বৃত্তের বাইরে (Britter Baire) : 01
শেয়ার-বাজারে লাখ তিন চার ডুবে গেল। ক বছর ধরেই তেজী চলছিল বাজার। দালাল প্রকাশ দেওরা যেমন যেমন বলেছে তেমন তেমনই করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন বিজু রায়। তিনি নিজে শেয়ারের পাতাটা খেলার পাতার মতোই একবার উল্টে দেখেন মাত্র। দেওরা শেয়ারের ঘুণ, এমন ভুলটা কী করে করল বিজু রায়ের মাথায় আসে না। মুখ দেখাচ্ছে না লজ্জায়। রক্ষা এই যে আরও যায়নি। কেব্ল ম্যানুফ্যাকচারিং-এর বিরাট বিজনেস তাঁর মূলত। টেন্ডার ধরতে, সরকারি বেসরকারি এক্সপার্টদের তুষ্ট করতে, লেবারকে মুঠোর ভেতর রাখতে মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা হচ্ছে ইদানীং। ইলেকট্রিকাল ইলেকট্রনিক জিনিসপত্রের এজেন্সিও আছে অনেকদিনের। ইচ্ছে আছে একটু বাজার দেখেশুনে ইলেকট্রনিক্স্-এও ম্যানুফ্যাকচারিং-এ নেমে পড়বেন। অরোরা, শেঠ, বসাক এরা তো হাজারটা বিজনেস করছে। স্বনামে, বেনামে। তিনিই বা নামবেন না কেন? তিনটে পলিটিক্যাল পার্টিকে বছর বছর মোটা চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন, যার যেমন ওজন তার তেমন। তো সেখানেও তো আজকাল মেলা ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। ভুঁইফোঁড় কিছু মস্তান, পলিটিক্যাল ক্রেডেনশিয়াল্স্ আছে কি নেই, হুটহাট করে তোলা চাইতে শুরু করেছে। আইচকে তিনদিন ফোন করে পাচ্ছেন না। মিনিস্টারের সঙ্গে আইচের ওঠাবসা। তার মাধ্যমেই এসব ঝামেলাগুলো তিনি মেটান। হাতে চাবির রিং লুফতে লুফতে চোখ গরম দেখিয়ে যাবে তাঁকে, এ জিনিস তিনি বরদাস্ত করতে পারবেন না।
লাল রঙের টেলিফোনটার দিকে হাত বাড়িয়েছেন, আইচকে যত শিগগির সম্ভব কনট্যাক্ট করা দরকার, উমেশ রক্ষিত ঢুকল। এর সামনে আইচের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। অথচ এ আসাতে তিনি টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন এটাও একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। উমেশ রক্ষিভের কৌতুহল বাড়বে, নিজেকে খামোখা খুব কেউকেটাও ভাবতে শুরু করতে পারে। অতএব তিনি একটা বানানো নম্বর টিপে গেলেন চোখ বুজে। সুখের বিষয় ওদিকে ‘দিস নাম্বার নো লংগার এগজিসটস’ বাজতে লাগল। ঠাস করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন বিজু রায়। মুখে দারুণ বিরক্তির কুঞ্চন।
‘বসুন।’
—‘পেলেন না নম্বরটা?’
—‘নাঃ। আজ আবার কী মনে করে? পেমেন্ট তো হয়ে গেছে!’
—‘পেমেন্টের জন্যে কি আমার ঘুম হচ্ছিল না রায়সাহেব? আরে বাবা, মাল আপনার গুদোমে পৌঁছে দিয়েছি। আবার কী? আমি ঘুমোলেও আপনার পেমেন্ট সময়মতো পৌঁছে যাবে। আসলে একটা ভাল জিনিস পেলুম…’
উমেশ রক্ষিত ছোট ব্যবসাদার। ওর কাছ থেকে কিছু পার্টস নেওয়া হয় তাঁর কারখানাতে। নিতেই হবে তার কোনও মানে নেই। উমেশ, রমেশ, দিনেশ, ধীরেশ এদের মধ্যে এসব ছোটখাটো ব্যাপারে কোনও তফাত করবার দরকার হয় না। ফেভার, জাস্ট ফেভার। তবে তোষামোদে ভুলে নয়। তোষামুদিগুলো ওর বড্ডই মোটা দাগের। আপনার মতো উদার, সচ্চরিত্র বাঙালি-ব্যবসাদার দেখা যায় না। কীভাবে হাল ধরে রেখেছেন! ছবির মতো কারখানা। এ সব দেখে শেখবার ইত্যাদি ইত্যাদি, কোনও দিনই এই ঘ্যানঘেনে কথাগুলো ভাল লাগে না বিজু রায়ের। ওকে অর্ডারগুলো দেন স্রেফ ওর পরিবারের সাইজের কথা মনে করে। নিজের চারটি। বড় ভাই অকালে গেছে। তার পুরো ফ্যামিলি ওর ঘাড়ে। বুড়ো বাবা মা এরা তো আছেই।
উমেশ ঝোলার থেকে একটা প্যাকেট বার করল। ভেতরে অনেক কিছু ঠেসেটুসে জিনিসটাকে চৌকো আকার দেবার চেষ্টা হয়েছে। তা সত্ত্বেও বোতলের গড়ানে গোলালো দিকটা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে।
গলোগলো হয়ে উমেশ রক্ষিত বলল—‘আমার এক শালা ফ্রান্সে থাকে, সে-ই..মাঝে মাঝে…খুব ভাল…’
দুম করে বিজু রায় বললেন, ‘কজন শালা আপনার রক্ষিতবাবু?’ যখনই কিছু উপহার দেবে, শালার নাম করবে উমেশ রক্ষিত। বিজু রায়ের প্রশ্নে থতমত খেয়ে বলল, ‘তি তিন। তিনজন নিজের শালা আমার।’
—‘সব্বাই-ই বাইরে থাকে?’
—‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সেট্লড্।’ ভেতরের সন্তোষে গর্বে রক্ষিত ফুলে ওঠে। শালাদের ইন্ডিয়ার বাইরে থিতু হওয়ার চেয়ে বড় গৌরব যেন আর নেই।
—‘তাহলে “খেতে বসল জামাই শালা” এ সৌভাগ্য আপনার বড় একটা হয়, কী বলুন?’ বিজু রায় বলেন।
—‘হাঃ হা, তা যা বলেছেন। তা যা বলেছেন। ওদিকেও যেমন জামাইষষ্ঠীর পাট নেই, এদিকেও তেমনি নো ভাইফোঁটা।’ রসিকতাটাতে যোগ দিতে পেরে রক্ষিতের মুখ উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে।
—‘তা যদি বলেন মশাই। তিন তিনখানা এন আর আই আপনার হেপাজতে। বাজেট দেখেছেন তো? এন আর আই মানেই জামাই। দিন না সব কটাকে বিজনেসে নামিয়ে। দেশের মাটিতে কিছু ডলার স্টার্লিং ঢালুক। অর্ডারগুলোও সব আপনিই ধরে নেবেন। বি বি রায়কে আর গিফট দেবার দরকার হবে না।’
শুনতে শুনতে ভীষণ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে রক্ষিত। ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে এমনি ভাব। কতক্ষণে সামলে ওঠে মৃদু কৌতূহল নিয়ে দেখতে থাকেন বিজু রায়। শিগগিরই সামলে উঠবে। কোনও সন্দেহ নেই। একটু আচমকা হয়ে গেছে ধাক্কাটা!
—‘আপনি আজ আসুন। সময় হাতে বড্ড কম।’ এ ফাইল ও ফাইল টেনে বিজু রায় অতিরিক্ত ব্যস্ততার ভানটুকু চমৎকার ফোটালেন।
—‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। খেজুরে গল্প করবার সময় আছে নাকি আপনার?’ উমেশ শশব্যস্তে উঠে তাঁকে নমস্কার করে কেমন পেছু হটতে হটতে বেরিয়ে গেল। যেন যতক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় রায়সাহেবকে চোখের আড়াল করতে চায় না। বিজু রায়ের হাসি পেল। তিনি তা হলে এতদিনে নবাব-বাদশা শ্রেণীর হতে পেরেছেন। নবাব-টবাবদের এইভাবে তসলিম জানাতে হয় না? পেছন ফেরা যায় না তাদের সামনে। উমেশ রক্ষিতটা আসলে পুরনোকালের সাম্পল। প্রথম তিনি যে সময়ে ব্যবসায় নেমেছেন সেই তখনকার, তখন এই সব চাল-চলন চালু ছিল। এখন যুগ পাল্টে গেছে। এখন আসছে স্মার্ট ছোকরা-ছুকরির দল। গটগট করে আসে, ফুটফাট ইয়াংকি ইংরিজি কি হিন্দি বলে, আসে প্রার্থী হয়ে। কিন্তু ভাবখানা যেন উদ্ধার করে দিতে এসেছে। প্রত্যেকেই যেন বলতে চায়, আরে আমার মতো একটা খানদানি, এ-ক্লাস, সেন্ট পার্সেন্ট কমপিটেন্ট সাপ্লায়ারকে ওবলাইজ করবে না? ইজ দ্যাট পসিবল বস? এরা নিজেদের প্রোডাক্টের খুঁটিনাটি জানে। শুনিয়ে তবে ছাড়ে। ব্যবসার জগতে এরা নতুন ক্লাস। মূলধন জামাকাপড়ের বাহার, কায়দা, আর আজকালকার ভাষায় ‘এনথু।’
উমেশ রক্ষিত বেরিয়ে গেলে ফাইলগুলো ঠেলে সরিয়ে দিলেন বিজু রায়। রক্ষিত-দত্ত পার্সেলটা টেবিলের এক কোণে বিরাজ করছে। সেটা নিজের ব্রিফকেসের মধ্যে চালান করলেন। একটু পরে সত্যিই তাঁকে বেরোতে হবে। ঘুসুড়ির দিকে একখানা হাই-রাইজ তুলছেন। খুব ঝামেলা পাকিয়েছে সেখানে চোর্পোরেশন। লোহার রডের মাপ নাকি ঠিক হয়নি। আরও কী কী সব গলতি রয়েছে। তিনি যখন প্ল্যান সাংশন পেয়েছিলেন তখন জি-প্লাস এইটের পান। তো এখন বলছে জি-প্লাস ফোরের বেশি করতে দেবে না। বিরানব্বই-এর আইন উননব্বইয়ের প্ল্যানের ওপর খাটবে কি না এখনও তিনি ঠিক জানেন না। সুখেন্দু তাঁর লিগ্যাল অ্যাডভাইজার, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে দুটো তলা তাঁর কমপ্লিট। দোতলায় লোক এসে যাচ্ছে এক মাসের মধ্যে। হঠাৎ ইনসপেকশন। ইনসপেকশন করে বলে গেছে বাড়ি নাকি ভেঙে দিতেও পারে। ভেঙে দেবে না আরও কিছু। আসলে নোলা বেড়েছে। কিন্তু কেমন রোখ চেপে গেছে বিজু রায়ের। পরিষ্কার দলিল, জমির মালিকের সঙ্গে কোনও অবনিবনা নেই, তৎসত্ত্বেও আগের কাউন্সিলারকে খাওয়াতে হয়েছে। এবার ভোটে জিতে নতুন কাউন্সিলার এসেছিস, তোকেও খাওয়াতে হবে? কভ্ভি নহি। দে বাড়ি ভেঙে, কত মুরোদ দেখি। দুঁদে মারোয়াড়ি সব মালিক আছে। এখনই অন্তত চারটে। কোটিপতি লোক। তাদের হিন্ট দিয়ে রেখেছেন বিজু রায়। বলেছে, দেখ লেঙ্গে শালে কো। তবু একবার আজ সাইটে যাবেন ঠিক করেছেন। লোহার রডে কনট্র্যাক্টর যদি সত্যি চারশো বিশ না করে থাকে, সিমেন্টে যদি গঙ্গামাটি পাইল না করে থাকে তো ওই চোর্পোরেশনকে তিনি খাওয়াবেন ঠিকই। তবে ঘোল। ঘোল খাইয়ে ছাড়বেন। আর কন্ট্র্যাক্টর যদি সত্যি গোলমাল করে থাকে তাহলে তাকে তো ফায়ার করবেনই, ড্যামেজ আদায় করবেন গলায় গামছা দিয়ে। এর পর সে খায় কী করে তাও দেখবেন বিজু রায়। এখন, কোর্ট কাছারি যদি করতেই হয় তো আটঘাট বেঁধে এগোতে হবে। সিভল এঞ্জিনিয়ার জয়দীপ চাটুজ্জেকে নিয়ে যাচ্ছেন আজ। চারতলার ছাদ ঢালাই হবার কথা আজকেই। সিমেন্ট, বালি, লোহা, চিপস, সব দেখাবেন। বদনামি বরদাস্ত করবেন না বিজু রায়। যাবার পথে ওর নেতাজী সুভাষ রোডের অফিস থেকে জয়দীপ চাটুজ্জেকে তুলে নেবেন এমন কথা আছে। একটু আগে ফোনে কনফার্ম করে নিয়েছেন।
কীরকম একটা তেতো মুখ, তেতো মনে অফিস থেকে বেরোলেন বিজু রায়। দু ধারে ফলের পসরার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে চলেছে গাড়ি। বাজারের শ্রেষ্ঠ কমলালেবু, মুসাম্বি, আপেল, আঙুর, আনারস, ডালিম সাজানো দু দিকে। বিজু রায় লোহা, লক্কড়, নাট, বল্টু, যন্ত্রপাতি ছাড়া কিছুই বড় একটা দেখতে পান না। অর্জুনের এই গুণটি তিনি পেয়েছেন। একাগ্রতা। তাঁর ড্রাইভার সমর ফলগুলোর দিকে চেয়ে ফলওয়ালাকে ধমকে উঠল, ‘এই আবদুল, ডালিমগুলো বেদানা বেদানা করে হাঁকছিস কেন?’
