Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বৃষ্টি ও মেঘমালা (২০০১) || Humayun Ahmed » Page 8

বৃষ্টি ও মেঘমালা (২০০১) || Humayun Ahmed

সুলতানার দাঁতে ব্যথা

সুলতানার দাঁতে ব্যথা।

দাঁতে কোনো ক্যারিজ নেই, কোনো দাত নড়ছেও না, তারপরেও তীব্র ব্যথা। গাল ফুলে গেছে। ব্যথায় তিনি কথা পর্যন্ত বলতে পারছেন না।

বীনা বলল, মা তুমি রিকশা করে কোনো একজন ডেনটিস্টের কাছে চলে যাও। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমার বের হওয়া মানে তিনঘণ্টা সময় নষ্ট। তিন ঘণ্টায় আমি অপটিক্সের একটা চ্যাপ্টার শেষ করতে পারি।

সুলতানা বললেন, তোকে যেতে হবে না। তুই পড়া শেষ কর।

বীনা বলল, মা তুমি রাগ করলে নাকি?

না।

তোমার গলার স্বর কেমন রাগী-রাগী মনে হয়েছে।

সুলতানা বললেন, এত কথা বলিসনা তো বীনা।

বীনা বলল, তুমি শুধু-যে রাগ করেছ তা না— তোমার মনটাও খারাপ হয়েছে। তুমি মনে মনে ভাবছ লীনা কাছে থাকলে আমাকে কখনো বলত না একা একা ডাক্তারের কাছে যেতে। সে অবশ্যই আমার সঙ্গে যেত। মা তুমি এ রকম ভাবছ না?

না আমি এরকম ভাবছি না।

অবশ্যই তুমি এরকম ভাবচ্ছ। কারণ মানুষের স্বভাবই হল তুলনা করা। মানুষ তুলনা করবেই। আচ্ছা মা শোনো, এসো সন্ধা ছটা পর্যন্ত দেখি। আমার ধারণা ফিরোজভাই এর মধ্যে চলে আসবে। যদি না আসে আমি নিয়ে যাব।

আমাকে তোদের কারোরই ডাক্তারের কাছে নিতে হবে না। দরকার মনে করলে আমি নিজেই যাব।

খুবই ভালো কথা মা। তাহলে একটা কাজ কর। রান্নাঘরে যাও। গরম পানি কর, যাতে গরম পানিতে লবণ দিয়ে তুমি গার্গল করতে পার। এইসঙ্গে গরমপানিতে খানিকটা চা-পাতা দিয়ে আমার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে এসো।

সুলতানা মেয়ের পাশ থেকে উঠে এসে রান্নাঘরে ঢুকলেন। দাঁতে ব্যথা ছাড়াও তাঁর মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। গত সপ্তাহে বড়মেয়ের কোনো চিঠি পাননি। প্রতি সপ্তাহেই তিনি দুটা করে চিঠি পান। গত সপ্তাহে একটা চিঠিও আসল না–এটা কেমন কথা। আজ দুপুরে বিছানায় শুয়েছিলেন, তন্দ্রামতো এসেছে— এর মধ্যে লীনাকে স্বপ্নে দেখেছেন। লীনার মুখভর্তি বসন্তের দাগ। একটা চোখ বসন্তরোগে নষ্ট হয়ে গেছে। ঠোঁট, জিভ সব কুচকুচে কালো।

স্বপ্নে তিনি আঁৎকে উঠে বলেছেন— কে কে? কুৎসিত মেয়েটা বলেছে— মা আমাকে চিনতে পারছ না? আমি তোমার বড়মেয়ে। আমার নাম লীনা। বসন্তরোগে আমার চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেছে মা। তবে এতে আমার খুব ক্ষতি হয়নি। আমি ভিক্ষা করি তো। চেহারা কুৎসিত হয়ে যাওয়ায় ভিক্ষা বেশি পাই। দেখ আমার সারাদিনের রোজগার।

এই বলেই লীনা তার থালা উল্টে দিল। ঝনঝন শব্দে থালা থেকে নানান ধরনের মুদ্রা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

এরকম কুৎসিত স্বপ্নের কোনো মানে আছে? সুলতানা বীনার কাছে গিয়েছিলেন স্বপ্নের কথা বলতে। শেষপর্যন্ত বলেননি। বললে বীনা নানান ধরনের যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করে দিত— তিনি খুব স্বাভাবিক স্বপ্ন দেখেছেন। এই স্বপ্ন দেখে অস্থির হবার কিছু নেই। মুরগি সদকা দেবার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।

সবসময় যুক্তিতর্ক শুনতে ভালো লাগে না।

সুলতানা রান্নাঘরে চুলার পাশে বসে আছেন। বড়মেয়ের জন্যে তাঁর খুব মন কাঁদছে। লীনা পাশে থাকলে কোনো অবস্থাতেই তিনি রান্নাঘরে আগুনের পাশে বসতে পারতেন না। তাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হত। মেয়ে তারচেয়েও অনেক অস্থির বোধ করত।

সুলতানার ইচ্ছা করছে মেয়ে যেখানে কাজ করছে সেখানে চলে যেতে। মেয়েকে দেখে এলেন। সম্ভব হলে মেয়েকে নিয়ে চলে এলেন। তাকে নিয়ে যাবে কে? ফিরোজকে বললে সে অবশ্যই নিয়ে যাবে। তিনি ঠিক করে রেখেছেন আজ যদি ফিরোজ আসে তাহলে তো ভালই–আজ যদি সে না আসে তিনি বাড়িওয়ালার মেয়েকে দিয়ে ফিরোজের অফিসে টেলিফোন করিয়ে তাকে আনাবেন।

বীনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে ফিরোজ আজ সন্ধ্যা ছটার মধ্যে আসবে। বীনা যা বলে প্রায় সময়ই সে-কথা ফলে যায়। একধরনের মেয়ে আছে তারা যা বলে তাই ফলে যায়। এইসব মেয়েদেরকে বলে ফলানি। ফলানিরা নিজের জীবনে খুব দুঃখ-কষ্ট করে। সুলতানার প্রায়ই মনে হয়— বীনা বোধ হয় একজন ফলানি।

কাঁটায় কাঁটায় দুটার সময় ফিরোজ এসে উপস্থিত। সে এই বাড়িতে কখনো খালিহাতে আসে না। আজও আসেনি। দশটা বড় সাইজের কৈমাছ এনেছে। এক কেজি বগুড়ার দৈ এনেছে। দুই কেজি শুকনো বড়ই এনেছে।

বীনা পড়ার টেবিল থেকে উঠে এসে কোমরে হাত দিয়ে রাগী-রাগী গলায় বলল, ফিরোজ ভাই-আপনি তো জানেন আপা জয়দেবপুরে। তারপরেও এই বাজার আনলেন কেন?

ফিরোজ বলল, তোমাদের জন্যে এনেছি—তোমরা খাবে।

বীনা বলল, আমাদের জন্যে আপনি কিছু আনেননি। আমি কৈ মাছ খাই না। একবার কৈ মাছের ভাজা খেতে গিয়ে গলায় কাঁটা ফুটেছিল— সেই থেকে কৈ মাছ খাওয়া বন্ধ। আপা আবার কৈ মাছের জন্যে পাগল। আপনি এনেছেন কৈ মাছ। আপার পছন্দের খাবার। বগুড়ার দৈ এনেছেনএটাও আপার পছন্দের খাবার। শুকনো বড়ই এনেছেন যাতে মা আচার বানিয়ে আপাকে পাঠাতে পারে। আপা আচার খায় আমি খাই না।

ফিরোজ উত্তরে কিছু বলতে পারল না। বীনী যা বলছে সত্যি বলছে।

বীনা বলল, যাই হোক আপনার অপরাধ ক্ষমা করা গেল। এখন আপনি দয়া করে মাকে একজন ডেনটিস্ট দেখিয়ে আনুন। আমি পড়া ছেড়ে উঠতে পারছি না। মার দাঁতে প্রচণ্ড ব্যথা।

ফিরোজ বলল, আমি এক্ষুনি নিয়ে যাচ্ছি।

বীনা বলল, আপনাকে এক্ষুনি নিতে হবে না। এসেছেন যখন, পাঁচ-দশ মিনিট বসুন। চা খান। শুধু চা ভো মা আপনাকে দেবে না। চায়ের সঙ্গে কোনো-না-কোনো নাশতা মা বানাবে। আমি সেই নাশতায় ভাগ বসাব। আমার প্রচণ্ড খিদে লেগেছে।

সুলতানা ফিরোজের জন্যে বোম্বাই টোস্ট বানাচ্ছেন। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, তার দাঁতের ব্যথাটা চলে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও মনে হচ্ছিল মাথা ছিড়ে পড়ে যাবে, সেখানে কোনো ব্যথাই নেই–এটা খুবই আশ্চর্যের কথা।

ফিরোজ বীনার সঙ্গে গল্প করছে। বীনার সঙ্গে গল্প করতে ফিরোজ পছন্দ করে। বীনা তার বোনের মতো না। বীনার সঙ্গে অনেক কঠিন কথা খুব সহজেই বলা যায়। অথচ লীনার কাছে বলা যায় না। লীনা কেঁদেকেটে একটা কাণ্ড ঘটিয়ে দেয়। একই পরিবারের দুই মেয়ে, অথচ তাদের মধ্যে কোনো মিলই নেই।

তোমার পরীক্ষা কবে বীনা?

সামনের মাসের ছাব্বিশ তারিখ।

টেনশান লাগছে?

যতটা টেনশান লাগা উচিত ছিল— ততটা লাগছে না।

প্রিপারেশন কেমন?

খুবই খারাপ। মন লাগিয়ে পড়তে পারছি না।

পীর সাহেবের দোয়া বা তাবিজ লাগলে আমাকে বলবে। আমি জোগাড় করে দেব। আমাদের পাড়ায় একজন পীরসাহেব থাকেন, তিনি পরীক্ষাপাসের তাবিজ দেন। পঞ্চাশ টাকা করে হাদিয়া নেন। আমি একশো টাকা দিয়ে ডাবল একশানের একটা তাবিজ নিয়ে আসতে পারি।

আপনাকে তাবিজ আনতে হবে না। আপনি নিজে প্রতি সপ্তাহে দুবার করে আসবেন। টুকটাক কিছু কাজ করে দেবেন। এতেই আমার উপকার হবে। ফিরোজ ভাই, কাল কী হয়েছে শুনুন— রাত নটার সময় মা বলে কী ঘরে লবণ নেই, মুদির দোকান থেকে লবণ এনে দিবি? চিন্তা করেন অবস্থা।

আমার গ্রামের বাড়ি থেকে একটা কাজের ছেলে আমি এক সপ্তাহের মধ্যে আনিয়ে দেব।

থ্যাংক য়্যু ফিরোজ ভাই।

ফিরোজ বলল, তোমার জন্যে বিরাট একটা দুঃসংবাদ আছে। দুঃসংবাদটা দেব?

বীনা চিন্তিতমুখে বলল, কী দুঃসংবাদ?

তোমার দুদিনের পড়া নষ্ট হবার মতো দুঃসংবাদ।

কী সর্বনাশ!

দুঃসংবাদটা হল— আমি সামনের মাসের ২১ তারিখ শুক্রবার বাদ জুম্মা বিয়ে করছি। ধানমণ্ডিতে উল্লাস নামের একটা কম্যুনিটি সেন্টারে বিয়েটা হবে। তোমার দুদিনের পড়া নষ্ট হবে। বিয়ের দিনের পড়া আর বিয়ের আগে তোমার আপার গায়ে হলুদ যেদিন হবে, সেদিনের পড়া। নিজের বোনের বিয়ে— এই ক্ষতিটা তো তোমাকে সহ্য করতেই হবে।

তাই না?

বীনা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এই আনন্দের খবরটা কি আপা জানে?

ফিরোজ বলল, জানে না। আমি আগামীকাল জয়দেবপুর যাব। তাকে খবরটা দিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসব।

বীনা বলল, ফিরোজ ভাই আমি আপনাকে লিখে দিতে পারি, বিয়ের পর আপা হবে এই পৃথিবীর সুখী মেয়েদের একজন।

ফিরোজ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমার কথা ঠিক না বীনা। আমি প্রতিভাশূন্য সাধারণ একজন মানুষ। আমার জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে কোনো ড্রামা নেই। কোনো একসাইটমেন্ট নেই। আমি আদর্শ স্বামীর মতো দশটা-পাঁচটা অফিস করব। বাজার করব। ছেলেমেয়ে বড় হলে তাদেরকে রোজ সন্ধ্যায় পড়াতে বসব। খুবই সরল জীবনযাপন। কোনো মেয়ের জন্যেই এই জীবন আদর্শ জীবন না।

সাধারণ মানুষ হতেও প্রতিভা লাগে। সাধারণ হওয়াও কিন্তু খুব কঠিন কাজ।

তোমার কথা শুনে ভালো লাগল বীনা। তোমার কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে। যাই হোক তুমি কি আমার জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করবে?

কি কাজ?।

বলতে খুব সংকোচবোধ করছি কিন্তু না বলে পারছি না। তুমি কি লীনার স্যার হাসান সাহেবকে একটা চিঠি লিখে দেবে। আমি চিঠিটা তাঁকে দিতাম।

চিঠিতে কি লিখতে হবে?

চিঠিতে কি লিখতে হবে তুমি জান। জান না?

হ্যাঁ জানি।

ফিরোজ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চিঠিটা লিখবে খুব গুছিয়ে, যেন চিঠি পড়েই উনি লীনাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress