বৃদ্ধাশ্রমে যাত্রা
এবার বৃদ্ধাশ্রম নামক বানপ্রস্থের পথে যাত্রা শুরু আমার। তাই আকাশের ঠিকানায় তোমায় চিঠি লিখা।
কত অতীত আজকে ভেসে উঠছে হৃদি ক্যানভাসে। ছিলে তুমি আর সঙ্গে তুতুল। কত আনন্দ বিরাজ করতো আমাদের ছোট্ট সংসারে। কেবল তোমার স্মৃতি মনে জাগে। তুমি চলে গেলে পুনে থেকে তুতুল এলো। তোমার সকল কাজ সম্পন্ন করে আমায় বললো, এখানে থেকে আর কি করবে মা? চলো বদলে আমার ওখানে কিছুদিন থাকবে , মন ভালো লাগবে। আমরা খুব শিগগিরই মাসকট চলে যাবো, ওখানে কর্মসূত্রে থাকতে হবে কয়েক বছর। যতদিন এদেশে আছি থাকবে আমাদের সঙ্গে। তারপর না হয় আমাদের সঙ্গে মাসকট যাবে।
আমি বললাম ঐসব দেশে গিয়ে আমি থাকতে পারবো না। তোর বাবার বাড়ি ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে নেই। তোর বাবার স্মৃতি জরিত বাড়ি কত কষ্টে গড়া।
তুতুল বললো, ও-মা ! অত বড় বাড়িতে কী করে একা থাকবে? বরং ওটা বিক্রি করে দিয়ে একটা ছোটো ফ্ল্যাট কিনে দেবো, থাকবে সেখানে। অথবা আজকাল অনেক ভালো ভালো বৃদ্ধাশ্রম হয়েছে সেখানে অনেক বৃদ্ধা থাকে , ওরা তোমার সঙ্গী হবে ; মন ভালো থাকবে। একাকীত্বতা কাটবে। আর বিদেশে আমিও নিশ্চিন্তে থাকবো।
আমি বললাম, না বাবা তোর বাবার তৈরি কষ্টের বাড়ি বিক্রি হোক আমার ইচ্ছে নেই- স্মৃতি সব মুছে যাবে। নিজের বাড়ি বলতে যে আর কিছুই থাকবে না।
তুই যখন এখানে আসবি কোথায় উঠবি।
তুতুল বললো, আমার জন্য চিন্তা করোনা। ব্যবস্থা একটা কিছু করা যাবে।
বাড়িতে এলে একদিন তুতুল বললো মা, এই বাড়িটা প্রোমোটারকে দিলাম। ফ্ল্যাট তৈরি হবে। দুটো ফ্ল্যাট আমরা ফ্রি পাবো। একটায় তুমি থাকবে আর অন্যটা আমরা আসলে ব্যবহার করবো। বললো সামনের সপ্তাহে বাড়িটা ওদের হ্যান্ড ওভার করতে হবে। একটা ভালো বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থা করেছি, জানি তোমার পছন্দ হবে।
মন খারাপ হয়ে গেল। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলে অভিভাবক, ইচ্ছা সবসময় মান্যতা পায়না। তাই চুপ থাকলাম।
আমি ওকে দোষ দিই না। ও আমার ভালো চিন্তা করেই এসব করছে মানি। শুধু আক্ষেপ তোমার গড়া বাড়িটা ভেঙে ফেলা হবে। ইচ্ছে ছিলো তোমার মতো এই বাড়ি থেকেই পরপারে যাবার, আর হলোনা।
পরের সপ্তাহে চললাম বৃদ্ধাশ্রমের পথে। পৌঁছলাম ‘ শান্তি বিলাস ‘। বৃদ্ধাশ্রমটির নাম। মন বিশেষ ভালো নয়। দোতলায় নির্দিষ্ট রুমে ঢুকতে যাবো, দেখি কয়েকজন বৃদ্ধা হলুদ গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে। চেনা চেনা লাগছে। মন ভালো না থাকায় তেমন গা করলাম না।
একজন বললো, ‘ চিনতে পারছিস আমায়? কৃষ্ণা দি’। আমি অবাক ! আমার ইস্কুলের হেডমিস্ট্রেস ছিলেন। তিনিই খুলেছেন এই সংস্থা – শুধুমাত্র অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকাদের জন্য। একে একে গায়েত্রীদি, শকুন্তলা, নবনীতা, রেবতী, অঞ্জুদি সবার সঙ্গে দেখা হলো। সকলের সন্তান বিদেশে, তাই স্বেচ্ছায় আসা বৃদ্ধাশ্রমে। আনন্দে চোখে জল এলো। সকলকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলাম। অভিমানী মন প্রশান্তিতে ভরে গেল।
তোমায় একটা সুখবর জানাই, আমাদের তুতুল খারাপ নয়। ও সব জেনে আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এসব কিছুই না জানিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে।
ও কষ্ণাদি’র সঙ্গে যোগাযোগ করে যখন দেখেছে আমার কলিগরা সব এখানে আছে তখন তাড়াতাড়ি আমার জন্য সুন্দর ব্যালকনি যুক্ত একটা ঘর বুক করে রেখে গেছে।
আজ খুব হালকা লাগছে জানো। ভীষণ মন খারাপ লাগছিল বাড়িটা ছাড়তে। কিন্তু এখন ভাবছি তুমি নেই, একাকীত্বে জর্জরিত মনটা এবার কলিগ বন্ধুদের সঙ্গে থেকে কিছুটা খুশি উপভোগ করবে। প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আজ ভালো লাগছে।
তুতুলকে আশির্বাদ ক’রো, ও যেন উদার আদর্শবান হয়। আমি ভালো আছি। তুমিও ভালো থেকো ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই।