Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বৃত্তের বাইরে || Bani Basu » Page 5

বৃত্তের বাইরে || Bani Basu

ঝিমঝিম ঝিমঝিম করে সন্ধ্যা নামার শব্দ হয়। ধোঁয়ার সঙ্গে অন্ধকার মিশিয়ে সিমেন্টের বড় বড় বস্তায় ভরে কেউ অনেক উঁচুর আকাশ থেকে ফেলছে। থলির পেছনের কোণ দুটো ধরে উল্টে দিচ্ছে। উড়ছে ধোঁয়া এবং অন্ধকার আকাশময়। নামছে অলিতে-গলিতে। এই শীতকালীন সন্ধ্যারও আবার কত রকমফের আছে। সল্ট লেকের সন্ধ্যা আর আহিরিটোলার সন্ধ্যা, সাদার্ন অ্যাভেন্যু-এর সন্ধ্যা আর বাঁধাঘাটের সন্ধ্যা যেমন এক নয়, তেমন চিলেকোঠার সন্ধ্যায় আর একতলার সন্ধ্যায় তফাত আছে। দশতলা বারোতলায় যে সন্ধ্যা দেখা যায়, দেড়তলার বাসিন্দা কখনওই সে সন্ধ্যা দেখতে পারে না। অঞ্চলভেদে, উচ্চতাভেদে প্রকৃতির দয়া-দাক্ষিণ্য ভাগ হয়ে গেছে।

আহিরিটোলার চিলেকোঠার সন্ধ্যায় নলিনী করের তক্তাপোশের পাশে একমাত্র টিনের চেয়ারে বসে হরিহর আনীত চায়ের সঙ্গে বড় বড় বেগুনি খাচ্ছেন বিজু রায়। এমন সময় বাঁদিকের বাড়ির ছাদ থেকে খুব সরু বাচ্চা-গলার ডাক শুনতে পেলেন,—‘দাদু, দাদু! অ দাদু!’

কে কাকে ডাকছে, বুঝতে পারলেন না বিজু। তবু একবার বেরিয়ে এলেন। বাঁদিকের বহু পুরনো বাড়িটা গায়ে গায়ে লাগা। পাঁচিলের ফোকরে পা দিয়ে একটা ছোট্ট মুখ ঝুঁকে আছে পাঁচিলের ওপর থেকে। বিজু এগিয়ে গেলেন। —‘কে তুমি? কাকে ডাকছ?’

—‘তুমি কে?’

—‘আমি…আমি…’ বিজু রায় ভেবে পেলেন না তাঁর কোন পরিচয়টা এই বাচ্চাটির কাছে গ্রাহ্য হবে। আজ গুড্ডু এসেছিল তার দাদিকে দেখতে। রত্নার নির্দেশে গুড্ডু তাঁকে দাদু বলে ডেকেছিল। এইটুকু বাচ্চাদের জগতে কারও নাম বলে কিছু থাকে না বোধহয়। খালি সম্পর্কবাচক শব্দ দিয়ে পরিচয় তৈরি হয়। মা বাবা, মাসি, মামা, পিসি, কাকা, দাদু, দিদা, এইরকম। এই জগতের পরিচয়পত্রে বিজনবিহারী রায় বা নলিনীকান্ত কর এসব চলবে না। তিনি বললেন—‘আমি দাদু।’

—‘আমার দাদু কোথায় গেল?’ বিজু বুঝতে পারছিলেন বাচ্চা মেয়েটি কার কথা বলছে, কাকে চাইছে। তবু তিনি জিজ্ঞেস করলেন—‘কোন দাদু?’

—‘ওই তো টঙের দাদু! লালচুলের দাদু! রোগা দাদু! ফর্সা দাদু!’

যাক অনেক রকম বর্ণনা পাওয়া গেল। বাসস্থান, চেহারা…মেয়েটি তখনও বলছে চকলেটের দাদু…। বাঃ আদান-প্রদানের বস্তু দিয়ে সম্পর্ক নির্ণয় হচ্ছে। বিজু রায় বাচ্চাদের কোনও দিন ভাল করে দেখেননি। বাচ্চাদের আদর-টাদর করা, তাদের সঙ্গে আধো-আধো কথা বলা এসব কোনও দিনই তাঁর অভ্যেস নেই। তাঁর এই বাচ্চাটির সঙ্গে কথা বলতে বাধো বাধো লাগছে। বাৎসল্য-রসে ভরা হাসি, আদিখ্যেতার নানা শব্দ তাঁর আসছে না। তিনি বললেন—‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে?’

—‘বীর চাঁদে।’

—‘বীর চাঁদ? সে কোন জায়গা?’

—‘বীর চাঁদ জানো না? আমার মামার বাড়ি। চিলড্রেন্স পার্ক আছে। বড় বড় রাস্তা আছে। দিদাই আছে।’

বীর চাঁদ নামে কোনও টাউনের কথা বিজু মনে করতে পারলেন না। যাই হোক, জায়গাটায় বাচ্চাটির মামার বাড়ি। কদিন সে সেখানে ছিল। সম্ভবত তাই-ই টঙদাদুর মহাযাত্রার কথা জানে না। তিনি বললেন—‘তোমার টঙদাদুও মামার বাড়ি গেছে নিশ্চয়ই।’

খুক খুক করে হাসল মেয়েটি, বলল—‘অত বড়দের আবার মামার বাড়ি থাকে নাকি?’

—‘কেন থাকবে না? বাঃ।’

—‘বারে! তাদের মামারা, মামিরা, দিদাইরা ভীষণ বুড়ো হয়ে যাবে না?’

—‘হোক না। ভীষণ বুড়ো হলেও তো তারা মামা-ই, মামি-ই, দিদাই-ই নাকি?’

—‘তুমি বুঝতে পারছ না। ভীষণ, ভীষণ বুড়ো, তার চেয়েও বুড়ো, তার চেয়েও বুড়ো।’

তখন বিজু রায় বুঝতে পারলেন বাচ্চা মেয়েটি এইভাবেই মৃত্যুকে বুঝেছে।

—‘কথা বলছ না কেন? আমি মামার বাড়ি থেকে এলেই টঙদাদু চকলেট দেয়।’

—‘তাই? আচ্ছা, এদিকে আসবে?’ বিজু হাত বাড়িয়ে দিলেন। একটু চেষ্টার পর তাকে নিজেদের ছাদে আনতে সমর্থ হলেন। ছোট্ট মুখ। চোখ দুটো একটু বসা, বড় বড়। কচি নাক আর ঠোঁটি, কচিপাতার মতো নরম শামলা রং। একটা নানা রঙের পশম দিয়ে বোনা, পুরোহাতা সোয়েটার পরে আছে সে। পায়ে ফুলমোজা এবং বকলস লাগানো জুতো। শীতের বিরুদ্ধে লড়াইটা দরকার জেনে তার মা তাকে ভালভাবেই অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাজিয়েছে। হাতে একটা টুপি।

—‘তুমি টুপিটা পরোনি?’

—‘আমার টুপি পরতে বিচ্ছিরি লাগে।’

—‘ও। এসো টঙে এসো।’

—ঘুরে ঢুকে সে বলল—‘এ মা! তুমি ভাল চাদরটা পেতে রেখেছ কেন? ওটা তো সাইমন কিংবা রফিককাকু এলে দাদু পাতে?’

—‘কে সাইমন? রফিককাকু কে?’

—‘ওমা, সাইমনকে চেনো না? রফিককাকুকে চেনো না! ওরা যে টঙদাদুর জন্যে টাকা আনে! না হলে দাদু আমাকে চকলেট কিনে দেবে কী করে?’

বিছানায় বসে মেয়েটি বললে—‘তুমি টঙদাদুর কে হও গো?’

—‘ভাই।’

—‘ধ্যাঃ।’ টঙদাদু বলত, ‘আমার ভাই নেই, বোন নেই, মা নেই, বাবা নেই, বউ নেই, ছেলে নেই, মেয়ে নেই। এসব কোনও দিন ছিল না। একদিন ভীষণ বিষ্টি হচ্ছিল পুজোর সময়ে, ভীষণ বাজ পড়ছিল, তখন পৃথিবীটা ফাঁক হয়ে গেল আর আমি বেরিয়ে এলুম।’

—‘এই কথা বলত বুঝি!’

—‘হ্যাঁ বলত। সত্যি কথা, বলবে না?’

—‘আমি তাহলে ভাইয়ের মতো। ধরো বন্ধু।’

—‘তাই বলো।’ খুব নিশ্চিন্ত হয়ে বলল খুকুটি। তারপরে বলল—‘আমার চকলেট দাও?’ সে ডান হাতটা পেতে আছে। পেছন ঘসটে এক পা মাটিতে রেখেছে। শরীরটা এখনও তক্তাপোশের ওপরেই।

বিজনবিহারীর হঠাৎ মনে হল জীবন ওই বাচ্চা খুকুটির মতো। অমনি ভাবে হাত পেতে আছে। চোখে অবোধ বাসনা। যতক্ষণ তুমি আছ তোমাকে ওর হাতে মিষ্টান্ন দিয়ে যেতে হবে। তিনি বললেন, ‘তুমি বোসো, আমি কিনে আনছি।’

—‘দূর তুমি কিছু জানো না, ওই তো টেবিলের টানাটায় থাকে। খোলো না?’

বিজনবিহারী চেয়ারে বসেছিলেন, তাঁর পেছনে টেবিল, তিনি ড্রয়ারটা টেনে খুলে ফেললেন। খুকু ছুটে এল। ড্রয়ারের মধ্যে ম্যাগনিফাইং গ্লাস একটা, কিছু সিগারেটের প্যাকেট, লাল রিবন, গোলাপি রঙের ক্লিপ, নাইলন পুতুল একটা আর বেশ কিছু টফি।

—‘ওই তো আমার ফিতে, আমার ক্লিপ, ওই তো আমার পুতুল,’ ড্রয়ারটা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুকু বলল, ‘কই চকলেট দাও! ওই তো!’

টফিগুলো তুলে খুকুর হাতে দিলেন বিজু। এগুলোকেই ও চকলেট বলছে। এগুলো কি সেই দাঁতের সঙ্গে আটকে যাওয়াগুলো! তিনি বললেন—‘সবগুলো যেন একসঙ্গে খেয়ো না। আর খেয়ে ভাল করে মুখ ধোবে, দাঁত ঘসে ঘসে ধোবে, নয়ত দাঁতে পোকা লাগবে, ভীষণ ব্যথা করবে কিন্তু।’

একটা টফি মুখে ফেলে খুকু বলল—‘ আমার দাঁতে পোকা আছে তো! আমি বুরুশ দিয়ে দাঁত মাজি তো! শীতকালে রাত্তিরে যে মা মুখ ধুতে বারণ করে।’

—‘তোমার দাঁতে পোকা আছে? যন্ত্রণা হয় না?’

—‘হয় না আবার! মা বলেছে এ দাঁতগুলো পড়ে যাবে, তখন আর হবে না।’

বিজু বললেন, ‘নাও, তোমার লাল রিবন, ক্লিপ তোমার পুতুল, সব নাও।’

—‘এখন কি নিউ ইয়ার? এখন কি আমার জন্মদিন? যে নোব!’

—‘তাই বুঝি? তোমার জন্মদিন কবে?’

—‘সে তো আঠারই ডিসেম্বর। সেইদিন আমি পুতুলটা পাব তো। টঙদাদু বলেছে।’

—‘আর রিবন-ক্লিপ?’

—‘ওগুলো তো ফাস্ট জানুয়ারি নিউ ইয়ারে পরবো।’

—‘টঙদাদু যদি তখনও না ফেরে? তুমি এখনই বরং নিয়ে যাও।’

—‘ন্‌ না। আমার জন্মদিনে টঙদাদু নেমন্তন্ন আসবেই। কেউ তো দাদুকে পায়েস খেতে দেয় না। আমার মা লাল পায়েস করবে, দাদু আসবেই। আচ্ছা আমি যাই, না আসি বলতে হয়; আসি টঙদাদুর বন্ধু। মা ভাববে ভীষণ।’

—‘চলো তোমায় দিয়ে আসি।’ বিজু রায় পাঁচিলের কাছে গিয়ে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর একটু হাত বাড়িয়ে পাশের পাঁচিলে দাঁড় করিয়ে ধরে রইলেন, মেয়েটি ধুপ করে লাফিয়ে পড়ল ওদিকে।’

—‘তোমার নামটা কী? নাম বললে না তো?’

—‘আমার নাম কুমারী মণিদীপিকা রজক দাস, বলে ছোট্ট দেহ আর মস্ত নামের ভার বইতে বইতে খুকুটি ছুট লাগাল।

ঘরে ফিরে এসে বিজু দেখলেন ড্রয়ারটা তখনও খোলা। রিবন ক্লিপ এবং পুতুল দেখা যাচ্ছে। নলিনী কর নিশ্চয়ই কিছুদিন আগে এগুলো সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। আশ্চর্য মণিদীপিকা জানে এসব তারই, তবু একটা জিনিসও ছুঁল না। সময়, লগ্ন। সে তার ওইটুকু মন দিয়ে লগ্নের গুরুত্ব বুঝতে পারে। দরিদ্রের মেয়ে, দেখলেই বোঝা যায়। এইরকম বয়সে হয়ত ছুটকিরও এরকমই চেহারা ছিল!

ছুটকি! ছুটকি কোথায়। এমন ফেরে পড়েছেন, যে চিঠিগুলো তন্ন তন্ন করে পড়বারও সময় পাচ্ছেন না। তবে ছুটকি যে বেঁচে আছে, ভাল আছে, স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে সুখী এটাও অনেক। সে তো হারিয়েই গিয়েছিল। জীবনের কোনওখানে আর তার কোনও স্মৃতি ছিল না, চিহ্ন ছিল না। হঠাৎই শূন্য থেকে রসগোল্লা পড়বার মত ছুটকি নেই থেকে আছে হয়ে গেল। বিজু কী করে তাকে হারিয়ে থাকতে দেবেন। অনেক যে বয়স হয়ে গেল! বয়সটা যে অনেক হয়েছে এ কথা তাঁর একবারও মনে হয়নি, মনে হত না। এন কে বা নলিনী কর তাঁকে মনে করিয়ে দিয়ে গেল। ফিফটি নাইন রানিং, বলেছিল। তখনই বুঝতে পেরেছিলেন লোকটি তাঁর বয়সী। আজ খুকুটি যা বলল তার মধ্যে থেকে ‘পুজোর সময়ে ভীষণ বিষ্টি পড়ছিল, বাজ পড়ছিল।’ কথাগুলো তাঁর কানে আটকে আছে। মা বলত ‘বাপ রে, পুজোর সময়ে সে কী বিষ্টি! পাড়ার ঠাকুর জল পড়ে গলে গেল। সে এক কাণ্ড। অমন তাণ্ডবের মধ্যে জন্মেছিলি, তুই দস্যি হবি না তো হবে কে?’

নলিনী করও ওই পুজোর সময়েই জন্মেছিল। কোন দিনে? জানবার আর বোধহয় উপায় নেই। কিন্তু দু-একদিনের এদিকে ওদিকে আর কী-ই বা আসে যায়। তিনি নলিনী করের একেবারে একবয়সী, যতই নলিনী তাঁকে ‘তুমি তো ভায়া পঁয়তাল্লিশের এদিকে হবে তো ওদিকে হবে না’ বলুক। বয়স জিনিসটাও কত আপেক্ষিক! তিনি চূড়ান্ত সুখে আছেন। নিয়মে আছেন। বিধিদত্ত কাঠামোটাও নিশ্চয় ছিল, সবচেয়ে বড় কথা কাজের মধ্যে আছেন। নিশ্চিদ্র কাজের মধ্য দিয়ে একটা দিন কোথা দিয়ে পার হয়ে গিয়ে আরেকটা দিন শুরু হয়, তিনি বুঝতেই পারেন না। হয়ত তাই। তাই-ই তিনি পঁয়তাল্লিশের এদিকে তবু ওদিকে হবেন না। নলিনীর জীবনে ভাঙা-গড়ার খেলা খেলেছে কেউ নির্মমভাবে, সে নিয়মের ধার ধারেনি। এখন কর্মহীন। দুপুরবেলায় কী করতে বেরোত কে জানে! ওই সাইমন আর রফিকের কাছে? এরা কে? যাই হোক, নলিনীতে জীবনটা আটান্নতেই শেষ হয়ে এসেছিল। তাই স্রেফ সিগারেট ধরিয়ে কাশতে কাশতে জীবনটা গলার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্যের কথা নলিনীও তাঁরই মতো বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। জাহাজের খালাসি হওয়া আর জাহাজ কেনা সে আক্ষরিক অর্থে বলেছে না আলঙ্কারিক অর্থে, জানা যাবে না। কিন্তু খুব নিচু অবস্থা থেকে দারুণ পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে সে খুব ধনী হয়েছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাঁর নিজের জীবনের সঙ্গে অদ্ভুত মিল। তারপর কোন লগ্ন, কোন ক্ষণের তফাতের ফলে বাকিটা তফাত হয়ে গেল কে জানে! বিজু রায়, জ্যোতিষ-ট্যোতিষ মানেন না। অথচ এভাবেই ভাবলেন। ভাবলেন—হঠাৎ সিগারেট ধরিয়ে কাশতে কাশতে কত সহজে তাঁর সমবয়সী মানুষটির প্রাণ বেরিয়ে গেল, আগের দিনও মেঝেতে আসন পেতে মুরগির কালিয়া খেলেন কবজি ডুবিয়ে, বিজু রায়ের পাশে বসে। মৃত্যু এইভাবে যখন-তখন জানান না দিয়ে আসতেই পারে। সেই বয়স হয়েছে বিজু রায়ের। নলিনীর ভেতর দিয়ে মৃত্যু যেন এই কথাটাই তাঁকে জানিয়ে দিয়ে গেল। এবং মৃত্যু খুব কাছেই বসে দু চোখ মেলে তোমাকে দেখছে জানলে—হঠাৎ সমস্ত কেমন দূরে সরে যায়! সব সম্পর্ক, সব অর্জন, সব নিমার্ণ। না, সব নয়। একমাত্র ছুটকি দূরে সরে না। ছুটকির সঙ্গে সাক্ষাৎ এখনও জীবনের মস্ত বড় আরব্ধ কর্ম। বাকি রয়ে গেছে।

আপাতত এই নলিনী কর নামে লোকটিকেও তাঁর খুব জানতে ইচ্ছে করছে। যেন একই সালে, একই মাসে জন্মের দরুন শুধু তাঁর সমবয়সীই নয়, আরও ঘনিষ্ঠ কিছু, তাঁর নিজেরই আরেকটা চেহারা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে। ওকে যত জানবেন, নিজেকেও তত জানা হবে। রাতে হরিহর তাঁর রুটি তরকারি নিয়ে এলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—‘আচ্ছা হরিহর, করবাবুর কাছে কেউ আসত না?’

—‘তেমন কেউ না।’

—‘তেমন কেউ মানে?’

—‘এই ধরুন, আপনার মতন, আসতেই করবাবু মিল বলে দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে জলখাবার।’

—‘কিন্তু কেউ না কেউ তো আসত।’

—‘শুনুন বাবু, করবাবু এমনিতে খুব ভাল লোক ছিলেন। কিন্তু…কিন্তু…’

—‘কিন্তু কী?’

—‘মরা মানুষের নামে বলব? পাপ হবে না তো?’

—‘কিছু হবে না, তুমি বলো।’ বিজু রায় কখনও এই ধরনের লোকেদের সঙ্গে এরকম অন্তরঙ্গভাবে কথা বলেননি। বদন, প্রমীলা, তাঁর দারোয়ান বিরজু বা তার বাবা বীরখা। একমাত্র ড্রাইভার সমর দিবারাত্র তাঁকে নিয়ে এখান-ওখান যাতায়াত করত বলে তার সঙ্গে অনেক প্রকার কথা বলতে বাধ্য হতেন তিনি। একমাত্র ওই সমরই।

হরিহর বলল—‘করবাবু বড্ড জুয়া খেলতেন। অনেক রকম। সে সব তো আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছ থেকে মাঝে মাঝেই টাকা ধার করতেন।’

—‘শোধ করেছিলেন?’

—‘সব শোধ করে দিতেন, কাউকে বলবেন না বাবু, তবে শেষেরটা আর পারেননি, খাস দফতরের পরোয়ানা এসে গেল কি না!’

বিজু রায় চমৎকৃত হলেন। এই মেসের চাকর লোকটি যে প্রায় সব সময়েই ঝলঝলে ইজেরের ওপর একটি গামছা পরে থাকে সে জুয়োখেলাকে পাপ মনে করছে? যখন সারা কলকাতা, সারা ভারত, সারা বিশ্ব জুয়ো খেলে যাচ্ছে। স্বয়ং সরকারবাহাদুর লটারির খেলা বার করেছেন সেই কবে থেকে! সরকারও জুয়ো খেলছে! দ্বিতীয় কথা ওই খাস দফতরের পরোয়ানা। এরকম লাগসই শব্দ কেমন অনায়াসে ব্যবহার করে ফেলল হরিহর! পরোয়ানাটা শোনা যায়। ‘মৃত্যুর পরোয়ানা’—এ জাতীয় শব্দ যেন পড়েছেন কোথাও। কিন্তু ‘খাস দফতর?’ হয় এটা হরিহরের সম্পূর্ণ মৌলিক উদ্‌ভাবন। না হলে কোনও জায়গা থেকে সংগ্রহ। শুনেছে একবার, মনে রেখেছে। তাকেও প্রায় মৌলিকই বলা যায়। শব্দ বা শব্দবন্ধ আর কজন বানায়! সবাইই তো শোনে। শুনে শুনেই মনে রাখে! তিনি বললেন—‘শেষেরটা কত?’

—‘পাঁচ হাজার।’

—‘অ্যাঁ? চমকে উঠলেন বিজু রায়। মেসের চাকর হরিহর অবলীলায় পাঁচ হাজার টাকা ধার দিতে পারে? সেটা মার খেয়ে গেলে তার কোনও হাহাকার পর্যন্ত থাকে না? তিনি বদনকে পাঁচশো টাকা মাইনে দেন, পুজোয় দেড় হাজার টাকা বোনাস। এ লোকটি কত মাইনে পায়? লোকের মাইনের কথা জিজ্ঞাসা করা অভব্যতা। তবু, উপায় নেই, তিনি জিজ্ঞেস করলেন—‘এখানে তোমাকে কী রকম দেয়-টেয়?’

‘আজ্ঞে, ইনকিমেন্টো হয়ে হয়ে এখন তিনশো দশ হয়েছে। বাবুরা বলেছেন সাড়ে তিনশোয় শেষ। কেল রিচ করে যাব। আপনি অত টাকা ধার দিয়েচি বলে জিজ্ঞেস করছেন? আজ্ঞে বাবু আমি গরিব মানুষ আমার চলে কী করে বলুন, আমি আজ্ঞে টাকাটা খাটাই। সুদ নিই টেন পার্সেন্ট।’

—‘তাই? কাদের কাছে খাটাও?’

—‘সে অনেক আছে, এখানকার বাবুরাও দরকারে অদরকারে হরিহরের কাছেই হাত পাতেন।’

—‘ও। করবাবুর টাকাটা কি সুদসুদ্ধ বললে?’

হরিহর জিভ কেটে বলল— ‘না বাবু, তাই কখনও পারি? ওঁর কাছ থেকে আমি এক পয়সা সুদ নিতুম না আজ্ঞে। বাবুর তো কোনও চাকরি-বাকরি, বাঁধা আয় ছিল না। জ্ঞানত কখনও পাপ করিনি বাবু।

—‘তা এখন যে টাকাটা মারা গেল!’

—‘কী করব বাবু, ভাগ্য। সবই ভাগ্য। মেনে নিতে হচ্ছে।’

—‘সাইমন বা রফিক বলে কাউকে চেনো? এখানে আসত।’

হরিহরের মুখে একটা ভয়ের ভাব খেলে গেল। সে বলল ‘আপনি কী করে জানলেন বাবু!’

—‘বলোই না।’

—‘বাবু কাউকে বলবেন না। করবাবু বলতে বারণ করে দিয়েছিলেন। একটা বেঁটে মতো ফিরিঙ্গি আসত বটে। কালো, সাহেব বলে কেউ বুঝবে না। বাজে লোক। আর রফিক, সুবিধের নয়। দেখলে ভয় লাগে। ইয়া চেহারা। করবাবু বোধহয় ওর কাছেও…। মাঝে মাঝে আমার কাছে প্যাকেট রেখে যেত করবাবু না থাকলে।’

—‘কখন আসত?’

—‘কখন? মেসের বাবুরা ঘুমিয়ে পড়লে। ঠাকুররা ছুটি নিয়ে চলে গেলে। আমি খুলে দিতুম। শনিবার সন্ধেতে মেস খালি। শনিবার সন্ধেয় কি রোববার সকালেও আসত অনেক সময়ে।’

—‘আচ্ছা শোনো, এরা কেউ এলে, বলবে না করবাবু মারা গেছেন, আমি থাকলে সোজা ওপরে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে। বুঝেছ?’

হরিহর বড় করে ঘাড় নাড়ল।

কেন এটা করলেন বিজু রায় জানেন না। কে সাইমন কে-ই বা রফিক, তাদের সঙ্গে নলিনী করের কী সম্পর্ক। তাঁর এ সবের মধ্যে ঢোকবার কী আছে! ভেবে করেননি। তেমনি না ভেবেই আজকে তিনি করবাবুর ট্রাঙ্কটা টেনে বার করলেন— চৌকির তলা থেকে। দু-তিন খানা ধুতি, চারটে পাঞ্জাবি, তার মধ্যে একটা সেই গরম ফ্লানেলের যেটা পরে তিনি নলিনীকে প্রথম দেখেছিলেন। কয়েকটা রুমাল। সেই জামেয়ার শালখানা। একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটের মধ্যে দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম। ভাল তোয়ালে দুটো। এ ছাড়াও একটা চৌখুপি নক্সা-কাটা খাদির বেড কভার, সাদা চাদর, বালিশের ওয়াড়। বেড কভার টা তুলে ভাল করে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে তার ভেতর থেকে ঠক করে একটা ছোট নোট বুক পড়ল। খুব পুরনো। মণিময়রা বলছিল— এঁর কোনও আত্মীয় স্বজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। কিন্তু নোট বুকটাতে তিনি দেখলেন তিন, চারটে ফোন নম্বর ও ঠিকানা রয়েছে। এগুলো কি ওরা দেখেছে? জিজ্ঞেস করতে হবে। তারপর একটা পাতায় লেখা— ‘ওপনিং-এর খেলায় দুয়া চৌয়া পঞ্জা লাকি নং। ক্লোজের খেলায় দিনের পর দিন এক্কা দুয়া নওকা। পাত্তি টু পাত্তি চান্স নিতে হবে একবার। জিতলে পঞ্চাশ। হারলে পাঁচ, কুছ পরোয়া নেই। জীবন-জুয়ায় অমৃত বা বিষ যা উঠল তা আমার। লক্ষ্মী যদি ওঠে তো সে দাদু পাবে।’

ঠিক সাড়ে নটায় চিত্তরঞ্জনে পৌঁছে গেলেন বিজন। তিনি ঢাকবার পাঁচ মিনিট পরেই এল রত্না। এ মেয়েটি যে কেন এখনও এরকম নিয়মিত যাওয়া-আসা করছে তিনি জানেন না। শমিত বা শাঁটুল যার সঙ্গে সম্পর্কের ফলে এর সঙ্গে দিদির সম্পর্ক, সে তো ফেরার, এবং দিদি কাটান-ছাড়ান-এর কথাও উল্লেখ করেছিল। মেয়েটি তাঁকেও খুব রুক্ষভাবে তাঁর কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে, মুক্তি চেয়েছিল। মেয়েটিকে তিনি মুক্তি দিয়েছেন। ও তবুও আসছে।

দিদিকে ও. টি তে নিয়ে গেল। যাবার সময়ে বিজন সাহস দেবার চেষ্টা করলেন, দিদি কিছুই বলল না। শুধু দু ফোঁটা জল শুকনো গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। রত্না নিচু হয়ে কিছু বলল দিদির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে।

দুজনে বসে আছেন। রত্না হঠাৎ মৃদুস্বরে বলল—‘মামাবাবু ও ফিরে এসেছে।’

বিজন অন্যমনস্ক হয়ে ছিলেন। চমকে উঠে বললেন—‘কী বলছ?’

—‘ও, মানে আপনার ভাঞ্জা ফিরে এসেছে।’

—‘ফিরেছে? কোথায়?’

—‘এখনও বাড়িতে আসেনি। আমার সঙ্গে দেখা করেছে।’

বিজন অপেক্ষা করছেন।

রত্না বলল— ‘কাল রাতে আমি ও বাড়ি সব সাফা করে এসেছি। আজ রাত হলে ও পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে ভিতরে শুতে পারবে।’

বিজন অপেক্ষা করছেন।

—‘ও বলছে বাড়িটা বিক্রি করে আমরা যদি অন্য কোথাও চলে যাই।’

বিজন বললেন—‘কিন্তু ওর নামে শুনেছি ওয়ারেন্ট আছে। যেখানেই যাক ও ফেরারি আসামি।’

—‘আপনি যদি বাড়িটা বিক্রির ভার নেন।’

—‘আমি তো তোমায় বললাম ও যেখানেই যাক ফেরারি আসামিই থাকবে।’

—‘আচ্ছা ও যদি ওই টাকাটা দিয়ে দেয়।’

—‘কী টাকা? কাকে?’

—‘মা আপনাকে কিছু বলেনি?’

—‘পরিষ্কার করে বলো কী বলতে চাইছ।

—‘যাদের ভেজাল সিমেন্ট সাপ্লাই করেছিল, সাত আটটা পার্টি, তাদের যদি কমপেনসেশন দিয়ে দেয়!’

—‘কত টাকার?’

—‘আমার ঠিক জানা নেই, তবে লাখখানেক তো হবেই!’

—‘এত টাকা কোথা থেকে দেবে?’

রত্না ইতস্তত করতে লাগল, কিছুক্ষণ পর বলল — ‘আপনি যদি টাকাটা অ্যাডভান্স করেন।’

বিজন মনে মনে বললেন— ও আমি লাখ বা ততোধিক টাকা অ্যাডভান্স করব, আমি বাড়িটা বিক্রি করিয়ে দেব। ও অন্যত্র গিয়ে থাকবে। ভাল।

মুখে বললেন— ‘সুখচরের বাড়ি কার নামে?’

—‘সেটাই তো মুশকিল। এখনকার কানুন তো মেয়েদেরও ভাগ দেয়, আমার দুই ননদের ভাগ আছে, মার ভাগ আছে, ওরও আছে। এই সময়ে যদি ওটা বিক্রি করে দেওয়া যেত! ছ-সাত লাখ টাকা তো নিশ্চয়ই হবে। আপনার টাকাটা আমরা শোধ দিয়ে দিতাম!’

বিজন বললেন— ‘কিছু মনে কোরো না রত্না, শমিত যাকে তুমি বিয়ে করেছ, বাঁকা পথে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না দেখছি। এ মতলবটা নিশ্চয় ওরই। বর্ন চিট। তুমি যদি ঠিক করে থাক ওকে ডিভোর্স করবে। তবে করতে পার।’

—‘ও বলছিল আপনি বিজনেসম্যান আপনি ব্যাপারটা বুঝবেন, হ্যান্ডল্‌ করতেও পারবেন।’

তখন বিজন বুঝলেন বিজনেসম্যানের সংজ্ঞা অন্ততপক্ষে শমিতদের কাছেও কী দাঁড়িয়েছে। শমিত, তাঁর ভাগনে তাঁকে ঠগ-ই মনে করে। একজন সফল ঠগ। তাই-ই সে প্রস্তাবটা সময়-সুযোগ বুঝে তাঁর কাছে পেশ করেছে। ব্যাপারটা তাঁকে ভাবাল। কতটা ঠগ তিনি? কিছুটা তো নিশ্চয়ই! কিন্তু কতটা? রত্না মুখ নিচু করে বলল— ‘মামাবাবু, আমি ওকে ডাইভোর্স করতেই পারি। আমার কোনও অসুবিধে হবে না। আমার পিতাজি আমাকে আলাদা সম্পত্তি লিখে দেবে। গুড্ডুও ভাল ভাবে মানুষ হবে। যে লোক সাচ্চা নয়, তাকে নিয়ে এমনি ভেসে পড়বার মুশকিল আছে আমি জানি। কিন্তু আমি ওকে ছেড়ে দিলে ও একদম তলায়, নীচে ঔর ভী নীচে চলে যাবে। এখন, আমার পিতাজি এ সাদি দিতে চাননি। আমার শাস ভী না। ও-ও তখন পিছু হটছিল। আমি জিদ্দি আছি। আমিই জোর করে এটা করেছি। এখন যদি ও গাড্ডায় পড়েছে বলে ভেগে যাই আমার সাচ্চাই কোথায় থাকবে? নিজেকে, আমার নিজের অন্দরে যে ভগোয়ান আছে তাকেই বা কী জবাব দেব?’

বিজন মন দিয়ে শুনছিলেন মেয়েটির কথা। তাঁর ভাগনে-বউ। এ কদিনে জেনেছেন ও মাত্রই স্কুল ফাইন্যাল পাশ। হায়ার সেকেন্ডারিতে আটকে গিয়েছিল। শমিত নাকি ওকে পড়াত। কী যে পড়াত ভগবান জানেন। বি. কম ফেল করেছে দুবার। হঠাৎ যেন বিজন ইলেকট্রিকের শক খেলেন। তিনিও বি. কম ফেল করেছিলেন। তিনি গ্র্যাজুয়েট নন। তৃতীয়বার পরীক্ষায় বসবার ভয়েও বটে, ছুটকি চলে যাওয়ার পরের গভীর অন্ধকার সইতে না পেরেও বটে তিনি পালিয়েছিলেন। বাবা ছুটকির নাম মুখে আনতেন না। মা! মাও কি খড়গহস্ত হয়েছিল। মায়ের ওরকম বিভীষণ চেহারা আর কখনও দেখেন নি বিজু। ওর নাম কেউ আমার সামনে উচ্চারণ করবে না, ভুলে যাও, ওকে তোমরা ভুলে…। গর্ভধারিণী মায়ের চেয়ে সন্তানকে কেউ বেশি ভালবাসে? সেই মা যখন ভূলে যায়, ভোলবার ম্যানডেট জারি করে, তখন অন্য কে আর…। তবে মা সন্তানকে সবচেয়ে ভালবাসে এটা একটা ধারণা। ছুটকি যা করেছিল তা, বা তার চেয়েও বেশি কত কত লোকে করছে আজ। জল-ভাত হয়ে গেছে। অন্তত তাঁদের সোসাইটিতে। কে জানে বিত্তবানের সমাজে হয়ত বরাবরই মূল্যবোধ আলাদা ছিল। শর্মাজির বর্তমান স্ত্রী রেণুকা শর্মা তাঁর আট বছরের মেয়েকে ছেড়ে চলে এসেছিলেন। সে মেয়ের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে বলেও তিনি জানেন না। কাজেই মা সন্তানকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসবেই— এটা একটা ধারণা। সংস্কার। মা ছুটকিকে চিঠিতে কী লিখেছিল, বড় দেখতে ইচ্ছে করছে। গর্ভধারিণীত্ব শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিল। কিন্তু শেষ জীবনে, একেবারে শেষে। তাঁর মনে পড়ল সে সময়ে তিনি ছুটকির জন্য ভীষণ গুমরোতেন। কাউকে বুঝতে দিতেন না। বাইরে যেমন হাসি খুশি, চঞ্চল ইয়ার্কিবাজ তেমনই। কিন্তু গঙ্গার ঘাটে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন। বাইরের হাওয়াটা যেমন হু হু করত, ভেতরটাও তেমনি হু হু করত। যেন বুকের ভেতরটা শূন্য মাঠ একটা। খাঁ খাঁ মাঠ। বাতাস বয়ে যাচ্ছে সেই মাঠের ওপর দিয়ে। শূন্য, শূন্য। জীবনের সামান্য সেই লেখাপড়া তা-ও শেষ করতে পারলেন না। পারল না বিজু। বিজনেস অর্গানাইজেশন, কম্পানি ল, ইনকাম-ট্যাক্স, অডিটিং অঙ্ক কিচ্ছু মাথায় ঢুকত না। সমস্ত ডেবিট ক্রেডিট, জার্নাল লেজার ফোলিও, অ্যাডভান্সড অ্যাকাউন্টেন্সির সমস্ত থিয়োরি, ফর্মুলা, ইকোয়েশনের ওপরে ছুটকির মুখ ভেসে উঠত, ছুটকির ঈষৎ ঢেউ-খেলানো মাঝ-পিঠ-ছাপানো বানে ফেঁপে ওঠা গঙ্গার মতো চুল। ছুটকির চোখ, গাঢ বাদামি, দুষ্টু দুষ্টু আবার ভাবুক বড় বড় পল্লবওলা। ছুটকির ছোট্ট তীক্ষ্ণ নাক। ভীষণ মিষ্টি ঠোঁট ছুটকির। তার শ্যামলা রঙের গালে সোনার মাকড়ির ছায়া। ডুরে শাড়ি, সরু সরু ছোট ছোট আঙুল। পারল না বিজু। বি. কমটা পাস করতে পারল না। অথচ সেই বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনই এখন করছে! তখন অদ্ভুত এক অপারগত্ব। ভীষণ সময়! কোনও স্থির লক্ষ্য সামনে নেই। ভয়াল বাস্তব উদ্যত হয়ে রয়েছে। নতুন কিছু নেই। কেউ নেই। অথচ পুরনো প্রিয়কে, ঘনিষ্ঠকে হারানো। কী ভয়াবহ সময় গেছে বিজুর জীবনে। শ্মশান ধারের সেই বাড়ির ছাদে সমস্ত কথা, তা যত গোপনই হোক, ছুটকির সঙ্গে। ছুটকি এক বন্ধু আর নিতাইদা আর এক। নিতাইদা অনেক অশ্লীল কথা বলত। অশ্লীল কথা উচ্চারণে তখন কেমন একটা মজা পাওয়া যেত। যেন চুরমুর খাওয়া, মুচমুচে সব শব্দ। আবার ইংরিজিও জোগাড় করে আনত, বলত ‘ফাক’ ‘ফাক’ মানে জানিস? জানিস না? মানেটা বুঝিয়ে দিত, দুজনে মিলে হাসত খুব খানিকটা, তারপর বলত ‘কক’ মানে কী বল তো’ ‘কেন মোরগ’ বিজুর জবাব। নিতাইদার হাসি চমৎকার ভাবে বেড়ে যেত। তারপর মানে টানে সব শেষ করে বলত ‘এই খবর্দার। এ সব যেন তোর ওই ছুটকি না ছোড়দিকে বলবি না। তুই তো আবার তোর ছোড়দির সামনে ন্যাংটোও হতে পারিস।’ এটা নিতাইদার বাড়াবাড়ি। কিন্তু সত্যিই নিজের অনেক গোপন অভিজ্ঞতার কথা বিজু ছুটকিকে বলত, কিন্তু ছুটকি কি কিছু বলত? বিজুকে? কিচ্ছু না। নেহাত বাধ্য না হলে না। কিন্তু ভান করত যেন সব বলছে। সবচেয়ে গুরুতর কথাটাই তো একদম চেপে গিয়েছিল। কেউ বিশ্বাস করেনি। ছুটকির প্রাপ্য প্রহারটা বাবার কাছ থেকে দাদাদের কাছ থেকে তাকেই খেতে হয়েছে। — ‘জানিস সব, বলছিস না।’ শেষকালে মা এসে মাঝখানে দাঁড়াল, ‘অতবড় ছেলেকে চোরের ঠ্যাঙানি দিচ্ছ সবাই মিলে কি জন্যে? ও তো বলছে জানে না। আর জেনেও যদি এত মার খেয়েও হজম করে থাকতে পারে। থাকতে দাও।’ ছুটকি তাকে বলেনি, ভাই তো! ওইটুকু দিদিগিরি। কিংবা ভাইয়ের কাছে নিজের আব্রু রক্ষা। ছুটকি চলে যাওয়ার পর অনেক ভেবে সে এটাই বুঝেছে।

রত্না বলল ‘মামাবাবু, আপনি তো কিছু বললেন না।’

বিজন দেখলেন ডাকাবুকো মেয়েটির চোখ ছলছল করছে। তিনি বললেন ‘শমিত কিছু জানে না। কিস্যুই জানে না। আয়্যাম সরি বউমা। আমাকে একটু ভাবতে দাও। আগে দিদির এ ব্যাপারটা চুকে যাক। এখন অন্য কিছু মাথায় নেই।’ বললেন বটে, কিন্তু বলেই বুঝলেন এক দিক থেকে দেখতে গেলে এই যুবক-যুবতীদের, যাদের এখনও অনেক দিন বাঁচতে হবে, একটি শিশুকে মানুষ করে তুলতে হবে, তাদের সমস্যা অনেক গুরুতর, দিদি তো মেরে এনেছে। তিনিও। হয়ত তিনিও।

ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। বিজন এগিয়ে যাচ্ছেন। উনিই প্রধান সার্জন, ভেতরে পুরো একটা টীম। বললেন—‘সরি, মিঃ রায়, গোটা লিভার, সপ্লিন, ইনটেসটাইন সর্বত্র স্প্রেড় করে গেছে। কিছু করার নেই। আমরা হাত দিইনি। ওপন করে দেখেই আবার সেলাই করে দিয়েছি।’

—‘এখন, তাহলে?’

—‘অপেক্ষা পাঁচ ঘন্টাও হতে পারে, পাঁচ দিনও হতে পারে, আবার পাঁচ মাসও।’

—‘কিন্তু পেইন? ওই অমানুষিক পেইন সহ্য করতে হবে যে কটা দিন বাঁচবে?’

—‘কেমোথেরাপি করতে পারেন। কিছু লাভ হবে না মিঃ রায়, শুধু গুচ্ছের সাইড এফেক্ট। লেট হার গো ইন পীস।’

—‘পীস?’ বিজু রায় তিক্ত কণ্ঠে বললেন।

—‘ওই হল।’ ডাক্তার মুখ নিচু করে ধীর পদক্ষেপে করিডর বেয়ে চলে গেলেন। অভিজ্ঞ। বয়স্ক মানুষ। অনেক দেখেছেন, যন্ত্রণা, মৃত্যু। তবু যখন এভাবে হেরে যান, প্রতি পদক্ষেপে গভীর হতাশা, ক্লান্তি, দুর্মর একটা অভিমান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রত্না এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল ‘কী হল মামাবাবু?’

—‘কোনও আশা নেই বউমা!’

রত্না হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তারপর জোর করে নিজেকে সামলে নিল। আরও কিছুক্ষণ পর ও.টির দরজা খুলে গেল— দিদি বেরিয়ে আসছে, সাদা চাদরে ঢাকা। মুখটা নীল। বিকেলের দিকে জ্ঞান হবার দুতিন ঘণ্টা পরেই মারা গেল দিদি। ঘোর-লাগা দৃষ্টিতে চারদিকে দেখল, ঘোর-ঘোর গলায় ডাকল— ‘বিজু!’ বিজু রে!’ তারপর চুপ হয়ে গেল।

বিজু সারাদিন ফেরেননি আর। রত্নাও না। কাছাকাছি দোকান থেকে দুপুরে খেয়ে নিয়ে ম্যাটিনিতে একটা ফিল্‌ম্‌ দেখে দুজনে সময় কাটিয়েছিলেন। ভিজিটিং আওয়ার হতে না হতেই হাজির। তা শেষ পর্যন্ত ওই হল। জ্ঞান ফিরল, তারপর চিরকালের মতো চলে গেল। মাঝখান থেকে বিজু অবাক হয়ে রইলেন। দেখা নেই, শোনা নেই, সম্পর্ক নেই, আজ পঁয়ত্রিশ বছরেরও অধিক হল। শুধু শেষ কটা দিন। তবু জীবনের শেষ আলো আঁধারির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিদি ঘড়ঘড়ে গলায় বিজুকেই ডাকল? তবে কি দীর্ঘ জীবনের দীর্ঘ অদর্শনের মধ্যেও দিদির ছোট ভাইয়ের জন্য একটা করুণ আকুলতা ছিল! সেই বিরহবোধই কি তবে দিদির জীবনের শেষতম কথা! আশ্চর্য! তিনি কি দিদির শেষ-কৃত্য করবার জন্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন? না। না। শুধু দিদি তো নয়। আরেক জনেরও। সম্পূর্ণ অচেনা একটি সমবয়সী-লোকেরও। সে লোকটিও যেন দিদিরই মতন তাঁর হাতের আগুনের জন্য অপেক্ষা করে ছিল।

রত্না তখন কাঁদতে কাঁদতে বলছিল বিয়েতে অমত করলেও পরে মা তাকে কত ভালবাসত। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কী অসামান্য সেবা করেছে। গুড্ডুকে হাতে করে মানুষ করেছে। কিন্তু বিজু রায় অর্ধেক শুনছিলেন। অর্ধেক শুনছিলেন না। অর্ধেক মন দিয়ে ভাবছিলেন, ভাল ভাল। কৃতজ্ঞতা ভাল। বড় বিরল প্রজাতির মানবিক গুণ। ভালবাসা নয়! শুধু অন্তত এইটুকু ছলছলে কৃতজ্ঞতা। আর মনের অপরার্ধ দিয়ে তিনি ভাবছিলেন— এ কি কাকতালীয়? এই সব দেখা-শোনা মৃত্যু এ সব কি দৈবাৎ ঘটে? দৈবাৎ ঘটল? নাকি….. সময়। লগ্ন, সঠিক লগ্নেরই একটা সঠিক টান আছে? ঠিকঠাক সব ঘটিয়ে দেয়! মণিদীপিকার জন্মদিনে লাল পায়েস আর নাইলন ডলের মতো! একদিন আগেও নয়। একদিন পরেও নয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress