বৃত্তের বাইরে (Britter Baire) : 06
কেমন একটা অতীন্দ্রিয় অনুভবে অর্জুন বোঝে যে তিতি তাকে ডাকছে। তার মনে হয় এটা অতীন্দ্রিয় অনুভব। সিক্সথ্ সেন্স। কিন্তু কতকগুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কারণও আছে এই অনুভবের। এটা অস্বীকার করা যায় না। যেমন তিতি দুবার তাদের কেমিস্ট্রি ল্যাবের সামনে দিয়ে ঘুরে গেল। শুধু শুধু। তিতির সঙ্গে একজন বন্ধু ছিল। গোপা বোধহয় মেয়েটার নাম। ভীষণ শব্দ করে গলা খাঁকারি দিল, অসভ্যের মতো। সার মুখ তুলে তাকালেন। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের পর সে বাইরে বেরিয়ে দেখল ফুলে ভরা জারুল গাছের তলায় তিতি দাঁড়িয়ে আছে। একা। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল— ‘ডাকছিলি?’ তিতি কিছু না বলে চলতে আরম্ভ করল। কম্পাউন্ড পার হয়ে সে মেন বিল্ডিঙের চত্বরে উঠল। গোপা এবং আরও কয়েকটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের কিছু বলল, তারপর তর তর করে সিঁড়ি নেমে এসে কলেজ গেটের বাইরে বেরিয়ে এল। অর্জুন সারাক্ষণই তার পেছন পেছন এসেছে, খালি মেন বিল্ডিঙের ওপরে ওঠেনি, একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল তিতি এখনও চলছে। খুব হনহন করে না হলেও খুব ধীর লয়েও নয়। তার উদ্দেশ্যটা কী এখনও বোঝা যাচ্ছে না। সে কি সত্যিই অর্জুনের সঙ্গে কিছু কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে, না সেরকম কিছু নয়? অন্য কোথাও যাচ্ছে। হয়ত বাড়িই! সেটা অর্জুন পুরোপুরি বুঝতে পারছে না। অথচ ভেতরে ভেতরে তার স্পষ্ট ইন্দ্রিয়াতীত ষষ্ঠ অনুভব তিতি তাকে ডাকছে।
একটু তাড়াতাড়ি হেঁটে সে তিতিকে প্রায় ধরে নিল। বলল— ‘আস্তে চুল। আরেকটু আস্তে।’ তিতি পেছন ফিরল না। থামলও না। তাদের মধ্যে এইরকমই হয়। ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বের একটা তীব্র টানা-পোড়েন চলে, চলতেই থাকে। কখনও অর্জুন ডমিনেট করে, কখনও তিতি। আজ যেমন। এতটা পথ পেছন পেছন ছুটে এসেও অর্জুন তিতিকে ধরতে পারছে না। তিতিই কর্তা। তিতি ডমিনেট করছে।
অথচ কটা দিন আগেই তিতি যখন তাদের চুঁচড়োর বাড়িতে গিয়েছিল, তিন দিন থেকেছিল তখন, সেই পুরো সময়টা তিতি অর্জুনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অর্জুনই ছিল কর্তা। সে তিতিকে ইচ্ছেমতো হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে, রাগিয়েছে।
প্রথমটা তিতি যেতে চায়নি। সে বন্ধুদের সঙ্গে যখন যেখানে খুশি যায়, বন্ধু থাকে বান্ধবও থাকে। কোনও ব্যাপারই নয়। কিন্তু অর্জুনের বেলায় সে ‘বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি’টা বলতে চাইছিল না। একটাই কথা বলেছিল— ‘তুই তো আমার বন্ধু নয়, ভাই। মিথ্যে বললে নিজেকে ছোট করা হয়।’
অর্জুন অবাক হয়ে বলেছিল— ‘কথাটা তুই বলতে পারলি তিতি? তোর সঙ্গে যখন আলাপ হয়, তুই জানতিস আমি তোর ভাই হই সম্পর্কে? আমি জানতুম তুই আমার বোন হোস?’ কেউই জানতুম না। এই সেদিন জেনেছি। সুতরাং বন্ধু পরিচয়টাই প্রথম, আদি পরিচয়।’
—‘কিন্তু গোপা, শৃঞ্জয়, বিশ্বজিৎ পৌলোমী কেউ যাবে না… আমি একা!’ খুবই দ্বিধা প্রকাশ করে তিতি।’
—‘দেখ তিতি, বাজে কথা বলিসনি। তুই খুব ভাল করেই জানিস তোর ওই গোপা শৃঞ্জয় এবং বিশ্বজিৎদের আমি দু-চোখে দেখতে পারি না। পৌলোমী আসতে পারে। যদি সে চায় এবং তুই চাস। কিন্তু আমি চাই না। আমি নিমন্ত্রণকর্তা, আমি চাইছি না, সে ক্ষেত্রে পৌলোমীর আসাটা কি খুব সম্মানজনক হবে? আর তুই তো জানিস তোকে নিয়ে যাচ্ছি আমার নিজের বাড়িতে আমার মা, কাকিমা সবার কাছে। সেখানে নিশ্চয়ই আমার কাছ থেকে তোর শ্লীলতাহানির ভয়টা নেই। না কী?’
‘বাজে কথা বলিস না অর্জুন, তুই আবার আমার শ্লীলতাহানি করবি কী রে? আমি বরঞ্চ তোর এই মভ রঙের শার্টটা টেনে ছিড়ে দিতে পারি। কত দিন পর পর তোকে এই একই শার্টে দেখছি।’
—‘আরও কদিন দেখতে পারিস, রাতে কেচে দিনের বেলায় যদি পরে বেরোতে পারি তাহলে আর সিনথিটিক পোশাকের মানে কী?’
—‘কিন্তু কেন? তোর কি আর নেই?’
—‘নেই তা নয়। তবে কমই আছে। কমই রাখতে চাই। এবং বিশ্বজিতের মতো ফ্যাশন-প্যারেড করা ছেলেদের দেখলে আমার একই সঙ্গে বিবমিষা এবং করুণা হয়। একটা উনিশ-কুড়ি বছরের যুবক হ্যাংলার মত ওয়ার্ডরোব ধুর, কাপড়ের আলমারির দিকে তাকিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে ভাবলে আমার কী যে হয়, রাগ না ঘেন্না না অবিমিশ্র অবজ্ঞা ঠিক আমি বোঝাতে পারব না রে তিতি। আর তা ছাড়াও জেনে রাখ আমি তোদের মতো বড়লোক নই। তিনটে বিধবার আমি একমাত্র সন্তান। তারা আমাকে নিজেদের সব দিয়ে অনেক কষ্ট করে বড় করছে। আমাকে তাদের দেখতে হবে। আমার কটা শার্ট, আর সে শার্টটা কদিন পরলুম এসব নিয়ে ভাবলে আমার চলে না। এগুলো ভাববার যোগ্য বিষয় বলেও আমার মনে হয় না।
অতএব তিতি অর্জুনদের চুঁচুড়ার বাড়ি গেল। এবং গিয়ে একাধারে মুগ্ধ এবং বিষণ্ণ হয়ে গেল। তিতি একটু অদ্ভুত। অর্জুনও অদ্ভুত কিন্তু তিতি আরও অদ্ভুত। সে যখন তার আগেকার বন্ধুদের অর্থাৎ ওই এবং বিশ্বজিৎদের সঙ্গে থাকে তখন তিতি পাক্কা ফিরিঙ্গি। এই কলকাতার শতকরা পঞ্চাশ জন কলেজি তরুণীর মতো। পরিসংখ্যানটা অর্জুনের নিজের। ওরা দিজেদের মধ্যে এটাকে বলে ‘হাই-ফাই কালচার’, যদিচ কালচার বলে এর ভেতরে কিছু নেই বলে ওর মত। এ নিয়ে তিতির সঙ্গে তার ফাটাফাটি তর্ক হয়েছে এক সময়ে। অৰ্জুন বলে ‘যদি ব্যুৎপত্তিগত’ অর্থে ধরিস তাহলে এটা কালচার। কারণ এরা মাতৃভাষার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃভূমির সব কিছু ত্যাগ করে মার্কিন জীবনযাত্রার ধরন “রপ্ত” করেছে। কালটিভেট করেছে অতএব— কালচার বলতে পারিস। নিজের দেশের বাতাসে শ্বাস নেয়। সরকারি টাকার অর্থাৎ ট্যাক্সপেয়ারদের টাকার মুণ্ডুপাত করে বড় বড় পড়াশুনো করে, তারপর প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে বিলেত-আমেরিকায় উড়ে যাবার। সেখানে গিয়ে এদের শতকরা নিরানব্বুইজন পাত্তা পায় না। কোনওরকমে চাকরিটা সেরে নিজেরা যে দেশি কলোনি গড়েছে সেইখানে শামিল হয়। একটাও বিলিতি বা আমেরিকান লোকের সঙ্গে মেলামেশা করে না। বাইরে থেকে তাদের অনুকরণ করে আর যে সংস্কৃতি এখানে ময়লা কাপড়ের মতো ত্যাগ করে গেছে সেই সংস্কৃতির বহিরঙ্গ ওইখানে প্রতিষ্ঠিত করবার হাস্যকর চেষ্টা করে যায়। দুর্গাপূজো, সরস্বতীপুজো, জলসা।
তিতি বলে— ‘তুইও বাইরে থেকে দেখে বিচার করছিস। সুতরাং অবিচার করছিস। যারা বাইরে যায় শুধু আরাম আর ডলার রোজগারের জন্যে যায় না। কাজ করবার জন্যেও যায়। এখানে কাজ করবার পরিবেশ আছে? জানিস আমার জারতুত দাদা দিব্যদা ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার। কোলাঘাটে আছে। বলে ইউনিয়নের ঠ্যালায় কাজ-কর্ম করাই দায়। দুর্নীতির চোটে হাত-পা বাঁধা জগন্নাথ হয়ে থাকো।
—‘ওকে ঠুঁটো জগন্নাথ বলে’ অর্জুন সংশোধন করে দেয়।
‘বেশ ঠুঁটো জগন্নাথ। তা হলে? কাজের জন্যে লোকে বিদেশে যাবে না কেন? সব প্রতিভা এখানে অপচয় করতে হবে? না কি? খোরানা, কি নারলিকর এখানে বেরোল?’
—‘তুই সরকারি সংস্থার কথা বললি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কি এদেশে নেই? গবেষণাগার কি এদেশে নেই?’
—‘আছে। থাকবে না কেন? সেখানেও কি অসুস্থ প্রতিযোগিতা নেই ভাবছিস? প্রফেশন্যাল জেলাসি, ক্লিকবাজি এসব সর্বত্র আছে।’
—‘বিলেত দেশটাও মাটিরই রে! বহুদিন আগেই এক ভদ্রমহিলা এ কথা বলে গেছেন। এখন তো তাড়িয়ে দিচ্ছে। নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে যারা সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হয়ে আজীবন কাটায় তাদের আমি ধিক্কারই দেব। আর কিছু আমার মুখ দিয়ে বেরোবে না।’
—‘দিস। ধিক্কারই দিস। কিন্তু জেনে রাখিস তারা সবাই অবজ্ঞার পাত্র নয়, করুণার পাত্র বরং। দিব্যদার এক বন্ধুর কথা জানি, ফৈজাবাদে ওয়ার্কস ম্যানেজার না কী হয়ে গিয়েছিল। সে অঞ্চলের লোকেদের অত্যাচারে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। বাংলো ঘেরাও করে ফেলেছিল মারবে বলে। অপরাধ কী? না কোম্পানির উন্নতির জন্যে কতকগুলো মেজার নিতে আরম্ভ করেছিল। ম্যানেজিং কমিটিই সেটা পাস করে দেয়। ইউনিয়ন লিডাররাও তখনকার মতো সায় দেয়। তারপর ওই ব্যাপার। ইউনিয়ন লিডারগুলো দু পক্ষেরই খায়।
‘বঙ্গালি মনজারকো হঠাও’— এই স্লোগান দিয়াছিল। তা এই তো নিজের দেশের নাগরিকত্ব!’
তিতি সেবার জিতে যায়। অর্জুন তাতে কিছু মনে করে না। তিতি মেয়ে বলেই তাকে হেরে যেতে হবে এতোটা পৌরুষাভিমান নেই তার। কিন্তু ‘বা বা ব্ল্যাকশিপ’ দিয়ে পড়ুয়া জীবন-শুরু করা বাচ্চাদের বাবা-মাদের ওপর তার কোনও শ্রদ্ধা নেই। সে তিতি যতই বলুক। তিতি বলে— ‘ইংরিজিটা জানা না থাকলে কাজকর্ম পেতে অসুবিধে হচ্ছে। বিয়ে-টিয়ে হতেও অসুবিধে হচ্ছে, এটা ঘটনা। বলতে পারিস দাসত্বের উদ্গার…’
এইখানে আবার অর্জুন তাকে সংশোধন করে দেয়— ‘দাসত্বের উদ্গারটা আবার কী? গুরুভোজন হয়ে গেলে উদ্গার বা ঢেকুর ওঠে। কিন্তু গুরুভোজনটা একটা বিলাস। দাসত্বের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্গারটা ঠিক— বুঝতে পারছিস জুতসই হচ্ছে না। বরং দীর্ঘস্থায়ী দাসত্বের অভ্যাস, অভ্যাসই বল।’
—‘ঠিক আছে বাবা তুই বাংলা ভাল জানিস, তুই যা বলবি আমায় মেনে নিতে হবে। কথার মাঝখানে কথা বলায় তিতি একটু অসন্তুষ্ট।
অর্জুনকে তখন বোঝাতে হয়— ‘দ্যাখ তিতি, তোর সঙ্গে আমার ভদ্রতার, ভব্যতার সম্পর্ক নয়। দুজনেই আমরা বেড়ে উঠছি। তোর ভুল আমি আমার ভুল তুই যদি শুধরে দেওয়া-দেওয়ি না করি তো দুজনেই অসম্পূর্ণ হয়ে থাকব। সেটা কী ভাল?’
তিতির মুখ তবুও গোমড়া।
—‘আচ্ছা তোকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি, স্বস্ত্যয়ন বানানটা বল তো!’ তিতির বানান ভুল হল। সে গোমড়া মুখে বলল, ‘জানি না তো কী করব!’
—‘ঠিক আছে! জানিস না। হেমারেজ বানান বল তো?’ তিতির বানান আবার ভুল হল, সে লজ্জা পেয়ে বলল—‘ইস্ কথাটা তো যখন-তখন ব্যবহার করি, অথচ বানানটা বলতে পারলাম না, এ মা!’
অর্জুন বিজয়ীর হাসি হেসে বলল— ‘বানান এক আধটা ওরকম ভুল হতেই পারে, ওটা কোনও ব্যাপার না, কিন্তু মাতৃভাষার বহুব্যবহৃত শব্দটা যখন ভুল করলি তোর প্রতিক্রিয়া হল— জানি না, তো কী করব!’ আর ওই ইংরেজি হয়ে যাওয়া ক্ল্যাসিক্যাল শব্দটা ভুল করে তুই লজ্জা পেলি, বললি এ মা!— এর মানে কী? কী দাঁড়ায়? তু-ই বল! আমরা এখনও পরাধীনই আছি। গোলাম। সর্ব বিষয়ে। শুধু বাক-স্বাধীনতাটাই একমাত্র স্বাধীনতা, যা আমরা অর্জন করতে পেরেছি। কথার ওপর কেউ ট্যাক্স বসাতে পারছে না।’ বলে অর্জুন হাসতে থাকে। তিতি ভাবিত। তিতি এই পর্বে হেরে গেছে। কিন্তু সে মনে করছে না কিছু।
তিতি অদ্ভুত। চুঁচড়োয় অর্জুনদের বাড়ি গিয়ে সে আনন্দে একবারে আত্মহারা হয়ে গেল। ‘খড়খড়ি খড়খড়ি! গরাদ-দেওয়া জানলা! ফ্যানটাসটিক্!’
প্রথমে গিয়ে দাঁড়াল বাগান পেরিয়ে তিন চার ধাপ উঠে কাঠের বিরাট দরজা খুলে ভেতরের প্রশস্ত দালানে যার এক দিকে ঠাকুর দালান, অন্য দিক দিয়ে কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছিলেন অর্জুনের মা। ধবধবে ফর্সা। একটু মোটাসোটা। কাঁচা পাকা চুল। কালোপাড় সাদা শাড়ি। খালি পা। তিতি প্রণাম করল। অর্জুনের মা বললেন—‘এই তোর প্রতীতি?’
অর্জুন গম্ভীরভাবে বলল—‘আমার প্রতীতি আমার নিজের কাছেই আছে মা, ও বরং তোমারই প্রতীতি, দেখো তোমার তনু-বোনের সঙ্গে মিল পাও কি না।’
—‘প্রতীতি, তোমার মা তনু আমার আপন পিসতুত বোন ছিল জানো তো? খুব মামার বাড়ি আসত। কী খেলতুম আমরা! রান্নাবাটি! পুতুল!’
সেই সময়ে তিতি বলে উঠেছিল ‘খড়খড়ি! খড়খড়ি! গরাদ!’ বলেই দু-সিঁড়ি। টপকে টপকে ছুট। সিঁড়ির বড় চাতালটায় পৌঁছে বোধহয় তার খেয়াল হয় সে মুখ ফিরিয়ে বলে—‘মাসি আমি ওপরে আসতে পারি তো?’
—‘নিশ্চয়ই।’ মৃদু হেসে বললেন অর্জুনের মা।
আসলে সিঁড়ির সেই বড় চাতালেই একটা পেল্লাই জানলা ছিল। সেটা দিয়ে পেছনের বাগান দেখা যায়। এই বাগানের পেছনে গঙ্গা। সেটাই ছিল তিতির আহ্লাদের কারণ। জানলায় প্রশস্ত ধাপ ছিল। সেই ধাপের ওপর বসে পড়ে সে দুটো গরাদের মধ্যে নিজের মুখটা চেপে ধরেছিল, আরও দুটো গরাদ হাত দিয়ে ধরে। বলেছিল— ‘জানিস অর্জাই, যেখানে যাব খালি গ্রিল গ্রিল গ্রিল, আমার প্রাণটা হাঁপিয়ে ওঠে। আজ কতদিন পর গরাদ দেখলাম! গরাদে মুখ রাখলাম!’
অর্জুন বলল— ‘তিতি তোর মুখ ডোরা কাটা হয়ে গেছে।’
অর্জুনের মা খুব লজ্জিত হয়ে বললেন— ‘এত জানলা, দরজা এ বাড়িতে যে নিয়মিত ঝাড়া-মোছা করতে পারি না, ইস্ প্রতীতি তোমার মুখটা কী হয়েছে।’
—‘মাসি আমাকে তিতি বলো। এই শাটারগুলো খোলা যায়?’
—‘কেন যাবে না? তবে খুব ধুলো।’
—‘আমি একটু এগুলো ফাঁক করব? ফাঁক করে করে দেখব? ভেঙে যাবে না তো?’
—‘না না ভাঙবে না, ও-সব খুব শক্ত।’
তিতি খড়খড়ি ফাঁক করে দেখতে লাগল, বন্ধ করে দেয়, আবার খোলে।’
অর্জুন এই সময়ে বলে ওঠে— ‘ওপরে চল, এক জানলা থেকে আরেক জানলায় ছুটে যাবার সুযোগ পাবি, তবে অপেরা-গ্লাস-টলাস কি বাইনোকুলার আমার কাছে নেই, আগে থেকেই বলে দিচ্ছি।
—‘কেন, অপেরা গ্লাস কী হবে?’
—‘না হলে চারুলতার ছবিটা ঠিক সম্পূর্ণ হচ্ছে না, হচ্ছে কি’
খড়খড়িগুলো তখনকার মতো বন্ধ করে দিয়েছিল তিতি। গম্ভীর মুখে বলেছিল— ‘তোর অনেক গুণ অর্জুন, কিন্তু এই এক দোষে সব নষ্ট।’
—‘গুণগুলোর কথা ভাল করে জানি না। বলছিস অনেক, তাই জিজ্ঞেস করছি না এখন, বড্ড সময় যাবে। কিন্তু একটা দোষ বলছিস, দোষটা কী জানতে পারি!’ অর্জুন হেসে জিজ্ঞাসা করে।
—‘সিনিসিজ্ম্। এক ঘড়ি গঙ্গাজলে এক ফোঁটা ইয়ে….।’
“ঘড়ি” নয় রে “ঘড়া” এক ফোঁটা ইয়ে নয় “চোনা”, চোনা মানে গরুর হিসি। খুব পবিত্র জিনিস।’
অর্জুনের মা ধমক দিয়ে উঠেছিলেন এই সময়ে— ‘আঃ কী হচ্ছে টুটুল!’
—‘ওহ জননী। তিতি কি তোমাদের সময়ের মেয়ে যে হিসি শুনলে মুচ্ছো যাবে? ওরা যে সব ইংরিজি স্ল্যাং জানে তা শুনলে আমি সুদ্ধু লাল হয়ে যেতে পারি। তা জানো?’
—‘আচ্ছা অনেক জ্ঞান দেখিয়েছিস তুই। তিতি আয় ওপরে, আগে মুখ ধুয়ে নিবি।’
যে মুহূর্তে ‘তিতি আয়’ বলে ডাকলেন অর্জুনের মা, সেই মুহূর্তে তিতি এক ছুটে গিয়ে তাঁর কোমর জড়িয়ে ধরল, ময়লা মুখটা তাঁর কাঁঠের ওপর রেখে ঘসতে লাগল। কে জানে কাঁদছে কি না!
অর্জুন বলল— ‘অবিকল কুকুরের মতো করছি।’
—‘বল— বলে যা, অপমানিত হচ্ছি না। ডগ্স্ আর নোব্ল অ্যানিমল্স।’
—‘আমি তো শুনেছিলাম ঘোড়া, ঘোড়াদের সম্পর্কে এটা বলা হয়ে থাকে, এক কবি তো ঘোড়া হবার প্রার্থনাই জানিয়েছেন।’
“মানবজীবন খোঁড়া করে প্রভু ঘোড়া করো ভগবান।
অবশ্য, ‘বেতো ঘোড়া নয়- ছ্যাকড়া টানিয়া আবার যাইবে প্রাণ। ”
—‘তোদের ঝগড়া থামাবি?’ অর্জুনের মা বললেন।
—‘তাহলে “তিতি আয়”-টা আবার বলো মাসি! তিতির সকাতর প্রার্থনা।
অর্জুনের মা আবারও বললেন অতএব,— হেসে— ‘আয় তিতি, মুখ ধুয়ে নিবি। আয়।’
এবার অর্জুনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মাসির সঙ্গে ওপরে উঠে গেল তিতি। ওপরে দুই কাকিমা ততক্ষণে গা ধুয়ে বেরিয়েছেন। সামান্য আগে-পরে বেরিয়ে এলেন দুজনে ঘর থেকে। মেজ কাকিমা, অর্জুনের মায়ের থেকেও কিছু বড়। সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ। খুব কেতাদুরস্ত। লম্বা মানুষ, সাদা কালো পাড় শাড়ি কুঁচি দিয়ে পরেছেন। কাঁধে রুপোর ব্রুচ। চুলটাকে তুলে একটা অদ্ভুত কায়দায় বাঁধা। ঠোঁটের ওপর একটা আঁচিল। তিনিই তাঁর টয়লেটে নিয়ে গেলেন তিতিকে। ছোটজও অর্জুনের মার থেকে সামান্য কয়েকমাসের ছোট। তিনি একটা নীল নক্শাপাড় টাঙ্গাইল শাড়ি কুঁচি দিয়ে পরেছিলেন। ইনিও ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে এসেছিলেন, বেশ ধনী ঘরের মেয়ে, অহঙ্কার আছে বনেদিয়ানার। বাপের বাড়ির লোকেদের প্রসঙ্গ উঠলেই ফুলে ফুলে ওঠেন। কিন্তু এ সবই বাহ্য। ভেতরে ভেতরে তিনজনেই করুণ বিধবা। অর্জুন বড় হতে হতে বিধায় পর্যবসিত হয়েছেন সবাই। ঠিক পর পর, স্ব স্ব স্বামীর বয়ঃক্রম অনুযায়ী। প্রথমে গেলেন অর্জুনের বাবা। নেফ্রাইটিস। তারপর অর্জুনের মেজ কাকা, ওই একই রোগ ধরা পড়ল। কিছু খেতে দেওয়া হত না। সব বারণ। মেজকাকা খ্যাংরা কাঠির মতো রোগা হয়ে গিয়েছিলেন। ঢলঢল করত কোট, প্যান্ট। তারপর একবার বেড়াতে গেলেন, মুসৌরি-দেরাদুন। মেজকাকি একা ফিরলেন। হয়ত কাকা কিছু অত্যাচার-অনিয়ম করে ফেলেছিলেন। হয়ত উপলব্ধি করেছিলেন এ ভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে একদিন জীবনটা ভোগ করে মরে যাওয়াও ভাল। অর্জুন জানে না। ছোটকাকা মেজকাকার বিয়ে হয়েছিল একই দিনে। মেজকাকা মারা যাবার পর ছোটকাকা নিজের থেকেই সাবধান হয়ে গেলেন। প্রোটিন খাওয়া কমিয়ে দিলেন। টাকা- পয়সা, সম্পত্তি সব গুছিয়ে বিলিব্যবস্থা করে বউদিকে, স্ত্রীকে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। অর্জুন যে বছর ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠল, ছোটকাকা তাকে বয়ঃপ্রাপ্ত পুত্রের মতো বোঝাতে লাগলেন শেয়ার, ডিবেঞ্চার, ফিক্সড্ ডিপজিট, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট, সেভিংস। নাইনে পড়তে পড়তেই ছোটকাকার রোগ ধরা পড়ল— নেফ্রাইটিস। তিনজনের নামে সব কিছু ট্রান্সফার করলেন ছোটকাকা। অনেকানেক সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেল। সে সব বোঝালেন অর্জুনকে। তারপর এক সকালে বেশি রোগা হবার আগেই মারা গেলেন।
‘তোদের বাড়িটা অদ্ভুত।’ শুনে করুণ, বিষণ্ণ স্বরে বলেছিল তিতি।
‘পৃথিবীটাই অদ্ভুত, জীবনটাও অদ্ভূত।’ এটা তোর মনে হয় না কখনও তিতি?
—‘অদ্ভুত? পৃথিবীটা? জীবনটা? কেন?’
—‘দ্যাখ সামগ্রিক ভাবে বোঝবার চেষ্টা কর। দেখবার চেষ্টা কর। কোনও কিছুর কোনও মানে নেই। মানুষ জন্মাচ্ছে, বড় হচ্ছে, কত কি তার জল্পনা-কল্পনা, কত আয়োজন, তারপরে মরে যাচ্ছে, আবার তার পরের প্রজন্ম, পরের প্রজন্ম। গাছ হচ্ছে, ফুল ফুটছে। ফল পাকছে, আবার গাছ, আবার ফুল আবার ফল।’
—‘এ তো তুই আউটলাইনটা দেখছিস। ভেতরটা মানুষ কী দিয়ে ভরাট করছে দ্যাখ, কত সাহিত্য, শিল্প, ইনডাস্ট্রি, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, চিন্তা দর্শন।
—‘তো কী? কী হল? সমস্ত কিছুরই যোগফল শূন্য।’
—‘শূন্য কেন হবে? শেষে মৃত্যু আছে বলে বলছিস? মৃত্যু যদি না থাকত তা হলেই কি জীবনটা অর্থময় হয়ে উঠত?’
—‘না, তা-ও নয়। বিজ্ঞানীরা যদি কোনওদিন মৃত্যুকে জয় করবার ফমুর্লাও আবিষ্কার করেন, যদি কৃত্রিম উপায়ে প্রাণের জন্ম দিতে পারেন, তবুও, তবুও সব শূন্য। তিতি পৃথিবীর সঙ্গে, পৃথিবী একটা কংক্রিট ব্যাপার, আর জীবন, জীবনটা একটা অ্যাবস্ট্রাকট জিনিস, এ দুটোর কোনওটাকেই আমরা নিয়ন্ত্রণও করতে পারি না, এদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগও স্থাপন করতে পারি না। কোনওদিন পারব। না। পাহাড়, পর্বত, নদী, জঙ্গল, এরা কেন, তার ভৌগোলিক, বৈজ্ঞানিক কারণটা নির্ণয় করতে পারি। কিন্তু এদের সঙ্গে কম্যুনিকেট করতে পারি না।’
—‘কী করে কম্যুনিকেট করবি? এগুলো তো জড়?’
—‘জড়? জড় কি না—তাও জানি না। জড় একটা কনসেপ্ট। সেই কনসেপ্টটা দিয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে তুই ভাব। জীবনের বা জড়ের ধারণাটা আমাদের একটা ধারণা। জাস্ট ধারণা। দীর্ঘদিন ধরে ভেবে এসেছি বলে তার বাইরে ভাবতে পারি না। কিন্তু যতদিন এই সমস্ত পাহাড় পর্বত নদী নালা জঙ্গল স্পেস, এই সবের সঙ্গে কম্যুনিকেট করতে না পারছি ততদিন শূন্যতা, ব্যর্থতাই আমাদের নিয়তি। যান্ত্রিক ভাবে বেঁচে যাচ্ছি, একটা প্রোগ্র্যামিং করা আছে। শরীরের মধ্যে, মনের মধ্যে, সেইটের নিয়ম অনুযায়ী। যতই কবিতা লিখি, আর ছবি আঁকি, আর আবিষ্কার করি। কোনও মানে নেই। মানে নেই কিচ্ছুর।’
তিতি বলল— ‘কী অদ্ভুত নেগেটিভ চিন্তা তোর! তুই কি কোনও ফিলসফির বই-টই পড়ে এভাবে ভাবতে শিখেছিস?’
‘না, না জীবনই এভাবে ভাবতে শিখিয়েছে আমাকে। সেই অ্যাবস্ট্রাক্ট সোর্স, জীবন। বিমূর্ত শক্তি। আমার বাবা আর কাকারাও এটা বুঝে গিয়েছিলেন, বিশেষত দুই কাকা। এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। বাবা অতটা বোঝাবার সময় পাননি। কিন্তু কাকাদের আগে ছিল এরকম অর্থহীন মৃত্যু, পেছনে ছিল অর্থহীন জীবন। ওঁরা বুঝেছিলেন। আমি মেজকাকার, ছোটকাকার মুখের ভাব এখনও দেখতে পাই। একদম ভাবলেশহীন পাথরের মুখের মতো। তৃষ্ণা নেই। বিতৃষ্ণা নেই। ভয় নেই, ভরসাও নেই। সবটাই শূন্য। সবটা একটা বিরাট ফাঁকি, বুঝেও সেই চেক, শেয়ার অ্যাকাউন্টস বুঝিয়ে যাওয়া সমানে আমাকে, মাকে, মেজকাকিমা, ছোটকাকিমাকে। সে যে কী অদ্ভুত গা-ছমছমে ব্যাপার, তুই, তোকে ঠিক বোঝাতে পারছি না।
“চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে?
কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?”
তিতি, কবিতাটা বললাম বটে, কিন্তু আমি ঠিক ব্যথিত বেদনের কথা যাতনার কথা বলতে চাইনি। বেদনা, যাতনা দিয়ে আমার অনুভূতি আমি বোঝাতে পারব না। আমি বোঝাতে চাই জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে যেমন একটা দুস্তর ফারাক, যে বুঝেছে আর যে বোঝেনি তাদের মধ্যে ওইরকমই দুস্তর পার্থক্য। শূন্যতার আশীবিষে দংশন করেছে আমাকে। যে শূন্যতা সমস্ত কিছুর বাইরে নিঃশব্দ ধৈর্যে অপেক্ষা করে আছে।’
তিতি বলল—‘মাসিরা? মাসিরাও কি এভাবে ভাবেন?’
‘—মাসিরা? কুন্তী, মাদ্রী আর গান্ধারী?’
—‘কেন এইসব মহাভারতের নামে মাসিদের ডাকছিস কেন?’
অর্জুন বলল— ‘এই যে আমি অর্জুন, অর্জুনের ওপরেই সমস্ত ভরসা ন্যস্ত করে সব কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করে যাচ্ছে। সব বিলুপ্ত। কোনওদিন ফিরবে না, বংশের সেই গৌরব সেই ধনসম্পদ সব ফিরিয়ে আনবে তাঁর অর্জুন, এই রকম একটা মানসিকতা লালন করে চলেছেন বলে জ্যেষ্ঠা মুখুজ্জে-গিন্নি কুন্তী। আর মেজকাকিকে কেন মাদ্রী ডাকি জানিস? আমার ধারণা মেজকাকিই মেজকাকার মৃতুর প্রত্যক্ষ কারণ।
—‘সে আবার কী?’
—‘হ্যাঁ, দা, হ্যাপলেস মার্ডারেস। তোর মনে আছে মেজকাকার মুসৌরি যাবার কথা বলেছিলাম!
—‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সেখান থেকেই তো আর ফিরলেন না।’
—আমরা সকলেই ভেবেছিলাম অত্যাচার-অনিয়ম। ঠিকই ভেবেছিলাম। কাকা এবং কাকিমার দুজনেরই হয়ত মনে হয়েছিল একদিনের জন্যে হলেও বেঁচে নিই। অত্যাচার-অনিয়মের প্রকৃতিটা কী হতে পারে বলে তোর মনে হয়? মেজকাকার মাঝরাত্তিরে হঠাৎ হার্ট ফেল করেছিল। প্রোটিনহীন ডায়েট। দিনের পর দিন সুদ্ধু দুধ-ভাত। দুধ ভাত, দুধ-ভাত খেতেন। কোনও শারীরিক উত্তেজনার বিদ্যুৎ সত্য করবার মতো ক্ষমতাই ছিল না মেজকাকার। মেজকাকি জানত। দুজনে প্ল্যান করেই গিয়েছিল। ফিরে এল ধবধবে সাদা থান পরে। ওখানেই শেষকৃত্য করে। জানত সব শেষ করতেই যাচ্ছে। কে জানে থানটাও হয়ত সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিল।’
তিতি শিউরে উঠে বলল— ‘কী বলছিস, চুপ কর অর্জাই?’
—‘না রে, হয়ত মেজকাকা-কাকি একটা সন্তানের জন্য শেষ চেষ্টা করেছিল মুসৌরী-পাহাড়ে। একটা নকুল বা সহদেব। কিংবা ভাগ্যে থাকলে উভয়েই। ভাগ্য হল না। মেজকাকাকে আমি বলি বীরপুরুষ, মেজকাকিকে বীরাঙ্গনা। দেখে, ভেবে বিস্ময় লাগে, বড় বিস্ময়।’
এই সব কথা হচ্ছিল অর্জুনদের বাগানে বসে। বাগানে বড় বড় গাছ। নীচেটা ঝোপে-ঝাড়ে ভর্তি, কাঠ পিঁপড়ে আছে, কাঠবেড়ালি আছে। মেঠো ইঁদুর-টিঁদুরও আছে। কোথাও কোনও শ্রী-ছাঁদ নেই। আর আছে বাঁধানো চত্বর। পাড়ে বেঞ্চ। বসলে গঙ্গা দেখা যায় অদূরে। এই সব কারণেই তিতির বাগানটা ভীষণ ভাল লেগেছে। এটা বাড়ির পেছনে। সামনে যেটুকু আছে সেখানে কিছুটা ঝাঁট পড়ে। ঘাস খুব বড় হয়ে গেলে বা লতার ঝাড় খুব ঝাঁপালো হয়ে গেলে লোক এনে কাটানো হয়। কিছু কিছু পুষ্পচর্চাও করেন মা-কাকিরা। কসমস, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা আছে। মাঝারি আকারের। গ্রীষ্মের ফুলগাছ আছে অনেক। কিন্তু পেছন দিকে সেই সব প্রাচীন গাছ-গাছালি যা হয়ত অর্জুনের প্রপিতামহ করে গিয়েছিলেন। সেই আদি বকুল, জামরুল, আম, ডালিম, বলরামচূড়া, সেই কলকে, দোলন চাঁপা। বাগানটার ওপর তিতির ঝোঁক দেখে অর্জুনের মা আবারও লজ্জিত হয়ে বললেন— ‘দ্যাখো না, অতখানি জায়গা—একটা মালি পাওয়া যায় না, কিছু না। বছরে একবার পুজোর আগে একটু পরিষ্কার করাই…।’
অর্জুন বলল— ‘মালি পাওয়া যায় না বলছ কেন মা। সোজাসুজি বলো রাখতে পারি না। অত আবার ঢাক-ঢাক কিসের?’
তিতি অর্জুনের কথায় কোনও কান না দিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল— ‘মাসি, বাগানটা কিছু কোরো না। প্লিজ এমনিই থাক। কেয়ারি-করা ফুলের বেড, গাদা গুচ্ছের সিজন-ফ্লাওয়ার, কৃত্রিম পুকুরে শালুক,…
—‘ওহ হরিব্ল্.. আমার দুচোখের বিষ।’
মাসি অবাক হয়ে বললেন— ‘অদ্ভুত মেয়ে তো তুমি। সাজানো বাগান তোমার ভাল লাগে না?’
—‘উহুঃ, সাজানো বাগান, সাজানো ঘর, সাজানো মানুষ, সাজানো জীবন সাজানো কিছু না কিছু না।’
—‘সাজানো জীবনও না?’ মাসি কেমন করুণ গলায় বললেন, বলে চলে গেলেন।
—‘মাসির মনে কি কষ্ট দিলাম?’ তিতি একটু অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করল। অর্জন বললেন— ‘নাঃ। মা তো সাজানো জীবন পেয়েছিল, চেয়েছিল। তাই। হয়ত খুব অবাক হয়ে গেছে।’
—‘কিন্তু আমি সত্যি বলছি রে অর্জাই আমার সাজানো কিছু, মানে প্ল্যান্ড্ জিনিস ভাল লাগে না। অসহ্য লাগে। এম. এ. পাশ করব। বিয়ে হবে। মাপামাপি দুটো ছেলে মেয়ে হবে। বছরে একবার কি দুবার বেড়াতে যাব। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে ভর্তির জন্য ছুটোছুটি করব, পড়তে বসাব, তারা বড় হবে… উঃ।’
—‘তোর এমন কেন হবে?’ অর্জুন বলল। ‘তোর এম.এ পর্যন্ত পড়তে ইচ্ছে না হলে পড়বি না। প্রিন্স-টিন্স জাতীয় লোকের সঙ্গে মহা ধুমধাম করে বিয়ে হবে। একটা বাচ্চা হবে, আরেকটা দেখে-শুনে অ্যাডপ্ট করবি। বছরে একবার কেন, একশোবার বেড়াতে যাবি, বাইরে, মানে সমুদ্র পার। …আর তোর ছেলে মেয়ের স্কুল? বি.বি. রায়ের নাতি-নাতনির খুব সম্ভব ইংল্যান্ডেই স্কুলিং হবে। তাদের ভেকেশনের সময় তুই একলা একলা উড়ে যাবি। তোর প্রিন্স-বর ব্যস্ত থাকবে তো?
—‘তারপর সিনিক দা গ্রেট?’ তিতি মুখে খুব তেতো হাসি ফুটিয়ে বলল। অর্জুন বলল— ‘তারপর আবার কী? চক্রবৎ ঘুরতে থাকবে সব। এক সময়ে ফুটে যাবি। প্রচুর মালা-ফালা দিয়ে নিমতলায় নিয়ে যাবে। তোর নাতিপুতি ঘটা করে শ্রাদ্ধ করতে করতে মনে মনে বলবে—‘বুড়ি অ্যাদ্দিনে কাটল।’
তিতি বলল—‘আজ্ঞে না।’
—‘কোনটা না?’
—‘কোনওটাই না। লাইফ হবে আনপ্রেডিকটেব্ল্। এইরকম ছকের জীবন তোর হোক, আমার নয়।’
—‘আমার ছক গোড়াতেই উল্টে গেছে। তো সে কথা থাক। তোর লাইফ কী রকম হবে? শুনি?’
—‘বললাম তো আনপ্রেডিকটেব্ল্। আগে থেকে কিছু বলা যাবে না। ধর আজ-কাল-পরশুর মধ্যেই একটা হলিডে-করতে আসা ফরাসি কি বেলজিয়াম কি নরওয়েজিয়ানের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। ধর মাস তিনেকের মধ্যে তাকে বিয়ে করে ফেললুম। তারপর চলে গেলুম তার সঙ্গে প্যারিস, কি ব্রাসেলস কি অসলো। লোকটা আসলে চিট, আন্ডার গ্র্যাজুয়েট লেভেলেই একটা বিয়ে করে রেখেছিল। একদিন সেই মেয়েটা এসে ধুন্ধুমার ঝগড়া করল। সাহেবটাকে ছেড়ে সেই মেয়েটার সঙ্গে বাস করতে লাগলুম…’
—‘থাম থাম, তুই একটা আস্ত পাগল। কোনও ম্যাচিওরিটিই হয়নি। বার্বারা কার্টল্যান্ড পড়ে পড়ে বড় হয়েছিস না কি?’
—‘বারবারা কার্টল্যান্ডে তো গরিব সুন্দরী মেয়েরা দারুণ জমকালো সব রাজপুত্তুর, কর্নেল-ফর্নেলের সঙ্গে প্রেম করে, তাদের অবস্থা ফিরে যায়।
—‘তাই বুঝি। আমি কখনও পড়ে দেখি নি। তা তুই কি উল্টোরকম চাইছিস?’
—‘না, ধর’ এখন তিতি উত্তেজিত হয়ে গেছে, ‘ধর। আমার বাবাই বিয়ে দিল। তারপর কয়েকদিন, কি মাস, কি বছর পরে বরটা দুম করে মরে গেল। কিংবা ধর বাচ্চাটা হারিয়ে গেল।…’
—‘ঠিক আছে, ঠিক আছে বুঝে নিয়েছি, আর বলতে হবে না’… অর্জুন বলল।
—‘কী বুঝলি?’
—‘বারবারা কার্টল্যান্ড নয়। তুই হিন্দি ফিলম্ দেখে বড় হয়েছিস। তোর বাচ্চাটা হারিয়ে গেলে কী হয়, অবিকল তোর বরের মতো দেখতে হবে। একদিন তোর বাড়িতে ডাকাতি করতে আসবে। দেখেই চিনতে পারবি “মেরা লাল, মেরা লাল” করে কেঁদে দুনিয়া ভাসিয়ে দিবি—এইরকম ডাবল রোল খুব চলে।
—‘ধুস—আমি হিন্দি ছবি দেখিই না।’ তিতি ঠেটি বেঁকিয়ে বলে।
—‘দিবারাত্র দেখাচ্ছে। তোর ঘরে বসে দেখতে পাচ্ছিস। দেখি না বললেই বিশ্বাস করব?’
—‘করিস না,’ তিতি বলল, ‘আসলে আমার কিছু ভাল লাগে না। সব কিছু এত একঘেয়ে, বিরক্তিকর। এমন নয় যে আমি সব সময়ে খুব উত্তেজনা চাইছি। একেবারেই না। কিন্তু আমার পরিচয় কী? চারপাশে যা যা ঘটে যাচ্ছে সেই রুটিন ঘটনা প্রবাহের মধ্যে আমার বিশেষ কী কাজ? আমি কেন? নাঃ আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না। … তিতি থেমে গেল। অর্জুন বলল,
—‘তা, তোরও তো আমারই মতো অবস্থা।’
—‘না। তোর মতো নয়।’ তিতি প্রতিবাদ করে উঠল, ‘তোর থেকে আমি কিছু গ্রহণ করতে পারি, কিন্তু আমার ভেতরে যে মৌলিক খিদেটা আছে সেটা অন্য, অন্যরকম।’
অর্জুন বলল—‘তাহলে আর কিছুই না, তুই একধরনের রোম্যান্টিক।’
—‘দ্যাখ অর্জাই। লেবেল সাঁটাটা বন্ধ কর। একটু আগেই বলছিলি না—জড় একটা কনসেপ্ট। ওইভাবে ভেবে আসছি, তাই ভাবি। যে একথা বলে সে আবার কোন মুখে লেবেল নিয়ে আঠা হাতে ঘোরে রে?’
‘ঠিক আছে। আঠা ফেলে দিচ্ছি। লেবেলগুলো এই কুচি কুচি করলাম। আমার আত্মখণ্ডনদোষ দেখিয়ে দেবার জন্যে ধন্যবাদ।’
ছোটকাকি নিজের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে ওদের ডাকলেন। ওরা উঠে পড়ল। চা খাবার সময় হয়েছে। খিড়কি দরজার কাছাকাছি এসে তিতি চুপি চুপি বলল— ‘একদম ভুলে গিয়েছিলাম। ছোটকাকিকে গান্ধারী বলিস কেন রে?’
অর্জুন হেসে ফেলে বলল— ‘বলি প্রধানত দুজন কুন্তী-মাদ্রী হলে একজনকে গান্ধারী হতেই হয় বলে। তবে কোথাও কোথাও গান্ধারীর সঙ্গে মিল আছে। নিজের চোখ দুটো যেন বেঁধে রেখেছে। ছোটকাকা যা-যা বলে দিয়েছে ঠিক তাই তাই করে যাচ্ছে। ছোটকাকা বলেছে পাড়-অলা শাড়ি পরবে, তাই পরে। ছোটকাকা বলে দিয়েছে মাছ খাবে, তাই মাছ খায়। ডিম-মাংস খায় না। ছোটকাকা বলে গেছে… নিজের অংশ অর্জুনকে লিখে দেবে। তো তাই দিয়ে রেখেছে। ছোটকাকার নির্দেশের অর্থ যে বৈধব্যের নিয়ম কানুন পালন না করা, সেটা কাকি বুঝতে পারেনি।’
—‘কিন্তু গান্ধারী তো এ রকম ছিলেন না। খুব ব্যক্তিত্বশালিনী ছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে দুর্যোধনকে খুব বকা-ঝকা করতেন! কৃষ্ণকে শাপ দিয়েছিলেন।’
—‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমার গান্ধারী তেমন নয়। কিন্তু ব্যক্তিত্ব আছে। সেটাকে ছোটকাকার ব্যক্তিত্বের তলায় ইচ্ছাকৃতভাবে চাপা দিয়ে রেখেছে। ওইটুকুতেই কাকীর গান্ধারীত্ব। বেশ কিছুদিন বাস করলেই টের পাবি।
এখন তিতি দু নম্বর বাসের দোতলায় উঠছে। উঠছে বেশ মেপে মেপে। দৌড়ঝাঁপ করে নয়। অর্জুনও সুতরাং পেরে যাচ্ছে তার পেছন পেছন উঠতে। অর্জুনের ঘড়িতে এখন প্রায় আড়াইটে। দু নম্বরের দোতলা প্রায় ফাঁকাই। সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বসল তিতি। পাশে অৰ্জুন বসে পড়ল। কেউই কিছু বলছে না। কিছুক্ষণ পর অর্জুন আর থাকতে পারল না। বলল—‘বিজনেস ম্যাগনেটের মেয়ে যে কেন সরকারি বাসে চড়ে কলকেতা দেখতে যায় বুঝি না।’
তিতি কিছু বলল না।
—‘বিজনেস ম্যাগনেট নিজে, অথবা তাঁর সমাজসেবিনী স্ত্রী, অথবা তাঁদের সাহেব যুবরাজ যদি দেখে ফেলেন মেম রাজকুমারী গরিব-গুরবো আত্মীয়র ছেলের সঙ্গে এক সিটে বসে সাত পায়েরও বেশি চলে যাচ্ছে, তবে কী হবে?’
তিতি তখনও কিছু বলছে না।
অর্জুন বলল—‘বি. বি. রায় অবশ্য চিনতেই পারবেন না আত্মীয় বলে। শুধু দরিদ্র কুমার বলে উদ্বিগ্ন হবেন। আর সমাজসেবিনী তনুদেবী? তিনিও…তিনি চিনেও চিনবেন না। যেমন সাধারণত করে থাকেন। যেমন করাটা কেতা! আর প্রিন্স যুবরাজ!’
এ সব কথা অর্জুন প্রায়ই তিতিকে বলে। বি. বি. রায় তার বাবা যে আত্মীয় স্বজনদের কারও সঙ্গে মেলামেশা করেন না। কারুর জন্য কিছু করেন না। কনিষ্ঠ অঙ্গুলিটিও নাড়েন না কারও জন্য, এ কথা অৰ্জুন আগেও বলেছে। অর্জুনের বাবা যখন মারা গেলেন বি. বি. রায়-তনুশ্রী রায়ের নামে একটা অতিকায় সাদা পদ্মের রীদ এসেছিল। শ্রাদ্ধের দিনও এঁরা কেউ আসতে পারেননি। আর তার বাবার অসুখের খবর শুনে দীর্ঘদিন পরে তনুশ্রী রায় যে ‘গেট-ওয়েল’ কার্ডটা পাঠিয়েছিলেন, সেটা শ্রাদ্ধের দিনই এসে পৌঁছেছিল। তার দাদা যে কলকাতায় যাচ্ছেতাই সব জয়েন্টে যায়, এই বয়সেই সর্বক্ষণ ট্যাঁকে মেয়ে নিয়ে ঘোরে, তাদের কিছু কিছু যে অন্তত ভাড়া-করা বান্ধবী এ কথাও তিতি অর্জুনের কাছ থেকে শুনেছে। শুনেছে মুখ নিচু করে, কখনও প্রতিবাদ করেনি, কারুর সাফাই গাইবার চেষ্টা করেনি। এমনকি মায়ের পুরুষ-বন্ধু নিয়ে ঘোরার ব্যাপারটাও অর্জুন তাকে তার স্বভাবসুলভ ব্যঙ্গের সঙ্গে শুনিয়েছে। তিতি শুধু মায়ের ব্যাপারেই একবার মাত্র বলেছিল—‘নব্বুইয়ের কলকাতায় বসে পুরুষদের সঙ্গে মেলা-মেশা বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করছিস না কি?’
উত্তরে অর্জুন বলেছিল—‘দূর আমি অতটা অনাধুনিক না। তবে মিসেস রায় আবার বন্ধুদের বুকের ওপর ঘুমিয়ে পড়েন কিনা। আমি আবার মিউজিক কনফারেন্সে নিয়মিত যাবার নেশাটা করে ফেলেছি। তাই এ সব দৃশ্য দেখতে হয়।’
তিতি আর কিছু বলেনি।
অর্জুন আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। তিতি হঠাৎ মৃদুস্বরে বলে উঠল—‘আমি কিন্তু তোমাকে ঠিক ডাকিনি অর্জুন!’
—‘তা হলে গোপা কেমিস্ট্রি ল্যাবের সামনে গিয়ে আওয়াজ মারছিল কেন?’
—‘আমার নির্দেশে নয়। তবে আমার একটা ক্ষীণ ধারণা হয়েছিল, একজন বন্ধুর সঙ্গ এই সময়ে আমার ভাল লাগবে। সহানুভূতি চাইছি না, কিন্তু সমালোচনাও চাইছি না। ভাল লাগছে না। তুমি নেমে যেতে পারো অর্জুন।’
তিতি জিতে গেছে আজকে। অর্জুন একেবারে বোল্ড। ইয়র্কার ছিল বুঝতে পারেনি। সমানে ঝাঁটা টেনে যাচ্ছিল। টেনে যাচ্ছিল। এমন সময়ে ইয়র্কার। কিন্তু বোল্ড হয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল অর্জুন। —‘তিতি, কী হয়েছে রে?’
—‘বি. বি. রায় আজ সাতদিন হল নিরুদ্দেশ। চিঠি নেই। পত্র নেই। কোথাও কোনও হদিশ নেই। শেষ রাত্তিরে দুটো সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। দাদার ধারণা ওতে বহু টাকা ছিল, কোনও অ্যান্টি-সোশ্যাল গ্রুপ চেয়েছিল। টাকাটাও নিয়েছে, বাবাকেও…।’ তিতি ঘাড়টা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।