মীরা
বাড়ি দেখে শামা হকচকিয়ে গেল। সে অনেকবার শুনেছে মীরাদের বিরাট বাড়ি। সেই বিরাট বাড়ি যে এই হুলুস্থুল তা বুঝতে পারে নি। এমন বাড়ির একটা মেয়ে ইডেন কলেজে পড়বে কেন? সে পড়বে দেশের বাইরে ইংল্যান্ড আমেরিকায়। তা না হলে দার্জিলিং-টার্জিলিং। এমন বাড়ির মেয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফুচকা খায়। ভাবাই যায় না।
শামা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির নাম্বার ঠিক আছে নামও ঠিক আছে হ্যাপি কটেজ। সব ঠিক থাকার পরেও তো ভুল হতে পারে। হয়ত এটা মীরাদের বাড়ি না। অন্য কারোর বাড়ি। একই নামের দু’টো বাড়িতে থাকতেই পারে।
আতাউর বলল, এই বাড়ি?
শামা বলল, তাইতো মনে হয়।
তুমি আগে আস নি?
না।
কী বিশাল ব্যাপার।
শামা বলল, আপনি চলে যান।
আতাউর দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না। শামা বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন চলে যান। আতাউর বলল, যেতে ইচ্ছা করছে না। তোমার সঙ্গে অনেকক্ষণ থাকলামতো, অভ্যাস হয়ে গেছে।
মানুষটা চলে যাচ্ছে। হঠাৎ করে শামার তীব্র ইচ্ছা হলো মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে দেয়। তার শরীর ঝিমঝিম করছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে। মানুষটাকে ছুঁয়ে না দিলে সে আর নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। একটা অজুহাত তৈরি করে কি মানুষটাকে ছুঁয়ে দেয়া যায় না! সে কি বলতে পারে না- এই যে। শুনুন, আপনার কপালে এটা কী লেগে আছে? খুব স্বাভাবিকভাবে এই কথাটা বলে সে কপালে হাত দিতে পারে। কপালে হাত দিয়ে অদৃশ্য ময়লা সরিয়ে ফেলা। মানুষটার নিশ্চয়ই এত বুদ্ধি নেই যে কপালে ময়লার আসল রহস্য ধরে ফেলবে। এই জাতীয় ব্যাপারগুলোতে পুরুষদের বুদ্ধি থাকে কম।
হ্যাপি কটেজের বারান্দায় তৃণা দাঁড়িয়ে আছে। সে শামাকে দেখে হাত নাড়ছে। শামা বাড়ির ভেতর ঢুকল। তৃণা অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে শামার কাছে এসে বলল, মারাত্মক একটা ব্যাপার হয়েছে। বিয়ের পর মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। না? মীরাকে আজ নিচ্ছে না। এই বাড়িতেই বাসর হবে। মারাত্মক না?
শামা বলল, মারাত্মক কেন?
বুঝতে পারছি না কেন মারাত্মক?
না।
তৃণা বিরক্ত গলায় বলল, তোর কি মাথায় বুদ্ধি বলতে কিছু নেই নাকি? এই বাড়িতে বাসর হচ্ছে তার মানে কী? আমরা বাসর ঘর সাজানোর সুযোগ পাচ্ছি। অলরেডি সাজানো শুরু হয়েছে। আমার দূর সম্পর্কের এক ভাই আছে, তার কলাবাগানে ভিডিওর দোকান। তাকে খবর দেয়া হয়েছে। সে বাসর ঘরে গোপন। ভিডিও ক্যামেরা সেট করে রাখবে। একটা সাউন্ড রেকর্ডারও থাকবে। মীরার যাবতীয় অডিও ভিজুয়াল কর্মকাণ্ড রেকর্ডের অবস্থায় থাকবে। এখন বুঝতে পারছিস কেন মারাত্মক?
পারছি।
মীরা কিছু বুঝতে পারছে না?
সে তার বিয়ের টেনশনে বাঁচে না, সে কী বুঝবে তার হচ্ছে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা।
বাসর হচ্ছে কোথায়?
মীরার ঘরে হচ্ছে না। ছাদে এদের প্রকাণ্ড একটা কামরা আছে। সেখানে হচ্ছে।
তুই এ বাড়িতে আগে এসেছিস।
এসেছি। মাত্র একবার এসেছি। এত প্রকাণ্ড বড়লোকের বাড়িতে বারবার আসা যায় না। এত বড় বাড়িতে নিজেকে সব সময় পর পর লাগে। তবে আমরা সবাই এক সঙ্গে আছিতো আমাদের লাগছে না।
সবাই এসে গেছে?
তুই আর টুনি তোরা দু’জন বাদ ছিলি। এখন বাকি শুধু টুনি। মনে হয় সে আসবে না। বাসা থেকে ওকে ছাড়বে না। টুনি খুবই ভুল করল। বাসর ঘরে ভিডিও ফিট করাতেই আমাদের শেষ না। আরো অনেক ফান হবে। আমাদের সোসিওলজির শাহানা ম্যাডামও এসেছেন। উনি প্রথম আলগা আলগা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এখন আমাদের দলে ভিড়ে গেছেন। ভিডিও ক্যামেরা ফিট করার তদারকি তিনিই করছেন।
সে-কী।
বিয়ে বাড়িতে গেলে সব মেয়ের মাথাই খানিকটা হলেও আউলা হয়। উনার সবচে’ বেশি আউলা হয়েছে।
ভিডিও ক্যামেরা বসানোর লোক চলে এসেছে। তার নাম তাহের। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে লজ্জায় মুখ তুলতে পারছে না। এতগুলো মেয়ের পাশে সে খুবই অস্বস্তিবোধ করছে। কেউ কিছু বললেই চমকে উঠছে। একবারতো হাত থেকে ক্যামেরাও ফেলে দিল।
শাহানা ম্যাডাম বললেন, তাহের ক্যামেরাটা ফিট করছ কোথায়? খাটের মাথায়? তাহের হা-সূচক মাথা নাড়ল। ম্যাডাম বললেন, ফিল্ড অব ভিশন কি রেখেছ? শুধু খাটটা কভার করলেই হবে। যা ঘটনা সব খাটেই ঘটবে। অডিও রেকর্ডারের কী করেছ?
ভিডিওর সঙ্গেই অডিও আছে।
ক্যামেরাটা গাদাফুল দিয়ে খুব ভালোমতো ঢেকে দাও যেনো বোঝা না যায় ক্যামেরা। সব ঠিকঠাক হলে একটা টেস্টরান করবে।
তাহের আবারো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
তৃণা বলল, এখন আমাদের দরকার নকল দাড়ি গোঁফ। ফর এভরিবডিস ইনফরমেশন— মীরাকে আমি অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। সে বাসর ঘরে ঢোকার আগে নকল দাড়ি গোফ পরে ঘোমটা দিয়ে থাকবে। তার স্বামী ঘোমটা খুলে দাড়ি গোফওয়ালা স্ত্রী দেখে যে কাণ্ডটা করবে আমাদের ভিডিওতে তা ধরা থাকবে।
যূথী বলল, মীরা কি জানে তার বাসর ঘরে ভিডিও ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
তৃণা বলল, আমরা এই ক’জন ছাড়া কেউ জানে না। বাইরের মানুষের মধ্যে শুধু মীরার মা জানেন।
শামা বিস্মিত হয়ে বলল, উনি কিছু বলেন নি?
খালা কিছুই বলেন নি। উনি বরং সবচে’ বেশি মজা পাচ্ছেন। প্রথম মেয়ের বিয়েতে সবচে’ বেশি ফান’ পায় মেয়ের মা। এক লাখ টাকা বাজি উনি
মেয়ের বাসর ঘরের ভিডিও দেখতে চাইবেন।
শাহানা ম্যাডাম বললেন, মেয়েরা তোমরা খেয়াল রেখো কোনো ছেলে যেন এদিকে না আসে। তিন তলার ছাদ আউট অব বাউন্ড ফর এভরিবডি।
তৃণা বলল, মিঃ হুক্কা কি আসতে পারবেন?
না হুক্কাও আসতে পারবেন না।
শামা বলল, হুক্কা কে?
তৃণা বলল, মীরার দূর সম্পর্কের ভাই। আমরা নাম দিয়েছি হুক্কা। সে তার চশমা খুঁজে পাচ্ছে না। তার ধারণা আমরা চশমা লুকিয়ে রেখেছি। বারবার আসছে আমাদের কাছে।
হুক্কা নাম কেন?
ফানি টাইপ ক্যারেক্টর, এই জন্যে হুক্কা নাম দেয়া হয়েছে। একসময় মীরা হুক্কার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। কিন্তু হুঙ্কা সাহেব পাত্তাই দেন নি। আমরা ঠিক করেছি হুক্কা সাহেবকেও একটু টাইট দেব।
শামা এক কোণায় বসে বাসর ঘরের ফুল সাজানো দেখছে। গাদাফুল আর। বেলিফুল এই দু’রকমের ফুল মশারি স্ট্যান্ড থেকে ঝুলছে। বিছানায় থাকছে শুধু গোলাপ। শাহানা ম্যাডাম এখন গোলাপের কাটা বাছছেন। টুনিও চলে এসেছে। জবরজং সাজে সেজেছে। টুনিকে দেখে সবাই হৈহৈ করে উঠল। যূথী বলল, এই তোকেতো একেবারে বিহারিদের মত লাগছে। মনে হচ্ছে তুই মোহাম্মদপুরের পাকিস্তান কলোনিতে থাকিস। হাওয়াই মিঠাইওয়ালা শাড়ি তুই পরলি কী মনে করে?
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। শামা লক্ষ করল তার কিছুই ভাল লাগছে না। নিজেকে আলাদা এবং একলা লাগছে। মনে হচ্ছে এদের কারো সঙ্গেই তার কোনো যোগ নেই। তার যোগ অন্য কোথাও। অন্য কোনোখানে। তার চোখ কেন জানি জ্বালা করছে। মাথাও ভার ভার লাগছে। বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দিলে হয়ত ভাল লাগবে। তিনতলায় নিশ্চয়ই বাথরুম আছে। কাউকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে বাথরুমটা কোথায়। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছা হচ্ছে না। তার ইচ্ছা করছে বাসায় চলে যেতে।
আতাউরকে টেলিফোন করে বললে কেমন হয়, ফিসফিস করে বলা— এই শোন আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। তুমি একটা বেবীটেক্সি নিয়ে চলে এসতো। আমাকে বাসায় নিয়ে যাও।
মানুষটাকে তুমি করে সে কি কখনো বলতে পারবে? মনে হয় না। বিয়ের পরেও হয়ত আপনি আপনি করেই বলবে।
তৃণা শামার কাছে এগিয়ে এসে বলল, তোর কী হয়েছে?
শামা বলল, কিছু হয় নি।
কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। তোকে দেখে মনে হচ্ছে তোর ওপর দিয়ে ঘন্টায় একশ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেমন জবুথলু হয়ে বসে আছিল। সমস্যা কী?
কোনো সমস্যা নেই।
সমস্যা অবশ্যই আছে। বলতে চাইলে বলতে পারিস। উড় উড়া শুনছি তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে?
হুঁ।
তুই নিজের মুখে আমাদের বলছিস না কেন? কেন আমরা উড়া উড়া শুনব? ছেলে পছন্দ হয় নি। তাইতো? বল হ্যাঁ বা না?
শামা চুপ করে রইল। তৃণ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এরেঞ্জড ম্যারেজে এ রকম হবে। বাবা মা ধরে বেঁধে এক বার নিয়ে আসবে। হাঁসি মুখে সেই বান্দরকে বিয়ে করতে হবে। বাকি জীবন সেই বান্দর গলায় ঝুলে থাকবে। তাকে আর গলা থেকে নামানো যাবে না।
এখানে শামা কে?
শামা চমকে তাকাল। এ বাড়ির কোনো বুয়াই হবে। তাকে খুঁজছে।
শামা কে? শামা?
শামা কাপা গলায় বলল, আমি শামা। কী হয়েছে?
দোতলায় যান আফা। আপনের টেলিফোন।
শামা ভেবেই পেল না, কে তাকে এ বাড়িতে টেলিফোন করবে। এই বাড়ির টেলিফোন নাম্বার সে নিজেই জানে না। টেলিফোনে কি কোনো খারাপ সংবাদ অপেক্ষা করছে? আজ কি শনিবার? শনিবারটা শামার জন্যে খুব খারাপ। শনিবার মানেই কোনো না কোনো খারাপ সংবাদ আসবেই।
শামা বলল, টেলিফোন কোন ঘরে?
বুয়া বিরক্ত গলায় বলল, টেলিফোন সব ঘরে আছে। আপনে দোতলায় চলেন।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শামা দেখল হলুদ ব্লেজার পরা এক ভদ্ৰলোক সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছেন। বেঁটে খাট মানুষ, মাথাভর্তি চুল। বিরক্তিতে তাঁর চোখ কুঁচকে আছে, তবে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার মধ্যে ছেলেমানুষি আছে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছেন। যেন সিঁড়ি বেয়ে ওঠাও একটা খেলা। ভদ্রলোকের চেহারাতেও ছেলেমানুষি আছে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই পৃথিবীতে জন্মায় যাদের দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছা করে না। এই ভদ্ৰলোক সেরকম। বাসে এই ভদ্রলোকের পাশে বসলে কোনো মেয়েই অস্বস্তি বোধ করবে না।
ভদ্রলোক শামাকে দেখে চট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গম্ভীর গলায় বললেন, এক্সকিউজ মি। আপনি কি মীরার বান্ধবীদের একজন?
জি।
আমি আমার চশমা তিনতলার খাবার টেবিলে রেখে বাথরুমে হাত মুখ ধুতে গিয়েছিলাম। হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখি চশমাটা নেই। আমার মাইওপিয়া আছে। চশমার পাওয়ার থ্রি ডাইওপটার। আমার খুবই অসুবিধা হচ্ছে। এর মধ্যে সিঁড়িতে দু’বার হোঁচট খেয়েছি। আমার ধারণা মীরার বান্ধবীরা মজা করার জন্যে চশমা লুকিয়ে ফেলেছে। এটা ঠিক না। আপনি মীরার বান্ধবীদের একজন। আপনি কি চশমাটা খুঁজে পাবার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবেন? আপনি কি জানেন চশমাটা কার কাছে?
জি না।
প্রথম ভুলটা আমিই করেছি। চশমা সঙ্গে নিয়ে বাথরুমে ঢোকা উচিত ছিল। এমন তো না যে বাথরুমে চশমা রাখার জায়গা নেই। বেসিনে রাখা যেত। তবে একবার বেসিনে রেখেছিলাম। বেসিন থেকে পড়ে চশমার গ্লাস ফ্রেম থেকে বের হয়ে এসেছিল। সরি, আপনাকে আটকে রেখেছি। কিছু মনে করবেন না।
ভদ্রলোক আগের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে লাগলেন। শামার খুবই মজা লাগছে। কোনো বয়স্ক মানুষকে এইভাবে সিড়ি বেয়ে উঠতে সে আগে কখনো দেখে নি। হড়বড় করে অকারণে এত কথা বলতেও শশানে নি। ভদ্রলোক এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন শামাকে তিনি
অনেকদিন থেকে চেনেন।
হ্যালো কে?
শামা, গলা চিনতে পারছি না? আমি মুত্তালিব। তোদর বাড়িওয়ালা চাচা।
এই বাড়ির টেলিফোন নাম্বার আপনি কোথায় পেলেন?
ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। Where there is a will, there is a way. তুই কি অবাক হয়েছিল?
হুঁ।
তোর গলাতে আমি চিনতে পারছি না। চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছিস কেন? একটা জিনিস খেয়াল রাখবি, টেলিফোনে কথা বলার সময় যতটা সম্ভব মিষ্টি গলায় কথা বলবি। কারণটাও ব্যাখ্যা করি। টেলিফোন কনভারসেশনের পুরোটাই অডিও। মুখ দেখা যাচ্ছে না— গলার স্বরটাই ভরসা। কাজেই সেই স্বরটা মিষ্টি হওয়া বাঞ্ছনীয়। কি আমার কথায় লজিক খুঁজে পাচ্ছিস?
শামা কিছু বলল না। সে স্বস্তিবোধ করছে। কারণ মুত্তালিব চাচার গলা স্বাভাবিক। তিনি হাসি মুখে কথা বলছেন। কোনো খারাপ সংবাদ থাকলে তিনি
এমন হাসিমুখে কথা বলতেন না।
হ্যালো শামা?
হ্যাঁ শুনছি।
এই টেলিফোন নাম্বার কী করে জোগাড় করলাম সেটা বলি।
কী জন্যে টেলিফোন করেছেন সেটা আগে বলুন।
স্টেপ বাই স্টেপ বলি। তুই এতো ছটফট করছিস কেন? মনে হচ্ছে পাবলিক টেলিফোন থেকে টেলিফোন করছিস তোর পেছনে লম্বা লাইন। সবাই তোকে তাড়া দিচ্ছে। শোন শামা, হ্যালো হ্যালো…
শুনছি।
আমি করেছি কী শোন। প্রথমে এশাকে বললাম, তোমার বোনের ডায়েরি ঘেঁটে দেখ তার কোনো বান্ধবীর নাম্বার লেখা আছে কিনা। সে একজনের নাম্বার দিল। তৃণা মেয়েটার নাম। আমি তৃণার বাসায় টেলিফোন করে এই বাড়ির নাম্বার নিলাম। বুঝেছিস?
বুঝলাম। আপনার অনেক বুদ্ধি। এখন বলুন টেলিফোন করেছেন কেন?
টেলিফোন করেছি এটা বলার জন্য যে, বাসায় চলে আয়। আমি তোদের এখানকার ঠিকানা নিয়ে গাড়িও পাঠিয়ে দিয়েছি। এতোক্ষণে গাড়ি পৌছে যাবার কথা।
বাসায় চলে আসব?
হুঁ।
কেন?
তোর বাবার শরীর খারাপ। বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। এখন ভাল। কিছুক্ষণ আগেও বিছানায় শুয়ে ছিল। এখন দেখে এসেছি বিছানায় বসা। লেবুর সরবত খাচ্ছে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে শামা, শামা, করছে। এই জন্যেই আমার মনে হয় ভোর চলে আসাটা ভাল হবে।
শামা হতভম্ব গলায় বলল, চাচা আপনি কী বলছেন?
আপসেট হবার কিছু নেই। তার বাবা ভাল আছে। ডাক্তার এসে দেখে। গেছে। বলেছে চিন্তার কিছু নেই। প্রেসার সামান্য বেশি। প্রেসার কমানোর ওষুধ দেয়া হয়েছে। সিডেটিভ দেয়া হয়েছে। আমি যতদূর জানি এখন নাক ঢেকে ঘুমুচ্ছে।
চাচা আমি আসছি।
তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুই টেনশনে মরে যাচ্ছি। টেনশন করার মতো কিছু হয় নি। এভরিথিঙ্ক ইজ আভার কন্ট্রোল। তোর মা শুরুতে খুব ভয় পেয়েছিল। এখন সামলে উঠেছে। তুই বরং এক কাজ কর— বাবাকে দেখে তারপর আবার বিয়ে বাড়িতে চলে যা। সাপ মরল লাঠি ভাঙল না। Snake is dead, stick in tact হা হা হা।
এত হাসছেন কেন? হাসির কী হল?
তোর টেনশন দেখে হাসছি। ভুল বললাম। টেনশন দেখতে পারছি না। শুধু ফিল করছি।
আমার টেনশন করাটা কি হাস্যকর?
হ্যাঁ, হাস্যকর। ছোটখাট ব্যাপারে যদি এত টেনশন করিস বড় ব্যাপারগুলি কীভাবে সামাল দিবি?
চাচা আমি রাখি।
এখন টেলিফোন রেখে কী করবি? গাড়িতো এখনো পৌছে নি। ততক্ষণ কথা বল।
চাচা, আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
শামা টেলিফোন রেখে দ্রুত নিচে নেমে গেল। মুত্তালিব চাচার গাড়ি এখনো আসে নি। গাড়ির ড্রাইভার যদি বাসা চিনে আসতে না পারে? আচ্ছা সে কি আতাউরকে টেলিফোন করে আসতে বলতে পারে না? আতাউর তাকে বেবীটেক্সি করে পৌঁছে দেবে। এতে নিশ্চয়ই দোষের কিছু নেই।
শামা আতাউরের নাম্বার ডায়াল করল। টেলিফোন আতাউরই ধরল। আগের বারের মতো অন্য কেউ ধরল না। শামাকে নানান ভনিতা করে আতাউরকে চাইতে হল না।
শামা হ্যালো বলতেই আতাউর বলল, এশা তোমার খবর কী? দেখলে আমি কেমন গলা চিনি? আমার সঙ্গে একবার মাত্র কথা বলেছ আর আমি গলা মুখস্থ করে রেখে দিয়েছি।
শামা হকচকিয়ে গেল। এশা-প্রসঙ্গটা তার মাথায় একেবারই ছিল না। অথচ থাকা উচিত ছিল। সে বোকা না, সে বুদ্ধিমতী।
এশা, হ্যালো বলেই চুপ করে গেলে কেন? কোথেকে টেলিফোন করছ?
আমাদের বাড়িওলা চাচার বাসা থেকে করছি। আপনি কেমন আছেন?
ভাল আছি। তোমার বুদ্ধি মতো দোকানটায় গিয়েছিলাম। তোমার আপা বুঝতেই পারে নি যে পুরো ব্যাপারটা সাজানো।
আমারতো মনে হচ্ছে আপনি একটু বেহায়া টাইপ। আপার সঙ্গে হুড়হুড় করে বাসায় চলে এলেন। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করলেন। আশ্চর্যতো!
কাজটা খুবই বেহায়ার মতো করেছি কিন্তু আমার একটুও খারাপ লাগছে না।
মাই গন্ড, আপনি যেভাবে কথা বলছেন তাতেতো মনে হচ্ছে আপনি আপার প্রেমে পড়ে গেছেন।
তুমি যেভাবে কথা বলছ তাতে মনে হচ্ছে প্রেমে পড়াটা অপরাধমূলক।
অবশ্যই অপরাধমূলক। যে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিকঠাক তার প্রেমে পড়াটা অপরাধ।
অপরাধ কেন?
বিয়ে ঠিকঠাক হওয়া মেয়ের প্রেমে পড়া মানে লাইসেন্স করে প্রেমে পড়া।
তুমিত খুবই গুছিয়ে কথা বল।
আমি গুছিয়ে কথা বলি টেলিফোনে। সামনাসামনি আমি একেবারেই কথা বলতে পারি না। আচ্ছা শুনুন, আপা কি আপনাকে মাকড়সার ধটা জিজ্ঞেস করেছে?
মাকড়সার কোন ধাঁধা?
আপার একটা মাকড়সার ধাধা আছে। ঐ ধাধাটা সে সবাইকে জিজ্ঞেস করে। আপনাকেও জিজ্ঞেস করবে। আপনার বুদ্ধি টেস্ট করার জন্যে জিজ্ঞেস করবে। ধাঁধার উত্তর দিতে না পারলে আপার মন খারাপ হবে। সে ভেবেই নেবে আপনার বুদ্ধি কম।
আমি পারব না। এমিতেই আমার বুদ্ধি কম। ধাঁধার বুদ্ধি আরো কম।
মাকড়সার ধাঁধাটা আপনি পারবেন। কারণ আমি উত্তরটা শিখিয়ে দিচ্ছি। উত্তরটা হলো মাকড়সা দু’রকমের সুতা দিয়ে জাল বানায়। এক রকমের সুতা থাকে আঠা লাগানো। আরেক রকমেরটায় আঠা থাকে না। যে সুতায় আঠা লাগানো থাকে না মাকড়সা তার ওপর দিয়ে হাটে বলে সে জালে আটকে যায় না।
আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ।
আপনিতো ধাঁধাটা জানেন না, শুধু উত্তরটা জানেন, এইজন্যে কিছু বুঝতে পারছেন না। বুঝতে না পারলেও ক্ষতি নেই। উত্তরটা জেনে রাখুন। আচ্ছা শুনুন আমি রাখি।
শামা টেলিফোন নামিয়ে ঘর থেকে বের হলো। আর তখনি তার সব বান্ধবীরা সিঁড়ি দিয়ে নামল। বান্ধবীদের সঙ্গে মিঃ হুক্কা আছেন। শাহানা ম্যাডামও আছেন। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। মিঃ হুঙ্কা কঠিন গলায় বলল, এক্সকিউজ মি, আপনার বান্ধবীরা বলছে, আপনি আমার চশমা আপনার হ্যান্ড ব্যাগে লুকিয়ে রেখেছেন। কাজটা ঠিক করেন নি। জোক ভাল–But not at the expense of some one.
শামা বলল, আমি আপনার চশমা লুকিয়ে রাখি নি।
তৃণা বলল, তোর হ্যান্ডব্যাগ খুলে দেখিয়ে দে না হ্যান্ডব্যাগে কিছু নেই। এত কথার দরকার কী?
তৃণ মুখ চেপে হাসছে। শামার বুক ধ্বক করে উঠল। সে এখন পুরোপুরি নিশ্চিত তার হ্যান্ডব্যাগে ভদ্রলোকের চশমা আছে। তৃণা এক ফাঁকে লুকিয়ে রেখেছে।
শামা হ্যান্ডব্যাগ খুলে চশমা বের করল। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। সে অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে বলল, I am sorry.
ভদ্রলোক চশমা নিতে নিতে বললেন–কিছু কিছু অপরাধ আছে শুধু সরিতে কাটা যায় না। যাই হোক, আমি আপনার সরি গ্রহণ করছি। আপনাকে একটা ছোট্ট উপদেশ দেবার ইচ্ছা ছিল। দিচ্ছি না, কারণ আমার মনে হয় না আপনার সঙ্গে আমার আবারো দেখা হবে।
রাত ন’টা। এতক্ষণে মন্টু দুটা চ্যাপ্টার পড়ে ফেলতে পারত। এখনো সে বই নিয়ে বসতেই পারে নি। একবার বসেছিল, বই খোলার আগেই টপ করে দেয়াল থেকে একটা টিকটিকি বইয়ের ওপর পড়েছে। টিকটিকি বইয়ের ওপর পড়া খুব অলক্ষণ। সে বই বন্ধ করে উঠে পড়েছে। অলক্ষণের সময় পার করে সে আবার পড়তে বসবে। তাছাড়া মনও বসছে না। বাবার জন্য খুব অস্থির লাগছে। বড় আপা অবশ্যি চলে এসেছে। অস্থির ভাবটা এখন অনেকখানি কমেছে। আপা মেয়ে মানুষ। সে কীই করবে! তারপরেও মন্টুর মনে হয়, আপা ঘরে থাকা মানেই অনেক কিছু। মন্টু একটু পর পরই দরজা ধরে দাঁড়াচ্ছে বাবাকে দেখেই চলে যাচ্ছে। তার ওপর দিয়ে সন্ধ্যার পর থেকে একের পর এক ঝামেলা যাচ্ছে। তাকেই ডাক্তার ডেকে আনতে হয়েছে। চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে স্যুপ আনতে হয়েছে। তাকেই অষুধ আনতে হয়েছে।
আবদুর রহমান সাহেব খুব বিব্রত বোধ করছেন। তাঁর লজ্জাও লাগছে। সবাইকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়ার লজ্জা। তিনি পরিবারের প্রধান। তার কর্তব্য সবাইকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখা। বড় মেয়েটা শখ করে বান্ধবীর বিয়েতে গিয়েছিল। তাকে চলে আসতে হয়েছে। মেয়েটার মনটা নিশ্চয়ই খুব খারাপ।
শামা বলল, বাবা স্যুপটা খাও। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
স্যুপ থেকে মুরগি মুরগি গন্ধ আসছে। ভাতের মাড়ের মতো একটা জিনিস। তার ওপর লতাপাতা ভাসছে। দেখেই অভক্তি লাগছে। তারপরও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি এক চুমুক স্যুপ মুখে দিলেন।
শামা বলল, স্যুপটা খেতে ভাল লাগছে না?
তিনি বললেন, খারাপ না।
তাহলে খাও। চামচ হাতে নিয়ে বসে আছ কেন?
তিনি পর পর কয়েক চামচ স্যুপ মুখে দিলেন। শামা বলল, শরীরটা কি এখন আগের চেয়ে ভাল লাগছে?
হুঁ।
একটু ভাল না অনেকখানি ভাল?
অনেকখানি ভাল।
স্যুপ খেয়ে শুয়ে পড়।
আবদুর রহমান সাহেব আরো এক চামচ স্যুপ মুখে দিলেন। ভক করে মুরগির গন্ধ মাকে লাগল। শরীর কেমন যেন মোচড় দিচ্ছে। বমি হয়ে যেতে পারে। তিনি বমি আটকাবার চেষ্টা করলেন। তাঁর শরীরের কলকজা ভাল না। একবার বমি শুরু হলে বাড়িতে আবারো হৈচৈ শুরু হবে। মন্টুর পড়া হবে না। পরীক্ষার আগের রাতের রিভিশনটা এক মাসের পড়ার সমান। কাল তার পরীক্ষা। মনেই ছিল না। স্যুপ খাওয়াটা বন্ধ করতে হবে। মেয়ে এমন আগ্রহ নিয়ে যেতে বলছে তিনি নাও করতে পারছেন না। মন্টু দরজা ধরে আবারো এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি চোখের ইশারায় ছেলেকে কাছে ডাকলেন। মন্টু এগিয়ে এলো।
রিভিশন শেষ হয়েছে?
না।
আমার শরীর ভাল আছে। আমাকে নিয়ে মোটেও চিন্তা করবি না। হাত মুখ। ধুয়ে বই খাতা নিয়ে বসে যা। রাত দু’টা পর্যন্ত পড়বি। দু’টার পর ঠাণ্ডা পানিতে হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়বি। পরীক্ষার আগের রাতে রিভিশন যেমন দরকার, ঘুমও ঠিক তেমনই দরকার। দু’টার ইম্পৰ্টেন্সই সমান সমান। ফিফটি ফিফটি। বুঝতে পারলি?
মন্টু মাথা কাত করল। শামা বলল, তোমার উপদেশ দেবার কোনো দরকার। নেই বাবা, তুমি স্যুপটা শেষ কর। ঠাণ্ড হলে আর খেতে ভাল লাগবে না।
আবদুর রহমান সাহেব নিচু গলায় বললেন, আমি আর খাব না। বমি আসছে। বাতি নিভিয়ে দিয়ে তুই চলে যা। আমি শুয়ে থাকব।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেই? দরকার নেই। তোমার কি ঘুম পাচ্ছে? হু।
ঘুম পেলে মাথায় হাত না বুলালেই ভাল। ঘুমের সময় মাথায় হাত বুলালে ঘুম কেটে যায়।
শামা বাবার ঘরের বাতি নিভিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল।
সুলতানা রান্নাঘরে রুটি বানাচ্ছেন। শামা মা’র পাশে বসতে বসতে বলল, রুটি বানাচ্ছ কেন?
তোর বাবাকে দেব। বাবা শুয়ে পড়েছে, কিছু খাবে না।
আজ সারাদিন কিছু খায় নি। অফিসে শুধু একটা কলিজার সিঙ্গাড়া খেয়েছিল। টিফিন বক্স খুলেও দেখে নি।
এই বয়সে বাবার কলিজার সিঙ্গাড়া খাওয়া একেবারেই ঠিক না। পচা বাসি কলিজা দিয়ে সিঙ্গাড়া বানায়।…
সুলতানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কি বিয়ে বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছিস?
শামা নাসূচক মাথা নাড়ল। তাহলে হাত মুখ ধুয়ে আয়, রুটি খা। না-কি ভাত খাবি? রুটি খাব। গরম গরম রুটি দেখে লোভ লাগছে। সুলতানা বললেন, তোর বান্ধবীর বিয়ের উৎসব কেমন জমেছে?
খুব জমেছে। নানান ধরনের মজা হচ্ছে।
কী হচ্ছে বল, শুনি।
বলতে ইচ্ছা করছে না। বড় মানুষদের বড় মজা।
ওরা কি খুবই বড়লোক?
বড়লোক মানে হুলস্থূল বড়লোক! মীরাদের বাড়ির প্রতিটা ঘরে এসি আছে। আমার ধারণী কাজের মেয়েদের ঘরেও আছে।
বলিস কী?
কথার কথা বলছি। কাজের মেয়ের ঘরেতো আর এসি থাকে না। বড়লোকেরা যা করে নিজের জন্যে করে। অন্যের জন্যে করে না।
মীরার বাবা কী করেন?
ইন্ডাস্ট্রি আছে। মাছের ব্যবসা আছে। আরো কী কী যেন আছে।
শামা একটা রুটি নিয়ে খেতে শুরু করলো।
সুলতানা বললেন, শুধু শুধু রুটি খাচ্ছিস কেন? তরকারি দিয়ে খা। ডিম একটা ভেজে দেব, ডিম দিয়ে খাবি?
উঁহু।
সবুজ শাড়িতে তোকে যে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে এই কথা কেউ বলে নি?
না বলে নি।
সুলতানা বললেন, কুমারী মেয়েদের সেজগুজে বিয়ে বাড়িতে যাওয়াটা ভাল। অনেকের চোখে পড়ে। সম্বন্ধ আসে।
সুলতানা মাথা নিচু করে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বললেন, তোর বয়সে আমি যতবার কোনো বিয়ে বাড়িতে গিয়েছি ততবার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। এর মধ্যে একটা এসেছিল প্লেনের পাইলট।
পাইলটের সঙ্গে বিয়ে হলো না কেন? বিয়ে হলেতো প্লেনে করে তুমি দেশবিদেশ ঘুরতে পারতে।
বিয়ে কপালের ব্যাপার। কপালের লেখা ছিল তোর বাবার সাথে বিয়ে হবে। তাই হয়েছে।
আমার কপালে লেখা খাতাউরের সঙ্গে বিয়ে হবে, কাজেই যত সেজেগুজেই বিয়ে বাড়িতে যাই না কেন আমার কপালে খাতাউর তাই না মা? খাতাউর সাহেব যে দুপুরে বাসায় খেতে এসেছিল এটা কি বাবাকে বলেছ?
না।
বল নি কেন?
আছে একটা সমস্যা।
কী সমস্যা?
পরে শুনবি।
পরে শুনব কেন? এখন বল।
সুলতানা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোর বাবার ইচ্ছা না ছেলেটার সঙ্গে তোর বিয়ে হোক। তার যে শরীরটা খারাপ করেছে এইসব ভেবেই করেছে।
তার মানে?
তোর বাবা আজ দুপুরে ছেলেটার সম্পর্কে খুব একটা খারাপ খবর পেয়েছে। তখনি তার শরীরটা খারাপ করেছে। এত আশা করে ছিল। হঠাৎ একটা ধাক্কার মতো খেয়েছে। অফিসেই বমি টমি করেছে।
খারাপ খবরটা কী?
আমাকে কিছু বলে নি। তোর বাবাকেতো তুই চিনিস একবার যদি সে ঠিক করে কিছু বলবে না, পেটে বোমা মারলেও বলবে না।
খারাপ খবর যেটা বাবা শুনেছেন সেটাতো ভুলও হতে পারে। বিয়ের সময় প্রায়ই মিথ্যা খবর রটানো হয়।
তোর বাবা বলেছে খবর মিথ্যা না।
শামা তাকিয়ে আছে। সুলতানা মেয়ের দৃষ্টির সামনে বসে থাকতে পারলেন না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। এশার ঘরে একবার যেতে হবে। মেয়েটা সন্ধ্যা থেকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে। স্বামীকে দেখতে গিয়ে মেয়ের দিকে তাকানো হয় নি।
প্রথমে তিনি স্বামীর ঘরে উঁকি দিলেন। মানুষটা ঘুমাচ্ছে। মনে হচ্ছে আরাম করেই ঘুমুচ্ছে। আরামের ঘুমের সময় মানুষ হাত পা গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে যায়। বেআরামের ঘুমের সময় মানুষ সরল রেখার মতো সোজা হয়ে থাকে।
সুলতানা ছেলের ঘরে গেলেন। বেচারার পড়ার আজ অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তিনি ঠিক করলেন মন্টু যতক্ষণ পড়বে তিনি পাশে বসে থাকবেন। তার এই ছেলেটা বোকা টাইপ হয়েছে। ছোটবেলায় এত বোকা ছিল না, যতই দিন যাচ্ছে বুদ্ধি মনে হয় ততই কমছে। পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে পড়ে। ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে পড়তে শুরু করে। এই ছেলের পড়াশোনা হবে বলে মনে হয় না। পরীক্ষা দিয়ে ফেল করবে। আবার দেবে, কোনো বছর দেবে, কোনো বছর দেবে না। এই করতে করতে বয়স হয়ে চেহারায় লোক লোক ভাব আসবে তখন কোনো দোকান টোকা দিয়ে বসিয়ে দিতে হবে। মন্টুর মতো ছেলেরা খুব ভাল দোকানদার হয়।
টেবিলে খোলা বই। মন্টু বইয়ে মাথা রেখে আরাম করে ঘুমুচ্ছে। ঘাড়ের ওপর মশা, রক্ত খেয়ে ফুলে আছে। মন্টুর কোনো বিকার নেই। সুলতানা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। ছেলেকে ঘুম থেকে তুললেই সে পড়তে শুরু করবে। ঘুমিয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে যেখানে পড়া শেষ করেছিল সেখান থেকে শুরু করবে, কিছুক্ষণ ঘুমাক। তিনি এশার ঘরের দিকে রওনা হলেন। খুব সম্ভব এশাও ঘুমুচ্ছে। মাইগ্রেনের ব্যথা প্রবল হলে এশা কয়েকটা ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেলে। ব্যথা কমে যায় কিন্তু ঘুম থেকে যায়।
এশার ঘরের দরজা ভেজানো। সুলতানা দরজার পাশে দাঁড়াতেই এশা বলল, ভেতরে এসে মা।
সুলতানা ঘরে ঢুকলেন। এই গরমে এশা চাদর গায়ে শুয়ে আছে। তার চোখ লাল। সুলতানা বললেন, মাথাব্যথার অবস্থা কী?
এশা বলল, অবস্থা ভাল। কমেছে?
না।
তাহলে ভাল বলছিস কেন?
আমার মাথাব্যথা প্রসঙ্গটা এখন একটু বাদ থাকুক। মা আসল ঘটনা আমাকে বল। আপার বিয়ে বাতিল হয়ে গেছে?
হুঁ।
হুঁ-ফু না, পরিষ্কার করে বল— বাবা কি বিয়ে বাতিল করে দিয়েছেন।
হুঁ।
ছেলেকে বলেছেন?
সরাসরি ছেলেকে বলে নি। তার চাচাকে আর বড় বোনকে খবর দেয়া হয়েছে।
ছেলের অপরাধটা?
আমি জানি না। তোর বাবা কিছু বলে নি।
কাজটা ঠিক করলে না মা। হুট করে বিয়ে ঠিক করা, আবার হুট করে বাতিল। বিয়ে তো Play and dust না।
প্লে এন্ড ডাস্ট কী?
প্লে হচ্ছে খেলা আর ডাস্ট হচ্ছে ধুলা। প্লে এন্ড ডাস্ট হলো- খেলাধুলা। মা এখন আমার ঘর থেকে যাও। তোমার পাথরের মতো মুখ দেখে আমার মাথা ধরা ছেড়ে যাচ্ছে।