—‘আফগানিস্তানে গণ্ডগোল বাবু, ও বেদানা আর পাওয়া যাবে না, এই বেদানাই নিতে হবে।’
দার্জিলিঙে গোলমালের পর সেখান থেকে লেবু আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। চারদিকে শুধু নাগপুর আর নাগপুর। তবু এখানে যা মেলে, শহরের অন্য কোথাও তা মেলে না। দামেও নিউ মার্কেটের থেকে শস্তা। খানদানি মারোয়াড় রেজিমেন্টের ঘাঁটি এখানে। আসলি ঘিউ, আসলি ফল, আসলি মসালা সব আসলি এখানে। অতএব বিজু রায়ের অফিসের অনেকেই এখান থেকে ফল কিনে নিয়ে যায়। একমাত্র বিজু রায়ই কেনেন না। তিনি অবশ্য জানেন না, তাঁর ড্রাইভার কেনে, তাঁরই বাড়ির জন্য। প্রমীলা, তাঁদের বাড়ির নামে-রাঁধুনি আসলে হাউজ-কিপার ফরমাশ করে, সমর কেনে। দু চারখানা যে নিজের পরিবারের জন্য সরায় না, তা নয়। তবে বেশির ভাগটাই রায়ভবনের তিনশো লিটারের পেল্লাই রেফ্রিজারেটরের মাথায় কখনও ত্রিপুরি বাঁশের নৌকায়, কখনও পোড়ামাটির ডোঙায়, কখনও ক্রিস্ট্যালের পাত্রে শোভা পায়। বিজু রায়ের পাতে যখন পড়ে তখন অফিস-সংলগ্ন ফল-বাজারের সওদা খাচ্ছেন বলে বুঝতেই পারেন না তিনি।
জয়দীপ চাটুজ্জেকে খুব অন্যমনস্ক দেখাল। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেন না বিজু রায়। এসব জিজ্ঞেস করবার মতো ঘনিষ্ঠতা জয়দীপের সঙ্গে তাঁর নেইও। তবে তাঁর যদি মেজাজ খিঁচড়ে থাকে, তো জয়দীপেরও থাকতেই পারে, কে জানে ও-ও কোথাও মার খেল কি না। জয়দীপ ছেলে ভাল। বছর ত্রিশ-বত্রিশের ব্রাইট ইয়াং ম্যান। বসাকের পার্টিতে আলাপ। সবে নিজের ফার্ম খুলেছে তখন। আর এখন তো সিভল এঞ্জিনিয়ার আর্কিটেক্টদের পোয়াবারো। খুব কামাচ্ছে। তিন চার বছর আগে বসাকের পার্টিতে দেখেছিলেন পাতলা ধরনের চেহারা। চোখে, খুব স্মার্টনেস সত্ত্বেও একটা খরগোস-খরগোস ভাব তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। সেই ছেলেরই এখন পেটের ফাঁদ বেড়েছে। কথা বলা শেষ করলেই থুতনির তলায় আরেকটা বেড় দেখা দেয়।
ব্রিজ থেকে নামবার মুখে গাড়ি আটকে গেল। মুখ বাড়িয়ে দেখলেন বিজু রায় এখন কিছুদিনের জন্যে নিশ্চিন্ত। নিজের হোল্ডারে একটা সিগারেট লাগিয়ে জয়দীপ সিগারেট কেসটা বাড়িয়ে ধরল বিজু রায়ের দিকে। সিগারেটের জন্য না সুদৃশ্য দামি সিগারেট-কেসটার জন্য বিজু রায় ঠিক বুঝলেন না। যাই হোক, তিনি একটা নিলেন। বললেন, ‘পরের বাড়িটা বুঝলে চ্যাটার্জি তোমার কাছ থেকেই আগাগোড়া প্ল্যানিং টল্যানিং করে নিয়ে নামব। এটার বেলায় আসলে অতটা এক্সপিরিয়েন্স ছিল না। দুলিচাঁদ নামিয়ে দিল। নেমে পড়লুম। এখন কেমন নেশা ধরে গেছে, বুঝলে?’
জয়দীপ গম্ভীরভাবে বলল, ‘হ্যাঁ। প্ল্যান-টল্যানগুলো পরিষ্কার থাকা দরকার। প্ল্যান একরকম সাবমিট করলুম। পরে চতুর্দিকে ক্যান্টিলিভার করে বেশ কয়েক হাজার স্কোয়ার ফুট বাড়িয়ে নিলুম এ তো আজকাল আকচার হচ্ছে। তা ছাড়া, রেসিডেনশ্যাল কমপ্লেক্স একটা সেক্রেড রেসপনসিবিলিটি, পবিত্র দায়। লোকে ঠেকায় পড়ে কিনছে বলেই প্রোমোটার-ডেভলপার কতকগুলো বিপজ্জনক খাঁচা বানিয়ে ছেড়ে দেবে—দ্যাটস নট জাস্টিস!’ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল জয়দীপ জানলার দিকে মুখ করে।
বিজু রায়ের মাথার মধ্যে কে একটা ছোট্ট ওয়ার্নিং বেল বাজাচ্ছে। এই বক্তিমের মানে কী? অন্তত পক্ষে পঁচিশ বছরের ছোট এই ছোকরা কোন সাহসে আপার হ্যান্ড নিচ্ছে রে বাবা! ইতিমধ্যেই আবার কার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধল? কেনই বা? তিনি তো ওকে রীতিমতো পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন! আড়চোখে জয়দীপের মুখটা একবার দেখে নিয়ে তিনি বললেন ‘ব্যাপারটা কি জানো! হাজার রকম ধান্দায় থাকি। নেহাত একটা খেয়ালের মাথায় বাড়িটা করা। বাট নাও অ্যায়াম সিরিয়াস। এরপর যদি করি, যেগুলো করব, সেগুলো হবে প্রতিটি স্কোয়ার ইনচ প্রি-প্ল্যানড। একেবারে ছবির মতন। কোন্নগরের দিকে একটা চোদ্দ কাঠা জমি দেখেছি। শিগগিরই সব ফাইনাল হয়ে যাবে। এবার আর…।’
কথাটা শেষ করলেন না বিজু রায়। কোন্নগরের চোদ্দ কাঠাটা আসলে ধাপ্পা। জয়দীপ চাটুজ্জে কতটা উৎসাহিত হয় সেটা দেখবার জন্য টোপ ফেলা। তিনি যদ্দূর জানেন, পেটের ফাঁদ বাড়লেও তেমন সন্তোষজনক কিছু জয়দীপ এখনও করতে পারেনি। খুঁটে তুললেও এ লাইনে ভাল কামাই হয়। কিন্তু একটা মান-মর্যাদার ব্যাপার আছে, পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে—বিশেষত এসব আধুনিক কেতার কোয়ালিফায়েড ছেলেদের।
‘মিডল্ ইনকাম-গ্রুপের জন্যে করব। কিন্তু হবে রাজপ্রাসাদের মতো। যতদূর সুবিধে দেওয়া যায়…’ ধোঁয়ার রিং ছাড়ার মতো বিজু রায় ছেড়েই যাচ্ছেন। আসলে এগুলে সুতো। জয়দীপ যদি ধরে।
জ্যাম ছেড়েছে। আই সি বোস রোড ধরে জি টি রোড নিল সমর, তারপর হু হু করে সাইটে পৌঁছে গেলেন। একতলায় অফিসঘর। পরে এটাই এদের অ্যাসোসিয়েশনের ঘর হবে। এখানেই সব কাগজ-পত্তরের ডুপ্লিকেট থাকে। সুপারভাইজ করছিল মিস্ত্রি। কড়কড় কড়কড় করে সিমেন্টে চিপসে মাখা হচ্ছে মেশিনে। বিজুবাবুকে দেখে একবার উঁকি মেরে সেলাম করে গেল। ব্রোশিওরের পাতা উল্টে যাচ্ছে জয়দীপ। এবার উঠছে।
—‘এলিভেশনটা তো ক্লিয়ার এসে গেছে!’ বিজু রায় বললেন।
‘সো ফার সো গুড’ কাঁধ নাচিয়ে বললে জয়দীপ, ‘চলুন একটু ঘুরে দেখে আসি।’ দোতলায় উঠতে উঠতে বলল—‘প্ল্যানে অনেক ডিফেক্ট আছে দাদা। মাঝখানে একটা করে ছোট ফ্ল্যাট স্কুইজ করে দিয়েছেন, অথচ ডাক্ট রাখেননি। অর্থাৎ এরা জাস্ট একটা দিক পাচ্ছে। এ ছাড়াও আছে অনেক টেকনিক্যাল গণ্ডগোল। তবে সে সব তো এখন কিছু করার নেই। আমি জাস্ট বিল্ডিং মেটিরিয়্যালসগুলো যদ্দূর পারি একটু দেখে নেব।’
থাকে থাকে সাজানো সিমেন্টের বস্তাগুলোর মধ্যে একটা আঙুল দেখিয়ে বার করতে বলল। গনির লোক সেটাকে টেনে বার করে খুলে দেখাল। দেখতে দেখতে মুখ বিকৃত করল জয়দীপ। অন্য দিকে তাকিয়ে বলল ‘গভর্মেন্টের মডুলার ইটগুলো নিলেন না কেন? স্ট্যান্ডার্ড ইট!’ বিজু রায় এ কথার উত্তর জানেন না। জানে তাঁর কনট্র্যাক্টর। লোহা সব ঢালাই হয়ে গেছে। সামান্য কিছু পড়ে আছে। জয়দীপ একটু নিচু হয়ে দেখে নিল। তারপর বলল—‘চলুন আমার দেখা হয়ে গেছে।’
নিচের অফিস ঘরে বড় করে জলযোগের আয়োজন ছিল। এক কাপ চা ছাড়া জয়দীপ কিছু ছুঁল না। —‘তাড়া আছে দাদা, বাড়িতে গেস্ট আসবার কথা আছে।’
গাড়ি ব্রিজে উঠতে আয়েস করে ধোঁয়া ছেড়ে বলল—‘সিমেন্টের কোয়ালিটি খুব খারাপ দাদা। নামী কোম্পানির লেবেল লাগিয়ে আপনাকে ভুসি মাল গছিয়েছে। লোহার রড কোয়ার্টার সুতো মতো কম আছে। কর্পোরেশনের ইনসপেক্টর ভুল রিপোর্ট দেয়নি।’
—‘বলো কি?’ বিজু রায় সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
—‘ওই যে বলছিলেন খেয়ালের মাথায় করেছেন। সিরিয়াসলি নেননি! আপনার সেই অ্যাটিটিউডটারই সুযোগ নিয়েছে কনট্র্যাক্টর। আমার তো সরাসরি আপনাকেই রিপোর্ট দেবার কথা। আমি সরকারি লোকও না। কিছুই না। কোথাও ওবলিগেশন নেই। জাস্ট কনসেন্স। বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। বাড়িটা ভাল হচ্ছে না দাদা।
—‘আপনি শিওর? আমি কিন্তু বেস্ট মাল দেবার কথাই গোড়ার থেকে বলে আসছি। শিবশঙ্কর, মানে ওই কনট্র্যাক্টর আমার চেনা লোক। ইন ফ্যাক্ট আমার সল্ট লেকের বাড়ি ও-ই করেছে!’
জয়দীপ কাঁধের একটা ভঙ্গি করল। মুখে কিছু বলল না। জয়দীপকে ওর অফিসে নামিয়ে দিয়ে বেশ কিছুদূর, প্রায় নিজের অফিসে পৌঁছে গিয়েছিলেন বিজু রায়। হঠাৎ মনে হল রক্ষিতের দেওয়া পার্সেলটা জয়দীপের টেবিলে ফেলে এসেছেন। ব্রিফ কেস থেকে কর্পোরেশনের ইনসপেকশন রিপোর্টটা বার করবার সময়ে পার্সেলটাকে টেবিলের ওপর রাখতে হয়েছিল। তারপর ঢোকাতে ভুলে গেছেন। ওটা আবিষ্কার করলে জয়দীপ ঘুষ মনে করতে পারে। ঘুসুড়ির বাড়িটা ওভাবে বাতিল করে দেবার পর ঘুষ দেওয়ার অর্থ খুব খারাপ দাঁড়াবে। মান-সম্মান আর কিছু থাকবে না বিজু রায়ের ওইটুকু একটা ছেলের কাছে। তিনি গাড়ি ঘোরাতে বললেন। নেতাজী সুভাষের গলিতে ঢুকছেন, জয়দীপের গাড়িটা ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। জয়দীপ নিজেই ড্রাইভ করছে। পাশে শিবশঙ্কর না? তাঁর কনট্র্যাক্টর জয়দীপের গাড়িতে কী করছে? দুজনে যেন গভীর আলোচনায় মত্ত। বিজু রায় এত অবাক অনেকদিন হননি। শিবশঙ্করের সঙ্গে জয়দীপের আদৌ কোনও জানাচেনা আছে বলে তিনি শোনেননি। ও কি টের পেয়েছে জয়দীপ ওর সমস্ত ব্লাফ ধরে ফেলেছে? তাই ওর অফিসে ছুটে এসেছে? আগে তো তাঁরই কাছে আসা উচিত ছিল। কারণ কোর্টে জজের মুখোমুখি হতে হবে বিজু রায়কেই। শিবশঙ্করকে দেখিয়ে দিয়ে তিনি পার পাচ্ছেন না। তবে শিবশঙ্করকেও মুখোমুখি হতে হবে বিজু রায়ের। তাঁর নিজস্ব আদালতে। সেখানের আর কারুর দিকে আঙুল দেখিয়ে শিবশঙ্করও পার পাবে না। পার্সেলটা আনতে ড্রাইভার সমরকেই পাঠাবেন ভেবেছিলেন। কি মনে করে নিজেই লিফটে উঠলেন। বিশ্রী অন্ধকার বাড়িটা। চারদিকে ঝুল ঝুলছে। পানের পিকে সিঁড়ির কোণ-টোন ভর্তি। দেখলে কল্পনাও করা যায় না, এরই পাঁচতলায় জয়দীপ সাতশো’ স্কোয়্যার ফুট মতো জায়গা অমন ছিমছাম করে দিতে পেরেছে। স্লাইডিং ডোর, কাচ, কাঠ। বড় বড় পোস্টার। রবার গাছ। অচেনা ক্রোটন। মোল্ডেড চেয়ার-ফেয়ার।
পি সি নিয়ে কাজ করছিল একটি লোক। ঢোকবার মুখে টুলের ওপর পিওন। টেবিলে ওটি বোধহয় ড্রাফটসম্যান। বিজু রায়কে দেখে সেই বলল ‘মিঃ চ্যাটার্জি তো এইমাত্র গেলেন কাজে। কিছু বলতে হবে?’
বিজু রায় গম্ভীরমুখে বললেন—‘ভেতরে একটা পার্সেল আছে। আমার। ভুলে ফেলে গেছি।’
—‘এইয্ যাঃ। স্যার তো অফিসের চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। খুব দরকারি নাকি?’
বিজু রায় বললেন—‘ফিরে এলে ওটা রেখে দেবেন। আমার ড্রাইভার সমরকে কাল কোনও সময়ে পাঠাব, তুলে নিয়ে যাবে।’
—‘ঠিক আছে। খুব দুঃখিত স্যার। উনি কখনও এত ছোটাছুটি করেন না। কোনও জরুরি ব্যাপার আছে মনে হয়। একটি ভদ্রলোক কদিন ধরেই আসছেন, তাঁকে নিয়ে কর্পোরেশনে গেলেন।’
ছোকরা একটু বেশি কথা বলে। অন্তত জয়দীপ ফিরে যদি শোনে তার অনুপস্থিতির এই কৈফিয়ত সে বিজু রায়কে দিয়েছে সে নিশ্চয়ই ছোকরাকে একটি বকর-বকর-বোক-চন্দর মনে করবে। কিন্তু তখন তারও আর কিছু করার থাকবে না। কিন্তু একটি ভদ্রলোক…মানে শিবশঙ্কর কদিন ধরেই আসছে? জয়দীপের কাছে? কেন? বাজে মাল দিয়ে তো সে আসলে ফাঁসিয়েছে তাঁকে? তাহলে কর্পোরেশনে যাবে কেন? তিন জনে, মানে তিনি, জয়দীপ আর শিবশঙ্কর মিলে পরামর্শ করে কর্পোরেশনে যেতে পারতেন। তা-ও ঠিক কর্পোরেশন-অফিসে নয়। গোটা কতক কাউন্সিলার, দরকার হলে, মেয়রের বাড়ি। ডিলিং ক্লার্কদের শিবশঙ্কর একাই ম্যানেজ করতে পারত। কিন্তু এরা দুজনে মিলে…তাঁর অজ্ঞাতে…গোপনে…? কীভাবে তাঁকে ফাঁসাবে আর? শিবশঙ্কর নিজেও তো পার পাবে না!
অফিস বন্ধ করতে বলে চাবি নিয়ে বিজু রায় আবার গাড়িতে উঠলেন। আজকে আর ভাল লাগছে না। এবার বাড়ি। সেই বাড়ি যা এই শিবশঙ্করেরই করা। শ্রেষ্ঠ আর্কিটেক্টের প্ল্যান। কিন্তু তাকে কংক্রিটে রূপান্তরিত করেছে শিবশঙ্করই। সে সময়ে নিজের বাড়িরও বেশ কিছু সংযোজন ও আগাগোড়া সারাইয়ের কাজ করে নিয়েছিল। ভাল করেই জানেন তিনি। এ জিনিস সব কনট্র্যক্টারই অল্পবিস্তর করে। শিবশঙ্কর একটু বেশি করেছিল। তো তিনি কিছু বলেননি। তাঁর বাড়িখানা তো বানিয়ে দিয়েছে সলিড! সল্ট লেকে বহু বাড়িই চেয়ে দেখবার মতো। তা তার মধ্যেও বিশেষ বোধহয় বিজু রায়ের বাড়ি। এক সময়ে যে এইভাবে ঘর তৈরি করে দিল, সে-ই এখন ঘর ভাঙতে লেগেছে! বিনা প্ররোচনায়! ভাল রে ভাল! কিন্তু শিবশঙ্করকে তো তিনি খুব সহজে ছাড়বেন না! তার লাইসেন্সটি তো বাতিল হয়ে যাবে! কিন্তু কর্পোরেশনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে? পারবেন কী? সে যা-ই হোক। খামোখা এই শিবশঙ্কর যাকে তিনি বহুদিন ধরে কাজ দিয়ে আসছেন, আর এই জয়দীপ চ্যাটার্জি যাকে সবে দিতে শুরু করেছেন এরা হঠাৎ তাঁর ক্ষতিসাধন করতে তৎপর হয়ে উঠবে কেন? দূর হোক গে ছাই, হয়তো রজ্জুতে সর্প দর্শন করছেন! হয়তো অন্য কোনও ব্যাপারে শিবশঙ্করের জয়দীপের পরামর্শ দরকার হয়েছে। অন্য কোনও কেস। কিন্ত…শিবশঙ্কর তো একদিনও বলেনি সে জয়দীপকে চেনে, তার কাছে যায়! জয়দীপও তো কই…
নাঃ মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চললে প্রেশার বাড়া ছাড়া আর কিছু লাভ হবে না। বিজু রায় একটু চেষ্টা করে শিবশঙ্কর-জয়দীপ সংক্রান্ত দুর্ভাবনার সুইচটা অফ করে দিলেন।
গত ষোলোই অক্টোবর মায়ের কাজ নির্বিঘ্নে হয়ে গেছে। তারপর সাতাশে বিজু রায় আটান্ন পূর্ণ করে ঊনষাটে পা দিলেন। সরকারি চাকরি জীবনে থাকলে অবসর, পেনশন ইত্যাদি হয়ে যেত। বাবার মতো ইউ.ডি. ক্লার্কের একখানা পোস্টে টিকে থাকতে পারলে এখন তিনি বাতিল বুড়ো, নিজের পাওনা-গণ্ডা বুঝে নিতে সরকারি দফতরে জুততার সুকতলা ক্ষওয়াতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। তাঁর ভাগ্য ভাল বাবা তাঁর ভাগ্য এই পথে চালিত করবার আগেই সময়মতো সরে আসতে পেরেছেন। স্টিল-গ্রে সুটের ভেতরে সময় তাঁর শরীরে কোথায় কতটা থাবা বসিয়েছে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। শরীরের ওপর সময়ের প্রভাব তিনি। খুব একটা বুঝতেও পারেন না। ডাক্তার বললে মানতেই হয়। দুশো চিনি, একশো একশো-সত্তর রক্ত চাপ। এটা খাবেন না, ওটা খাবেন না, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ একটু। প্রাতর্ভ্রমণ। কিন্তু মন? আটান্ন বছরের জীবন এমন অন্ধিসন্ধি পর্যন্ত কাজ দিয়ে ঠাসা যে তিনি যুবক হবারও যেমন অবসর পাননি, প্রৌঢ় হবার ফুরসতও তেমনি না। এদিক থেকে ভাবলে বলতেই হয় তিনি খানিকটা ক্লিওপ্যাট্রার মতন। সময়ের আয়ত্তের বাইরে কোনও একটা বিন্দুতে তাঁর মনটা কাজ করে যায়। চিরসবুজ? ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা? তা হয়ত নয়। কিন্তু চিরহলুদও নয়।
মায়ের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকাও তাঁর সময়কে থোড়াই কেয়ার-করা জীবনচর্যার একটা গোপন কথা। ছোট খোকা! ছোট খোকা! কখনও বিজু! এসব বলে ডাকতে তো কেউ ছিল! বস্তুত মায়ের এই বিজু ডাক থেকেই বিজনেস-সার্কলে তিনি বিজু রায়। ঊননব্বুই বছর বয়সে মা গেলেন। শেষের পনেরো যোলো বচ্ছর এক রকম শুয়েই। প্যারালিসিস-টিসিস কিছু নয়। মাঝ সত্তর থেকে হাত পা ভাঙতে আরম্ভ করল, পুরনো বইয়ের পাতা ভাঙবার মতো, কিংবা পুরনো গাড়ির কল-কবজা বিগড়োবার মতো। আজ ব্রেক ঠিক করে আনা হল তো কাল গেল ক্লাচ, আজ কারবুরেটরে গণ্ডগোল তো কাল ফিউয়েল-ট্যাঙ্ক ফুটো। নড়বড়ে হাড়গুলো নিয়ে ফোকলা বুড়ি শুয়ে থাকত আর লোকে জিজ্ঞেস করলেই বলত—‘কী বলি দাদা, আমার হাড়-মুড়মুড়ির ব্যায়রাম ধরেছে। দিবি নাকি খোক্কসের তেল এনে?’ ষোলো বছর মানে প্রায় দেড় যুগ। এই সময়ের মধ্যে একটা শিশু জন্মে লায়েক হয়ে যায়, এই এতদিন শুয়ে শুয়ে, তা সে যত আরামেই হোক, একটা মানুষ যে কী করে অত হাসি হাসতে পারে, কাউ কাউ করে অত কথা বলতে পারে সে-ও একটা বিস্ময়। বিজু রায়ের বাড়িতে প্রচুর লোকের আনাগোনা। তার শতকরা কজন ছেলের কাছে, আর কতজন মায়ের কাছে বলা শক্ত। ছেলের কাছে লোক এসেছে নেহাত কাজে, স্বার্থের তাগিদে, হাজার চেষ্টা করেও সেটা তাদের পক্ষে লুকোনো সম্ভব হত না। কিন্তু মায়ের কাছে তো লোকে ঠিক কাজে আসত না! কত কত দূর সম্পর্কের কাকা, ভাইপো, ভাইঝি, বোনপো, বোনঝি-জামাই, নাতবউ, নাতকুড়, সারা বছর ধরে আসতেই থাকত। আসতেই থাকত। তাদের মধ্যে অনেকে নীচে দাঁড়াতেও সাহস পেত না, কলকেও পেত না, সোজা উঠে যেত তিন তলায়। খয়েরি ক্যামবিসের জুতো, তাপ্পি-মারা ছাতা, খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি এক বৃদ্ধ যাঁকে মা নতুন ঠাকুরপো বলে ডাকত, যেন সেই সুবাদে বিজু রায়ও নতুন কাকা বলতেন, তাঁকে এই বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে হলে তিনি বা তাঁর পরিবারের কেউ বোধহয় চিনতেও পারবে না। এ বাড়িতে ওই কিসিমের লোক ঢুকতে পারে তা-ও কেউ ভাবতে পারবে না। কিন্তু এই নতুন কাকা না কে অবলীলায় খপ খপ করে তেতলায় উঠে যেতেন যত দিন মা ছিলেন। কিছুক্ষণ পর চা আর জলখাবারও এসে যেত। এই বৃদ্ধ থাকাকালীন মায়ের ঘরে ঢুকলে বিজু রায়ও মাঝে মাঝে যোগ দিয়েছেন কথাবার্তায়, ঠাট্টা ইয়ার্কিতে হেসেওছেন। মা যাবার পর থেকে বৃদ্ধ উধাও। আর এলেও বোধহয় দারোয়ান ঢুকতে দেবে না। বিজু রায়ই কি কথা বলবেন? এই যে নতুন কাকা, কখন এলেন? বলতে বলতে নীচে নিজের অফিস ঘরে নেমে যেতে থাকবেন না? নিজের ঘরের পর্দা সরিয়ে তনুশ্রী ভুরু কুঁচকে চাইবে, বুঝতে পারবে না এই বৃদ্ধটি কে এবং কেন! ছেলে এবং মেয়ে খুব সম্ভব ‘বদার’ করবে না। একমাত্র প্রমীলাই আগেকার কথা স্মরণ করে, দিলেও দিতে পারে এক কাপ চা, দুটো বিস্কুট।
কিন্তু মায়ের কাছে যে লোকে কাজে আসত না, এটাও বোধহয় ঠিক কথা নয়। রান্না শিখতে অর্থাৎ লিখে নিতে আসত কেউ কেউ। ‘মালাইয়ের পুর দিবি দিদি, পোস্ত আর নারকেল সামান্য, এই এতটুকু।’ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে একদিন শুনতে পেয়েছিলেন যেন। তিনি ঢুকতেই মায়ের নাত-বউটি ‘ওমা! ছোটকাকা’ বলে হুট করে উঠে গেল। আবার এও দেখেছেন বিয়ে-থা কি পুজো-আচ্চা, কি শ্রাদ্ধ অশৌচ ইত্যাদি সম্পর্কেও মার কাছে অনেক আত্মীয়-স্বজন উপদেশ নিতে আসছে। ছাউনি-নাড়া ফুল, ছিরি, বরণ ডালায় কী কী থাকবে, হলুদ মাখানো সুতোটা কপাক বেড় দিতে হবে—অশৌচান্তর নাপিত না পাওয়া গেলে মেয়েরা কী করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকালকার মেয়ে-বউরা এসব খুঁটিনাটি অনেক জানে না। কিন্তু ফেলেও দিতে পারে না বোধ হয়। তাই মায়ের কাছে ছুটে আসত। একেকটা বিয়ের মরশুমে এই জাতীয় অতিথি বাড়িতে খুব বেশি হয়ে যেত। অত কথা বলে মা অসুস্থ হয়ে পড়ত। বিজু রায় তখন ঘরে ঢুকে বলতেন—‘আমি এবার সব বারণ করে দিচ্ছি। এ কী কাণ্ড! বুড়ো মানুষকে এভাবে জ্বালাতন করার কোনও মানে হয়?’ মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি। মা বলত,
—‘বারণ করিসনি বিজু। বারণ করবি কী জন্যে?’
—‘কী জন্যে? একটা কিছু হলে?’
—‘কী হবে?’ ক্ষীণ কণ্ঠ, কোটরাগত চোখ বিজুর চোখে। অন্য সময়ে এই চোখই কৌতুকে ঝিকমিক করে। আজ ক্লান্ত তাই স্তিমিত। অস্থি চর্মসার দেহ। মাথায় কিছু সাদা তুলোর কুণ্ডলি। চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে না মা। বিজু রায় বুঝতে পেরেছেন মা কী বলতে চায়।
কত অল্প খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, মাকে দেখে জানা গেল। মায়ের জন্য গত পনেরো বছর ধরে সকাল আর রাতের আয়ার ব্যবস্থা ছিল। প্রথমটা তিনি ভেবেছিলেন মা আপত্তি করবে, একটা মহা সমস্যা তৈরি হবে। কিন্তু আপত্তি ছেড়ে, কোনও অসন্তোষও মা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করেনি। তিনিই বরং একদিন আগ বাড়িয়ে কৈফিয়ত দিয়েছিলেন—‘আতুরে নিয়মো নাস্তি। কী বলো, মা?’
‘নিয়ম? কিসের নিয়ম?’ মা অবাক হয়ে বলেছিল। তার পরে ছেলের কথার প্রসঙ্গ ধরতে পেরে বলেছিল ‘আতুরে সব কিছুই নাস্তি ছোটখোকা। স্বস্তিই সব।’ মায়ের অভিমান ছিল কি না বলতে পারবেন না তিনি। থেকে থাকলে সেটা অযৌক্তিক, আবার অযৌক্তিক নয়ও। বিজু রায়ের যা কাজকর্ম তাতে তাঁর পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে মায়ের সেবা করা অসম্ভব। তনুশ্রী যদি সাধারণ গেরস্থ ঘরের বউ হত, তাকে করতে হত, কিন্তু তা তো সে নয়। কেন করবে? মাকে যতদূর জেনেছেন খুব গোঁড়া, প্রাচীনপন্থী, শুচিবায়ুগ্রস্ত, নিজের সম্পর্কে লাজুক বলেই জেনেছিলেন। কিন্তু মা নির্বিবাদে মাইনে করা আয়া জাত-জন্মের ঠিক নেই, তার কাছ থেকে বেডপ্যান নিল। তার কাছে স্পঞ্জ করল, হরলিকস খেল, পরে ভাতও খেল। এই মেনে নেওয়াটা মার বয়সে সম্ভব হল কী করে তিনি জানেন না। আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তো মা মেনে নেয়নি। দাঁতে দাঁত চেপে মা যে নিরুপায় হয়ে মেনে নিল, এমনও বলা যাবে না। মা একটা লড়াই দিতে পারত। দাঁতে দাঁত টিপে রইল, কিছু খেল না, অশক্ত হাত-পা নিয়ে বাথরুমে যেতে গেল, পড়ে গেল। এই রকম। তা সেসব কিছু তো মা করেনি। বরং ওই দুটি আয়া, সুলতা আর শিবানী ওদের সঙ্গে খুবই ভাব-ভালবাসা হয়ে গিয়েছিল মার।
মা ছেলে-মেয়েকে যতটা দেয়, ছেলে-মেয়ে মাকে ততটা তো কিছুতেই দিতে পারে না। বাবা সাত বছর শুয়েছিলেন। ঠাকুমা ছ বছর। দুজনেই পক্ষাঘাতে। তাঁরা ভাইবোনেরা যখন-তখন। সে সময়টা কী অসুখই না করত! টাইফয়েড? চলল একাদিক্রমে একুশ দিন, চিকেন পক্স, আবার চলল মাসখানেকের কাছাকাছি। ইনফ্লুয়েঞ্জা? থাক শুয়ে অন্ততপক্ষে পনেরো দিন। তারপরে আছে রক্ত-আমাশা, খোস-পাঁচড়া, বেরিবেরি, ন্যাবা…কী নয়? যখন তখন। সবাইকে মা একা হাতে সেবা করেছে। করে সংসার দেখেছে। কী করে করেছে মা-ই জানে। তখন মনে হত এটাই স্বাভাবিক। ঠাকুমাকে বেড-প্যান দিয়ে, বড় ছেলের গা মুছিয়ে, চান করে মা নতুন টাইফয়েড থেকে ওঠা দুই ছোট ছেলে মেয়ের শিঙি মাছের ঝোল-ভাত পথ্য নিয়ে আসবে। ইতিমধ্যে অন্যদের দুপুরের খাওয়া, জলখাবার, রাতের আহার, বিছানা করা, টেবিল গুছোনা, আলনা গুছোনো। একটিমাত্র ঠিকে কাজের লোক বাড়িতে। দিদি যখন ছিল সামান্য সাহায্য করত। কিন্তু মা সেটা চাইত না। তোরা পড়। মায়ের ওই এক বাক্য, এক মন্ত্র, এক চাহিদা। তোরা পড়। পড়লেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দারিদ্র্যের সুরাহা হবে। সামাজিক মানমর্যাদার নাগাল পাওয়া যাবে। বড়লোক আত্মীয়ের বাড়ি ‘তোমরা তো ঘরের লোক’ বলে অসাগর খাটুনির পর শেষ ব্যাচে মাংসের শুধু ঝোল, মাছের ছাল, আর ভাঙা ভাঙা লেডিকেনি এসব। সব কিছুর সুরাহা। যাক গে। মা দিয়েছে। সেবা, যত্ন, নিজের কিছু রাখেনি। আদর্শ। আদর্শও মা দিয়েছে। জীবনে বড় হবার মূলমন্ত্র। সেটা কাজে লাগাতে পারেননি বিজু রায়, সেটা আলাদা কথা। কিন্তু মা দিয়েছিল। তিনি ছেলে, ছেলে হিসেবে ফেরত দিয়েছেন সেবা যত্ন। সবই ঠিক। কিন্তু মা নিজের হাতে দিয়েছিল। মা বোকা। তিনি আয়ার হাতে দিচ্ছেন। তিনি কেজো, তিনি চালাক।
মা সারা জীবন এত ব্যস্ত থেকেছে যে মাকে কোনও দিন ভাল করে দেখা হয়নি। কখনও সবুজ পাড়ের শাড়িতে ঘেরা মুখ, কখনও আলুথালু খোঁপার নীচে শাড়ির পাড় হেলায় পড়ে আছে। বেশি বয়সে আবার সেই একই মুখ শুভ্রতার ঘেরে। মা যে কবে কী খেয়েছে, পরেছে, কীভাবে কী করেছে মনে পড়ে না। বড় দাদা-দিদিরা জানত হয়ত। বিজু লাটিম থেকে ঘুড়ি, ঘুড়ি থেকে বিড়ি, বিড়ি থেকে ফেরি, বেওসা…তারপর সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে অনেক ওপরে এসে যখন দেখবার অবসর হল দেখলেন এক বৃদ্ধা ফিমর বোন ভেঙে শুয়ে আছেন। নার্সিং হোমের শয্যায়। একটি খুব সুসজ্জিত যুবতী পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। ‘চলো এবার মাকে ও-টিতে নিয়ে যাবে’, যুবতী বলল। চমকে উঠে বিজু রায় দেখলেন তাঁর মা। পড়ে গিয়ে মোক্ষম হাড় ভেঙেছে। ভেতরে লোহার রড ঢোকাতে হবে। নার্সরা তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত, তাঁর স্ত্রী হাত-ব্যাগ দোলাতে দোলাতে বাইরে চলে যাচ্ছে। বলল— ‘সেজদাকে ফোন করে দিয়েছি। দিব্য ধরেছিল। ও-ই সব্বাইকে খবর দিয়ে দেবে।’ সেজদা? দিব্য? মানে তাঁর সেজদা কানন? হ্যাঁ। হ্যাঁ তাই-ই তো! সেজদা সরকারি চাকরি করে না? কোন ডিপার্টমেন্টে যেন? ফুড বোধহয়। দিব্য, দিব্যদ্যুতি সেজদার বড় ছেলে তাঁর ভাইপো হল সম্পর্কে। ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে না? সেজদা, এই সেজদার ফ্যামিলিটাই যা একটু…। তাই তাঁর স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে ওর স্ত্রী-পুত্রদের একটু বেশিই…। আর কে কে যেন আছে? বড়দা, বড়দা ছিল জড়বুদ্ধি। ভাগ্য ভাল মায়ের শরীর থাকতে থাকতে মারা গেছে। মেজদা গগন? গগনবিহারী। একটা মনোহারি দোকান আছে। ব্যবসাই যদি করবি, একটু ফলাও করে করলে কী হয়! মাথায় গোল টাক গগনবিহারীর। ধারে ধারে চুল। ঠিক যেমন বাবার ছিল। মেজদাই ছেলেবেলায় ধরে বেঁধে পড়াত আর মাথায় গাঁট্টা মেরে বলত— ‘বিজুটা পয়লা নম্বরের ফাঁকিবাজ। ওটার কি হবে না।’ তা এম-কম পাশ করেই বা মেজদার কী হল? দোকানদার। লেখাপড়া করে যে-ই গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে-ই। মেলেনি। মেজদার ডিগ্রিটা এমন দামে এখনও পর্যন্ত বিকোল না যে একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়িও কিনতে পারে। সেজদার সরকারি চাকরি, প্রশ্নই নেই। একমাত্র বি-কম ফেল বিজনবিহারীরই গাড়ি আছে। চকচকে নতুন। একখানা নয়, তিনখানা। বাড়ি সোনারপুরের দিকে মেজদাও করেছে, শ্বশুরের দেওয়া জমিতে। কিন্তু বিজনবিহারী রায়ের নিজের গায়ে খেটে মাথায় খেটে উপার্জন করা টাকায় কেনা জমি, তৈরি বাড়ি, বাড়ি নয় একটা শিল্পদ্রব্য। মেজদা মেয়ের বিয়েতে খাইয়েছিলও খুব ভাল, কিন্তু মেজদার সঙ্গে ঠিক…। ভীষণ গম্ভীর মুখ, পকেটে বিড়ি আবিষ্কার করে শাসন করছে সেই দিদি। দিদিই বা কী করছে! কেমন প্রার্থী-প্রার্থী চেহারা দেখেছিলেন যেন একবার? থানে-ঘেরা সেই ন্যুব্জতা, তার সঙ্গে ছেলেবেলার দিদি ধারণাটা কিছুতেই খাপ খায় না। কোথায় থাকে দিদি? মায়ের কাজে এসেছিল। সুদ্ধ কাজের দিন। সঙ্গে ছেলে? না নাতি? কেয়ারি করা ঘাড় পর্যন্ত চুল, বড় বড় নখ রেখেছে। হাতে মেহেদির ছাপছোপ। কী অদ্ভুত! তিনি কাজে ব্যস্ত ছিলেন, ওই অদ্ভুত দর্শন ছেলেটির পরিচয় জিজ্ঞেস করেননি। সম্ভবত কেউই করেনি। দিদি শ্রাদ্ধ শেষ হলে ফল-মিষ্টি খেয়ে চলে গেল। বলল— ‘নিয়মভঙ্গে আর আসব না, আমার নিয়ম তো আর ভঙ্গ হবে না। আসতে বড় কষ্ট হয়।’ সমরকে ডেকে বলেছিলেন, শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে দিতে। ওই লাইনেই কোথায় যেন থাকে! আর ছুটকি? যার সঙ্গে পাশাপাশি টাইফয়েডের শয্যা ভাগ? শিঙ্গি-মাছের ঝোল-ভাত ভাগ? সেই ছুটকি? নাহ…ছুটকির কথা বিজু রায় কিছু জানেন না। এমনকি তনুশ্রী, তাঁর স্ত্রী ছুটকির অস্তিত্বের কথাই জানে না। ছুটকি লজ্জা। ছুটকি মুছে গেছে।
এত সব ভাববার সময় সাধারণত বিজনবিহারীর থাকে না। রাত সাড়ে আটটা নটার আগে তিনি বাড়ি ফিরতে পারেন না। রবিবারের কথা অবশ্য আলাদা। কিন্তু বেশির ভাগ রবিবারেই প্রচুর লোক দেখা করতে আসে। সন্ধেবেলায় তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। যতদিন মা বেঁচে ছিল রবিবার সকালে নিয়ম করে আধঘন্টা মায়ের কাছে বসতেন। অন্যান্য দিনও খুব বেশি দেরি না হয়ে গেলে অন্তত পনেরো কুড়ি মিনিট। আজ মঙ্গলবার, মা না থাকায় ফেরার সেই তাড়ার বোধটাও ছিল না। কিন্তু হাতের কাজগুলো ফুরিয়ে গেল। মনটা খারাপও হয়ে গেল খুব। প্রোমোটারের ব্যবসায়ে তিনি নামতে চাননি, দুলিচাঁদ নামাল। দুলিচাঁদের ব্যবসা রমরম করে চলছে। তিনি প্রথমটাতেই মুখ থুবড়ে পড়লেন। সামলে দেওয়া যাবে ঠিকই। কিন্তু বদনাম তো একটা হল। এর আগে বদনাম তাঁর কখনও হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বুকের মধ্যে গলার মধ্যে ট্যাংরা মাছের কাঁটার মতো খচ-খচ করছে ওই দৃশ্যটা। ছাই-ছাই রঙের স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড। পুরনো গাড়ি কিনেছে জয়দীপ। সামনের দিকে দুটো মুখ খুব কাছাকাছি। শিবশঙ্করের সঙ্গে জয়দীপ আলোচনায় মত্ত। জয়দীপের সঙ্গে শিবশঙ্করের কী? শিবশঙ্কর তাঁর লোক, জয়দীপকেও, তিনি বসাকের পার্টিতে চিনে অবধি সাহায্য করছেন। ওরা কেউ কাউকে চেনে না, অন্তত চেনবার কথা নয়। অথচ দুজনে ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলছে। তাঁকে গোপন করে কর্পোরেশন অফিসে গেল। বিজু রায় যখন ব্যবসায়ে নামেন দুজন ব্যক্তির কাছ থেকে সাহায্য পরামর্শ ইত্যাদি পেয়েছিলেন। এই বসাকের বাবা নৃত্যগোপাল বসাক, সংক্ষেপে এন. জি। আর দুলিচাঁদ। এন. জিকে তিনি এখনও নিজের বাবার মতো শ্রদ্ধা করেন। প্রতি জন্মদিনে ধুতি-চাদর, ফুল, মিষ্টান্ন নিয়ে দেখা করেন। বোঝাই যায় বৃদ্ধ এখন ভিমরতির পর্যায়ে। বাড়িতে কেউ তাঁর খোঁজ রাখে না। বিজু রায় কিন্তু যান। সময় পেলেই যান। প্রায় বদ্ধ কালা বৃদ্ধের সঙ্গে বহুক্ষণ আলাপ করে আসেন। তাঁর বিষণ্ণ মুখে যতক্ষণ না হাসি ফুটছে ততক্ষণ অব্দি তিনি অপেক্ষা করেন। আর দুলিচাঁদ! দুলিচাঁদের কোন পরামর্শটা তিনি আজ অব্দি ফেলেছেন? দেওরাকে শেয়ারের দালাল ঠিক করেছিলেন দুলিচাঁদের অনুরোধেই। ডুবোল তো? রিয়্যাল এসটেটে নামাল দুলিচাঁদ। তিনি নেমেছেন সুদ্ধ দুলিচাঁদের পরামর্শের মান রাখতেই। এই দুলিচাঁদই না তাঁকে কচি বয়সে ব্যবসার ঘাঁত ঘোঁত শিখিয়েছে? কিন্তু জয়দীপ? আজকালকার পাশ করা ঝা-চকচকে সিভল এঞ্জিনিয়ার! এই অল্প দিনের পরিচয়েই যথেষ্ট ব্যবসা পাঠিয়েছেন তিনি ওকে। হঠাৎ এমন ব্যবহার করল? আর শিবশঙ্কর তো একরকম তাঁর খেয়ে-পরে মানুষ! ওই রক্ষিতের মতো! তবে?
বাড়ি পৌঁছে বিজু রায় দেখলেন বাড়িখানা আপাদমস্তক শূন্য। মস্তকে মা ছিলেন, মা চলে গিয়ে সেখানটায় টাক পড়ে গেছে। ছেলে মেয়ে স্ত্রী এরা সব কোথায় তিনি তো জানেনই না। লোকজনরাও বিশেষ কিছু বলতে পারল না। তাঁর চান হয়ে গেল। শামি কাবাব, হুইস্কি আর স্টার টি.ভি নিয়ে ঘণ্টা দুয়েক পার হয়ে গেল। সাড়ে নটা। ঘড়িটা কিছুক্ষণ অন্তর-অন্তরই পাখা মেলে নানান ক্যারদানি করে সময় জানান দিচ্ছে। দশটা বাজল, এখনও বুড়ি এল না। সাড়ে দশটা বাজল, এখনও বুড়ি এল না। টি.ভি অফ্ করে বিজু রায় উঠে পড়লেন।
এই জায়গাটা তাঁর বাড়ির বিখ্যাত সেন্টার পার্লার। এখানে তাঁরা নিজেরা এবং ঘনিষ্ঠজনেরা ছাড়া কেউ আসতে পায় না। তাদের জন্য নীচে আলাদা বসার ঘর আছে। দেয়ালজোড়া নরম কার্পেট। দেয়ালে হালকা বেগনি রং। তার ওপর বনসাইয়ের ছায়া পড়েছে। কোণে একটা ব্রঞ্জের গাছদান থেকে একটা বিরাট সাদা লিলি সুললিত আঙুল মেলে দিয়েছে। বাটিকের বুদ্ধ যশোধরা রাহুল ঝুলছে আর একটা দেয়াল থেকে। ওদিকে আবার ভ্যান গখের বিদ্ঘুটে আত্মপ্রতিকৃতি। যেদিকেই তাকালেন বিজু রায়, দুলিচাঁদ কানোরিয়ার ঘর, রাকেশ গুপ্তর ঘর, অনিল চৌধুরী বা এন. জির ছেলে শরদিন্দু বসাকের ঘর দেখতে পেলেন। ইনটিরিয়র ডেকোরেটর এসে সাজিয়ে দিয়ে গেছে; চরিত্রহীন ঘর। বিজু রায় অবাক হলেন ভেবে আগে কেন কখনও এসব মনে হয়নি, কেন লক্ষ পড়েনি তাঁর সেন্টার পার্লারের এই বেয়াড়া নৈর্ব্যক্তিকতা! বিজু রায় বিরক্তির আওয়াজ করে তাঁর স্ত্রীর শোবার ঘরে গেলেন। ডবল বেড খাটে টান টান বেডকভার। ফুলোফুলো মতন, যেন তুলো বা স্পঞ্জের তৈরি। ব্যাপারটা কী তিনি হাত বুলিয়ে দেখে নিলেন। একদিকের দেয়াল জুড়ে বিরাট ড্রেসিং টেবল্। কিছু-কিছু প্রসাধন দ্রব্য সাজানো রয়েছে। ড্রয়ারগুলোতে চাবি। প্রসাধন দ্রব্যগুলো তুলে তুলে শুঁকে শুঁকে দেখতে লাগলেন বিজু রায়। ডিওডোরান্ট, হেয়ার-স্প্রে। আর কিছু নেই। খুব সম্ভব এইগুলো সবশেষে ব্যবহার করে ড্রয়ারে তুলতে ভুলে গেছে তনুশ্রী। বিজু রায় লক্ষ করলেন ড্রেসিং টেবলে, দেয়ালের নানান জায়গায়, খাটের মাথায় সর্বত্র বিভিন্ন ভঙ্গিতে তনুশ্রীর ফটো। একটা অবশ্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আছে, তারা তখন খুব ছোট, তনুশ্রীও একেবারে কাঁচা। কিন্তু আর সবই তনুশ্রীর একার কিংবা নানান বাইরের লোকের সঙ্গে তোলা। এদের মধ্যে শিল্পপতি, গাইয়ে বাজিয়ে, পলিটিকসের লোক সবরকমই আছে। যেগুলো তনুশ্রীর একার, সেগুলো বেশ ফিলমস্টার ফিলমস্টার ভঙ্গিতে তোলা। মাথায় তোয়ালে বাঁধা, বুকে তোয়ালে জডানো, কামানো বগল দেখিয়ে হাত দুটো ওপরে তোলা— এ ছবি কে তুলেছে কে জানে? আর একটা ওড়না টেনে, নাকে নথ পরে নাচের পোশাকে চারদিকে কুঁচি ছড়িয়ে বসে। এক পা সামনে ছড়ানো। কানের পাশে হাত। তনুশ্রী কি কখনও নাচ-গান জানত? বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিগুলো আজ দেখলেন বিজু রায়। যেন নতুন চোখে। আগেও তো এগুলো এ ভাবেই ছিল। তিনি যে এ ঘরে ঢোকেন না তা-ও নয়। কিন্তু আজই ছবিগুলো যেন প্রথম দেখলেন। ছবিগুলোর মধ্যে দিয়ে তনুশ্রীর সারা জীবনের চাওয়াও বেশ স্পষ্ট করে যেন দেখতে পেলেন তিনি। তনুশ্রী মোটামুটি ভাল দেখতে। প্রাণপণ চেষ্টা করে চেহারা রেখেছে। সে অনেক পেয়েওছে, সম্ভবত যা-যা চেয়েছে সব। পোশাক পরিচ্ছদ, বিউটি সেলুন, কসমেটিক সার্জারি, মাসাজ-ক্লিনিক, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট পদ, বড় বড় লোকের সঙ্গে ঘোরাফেরা। কিন্তু বিজু রায় পরিষ্কার আয়নার মধ্যে দিয়ে প্রতিবিম্ব দেখার মতো করে দেখতে পেলেন তনুশ্রী আসলে বেশ্যা হতে চায়। টান টান ত্বক সমেত সরু লম্বা পা, ভাঁজহীন পেট, নধর গোল হাত, মসৃণ কাঁধ, এই সমস্ত তনুশ্রী সবাইকে দেখাতে চায় ভীষণভাবে। নির্দোষ এই চাওয়া হয়। কিন্তু সন্দেহ নেই তনুশ্রী চাইছে, চতুর্দিকে প্রেমিকদের, স্তাবকদের কোলাহল, কেউ পায়ে হাত বুলোচ্ছে, কেউ বুকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, কেউ চোখে চোখে ইশারা করছে— এইসব তনুশ্রী অন্তরের অন্তস্তল থেকে বহু বাসনায় প্রাণপণে চাইছে চাইছে চাইছে।
চাইছে শুধু? না পাচ্ছেও? পাচ্ছে নিশ্চয়ই। টাকা। অনেক অনেক নিজের অনর্জিত টাকা। তিনি তনুশ্রীকে আলাদা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছেন অনেক দিন। তাঁর নিজের সঙ্গে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টও আছে বেশ কয়েকটা। কিন্তু কথাটা হল তনুশ্রী পেয়ে যাচ্ছে। স্রেফ বিজু রায়ের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে। টাকা, পদ, সামাজিক মর্যাদা, খোসামোদ এই সব পেয়ে যাচ্ছে এক্স অফিসিও। বিজু রায়ের ধর্মপত্নীর গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে বলে। এই পরিমাণ টাকা, এবং মর্যাদা একটা গুণহীন মেয়েমানুষ যদি ফোকটে পেয়ে যায়, এবং তাকে যদি সমস্ত সাংসারিক দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয় তা হলে সে কী করবে? হয় বোর হবে নয় অকাজের কাজ করে বেড়াবে। একেকজন একেক ভাবে। নিজের প্রবৃত্তি অনুযায়ী। এই সংসারে কোথায় কী লাগে, কতটা চাল ডাল, কী পরিমাণ চা-দুধ-কফি-চিনি, কে কী খায়, কখন খায়, এ সব তিনি যেমন জানেন না, তনুশ্রীও তেমনই জানে না বলে তাঁর ধারণা। কারণ একেকদিন দুজনে কি তিনজনে, কদাচিৎ চারজনে খেতে বসলে তনুশ্রীকে যেন জিজ্ঞেস করতে শুনেছেন ‘প্রমীলা! আজ কী মেনু?’ তাঁদের অল্পবয়সে ভাইবোনেরা খেতে বসলেও এ প্রশ্ন কেউ-না-কেউ করত। তিনি করতেন। ছুটকি করত। বাবাও করতেন। ‘আজ কী রান্না হয়েছে?’
—‘কী আবার হবে? থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়!’ মায়ের জবাব।
—‘বলোই না বাবা, অত বিনয় করছ কেন?’ ছুটকি হয়ত বলল।
—‘শুকতো’, মেজদা মুখ বিকৃত করল, ‘শাকে ডালে’, বাবা উৎসাহিত হয়ে বললেন ‘মুলো দিয়েছ তো?’ ‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ।’ ‘ডাঁটাচচ্চড়ি।’ বিজু বলল—‘আগে বাঢ়ো, এখনও আমার পছন্দমতো কিছু শুনছি না।’ মুখ টিপে হেসে বলছে, ‘আলু পোস্ত’ ‘হুররে’। সশব্দে বলছে বিজু, অন্যরা নিঃশব্দে। ‘আজকে মাছ নয়, ডিম।’ মা বলছে। ‘তবে তো আরও ভালো, হাঁস না মুরগি?’ বিজুর প্রশ্ন। ‘মারব এক থাবড়া, বামুনবাড়িতে মুরগি!’ ‘মুরগির ডিম কিন্তু সহজপাচ্য মা’ ছুটকি বলল, ‘তা ছাড়া একটা পাখির ডিম খেতে যদি আপত্তি না থাকে তো আরেকটাতে কেন আপত্তি হবে! বলো বাবা!’
বাবা রাশভারী লোক। ছুটকি ছাড়া আর কেউ বাবাকে এভাবে আলোচনায় টানতে সাহস পায় না। বাবা বললেন ‘হাঁসের ডিম বড়ও বেশি, খেতেও অনেক ভাল।’
—‘তুমি মুরগির ডিম খেয়ে দেখেছ বাবা!’ সঙ্গে সঙ্গে ছুটকি তৈরি। ‘না, মানে, লোকে বলে।’
এই ঘরোয়া দৃশ্য এবং কথাবার্তা স্মৃতির কোন কোনায় এত যত্নে এমন নিখুঁত নির্ভুলভাবে সংরক্ষিত ছিল ভেবে অবাক হতে হতে বিজু রায় নিজের ঘরটাতে ঢুকলেন। একটা গুমসোনি গন্ধ নাকে এল প্রথমেই। জানলা খুলে দিলেন। গেল না। খুব মৃদু একটু তামাক, একটু হুইস্কির কড়া গন্ধ—তা-ও মিশে আছে ঘরের বাতাসে। কিন্তু মূল গন্ধটা খুব বিশ্রী, অচেনা। সকালে তিনি ঘর ছেড়ে বেরোবার পর এরা কি পরিষ্কার-টরিস্কার করেনি? বেডকভার সরিয়ে চাদর দেখলেন তিনি। বেশ পরিষ্কার চাদর। চাদর সরিয়ে গদি দেখলেন, পরিষ্কার গদি। দেয়ালের কোণে আয়না-সুদ্ধু ছোট্ট তিন কোনা আলমারি ফিট করা। এইখানে তিনি দাড়ি কামান। দাড়ি কামানোর যাবতীয় সরঞ্জাম এখানেই থাকে। ছেলেবেলায় মায়ের খুড়তুত পিসেমশাইয়ের বাড়ি তিনি এইরকম দেখেছিলেন। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। দীর্ঘকাল পরে যখন তাঁর নিজের বাড়ি হচ্ছে, সবই পেশাদারি হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন খালি এইটা বলে দেন। ‘আমার ঘরের উত্তর-পূব কোণের দেয়ালে একটা তিন সাড়ে তিন ফুট লম্বা আলমারি ফিট করে দিয়ো। চওড়া যতটা পারমিট করে। ভেতরে তাক থাকবে। তেকোনা ন্যাচার্যালি। আমি ভালভাবে মুখ দেখতে পারব, এমন হাইটে কোরো।’ দাড়ি কামান, চুল আঁচড়ান, টাই বাঁধেন সব এই আয়নার সামনে। আরাম চেয়ার রয়েছে একটা। বই, রেডিও, কাগজপত্র রাখবার ড্রয়ার, ওয়ার্ডরোব সব একত্র করে একটা মালটিপারপাস ফার্নিচার করে দিয়েছে এরা। ফুলদানে টাটকা ফুল, টাটকাই তো! আশ্চর্য! তবু চিমসোনি গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে!
বিজু রায় আলো নিবিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। চারদিকে গাছপালা। বাগান। অপূর্ব নকশার সব বাড়ি। আকাশ মালিন্যহীন। এক টুকরো চাঁদ ফিক ফিক করে হাসছে। পাটের ফেঁসোর মতো দু চারটে মেঘ অনেক দূরে দূরে স্থির হয়ে আছে। বারান্দায় বেশ মশা। দু চারটে চটাচট গায়ের ওপরেই মেরে ফেললেন তিনি। তারপর কি ভেবে পার্লারে বেরিয়ে, গোল জায়গাটা পেরিয়ে ওদিকে ছেলের ঘরে ঢুকলেন। ঢুকতেই একটা জীবন্তপ্রতিম পোস্টার তাঁকে অভ্যর্থনা করল। খুব সুন্দর একটি মেম সাহেবের আবক্ষ ছবি। গোলাপি বুক ঠেলে উঠেছে। তলপেটে যেন একটা ধাক্কা খেলেন বিজু রায়। হাসছে মেম সাহেবটি। তলায় কি সব লেখা। কাছে গিয়ে আবছা আবছা পড়তে পারলেন—‘ওহ্, মাই ম্যাডোনা। আই লাভ ইউ।’ ম্যাডোনা? ম্যাডোনার ছবি এই রকম? বিজু রায় অবাক হয়ে গেলেন। সে তো গোল ধরনের মুখ। কোমল লাবণ্যে ভরা। মৃদু হাসি। চুলগুলো সিঁথি কেটে আঁচড়ানো। এ লেখাটা কি চিন্টুর? চোখে পড়ার চশমা নেই বলে ভালভাবে অক্ষরের ছাঁদ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। চিন্টু কাকে ম্যাডোনা বলে ডাকছে রে বাবা! দেয়াল-ভর্তি আরও পোস্টার। কোথাও এক যুবক হাতের মাস্ল ফুলিয়ে কপ্নি জাতীয় কিছু একটা পরে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও যুবক-যুবতী নিবিড় আলিঙ্গনে। চুম্বনে মত্ত। এই ছবিগুলো দেখতে দেখতে ঘুমন্ত বিজু রায় নির্ভুলভাবে জেগে যাচ্ছিলেন। ভাবছিলেন— ‘বারে বিজু ষাটের কাছেও তুই তো বেশ…’ তার পরেই লজ্জা পাচ্ছিলেন। এ সমস্ত উন্মাদনার উপকরণ তাঁর ছেলের। তিনি বাবা না? মুখ ফিরিয়ে টেবিলের ওপর তাকালেন। স্তূপীকৃত বই, পত্রিকা। উল্টে পাল্টে দেখলেন, স্পোর্টস, ফিল্ম। বইগুলো একটু আধটু পড়বার চেষ্টা করলেন। কিছু বুঝতে পারলেন না। কী অদ্ভুত ইংরিজি! কত বয়স হল নীলাদ্রির? একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। ছেলেটির বোধহয় একুশ বাইশ। কী পড়ছে, শুনছে? কমার্স পড়ছিল না? নাকি অন্য কিছু? এর সম্পর্কে অথাৎ কেরিয়ার সম্পর্কে এবার ভাবতে হয়। কমার্স পড়ে তাঁর ফার্মে যোগ দেবে এটাই স্বাভাবিক ইচ্ছে। ফার্মে দু এক বছর বসে গেলেই বিয়ের জন্যে পাত্রী দেখতে হচ্ছে। তনুশ্রীর ঘরে যেমন তার আশা-আকাঙক্ষার একটা পুরো ছবি তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, এখানে যেন তেমনটা পেলেন না। কিংবা হয়ত পেলেন খানিকটা, নিজের অজান্তেই সেটাকে মেনে নিলেন না। এ সব ছবি প্রকাশ্যে এ ভাবে টাঙানো রয়েছে, এ তাঁদের সময়ে কল্পনা করা যেত না। তবু এই জাতীয় কিছু বই খাতার ফাঁক ফোকর থেকে আবিষ্কৃত হলে সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকরা বিয়ের কথা ভাবতেন। মধ্যবিত্ত ঘরে চাকরি-বাকরি বা অন্য কোনও রোজগার না করলে তখন বিয়ের সম্ভাবনা থাকত না। তবু, মেজদার বইয়ের ভেতর থেকে মধুবালার ছবি বেরোতে বাবা ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। নানা জায়গায় যুগপৎ মেজদার চাকরি এবং বিয়ের জন্যে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিয়েছিলেন। নীলাদ্রির বিছানার ওপরও একগাদা অডিও এবং ভিডিও ক্যাসেট ছড়ানো। ভি সি আরটা মেঝেতে কার্পেটের ওপর নামিয়ে রাখা। কেউ কি ওর ঘরখানা একটু গুছিয়েও দেয় না! নিজে তো গুছোতে জানেই না। মা, বোন, এতগুলো কাজের লোক। কেউ রায় সাহেবের একমাত্র ছেলের ঘরখানা গুছিয়ে দেবে না! আচ্ছা এই কাজের লোকেরা, এরা তো কখনও কখনও এ ঘরে ঢোকেই। এই সব ছবি-ছাবা দেখে কী মনে করে? দূর হোক গে! লোকের ভাবনা তো তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না! পাছে জয়দীপ তাঁর প্যাকেটটাকে ঘুষ মনে করে তাই তিনি পুরো পথটা আবার গিয়েছিলেন। তার অফিস পর্যন্ত। অফিসের লোকগুলোকে ভাল করে জানিয়ে এসেছেন ওটা তাঁর নিজের জিনিস। জয়দীপের কাছে নিজের মান রাখতে তিনি এতটা করেছেন। কিন্তু ছেলের ব্যাপারে, ছেলের মানরক্ষার জন্য আপাতত তিনি কীই বা করতে পারেন? তাঁর হাত পা বাঁধা। নিচু হয়ে কতকগুলো ভিডিও ক্যাসেট তিনি তুলে নিলেন হাতে। পরক্ষণেই জ্বলন্ত কাঠের টুকরোর মতো সেগুলো ফেলে দিলেন। আর একটুও দাঁড়ালেন না। ঝঞ্ঝাবাত্যার মতো বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন। যেন তিনি ভেজিয়ে দিলেই এ সব অদৃশ্য থাকবে। তারপর আর একটু দূরত্বে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন।
কিছু দেখলেন না প্রথমটায়। টেবিলের সামনে চেয়ার রয়েছে। ভেতরে ঢুকোনো। কিন্তু তিনি গিয়ে বিছানায় বসলেন। বেশ কিছুক্ষণ বসেই রইলেন। বসেই রইলেন। তারপর চোখ মেলে দেখলেন সামনের দেয়ালে একটা ক্রুসবিদ্ধ যিশুর ছবি। বেশ সুন্দর সৌম্য করুণকান্তি যিশু নয়। কেমন হাড় জিরজিরে বুড়ো মতো। চোখকে ধাক্কা দেয়, অপ্রসন্ন করে। টি.ভির ওপরে একটি অচেনা ছেলের ফটো একটু একটু হাসছে। দাঁত বার করে নয়। মুখখানা কোনওক্রমে একটু স্মিত এইটুকু বলা যায়। সাদা-মাটা চেহারা। গেরস্থ ঘরের ছেলে। চিন্টু বা তার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বা যে-সমস্ত ছেলেপুলে নিত্যদিন আশে-পাশে চোখে পড়ে তাদের মতো নয়। গালে একটা হাত। বইয়ের র্যাকে বেশ কিছু ইংরিজি বাংলা বই রয়েছে। সবই পাঠ্য বই মনে হল। ড্রয়ারগুলো আপাদমস্তক বন্ধ। ওয়ার্ডরোব চাবি লাগানো। ওকে বুঝতে পারলেন না বিজু রায়। চিন্টুর ঘরে ঢুকে মনে হয়েছিল ওর মনটা অস্পষ্ট, নিজেই জানে না কী করবে, কী চায়। কোনও অ্যামবিশন নেই, ইচ্ছাশক্তি, সংকল্প, এসব কিছু নেই ও ঘরে। এটা প্রথম মনে হওয়া। তার পরে মনে হল সর্বনাশ, এ তো একটা বিকৃতরুচি, বিকৃতবুদ্ধি পার্ভার্ট। কিন্তু তিতি যেন খুব কঠিন মুখ করে অনেক কিছু লুকিয়ে রেখেছে। তিতির মুখখানা এই মুহূর্তে চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না বিজু রায়। তিতি কি উনিশে পড়ল? টি.ভি.র ওপর গালে হাত দিয়ে ছেলেটি কে? বয়স তার বেশি নয়। খুব মধ্যবিত্ত চেহারা। একে কোনওদিন নিজের বাড়িতে দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না তিনি। অথচ কেমন চেনা-চেনা লাগল।
পার্লারে এসে চোখে পড়ল একটি মোটাসোটা ঘুঘুর মতো দেখতে মহিলা ঘুরঘুর করছে। পরিচ্ছন্ন পোশাক-আশাক। তিনি কৌচে বসতেই সাঁত করে সরে গেলে। ঘুঘু নয়। কেমন কেঁদো ভিজে বেড়ালের মতো। যথেষ্ট ওজন সত্ত্বেও অমনি ক্ষিপ্রতা চলাফেরায়। একটু ধূর্তামি। সব বুঝে জেনেও না বোঝা না জানার ভান। তিনি চিনতে পারলেন এটি তাঁদের রাঁধুনি। তিনি আজকে সকাল-সকাল বাড়ি ফিরে অনেকক্ষণ ধরে এখানে ঘোরাঘুরি করছেন তাই ও বোধহয় টি.ভি. দেখতে পাচ্ছে না। গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে পড়লেন বিজু রায়। মহিলা বলল, ‘সাহেব, খাবার দেব?’ গলাটা সম্ভ্রমে ভয়ে যেন কাঁপছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিজু রায় দেখলেন সত্যিই তো! এগারটা বেজে গেছে। আর কখন খাবেন?
তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়েই বললেন, ‘তোমার মেম সাহেব, …ছেলেমেয়েরা এরা সব কোথায় গেল? কেউ কিছু বলতে পারল না।’
—‘ওরা জানে না সাহেব। তিতিদিদি বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় বেড়াতে গেছে, দু দিন হল। মেম সাহেব কিছু বলেন নি। তবে মনে হয় কোনও নাচ-গানের জলসায় গেলেন। দাদার কথা আমি জানি না।’ থেমে থেমে বলল মহিলা।
—‘হুঁ।’ বিজু রায় কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। মহিলাটি সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি বললেন— ‘খাবার দাও।’
খাবার ঘরে যেতে যেতে হঠাৎ গন্ধটা চিনতে পারলেন বিজু রায়। তাঁর ঘরের চিমসোনি গন্ধটা মর্গের। একবার তাঁকে একটা কেস শনাক্ত করবার জন্য যেতে হয়েছিল। গন্ধটা বাসি মড়ার। প্রভূত বাসি মড়ার।
মুখটা বিকৃত করে তিনি বসে রইলেন চেয়ারে। রাঁধুনি মহিলাটি যত্ন করে তাঁর রাতের খাবার এনে টেবিলে সাজিয়ে দিল। চিকেন সুপ, গরম, ধোঁয়া উঠছে, সুজির রুটি, তিনটে, ফুটবলের মতো ফুলে রয়েছে একখানা এখনও। দু টুকরো মাছ সসে ভেজানো। এবং অনেকটা কাঁচা সালাড। খাবারের সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন বিজু রায়। তারপর হঠাৎ খাবারগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগলেন। বেশ তাক করে করে। সুপের বাটিটা সাইডবোর্ডের কানায় লেগে ভেঙে গেল। তরল পদার্থটা সাইডবার্ডের গা বেয়ে মেঝেয় গড়াচ্ছে। মাছগুলো জানলার কাচে তাক করলেন। থুপ থুপ শব্দ করে সেগুলো কাচে লেগে জানলার তলায় পড়ে রইল। সালাডের শশা, টোম্যাটো, গাজর ইত্যাদির চাকা দেয়ালের গায়ে নতুন ডেকোরেশনের মতো লেগে আছে। সবচেয়ে বেশি দূরে গেল রুটিগুলো। একটা একটা করে সেগুলোকে জানলার বাইরে পাঠাতে চেষ্টা করলেন বিজু রায়। লতা পাতার গ্রিল। আশপাশ দিয়ে টুক টুক করে বেরিয়ে গেল সে গুলো। বেশ নিশ্চিন্ত হলেন এবার বিজু রায়। শব্দ শুনে রাঁধুনি ছুটে এসেছিল। হতভম্ব মহিলাকে বিজু রায় বললেন, ‘আমার ঘর পরিষ্কার হয়নি কেন? যাচ্ছেতাই গন্ধ বেরোচ্ছে।’
তিনি বেশ ধীর দৃঢ় পায়ে তেতলায় উঠে যেতে থাকলেন। সিঁড়ির বাঁকে তিনি অদৃশ্য হয়ে যেতেই রাঁধুনী মহিলা যার নাম প্রমীলা, সে তার সাহায্যকারী ও বন্ধু বদনকে ডাকতে গেল। বদন এগুলো পরিষ্কার করে দেবে, সাহেবের ঘরটাও দেখবে কী হল, ব্যাপারটা সম্পর্কে তারা আলোচনাতেও বসতে পারবে।
তিনতলাটায় অর্ধেক ছাদ। তাতে একরঙা টালি বসানো। গাছ প্রচুর। ফুলগাছই বেশি। মা ও সব পাতাবাহার টাহার পছন্দ করত না। একটা বেশ ঝাড়ালো তুলসীগাছ। একদিকে ঠাকুরঘর, আরেক দিকে মায়ের ঘর, টয়লেটসহ। মাঝখানের পথটা দিয়ে প্রথমেই ছাদে এসে বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন বিজনবিহারী। গভীর করে প্রশ্বাস নিলেন, শ্বাস ছাড়লেন বার কয়েক। প্যাসেজের মাঝখানে একটা গোল আলো জ্বলে। সেই আলো খানিকটা গিয়ে পড়েছে ছাদে। আকাশের আলোও আছে। মঞ্জরিত তুলসী দেখা গেল। নীচে তাঁর যে বাগান, তাতে সবুজ লন আছে, মরশুমি ফুলের বেড আছে। কিন্তু ছাদের বাগানে মা শুধুই গন্ধকুসুম রাখত। গন্ধহীনদের মধ্যে একমাত্র জবা আর নয়নতারা। আধা-অন্ধকারে ফুটে আছে দেখতে পাওয়া গেল। এবং সাদা নয়নতারা। কোনও ফুলের গন্ধ পাওয়া গেল না। রজনীগন্ধা গোলাপ এদের তো ফোটার কথা! তিনি ফিরে মায়ের ঘরের দরজাটা খুলে ফেললেন। এ বাড়িতে কোনও ঘরেই কখনও তালা চাবি ইত্যাদি দেওয়া থাকে না। ড্রয়ার, ক্যাবিনেট, আলমারি ইত্যাদি বন্ধ থাকে, কিন্তু ঘর খোলা।
মায়ের ঘরে মায়ের পুরনো আমলের সেগুন কাঠের পালঙ্ক। আলমারি। লোহার সিন্দুক। চৌকির ওপর বসানো কিছু তোরঙ্গ। বাবার আরাম-চেয়ারটা। তা ছাড়াও গোটা দুই চেয়ার। একটা নতুন ডিজাইনের আলনা। এটাই একমাত্র এ যুগের জিনিস ঘরটাতে। পালিশ-টালিশ অন্যান্য আসবাবের সঙ্গে মানানসই। কিন্তু জিনিসটা ঘরের মধ্যে মূর্তিমান ছন্দপতনের মতো দাঁড়িয়ে আছে বলে বিজনবিহারী সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন। তাঁর চোখ এখন সুরুচি-সুছন্দে নতুন যুগের সুষমা-সৌন্দর্যের ধারণায় বড্ড বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর। খুব সম্ভব সন্ধেবেলায় ধূপ জ্বেলে দেওয়া হয়েছিল, ধূপদানির তলায় কুণ্ডলিকৃত ছাই পড়ে আছে। গন্ধটাও আটকে আছে ঘরে। মৃদু কস্তুরী গন্ধ। কিন্তু গন্ধটা সইতে পারলেন না তিনি। তাড়াতাড়ি জানলা খুলে দিলেন। এক ঝলক হাওয়া ঢুকল। পরিষ্কার হলেও, ঘরটাতে অব্যবহারের দরুন কেমন একটা শূন্যতার ছাপ পড়ে গেছে।
আরাম-চেয়ারটাতে বসলেন বিজনবিহারী। সোজা হয়ে এটাতে বেশিক্ষণ বসা যায় না। চেয়ারের বাঁকানো পিঠটা কেমন টানতে থাকে। অভ্যাসবশত পকেটে হাত চলে গেল, সিগারেট ও লাইটারের খোঁজে। কিন্তু ঠিক সিগারেটটা ধরানোর মুহূর্তে ছাদের দিকের জানলা দিয়ে একঝলক ফুলের গন্ধ ঢুকল। গন্ধটা চিনতে পারলেন না বলেই বিজনবিহারীর গায়ে যেন কাঁটা দিল, যেন মা ঢুকল। সাদা থান, গলায় সোনায় গাঁথা রুদ্রাক্ষের মালা। শুকনো বৃদ্ধা এক। মায়ের সামনে এতটা বয়সেও সিগারেট খেতেন না বিজন। একদিন অনেকক্ষণ মার কাছে বসবার পর ছটফট করছিলেন সিগারেট না খেয়ে। মা বলল—‘যা না, একটু বাইরে যা না। ছাদে ঘুরে আয় একটু।’
বিজন হেসে বলেছিলেন— ‘ছাদে খাবার দরকার কী মা! বয়সটা তো কম হল না। তোমার সামনে খেলে কী হয়! এমন নয় যে গন্ধটা তোমার কোনও দিন অভ্যেস ছিল না। বাবা ছিলেন চেইন-স্মোকার, সিগারেটের পয়সা কুলোতে না পারলে বিড়ি খেতেন।’ সে কথা মনে করেই কথাটা বলেছিলেন মাকে।
মা গম্ভীর হয়ে বলল— ‘গন্ধটা আমার কোনও দিনই ভাল লাগেনি। সে উনিই খান, কি আর কোনও গুরুঠাকুরই খান। কিন্তু সে কথা নয়, মায়ের সামনে ছেলের ধূমপান আবার কী।’
—‘এতো সংস্কার ত্যাগ করতে পারলে মা, এটা পারছ না?’
—‘এটা তো সংস্কার নয় বিজু, এটা সভ্যতা, সম্ভ্রম। মা ছেলে যত ঘনিষ্ঠই হোক, সম্পক্কটার মধ্যে শ্রদ্ধা আছে তো!’
—‘কিন্তু মা, আমার ছেলেকে আমি অনুমতি দিয়ে দিয়েছি। নেশা করতে হয় সামনাসামনি করুক।’
—‘ভাল করিস নি। বয়সধর্মে যা করে করুক, একটু নলচে-আড়াল থাকা ভাল।’
মায়ের এই সব কথা স্মরণ করে লাইটারটা নিবিয়ে দিলেন তিনি। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকবার পর হঠাৎ কী মনে হল তিনি উঠে পড়ে আলোটা জ্বেলে দিলেন। লুকোনো জায়গা থেকে সিন্দুকের চাবি বার করলেন। দুটো চাবি দুটো দিকে ঘুরিয়ে খুলে ফেললেন সিন্দুকটা। দুটো তাক। ভর্তি কাগজপত্র। ওপর তাকে একটা মোটা বাঁধানো খাতা। চট করে পাতা উল্টে বাবার হস্তাক্ষর দেখতে পেলেন। কিছু হিসেব-পত্ৰ যেন। সংসার খরচের হিসেব মনে হয়। খুদে খুদে কালো পিঁপড়ের সারির মতো লেখা। তিন এক পঞ্চাশ, চার এক পঞ্চাশ, এইভাবে পর পর সাত আট দিন। হলুদ দু পয়সা, কালো জিরে দুই আনা, ধোপা বারো আনা, কাগজ চার আনা। এইভাবে চলেছে। আশ্চর্য! মা এ খাতাখানাকে সিন্দুকের মধ্যে হীরে-জহরতের মতো করে রেখে দিয়েছে? কেন? পঞ্চাশ সালের বাজার-দরের একটা দলিল হতে পারে অবশ্য খাতাটা। বাবা যেন প্রাণপণে উত্তর-কালের কোনও অর্থনীতিক মীমাংসার জন্যে এক সামান্য নিম্নবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন ব্যয়ের পরিমাণ খুঁটে খুঁটে লিখে গেছে। বাবার কি এরকম অভ্যেস আদৌ ছিল? মনে করবার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। অমনি যেন কত শতাব্দীর ওপার থেকে ঠাকুমার খনখনে গলার স্বরটা ভেসে এল। খনখনে কিন্তু বড় প্রিয় স্বর। শিশুকালে ওই স্বর এবং তার সঙ্গে মেশানো ছাঁচিপানের গন্ধ ভীষণ মিষ্টি লাগত। ঠাকুমা এইভাবে খনখন করে উঠলেই বাবা একটা খাতার ওপর বা কাগজপত্রের ওপর উপুড় হয়ে পড়তেন। এটা মনে পড়ে গেল। সে কি এই খাতা?
ঠাকুমা বলছে— ‘হ্যাঁ রে বঙ্কু, বাপ-পিতেমোর ভিটে নয়, কিছু নয়, আর একখানা বাড়ি দেখতে কী হয়?’
—‘কেন মা খারাপ কী, গঙ্গার হাওয়া খাচ্ছ তো বিনা পয়সায়।’
—‘চিতের হাওয়াও খাচ্ছি! চিতের হাওয়া খেয়ে খেয়ে বাড়িটার পরকাল যে ঝরঝরে হয়ে গেল!’
—‘চিতের হাওয়াতেই তো সংসারটার পত্তন হল মা। সমুদ্দুরে বাস যার, শিশিরে কী ভয় তার?’
গঙ্গার ধার ঘেঁসে বাড়ি। মাঝখানে গাড়ি চলাচলের রাস্তা। পার হলেই ওদিক দিয়ে ঘাট নেমে গেছে। শ্মশান খুব কাছে। সেখান থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি মাঝে মধ্যেই পাকিয়ে পাকিয়ে দোতলা ছাদের হাওয়া ছুঁয়ে যায়। এই ধোঁয়া নিয়েই ঠাকুমার আক্ষেপ। পক্ষাঘাত হয়ে যখন প্রায় সুস্থ মানুষটা শুয়ে পড়লেন তখনও তিনি এই চিতের ধোঁয়ারই মুণ্ডপাত করেছিলেন।
মায়ের কাছে বিজুরা শুনেছিল। নিতান্ত গুড়গুড়ে বয়সে ঠাকুর্দাদা মারা যাবার পর বাবাদের ক’ভাই-বোনের হাত ধরে ঠাকুমা নিজেই গাঁয়ের দোতলা বাড়ি জমি-জমা-পুকুর সব বিক্রি করে দিয়ে এই বাঁধা ঘাটের কাছে বাসা নিয়েছিল, ভাইদের কাছাকাছি থাকবে বলে। সেইখানে, বাবারা তিন নাবালক ভাই বড় হল, বড় জন একদিন কোথায় পালিয়ে গেল। লোকে বললে সন্ন্যাসী হয়ে গেছে। মেজ ভাই মামাদের দৌলতে ক্রমে জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট হল, বড় ঘরে বিয়ে করল, অন্যত্র বসবাস— আপনি আর কপনি। পিসির বিয়ে হল অনেক দূরে, পঞ্জাবে না কোথায়, খালি ছোট ভাগনেটির বেলাতেই মামাদের দাক্ষিণ্যে কম পড়ে গেল। বড় মামা মারা গেলেন। তিনিই ছিলেন মাথা, অন্যরা নিজেদের নিজেদের সামলাতেই ব্যস্ত। অনেক কষ্টে হুগলি-ডকের চাকরিটা জুটেছিল তাই। ত্রিশ টাকা ভাড়ায় ওই রকম দোতলা বাড়ি আর কেউ দেবে? বাড়ি নিয়ে এই জাতীয় তকরার বাবা আর ঠাকুমার মধ্যে মাঝে মাঝেই হত।
খুব ছেলেবেলা। দাদা-দিদিরা সব বেরিয়ে গেছে, বিজু প্রস্তুত হচ্ছে। বাবা ভেতর-রকে নিজের জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটাতে ধুতি গুটিয়ে মোড়ায় বসেছেন।
—‘বলি শুনছ! ছেলে মেয়েগুলো কোথায় গেল সব?’
—‘কোথায় আর যাবে? গঙ্গায় ঝাঁপাই জুড়তে গেছে।’
—‘বারণ করলে না?’
—‘খেলাধুলো করছে, খারাপ কিছু তো নয়! বারণ করতে যাব কেন?’
—একটা বিপদ হলে?
—‘ও সব কথা মনেও স্থান দিয়ো না। গরিবের ছেলে ওইটুকু যে খেলেধুলে আনন্দ করবার সুযোগ পেয়েছে…’ মা বারবার কার উদ্দেশে যেন নমো করছে।
—‘আর সময়ই বা কোথায় আমার তোমার ছেলেমেয়েদের পেছনে খবর্দারি করবার? ওদিকে মা পড়ে পড়ে কোঁকাচ্ছেন, তাঁর এটা ওটা সারাক্ষণ আছে, এরই মধ্যে তুমি রাজ্যির কচুর শাক, ঘোড়, মোচা সব একই দিনে এনে ফেললে, উনুন খাঁ খাঁ করছে।’ মা দ্রুত পা ফেলে রান্নাঘরে চলে যাচ্ছে। মাথায় ঘোমটা।
বিজনবিহারী চোখ দুটো ভাল করে মুছে নিলেন। এত ভাল করে এ সব দৃশ্য, এ সব শব্দাশব্দ, চেহারা তাঁর মনে আছে? আশ্চর্য! সে তো অন্য এক জীবন! অন্য এক জগৎ। অকল্পনীয় সস্তা ভাড়ায় পুরো দোতলা একখানা বাড়ি। দোতলার ঘরগুলোর জানলা খুললেই গঙ্গার হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে। কোলে দালান। দূর প্রান্তে কলঘর। নীচেও অমনি সব ঘর। ঠাকুমা নীচে থাকতেন। মা-বাবাকেও তাই নীচেই থাকতে হত। দোতলাটা পাঁচ ভাইবোনের রাজত্ব।
কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে গেলেন বিজনবিহারী।
‘আজ বিজু নিরুদ্দেশ হইল। —চলিয়া গিয়াছে এক বছর হইতে চলিল। তাহার পর হইতেই ছোট খোকা সম্পর্কে অস্বস্তিতে ছিলাম। অন্যমনস্ক। উদাসীন। সংসারের কারও প্রতি, কোনও কর্তব্যের প্রতি যেন টান নাই। আঁট নাই। — গেল, গেল। আমার সংসারটিকে আগাগোড়া দুরমুশ করিয়া গেল। পত্নী যেন নীরবে আমাকেই দোষারোপ করেন। বড় মেয়ে কলঙ্কের ভয়ে কি কী জানি, হয়ত লজ্জায় এদিক মাড়ায় না। বড় খোকা— এর ন্যাওটা ছিল। তাহাকে দেখাশোনার ভার সে নিজে হইতেই লইয়াছিল। বড় মায়াবী শরীর। ধাতটাই মায়ের। সে এমন করিতে পারে ইহাতে বিশ্বাস হয় সংসারে অসম্ভব কিছু নাই। বিজুর খোঁজ করিব কোথায়? তাহার বন্ধু-বান্ধব— সবগুলিই তাহা অপেক্ষা বয়সে বড়, বলিতেছে সে ভাগ্যান্বেষণে গিয়াছে। বিবাগী হইবার পাত্র সে নয়। কিন্তু তাহার জ্যাঠা গৃহত্যাগী হইয়াছিলেন। কোনও দিনই আর তাঁহার খোঁজ পাওয়া গেল না। হায়, আমি দরিদ্র মানুষ। কী-ই বা করিতে পারি। পুলিশে একটি ডায়েরি ভিন্ন আর কিছুই আমার হাতে নাই। — এর জন্য আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাইতে পারি না। বিজু ছোটখোকা আমার বড় প্রিয় ছিল। হায়, ছিল বলিতেছি কেন? আছে আছে, শতবার আছে।’
বাবার এই কথাটুকু পড়ে চমৎকৃত হয়ে গেলেন বিজনবিহারী। ‘ছোট খোকা আমার বড় প্রিয় ছিল।’ তাঁর যতটুকু মনে পড়ে, গঙ্গার ধারের সেই নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ি তখন তাঁর কাছে জ্বলন্ত কটাহস্বরূপ। বি.কম দ্বিতীয়বার ফেল করে তিনি সবার চক্ষুশূল। মেজদা প্রায় কথাই বলে না। সেজদা সুযোগ পেলেই উপদেশ দেয়। বাবা হাপরের মতো দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন। যেন সে ইচ্ছে করে ফেলটা করেছে। একমাত্র মা-ই, মুখের হাসি অটুট রেখে শত কাজের মধ্যেও মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে—‘ছোট খোকা আশা হারাসনি, আবার চেষ্টা কর, পারবি, ঠিক পারবি।’ যদিও অন্যদের তাড়নার চেয়ে মায়ের এই স্নেহবাক্যই তাঁর বাড়ি থেকে পালানোর মুখ্য কারণ হিসেবে কাজ করেছে। আবার চেষ্টা? মা এই ‘আবার চেষ্টা’র বাইরে কোনও পথ দেখতে পেত না। অত কল্পনাশক্তি ছিল না মায়ের। কিন্তু আরেকবার চেষ্টার সম্ভাবনাতেও বিজুর গা গুলোত, মাথা ঘুরত, ভেতরে প্রচণ্ড বিদ্রোহ জন্ম নিত। মনে হত সংসারের সব জিনিসপত্তর টুকরো টুকরো করে ভেঙে ছিঁড়ে, মানুষগুলোকে যাচ্ছেতাই গালাগাল-টাল দিয়ে সে উধাও হয়ে যায়। উধাও-ই হল। তবে তার পূর্ববর্তী কাজগুলো সে করে নি। একটি পক্ষাঘাতের রোগী, একটি জড়ব্যাধিগ্রস্ত এবং আরও একটি সামাজিক দূর্ঘটনার আঘাতে টলটলায়মান সেই সংসারকে আঘাত করার মতো নিষ্ঠুরতা বিজুর ছিল না। বাবার ডায়েরির ড্যাশ অংশগুলো হঠাৎ যেন তাকে কুড়ি একুশ বছর বয়সের সেই ধাক্কা-খাওয়া দিনগুলোয় নিয়ে গেল। ক্ষতটা যেন এখনও টাটকা! এরকম হয়? সল্ট-লেকের এই বাড়ি নেই। নেই ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী! নেই আটান্ন-ঊনষাট বছর বয়স, তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, সাফল্য, নানান ব্যবসা সহচর। সমস্যা। কুড়ি-একুশের বিজু একখানা শূন্য ঘর, শূন্য বাড়ি, শূন্য ছাদে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুক্ত যন্ত্রণা! ছুটকি ছুটকি ছুটকি!
খোলা পাতাগুলোয় হাত রেখে অনেকক্ষণ বসে রইলেন বিজনবিহারী। কোথাও একটা ঘড়িতে ভীষণ শব্দ করে একটা বাজল। তিনি চমকে উঠলেন। পুরনো খাতা, হাতের চাপে একটু ভেঙে গেছে। যাঃ।
খুব সাবধানে পাতা উল্টে দেখতে লাগলেন তিনি আর কী আছে খাতাটাতে। হিসেব। মেজদার বিয়ের খবর। বেনারসী শাড়ি— এক, একশত পঞ্চাশ টাকা। মুর্শিদাবাদি সিল্ক—পয়তাল্লিশ, তাঁত শাড়ি—চার খানি—চার ইনটু পঁচিশ মোট একশত। এইভাবে এয়োড়ালা, প্রসাধনদ্রব্য, বরের জোড়, ব্র্যাকেটে লেখা—কাশীর সিল্ক দিলাম, গরদের জোড় দিতে পারিলাম না। আমার বিবাহে যাহা পাইয়াছিলাম তাহা বেনারসী জোড়। এক্ষণে পিঁজিয়া গিয়াছে। তাহা মেজ খোকা পরিতে চাহিল না।’ ষাট সালের তারিখ দেওয়া। বিস্তৃত হিসেব— ঘর খরচ, বউ ভাত, প্রীতিভোজ, কার্ড। তিনি সে সময়ে ছিলেন না, পলাতক। এখন শোনেন বাবা মেজদা সেজদা উভয়ের বিয়েতেই বেশ দাঁও মেরেছিলেন। মেজ বউদি একদিন কথায় কথায় শুনিয়েছিল খবরটা। সত্যি কথাই। মেজদা-সেজদার বিয়ে বোধহয় কমাসের আড়াআড়ি হয়। সাল হিসেবে আলাদা। কিন্তু মাসের তফাত ছ সাত মাসের। এত অল্প সময়ের মধ্যে বাবার মতো ডাইনে-আনতে-বাঁয়ে কুলোয়-না মানুষ দুখানা বিয়ে দিয়ে উঠলেন কী করে। বিজন আপন মনেই হাসলেন।
বাবা দেখা যাচ্ছে নিয়মিত হিসেব রাখতেন না। কোনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ হিসেব। বিয়ে ইত্যাদির। নইলে মাঝে মাঝে পুজোর খরচ, অন্য কোনও পার্বণ, সত্যনারায়ণের ফর্দ ইত্যাদির। দৈনন্দিন হিসেব মাঝে মাঝে ঢুকে পড়েছে। দৈনন্দিন হিসেবের ব্যাপারে বাবা যেন ঠিক মনঃস্থির করতে পারেননি। রাখবেন কি রাখবেন না। তেড়ে ফুঁড়ে এক হপ্তামতে রেখেছেন, আবার ছেড়ে দিয়েছেন। কেমন একটা অস্থিরচিত্ততা প্রকাশ পাচ্ছে এই হিসেব রাখারাখির ব্যাপারটার মধ্যে দিয়েও। অথচ বাবা যে আদৌ অস্থির হতে পারতেন, কোনও বিষয়ে দ্বিধা, দ্বিমত, মত পাল্টানো ইত্যাদির মধ্যে যেতে পারতেন, সে কথা তাঁর ছেলে হিসেবে বিজনের কখনও মনে হয়নি। বাবা যেন অচল, অনড়, জগদ্দল এক পাথর। কিছুতেই তাঁকে তাঁর সংকল্প, ধারণা ইত্যাদির থেকে নড়ানো যাবে না।
‘বৃদ্ধ’ মানুষ, না মানুষ বলা ঠিক হইল না। বৃদ্ধ ব্যক্তি, না ব্যক্তিই বা কেন? যখন কাহাকেও একটি স্বতন্ত্র সত্তা বলিয়া স্বীকার করা হয় তখনই সে ব্যক্তি। বৃদ্ধের ব্যক্তিত্ব আর কাঁটালের আমসত্ত্ব একই বস্তু। সুতরাং শুধু বৃদ্ধ বলাই ভাল। এই বৃদ্ধ খিড়কির দুয়ার দিয়া পাঁশকুড়ায় ফেলিয়া দিবার যোগ্য একটি অবাঞ্ছিত বস্তু। বিনষ্ট ভ্রূণ যেমন পাপী পাঁশকুড়ায় ফেলিয়া দেয়, বৃদ্ধ নামক মনুষ্যত্বের অপভ্রংশটিকেও তেমনই জীবন পাতক, রাস্তার ধারে, অবহেলায়, লজ্জায়, ক্ষোভে ফেলিয়া দিয়া যায়। বৃদ্ধের না আছে মূল্য, না আছে মান। পরমহংসদেব বলিতেন মান আর হুঁশ দুই মিলিয়া মানুষ। বৃদ্ধের হুঁশ নাই, সুতরাং মানও গিয়াছে। সে আর কোন মুখে মনুষ্য-পদবি যাঞা করে? কিন্তু ইহা কি বৃদ্ধের দোষ? সে তো সাধ করিয়া বৃদ্ধ হয় নাই! পারিলে সে বার্ধক্যকে ঠেকাইয়া রাখিত। বলিতে কি ঠেকাইয়া রাখিবার প্রাণান্তকর প্রয়াস বৈজ্ঞানিক মহলে চলিয়াছে। গেরন্টোলজি নামে একটি নূতন শাস্ত্র হইয়াছে শুনিয়াছি। নূতন কী?’
প্রশ্ন চিহ্ন দিয়ে শেষ করেছেন বাবা। এ কি বার্ধক্য সম্বন্ধে নৈর্ব্যক্তিক ভাবনাচিন্তা? না বাবা তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার সার-মর্ম লিখে গেছেন! সালটা কী! সাতষট্টি। বাবার বাঁ দিকটা পড়ে গিয়েছিল। এ সময়টা বাবা ঠিক কোথায় ছিলেন তিনি মনে করতে পারলেন না। মেজদা তো প্রায় ঘর-জামাই-ই হয়ে গিয়েছিল। সোনারপুরে শ্বশুর বাড়ির লাগোয়া জমিতে আস্তে আস্তে বাড়ি করে। তাহলে কি সেজদা? সেজদার কাছেই থাকতেন বাবা এ সময়টায়। সাতষট্টি মানে দাদাদের বিয়ের বছর পাঁচ পরে। বাবা তখন শয্যা নিয়েছেন। আর তার কিছুকাল পরেই বিজন ফিরে এলেন রূপকথার সওদাগরের মতো। ময়ূরপঙ্খী সপ্তডিঙা কূলে ভিড়িয়ে।
বার্ধক্য সম্পর্কে বিজনবিহারীর ধারণা কিন্তু আদৌ তাঁর বাবার অনুরূপ নয়। তার কারণ অবশ্যই তাঁর দাদামশাই ভবানীচরণ। ছোটতে দিনের পর দিন মামার বাড়ি গিয়ে থাকতেন তিনি আর ছুটকি। সে সময়ে মামাবাড়ির প্রধান আকর্ষণ ছুটকির কাছে কে ছিলেন কে জানে কিন্তু বিজুর কাছে নিঃসন্দেহে ভবানীচরণ।
দুপাটি পরিষ্কার বাঁধানো ডেঞ্চার ছিল। নাতি নাতনিরা কোনও দিনই বুঝতে পারেনি যে তাঁর দাঁত পড়ে গেছে বা ফেলে দেওয়া হয়েছে। চুলগুলো ছিল নিকষ সাদা। সেই সাদার কী চমক। সকালে বেল খেতেন। নিয়ম করে বারো মাস। যাওয়ার সময় পুব আকাশ থেকে নতুন রোদটুকু এসে পড়ত সে চুলে, রুপোর মতো ঝিলিক দিত। সূর্য মধ্য-গগনে ওঠবার খানিক আগে আরম্ভ হত দাদামশাইয়ের স্নান-পর্ব। স্নান-যজ্ঞই বলা উচিত তাকে। নাকের ফুটোয়, কানের ফুটোয়, নাভিকুণ্ডে, পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের ফোকরে টোপা টোপা তেলের ফোঁটা দিয়ে শুরু হত যজ্ঞ। সে সময়ে দাদামশাইয়ের চুলগুলো হা-হা হো হো করে হাসত। তাঁর মুখময় গা-ময় যেন সূক্ষ্ম রেশমের কাপড়, তাতে একটা সুতো টেনে দিয়েছে কেউ। সূক্ষ্ম কুচি কুচি ভাঁজ। একেবারে পাতলা গরদ হেন চামড়া। বাড়িতে কাচা সাদা থান পরতেন। দৈবাৎ কাপড় টান টান হয়ে লেগে গেলে সেই গরদের চামড়া কেটে গিয়ে ফুটফুট করে রক্ত বেরিয়ে আসত।
রাতের খাবার ছিল খই দুধ। জুঁইফুলের মতো একরাশি খই কানাওয়ালা বড় খাগড়াই কাঁসার বাটিতে দুধের ওপর যেই ফেলতেন শোঁ করে একটা আওয়াজ হত। সোঁদা সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে যেত চারদিকে। সেই আওয়াজটা শোনবার জন্য, সেই গন্ধের শ্বাসটুকু নেওয়ার জন্যে সন্ধে সাতটা থেকে দাদুর কাছে ঘুরঘুর করত বিজু। রুপোর বড় গোল চামচ দিয়ে সাপ সুপ খইগুলো শেষ করে শেষের দুধটুকু বাটির কানা দুহাতে ধরে যখন এক চুমুকে শেষ করতেন দাদুর মুখটা বুকের ওপর থেকে পিঠের দিকে আস্তে আস্তে একশো ষাট ডিগ্রি কোণে ঘুরে যেত। সে দৃশ্যটাই বা কী চমৎকার। সামনে চেয়ারে বসে রয়েছেন বড় মামিমা। ফরাসডাঙার একটু নীলচে কোরওয়ালা কালো পাড় শাড়ি ছাড়া বাড়িতে পরতেন না। কপালের সিঁদুর টিপটা সব সময়েই একটু ধেবড়ে থাকত। মামিমার মুখ আড়ের দিকে চওড়া। ঘোমটা থেকে বেরিয়ে থাকা চুলগুলো চারভাগের তিনভাগই পাকা। মুখে একটা আলগা হাসি ভেসে থাকত, দাদু গোমড়া মুখ পছন্দ করতেন না বলে। এমনি কত ছবি! প্রত্যেকটি স্মরণ করলে এখনও বিজনবিহারীর অনুভব হয় বার্ধক্যটা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। খ্যাতি, সম্মান, শ্রদ্ধা, সমীহ আর সেবার শীর্ষ চূড়ায় তার অবস্থান। চারদিকে বিশ্বাস, আস্থা, নির্ভর। যা-কিছু জীবনের, সংসারের, সমাজের শ্রেষ্ঠ ফসল সব টুকরি-ভর্তি উৎকৃষ্ট আমের ভেটের মতো বৃদ্ধর পায়ের কাছে নামানো।
মনে আছে মামাবাড়ির গোয়ালা ডার্বির টিকেট জিতে দশ হাজার টাকা পেয়েছে। অত টাকা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে সুবল। ভেউ-ভেউ করে কাঁদছে আর বলছে-‘হমাকে জরুর ফাটকে নিয়ে যাবে বুঢ়াবাবু। আপনি বাঁচাও।’
—‘ফাটকে নিয়ে যাবে কী রে? এ তোর হকের টাকা।’
—‘তো তুমার পাস রাখিয়ে দাও।’
—‘হ্যাঁ তারপর আমি মরে যাই আর তুই টাকা নিয়ে ঝামেলা করিস আমার ছেলেদের সঙ্গে।’
—‘ওরে বাপ্। বজরংবলী তবে হমাকে মাফ্ করবে নাই বুঢ়াবাবু। তুমি যো করবে সো হোবে।’
সুবলের ছোট ছেলেটি শোনা যায় আই.পি.এস. হয়েছে মতিহারীর দিকে। বড়গুলি হাতে দামি ঘড়ি, পরনে সিল্কের লুঙ্গি, মুখে সিগারেট এখনও জোর দুধের ব্যবসা করছে। গাই, ভঁইস। দেহাতে ওদের বিরাট জমি-জমা। পাঁচটি মেয়ের বিয়ে দিতে সুবল গোয়ালা প্রচুর টাকা খরচ করেছিল।
সেই বাল্যকালেই বিজু পুবের বারান্দায় আরাম-চেয়ার পেতে হাতে দুধের জামবাটি নিয়ে বসে পড়বার জন্য রেডি-স্টেডি হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বাবা বন্ধুবিহারী রায়, দেখা যাচ্ছে এই বার্ধক্যের সন্ধান পাননি। সে আরাম-চেয়ার থেকেও ছিল না। সে দুধের বাটিও ভোঁ ভাঁ। তবে সবচেয়ে অভাব হয়ত সামনে বসা ওই হালকা-হাসি মুখ বয়স্ক বধূটির সজাগ উপস্থিতি।
কিন্তু, বধূ কেন? বাবার তো নিজের পত্নীই বর্তমান ছিলেন। মা ওই বয়সে বাবার খুঁটিনাটি সেবা সমস্তই করেছে। নিজের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করবার জন্যে এই খাতা এগিয়ে দেওয়া, এ-ও নিশ্চয়ই মারই কাজ ছিল।
আর কয়েক পাতা পরে তিনি বাবার আরও কিছু চিন্তা নথীকৃত দেখতে পেলেন। বিষয় ওই একই।
‘জরাকে আমি আদৌ ভয় পাই না। জানিতাম জীবন এক হাতে লইয়া থাকে। কিন্তু অন্য হাতে পুরাইয়া দেয়। তাহা ব্যতীত ইহা জীবনের ফসলের সময়। স্বর্ণাভ হেমন্তকাল, কোন কবিতায় যেন পড়িয়াছিলাম মাঠের আলের পাশে সে গভীর আলস্যে ঘুমাইতেছে। ফসল-উঠিয়া-যাওয়া ক্ষেত ন্যাড়া হইলে কী হইবে নূতন ধান্যে নবান্ন হইবে না! গোলা ভরিয়া স্বর্ণময় ধান্যের স্তূপ উপচাইয়া পড়িবে না! ঘর ভরিয়া তিন পুত্র, দুই কন্যা। স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম ছেলেরা মানুষের মতো মানুষ হইয়াছে। নাতি নাতনিরা চারদিকে স্নুকারের বলের মতো ছিটকাইতেছে। কন্যারা সুখী শ্বশুরগৃহ হইতে মাঝে মাঝেই আসিয়া পড়িতেছে। গৃহিণী তাহাদের জন্য বিশেষ ভোজের আয়োজন করিতেছেন। হইল না। জানি না কাহার ইচ্ছায়। কে সেই সর্বশক্তিমান, মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইচ্ছায় বাদ সাধিতে যাঁহার এমন নিষ্ঠুর রঙ্গ!’
বাবা কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু সে কষ্টের কথা লিখে যাবার মতো মনও তো বাবার ছিল? বাবা সম্পর্কে দেখা যাচ্ছে তাঁর ছোট খোকার ধারণা খুব অস্পষ্ট।
‘অর্থ জীবনের রং বদলাইয়া দেয়: ইহা জানিতাম। কিন্তু সে চরিত্রের কাঠামো, পারস্পরিক সম্পর্কের চেহারা, ইহলোক-পরলোক ধর্মাধর্ম সবই বদলাইয়া দেয় তাহা ঠিক এইভাবে উপলব্ধি করি নাই।’
বিজনবিহারী খুব আগ্রহসহকারে পড়তে লাগলেন।
‘ছোটখোকা কৃতী হইয়া আসিয়াছে। কৃতী অর্থে পণ্ডিত, ডিগ্রিধারী নয়। সে বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভ করিয়াছে। তাহাকে খরচের খাতায় ধরিয়া রাখিয়াছিলাম। তাই তাহার এ-ভাবে আসা যেন দ্বিগুণ আহ্লাদের। কিন্তু তাহার দাদারা তো সেভাবে আহ্লাদিত হইল না! মেজ খোকা বলিয়া গেল—“অত হ্যাট-কোটে আপনি ভুলবেন না বাবা, খোঁজ করুন ও কীভাবে কী করছে।” সত্য কথাই হয়ত। উহারা ছোটকে সেই ছেলেমানুষ, দস্যি, পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা হিসাবেই মনে রাখিয়াছে। তাই সতর্ক করিয়া দিতেছে। সেজবাবুও সেদিন বলিলেন—“এক সংসারে একজন মাস মাইনের ছাপোষা চাকুরে, আরেকজন লাখপতি ব্যবসাদার একসঙ্গে থাকতে পারে না বাবা। আপনি বুঝুন ব্যাপারটা। আমার দিকটা ভাবুন। ” কী ভাবিব? তোমরা তিনজনেই আমার ঔরসজাত পুত্র বই তো নও! আমি অশক্ত হইয়া পড়িয়াছি, বিছানায় পরের হাত তোলা হইয়া আছি। আমি ভাবিবার কে? শুইয়া শুইয়া ছোটকে তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ করি। সে বরাবরই তাহার মায়ের ভক্ত। তবু আমার শয্যার পাশে পাঁচ মিনিট হইলেও আসিয়া বসে। সদা অন্যমনস্ক। অর্থাগমের যে পথ সে ধরিয়াছে তাহাতে বিরাম নাই। বিশ্রাম বা স্বস্তি সে জীবনে পাইবে না। কিন্তু তাহা ছাড়াও আমি লক্ষ করি তাহার দাদা বউ-দিদিদের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই শিথিল হইয়া আসিতেছে। কাহার দোষ বলা শক্ত। সম্ভবত উভয় পক্ষেরই। আমি বুঝিতে পারি ছোট এখন যে জগতে বাস করে তাহার সহিত আমাদের জগতের মেজবাবু বা সেজবাবুর জগতের মিল নাই। সেদিন মেজ বউমা ঠাট্টা করিয়া বলিল—“সংসার খরচের টাকা দিচ্ছ দু হাজার টাকা? শুধু খাই-খরচ? তুমি বোধহয় একটা টাঁকশালই খুলেছ, তাই না?”
ছোটর উত্তরের জন্য উৎকর্ণ হইয়াছিলাম, সে বলিল—“তোমার কথার অর্থ কী হয় ভেবে বললে মেজ বউদি? সোজা অর্থ হয় ফর্জারি। আমি কি টাকা জাল করছি বলে তোমাদের ধারণা?” লক্ষ করিলাম ছোট বহুবচন ব্যবহার করিল। তাহার দাদারা বিদ্যায় বড়, সে বিত্তে বড়। দুটিতে মিলিতেছে না। বিজু এখানে থাকিতে পারিবে না। এখন আমি ও নীলিমা কী করিব?’
বাবা নৈর্ব্যক্তিকভাবে আরম্ভ করেছিলেন। ব্যক্তিগত সমস্যায় এসে পৌঁছলেন শেষ পর্যন্ত। সে সময়ে তাঁর সল্ট লেকের জমি কেনা হয়ে গেছে। দু হাজার টাকার খাইখরচ দেওয়াতে সেজবউদির প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি সাবধান হয়ে যান। জমির কথা কাউকে বলেননি। সাংসারিক ব্যয়ের ব্যাপারে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন। মেজদার তখন সোনারপুরে বাড়ি উঠছে। মাস্টারি ছেড়ে সে গড়িয়াহাটের দিকে দোকানে বসছে। মেজদা সেজদার হাঁড়ি আলাদা। বাবা-মা সেজদার সঙ্গে, সুতরাং তিনিও সেখানেই উঠেছিলেন। সুবিধে হয়ে গেল। বছর দেড়েকের মধ্যেই সেজদা বললে, ‘সরকারি কোয়ার্টার্স পাচ্ছি সি.আই.টি রোডে। ছাড়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?’ কথাটা বলল খাওয়ার সময়ে। মা, সেজবউদি এবং সে, তিন জনের উপস্থিতিতে। বিজু বলল—‘কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না সেজদা। যতদিন চাকরি, ততদিন কোয়ার্টার্স। ইতিমধ্যে তুমি ধীরে ধীরে নিজের বাড়ি করে নিতে পারবে।’
সেজদাই আগে গেল। তার পরে মেজদা। বাঁধাঘাটের গলিতে মা বাবা আর বিজু। রই-রই করে উঠে যাচ্ছে সল্ট লেকের বাড়ি। মেজদাদাদের যাবার চার পাঁচ মাস পরেই তাঁরা চলে এলেন সল্ট লেকে। শয্যাশায়ী হলেও যতদূর সম্ভব আরামে ছিলেন বাবা শেষ ক বছর।
আর কী আছে সিন্দুকটাতে। চিঠিপত্রের তাড়া। দুটো তিনটে পলিথিনের ঠোঙার মধ্যে, হলুদ রঙের সরু ফিতে দিয়ে বাঁধা। একটা প্যাকেট খুললেন বিজু রায়। মেজ বউদি, সেজ বউদি, ছোট মামা, বড় মাসি, … প্রচুর চিঠি। সব রেখে দিয়েছে মা। অবসর মতো পড়তে হবে। এটা? দ্বিতীয় প্যাকেটটা খুলে ফেললেন তিনি। অন্তর্দেশীয় পত্র। হাতের লেখা দেখেই চমকে উঠলেন বিজু রায়। সঙ্গে সঙ্গে খুলে ফেললেন চিঠিটা। হাত কাঁপছে।
‘শ্রীচরণেষু মা,
তোমার ১০/৯-এর চিঠি পেয়েছি। তোমার এতদিন বেঁচে থাকার কষ্ট বুঝি। কিন্তু আমার আগের জীবনের তুমিই তো একমাত্র সূত্র। তোমার জামাই যত সুখেই রাখুক আমার জীবনের কুড়িটা বছর তো আমি কিছুতেই মুছে ফেলতে পারব না। মা, জীবনটা সামনে এগোনো সেটা বুঝি। প্রতিদিন পৃথিবী হু হু করে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ বিজ্ঞানের যে তত্ত্ব বার হচ্ছে, কাল তা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মতো মগজ বসবে কম্পুটারে শিগগিরই। কিন্তু পেছনে কেউ নেই, কিছু নেই, খাঁ খাঁ। এ যে কী কষ্ট। সে যার না হয়েছে সে বুঝবে না। মা তুমি চলে গেলে, গেলে কেন যাবেই যে কোনও দিন, আমার আর কেউ থাকবে না। মা, মা গো। স্বার্থপরের মতো কথা বলছি। শুধু আমার জন্যেই তুমি আর ক বছর অপেক্ষা করো মা। যেমন করে হোক একবার তোমায় দেখে আসব।’
তলায় কোনও সই সাবুদ নেই। তবু বিজু রায় সেখানে অদৃশ্য-কালিতে লেখা নামটা দেখতে পেলেন—ছুটকি। ধাক্কাটা এত অপ্রত্যাশিত, এত তীব্র যে তিনি চিঠিটা প্রায় মুঠো করে ফেলেছিলেন। ঠিকানা আছে? এ চিঠিটাতে ঠিকানা নেই। ঠিকানা নেই কেন? ছুটকি, ছোড়দি তুই ঠিকানা দিসনি কেন? আরও কয়েকটা চিঠি উল্টে-পাল্টে দেখলেন তাড়াতাড়ি, আছে। নানান ঠিকানা। কিন্তু সবই বিভিন্ন পোস্ট অফিসের।
চটপট করে লোহার সিন্দুকের সব কাগজপত্র, মায়ের খাটের তলায় রাখা একটা ডাকব্যাকের বড় সুটকেসে ভরে নিলেন বিজু রায়। তারপর দরজা বন্ধ করে নীচে নেমে এলেন নিজের ঘরে। সেখানেও অনেকক্ষণ ধরে কাগজপত্র, চেক বই, পাস বই, ইত্যাদি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেন। ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ যখন তিনি চুপচাপ গোটা দুই সুটকেস নিয়ে বাড়ি থেকে নিঃশব্দে গেলেন তখন তাঁর ওই চিঠিগুলি, তাদের ঠিকানা এক। তাদের লেখিকা ছাড়া আর কিছু মনে ছিল না। জাতিস্মরের যেমন হঠাৎ পূর্বজন্মের কথা মনে পড়লে এ জন্মের সব কিছু ফিকে হয়ে যায় বলে শোনা যায় এ-ও কতকটা তেমনি। বিজু রায় বেরিয়ে গেলেন সম্পূর্ণ উদভ্রান্তের মতো, এবং একমাত্র সেই অক্লান্ত ঘড়িটাই উড়ে উড়ে তাঁর নিষ্ক্রমণের সময়টা নোট করে রাখল।