নেমন্তন্ন খেতে যাবে

তা সে তো রাত্তিরে?

তারপর হরিপদ বলেছিল–আচ্ছা দাঁড়াও, দেখি, দুগগাকে জিজ্ঞেস করে আসি গান শুনবে কিনা। আমাকে বলে রেখেছিল, তুমি এলে খবর দিতে। ভারী দেমাক কিনা দুগার। আগে জিজ্ঞেস না করলে যদি আবার খোয়ার করে–

উদ্ধব দাস বলেছিল-ঝিউড়ির আবার অত খোয়ার কেন গা?

ওমা, খোয়ার হবে না? ছোট বউরানির আদর পেয়ে পেয়ে দুগগার খোয়ার যদি একবার দেখো তো তুমিই অবাক হয়ে যাবে দাসমশাই–তুমি বোসো, আমি দেখে আসি ভেতরে

এ-সব বিকেলবেলার ঘটনা। বিকেলও হয়নি ভাল করে। ভেতর বাড়ির প্রথম দরজা পেরিয়ে বড়

বউরানির মহল। তার পাশের বারান্দা দিয়ে গিয়ে তবে ছোট বউরানির মহল পড়বে। কেমন যেন। ভয়-ভয় করতে লাগল হরিপদর। পাশে ছোটমশাইয়ের খেউরি হবার জলচৌকি। সকালবেলা সেখানে বসে খেউরি করে বিশু পরামানিক। জলচৌকিটার পাশে দাঁড়ালে ছোট বউরানির ঘরের বারান্দাটা দেখা যায়। ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। আশেপাশে দুগাকে কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না। এইসময় ছোট বউরানির জন্যে খাবার নিতে আসে দুগগা। রান্নাবাড়িতে গিয়ে খাবার ফরমাজ দিয়ে আসে। সেদিন যা খেতে ইচ্ছে হবে তা আগে থেকে বলে আসতে হয়। বড় আয়েশি মানুষ। ছোট বউরানির ঘুম বড় গাঢ়। সকালবেলা ছোটমশাই উঠবার পরও বিছানায় শুয়ে পড়ে থাকে। তখন দুগগা গিয়ে গা-হাত-পা টিপে দেয়, মাথায় সুড়সুড়ি দেয়। দুগগা না হলে ছোট বউরানির চলে না। সন্ধেবেলা হয়তো ঘি দিয়ে চিড়েভাজা খেতে ইচ্ছে হয়। বাগানের সেরা সেরা আম আসে ছোট বউরানির জন্যে। ভাড়ার ঘরে গিয়ে দুগগা ঝগড়া করে আদায় করে নিয়ে আসে।

দুর্গা বলে খেতে পরতে দেবার মালিক যে, তার যদি একটু তোমোদ করি, তাতে কী এমন অন্যায় করি মা

তরঙ্গিনী ভাঁড়ারের লোক। বলে–বড় বউরানির জন্যে আমের আচার করেছিলুম তাও নিয়ে গেলি

দুর্গা বলে নিজের জন্যে নিইনি গো, নিজের জন্যে নিইনি। খেতে পরতে দেবার মালিকের জন্যেই নিয়েছি। ছোট বউরানির জন্যে জিনিস নিলে তোমাদের এত চোক টাটায় কেন গা?

তরঙ্গিনীও কম নয়। বলে ছোট বউরানি তোর সগ্যে বাতি দেবে লা, তোর পরকালের গতি করবে, ভাল করে পা টিপিস বাপু

এর পর আর ধৈর্য থাকে না দুর্গার। বলে আমার সগ্যে কেন বাতি দেবে না, দেবে তোর সগ্যে। তুই বউরানির খাতির করিস, বাঁজা মেয়েমানুষের পায়ে তেল দিস, মুদ্দোফরাসেও তোর গতি করবে না, করুণাময়ীর ঘাটে তোকে শ্যাল-কুকুরে খাবে! তুই কবে মরবি লা, আমি ঘাটে বসে দেখব

তারপরেই ঝগড়া বেধে যায়। তুমুল ঝগড়া। রান্নাবাড়ি থেকে লোক জড়ো হয় ভাঁড়ারের উঠোনে। সধবা বিধবা কেউ বাকি থাকে না। গালে হাত দিয়ে ক্ষেন্তির মা বলে–অবাক করলি মা। দুগগা, তোর না মাসি হয় তরি। তরিকে তুই ওই কথা বললি?

তরঙ্গিনী তখন সত্যিই কাঁদতে শুরু করেছে।

বলে–তোমরা পাঁচজনে দেখো মা, এই অ্যাটুকু বয়েসে রাড় হল যখন, তখন আমি এনে ঢোকালুম ওকে চাকরিতে, সেই চাকরিতে ঢুকে বড় বউরানির সঙ্গে রাজবাড়িতে এল; ভাবলুম ভাতার যায় যাক, মুখপুড়ি দু’বেলা দু’মুঠো খেতে তো পাবে পেট ভরে। এখন আমার কপাল মা, আমার কপাল–আপন বোনঝি আমার, সেও আমায় কিনা খোয়ার করে

এসব রাজবাড়ির ভেতরকার ব্যাপার। অন্দরমহলের ঘটনা। কিন্তু বাইরে কাছারি, কানুনগো কাছারি, চণ্ডীমণ্ডপ, খাজাঞ্চিখানাতে অন্য চেহারা। হাতিয়াগড়ের রাজবংশের সে ইতিহাস সবাই জানে। পাঠান আমলের শেষ দফায় সুলেমান কররানির সময়ে কালাপাহাড়ের অত্যাচারে সমস্ত ভূভাগ যখন জর্জর হয়ে আছে, তখনকার কথা। এক-একজন সর্দার এক-একটা এলাকায় প্রধান হয়ে উঠেছে। কেবল মদিপুর, চট্টগ্রাম আর এই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত প্রদেশ তখনও বিবাদী স্বরূপ স্বাধীন সত্তায় বিরাজ করছে। তখন বাইরে থেকে বারবার অত্যাচার আর আঘাতের ঢেউ এসেছে। কখনও অর্থলোভে, কখনও ভূমির লোভে, কখনও নারীর লোভে সে অত্যাচার দুর্দম আকার নিয়েছে। অত্যাচারের পর অত্যাচারে হয়তো অনেক সময়ে ভূমির অংশ ছেড়ে দিতে হয়েছে, অর্থ দিয়ে অত্যাচারীকে বশীভূত করতে হয়েছে। দেশও পুরনো, এ-দেশের অতীতও পুরনো। সেই সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকেই মুসলমানদের অত্যাচার শুরু হয়েছে। মহম্মদ বিন কাশিম আর দ্বিতীয় খলিফ ওমরের সময় থেকেই এর সূত্রপাত। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল এ-দেশের মেয়েমানুষ। আরবের মরুভূমির দেশের চোখে এ-দেশের মেয়েমানুষেরা ছিল স্বপ্ন। তারপর যুগের পর যুগ কেটে গেছে। লুঠতরাজের শেষ হয়নি কোনওদিন। মহম্মদ বিন কাশিম থেকে সবক্তজিন। সবজিন থেকে সুলতান মামুদ পর্যন্ত তার জের চলল। সঙ্গে সঙ্গে মন্দির ভাঙল, বিগ্রহ ভাঙল। দেশের ক্ষাত্রশক্তির আর তখন জাগবার কথা নয়। পুবে বারানসী আর দক্ষিণে সোমনাথ পর্যন্ত অত্যাচারের উত্তাল ঢেউ চলল গড়িয়ে গড়িয়ে। লুঠের পর লুঠ, রক্তপাতের পর রক্তপাত। কান্নায় ভারী হয়ে উঠল বাতাস, রক্তে পঙ্কিল হয়ে উঠল পৃথিবী। সুলতান মামুদ অত্যাচার করতে করতে একদিন নিজের অত্যাচারের বীভৎসতায় নিজেই দু’হাতে নিজের দু’চোখ বুজে ফেললেন। কিন্তু নবাব বাদশাদের মেয়েমানুষের লোভ তবু গেল না।

সিং-দরজার সামনেই মাধব ঢালি পাহারা দেয়।

উদ্ধব দাসকে নিয়ে হরিপদ আর শোভারাম সেখানে এসে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে গেল। নবাবের ফৌজি সেপাই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। আর মাধব ঢালির সঙ্গে কী যেন কথা বলছে।

কী হল? এখানে কী?

কথাটা জিজ্ঞেস করেই কিন্তু হরিপদ শিউরে উঠেছে। ছোটমশাইকে খুঁজতে এসেছে ফৌজি সেপাই।

মাধব ঢালি বললে–ছোটমশাই তো এখন শুয়ে পড়েছেন হুজুর

তা নায়েব, নায়েব কোথায়? হাতিয়াগড়ের নায়েব-নাজিম?

আজ্ঞে হুজুর, নায়েবমশাই তো বাড়িতে আছেন।

কোথায় তার বাড়ি?

কাছারি বাড়ির পাশে। ওই দিকে, ওই দিকে সোজা নাক বরাবর চলে যান হুজুর।

ফৌজি সেপাই দুটো আর বাক্যব্যয় না করে সোজা সেই দিকে চলে গেল।

হরিপদর এতক্ষণে সাহস হল। জিজ্ঞেস করলে সেপাই এসছিল কেন গো মাধব?

মাধব ঢালি ডাকাতি করত এককালে। বড়মশাই যাবার আগে ওকে এই পাহারাদারির চাকরি দিয়ে গিয়েছিলেন। বললে–পরোয়ানা আছে বোধহয়

কীসের পরোয়ানা?

নবাব-নিজামতের পরোয়ানা, আবার কার?

তা বলে এত রাত্তিরে?

শোভারাম বাধা দিয়ে বললে–ওসব নবাবি ব্যাপারের কথা এখন থাক হরিপদ, ওদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে, তুই চল

বিয়েবাড়ির ভেতরে তখনও গোলমাল চলছে। যারা খেতে বসেছে, তারা তখনও কিছু টের পায়নি। সিদ্ধান্তবারিধি মশাই একবার ঘরের মধ্যে এসেছিলেন। কনে দেখে বলেছিলেন বেশ হয়েছে। শোভারাম, তোর মেয়ে সুখে থাক, সতীলক্ষ্মী হয়ে স্বামীর সংসার আলো করে থাকুক।

শোভারাম বলেছিল–সবই ছোটমশাইয়ের দয়াতে হল ঠাকুরমশাই।

শেষকালে একবার সিদ্ধান্তবারিধি মশাই মরালীর মাথায় হাত দিয়ে কী সব শ্লোক বলে আশীর্বাদ করে গিয়েছিলেন। আয়োজনের ত্রুটি কিছুই হয়নি। বড় বড় কলাপাতা এসেছিল ছোটমশাইয়ের বাগান থেকে। হরিপদ মাছ এনে দিয়েছিল ছোটমশাইয়ের পুকুর থেকে। নয়ানপিসি রাঁধতে বসেছে সকাল থেকে। একা মানুষ। পাড়ার সকলেরই পিসি। কাজেকর্মে শূদ্রদের বাড়ি রাঁধবার সময় তার ডাক পড়বেই। আর শুধু কি রান্না! কনে সাজানো, জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব সাজানো সবই তার কাজ।

নয়ানপিসি বলে গিয়েছিল চুপ করে বসে থাক মেয়ে, আমি অম্বলটা সাঁতলে আসি—

পাড়ার মেয়েরা তখন পাশেই বসে ছিল। মরালীর জানাশোনা সব মেয়েদেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। অনন্তদিদি বলেছিল–বর কী দ্রব্য তা আর জীবনে জানতে পারলুম না

মরালী জিজ্ঞেস করেছিল বরের সঙ্গে প্রথমে কী কথা বলব অনন্তদিদি?

অনন্তদিদি বলেছিল আমার আবার বর, আমার আবার বিয়ে, সেই বিয়ের পর আর তো দেখিনি বরকে–

অনন্তবালার বিয়ে, সে-এক ঘটনা বটে। বর এল গ্রামে। সবাই করুণাময়ীর ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনন্তবালার বর দেখতে। বোশেখ মাসের সকাল। যে-যার ব্রত সেরে সকাল থেকে ঘাটে গিয়ে পৌঁছেছে। যখন বর এল, দেখা গেল কাঁধে পুঁটলি, হাতে খড়ম। নৌকো থেকে বর নামল।

অনন্তবালার বাবা জগদীশ বাঁড়ুজ্জেমশাই খাতির করে বরকে নামিয়ে নিতে গেলেন।

বর বললে–নৌকোর ভাড়াটা মিটিয়ে দিন

হন্তদন্ত হয়ে জগদীশ বাঁড়ুজ্জে বললেন–কত?

পাঁচ টাকা।

পাঁচা টাকা শুনেই চমকে গিয়েছেন বাঁড়ুজ্জেমশাই। কুলীন জামাইয়ের জন্যে গুনে চারশো টাকা আগাম দিতে হয়েছে, আবার পাঁচ টাকা তার ওপর। অথচ জামাইয়ের নিজেরই নৌকো।

বললেন–নৌকোভাড়াটা পরে দিলে হবে না বাবাজি?

বর বললে–পরে আর কখন দেবেন। আমি তো আজই চলে যাব পলাশপুরে, সেখানে আর একটি কন্যার পাণিগ্রহণ করে তারপর যাব ঘুষুটি। সেখানেও একটি কন্যা আছে। বোশেখ মাসে লগনসার বাজারে কি আমাদের কোথাও বেশি তিষ্ঠুবার সময় আছে?

সেই পাঁচ টাকাই শুধু নয়, আরও পঞ্চাশটি টাকা চাদরে বেঁধে দানের সামগ্রী ঘড়া থালা পিলসুজ সমস্ত কাঁধে তুলে নিয়ে উঠল নৌকোতে। নৌকো সারা দিনই ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল।

বাঁড়ুজ্জেমশাই বলেছিলেন–একটা রাত কন্যার সঙ্গে এক ঘরে বাস করলে হত না বাবাজি?

অনন্তবালার মা-ও ঘোমটার আড়াল থেকে বলেছিল–অনন্ত আমার বড় আদরের মেয়ে, আমার বড় সাধ ছিল জামাই-মেয়েকে একসঙ্গে দেখে চোখ জুড়োব, তা-ও হল না

বলে কাঁদতে লাগলেন তিনি।

বর বললে–থাকলে আরও হাজার টাকা দিতে হবে, এই আমার নিয়ম করে দিয়েছি

হাজার টাকা! হাজার টাকা দেবার মতো অবস্থা নয় বাঁড়ুজ্জেমশাইয়ের। সামান্য জমিজমা আর ক’ঘর বামুন কায়েত যজমান। তাদেরই ওপর ভরসা। হাজার টাকা তাকে খুঁড়ে ফেললেও আসবে না।

বললেন–এর পর যখন আসবে বাবাজি, তখন না-হয় ধারকর্জ করে যেমন করে তোক

বর বললে–তা তো বুঝতেই পারছি, কিন্তু নগদ-ছাড়া কাজ করব না ঠিক করেছি। বড় ঠকায় সবাই আজকাল। আর তা ছাড়া বোশেখ মাস পড়ে গেছে যে, বড় ক্ষেতি হয়ে যাবে, চারদিক থেকে ডাক আসছে, বয়েসও বাড়ছে, সব কন্যার পাণিগ্রহণ করে উঠতে পারিনে আজকাল

বলে নৌকোয় উঠে পড়েছিল বর। আর বাক্যব্যয় করেনি

বাঁড়ুজ্জেমশাই শেষপর্যন্ত জিজ্ঞেস করেছিলেন–তা হলে আবার কবে আসছ বাবাজি!

বর বলেছিল–পত্র দেবেন রাহা-খরচ দেবেন, সময় করে যদি আসতে পারি দেখব

অনন্তবালার পর নন্দরানি। দুই মেয়ে জগদীশ বাঁড়ুজ্জের, নন্দরানির কপালে বরই জোটেনি। নন্দরানিও এসেছিল মরালীর বিয়েতে। শেষপর্যন্ত নন্দরানির বিয়ে হয়েছিল কলাগাছের সঙ্গে। এয়োতির মতো মাথার সিঁথিতে সিঁদুর দিত। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েস হয়েছে। তবু ছেলেমানুষের মতো বাসর জাগতে পারে। ফুলশয্যের রাত্রিতে বর কনের শোবার ঘরে আড়ি পাতে। পুকুরঘাটে গিয়ে পরের বর। নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। বর ঠকাতে নন্দরানির ডাক পড়ে সব বাড়িতে।

নন্দরানির নিজের বিয়েতে শুভদৃষ্টিও হয়নি, ফুলশয্যেও হয়নি, বাসরঘরও হয়নি। কিন্তু পাড়ার সব বিয়ের বাসর জেগেছে।

নন্দরানির মা বলতেন–মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছ, সব মুখ বুজে সহ্যি করতে হবে মা তোমাকে

নন্দরানি কিন্তু মার কথা শুনে হাসত। বলত–মা যেন কী! দিদির চেয়ে তো আমার কপাল ভাল। আমার বর তবু আমার বাড়িতেই থাকে, কিন্তু দিদির বর যে আসেই না একেবারে

তা অনন্তদিদির বর কিন্তু আর একবার এসেছিল। যথারীতি নিজের নৌকো করে পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে রাত দেড়-প্রহরের সময় এসে হাজির। জগদীশ বাঁড়ুজ্জে বাড়ির ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন–কে?

অনন্তবালার বর বলেছিল–আমি আপনাদের জামাই বাবাজীবন

কথাটা শুনেই জগদীশ বাঁড়ুজ্জে লাফিয়ে উঠেছিলেন। গিন্নিও উঠেছিলেন। সেই রাত্রে আবার উনুনে আগুন দেওয়া হল। ভাল চাল আনা হল বাবুদের মরাই থেকে। সেই অত রাত্রে আবার পাশের ডোবা থেকে বড় বড় কই মাছ ধরা হল। গাছের কলার কাদি থেকে কলা পেড়ে, সরের ঘি, নারকেল নাড়ু, দুধ-ক্ষীর খেতে দেওয়া হল জামাইকে। জামাইয়ের জন্যে কাঁঠাল কাঠের সিন্দুক খুলে বগি থালা, জামবাটি, রেকাবি বার করা হল।

জামাই বাবাজীবন খেতে বসবার আসনে খেতে বসল কিন্তু ভাতে হাত দিলে না।

বললে–আমি তো খেতে আসিনি, কিছু টাকার দরকারে এসেছিলাম আপনার কাছে

বাঁড়ুজ্জেমশাই অবাক হয়ে বললেন–টাকা!

অনন্তবালা ততক্ষণে তোরঙ্গ থেকে একখানা পোশাকি পাটশাড়ি বার করে পরে নিয়েছে। খোল দিয়ে মুখখানা মেজে চকচকে করে নিয়েছে। মা বিছানা করে দিয়ে গেছে। কনে-জামাই এই প্রথম এক ঘরে শোবে। তাম্বুল দিয়ে পান সেজে ডিবে ভরতি করে দিলেন। তারপর মেয়ের কাছে গিয়ে চুপি চুপি ফিসফিস করে বললেন–এইটে খোঁপায় বেঁধে রাখ।

ছোট একটা ন্যাকড়ায় বাঁধা পুঁটলির মতন।

কী এটা?

মা বলেছিল–দুগাকে বলেছিলাম কিনা, দিয়েছে সে, অচ্ছেদ্দা করিসনে—

কী আছে এতে?

মা বলেছিল–কী জানি মা কী আছে, দুৰ্গ দিয়েছে, দুগাই জানে–বলছিল সাপের গায়ের এঁটুলি আর দানকাকের রক্ত,

অনন্তবালা বললে–কী হবে এ দিয়ে?

মা রেগে গিয়েছিল–তুই আর জ্বালাসনে বাপু, মেয়ের এত বড় বয়েস হল, এখনও জামাইকে বশ করতে পারলিনে, তোর জন্যে আমার মাথা খুঁড়ে মরতে ইচ্ছে করে মা

তারপর অনন্তবালা সেজেগুজে বিছানায় বসেই রইল। জামাই খেয়ে ঘরে শুতে আসবে। কিন্তু গোল বাধল খাবার আগেই। জামাই বললে–আমি খেতে তো আসিনি, টাকা নিতে এসেছি।

মা আড়াল থেকে বললে–এত দিন পরে এলে বাবাজি, না খেলে কি চলে? খেয়েদেয়ে ঘরে একটু বিশ্রাম করো, টাকা তোমায় দেবই যেমন করে থোক–

কী জানি কী হল! জামাই খেলে সবকিছু চেটেপুটে। কিন্তু খাওয়ার পর আর ওঠে না আসন ছেড়ে।

বললে–এবার টাকা ছাড়ুন, খাইয়েদাইয়ে নিয়ে শেষে টাকা দেবেন না, আমার এসব অনেক দেখা আছে

তা বাবাজীবন বিশ্রাম তো করবে একটু, অনন্তবালার সঙ্গে একটু দেখাও তো করবে–

জামাই নাছোড়বান্দা। বললে–ওসব কথা সবাই বলে, শেষে কলা দেখিয়ে দেয়, আমি ওসব অনেক দেখেছি, কথায় আর ভুলছে না এ শর্মা

জগদীশ বাঁড়ুজ্জের কিছু টাকা ছিল লুকোনো। কাঁঠাল গাছের তলায় বহুদিন আগে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। অবরেসবরে বিপদেআপদে কাজে লাগতে পারে। সেই অত রাত্রে আবার শাবল নিয়ে গিয়ে খুঁড়ে বার করে আনলেন। পাঁচটি মাত্র টাকা। কাদামাটি মাখানো। জামাইয়ের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন যৎসামান্য এই যা ছিল সব তোমায় দিলাম বাবাজীবন, এইটি নিয়ে একটু বিশ্রাম করে যাও শুধু

জামাই টাকা ক’টি ট্র্যাকে খুঁজে নিলে। কিন্তু বিশ্রাম করতে শোবার ঘরে আর গেল না।

বললে–তবে আর থাকা হল না আমার, ঘুষুটির চাটুজ্জে মশাইয়ের বাড়িতেই যাওয়া ভাল ছিল দেখছি

বলে উঠল জামাই। তারপর সেই নিজের এঁটো বগি থালা, জামবাটি, রেকাবি সবকিছু পোঁটলায় বেঁধে নিয়ে আবার গিয়ে উঠল নৌকোতে। অনন্তবালা তখনও সেজেগুজে বসে ছিল বিছানায়। মা ঘরের ভেতর ঢুকে চিৎকার করে উঠল–তোর মরণ হয় না মুখপুড়ি, তুই মরিসনে কেন, আমি দেখে চোখ জুড়োই, এত ধিঙ্গি বয়েস হল, জামাই বাড়ি বয়ে এল আর তুই ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসে রইলি? জামাইয়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরতে পারলিনে?

সেদিন অত বকুনি খাওয়ার পরও অনন্তবালা পাথরের মতো চুপ করে বসে ছিল।

কিন্তু নন্দরানির বেলায় আর সে-সব কোনও আয়োজন অনুষ্ঠান করেননি জগদীশ বাঁড়ুজ্জে। আর তখন টাকাকড়িও ছিল না তার।

নয়ানপিসি পরামর্শ দিয়েছিল তার চেয়ে নন্দরানির গাছবরে বিয়ে দাও দাদা, মেয়ে এমনিতেও ঘরে থাকবে, অমনিতেও ঘরে থাকবে, জাত-কুলও বজায় থাকবে

তা তাই-ই হল শেষপর্যন্ত। শুভদিনে পাঁজি দেখে বরণডালা কুলো পিদিম সুপুরি হলুদ আর দুধের সর নিয়ে কলাগাছের তলায় গিয়ে সাত পাক দিলে নন্দরানি। পুরুতমশাই মন্ত্র পড়তে লাগল।

নয়ানপিসি বললে–এবারে কলাগাছটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধর

নন্দরানি তাইই করল।

নয়ানপিসি বললে–এবার এই কড়ি আর সুপুরি নিয়ে শেকড়ের কাছে রাখ, রেখে মনে মনে তিনবার বল

কলাগাছ বর,
হলাম স্বয়ংবর,
কড়ি দিলাম, সুপুরি দিলাম,
দিলাম দুধের সর।
তুমি আমার বর।

এমনি করে একদিন জগদীশ বাঁড়ুজ্জের ছোট মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেল। আর শুধু কি নন্দরানি। এ-গাঁয়ের আরও অনেক মেয়েরই এমনি করে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এমনি করেই নন্দরানির মতো বাপের বাড়িতে হাঁড়ি ঠেলে তারা। এমনি করেই বাড়ি বাড়ি বর দেখে বেড়ায়, কারও বাড়ি জামাই এলে ঘটা করে দেখতে যায়, বরের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে। বরকে হাসায়, নিজেরাও হেসে গড়িয়ে পড়ে। তারপর একদিন খবর আসে গুপ্তিপাড়া কিংবা বর্ধমান কিংবা পূর্বস্থলী কিংবা বড়চাপড়ার শ্রীযুক্ত দেবনারায়ণ দেবদর্শন: সময়োচিত নিবেদনমিদং ৩ বৈশাখ শুক্রবার বেলা আড়াই প্রহরের সময় আমার পিতা লোকান্তর হইয়াছে জ্ঞাত কারণ লিখিলাম, ইতি। আর সঙ্গে সঙ্গে একশো মেয়ের শাঁখা ভাঙে, সিঁদুর মোছে, শাড়ি ছেড়ে থান কাপড় পরে। তাদের সবাই আজ জড়ো হয়েছে মরালীর বিয়েতে। সবাই বাসর জাগবে বলে এসেছে। নয়ান পিসিরও কবে বিয়ে হয়েছিল কে জানে। নিজেও নয়ানপিসি কখনও শ্বশুরবাড়ি যায়নি। পাড়া-প্রতিবেশীর বিয়ে উৎসব অনুষ্ঠানে খেটে খেটে পরিশ্রম করে উপদেশ দিয়েই নয়ানপিসি নিজের জীবনটা কাটিয়ে দিলে।

শোভারাম দৌড়াতে দৌড়োতে ঘরে এসে ঢুকেছে।

বললে–নয়ান

ঘরে একলা মরালী বসে ছিল। আর কেউ নেই। মেয়ের দিকে চেয়ে যেন সান্ত্বনা দিয়ে বললে–কিছু ভাবিসনে মা, আর ভাবনা নেই, এবার সব ঠিক হয়ে গেছে।

বলেই আবার বাইরে চলে গেল।

বশির মিঞার সঙ্গে আবার সেদিন দেখা। সারাদিন সোরার গদিতে বসে কাজ করে করে যখন আর মাথা। তোলবার সময় থাকত না, ঠিক তখনই এক-একদিন বশির মিঞা এসে হাজির হত। বেভারিজ সাহেব থাকলে আর বশির মিঞা ঢুকত না। কিন্তু একলা দেখলেই ঢুকে পড়ত। চেনা নেই শোনা নেই মানুষটার সঙ্গে। কিন্তু বশির মিঞা একদিনেই বেশ ভাব করে নিয়েছিল। আর কান্তও ছিল সেইরকম। একটু মিষ্টি কথা শুনলে গলে যেত একেবারে।

কী খবর ভাইয়া?

কান্ত বলত–এসো ভাই, এসো, বোসো

তক্তপোশের ওপর কাটি-মাদুর পাতা থাকত। সেই জায়গাটা পরিষ্কার করে দিয়ে বসতে বলতকান্ত। পান দিত, জর্দা আনিয়ে দিত। বন্ধু মানুষ, খাতিরের কোনও কমতি রাখতনা কান্ত। ভারী মজাদার মানুষ ছিল বশির মিঞা। তেজি জোয়ান ছেলে। মুসলমান জাতে। তা হোক। কিন্তু খবর রাখত অনেক, নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াত, আবার নানান লোকের সঙ্গে মেলামেশা ছিল।

কী কাজ তোমার এত? সারা বাংলা মুলুক ঘুরে বেড়াতে হয়?

বশির মিঞা বলত–নবাব সরকারের কাজের তো এই মজা ইয়ার। মাঝে মাঝে দিল্লি যাই, মাঝে মাঝে ঢাকা যাই, আবার তারপর হয়তো আগ্রা, ফতেপুর সিক্রি চলে যাই–আমার ফুপা মনসুর আলি সাহেবের নাম শুনেছিস তো?

কান্ত বলেছিল-না; কে সে?

আরে আমার ফুপা। মির্জা মহম্মদ সাহেবের ইয়ার।

মির্জা মহম্মদ কে?

মির্জা মহম্মদের নামই শোনেনি কান্ত। অথচ এই দুনিয়ায় বেঁচে আছে। তাজ্জব বাত আর কাকে বলে। আরে মির্জা মহম্মদের নামই তো সিরাজ-উ-দ্দৌলা। কিছুই জানিস না তুই। এত বড় নবাব আর হয়নি যে হিন্দুস্তানে। তুই কাজ করছিস ফিরিঙ্গি কোম্পানির কাছে। তোর সাহেব নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার পা চাটে, তা জানিস। এই যে দেখছিস সুতোনুটি, এই যে দেখছিস তোর সোরার গদি, নবাব ইচ্ছে করলে একটা কামান দেগে সব উড়িয়ে দিতে পারে। তোর সায়েবের মুন্ডু উড়ে যাবে এককথায় তা জানিস। তখন তুই তো তুই, তোর বাপজানের বাপজান ড্রেক সায়েব পর্যন্ত কোথায় উড়ে যাবে তার ঠিক নেই। তুই রহিম খাঁর নাম শুনেছিস? জবরদস্ত খাঁর নাম শুনেছিস?

না।

নবাব জাফর মুর্শিদকুলি খাঁর নাম শুনেছিস?

না।

আরে তোর মতন বেওকুফ তো আমি দেখিনি।

দিনের পর দিন বশির মিঞার কাছে মোগল বাদশা আর নবাব দেওয়ানদের গল্প শুনে শুনে নিজেকে কেমন ছোট মনে করেছে কান্ত। বশির মিঞা রাজার জাতের লোক। আর সে ফিরিঙ্গি কোম্পানির তিন টাকা তলবের ক্রীতদাস। কত বড় বড় লোক সব জন্মেছে মুসলমানদের মধ্যে। এই যে মুর্শিদকুলি খাঁ। ও-ও তো কাফের ছিল আগে। বামুনের ছেলে। খেতে পেত না। ইস্পাহানের হাজিসুফি মেহেরবানি করে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছিল বলেই তো সুবে বেরারের দেওয়ান হাজি আবদুল্লা খোরাসানির দফতরে নোকরি পেল। আমাদের বাদশা তো গুণের কদর করত–বাদশা আওরঙ্গজেব।

বলে বশির মিঞা নিজের নাক আর দুটো কান মলে দিল।

বললে–অমন বাদশা আর হিন্দুস্তানে হবে না রে। দীন-দুনিয়ার বাদশা আওরঙ্গজেব বাদশা। জাফর খাঁ সায়েবকে গুণ দেখে নিজের খাস-দরবারে এত্তালা দিলে। দিয়ে তার খেলাত দিলে কারতলব খা। মনসবি দিলে। তোকে তোর কাজ দেখে খেলাত দেবে বেভারিজ সায়েব? গুণের কদর করবে ফিরিঙ্গি বাচ্চা?

এমনি গল্প করত বশির মিঞা। তারপর আবার কোথায় চলে যেত। কী কাজ যে করত বশির তা কোনওদিন বলেনি। মাঝে মাঝে কান্তকে জিজ্ঞেস করত–বেভারিজ সায়েবের কাছে কোন কোন সায়েব আসে, তাদের নাম কী। সোরা বেচে সাহেবের কত মুনাফা থাকে। গঙ্গার কিনারায় কেল্লা বানাচ্ছে কেন ফিরিঙ্গিরা। তাদের মতলব কী!

যা জানত কান্ত তাই বলত। কান্ত বলত–আমি তো ইংরিজি জানি না তাই সব কথা ওদের বুঝতে পারি না

তা এতদিন নোকরি করছিস আর ইংরিজি শিখিসনি? শিখে নে। কী কথা হয় ওদের আমাকে বলবি, তোকে ইনাম পাইয়ে দেব, বকশিশ পাইয়ে দেব–ফিরিঙ্গিদের যত খবর দিতে পারবি তার জন্যে তুই টাকা পাবি। কেল্লাতে ফিরিঙ্গিদের কত পল্টন আছে, কত কামান আছে, আমাকে খবরটা দিতে পারিস?

এসব কথা শুনতে শুনতে কান্তর কেমন সন্দেহ হত। বেভারিজ সাহেব তাকে কতবার সাবধান করে দিয়েছিল। কোম্পানির এলাকায় স্পাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব হুঁশিয়ার থাকবে মুনশি। স্পাই মানে চর। গেরুয়া পরা সন্ন্যাসী দেখলে বুঝবে ওরা মারাঠিদের চর। ওরা মুসলমানদের হঠিয়ে হিন্দু রাজাকে দিল্লির মসনদে বসাতে চায়। তাদের সঙ্গে বেশি কথা বলবে না। অনেকে বাউল ফকিরের মতো গান শোনাবে গদিতে এসে। ভিক্ষে চাইবে। তাদের আমল দেবে না। আর তারপর আছে মুর্শিদাবাদের স্পাই। তারাও কলকাতায় ঢুকে পড়েছে। খুব হুঁশিয়ার থাকবে।

কিন্তু বশিরকে কিছুতে এড়ানো যেত না। বশির বলত–তোর ডর কীসের? আমি তো আছি, আমার ফুপা তো আছে–

একদিন রাত্তিরবেলার কথা মনে আছে। অনেকদিন আগেকার কথা। সাহেব সকালবেলা একবার গদিতে আসত। তারপর মাল-চালান দিয়ে বাড়িতে খেতে চলে যেত। দুপুরবেলা বাড়িতে গিয়ে ঘুমোত। দিবানিদ্রা দেওয়াটা বেভারিজ সাহেবের ছিল স্বভাব। সেসময়ে সাহেবকে বিরক্ত করা চলবে না। তারপর বিকেলবেলা যখন ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে বেরোত তখন এক-একদিন আসত। কিন্তু সেদিন রাত্তিরবেলাই পালকি চড়ে এসে হাজির। অত রাত্তিরে সাহেব কখনও আসে না। সাহেবের মুখ গম্ভীর। এসেই কান্তর হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠালে কেল্লাতে। সাহেবের সঙ্গে আরও দু’জন লোক। তারা চুপি চুপি কী সব কথা বলতে লাগল। কান্ত অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারলে না।

বাইরে আসতেই পালকি-বেহারারা রয়েছে। কান্ত আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁগো, কে এসেছে এখানে? বেভারিজ সাহেবের সঙ্গে কারা এনারা?

উমিচাঁদ সাহেব! আমরা উমিচাঁদ সাহেবের লোক।

আর সঙ্গে কে?

লোকগুলো সাদাসিধে মানুষ। বেশি ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। বললে–নারায়ণ সিং

নারায়ণ সিং কে?

আজ্ঞে তা জানিনে, রাজধানী থেকে এয়েচে

কে নারায়ণ সিং, কে উমিচাঁদ সাহেব, কিছুই জানত না কান্ত। দিনমানে না এসে এত রাত্তিরেই বা গদিতে এল কেন সাহেব, তাও বুঝতে পারল না। হঠাৎ যেন সব ওলোটপালোট হয়ে গেল। কদিন আগেই কান্তর কানে এসেছিল নবাব মারা গেছে। সে ছিল ভোর পাঁচটার সময়। তখন বলতে গেলে ভাল করে ঘুমও ভাঙেনি। সেই খবর শোনার পর থেকেই যেন সাহেবদের রকমসকম সব বদলে গেল। মনে আছে, বেভারিজ সাহেব কতদিন গদিতেই আসেনি। একলা কান্তকেই কাজ চালাতে হয়েছে। তারপর ক’দিন যেতে-না-যেতেই এই কাণ্ড। সাহেবের হুকুম। কান্ত সেই অত রাত্তিরে কেল্লার ফটকে গিয়ে পল্টনের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল।

হু কামস দেয়ার?

আমি কান্ত সরকার, বেভারিজ সায়েবের মুনশি। চিঠি এনেছি ড্রেক সাহেবের জন্যে।

তবু পল্টন বেটা কথায় কান দেয় না। বললে–লাটসাব বারাসাত গিয়া

বোঝা গেল ড্রেক সাহেব কেল্লায় নেই! বারাসতে গিয়েছে কাজে।

ফিরে এসে খবরটা বেভারিজ সাহেবকে দিতেই সাহেব একেবারে রেগে খুন। ড্রেক সাহেব কেল্লায় নেই তা যেন কান্তরই অপরাধ। আরও কী সব কথাবার্তা হতে লাগল তিনজনে অনেকক্ষণ। কান্ত সেই দরজা বন্ধ গদি-বাড়ির সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তখন বেশ গরম পড়েছে। এপ্রিল মাস। তারিখটাও মনে আছে কান্তর। ১৩ রজব। তারপর অনেকক্ষণ কথা বলে আবার তিনজনে পালকি করে। যেদিক থেকে এসেছিল, সেই দিকেই চলে গেল।

আর ঠিক তার খানিক পরেই বশির এসে হাজির। বশির মিঞাকে সেই সময়ে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল কান্ত। তুই, এত রাত্তিরে?

তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকেই বশির মিঞা দরজায় হুড়কো দিয়ে দিয়েছিল। বললে–কে এসেছিল রে তোর এখানে?

আমার সায়েব।

আর দু’জন কে?

ওদের আমি চিনি না।

নামও শুনিসনি? পালকি-বেহারাদের তুই যে জিজ্ঞেস করলি দেখলুম!

তুই সব দেখেছিস নাকি?

সব দেখেছি আমার কাছে চাপতে কোসিস করিসনি। সচ-বাত বলবি, ঝুটা বললে–তোর নুকসান হবে বলে রাখছি। যা-যা শুনেছিস সব বিলকুল খোলসা করে বল।

কান্ত বললে–সত্যি বলছি, আমি ওদের চিনি না, শুনলাম একজনের নাম উমিচাঁদ আর একজন নারায়ণ সিং

নারায়ণ সিং! নামটা শুনেই বশির মিঞা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। শালা হারামিকা বাচ্চা। বেওকুব, বেতমিজ, বেশরম। শালাকে আমি দেখে লেব। ওর বাপের নাম ভুলিয়ে দেব তবে আমি মুসলমানের বাচ্চা। ওর ভাই রামরাম সিংয়ের শির কাটিয়ে দেব। শালা আমাকে চেনে না হিন্দুর বাচ্চা। তুই কিছু মনে করিসনি হিন্দুর বাচ্চা বলছি বলে। তুই আমার দোস্ত। তোর সঙ্গে আমার দোস্তালি হয়ে গেছে ইয়ার। কিন্তু ওরা নিমকহারাম। ওই রামরাম সিং, ওই নারায়ণ সিং, ওই ঘসেটি বেগমও নিমকহারাম–শালা মুসলমানের মধ্যেও হারামির বাচ্চা আছে অনেক

বলতে বলতে বশির মিঞা চিৎকার করে উঠতে যায় আর কী।

কান্ত বললে–ওরে থাম ভাই বশির, একটু চুপি চুপি কথা বল, কেউ শুনতে পাবে, আমার চাকরি চলে যাবে

কিন্তু বশির মিঞা রেগে তখন টং হয়ে গেছে। তার মুখে তখন খই ফুটতে আরম্ভ করেছে। যাকে পাচ্ছে তাকে গালাগালি দিচ্ছে। কোথাকার রাজা জানকীরাম, রাজা দুর্লভরাম, রাজবল্লভ, তার ছেলে কৃষ্ণবল্লভ, কারওই নাম শোনেনি কান্ত। গড়গড় করে সকলের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি বলে গেল বশির মিঞা। বশির মিঞা বললে–নারায়ণ সিংকে আর বেশিদিন বাঁচতে হবে না, দেখে নিস–

কেন?

আমার হাতে খুন হয়ে যাবে শালা। আমি আমার ফুপাকে গিয়ে কাল খবরটা দিচ্ছি—

কিন্তু, নারায়ণ সিং কে? কী করতে এসেছে সাহেবের কাছে?

ওই শালা উমিচাঁদ এনেছে সঙ্গে করে। ও শালা হল চর। শালা রাজবল্লভের চর। রাজবল্লভের ছেলে কেষ্টবল্লভ এখেনে ফিরিঙ্গিদের কাছে রয়েছে, তা জানিস তো। এ ওই রাজবল্লভের কাণ্ড। নবাব মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারামিরা নেমকহারামি শুরু করেছে।

কান্ত এবার আর থাকতে পারলে না। বললে–তুই এখন যা বশির, সাহেব আবার কোন সময়ে এসে পড়বে, তখন আমার চাকরি চলে যাবে

যাক না তোর নোকরি, আমি তো আছি, বশির মিঞা থাকতে, বশির মিঞার ফুপা থাকতে তোর ডর কীসের?

না ভাই, এবার আমি বিয়ে করছি, এখন আর ছেলেমানুষি করলে চলবে না।

বিয়ে! শাদি? শাদি করছিস? কোথায়?

হাতিয়াগড়ে। সব ঠিক হয়ে গেছে, দিনটিন সমস্ত ঠিক হয়ে গেছে!

ঠিক করছিস! মরদের কাম করছিস। শাদি করবি, লেড়কা পয়দা করবি, তবে না মরদ! আরে মরদের পয়দাই হয়েছে শাদি করবার জন্যে, আর মর্দানার পয়দা হয়েছে লেড়কা পয়দা করবার জন্যে। খোদাতালার দেমাগ আছে ইয়ার, খোদাতালা অনেক ভেবে ভেবে তবে এই কানুন করেছে। দুনিয়ার

বলতে বলতে বশির মিঞা সেদিন সেই রাত্রের অন্ধকারের মধ্যেই বেরিয়ে গিয়েছিল। বশির মিঞা। সেদিন চলে যাবার পর থেকেই আরও অনেক কাণ্ড শুনেছিল কান্ত। ভেতরে ভেতরে যে এত ব্যাপার চলছে তা এতদিন টের পায়নি সে। কোথায় সে বিয়ে করবে, বিয়ে করে বউ নিয়ে বড়চাতরায় তাদের বাড়িতে গিয়ে উঠবে, পাড়ার বউ-ঝিরা তার বউ দেখতে আসবে, এইসব স্বপ্নই দেখত সারাদিন। গদিবাড়ির কাজের ফাঁকেও বউয়ের মুখটা কল্পনা করে নিয়ে চোখ বুজিয়ে ভাবতে ভাল লাগত। কিন্তু হঠাৎ যেন কোম্পানির সব সাহেবরা চারদিকে ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিলে। ড্রেক সাহেবের শরীর ভাল ছিল না, বালেশ্বরের বন্দরে বেড়াতে গিয়েছিল। তারপরেই কলকাতায় এসে হাজির হয়েছিল কৃষ্ণবল্লভ। ঢাকার রাজবল্লভ সেনের ছেলে। টাকাকড়ি-গয়নাগাঁটি, বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে এসে হাজির। সঙ্গে ছিল কাশিমবাজার কুঠির ওয়াটস সাহেবের চিঠি। সেই তাকে যদি এখানে সাহেবরা না থাকতে দিত তো কোনও গণ্ডগোল হত না আর।

কেন?

আজ্ঞে, কেষ্টবল্লভ যে রাজবল্লভ সেনের ছেলে। রাজবল্লভ সেনকে চেনেন তো? ঢাকার দেওয়ান, আলিবর্দি খাঁ’র পেয়ারের লোক ছিল। ঘসেটি বেগমের সঙ্গে যে তার খুব ইয়ে–

ইয়ে মানে?

ষষ্ঠীপদ একটু বেঁকা হাসি হেসে বললে–ইয়ে মানে ইয়ে। আপনি তো কিছুই খবর রাখবেন না, কেবল চাকরি আর ঘুম। দুনিয়ায় কত কী ঘটে যাচ্ছে খবর রাখবেন তো!

ষষ্ঠীপদ কান্তর নীচে চাকরি করত। কান্ত মালের হিসেব রাখে, আর ষষ্ঠীপদ মালের বস্তা গোনে। কিন্তু খবর রাখে সব। কী করলে চাকরিতে উন্নতি করা যায় তার চেষ্টা ষষ্ঠীপদ করে। ষষ্ঠীপদ বলে–কোম্পানির চাকরি, এই আছে এই নেই, চিরকাল তো কোম্পানির চাকরি করলে চলবে না, কোম্পানিও চিরকাল থাকছে না। যদি নবাব কাছারিতে চাকরি পেতাম একটা তো আমার কী আর ভাবনা

তা বিয়ের দিন সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ এল। ভোরবেলাই এসে হাজির। সেদিন আবার কাজও খুব। চোখে-মুখে দেখবার সময় নেই কান্তর।

ঘটক মশাই বললে–চলো বাবাজি, আমার সঙ্গে চলো

কান্ত বললে–এখন যাব কী করে, এখনও ছুটি পাইনি যে ক’দিন ধরে আমার সাহেব আসছে না।

সে কী কথা? সাহেব যদি না আসে ততো তোমার বিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে? একটি মেয়ের জীবন-মরণ সমস্যা, আর তোমার চাকরিটাই সেখানে বড় হল?

কান্ত বললে–না, তা বলছি না, আপনি এখোন, আমি নাপিতকে নিয়ে যাচ্ছি। আজ সাহেব আসবার কথা আছে

তুমি যাবে তো ঠিক বাবাজি?

কিছুতেই আর ঘটক মশাইয়ের সন্দেহ যায় না। কান্ত সমস্ত দেখালে। বিয়ের তোড়জোড় সমস্ত ঠিক করে রেখে দিয়েছে। গায়ে-হলুদের জন্যে তেল-হলুদ পাঠিয়ে দিয়েছে। সারাদিন উপোস করে আছে আর বিয়ে হবে না মানে। বড়চাতরায় চিঠি পর্যন্ত লিখে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার বাড়ি-ঘরদোর পরিষ্কার করা হয়েছে। জঙ্গল কেটে রাস্তা করা হয়েছে। নতুন বউকে নিয়ে যাবে, দেশে দশজনকে বউ দেখাবে। পিতৃপুরুষের ভিটে! নতুন বউ নিয়ে হাতিয়াগড় থেকে সোজা নৌকো করে তো সেখানে গিয়েই উঠতে হবে।

তারপরেই একটা কাণ্ড ঘটল। ঘটকমশাইকে বুঝিয়েসুঝিয়ে বিদায় করে দিয়ে ষষ্ঠীপদকে সব মালের হিসেব বুঝিয়ে দিলে। নাপিত তৈরিই ছিল। কান্ত সেজেগুজে নৌকোয় উঠতে যাবে, হঠাৎ বশির এসে পড়লে।

কোথায় যাচ্ছিস?

বিয়ে করতে। আর সময় নেই

তা আজকেই বিয়ে করতে চললি? এদিকে যে সব পয়মাল হয়ে গেল রে। তোর নোকরি হয়তো থাকবে না।

কেন?

তখন সত্যিই আর কথা বলবারই সময় ছিল না। মাঝি-মাল্লারা পাল খাঁটিয়ে দিয়েছে নৌকোয়। নাপিতও গিয়ে উঠে বসেছে পোঁটলাটা নিয়ে।

বশির মিঞা বললে–তোর সাহেবদের ওপর নবাব খুব গোঁসা করেছে। আমাদের কাশিমবাজারে ফিরিঙ্গিদের কুঠির ওয়াটস্ সাহেবকে নবাব ডেকেছিল, ডেকে খুব হল্লা করেছে, বলেছে রাজা রাজবল্লভের ছেলেকে যদি ফিরিঙ্গিরা না ফিরিয়ে দেয় তো কোম্পানির গুষ্টি তুষ্টি করে ছাড়বে।

কান্ত জিজ্ঞেস করলে–কেন, সাহেবদের কী দোষ?

দোষ নয়? ফিরিঙ্গির বাচ্চারা পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে তার কাছ থেকে, তা জানিস? তোর সাহেবের দোস্ত ওই হলওয়েল আর ম্যানিংহাম, ওই দুটো ফিরিঙ্গি।

কান্তর মনে আছে সেসব কথা। বশির মিঞাই বলেছিল সব। উমিচাঁদই হচ্ছে নাকি আসল। তার সঙ্গেই সাহেবদের দোস্তালি। নারায়ণ সিং-কে সে-ই নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল। কেষ্টবল্লভ যে কলকাতায় এসে ফিরিঙ্গিদের কাছে থাকতে পেয়েছিল তাও রাজা উমিচাঁদের জন্যেই। রাজা উমিচাঁদকে প্রায়ই বেভারিজ সাহেবের কাছে আসতে দেখেছে কান্ত। সব সাহেবই আসত বেভারিজ সাহেবের বাড়িতে। ওই হলওয়েল সাহেব, ম্যানিংহাম সাহেব। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে এক কাণ্ড চলেছে তা জানত না। নবাবের মাসি যে নবাবের শত্রু, তাও জানত না।

তা হলে কী হবে?

বশির মিঞা বললে–লড়াই হবে। নবাব যখন একবার রেগে গেছে, তখন আর তো সহজে ঠান্ডা হচ্ছে না, ফিরিঙ্গিদের দরিয়ার ওপারে না-পাঠিয়ে আর ছাড়ছে না। ফিরিঙ্গিরাও বাঁচবে না, ও রাজা রাজবল্লভও বাঁচবে না, ওই ঘসেটি বেগমও বাঁচবে না। মির্জা সাহেবের একবার গোসা হলে তখন আর কারও পরোয়া করবে না

তা হলে আমার চাকরির কী হবে?

বশির মিঞা বললেআরে নোকরির কথা তুই পরে ভাবিস, আগে তুই বাঁচিস কি না তাই দ্যাখ। লড়াই হলে তোর কলকাতা থাকবে নাকি? তোর লাটসাহেব ওই ড্রেক সাহেবই বাঁচে কি না তাই আগে ভাব। একলকাতাও থাকবে না, এই ফিরিঙ্গিদের কেল্লাও থাকবে না, এই ফিরিঙ্গি বাচ্চারাই সব মরে মামদো ভূত হয়ে যাবে। তখন আমার কথা মনে রাখিস, তোকে আমি হুশিয়ার করে দিচ্ছি, বশির মিঞা কখনও ঝুট বলে না–

বশির মিঞা চলে যাবার পর কান্ত তাড়াতাড়ি গিয়ে নৌকোয় উঠল। বদর বদর।

যেমন দেশের ঊর্ধ্বে আর একটা দেশ আছে, তার নাম মহাদেশ, যেমন কালের ঊর্ধ্বে আর একটা কাল আছে তার নাম মহাকাল, তেমনই ইতিহাসের ঊর্ধ্বেও আর একটা ইতিহাস আছে তার নাম মানুষ। মানুষই ইতিহাস। এই মানুষই মহাদেশ সৃষ্টি করেছে, এই মানুষই মহাকাল সৃষ্টি করেছে, এই মানুষই ইতিহাসের সৃষ্টিকর্তা। পৃথিবীর ইতিহাস মানুষেরই ইতিহাস। এই মানুষই একদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হয়ে সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে নোনা জলে হাবুডুবু খেতে খেতে ইন্ডিয়াতে এসে পৌঁছেছিল, আবার এই মানুষই একদিন আলিবর্দি খাঁ হয়ে তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। বলেছিল তোমরা থাকো এখানে, থেকে কারবার করো। আমাদের শুধু সামান্য কিছু কারবারের মুনাফার অংশ দিয়ো। আর হিন্দুরা মারাঠা দেশ থেকে এসে আমাদের বড় জ্বালাতন করছে, তাদের শায়েস্তা করতে তোমাদের মদত চাই। হিন্দুদের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আমার সারা জীবনটা কেটে গেছে। আমার টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে। তোমরা টাকা দিয়ে বন্দুক দিয়ে কামান দিয়ে আমাকে সাহায্য করা, যাতে আমি আয়েশ করে মসনদে বসে রাজ্য শাসন করতে পারি। আমরা মোগল, আমরা সেই বারোশো বছর আগে আরব দেশ থেকে বেরিয়েছিলাম জেহাদ করতে, হজরত মহম্মদের বাণী প্রচার করতে। সারা পৃথিবী আমরা কবুল করেছি। শেষকালে এখানে এসে এই মারাঠি ডাকাতদের হাতে বুড়িগঙ্গায় ডুবে মরব নাকি! তোমাদের কাছে আমি মদত চেয়েছিলাম, তার বদলে তোমরা আমার লোকসান করেছ। আমার গদি কেড়ে নেবার মতলব করেছ। তোমরা বাগবাজারে পেরিং-পয়েন্টে কেল্লা বানিয়েছ, কেশাল সাহেবের বাগানবাড়ির মধ্যে গড়বন্দি তৈরি করেছ। তাই আমরা তোমাদের ওয়াটস্ সাহেবকে, কলেট সাহেবকে, আর ব্যাটসন সাহেবকে ধরে গারদে পুরেছি। তাই আমরা তাদের দিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে নিয়েছি–মুচলেকায় লেখা আছে–প্রজাগণের মধ্যে কেহ রাজদণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য কলিকাতায় পলায়ন করিলে, আদেশ দেওয়ামাত্র তাহাদিগকে নবাবের হস্তে সমর্পণ করিতে হইবে। গত কয়েক বৎসরের বাণিজ্যের দস্তকের হিসাব দিতে হইবে এবং ওই সকলের অপব্যবহারজনিত রাজকোষের যে-পরিমাণ ক্ষতি হইয়াছে তাহার ক্ষতিপূরণ করিতে হইবে। পেরিং-পয়েন্টে যে-কেল্লা নির্মিত হইয়াছে তাহা ভাঙিয়া ফেলিতে হইবে এবং কলিকাতার হলওয়েল সাহেবের ক্ষমতা বিশেষ সংকুচিত করিতে হইবে। ইতি, বিনীত বশংবদ ওয়াটস, কালেট ও ব্যাটসন।

সচ্চরিত্র ঘটক তখনও ছাতিমতলার ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে দূরের বাঁকটার পানে চেয়ে আছে। নদীটা ওখানেই বাঁক নিয়েছে। যেন সেই দিকেই একটা টিমটিমে আলো নজরে পড়ল। বরবাবাজি এত দেরি করবে কে জানত। আজকালকার ছোকরাদের একটা দায়িত্বজ্ঞান বলে কিছু নেই। আগেকার মতো ক্ষমতায় থাকলে ঘটকমশাই আবার চলে যেত সেই কলকাতায়। একবার হাতিয়াগড় একবার কলকাতা। দেনাপাওনার কথা তো সবই হয়ে গিয়েছিল। আগেকার দিনে এমন ছিল না। আগে গ্রামের মধ্যেই বর, গ্রামের মধ্যেই কনে। আর এখন যদি সন্ধান পাও তো যাও কাটোয়া, যাও পূর্বস্থলী, যাও বর্ধমান। কঁহা বীরভূম, কঁহা ঢাকা, সোনারগাঁ, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ। কোনও জায়গায় আর যেতে বাকি নেই সচ্চরিত্রর।

সচ্চরিত্র বলে–আমার নাম সচ্চরিত্র ঘটক, আমি হলাম ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটকের পুত্র, ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র, ঈশ্বর সিদ্ধেশ্বর ঘটকের প্রপৌত্র। সমস্ত ঘটককারিকা আমার মুখস্থ গো, আমরা হলাম। সাতপুরুষের ঘটক, যদি কলকাতায় কখনও যান হুজুর, আমার নাম করবেন

লোকে বলে কলকাতায় কে তোমায় চিনবে?

আজ্ঞে বড় বড় যজমান সব আমার আছেন সেখানে, নানান জাতের গেরস্থ সব। বাহাত্তুরে কায়েত কৃষ্ণবল্লভ সোম আমার যজমান, মৌলিক কায়েত গোবিন্দশরণ দত্ত, কুলীন কায়েত গোবিন্দরাম। মিত্তির, শ্রোত্রিয় বামুন কন্দর্প ঘোষাল, কুলীন বামুন মনোহর মুখুজ্জে, সুবর্ণ বণিক শুকদেব মল্লিক, সদগোপ আত্মারাম সরকার, তিলি কালীচরণ পাল, কৈবর্ত গৌরহরি হালদার, সব আমার যজমান। শুধু কলকাতা কেন, বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, নদীয়ায় পর্যন্ত যজমান আছে আমার হুজুর। যাদের কাজকর্ম একবার করে দিয়েছি আর কোনও ঘটকের কাজ পছন্দ হয় না তাদের

এই সচ্চরিত্রর কথাতেই বিশ্বাস করে শোভারাম মেয়ের সম্বন্ধ করেছিল। সারা মুলুকটাই ঘুরে বেড়াত সচ্চরিত্র পোঁটলাটি কাঁধে নিয়ে। এ-গ্রাম থেকে সে-গ্রাম। তারপর দুমাস-তিনমাস কোথায়। কোথায় কেটে যায় কেউ জানতে পারে না। বাড়ির ছেলেমেয়ে বউয়ের সঙ্গে হয়তো ছ’মাস পরে একদিন দেখা হয়। তারপর আবার একদিন বেরিয়ে পড়ে। এমনই রাজমহল থেকে বর্ধমান, বর্ধমান থেকে হুগলি, হুগলি থেকে কলকাতা। কলকাতাই কি ছোট জায়গা নাকি। কায়েতই যে কতরকম এখানে। জেলে-কায়েত, ছুতোর-কায়েত, চাষাকায়েত। পইতে কি চেহারা দেখে আর কাউকে চেনবার উপায় নেই। একমাথা বাবরি চুল, গাল পর্যন্ত টানা জুলপি, ওপর ঠোঁটে একটুখানি গোঁফ শুধু। মাথায় পাগড়ি, গায়ে জোব্বা আর পায়ে চামড়ার চটি, দেখেই বোঝা যায় কলকাতার নতুন সম্প্রদায়ের লোক।

শোভারাম যেবার প্রথম সচ্চরিত্রর সঙ্গে পাত্র দেখতে এসেছিল, জিজ্ঞেস করেছিল–ওসব কারা ঘটকমশাই?

সচ্চরিত্র বলেছিল–সাবধান, আস্তে কথা বলুন বিশ্বাসমশাই, কোম্পানির দালাল ওরা। ওদের অমন কথা বলবেন না, ওদের দোরে লক্ষ্মী বাঁধা, কঁচা টাকা ওদের হাতে জমেছে, ও আপনার মুর্শিদাবাদও নয়, হাতিয়াগড়ও নয়, আপনি আজ্ঞে করে কথা বলতে হয় এখেনে–

সচ্চরিত্র বলত ও চিৎপুর সিমলে মির্জাপুর আরপুলি কলিঙ্গা বির্জিতলাই বলুন আর ওদিকে বেলগেছে উলটোডিঙি কামারপাড়া কঁকুড়গাছি বাগমারি ট্যাংরাই বলুন, সব আমার এলাকার মধ্যে

রাস্তার মধ্যে কাউকে দেখলেই ঘটকমশাই ডাকত–ওগো, ও-মশাই শুনছেন

কে গো, আমাকে ডাকছ?

বলি এখানে বিয়ের যুগ্যি পাত্তোরটাত্তোর আছে? আমি সচ্চরিত্র ঘটক, আমার পিতা ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটক, পিতামহ কালীবর ঘটক, প্রপিতামহ সিদ্ধেশ্বর ঘটক, ঘটকালি আমাদের সাতপুরুষের পেশা–

ভদ্রলোক বারকয়েক দেখলেন সচ্চরিত্রর দিকে। দেখে কী ভাবলেন কে জানে। বললেন–ওদিকে দেখুন, এদিকে নেই

ইন্দিবর ঘটক সচ্চরিত্রকে ছোটবেলাতেই বলে গিয়েছিলেন। এবার আমাদের ধর্মকর্ম সব যাবে সচ্চরিত্র–

সচ্চরিত্র তখন ছোট। বুঝতে পারেনি কথাটা। জিজ্ঞেস করেছিল কেন?

যাবেই তো! ইদিকে নবাব হল ম্লেচ্ছ, উদিকে ফিরিঙ্গিরাও হল ম্লেচ্ছ, জাতজন্ম আর ক’দিন বাঁচবে? হিন্দু আর কেউ থাকবে না

তা বটে! কিছুই আর থাকবে না। এরকম করে আর জাত-পেশা রাখা চলবে না। হঠাৎ দূর থেকে আলোটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। ছাতিমতলার ঢিবিটা পেরিয়ে একেবারে করুণাময়ীর ঘাট বরাবর গিয়ে হাজির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সচ্চরিত্র। হ্যাঁ, ঠিক এসেছে। হুমড়ি খেয়ে পড়ল নৌকোর গলুইয়ের ওপর। পড়েই কান্তর হাতখানা ধরে ফেলেছে। তুমি আমাকে কী বিপদে ফেলেছিলে বলল দিকিন বাবাজি, আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারিনে, এদিকে খিদে পেয়েছে, আর ওদিকে কী কাণ্ড বলল দিকিনি তোমার, ছি ছি ছি আমি হলাম ঈশ্বর ইন্দিবর ঘটকের পুত্র, ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র…।

কান্ত যেন মুশকিলে পড়ল। বশির মিঞাই তো আসলে গণ্ডগোল বাধালে। তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই তো ভাটা এসে গেল নদীতে। চড়ায় আটকে গেল নৌকো।

তাড়াতাড়ি কান্তকে নিয়ে ছুটেছে সচ্চরিত্র। বিয়েবাড়ির সামনে গোলমাল শুনে শোভারামও ছুটে এসেছে। মনটা বড় খারাপ ছিল তার। এত সাধের মেয়ে তার। একেবারে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললে কান্তকে দেখে।

কান্ত বললে–নদীতে ভাটা পড়ে চড়ায় আটকে গিয়েছিল আমার নৌকো,

গোলমাল শুনে সিদ্ধান্তবারিধিমশাইও এসে পড়েছিলেন। বললেন–তা এখন তো আর উপায় নেই। শোভারাম, সম্প্রদান তো হয়ে গেছে–

তা হলে?

বশির মিঞাই তো গোল বাধালে। নৌকো আটকে যাবার পর কী করবে বুঝতে পারেনি কান্ত। নাপিত বলেছিল–চলুন বাবু, হাঁটা-পথেই যাই, যদি ঘোড়াটোড়া ভাড়া পাওয়া যায় তো তাই নেওয়া যাবে

শাহি রাস্তার অবস্থাও ভাল নয়। কোথায় ঘোড়া! হাঁটা-পথে হেঁটে গেলেও এক প্রহর লাগবার কথা। কী করবে বুঝতে পারেনি কেউ। শেষে ভাগ্য ভাল, জোয়ার আসতে দেরি হয়নি। সেই নৌকোতেই চারজনে মিলে বৈঠা বাইতে বাইতে এসেছে। ঘেমে নেয়ে একেবারে প্রাণ বেরিয়ে গিয়েছে।

শোভারাম তাড়াতাড়ি ভেতর বাড়ির দাওয়ার কাছে গিয়ে ডাকলে–নয়ান

নয়ানপিসি এল। সব শুনে বললে–তা এখন আর কী করবে দাদা, এখন তো আর করবার কিছু নেই

বলে আবার বাসরঘরে গিয়ে ঢুকল। বললে–ওরে মেয়েরা, তোরা বরকে বিরক্ত করিসনে বাছা, বর এখন একটু ঘুমুবে–

নন্দরানি বললে–তুমি যাও তো এখেন থেকে নয়ানপিসি, বর এখন আমাদের, আমরা যা করাব। তাই করবে

নয়ানপিসি চলে যেতেই নন্দরানি বললে–আজকের রাত্তিরে বর কি একা মরির, বর আজকে আমাদের সকলের, কী ভাই বর, রাজি তো?

উদ্ধব দাস বললে–ঠাকরুনরা যেমন নিবেদন করবেন, তেমনই হবে

ও মা, বর যে দেখছি খুব সেয়ানা রে, বলি হ্যাঁ গো বর, কনেকে কোলে করতে পারবে তো?

উদ্ধব দাস বললে–কোলে তো আগে করিনি কখনও, ঠাকরুনরা বললে–করতে পারি

ওলো, বরের কথা শোন, তা তোমার বুঝি আগে আর বিয়ে হয়নি?

উদ্ধব দাস বলে–না।

নন্দরানি বললে–সকলের সামনে মরিকে কোলে করতে হবে কিন্তু, আমরা সকলে দেখব

উদ্ধব দাস বলে উঠল–তা আপনারা যদি নিবেদন করেন তো আপনাদের কোলে তুলতে পারি

সবাই হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল। তারাময়ী বললে–ওমা, কী অসভ্য বর ভাই

তা হোক, কথাটা তারাময়ী বললে–বটে, তবু বরকে নিয়ে মেয়ে-মহলের যেন আনন্দ কৌতূহলের শেষ নেই।

নন্দরানি এগিয়ে এসে বললে–তা আমাকে কোলোকরা দিকি ভাই, দেখি তোমার কত ক্ষমতা

তারপরেই হঠাৎ ভয় পেয়ে সরে এল। বললে–ওমা, এবর যে সত্যি সত্যি হাত বাড়ায় গো, না, অত রসে কাজ নেই, নে লো তারা, মরিকে ধরে বরের কোলে বসিয়ে দে তো

মরালী এতক্ষণ ঘোমটায় মুখ ঢেকে চুপ করে বসে ছিল। একজন কানে কানে গিয়ে কী বললে। বলতেই মরালী কান সরিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল

ওমা, মরি যে কাঁদছে লো!

সবাই অবাক হয়ে গেল। এমন এক-বিয়েওলা বর পেয়েও মন ভরেনি মেয়ের। বুড়ো হোক, যাই হোক, এবরের সঙ্গে তো ঘর করতে পারবে তবু। এবরের সঙ্গে এক ঘরে তো শোবে। তবু কান্না! আর আমাদের!

নন্দরানি বুঝিয়ে বললে–আজকের দিনে বরের কোলে বসতে হয় রে, বরের কোলজোড়া রূপ দেখে আমরাও নয়ন সাখক করি, আয় ভাই মরি, ছিঃ

তবু কিছুতে মরালী নড়ে না। পাথরের মতন শক্ত হয়ে বসে রইল একপাশে।

অনন্তদিদি বললে–রাত পোয়ালে তখন তো আর আমরা কেউ আসব না রে, আর আসতে চাইলেও তোরা কেউ আসতে দিবিনে, আজকের মতো আমরা একটু আনন্দ করে নিই আমাদের নিজেদের তো সাদ-আহ্লাদ সব ঘুচে গেচে ছি, কথা শোন, আজ শুনতে হয়–

কিন্তু টানাটানি করেও কিছু ফল হল না। সকলকে আঁচড়ে কামড়ে একাকার করে দিলে মরালী। কিছুতেই সে বরের কোলে বসবে না।

এবার নন্দরানি এগিয়ে এল। বললে–তোরা সর দিদি, আমি দেখি

বলে–কোমরে কাপড় জড়িয়ে মরালীকে টেনে বরের কোলে বসাতে যেতেই এক কাণ্ড ঘটে গেল। নন্দরানির বুড়ি মা বাইরে থেকে আর্তনাদ করে উঠল–ও মা, অনন্ত, অনন্ত রে–

সমস্ত ঘরখানা যেন অকস্মাৎ এক নিমেষে স্তব্ধ পাথর হয়ে গেল সে কান্নার শব্দে। কী হল। কী হয়েছে! মেয়েরা সবাই এক অজ্ঞাত আতঙ্কে শিউরে উঠেছে।

কী হয়েছে জ্যাঠাইমা? কে বুঝি জিজ্ঞেস করলে।

আমার অনন্তর কপাল পুড়েছে মা! অনন্ত যে আমার মাছ না হলে খেতে পারে না গো! ও অনন্ত, অনন্ত রে–

বাসরঘর থেকে বেরিয়ে এল অনন্তবালা। সঙ্গে নন্দরানিও বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এল তারাময়ী, বেরিয়ে এল সবাই। বাইরে ভিড় হয়ে গেল এক নিমেষে। শোভারাম ছুটে এল। জিজ্ঞেস করলে কী হয়েছে বামুনদিদি?

নয়ানপিসিও এসে দাঁড়িয়েছিল। বললে–মেয়েকে করুণাময়ীর ঘাটে নিয়ে গিয়ে সিঁদুরশাখা ভেঙে দাও গে, ও আর কেঁদে কী করবে দিদি, কপালের লিখন তো কেউ খণ্ডাতে পারবে না–

ভিড় জমে গেল বাড়ির উঠোনে। বরের সঙ্গে কোনওদিন কথাও হয়নি অনন্তবালার। কথা হওয়া দূরে থাক, ভাল করে দেখেওনি বরকে কোনওদিন। সেই স্বামীর মৃত্যুসংবাদ শুনে কাতর হওয়া স্বাভাবিক কি অস্বাভাবিক সেকথাও কারও মনে এল না। স্বামীর মৃত্যু মানে জীবনের সব সাধ-আহ্লাদ থেকে বঞ্চিত হওয়া, পাথর যদি হয়েই থাকে তো সে শোকে না লোকাঁচারের সংস্কারে, কে জানে? আর কোনওদিন মাছ খেতে পারবে না অনন্তবালা। আর কোনওদিন শাঁখা-সিঁদুর-শাড়ি পরে বেরোতেই পারবে না, এ-ও কি কম ক্ষোভ, কম ক্ষতি! এর পর থেকে এই নয়ানপিসির মতো পরের বাড়ির উৎসবে-আনন্দে শুধু গতরে খেটে আনন্দ দিতে হবে। অথচ নিজেরই যেন এতদিন আনন্দ করবার কিছু ছিল!

তবু সহানুভূতির কথা শোনাল সবাই! অনন্তবালাকে নিয়ে যখন বামুনদিদি বাড়ি চলে গেল তখন সকলের মুখ দিয়েই শুধু একটা শব্দ বেরোল–আহা!

আর মেয়েরা যে-যেখানে ছিল সবাই সেই আহা’ শব্দের সঙ্গে নিজেদের জীবনের মর্মান্তিক সত্যিটাই প্রকাশ করে দিলে। অথচ এ-ঘটনা এত সত্য, এত স্বাভাবিক, এত সাধারণ যে তার কোনও প্রতিকারই নেই যেন কারও হাতে! নিতান্ত কার্যগতিকেই জামাই যাচ্ছিল নৌকো করে কোন দেশে, যাচ্ছিল হয়তো আর কোনও কন্যার পাণিগ্রহণ করতে–পথে ডাকাত পড়ে খুন করে ফেলেছে। ঘটনাটা ঘটেছে কতদিন আগে। তার পরেও কতদিন ধরে অনন্ত শাঁখা-সিঁদুর পরেছে, মাছ খেয়েছে, স্বামীর আসার প্রতীক্ষায় দিন গুনেছে, বছর গুনেছে, এতদিন পরে সে খবর হাতিয়াগড়ে এসে পৌঁছেছে। বাংলার গ্রামে গ্রামে যত বধূ ছিল সবাই একসঙ্গে অনাথা হয়ে গেল। এর বুঝি কোনও প্রতিকার নেই, কোনও সান্ত্বনাও নেই কোথাও। সেদিনকার উৎসবের মধ্যে হঠাৎ যেন কোনও অশনিপাতে সব নিঃশেষ হয়ে গেল।

সচ্চরিত্র ঘটক এতক্ষণ খাইখাই করেও খেতে পারেনি। যেন তার খাবার জায়গাও হঠাৎ ফুরিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে কান্তর সঙ্গে দেখা।

একী বাবাজি, তুমি এখনও আছ? খাওয়া হয়েছে?

কান্ত কিছু উত্তর দিলে না।

সচ্চরিত্র বললে–সেকী, বিয়ে হল না বলে খেতে কীসের আপত্তি, চলো, আমারও খাওয়া হয়নি–

তারপর নাপিতের দিকে চেয়ে বললে–চলো হে, তুমিই বা কেন মাঝখানে থেকে উপুসি থাকবে, চলো, চলো–

ওদিকে মুর্শিদাবাদেও অনেক রাত হয়েছে। রাত হলেই আজকাল কেমন সব থমথম করে। এই মহিমাপুর থেকেই শাহিবাগটার সামনের বড় মসজিদটা দেখা যায়। মসজিদের মাথায় সবুজ নিশান ওড়ে। হাওয়ায় দোল খায়, পতপত করে। তার ওপরে একটা বাতি জ্বলে। বাতির আলোটা আরও অনেক দূর থেকে দেখা যায়। ভাগীরথী দিয়ে যেতে যেতে নৌকোর মাঝিমাল্লারা আলোটা দেখে নিশানা ঠিক করে নেয়। বলে মসজিদের আলো

ফতোদ জগৎশেঠের বাড়ির লোহার দরজার সামনে বন্দুক নিয়ে বসে পাহারা দেয় ভিখু শেখ।

ভিখু শেখ বলে–মহারাজ ফতোদ জগৎশেঠকা হাবেলি।

মনিবের গৌরবে গোলামেরও গৌরব বাড়ে। সামনে দিয়ে কেউ গেলে কিছু বলে না। যার-তার সঙ্গে কথা বললে–ভিখু শেখের ইজ্জত চলে যায়। শাহি সড়কের পদাতিক মানুষের ওপর তার বড় তাচ্ছিল্য। তাচ্ছিল্য করে বলেই তাদের সঙ্গে কথা বলে নিজেকে ছোট করে না। বরং একলা চুপচাপ সব দেখে। দুনিয়াদারি দেখতে ভিখু শেখের বেশ লাগে। যখন নবাব মঞ্জিলের নহবতখানায় ইনসাফ মিঞা ভোরবেলা আশাবরীর সুর তোলে তখন ভিখু শেখ মাঝে মাঝে চোখ বুজে দিওয়ানা হয়ে যায়। দুনিয়ার দৌলত, খানদান, জৌলুস, জমজমা, আওরাত, তনখা, এমনকী বেহেস্তের খোদাতালা পর্যন্ত তার কাছে বরবাদ হয়ে যায়। যেন ইনসাফের নহবতের ফুটোগুলোতে মিছরি মাখানো আছে। ভিখু শেখের মতো পাঠানকেও জাদুর মোহে ভুলিয়ে দেয়। আর ঠিক তার পরেই বুঝি হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠে। চোখ দুটো খোলে। বন্দুকটাও সামলে নেয়। গোঁফজোড়া পাকিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে নিজেকে যেন অপরাধী মনে হয় তার। রাজা দৌলতরাম ফতোদ জগৎশেঠজির সে খাস নৌকর। রাজা দৌলতরাম নামটা তার নিজের দেওয়া। তার মনে পড়ে যায়, তার ওপর নির্ভর করে এত বড় দৌলতরাম আরাম করে ঘুমুচ্ছে। তার একটু গাফিলতিতে সবকিছু লোকসান হয়ে যেতে পারে। মারাঠি ডাকুরা লুঠপাট করে নিতে পারে। চোট্টা ডাকুর তো কমতি নেই দেশে। দৌলত দৌলত করে তামাম দুনিয়া মস্তানা হয়ে গেছে। আরে, হারামি দৌলতের মতো খতরনাক চিজ আছে নাকি আর? দৌলতের জন্যেই তো বেগমের সঙ্গে নবাবের, নবাবের সঙ্গে নবাবজাদার লড়াই চলছে দুনিয়ায়। দৌলত আর আউরত। দুটোই খতরনাক চিজ। ভিখু শেখের চোখের সামনেই এই দুটো জিনিসের পাহাড় জমে আছে। দৌলত ভি দেখেছে, আউরত ভি দেখেছে, ঘসেটি বেগম, আমিনা বেগম, মনি বেগম সবাইকে দেখেছে ভিখু শেখ। ঢাকার দেওয়ান নোয়াজিস মহম্মদ সাহেবকে দেখেছে, পূর্ণিয়ার দেওয়ান সৈয়দ আহম্মদ সাহেবকে দেখেছে। শেঠ মানিকচাঁদ সাহেবকে দেখেছে, ফতেচাঁদ জগৎশেঠজিকে দেখছে। মহারাজ স্বরূপচাঁদকে দেখেছে, এখন মহতাপচাঁদ জগৎশেঠজিকে দেখছে। সবই দৌলত আর আউরত। সেই দৌলত আর আউরতের খাতিরেই সবাই মহারাজার কাছে দরবার করে। কাশ্মীরিরা আসে, মুলতানিরা আসে, পাঠানরা আসে, শিখরা আসে। তাতার, মোগল, ফিরিঙ্গি, ইংরেজ, দিনেমার, আর্মানি সবাই আসে। এসে টাকা চায়, হুন্ডি কেনে। ভিখু শেখ শেঠজির ফটকে পঁড়িয়ে সবাইকে দেখে। সব লক্ষ করে। কিন্তু কথা বিশেষ বলে না।

কিন্তু সেদিন হাঁক দিয়ে উঠল ভিখু শেখ–কৌন?

বশির মিঞা বলে–আমি রে বাপু, আমি

আমি কৌন?

আরে বাবা, আমাকে চিনিস না? মোহরার মনসুর আলি মেহের আমার ফুপা, নবাব-নিজামতের মোহরার

ভিখু শেখ আজকের লোক নয়। মির হবিব খাঁ যখন বর্গির সেপাই নিয়ে শেঠজির বাড়ি চড়াও হয়েছিল, তখনও এই বন্দুক দিয়ে দশটা মারাঠি ডাকুকে খুন করেছিল। ফতেচাঁদ জগৎশেঠজির আমলের লোক সে। অত সহজে তাকে দলে টানা যায় না।

বললে–হুকুম নেই—

বশির মিঞা বললে–আরে হুকুম নেই মানে, তোমার শেঠজির দোস্ত আমাদের নবাব, আমাদের অন্দরে যেতে দেবে না?

তারপর হঠাৎ সোজা কথায় কাজ হবে না দেখে আদর করে বললে–কেন গোসা করছ শেখজি, তুমিও মুসলমান আমিও মুসলমান, এক জাত, এক আল্লা আমাদের

ভাগো নেড়ি কুত্তা!

এর পর আর দাঁড়ানো যায় না। জগৎশেঠজির হুকুম হয়েছে কাউকেই বিনা পাঞ্জায় ঢুকতে দেওয়া হবে না এই হাবেলিতে! দুনিয়ার হালচাল ভাল নয়। দিল্লির বাদশা না-থাকারই মতো। পাঠান, আফগান, মারাঠি সবাই টাকা লুঠতে বেরিয়েছে। আর জগৎশেঠজির মতো টাকা কার আছে? শাহানশা বাদশা দিল্লির বাদশার চেয়েও বেশি দৌলত জগৎশেঠজির। তাই মহিমাপুর হাবেলির সব ফটকে বন্দুকওয়ালা পাহারাদার বসেছে। কোথাকার কোন নবাবের মোহরার তার রিস্তাদারকে ঢুকতে দেবে জগৎশেঠজির বাড়িতে! ভিখু শেখ আবার বন্দুকটা খাড়া করে ধরে গোঁফে তা দিতে লাগল।

কৌন?

এবার দুটো পালকি এগিয়ে আসছিল। সামনে সামনে আসছিল আর-একজন আদমি। আদমিটা কাছে আসতেই ভিখু শেখ হাতটা ধরে ফেলেছে। ফির দিল্লাগি!

বশির মিঞা এবার বুকটা চিতিয়ে দাঁড়াল।

পাঞ্জা?

পাঞ্জাও ফেলে দিলে চিত করে ভিখু শেখের চোখের সামনে।

পালকিতে কে আছে?

জেনানা!

এবার আর আটকানো যায় না। ফটকটা ফাঁক করে রাস্তা করে দিলে ভিখু শেখ। দিতেই পালকি দুটো ভেতরে গিয়ে ঢুকল। মহিমাপুরের এই বাড়িতে কত নবাব এসেছে। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এসেছে, নবাব সুজাউদ্দিন খাঁ এসেছে, নবাব সরফরাজ খাঁ এসেছে, নবাব আলিবর্দি খাঁ এসেছে। জগৎশেঠজিরা কি নবাবের চেয়ে কিছু ছোট? লড়াই করতে যখন টাকার কমতি পড়বে তখন তো জগৎশেঠজির কাছেই হাত পাততে হবে। দিল্লির বাদশার কাছেও যখন খাজনা পাঠাতে হবে তখন তো এই জগৎশেঠজির কাছেই হুন্ডি কাটতে হবে। পালকি ভেতরে চলে যাবার পর ভিখু শেখ আবার গোঁফজোড়া পাকিয়ে নিলে। ভিখু শেখ নিজে পাঠান, আর জগৎশেঠজি জৈন। তা হোক, ভিখু শেখের কাছে ইমানদারি আগে, তারপর জাত। ভিখু শেখ ইমানদারির জন্যে একবার নিজের জানের ঝুঁকি নিয়েছিল। দরকার হলে আবার নেবে। রাস্তার সামনে একটা ঘেয়ো কুকুর সামনের দিকে আসছিল। ভিখু শেখ বন্দুকটা জমিনের ওপর ঠুকল–ভাগো, নিকাল

শালা নেড়ি কুত্তার বাচ্চা! জগৎশেঠজির অন্দরে ঘুষতে এসেছে। নবাব সরফরাজ খাঁ এইরকম করে একদিন জগৎশেঠজির হারেমে ঘুষতে চেয়েছিল। তার ফল পেয়েছে নবাব। তোরও সেই দশা হবে। ভাগ ভাগ নিকাল যা–ভিখু শেখ বন্দুকটা নিয়ে আবার জমিনের ওপর ঠুকে দিলে।

ওদিকে দেউড়ি পেরিয়ে পালকি দুটো গিয়ে থামল দরদালানের সামনে। পালকির দরজা খুলে ঘোমটা দেওয়া জেনানা নামল একজন। পেছনের পালকিতেও জেনানা। আর নামল মোহরার মনসুর আলি মেহের। বশির মিঞা বুকটা আরও চিতিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। জগৎশেঠজির অন্দরের দরোয়ান গদির দরজা খুলে দিলে। তারপর সকলকে বসতে বলে অন্দরে চলে গেল।

মনসুর আলি সাহেব বশিরকে বললে–তুই বাইরে যা

বশির মিঞা দরজার বাইরে এসে একটা বিড়ি ধরালে। তারপর চারদিকে চেয়ে দেখলে কেউ কোথাও নেই। মুর্শিদাবাদ থেকে অনেক দূরে এই মহিমাপুর। সারাদিন খেটে খেটে পরেশান হয়ে গিয়েছিল। তা জাসুসের কাজই এইরকম। ভেতরে কী কথা হচ্ছে শোনা যাচ্ছে না। ভিখু শেখ তখন নেড়ি কুত্তাটাকে তাড়া করছে। বশির মিঞা বললে–আহ্যাঁ হ্যাঁ, ওকে তাড়াচ্ছ কেন শেখজি, ও তো কুত্তা, ছাড়া আর কিছু নয়

তারপর ভাল করে ভাব করবার জন্যে জেব থেকে একটা বিড়ি বার করলে একটা বিড়ি পিয়ো খাঁ সাহেব

ভিখু শেখ এরকম অনেক বশির মিঞাকে বগলে টিপে মেরে ফেলতে পারে। কিছু বললে–না মুখে, বশিরের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে একবার চাইলে। অর্থাৎ আমি যার-তার নোকর নই ছোকরা, আমি শাহানশা বাদশা দিল্লির আলমগির বাদশার চেয়েও রেইস আদমি জগৎশেঠ মহাতাপজির নোকর! আমি কুত্তাদের সঙ্গে বাতচিত করি না–।

বশির মিঞা ভয়ে ভয়ে পেছিয়ে এসে বিড়িটাতে লম্বা লম্বা টান দিতে লাগল।

জগৎশেঠজি ঘরে ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে আদাব করলে। ততক্ষণে মনসুর আলি ঘরের সব জানালা দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসেছে।

হুজুর, ইনিই সেই হলওয়েল সাহেব আর এঁকে তো চেনেনই, মিরজাফর আলি সাহেব।

জেনানার বোরখা খুলেছে তখন দুজনেই। জগৎশেঠজি বসতেই হলওয়েল সাহেব বসল, পাশে বসল মিরজাফর আলি খাঁ।

জগৎশেঠজি সোজা কথার লোক। ফতোদজি যতদিন বেঁচে ছিলেন, সব হাতেকলমে মহাতাপজিকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়ে গেছেন। মহাতাপজি নিজেও ছিলেন দিল্লির বাদশার দরবারে। তামাম দুনিয়ায় কোথায় কী ঘটছে তা জগৎশেঠজির জানতে বাকি নেই। দিল্লির বাদশাই হোক আর তাতারের খুদে চামড়ার কারবারিই হোক, জগৎশেঠজির কাছে টাকার জন্যে হাত পাততেই হবে। ফতোদজি রেখে গিয়েছিলেন দশ কোটি টাকা, মহাতাপজি আর স্বরূপচাঁদজি দুই ভাই মিলে তাকে এই কদিনেই বাড়িয়ে করেছেন বারো কোটি টাকার জন্যেই বরাবর ওয়াটস্ সাহেব, কলেট সাহেব, হলওয়েল সাহেব, ব্যাটসন সাহেব সবাই তার কাছে এসেছে হুন্ডির জন্যে। কিন্তু এবার অন্য কারবার। এবার টাকা নয়, দুনিয়াদারি।

হলওয়েল সাহেব বললে–না হুজুর, দুনিয়াদারি নয়–

জগৎশেঠজি বললেন–তা দুনিয়াদারি নয় তো কী? আমার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে আপনাদের কাউন্সিল কলকাতায় ঠাকশাল করেছে, আমি খবর পেয়েছি।

হলওয়েল ইংরেজ বাচ্চা। গরম হতে জানলেও নরম হতেও জানে। বললে–আপনি যদি বলেন হুজুর তো মিন্ট আমরা তুলে দেব, আপনার মিন্ট থেকেই আগেকার মতন আর্কট টাকা ম্যানুফ্যাকচার করে দেব! আপনি হুজুর যা বলবেন তাই-ই করব, আমাদের কোম্পানি ইন্ডিয়াতে ব্যাবসা করতে এসেছে, পিসফুলি ব্যাবসা করতে পারলে আমরা তো আর কিছু চাই না। কিন্তু নবাব আমাদের তাও করতে দেবেন না

তারপর একটু থেমে আবার বললে–সেই জন্যেই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, আমি শুনেছি আপনি হুজুর এব্যাপারে কোম্পানির কাউন্সিলকে হেল্প করবেন

মিরজাফর আলি এতক্ষণ চুপ করে ছিল। জগৎশেঠজির সামনে বহুবার এসেছে আগে আলিবর্দি খাঁ’র সময়ে। কিন্তু তখনকার কথা আলাদা। হজরত আলির শেষ বংশধর। নবাব আলিবর্দির সৎ বোনের স্বামী। বড় ভালবাসত আলিবর্দি খাঁ তাকে। কিন্তু শেষের দিকে চটে গিয়েছিলেন নবাব তার ওপর।

জগৎশেঠজি হঠাৎ বললেন–শরবত আনতে বলব?

হলওয়েল সাহেব মাথা নিচু করে সবিনয়ে বললে–আপনার খেয়েই আপনার মেহেরবানিতেই কাউন্সিল এখানে টিকে আছে হুজুর আর আপনাকে তকলিফ দেব না

মিরজাফর আলিও সুরে সুর মিলিয়ে বললে–হুজুরের অনেক কষ্ট হল, আর কষ্ট দিতে চাই না

কিন্তু আমি আপনাদের কী মদত দিতে পারব?

হলওয়েল সাহেব বললে–আপনি শুধু একটু নবাবকে বুঝিয়ে বললেই আমাদের উপকার হবে

কী বুঝিয়ে বলব?

যেন আমাদের ওপর আর টরচার না হয়, অত্যাচার না হয়। তারপরে গলাটা একটু নিচু করে বললে–নবাব আমাদের চারিদিকে স্পাই লাগিয়েছেন, আমাদের এখানকার কাশিমবাজার কুঠির ওয়াটস, কলেট, ব্যাটসনকে ধরে নিয়ে গিয়ে নজরবন্দি করে রেখেছিলেন, তাদের দিয়ে জোর করে বন্ড লিখিয়ে নিয়েছেন, মুচলেকায় সই করতে হয়েছে তাদের। তাদের জেনানাদের পর্যন্ত ইনসাল্ট করেছেন-নবাবের অর্ডারে কোম্পানির কুঠির সব মাল লুঠ করেছে। নিজামতের লোকেরা…

বলতে বলতে হলওয়েল সাহেব বোধহয় উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। মিরজাফর বললে–আস্তে সাহেব, আস্তে, অত চেঁচিয়ো না, কেউ শুনতে পাবে–

জগৎশেঠজি বললেন–না, বলুন আপনি। তারপর?

সে ইতিহাস তো এক দিনের নয়, এক যুগেরও নয়। ১৭৩০ সালে নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌল্লার জন্ম। তারও আগের কাহিনী সব। তখন এই জগৎশেঠ মহাতাপজিও জন্মাননি। মহারাজ স্বরূপচাঁদও জন্মাননি। তখন থেকেই তো ফিরিঙ্গি কোম্পানির আমদানি হয়েছে হিন্দুস্থানে। তখন থেকেই বিষনজরে পড়েছিল কোম্পানি। আওরঙ্গজেব মারা যাবার পর থেকে পাঁচজন মাত্র বাদশা হয়েছে। বলতে গেলে দিল্লির মসনদ তখন ফাঁকা। মারাঠারা উঠেছে পশ্চিমে আর শিখরা উঠতে চেষ্টা করছে। উত্তরে। এই অবস্থায় আমরা নিশ্চিন্তে কেমন করে ব্যাবসা করব হুজুর।

রাত আরও গভীর হয়ে আসছে। পালকি-বেহারারা বাইরে বসে বসে ঢুলছে। বশির মিঞা আর থাকতে পারলে না। তার নিজের বিড়ি তখন খতম হয়ে গেছে। বেহারাদের কাছে গিয়ে বললে–ভাইয়া, বিড়ি আছে তোমাদের কাছে?

ভিখু শেখ ধমক দিয়ে উঠল ফটক থেকে–এই উন্মুখ, চিল্লাও মাত

গদির ভেতরে তখন জগৎশেঠজি বললেন–আপনারা মিথ্যে কথা কেন বললেন নবাবকে?

কী মিথ্যে কথা?

আপনারা কেল্লা বানাচ্ছেন কলকাতায়, এ-খবর নবাব পেয়েছিলেন। নবাবের চিঠির উত্তরে

আপনাদের ড্রেসাহেব লিখলেন–গঙ্গার ধারে পোস্তা ভেঙে যাওয়ায় মেরামত করছেন! এটা তো মিথ্যে কথা!

হলওয়েল সাহেব কী বলতে যাচ্ছিল, জগৎশেঠজি বাধা দিয়ে বললেন–আর কাশিমবাজার কুঠির ওয়াটস্ সাহেবের মুচলেকা আপনারা মেনে নিলেন না কেন? আর একটা কথা

জগৎশেঠজির কাছে সব খবরই আসে। বোঝা গেল তার জানতে কিছুই বাকি নেই।

ঢাকার নায়েব রাজা রাজবল্লভের ছেলে কেষ্টবল্লভকে আপনারা কলকাতায় থাকতে দিলেন কেন? তার সঙ্গে অত টাকাকড়ি ছিল। আপনারা তার কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে নবাবের সঙ্গে বেইমানি করলেন কেন? রামরাম সিংয়ের ছেলে নারাণ সিংকে আপনারা ধরে রাখলেন কেন? তাকে অপমান করলেন কেন? উমিচাঁদ একটা ঠগ, ওকে আপনারা অত আমল দেন কেন? কলকাতার সোরার কারবারি বেভারিজ সাহেবের সঙ্গে উমিচাঁদের অত দোস্তালি কেন?

মিরজাফর এতক্ষণ চুপ করে ছিল। বললে–হুজুর, এইসব কথার জবাব দেবার জন্যেই আমরা এসেছি আপনার কাছে আপনি নবাবের তরফের কথাগুলো শুনেছেন, এবার আমাদের তরফের কথাও শুনুন।

জগৎশেঠজি বললেন–বলুন–আমি যখন জবান দিয়েছি, তখন কাউকেই আমি এসব কথা বলব–এক আমি ছাড়া কেউই এসব জানবে না।…

কী বিড়ি রে? বড় কড়া মাল মালুম হচ্ছে—

ভিখু শেখ বন্দুক নিয়ে এগিয়ে এসেছে এই কুত্তা, নিকাল ইহাসে–

হঠাৎ বোধহয় বাইরের রাস্তার দিকে নজর পড়েছে। আর একটা পালকি। ঘন ঘন দম ফেলবার শব্দ কানে আসতেই ভিখু শেখ পেছন ফিরল। আজ হল কী! এত পালকি আসছে এখানে।

পাঞ্জা!

পাঞ্জা দেখালে আর ভিখু শেখের করবার কিছু নেই। পাঞ্জা দেখলে ভিখু শেখ বন্দুকটা জমিনের ওপর রেখে খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। পালকিটা দেউড়ির ভেতরে ঢুকল। বশির মিঞা তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল। কোথাকার কে ভেতরে ঢুকছে নির্বিবাদে পাঞ্জা দেখিয়ে। পালকি থেকে পালকির দরজা খুলে কে নামল একজন। ঢাকাই মসলিনের পিরান গায়ে। চটকদার চেহারা। নেমে সোজা সিঁড়ি দিয়ে দরদালানের দিকে এগিয়ে গেল। বশির মিঞা কিছু বলতে পারলে না। ভদ্রলোক ভেতরে যেতেই পালকি-বেহারাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে–এ কৌন হ্যায় ভাইয়া? জমিনদার?

ভিখু শেখ ওধার থেকে আবার ধমক দিয়ে উঠল–এই কুত্তা, ফিন?

জগৎশেঠজির কাছে খবর গেল। খতটা দেখে বললেন–এখন তো দেখা হবে না। বলে দে, কাল সকালে দেখা করতে

মিরজাফর জিজ্ঞেস করলে কে হুজুর, এত রাত্তিরে?

হাতিয়াগড়ের জমিদার!

মিরজাফর যেন হাতে ইদের চাঁদ পেয়ে গেল। বললে–হাতিয়াগড়ের জমিদার? ও এলে কোনও লোকসান নেই হুজুর, ওকে আসতে বলুন, হাতিয়াগড়ের রাজা আমাদের দলে–

যে-লোকটা চিঠি নিয়ে এসেছিল সেও থমকে দাঁড়াল।

মিরজাফর আবার বলতে লাগল–শুধু হাতিয়াগড় নয় হুজুর, সবাই আমাদের দলে। নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, নাটোরের মহারানি, সবাইকে আপনার কাছে নিয়ে আসব হুজুর। হাতিয়াগড়ের জমিদারের কাছেও যে ফৌজি-সেপাই গিয়ে পরোয়ানা দিয়ে এসেছে

কেন?

হাতিয়াগড়ের রাজার কাছেই আপনি সব শুনতে পাবেন হুজুর। আমি নিজে মুসলমান হয়ে বলছি, নবাবের কাছে হিন্দু মুসলমান খ্রিশ্চান কিছু নেই, তামাম বাংলা মুলুক নবাবের দুশমন হয়ে গেছে!

জগৎশেঠজি বললেন–যাও, জমিদার সাহেবকে এত্তেলা দাও

আর সঙ্গে সঙ্গে হাতিয়াগড়ের জমিদার হিরণ্যনারায়ণ রায় ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। প্রথমে বুঝতে পারেননি। তারপর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল– আপনারা?

নয়ানপিসি তখন মরালীকে খাওয়াচ্ছিল। সারাদিন বিয়ের ধকল গেছে। উদ্ধব দাস শুভদৃষ্টির সময়েই লক্ষ করেছিল।

হরিপদ কানে কানে বলেছিল–একটু কান্নাকাটি করছে বটে, কিন্তু তা করুক, মেয়েমানুষের মন, ও দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে দাসমশাই, ওর জন্যে কিছু ভেবো না

তারপর শোভারামের দিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিল–এ তোমার অনেক ভাল হল শোভারাম, কলকাতার বর আসেনি, এ অনেক ভাল হয়েছে। বড়মশাই শুনলে রাগ করতেন, ম্লেচ্ছদের চাকরি, জাত-জন্ম কি আর থাকত তোমার মেয়ের?

শোভারাম বলেছিল কিন্তু মরি যে আমার বড় সোহাগি মেয়ে হরিপদ, পাশা খেলে, পান খায়, চুলে গন্ধ তেল দেয়, গান গায়

হরিপদ বলেছিল–তা পাশা খেলবে। দাসমশাইও তো শৌখিন মানুষ, জানো, রসের গান জানে কত

শোভারাম বলেছিল কিন্তু রসের গান শুনলে তো আর পেট ভরবে না। শেষে কি বাঁড়ুজ্জে মশাইয়ের মেয়ের মতো বাপের বাড়িতেই কাটিয়ে দেবে চের-জন্ম, শ্বশুরঘর করবার কপাল হবে না। আর

তারপর শোভারাম হরিপদকে জিজ্ঞেস করেছিল–আচ্ছা, মরি অত কাঁদছিল কেন বলো তো হরিপদ?

আহা, মেয়েছেলে হয়ে জন্মেছে, কাঁদবে না? মায়ের কথা মনে পড়ছিল হয়তো! বিয়ের দিনে মেয়েছেলে কাদবে না তো কি বেটাছেলে কাদবে? সেই যে কথায় বলে না, মেয়েছেলের মন যেখানে যেমন! দেখবে দাসমশাইয়ের কাছে গিয়ে তখন তোমার কাছে আসতেই চাইবেনা, দেখে নিয়ে তুমি

ঠিক এই ঘটনার পরেই কান্ত এসে গিয়েছিল। কতদূর থেকে কেমন করে হাঁফাতে হাঁফাতে সে এসেছে। ঘেমে নেয়ে চান করে উঠেছে বর। সচ্চরিত্র ঘটক রাস্তা থেকেই চিৎকার করতে করতে আসছিল–বর এসে গেছে। বর এসে গেছে, উলু দাও গো, উলু দাও

চারদিকে হইহই কাণ্ড তখন। লোকজন খেতে বসেছিল উঠোনের মাঝখানে। সিদ্ধান্তবারিধিমশাই তখন সম্প্রদান সেরে গামছা দিয়ে গায়ের ঘাম মুছছেন। সব কথা কানে গিয়েছিল মরালীর। সব দেখা দেখে নিয়েছে। অনন্তদিদির বর দেখে একদিন ঘেন্না হয়েছিল মরালীর। নন্দদিদির বিয়েও দেখেছিল। আজও অশোক-ষষ্ঠীর দিন নন্দদিদি উপোষ করে কলাগাছের পায়ে তেল-সিঁদুর দিয়ে এসে তবে জল খায়। তাদের পাশাপাশি তার নিজের বরের দিকে চেয়েও যেন কেমন ঘেন্না হল। হঠাৎ তার দুর্গাদিদির কথা মনে পড়ল। দুগ্যাদি কত ওষুধবিষুধ জানে। ছোট বউরানিকে ওষুধ দিয়ে ছোটমশাইকে বশ করে রেখেছে।

চুপি চুপি বললে–পিসি—

নয়ানপিসি বললে–কী রে? কান্না থামল তোর?

মরালী বললে–দুগ্যাদি আসেনি পিসি?

হ্যাঁ, কেন রে? ওই তো উঠোনে বসে খাচ্ছে—

একবার ডেকে দেবে পিসি?

তারপর খাওয়াদাওয়ার পর দুর্গা এল। বললে–ডাকছিলিস নাকি রে মরি আমাকে?

আদর করে মাথায় হাত বুলোত বুলোতে বললে–বেশ ভাতার হয়েছে লো তোর, দেখলুম, বেশ ভাতার।

হঠাৎ মরালীর চোখে জল দেখে বললে–ওমা, কঁদছিস কেন লা? ভাতার বুঝি পছন্দ হয়নি?

মরালী যেন ডুকরে কেঁদে উঠল। বললে–দুগ্যাদি, তুমি যে সেই আমাকে ওষুধ দেবে বলেছিলে?

কীসের ওষুধ লা?

মরালী বলে উঠল আমি মরব দুগ্যাদি, আমি বিষ খেয়ে মরব—

চুপ কর মুখপুড়ি, চুপ কর–

দুর্গা চারদিকে চেয়ে একবার দেখে নিলে। কেউ শুনতে পেয়েছে কি না কে জানে। নিজের আঁচল দিয়ে মরালীর চোখ দুটো মুছিয়ে দিলে। কোলে টেনে নিয়ে বোঝালে। বললে–মুখপুড়ি, তোর কপালে অনেক দুঃখু আছে, মেয়েমানুষের অত অসৈরন হলে চলে?

মরালী কাঁদতে কাঁদতে বললে–আমায় মরবার একটা ওষুধ দাও দুগ্যাদি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি আমি

দুর্গা কেমন যেন বোবা হয়ে গেল। অনেককে দুর্গা ওষুধ দিয়েছে। থুনকোর ওষুধ দিয়েছে গিরিরানির মাকে, বাধকের ওষুধ দিয়েছে বৈরাগীদের বউকে, বশীকরণের ওষুধ দিয়েছে অনন্তবালাকে। আরও কত কাজে কত ছেলেমেয়ে এসেছে তার কাছে। দুর্গার ওষুধ আজ পর্যন্ত কখনও ব্যর্থ হয়নি। জলপড়া, আগুনে পোড়া, নখদর্পণ, বাঘের মুখখিলানি, বাটি চালানো ওষুধ তো কম জানে না দুর্গা। কিন্তু এমন ওষুধ তো দুর্গার জানা নেই। স্বামীকে যার পছন্দ হয় না বিয়ের রাত্রে, তার প্রতিকার কেমন করে করবে দুর্গা!

তা হ্যাঁ লো, বর বুঝি তোর পছন্দ হয়নি?

মরালী বললে–আমি গলায় দড়ি দেব দুগ্যাদি

দুর্গা বললে–মেয়েমানুষের অত পছন্দর বালাই কেন বল তো মরি? মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছিস, অত অসৈরন হলে চলে?

মরালী বললে–তা হলে কালকে আমার মরা মুখ দেখো তুমি দুগ্যাদি

দুর্গা যেন কী ভাবলে। বললে–বোস, দাঁড়া দেখি কী করতে পারি

তারপর একটু ভেবে বললে–তুই এখন থেকে পালাতে পারবি?

আমি চুলোয় যেতে পারি দু্যাদি, আমাকে তুমি বাঁচাও

আর তার পরেই সেই রাত্রে যখন বাসরঘর থেকে সবাই বাইরে খেতে গেছে, উদ্ধব দাস মরালীর হাতটা চেপে ধরে ছিল। ঠিক তখনই বলা কওয়া নেই, নিজের হাতটা টেনে নিয়ে খিড়কির দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। দুগ্যাদি বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। হাত ধরে নিয়ে বললে–চেঁচাসনে, আয়,-সব ব্যবস্থা করে রেখেছি

মাধব ঢালি পাহারা দিচ্ছিল রাজবাড়ির সদর দরজায়। একমুখ দাড়ি-গোঁফ। মাথায় গামছা বেঁধে, সড়কি আর লাঠিটা পাশে পাশে রেখে একটু বুঝি ঢুলছিল। একবার খুট করে শব্দ হতেই বাঘের মতো লাফিয়ে উঠেছে।

কে?

দুর্গা আঁচলের আড়াল দিয়ে মরালীকে নিয়ে আসছিল। বললে–দূর মুখপোড়া, চেঁচাচ্ছে দেখো, তোকে বলে গেলাম না–

তারপর মাধব ঢালির পাশ দিয়ে যাবার সময় বললে–সরে দাঁড়াতে পারিসনে, মেয়েমানুষের গায়ে ঢলে পড়বি নাকি মুখপোড়া

তখনও ভেতরের বারমহলের উঠোনে ঢোকেনি। হঠাৎ মনে হল যেন ঘোড়র পায়ের শব্দ কানে এল। দুর্গা মরালীকে আড়াল করে বুড়োশিবের মন্দিরে এসে দাঁড়াল। তারপর একবার চারদিকে চেয়ে নিয়ে পা বাড়াল। অতিথিশালার ভেতরে কেউ আছে কি না কে জানে। ভোগবাড়ির দিকেও সমস্ত অন্ধকার। দক্ষিণ দিকের দরজাটা খোলা রেখেছিল দুর্গা। সেটা পেরিয়ে ভেতরবাড়ির ছোট গড়বন্দি। সেখানে তখনও টিমটিম করে আলো জ্বলছিল।

দুর্গা বললে–আয়, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আয়, কেউ দেখে ফেলবে—

মরালী বললেও কীসের শব্দ দুগ্যাদি? ছোটমশাই বুঝি?

দূর, ছোটমশাই তো মহিমাপুর গেছে

কেন?

দুর্গা বললে–ডিহিদারের পরওয়ানা এসেছে

কীসের পরওয়ানা?

তা জানিনে, তুই চুপ কর, কেউ জানতে পারলে তুইও মরবি আমিও মরব–

তারপর কয়েকবার ঝনঝন করে দরজার হুড়কো খোলার শব্দ হল। আলো, ফিসফিস কথা, হাঁক-ডাক, সিঁড়িতে ওঠা-নামা। অন্ধকার সিঁড়ির তলায় একটা ঘরে মরালীকে পুরে দিয়ে দুর্গা বললে–এখানে থাক তুই, আমি দরজায় তালা চাবি দিয়ে যাচ্ছি, কিচ্ছু ভাবিসনে, আমি এক্ষুনি আবার আসব—

মেহেদি নেসার খানদানি লোক। তামাম মুর্শিদাবাদে মেহেদি নেসারের নাম জানে না, এমন মানুষ পাবে না। মেহেদি নেসার মানেই খেলাত মির্জা মহম্মদ নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা। যারা নেহাত গরিব মানুষ, তারা নবাব পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না। শুধু নবাব কেন, নবারের কাছারি পর্যন্তও পৌঁছাতে পারে না। কারও বাড়িতে চুরি হয়েছে, কারও স্বামীকে কোতোয়াল গ্রেপ্তার করেছে, দারোগা-ই-আদালতে গিয়ে ফরিয়াদ কবুল করতে হবে। কিন্তু তার আগে টাকা দাও। টাকা দিলে তবে তোমার আর্জি পেশ হবে। আর কত টাকা দিতে হবে, তারও আইন কায়েম আছে নিজামত-কাছারিতে।

সেরেস্তায় গেলেও সেই একই নিয়ম। খাসনবিশ থেকে শুরু করে পরগনা কানুনগো আর পেশকার মুনশি মোহরার পর্যন্ত সবাই বাঁ হাতটা পেতেই বসে আছে। বলে টাকা দাও তবে খালাস দেব।

লোকে মিনতি করে বলে–জনাব, আগে আর্জিটা তো নেন, তার পরে আপনার পাওনা-গণ্ডা যা লাগে দেব

হুজুর-নবিশরা চটে যায়। বলে–পাওনাগণ্ডা আবার বাকিতে চলে নাকি?

গরিব প্রজারা তবু পীড়াপীড়ি করে, বলে পরে দেব হুজুর, পরে দেব, এবার খেতের ধান বেচেই আপনার পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দেব

কিন্তু এত ল্যাঠায় দরকার কী! সোজা যদি কোনওরকমে মেহেদি নেসারকে ধরতে পারো তো তুমি যা চাও, তাই পাবে। আকাশের আফতাব থেকে শুরু করে ইদের চাঁদ পর্যন্ত আদায় করে দিতে পারে মেহেদি নেসার। আর যদি মেহেদি নেসার পর্যন্ত না পৌঁছোতে পারো তো সেরেস্তার মুনশি মোহরার মনসুর আলি মেহের সাহেব পর্যন্ত পৌঁছোত পারলেই চলবে। আর যদি তা-ও না পারো তো বশির মিঞা আছে। বশির মিঞার ফুপা মনসুর আলি মেহের। বশির মিঞা চেষ্টা করলেও তোমার আর্জি হাসিল করতে পারে।

আসলে নবাব-নিজামতে কেতাদুরস্তের কোনও কমতি নেই। পাঠানদের সময়ে যা-থাক তা-থাক, কিন্তু মোগল আমলে কানুন কায়দার সবকিছু আছে। নায়েব সুবাদার আছে, দারোগা-ই-আদালত আছে, সিপাহশালার আজম আছে, খাসনবিশ, হুজুরনবিশ, দারোগা কাছারি, আমিন কাছারি, ফৌজদার, থানাদার, ডিহিদার, কোতোয়াল, কোতোয়াল-ই-দাগ সবই আছে। কিন্তু এসব ডিঙিয়েও তুমি আর্জি হাসিল করতে পারো, যদি মেহেদি নেসার তোমার সহায় হয়। মেহেদি নেসারের সবচেয়ে বড় গুণ, সে খেলাত মির্জা মহম্মদের ইয়ার। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার দোস্ত।

মেহেদি নেসার খুশি হলে হুকুম তো হুকুম, হাকিমও নড়ে যায়।

সেই মেহেদি নেসারের কাজের মধ্যে কাজ সকালবেলা নাস্তা করেই মির্জা মহম্মদের সঙ্গে মোলাকাত করা। আর যতদিন বুড়ো আলিবর্দি বেঁচে ছিল, ততদিন তো মেহেদি নেসারকে কেউ পরোয়া করেনি। কিন্তু এখন? এখন তামাম দুনিয়ার দৌলত মেহেদি নেসারের মুঠোর মধ্যে। এখন মেহেদি নেসারের এক কথায় জমিদারদের নসিব ওঠে আর নামে।

মুর্শিদাবাদের রাস্তায় মেহেদি নেসারের পালকি চলেছে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে। বেহারারা হুম হাম করতে করতে চলেছে। সামনে তোক দেখে হাঁকে হুঁশিয়ার

মেহেদি নেসার সারা রাত মহফিল করেছে কাল। ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে খানাপিনা করেছে। কিন্তু মহফিল তেমন জমেনি। জুতসই হয়নি নেশাটা। মির্জার মাথায় যত বদ ভাবনা ঢুকেছে। মেহেদি নেসার মির্জাকে বলেছে–আরে এখন তুই গদি পেয়েছিস, এখন কাকে ডরবি তুই? ওই ফিরিঙ্গিদের? তুই অত ডরপোক কেন রে? আমাকে বল, আমি ওই শালা উমিচাঁদকে শায়েস্তা করে দিচ্ছি। ও শালা দুমুখো সাপ। ও তোরও খাবে, ফিরিঙ্গিদেরও খাবে। ওকে আমি এখুনি ঢিট করে দিতে পারি। ফুর্তির সময় ওসব কথা ভাবিসনি, ওতে টাকাও নষ্ট, মহফিলও নষ্ট

নাচ হয়েছে, পান হয়েছে, সরাব হয়েছে। তবু মির্জার মন ওঠেনি।

মির্জা বলেছে–এবার খতম করে দে ইয়ার, ঘুম পাচ্ছে

ঘুম পাচ্ছে? সেকী রে? বাংলা মুলুকের নবাব ঘুমোবে কী রে? তোরই তো দুনিয়া। দিল্লির বাদশা তো তোর কাছে জবাবদিহি চাইছে না। খাজনা পাঠাতেও বলছে না। আর আলিবর্দি খাঁ কখনও দিল্লির দরবারে খাজনা পাঠিয়েছে? এখন আলমগির বাদশা আছে দিল্লির তখত-এ-তৌস-এ যে ভয় পাচ্ছিস?

তবু কিছুতেই জমেনি মহফিল। মির্জা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গেছে। নবাবের আবার অত বেগমের ওপর টান কেন? নবাব তো নবাব সুজাউদ্দিন খাঁ, নবাব তো নবাব সরফরাজ খা। ফুর্তি করতে জানত, মহফিল করতে জানত। সেসব দিনের কথা শুনেছে মেহেদি নেসার। নবাব সুজাউদ্দিন বুড়ো বয়েস। পর্যন্ত ফুর্তি করে গেছে নবাবের বাচ্চার মতো। হ্যাঁ, জানত কাকে বলে হররা। ইরান তুরান থেকে জেনানারা আসত সুজাউদ্দিনের ফররাবাগে হোলির দিন। নবাব মসনদ ফেলে রেখে হোলি খেলত সুন্দরীদের সঙ্গে। সঙ্গে থাকত বেগমরা। দুনিয়ার সেরা সব রূপসি। নবাবি দেখত দেওয়ানই আলা, দেওয়ান-খালসা-শরিফা আর নায়েব সুবাদাররা। যেদিন নবাবের জন্মদিন পড়ত, সেদিন তুলট হত। সেদিন ইয়ারবকশিরা ইনাম পেত, খেলাত পেত, বকশিশ পেত। আর সরফরাজ খা? সরফরাজ খা তো। গদি পেয়েই ফররাবাগে হররা উড়িয়ে দিয়েছিল। নিজের মেয়েমানুষের অসুখ হলে সরফরাজ রোজা রেখে মাথায় কোরান নিয়ে টাটা রোদের তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। আর তুই নবাব হয়েছিস কি লড়াই করবার জন্যে? লড়াই-ই যদি করবি তো বাংলার মসনদ নিয়ে কেন?

হঠাৎ পালকিটা দুলে উঠতেই মেহেদি নেসার চমকে উঠেছে কে?

পালকি-বেহারারা পালকি থামিয়ে বললে–খোদাবন্দ

আর দেখতে হল না। একেবারে চকবাজারের মধ্যিখানের রাস্তা। চার দিকে প্রজাদের ভিড়। একটা কসাইখানার পাশে মস্ত গর্ত। তারই ওপর পায়ে হোঁচট খেয়ে একজন বেহারা পড়ে গেছে। পা ভেঙে গেছে। বোধহয়। আর উঠতে পারছে না। পালকিটা আর-একটু দুললেই মেহেদি নেসারের পালকি উলটে যেত।

ক্যা হুয়্যা?

হুজুর খোদাবন্দ, পা ভেঙে গেছে ওর, উঠতে পারছে না–

উঠতে পারছে না মানে? তা হলে কি পালকি চলবে না? মেহেদি নেসার এই বাজারের ময়লা গলির মধ্যে আটকে পড়ে থাকবে? ওঠ উল্লকা-পাটঠা! ওঠ–চল জলদি

লোকটা হাত জোড় করে কাদো কাদো হয়ে ক্ষমা চাইল।

মেহেদি নেসার রেগে তখন টং। একে কাল রাতে মহফিল জমেনি, তার ওপর এই ছোটলোকের দিগদারি। চাবুকটা পালকি থেকে নিয়ে এসে পিঠের ওপর সপাং-সপাং করে বসিয়ে দিতে লাগল।

সপাং সপাং সপাং

হুজুর খোদাবন্দ

আর কোনও কথা নয়। মেহেদি নেসারের সঙ্গে দিল্লাগি। আবার সপাং সপাং সপাং।

আশেপাশে রাস্তার লোকের অনেক ভিড় জমেছিল। মেহেদি নেসার একজনের গর্দানটা খপ করে ধরে ফেললে। তারপর জোর করে পালকিতে জুতে দিয়ে বললে–চল, লে চল–

মানুষ নয় তো সব। শুয়োরের বাচ্চা। শুয়োরের বাচ্চার মতো রাস্তার ওপর পিলপিল করে পয়দা হচ্ছে সব। রেইস আদমিদের নড়বার জায়গা নেই, রাস্তায় চলবার পর্যন্ত উপায় নেই। রাস্তায় সবাই হাঁ করে মজা দেখতে বেরিয়েছে। নতুন লোকটা মামলার নথি নিয়ে কানুনগো কাছারিতে এসেছিল দরবার করতে। তিন দিন ধরে হেঁটে হেঁটে সদর কাছারিতে এসেছিল। হঠাৎ মামলা করা ঘুচে গেল, পালকি বয়ে নিয়ে যেতে হল।

নটবর!!

নটবর বেহারাদের সর্দার। মেহেদি নেসারের তলব পেয়েই পালকির দরজার মুখে এসে দাঁড়াল।

ও ছুকরিটা কে রে? জানিস?

কোন ছুকরিটা হুজুর?

ওই যে চৌকের পাশে একটা বাড়ির ঘুলঘুলি দিয়ে এদিকে চেয়ে দেখছিল? খোঁজ নিস তো কার মেয়ে! ওর বাপ কী করে?

এসব ইঙ্গিত বুঝতে পারে নটবর। বললে–হুজুর, বলেন তো কালকে মতিঝিলে হাজির করব?

পারবি?

বান্দা কী না পারে!

মির্জা মহম্মদ বড় মুষড়ে পড়েছে কদিন। আবার নয়া দাওয়াই দিতে হবে। নবাবজাদাদের এই মুশকিল। গদিতে বসবার পর থেকে কেবল ভাবছে কোথায় কী হচ্ছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও স্বপ্ন দেখছে, কে বুঝি চাকু মারল কলিজায়। কোথায় মহম্মদাবাদ, বাংলা, ঘোড়াঘাট, সোনারগাঁতে কী ঘটছে, অমনি টনক নড়ে ওঠে। সেই জন্যেই তো মেহেদি নেসার ফুর্তির মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে চায় মির্জাকে। এত ভাবলে মারা যাবি যে! সে কথা বুঝত নবাব সুজাউদ্দিন খাঁ, সরফরাজ খাঁ। নবাব আলিবর্দি খাঁ বোঝেনি, তাই জিন্দগি-ভর কেবল লড়াই করতে হয়েছে। লড়াই করতে করতেই জওয়ানি বরবাদ হয়ে গেছে।

বাজার পেরিয়েই গঙ্গা। পালকির দরজার ফাঁক দিয়ে গঙ্গা দেখা যায়। গঙ্গায় নৌকো চলেছে দাঁড় বেয়ে বেয়ে। হঠাৎ একটা নৌকোর দিকে চেয়েই কেমন চমকে উঠল মেহেদি নেসার সাহেব। চেনা চেনা যেন নৌকোটা। ছাড়ের নৌকো। ময়ূরপঙ্খীর গলুই। তার লাগোয়া ছইঢাকা ঘর। তার সামনেই একজন বসে আছে।

নটবর।

নটবর আবার সামনে এল। মেহেদি নেসার জিজ্ঞেস করল–ওটা কার বজরা যায় রে নটবর? হাতিয়াগড়ের জমিদার না?

আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর, আপনি ঠিক বলেছেন।

মেহেদি আবার ভাবতে লাগল। রাত্রে এসেছে, সকালবেলা চলে যাচ্ছে। সব ওই জগৎশেঠজির কাণ্ড! জগৎশেঠজির কাছে দরবার করতে এসেছিল। বাংলা মুলুকের যত জমিদার সব জগৎশেঠজির দলে। সবাই নিমকহারামি করতে চাইছে।

পালকিটা মতিঝিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। যথারীতি যারা ফটকে পাহারা দিচ্ছিল তারা হাত তুলে আদাব করল। পালকি আরও ভেতরে চলল। লম্বা ঝিল। ঝিলের শেষে শ্বেতপাথরে বাঁধানো চবুতর। মেহেরুন্নিসা বেগম বানিয়েছিল। জাহাঙ্গিরাবাদের টাকা দিয়ে জলের মতো খরচ করেছে মতিঝিল বানাতে, রাজবল্লভ পেছনে আছে। শালারা ভেবেছিল মির্জা ছেলেমানুষ, কিছু বোঝে না। সামনের সিংফটক দিয়ে ঢুকেই বড় দোতলা কুঠি। মাথার ওপর নহবতখানা। কাল অনেক রাত পর্যন্ত এখানেই মহফিল হয়েছিল মেহেদি নেসারদের। মেহেদি নেসার সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে উঠতে লাগল। বড় ঘরটার মাথায় আলোর ঝড় ঝুলছে। কালকের মহফিলের সব চিহ্নই সাফ করে ফেলেছে বান্দারা। মেহেদি নেসার সাহেব আবার তাকিয়া-ফরাসের ওপর কাত হয়ে পড়ল। হুজুতেই কাটল ক’টা দিন।

সামনে দরজার বাইরে পায়ের আওয়াজ হতেই মেহেদি নেসার সাহেব বললে–দে দে, শরবত দে

তারপর ভাল করে দেখে বুঝলে শরবত নয়, মনসুর মেহের আলি মোহরার এসে হাজির। সামনে এসে মাথা নিচু করে তিনবার হাত ঠেকালে মাথায়।

আমাকে ডেকেছেন হুজুর?

কী খবর পেলি তুই? মিরজাফর সাহেবের হালচাল কী? বশির কোথায়?

বশির মিঞা বোধহয় আড়ালেই ছিল। তার নাম উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকে কুর্নিশ করলে হুজুর, খবর সব বিলকুল ঠিক হ্যায়। দেওয়ান-ই-আলা মিরজাফর সাহেব…

বাধা দিয়ে মেহেদি নেসার সাহেব বললে–দূর বেল্লিক, মিরজাফরকে আবার দেওয়ান-ই-আলা বলছিস কেন? ও তো বরখাস্ত হয়ে গেছে। এখন কী করছে তাই বল। কার সঙ্গে শলা-পরামর্শ করছে তাই স্রেফ বল? নজর রাখছিস?

হ্যাঁ জনাব, রাখছি? মিরজাফর খাঁ সাহেবের বাড়ির সামনে চর রেখেছি, জগৎশেঠজির বাড়ির সামনে ভি চর রেখেছি। কলকাতায় বেভারিজ সাহেবের বাড়ির সামনে ভি রেখেছি, উমিচাঁদের বাড়ির সামনেও নজর রাখবার জন্যে চর রেখেছি, আমি খুদ নিজে ভি ঘুমছি তামাম বাংলা মুলুক–

তারপর একটু থেমে বললে–কিন্তু হুজুর, একটা বাত আছে, ওই ভিখু শেখ শালা বেল্লিকের বাচ্চা বড় খতরনাক আদমি হুজুর, শালা হারামি আমাকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালাগালি দেয়–

কে ভিখু শেখ? ভিখু শেখ কে?

আজ্ঞে হুজুর, ওই জগৎশেঠজির ফটকের সেপাই—

ওই পাঠানটা?

জি হাঁ, হুজুর!

আচ্ছা তুই যা,–

বলে মেহেদি নেসার সাহেব মোহরার মনসুর আলি মেহেরের দিকে চাইলে। তারপর হঠাৎ কী মনে পড়ে গেল। আবার ডাকলে–শোন বশির

বশির ঘুরে দাঁড়াল। মেহেদি নেসার সাহেব বললে–ারে, হাতিয়াগড়ের জমিদার কেন এসেছিল রে মুর্শিদাবাদে? আজ তার বজরা দেখলুম। মহিমাপুরের দিক থেকে আসছে। জগৎশেঠজির কাছে গিয়েছিল নাকি শল্লা করতে?

কই, না হুজুর, আমি তো জগৎশেঠজির বাড়ির সামনে নজর রাখার ইন্তেজাম করেছি, কেউ তো আসেনি সেখানে

কেউ আসেনি?

না হুজুর,–

মিরজাফর আলি, হলওয়েল, ওয়াটস, ব্যাটসন, কলেট, উমিচাঁদ, কি কোনও জমিদার, জায়গিরদার, পাট্টাদার, তালুকদার, কেউ না?

আজ্ঞে হুজুর, সে তো আসছে হুন্ডি কাটাতে। তারা তো হামেশা আসছে!

নিজামতের মহাফেজখানা কি সেরেস্তার কেউ যাচ্ছে?

না, কেউ যাচ্ছে না হুজুর!

তারপর আসল কথাটা মনে পড়ল এতক্ষণে। ভেতর থেকে মতিঝিলের খিদমদগার এক গেলাস ঠান্ডা শরবত এনে দিয়েছিল। তাতে একবার চুমুক দিয়ে বললে–আর সেই হাতিয়াগড়ের রানিবিবির কী হল? ডিহিদারের পরওয়ানা পৌঁছে গেছে।?

একেবারে ভুলে গিয়েছিল বশির মিঞা একথাটা। ইস! লজ্জায় মাথা কাটা গেল বশির মিঞার। তামাম বাংলা মুলুকের জাসুসি কাজ একলা বশির মিঞার মাথার মধ্যে। দুনিয়ার কাজ সব তার ঘাড়ে। ক’টা দিকে দিকদারি করবে সে। সেই কবেকার ব্যাপার। এখনও কোনও বন্দোবস্ত করা হয়নি। তখন বুড়ো নবাব বেঁচে। মির্জা মহম্মদের শাদির সময় মুর্শিদাবাদের ভিড় ছিল দেখবার মলে। জলের মতো টাকা উড়িয়েছিলেন আলিবর্দি খাঁ। সারা মুলুক ঝেটিয়ে জমিদাররা এসেছিল এখানে। জিন্নতাবাদ, চাঁড়া, ফতেবাদ, মহম্মদাবাদ, বাকলা, পূর্ণিয়া, তাজপুর বাজুহা, হাতিয়াগড়–সব সরকারের জমিদাররা এসে জুটেছিল এখানে। মুর্শিদাবাদের ঘাটে বজরার গাদি লেগে গিয়েছিল। মেহেদি নেসার তখনই প্রথম দেখেছিল হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে। নয়া জওয়ানি মেয়ে। চোখ দুটো যেন আসমানের জমিন। মেঘ-মেঘ রোদ-রোদ। বজরার খিড়কির ভেতর দেখা। মির্জাকেও দেখিয়েছিল। বলেছিল–ইয়া আল্লা, ওকে চাই ইয়ার। খোঁজ নাও কে ও! মেহেদি নেসারও সব খোঁজখবর নিলে। জানা গেল হাতিয়াগড়ের দোসরা তরফের রানিবিবি। আগের রানির বাচ্চা পয়দা হয়নি বলে দোসরা বিবি ঘরে এনেছে। তা হোক, তাতে মির্জার ইয়ারের কোনও লাভলুকসান নেই। আরে, আওরতের আবার জাত-বিচার কী! যেমন মসনদ হল মসনদ, তেমনি আওরত হল আওরত। মসনদ কেড়ে নিতে পারলেই নিজের। আলিবর্দি খাঁ মুর্শিদাবাদের মসনদ কেড়ে নিতে পেরেছিল সরফরাজ খাঁকে খুন করে। তাই তা তার নিজের হয়েছে। মেয়েমানুষও তেমনি। কেড়ে নিতে পারলে আমি তোমার। আবার আমাকে যে কেড়ে নেবে আমি তার হব। মসনদ মেয়েমানুষ টাকা–এদের তো এই-ই কানুন।

মনসুর আলি মেহের সাহেব তখনও দাঁড়িয়ে ছিল।

তুই আবার ঝুটমুট দাঁড়িয়ে কেন?

আজ্ঞে, আপনি কিছু ফরমায়েশ করুন

মেহেদি নেসার বললে–সেরেস্তায় যা-কিছু শুনবি, সব আমাকে বলে যাবি। মোহনলাল দেওয়ান-ই-আলা হয়েছে বলে সকলের বুক জ্বলছে খুব, না?

আজ্ঞে, না হুজুর।

হলে বলে যাবি আমাকে। রাজবল্লভটা কাফের বাচ্চা, ওটাকেও শায়েস্তা করতে হবে। আর ওই বাঁদির বাচ্চা, মেহেরুন্নিসা, ঘসেটি বেগম! সকলকে শায়েস্তা করে তবে দেওয়ানি কাবিল করব। তুই যা–

ততক্ষণে একটু নেশার ঘোর লেগেছে নেসারের মগজে। একটু একটু করে লাল হয়ে আসছে চোখ। এমনি লাল আরও লালচে হবে। যত বেলা বাড়বে তত মেহেদি নেসার সাহেব রঙিন হয়ে উঠবে। সারা মতিঝিলে তখন রোশনাই জ্বলে উঠবে। মতিঝিল যেন বুঝতে পারে সব। মতিঝিলেরও যেন প্রাণ আছে। এই মতিঝিলে কত রোশনাই হয়েছে একদিন। এখানেই রাজবল্লভ এসে চুপি চুপি বুড়ো নবাবের বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে। আবার সেই বিছানা থেকেই ঘসেটি বেগম মাঝরাতে উঠে গিয়ে শুয়েছে হুসেনকুলি খাঁ’র ঘরে। এখানকার প্রতিটি পাথরে যেন আলিবর্দির পাপের দাগ লেগে আছে। তুমি একদিন তোমার অন্নদাতাকে মেরেছ, তোমার অন্নদাতার একমাত্র ছেলে সরফরাজকে খুন করেছ। তোমার পাপের কি শেষ আছে জাঁহাপনা! তুমি কেবল রাজনীতিই মেনেছ, আর কোনও নীতিই তো মানোনি। তাই চোখের সামনে দেখেছ তোমার মেয়েদের কীর্তি-কেচ্ছা। তারপর আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে আরও দেখে যেতে পারতে! দেখে যেতে পারতে নজর আলির কীর্তি। তখন ঘসেটি বেগমের এই মতিঝিল তোমার নাতির অত্যাচারে থরথর করে কাঁপছে। তোমার বড় আদরের মির্জা মহম্মদ হুকুম দিয়েছে মতিঝিল লুট করে যা পাবে নিয়ে আসবে। ঘসেটি বেগমের অনেক টাকা, অনেক দৌলত, অনেক ঐশ্বর্য। জাহাঙ্গিরাবাদের সব টাকা নিয়ে এখানকার সিন্দুকে লুকিয়ে রেখেছে। একদিন রাত থাকতে নবাবি ফৌজ গিয়ে সকালবেলা মতিঝিল ঘিরে ফেললে।

তখনও বুঝি ঘসেটি বেগমের ঘুম ভাঙেনি। নবাব-বেগমদের সকাল সকাল ঘুম ভাঙা যেন অপরাধ। আর সকাল সকাল ঘুম ভাঙবেই বা কেন? কীসের দায়? কিন্তু ঘুম ভেঙেছে নজর আলির। নজর আলি সত্যিই নজর আলি। মেয়েরা তার দিকে একবার নজর দিলে আর চোখ ফেরাতে পারে না। হুসেনকুলি খার চেয়েও সুন্দর দেখতে। চারদিকে নবাবি ফৌজের নিশানা টের পেয়েই ঘুম ভেঙে গেছে। তাড়াতাড়ি পিরেন-পায়জামা সামলে নিয়ে ঘসেটি বেগমকে ডাকতে লাগল–মেহেরুন্নিসা, মেহেরুন্নিসা

ঘসেটি ধড়ফড় করে উঠেই সব দেখে শুনে তাজ্জব হয়ে গেছে।

কী হবে এখন নজর? মির্জা তো সহজে ছাড়বে না।

ততক্ষণে নবাবি ফৌজ তোপ দাগবার জন্যে তৈরি হয়ে গেছে। মতিঝিলের আমলা-নোকর-নোকরানিরা সবাই ভয় পেয়ে যে-যেদিকে পারে দৌড়োচ্ছে।

মিরজাফরকে খবর দেব?

নজর আলি বললে–তাকে এত্তেলা দিলে কিছু হবে না, মোহনলালকে হাত করতে হবে। সে-ই তো এখন সেপাহশালার

তা হাত করো না, কত টাকা লাগবে মোহনলালকে হাত করতে?

নজর আলি জিজ্ঞেস করলে কত টাকা আছে তোমার কাছে এখন?

তা কি মনে আছে না গুনে রেখেছে ঘসেটি বেগম। তাড়াতাড়ি সিন্দুক খোলা হল। জাহাঙ্গিরাবাদের দেওয়ানি করা টাকা। শুধু টাকাই নয়, সোনা আছে, মুক্তো আছে, হিরে আছে, চুনি পান্না মতি সব আছে ঘসেটি বেগমের। সব তুলে নিলে নজর আলি। টাকাও নিলে গয়নাও নিলে। সব দিতে হবে মোহনলালকে। যে যা চাইবে তাকে তাই দিতে হবে। বারো লাখও হতে পারে পনেরো লাখও হতে পারে। সেই টাকা নিয়েই সেই ভোরবেলা বেরিয়ে গেল নজর আলি। বললে–আমি ফিরে আসছি মেহেরুন্নিসা বিবি, তুমি ঘাবড়িয়ো না–

সে নজর আলি তারপর আর আসেনি। ঘসেটি বেগম যাকে পেরেছে দু’হাতে টাকা বিলিয়েছে তার মতিঝিল বাঁচাবার জন্যে। কিন্তু মতিঝিল বাঁচেনি। আজও দুপুরবেলা মাঝে মাঝে বোধহয় তাই। মতিঝিলের চোখে তন্দ্রা নামে আর তার মধ্যে খাপছাড়া স্বপ্ন দেখে।

কৌন?

কোথায় যেন একটা গোলমাল উঠল। মতিঝিলের ঘরগুলোর মধ্যে যেন আর্তনাদ করে উঠল কেউ! মেহেদি নেসারের তন্দ্রা ভেঙে গেল। কৌন? কে? নজর আলি কি আবার ফিরে এল ফৌজ নিয়ে। দুপুরবেলার মতিঝিলে তো এত আওয়াজ হওয়ার নিয়ম নেই। তবে কি মির্জার ভাই শওকত জঙ? পূর্ণিয়া থেকে নবাবির খবর পেয়ে দৌড়ে এসেছে? নাকি কাশিমবাজার কুঠির ওয়াট। ফিরিঙ্গিদের পলটন নিয়ে সোজা গঙ্গা বেয়ে এসে হাজির হয়েছে মতিঝিলে।

নেশার মধ্যেই উঠে দাঁড়াল নেসার। মৌতাত এরা জমাতে দেবে না কেউ।

খোদাবন্দ!

মেহেদি নেসার চোখ তুলে দেখলে, মতিঝিলের সেপাইরা কাকে ধরে এনেছে। সমস্ত শরীর দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। পেছনে পেছনে মতিঝিলের নোকর-নোকরানি বান্দা-খোঁজা সবাই এসেছে।

হুজুর, একে খুন করে ফেলেছি।

মেহেদি নেসার চিৎকার করে উঠল–কে এ? কী করেছিল?

হুজুর, এর নাম কাশেম আলি। লস্করপুরের তালুকদার। নিজামত আদালতে পেশক দিতে এসেছিল, চকবাজারের কাছে হুজুর আপনার পালকিতে জুতে দিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে সঙ্গে একেবারে মতিঝিলের অন্দরে ঢুকে পড়েছিল–মনে হচ্ছে মতলব খারাপ। সিঁড়ির নীচে লুকিয়ে ছিল, তাই কোতল করে দিয়েছি–

বেশ করেছিস! আচ্ছা করেছিস!

লোকটার দিকে আবার চাইলে মেহেদি নেসার। সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। লোকটাকে ধরে জুতে দিয়েছিল পালকিতে। একটা কথা পর্যন্ত বলেনি, প্রতিবাদও করেনি তখন। এখন মনে হল যেন কথা বলতে চাইছে। যে-কথা হুসেনকুলি খাঁ বলতে চেয়েছিল মরবার সময়, সেই কথা বলবার জন্যেই যেন লস্কপুরের তালুকদার কাশেম আলিও নড়ে নড়ে উঠছে। তামাম বাংলা মুলুকের মুখের কথা একা সে-ই মরার আগে বলে যাবে।

ওরে, নড়ছে যে, কোতল কর, কোতল কর ওকে এখনও জিন্দা আছে–

আর নিজের চিৎকারে নিজেরই ঘুম ভেঙে গেছে মেহেদি নেসারের। মতিঝিলেরও ঘুম ভেঙে গেছে। চারদিকে লাল চোখ দিয়ে চেয়ে দেখলে মেহেদি নেসার। কেউ কোথাও নেই। এতক্ষণ কেবল স্বপ্ন দেখছিল তবে! মিছিমিছি ভয় পেয়ে গিয়েছিল মেহেদি নেসার। মুর্শিদাবাদের চেহেল্‌-সুতুন কায়েম হয়ে গেছে, মসনদও কায়েম হয়ে গেছে। ঘসেটি বেগম, মিরজাফর, ওয়াটস, ফিরিঙ্গি কোম্পানি, শওকত জঙ, সব খতম। এবার আর কীসের ভয়। কাকে ভয়? মেহেদি নেসার হল–শরবত

খিদমদগার হঠাৎ ঘরে ঢুকেছে–হুজুর, নবাবের তাঞ্জাম এসেছে—

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress