Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বৃষ্টি বিলাস (২০০০) || Humayun Ahmed » Page 2

বৃষ্টি বিলাস (২০০০) || Humayun Ahmed

এশা

মিথ্যা দু’রকমের আছে। হঠাৎ মুখে এসে যাওয়া মিথ্যা, আর ভেবে চিন্তে বলা মিথ্যা। হঠাৎ মিথ্যা আপনা আপনি মুখে এসে যায়। কোনো পরিশ্রম করতে হয় না। ভেবে চিন্তে মিথ্যা বলাটাই কঠিন। এই মিথ্যা সহজে গলায় আসে না। বারবার মুখে আটকে যায়।

শামার মুখে অবশ্যি মিথ্যা তেমন আটকাচ্ছে না। সে গড়গড় করেই বলে যাচ্ছে এবং নিজেও খুব বিস্মিত হচ্ছে। সে কথা বলছে টেলিফোনে। ওপাশে ফোন ধরে আছে আতাউর। মাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। সন্ধ্যাবেলা মিথ্যা বলতে নেই। শামাকে বলতে হচ্ছে।

শামা বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম এশা। শামা আপু, যার সঙ্গে আপনার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছে আমি তার ছোট বোন।

ও আচ্ছা। তুমি কেমন আছ?

ভাল আছি। আপনার টেলিফোন নাম্বার আমি আপাকে দিয়েছিলাম, সে আপনাকে টেলিফোন করবে না। লজ্জা পায়। কাজেই ভাবলাম আমিই করি। আপনি বিরক্ত হচ্ছেন নাতো?

বিরক্ত হব কেন?

আপনার চেহারা দেখে মনে হয় আপনি অল্পতেই বিরক্ত হন।

আমি অল্পতে কেন বেশিতেও বিরক্ত হই না।

বিরক্ত না হলেই ভাল। কারণ বড় আপুর স্বভাব হলে সবাইকে বিরক্ত করা। আপনাকে সে বিরক্ত করে মারবে। আপনার সঙ্গে সে নানান ধরনের ফাজলামি করবে। আপনার জীবন অতিষ্ট করে তুলবে।

তাই না-কি?

হ্যাঁ তাই। সে আপনাকে কী ডাকছে জানেন? ডাকছে খাতাউর। খাতাউর? হ্যাঁ খাতাউর। আপনাকে ডাকছে ন’আনির জমিদার মি. খাতাউর।

শোন এশা, আমরা জমিদার উমিদার না। আমার চাচার বেশি কথা বলা অভ্যাস। আমার খুবই লজ্জা লাগছে যে তিনি এ ধরনের কথাবার্তা বলেছেন।

এখন জমিদার না হলেও এক সময়তো ছিলেন।

অনেক আগের কথা। আমরা এখন খুবই দরিদ্র মানুষ।

আপনার জমিদারি নিয়ে বড় আপা কিন্তু আপনাকে খুব ক্ষেপাবে। গতকালই আমাকে বলেছে এই এশা, তুই আমাকে আপা ডাকবি না। আমি জমিদারের বউ। আমাকে ডাকবি মহামান্য ন’আনির প্রাক্তন জমিদারনি।

তোমার কথা শুনে আমারতো খুবই লজ্জা লাগছে।

আর আপনি খুব কাশছিলেন তো, এই নিয়েও বড় আপু অনেক মজা করেছে— বলছে খাতাউর সাহেবের যক্ষা আছে। যক্ষা হচ্ছে রাজরোগ। সে রাজা মানুষ, তারতো রাজরোগ থাকবেই। আচ্ছা শুনুন, আপনার কাশি কি কমেছে?

হ্যাঁ কমেছে।

আপাকে দেখে ঐ দিন আপনার কেমন লেগেছে?

বেশ সুন্দর।

আপনি তো চোখ তুলে আপার দিকে তাকানই নি। আপার ধারণা আপনি পায়ে স্যান্ডেল পরেছিলেন সেই স্যান্ডেলের ফিতার ডিজাইন নিয়ে গবেষণা করে আপনি পুরো সময় কাটিয়ে দিয়েছেন। আচ্ছা শুনুন, নাশতা দেবার সময় আপা যখন সবাইকে বাদ দিয়ে আপনাকে প্রথম প্লেটটা দিল তখন কি একটা ধাক্কার মতো খেয়েছিলেন?

না।

তাহলে আপার হিসেবে ভুল হয়েছে। আপা আপনাকে চমকে দেবার জন্যে এই কাজটা করেছে। সে মানুষকে চমকাতে খুব পছন্দ করে। এখন বুঝতে পারছি আপা আপনাকে চমকাতে পারে নি।

অন্য সময় হলে অবশ্যই চমকাতাম। ঐ দিন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কিছু বুঝতে পারি নি।

আরেকটা কথা আপনারা যে আপাকে টাকা আর আংটি দিলেন আপনারা যখনই মেয়ে দেখতে যান পকেটে টাকা আংটি নিয়ে যান? আপার ধারণা। আপনারা আগেও অনেক মেয়ে দেখেছেন। প্রতিবারই পকেটে করে টাকা আংটি নিয়ে গেছেন। আপার ধারণাটা কি ঠিক?

হ্যাঁ ঠিক।

আচ্ছা ধরুন, কোনো কারণে বিয়ে হলো না। তখন কি আপনারা টাকা আংটি ফেরত নেবেন?

এমন কথা বলছ কেন?

এমি বলছি। রাগ করবেন না। রাগ করছি না। আমি এত সহজে রাগ করি না।

আপনার সঙ্গে যে আমার এত কথা হয়েছে এটাও আপাকে বলবেন না। সে জানলে খুবই রাগ করবে। আপা চট করে রেগে যায়। আপার স্বভাব আপনার উল্টো। আপনি রাগ করেন না। আপা করে। স্কুলে তার নাম ছিল R K.

R K মানে কী?

R K মানে রাগ কুমারী। আপনি কিন্তু আপাকে কিছু বলবেন না।

আমি কখনো তাকে বলব না।

আচ্ছা শুনুন, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। আপা যেমন আপনাকে চমকে দিতে চাচ্ছে আপনিও তাকে চমকে দিন। আমি আপনাকে সময় বলে দিচ্ছি। ঠিক দেড়টার সময় আপা কলেজ থেকে বের হয়। কলেজ গেটের সামনে আপনি ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন। আপনাকে দেখে আপার আক্কেলগুড়ম হয়ে যাবে। আমার ধারণা হাত থেকে বই খাতা ফেলে দেবে।

এই কাজটা আমি করতে পারব না এশা, আমি খুবই লাজুক মানুষ।

তাহলে কী করা যায় বলুন তো?

তোমাকে কিছু করতে হবে না। থ্যাংক য়্যু।

না, আপনাকে করতে হবে। আমি চাই আপনি আপাকে চমকে দিন। আপার একটা শিক্ষা হোক। আপনাকে কলেজের গেটের সামনে দাঁড়াতে হবে না। একটা কনফেকশনারির দোকান আছে নাম ‘নিরালা’। আপনি দোকানে ঢুকে একটা কোক বা পেপসি খাবেন। আপা সেখানে উপস্থিত হবে।

সে শুধু শুধু সেখানে যাবে কেন?

যাবে কারণ আমি তাকে বলে দেব ঐ দোকান থেকে আমার জন্যে একটা জিনিস আনতে পারবেন?

না, পারব না।

আপনাকে পারতেই হবে। প্লিজ। আগামীকাল দুপুর দেড়টায়। একটা চল্লিশে আপার ক্লাস শেষ হবে। দোকানে আসতে আসতে তার লাগবে দশ মিনিট।

এশা আমি এই কাজটা করতে পারব না।

না পারলে কী আর করা।

আমার অফিস আছে। অফিস কামাই দিয়ে দোকানে বসে কোক খাওয়া!

কোক খাওয়ার জন্যেতো অফিস কামাই দিচ্ছেন না। যে মেয়েটিকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে যাচ্ছেন।

বিয়ের পরতো গল্প করবই।

বিয়ের পর গল্প করা আর বিয়ের আগে গল্প করা কি এক?

এক না?

না এক না। আকাশ পাতাল তফাত।

তুমি বুঝলে কী করে? তুমিতো বিয়ে কর নি।

বিয়ে না করলেও বুঝতে পারছি। এইসব ব্যাপারে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি বোঝে। আপনি যাবেন কিন্তু।

ধর আমি গেলাম। তারপর দেখলাম তোমার আপা আসে নি।

আপা যাবে। আমি ব্যবস্থা করে রাখব। আর না গেলে দেখা হবে না।

তুমি দেখি খুবই ইন্টারেস্টিং মেয়ে।

দুলাভাই আপনি যাবেন তো?

মাই গড এখনি দুলাভাই ডাছ কেন?

একদিনতো ডাকতেই হবে, একটু প্র্যাকটিস করে নেই।

আগেভাগে প্র্যাকটিস করতে হবে না। আমার খুবই লজ্জা লাগছে।

লজ্জা লাগলে ডাকব না। আচ্ছা শুনুন, আপনি কাল যাচ্ছেন তো?

এখনো বলতে পারছি না।

না আপনাকে যেতে হবে। না গেলে আমি খুবই রাগ করব। আমি আপনার একটা মাত্ৰ শালী। আমাকে রাগালে তার ফল শুভ হবে না। টেলিফোন রাখি। অনেকক্ষণ কথা বলে ফেললাম, আপনি বোধহয় আমাকে ফাজিল টাইপ মেয়ে ভাবছেন। দুলাভাই আমি কিন্তু ফাজিল টাইপ না। সরি, আবার দুলাভাই বলে ফেললাম।

শামা টেলিফোন রেখে খানিক্ষণ হাসল। ছোটবোন সেজে টেলিফোন করার এই বুদ্ধিটা হঠাৎ তার মাথায় এসেছে। বুদ্ধিটা যে এমন কাজে লাগবে আগে বুঝতে পারে নি। মানুষটার গলার স্বর সুন্দর। শুনতে ভাল লাগছিল। আরো কিছুক্ষণ কথা বললে হত। আরেক দিন বললেই হবে। প্রথম দিন এত কথা বলা ঠিক না। এশাকে সে ফাজিল মেয়ে ভাববে। এশা মোটেই ফাজিল মেয়ে না।

মুত্তালিব সাহেব বারান্দায় বসেছিলেন। শামা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মুত্তালিব সাহেব বললেন, কার সঙ্গে কথা বললি?

শামা হাসল।

মুত্তালিব সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, প্রশ্ন করলে প্রশ্নের জবাব দিবি। হেসে ফেলবি না। এতক্ষণ ধরে কার সঙ্গে কথা বললি?

বলা যাবে না।

এ দুনিয়াতে নানান ধরনের ব্যাধি আছে। তার একটা হলো টেলিফোন ব্যাধি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিফোনে কথা বলা ব্যাধি। এটা ভাল না।

আপনার পায়ের অবস্থা কী?

আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম তার জবাব কিন্তু এখনো পাই নি।

আসুন আপনাকে হাঁটাই।

তুই তোর কাজে যা। আমাকে হাঁটাতে হবে না।

আমি টেলিফোনে যতক্ষণ কথা বলেছি ঘড়ি ধরে ঠিক ততক্ষণ আপনাকে হাঁটাব। নগদ বিদায়।

শামা মুত্তালিব সাহেবকে টেনে দাড় করালো। শামা বলল, আমার কাছে হাত রাখুন। আমাকেইতো ধরে আছেন আবার দেয়াল ধরছেন কেন? ভেরি গুড। একী দু’টা পা এক সঙ্গে ফেলছেন কেন? আমি ওয়ান টু বলব। ওয়ান হলো ডান পা, টু হলো বাম পা। ওয়ান-টু। ওয়ান-টু। হাঁটি হাঁটি পা পা।

সুলতানা রান্নাঘরে। আবদুর রহমান সাহেব আজ অফিস থেকে ফেরার পথে ইলিশ মাছ কিনে এনেছেন। তাঁর হঠাৎ সর্ষে ইলিশ খেতে ইচ্ছা করছে। কাচা বাজার থেকে রাই সরিষা, কাচা মরিচ কিনেছেন। দুই কেজি আতপ চালও কিনেছেন। সর্ষে ইলিশ না-কি আতপ চালের ভাত দিয়ে খেতে মজা। ইলিশ সর্ষে রান্না হচ্ছে। এশ খুব আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। সুলতানা বললেন, রান্নাঘরে বসে আছিস কেন?

এশা বলল, রান্না শিখছি। মা, আজ আমি রাধব। তুমি আমাকে দেখিয়ে দাও।

সুলতানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এশার মুখ থেকে অন্ধকার দূর হয়েছে। গত কয়েকদিন চিমসে মেরে ছিল। এখন হাসি খুশি ভাবটা ফিরে এসেছে। তার যে সমস্যা ছিল সেই সমস্যা নিশ্চয়ই দূর হয়েছে। সুলতানার সামান্য মন খারাপ হলো। তার মেয়েগুলির খুবই চাপা স্বভাব। মনের কথা কেউ মা’র সঙ্গে বলে না।

এশা বলল, লবণের অনুমানটা কীভাবে কর মা? কোনো নিয়ম কি আছে?

সুলতানা বললেন, পুরোটাই আন্দাজ। মাখানোর পর জিবে নিয়ে লবণ দেখে নিতে হয়।

ওয়াক থু, কাচা মাছের রস মুখে দেব? পরে পানি দিয়ে কুলি করে মুখ পরিষ্কার করবি।

এশা মাছ মাখাচ্ছে। সুলতানা মুগ্ধ হয়ে মেয়ের কাজ দেখছেন। সময় কত। দ্রুত পার হচ্ছে। এতটুকু মেয়ে ছিল, দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেছে। একজনের তো বিয়েই ঠিক হয়ে গেল।

মা দেখতে লবণ কি এতটুক দেব?

বেশি হয়ে গেছে। আরো কম। একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবি। লবণ কম হলে পরে দেয়া যায়। বেশি হলে কিন্তু কমানো যায় না।

বেশি হলে পানি দিয়ে ঝোল বাড়িয়ে দেব।

সর্ষে বাটায় পানি দিবি কীভাবে?

তাওতো কথা।

সুলতানা আগ্রহের সঙ্গে বললেন, কাচা মরিচের একটা ব্যাপার তোকে শিখিয়ে দেই। কাচা মরিচ আস্ত দিলে মরিচের ঘ্রাণটা তরকারিতে যায়। তরকারি ঝাল হয় না। আর যদি মাঝখান দিয়ে কেটে দিস তাহলে মরিচের ঘ্রাণও যায়

তরকারি ঝালও হয়।

আমরা কী করব মা? ঝাল করব, না মরিচের গন্ধওয়ালা তরকারি করব?

তুই রান্না করছিস, তুই ঠিক কর।

এখাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। সে ভুরু কুঁচকে আছে। এশা বলল, মা আমার খুব আশ্চর্য লাগছে।

কেন?

সামান্য রান্না, তার মধ্যে ডিসিশান নেয়ার ব্যাপার আছে। আমাকে চিন্তা করতে হচ্ছে কী করব। ঝাল তরকারি করব, না-কি মরিচের ঘ্রাণওয়ালা তরকারি করব। মা, আমি তো খুবই চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছি।

সুলতানা তার চিন্তাগ্ৰস্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার খুবই মজা লাগছে।

এশা বলল, মা তুমি যদি এখন বারান্দায় যাও তাহলে খুব মজার একটা দৃশ্য দেখবে।

কী দৃশ্য দেখব?

আপা বাড়িওয়ালা চাচাকে হাঁটা শেখাচ্ছে। ধরে ধরে হাঁটাচ্ছে। আর মুখে মুখে বলছে হাটি হাঁটি পা পা। আপা খুবই মজা পাচ্ছে। বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছে।

সুলতানা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মুত্তালিব সাহেব বেচারা পা নিয়ে ভাল সমস্যায় পড়েছেন। কী অদ্ভুত রোগ— হাঁটু বাঁকে না।

এশা বলল, মা তোমাকে একটা কথা বলব? তুমি কিন্তু রাগ করতে পারবে। না। যদি প্রমিজ কর রাগ করবে না, তাহলেই কথাটা বলব।

রাগ করার মতো কথা?

হুঁ। আমার কথা শুনে তোমার হয়ত মনে হবে আমার মন ছোট বলে এ ধরনের কথা বলছি।

কথাটা কী? বাড়িওয়ালা চাচার সঙ্গে আপার এত মেশা ঠিক না। মেশামেশি বেশি হচ্ছে।

সুলতানা বিস্মিত হয়ে বললেন, এইসব কী বলছিস! উনি শামাকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। মা ডাকেন।

এশা বলল, মা ডাকলেও ঠিক না। ঠিক না কেন?

আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না মা। আমার কাছে মনে হচ্ছে ঠিক না। মুত্তালিব চাচা আপাকে খুব পছন্দ করেন আবার আপাও উনাকে খুব পছন্দ করেন। তুমি কি লক্ষ করেছ দিনের মধ্যে একবার দোতলায় না গেলে আপা থাকতে পারে না?

ও যায় টেলিফোন করতে।

টেলিফোন করতে যাওয়াটা আপার একটা অজুহাত।

তুই বেশি বেশি বোঝার চেষ্টা করছিস এশা। এত বেশি বোঝা কিন্তু ঠিক না। কিছু কিছু মানুষ আছে ভালর মধ্যে মন্দ খুঁজে। তুইও তাদের মতো হয়ে গেলি?

তুমি রেগে যাচ্ছ মা। কথা ছিল তুমি রাগবে না।

আমি রাগি নি। তোর কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছি। মানুষের সম্পর্ক এত ছোট করে দেখতে নেই।

এশা চুলায় হাড়ি বসাতে বসাতে বলল, মা শোন, একবার মুত্তালিব চাচার। টেলিফোন নষ্ট ছিল। প্রায় এক মাস নষ্ট ছিল। এই একমাসও কিন্তু বড় আপা প্রতিদিন একবার করে দোতলায় গেছে।

তাতে কী হয়েছে?

কিছু হয় নি এম্নি বললাম। তুমি যে বললে আপা টেলিফোন করতে যায় এটা যে ঠিক না তা বোঝানোর জন্যে বললাম। তুমি রেগে যাচ্ছ বলে গুছিয়ে তোমাকে কিছু বলতে পারছি না। মা শোন, আপা যখন শুনবে আজ বাসায় সর্ষে ইলিশ রান্না হচ্ছে সে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বে মুত্তালিব চাচার জন্যে তরকারি পাঠাতে।

এতে দোষের কী আছে? উনি শামাকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। মেয়ে কি বাবার জন্যে তরকারি নিয়ে যাবে না? এক টুকরা মাছ মানুষটার জন্যে নিয়ে গেলে সেটা দোষের হয়ে যাবে?

এশা বলল, মা সরি। এই প্রসঙ্গটা তোলা ঠিক হয় নি। তোমার মুখ থেকে রাগ রাগ ভাবটা দূর করে সহজভাবে তাকাও। আমার মন আসলেই ছোট। কী আর করা। মা, চা খাবে?

না।

চা খাও। আমি তোমাকে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছি। চা বানানোটা আমি ভাল শিখেছি মা। বানাই? প্লীজ।

বললামতো না।

তোমার সঙ্গে আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে মা। কঠিন মুখে না বলবে না। আমিতো স্বীকার করেছি আমার মন ছোট। তারপরেও রাগ করে থাকাটা কি ঠিক?

এশী খালি চুলায় চায়ের কেতলি বসাল। শামা এসে উপস্থিত হলো। খুশি খুশি গলায় বলল, চা হচ্ছে না-কি রে? আমিও চা খাব। আজ কি তুই রান্না করছিস?

হুঁ।

কী রান্না?

সর্ষে ইলিশ।

ইলিশ মাছে ডিম ছিল?

ছিল।

ডিমটা আলাদা করে রাখবি। মুত্তালিব চাচা ইলিশ মাছের ডিম পছন্দ করেন। ডিমটা আমি উনাকে দিয়ে আসব।

আচ্ছা।

সুলতানা এশার দিকে তাকিয়ে আছেন। এশা একবার মা’র দিকে তাকাল না। সে নিজের মনে চা বানাচ্ছে। শামা বলল, মা শোন, চাচাকে একসারসাইজ করিয়ে এসেছি। আমার কী মনে হয় জান মা? আমার মনে হয় একসারসাইজের চেয়েও উনার যেটা বেশি দরকার সেটা হচ্ছে সেঁক। কাল থেকে একসারসাইজও করাব, সেঁকও দেব।

তুইতো ডাক্তার না। তুই এসবের জানিস কী?

শামা চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, ছোটখাট ব্যাপার জানার জন্যে ডাক্তার হওয়া লাগে না মা।

এশা বলল, আপা তুমি কী আতাউর ভাইকে টেলিফোন করছিলে?

শামা বলল, না। আমার এত গরজ নেই।

বাবা শখ করে টেলিফোন নাম্বার এনেছেন। একবার টেলিফোন কর।

শামা হালকা গলায় বলল, বাবার শখ থাকলে বাবা করুক। আমার শখ নেই।

সুলতানা নিজের চায়ের কাপ নিয়ে উঠে গেলেন। এশার কথাগুলি শোনার পর থেকে তার ভাল লাগছে না। মনের মধ্যে কী যেন খচখচ করছে। অদৃশ্য কোনো কাটা বিধে আছে।

শোবার ঘর অন্ধকার করে আবদুর রহমান শুয়ে আছেন। শুয়ে থাকার ভঙ্গিটা কেমন যেন অস্বাভাবিক। লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। পায়ের বুড়ো আঙুল এবং নাক এক লাইনে। সুলতানা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেন। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, কী হয়েছে শরীর খারাপ না-কি?

আবদুর রহমান উঠে বসতে বসতে বললেন, মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। মুখের ভেতরটা টক টক লাগছে।

জ্বর আসে নি তো?

না।

চা খাবে? নাও চা খাও, রান্নার দেরি হবে।

অসুবিধা নেই, তোক দেরি।

আজ এশা রান্না করছে।

ও রান্না জানে?

জানে না, শিখবে। তোমার বড় মেয়ের রান্নাবান্নায় আগ্রহ নেই। এশার আছে।

দুই মেয়েকেই শিখিয়ে দাও। আজকালকার মেয়েরা সব শিখতে রাজি, শুধু রান্না শিখতে রাজি না। রান্না শেখাটা খুব দরকার।

আমার মেয়েরা আজকালকার মেয়ের মতো না।

আবদুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের খোঁজ নিয়েছি। এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার মতো আছে। এতে তোমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে না?

সব টাকা এক মেয়ের পেছনে খরচ করে ফেলবে? তোমার তো আরো একটা মেয়ে আছে।

প্রথম বিয়ে একটু ধুমধাম করে দেই। আমি ঠিক করেছি বিয়ের পর মেয়ে। জামাইকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাব। পালকির ব্যবস্থা করব। পালকি করে জামাই-বৌ যাবে। গ্রামের মানুষ ভিড় করবে।

পালকি পাবে কোথায়? দেশে কি পালকি আছে?

আমাদের এদিকে আছে। গ্রামের বাড়িটাও এই উপলক্ষে ঠিক করতে হবে। গ্রামের মানুষরা তো আর দলবেঁধে বিয়েতে আসতে পারবে না। একটা গরু জবহ করে ওদের খাইয়ে দেব।

তার কি দরকার আছে?

আছে। দরকার আছে। সুলতানা শোন, এর মধ্যে আতাউরকে বলি একবেলা এসে আমাদের সঙ্গে খেয়ে যাক।

বল।

অফিস থেকে ফেরার সময় ওকে নিয়ে আসব। রাতে খেয়ে দেয়ে যাবে। গল্প-গুজব করবে। আমিতো আর গল্প করতে পারি না। তোমরা করবে।

আচ্ছা।

তোমার কিছু স্পেশাল রান্না যে আছে সেগুলি কর। শাশুড়ির হাতের রান্না খেয়ে বুঝুক রান্না কাকে বলে! কলার থোর বেটে তুমি যে জিনিসটা কর ওটা করবে। আর মাছের টকও রাঁধবে। নেত্রকোনার ছেলেতো শুটকি পছন্দ করবে। বেগুন দিয়ে শুটকি করবে।

আবদুর রহমান চায়ের কাপ নামিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। সুলতানা বললেন, কী হয়েছে?

বমি আসছে।

বলতে বলতেই তিনি ঘর ভাসিয়ে বমি করলেন।

মন্টু সাউন্ড কমিয়ে দিয়ে টিভিতে এক্স ফাইল দেখছে। টিভির এই প্রোগ্রামটি তার খুব পছন্দের। সপ্তাহে একদিন মাত্র দেখায়। আজ না দেখতে পেলে আরো এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। বাড়িতে একজন অসুস্থ মানুষ আছে। মানুষটা অনেকবার বমি করে এখন শুয়ে আছে। তাঁর ঘর অন্ধকার। মা তাঁর মাথার চুলে ইলিবিলি করে দিচ্ছে। আর সে কি-না টিভি দেখছে! কাজটা খুবই অন্যায়। মন্টুর নিজের কাছেই খারাপ লাগছে কিন্তু সে টিভি বন্ধ করতে পারছে না। সে অবশ্য তার দায়িত্ব ঠিকই পালন করেছে। ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন নিয়ে ওষুধ নিয়ে এসেছে। তারপরেও টিভি দেখাটা ঠিক হচ্ছে না। বড় আপা তাকে একবার দেখে গেছে। বড় আপা কিছু বলে নি। বড় আপা যদি বলত–এই টিভি বন্ধ কর সে বন্ধ করে দিত। বাবার ঘরের দরজা বন্ধ। টিভির সাউন্ড সে ঘরে যাচ্ছে না। তাছাড়া সে সাউন্ড কমিয়ে রেখেছে। নিজেই কিছু শুনতে পাচ্ছে না। বাবার শুনতে পাবার কোনো কারণ নেই।

মন্টু টিভি দেখে স্বস্তি পাচ্ছে না। বারবার চমকে চমকে উঠছে। মনে হচ্ছে। এই বুঝি বাবা বের হয়ে আসবেন! বের হয়ে তিনি কিছুক্ষণ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলবেন আমি মারা যাচ্ছি আর তুই টিভি দেখছি! টিভিটা এতই জরুরি। দেখতেই হবে? বাবা অবশ্যি মারা যাচ্ছে না। দু’তিনবার বমি করলে কেউ মারা যায় না। ডাক্তার সাহেব বলেছেন, আজেবাজে খাবার খেয়ে পেট গরম হয়েছে। তিনি ওরস্যালাইন খেতে দিয়েছেন। আর ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন।

খট করে শব্দ হলো। বাবার ঘরের দরজা খুলছে। মন্টু টিভির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টিভি বন্ধ করল। সুলতানা বের হয়ে এলেন। তিনি সহজ গলায় বললেন, পড়তে যা। টিভির সামনে বসে আছিস কেন? বলেই তিনি মেয়েদের ঘরে ঢুকলেন। মন্টু আবারো টিভি ছাড়ল। এক্স ফাইলে আজকের গল্পটা খুবই জটিল। এক লোকের অস্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। সে তার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু সব সময় পারে না। ইচ্ছা শক্তি খাটাতে হলে তার আশেপাশে গাছ লাগে। টবে বসানো গাছ হলেও হয়। ইচ্ছা শক্তি কাজে লাগানোর পর গাছটা মরে যায়। মন্টু টিভির পর্দার সঙ্গে প্রায় চোখ লাগিয়ে আছে। সাউন্ডটা আরেকটু বাড়াতে পারলে ভাল হত। সেটা ঠিক হবে না।

সুলতানা মেয়েদের ঘরে ঢুকলেন। শামা বলল, বাবা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?

সুলতানা বললেন, হ্যাঁ ঘুমুচ্ছে।

তুমি ভাত খেয়ে নাও।

আমি খাব না। ক্ষিধে নেই।

এশা বলল, মা শোন, খেতে যাও। বাবার শরীর খারাপ করেছে বলে বাবা খাচ্ছে না। তাই বলে তুমিও খাবে না এটা কেমন কথা?

বললাম না ক্ষিধে নেই।

খেতে বসলেই ক্ষিধে হবে। আমি এত আগ্রহ করে রান্না করেছি তুমি খাবে না এটা কেমন কথা!

তোর বাবা শখ করে মাছটা এনেছে। সরিষা বাটা রান্না হবে বলে সরিষা কিনে এনেছে। সে খেতে পারল না, আর আমি খাব এটাই বা কেমন কথা!

এশা ঝগড়ার ভঙ্গিতে বলল, না খেয়ে তুমি কী প্রমাণ করতে চাচ্ছি মা? তুমি কি প্রমাণ করতে চাচ্ছ যে বাবার সঙ্গে তোমার গভীর প্রণয়?

আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাচ্ছি না। ক্ষিধে মরে গেছে, খেতে ইচ্ছা করছে না বলে খাব না। ভোরা ঘুমুতে যা।

সুলতানা চলে গেলেন। শামা এশার দিকে তাকিয়ে বলল, মা এই কাজগুলো যে করে, মন থেকে করে, না দায়িত্ব থেকে করে?

এশা বলল, তোমার বিয়ে হোক, তখন তুমি নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর পাবে। শামা বাতি নিভিয়ে বিছানায় গেল। এশা বলল, আমরা আজ এত সকাল সকাল শুয়ে পড়লাম, ঘুমতো আসবে না।

আয় শুয়ে শুয়ে গল্প করি। এশা তুই কি একটা জিনিস লক্ষ করেছিস, বাতি নিভিয়ে গল্প করতে এক রকম লাগে আবার বাতি জ্বালিয়ে গল্প করতে অন্য রকম লাগে? একই গল্প শুধুমাত্র বাতি জ্বালানো নিভানোর কারণে দু’রকম হয়ে যায়?

এশা বলল, মুত্তালিব চাচার কি ইলিশ মাছের ভিম পছন্দ হয়েছিল?

শামা বলল, খুব পছন্দ হয়েছে। চেটেপুটে খেয়েছেন। তুই রান্না করেছি শুনে বলল তোকে একটা মেডেল দেবে। রুপার মেডেল। মেডেলে লেখা থাকবে- দ্ৰৌপদী পদক।

দ্ৰৌপদী কি খুব ভাল রাঁধতেন?

হুঁ।

উনার পাঁচটা স্বামী ছিল না।

হুঁ।

এশা হাসছে। শামা বলল, হাসছিস কেন? এশা বলল, বেচাৰি দ্ৰৌপদীর কথা ভেবে হাসছি। সে কী বিপদেই না ছিল! পাঁচটা স্বামীকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখাতো সহজ কথা না। একটা স্বামীকেই ভুলানো যায় না, আর পাঁচ পাঁচটা স্বামী। কোনো স্বামী হয়ত লাজুক, সে স্ত্রীকে একভাবে চাইবে। আবার কোনো স্বামী নির্লজ্জ, সে চাইবে অন্যভাবে।

শামা বলল, এশ চুপ করতো, তোর মুখে এই ধরনের কথা একেবারেই মানাচ্ছে না।

কেন? তোমার কাছে কি মনে হয় আমি এখনো ছোট?

ছোটইতো।

আমি অনেক বড় হয়ে গেছি আপা। যতটা বড় তুমি আমাকে ভাব, আমি তার চেয়েও বড়। তুমি তো এখনো বিয়ে কর নি। আমি কিন্তু বিয়ে করে ফেলেছি।

শামা উঠে বসতে বসতে বলল, তার মানে?

এশা কিছু বলল না, হাসল। অন্ধকারে তাঁর হাসি শোনা গেল। শামা বলল, এই তুই কি ঠাট্টা করছিস?

এ রকম ঠাট্টা করবি না। তুই যেভাবে বললি— আমার মনে হলো সত্যি বুঝি কিছু করে ফেলেছিস।

এশা বলল, আমি যা করি খুব চিন্তা ভাবনা করে করি। ইচ্ছা হলো আর হুট করে ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম আমার বেলায় এ রকম কখনো হবে না। যদি আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে বিয়ে করি তাহলে বুঝতে হবে এটা ছাড়া। আমার হাতে অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না।

তুই কি গোপনে বিয়ে করেছিস?

না এখনো করি নি, তবে…

তবে আবার কী?

বিয়ে করব।

ছেলেটা কে?

এশা হাসল। শামা কঠিন গলায় বলল, হাসি বন্ধ করে বলতে ছেলেটা কে?

তুমি চিনবে না। খুবই আজেবাজে টাইপের ছেলে।

আজেবাজে টাইপ ছেলের সঙ্গে তোর পরিচয় হলো কীভাবে?

যেভাবেই হোক, হয়েছে।

ছেলে করে কী?

কিছু করলেতো বলতাম না আজেবাজে টাইপ ছেলে। কিছুই করে না। মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তোলে।

তার মানে?

রবীন্দ্র জয়ন্তী করবে তার জন্য চাঁদা তুলবে, নজরুল দিবস করবে তার জন্য চাঁদা তুলবে, পাড়ায় ক্রিকেট খেলার চাঁদা, দুঃস্থজনগণের জন্য চাদা। এপাড়ার মানুষদের মাসের মধ্যে দু’তিনবার তাকে চাঁদা দিতে হয়। যে চাঁদা দেয় সে হাসি মুখে দেয়, সেও হাসি মুখেই চাদা নেয়। চাঁদা তোলা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সে একজন ডিরেক্টর। তার ব্যবহারও অত্যন্ত ভাল। অফিস বসদের ব্যবহার সাধারণত ভাল হয় না। তারা খিটখিটে স্বভাবের হয়। ইনি সে রকম না।

তুই আমার সঙ্গে ইয়ারকি করছিস নাতো?

না।

শামা বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে যাচ্ছিল, এশা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, যাচ্ছ কোথায়?

শামা বলল, বাবাকে ডেকে তুলি। তোর কথাগুলি তাঁকে বলি।

এশা বলল, বাবার শরীর ভাল না। ঘুমুচ্ছেন। তাছাড়া বাবাকে তোমার কিছু বলতে হবে না। যা বলার আমিই বলব। তুমি চুপ করে বিছানায় বস।

সুলতানার শোবার ঘর থেকে কথাবার্তা শশানা যাচ্ছে। দরজা খোলা হলো। স্বামী স্ত্রী দু’জন এক সঙ্গে বেরুচ্ছেন। সাড়াশব্দ পেয়ে এশা এবং শামা ঘর থেকে বের হয়েছে।

এশা বলল, কী হয়েছে।

সুলতানা লজ্জা লজ্জা গলায় বললেন, কাণ্ড দেখ না। তোর বাবা এখন বলছে ভাত খাবে। তার না-কি শরীর ভাল লাগছে। ক্ষুধা হচ্ছে।

এশা বলল, তোমরা খাবার টেবিলে বসো। আমি খাবার গরম করে আনছি। আবদুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে সংকুচিত গলায় বললেন, আমার মনে হয় ফুড পয়জনিং হয়েছিল। বমির সঙ্গে পয়জন সবটা বের হয়ে গেছে। এখন শরীর ফ্রেশ লাগছে।

এশা খাবার গরম করছে। শামা দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। শামা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকাচ্ছে। তার মুখ থমথম করছে। শামা বলল, ছেলের নাম কী?

এশা হালকা গলায় বলল, নামেতো আপা কিছু যায় আসে না। ওর নাম সলিম হলেও যা, দবির হলেও তা, আবার খলিলুল্লাহ হলেও ঠিক আছে।

আমি মনে হয় ছেলেটাকে চিনতে পারছি। একদিন কলেজে যাবার জন্যে রিকশা পাচ্ছিলাম না, তখন ফর্সামতো লম্বা একটা ছেলে রিকশা ঠিক করে দিয়ে আমাকে বলল, আপা উঠুন।

রিকশাওয়ালা কি তোমার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে?

ভাড়া নেবে না কেন?

এশা হালকা গলায় বলল, রিকশাওয়ালা তোমার কাছ থেকে ভাড়া নিলে বুঝতে হবে মাহফুজ না। মাহফুজ রিকশা ঠিক করে দেবে আর রিকশাওয়ালা ভাড়া নেবে এ রকম হতেই পারে না।

ছেলের নাম মাহফুজ?

হ্যাঁ।

তুই কি সত্যি সত্যি তাকে বিয়ে করেছিস? আমার গা ছুঁয়ে বলতো। প্লিজ।

এশা বিরক্ত গলায় বলল, টেনশনে তোমার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। তুমি টেনশন করছ কেন? টেনশন করব আমি। তোমার এখানে টেনশন করার কিছু নেই।

আমি টেনশন করব না?

না। আমরা যখন এক সঙ্গে ছিলাম তখন একজন আরেকজনের সমস্যা দেখেছি। এক সঙ্গে থাকার সময় শেষ হয়েছে। তোমার একটা জীবন শুরু হতে যাচ্ছে। তুমি তোমারটা দেখবে। আমি দেখব আমারটা।

তোর কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে আমি চিন্তা করব না?

না করবে না। বড় খালা বা ছোট খালা এদের কারোর সঙ্গে কি মা’র যোগ আছে? যোগ নেই। হঠাৎ হঠাৎ বিয়ে জন্মদিন এইসব উৎসবে তাদের দেখা হয়। এই পর্যন্তই। আমাদের অবস্থাও তাই হবে। তুমি তোমার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আমি আমার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হব। কাজেই আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা না। করে নিজের জীবনটা কেমন যাবে তা নিয়ে চিন্তা কর।

ইদানীং তুই নিজেকে খুব বুদ্ধিমতী ভাবছিস।

ভাবাভাবির কিছু নেই আপা, আমি বুদ্ধিমতী।

বুদ্ধিমতী কোনো মেয়ে চাঁদাবাজ ছেলের প্রেমে পড়ে?

হ্যাঁ, পড়ে। ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’ এই প্রবচনটা জান না? আমি অতি চালাক বলেই আমার গলায় দড়ি।

পুরো ঘটনাটা কি আমাকে বলবি?

না। ঘটনা বলে বেড়াতে লাগে না।

আবদুর রহমান সাহেব খেতে বসেছেন। এশা খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললেন, মাছের তরকারিটা অপূর্ব হয়েছে রে মা! এশা শীতল গলায় বলল, মাছের তরকারি তুমি এখনো মুখে দাও নি বাবা। আবদুর রহমান ব্রিত গলায় বললেন, মুখে দিতে হবে না। আমি চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি। চেহারা দেখেই ষোলআনার বারোআনা বোঝা যায়। এশা বলল, চেহারা দেখে কিছুই বোঝা যায় না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress