বুবুনের বাবা : 09 – কিডন্যাপ
সবাই মিলে স্কুলে যেতে যেতে কথা বলছিল, হঠাৎ করে বুবুন সবাইকে থামিয়ে বলল, “কাল রাতে আম্মা কী বলেছে জান?”
“কী?”
“খবিরউদ্দিনের দল আমাকে কিডন্যাপ করে নেবে!” সুমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বলল, “যাহ্! গুল মারছিস!”
“আমার কথা বিশ্বাস হল না? আম্মাকে জিজ্ঞেস করে দেখো।”
“কেন? তোকে কেন কিডন্যাপ করবে?”
“আম্মাকে ভয় দেখানোর জন্য। আম্মা তো মেয়েদের স্কুলের জন্যে কাজ করেন–এইজন্যে খবিরউদ্দিনের খুব রাগ আম্মার উপরে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। মাঝে মাঝে আম্মার কাছে চিঠি লেখে খবিরউদ্দিনের দলবল।”
“কী লেখা থাকে চিঠিতে?”
“জানি না–আম্মা আমাকে কখনো দেখায় না। নানারকম ভয়ের জিনিস থাকে তো!”
গাব্বু একটা চিউয়িংগাম চিবুতে চিবুতে সুমি আর বুবুনের কথা শুনছিল, এবারে এগিয়ে এসে চোখ বড় বড় করে বলল, “ইশ! কী মজাটাই-না হবে!”
সুমি অবাক হয়ে বলল, “কখন মজা হবে?”
“যখন বুবুনকে ধরে নিয়ে যাবে।”
“মজা হবে?”বুবুন একটু রেগে গেল, “মজা হবে কেন?”
“খালি ডিটেকটিভ বইয়ে পড়েছি মানুষকে কিডন্যাপ করে নেয়, তাকে যখন নেবে তখন সত্যি সত্যি দেখব।”
“সেটা মজা হল?”
“মজা হবে না। আমরা সবাই মিলে তোকে উদ্ধার করে আনব। একেবারে অ্যাডভেঞ্চার বইয়ের মতো!”
“আর যদি না পারিস? আমার রগ যদি কেটে ফেলে?”
“ধুর! রগ কাটতে দেব নাকি আমরা! তার আগেই তোকে উদ্ধার করে ফেলব না?”
পিয়াল বলল, “গাব্বু ঠিকই বলেছে। আসলেই যদি তোকে কিডন্যাপ করে নেয় আর আমরা যদি তোকে উদ্ধার করি কী মজাটাই-না হবে!”
সুমিও মাথা নাড়ল, “সেটা ঠিক।”
গাব্বু পিচিক করে থুতুর সাথে চিউয়িংগামটা ফেলে দিয়ে বলল, “আমাদের জীবনটা একেবারে পানশে হয়ে গেছে। কোনোই আনন্দ নাই। কিছু-একটা না হলে আর মজা লাগছে না। সত্যি সত্যি তোকে কিডন্যাপ করবে তো?”
বুবুন হেসে ফেলল, “তোকে মজা লাগানোর জন্যে আমাকে কিডন্যাপ হতে হবে?”
পিয়াল হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বলল, “আমরা আগে থেকে শুরু করতে পারি না?”
সুমি ভুরু কুঁচকে বলল, “আগে থেকে কী শুরু করবি?”
“মনে কর পিয়ালকে হাইজ্যাক করে নিল। তখন আমাদের কী করতে হবে?”
সুমি মাথা চুলকাল, “ইয়ে, সেটা তো বলা মুশকিল!”
“দেখলি তুই জানিস না! তার মানে যদি সত্যি সত্যি বুবুনকে ধরে নিয়ে যায় তখন কী করতে হবে আমরা বুঝতেই পারব না। কাজেই আগে থেকে যদি কাজ এগিয়ে রাখি–”
গাব্বু হাতে কিল দিয়ে আনন্দে হেসে ফেলে বলল, “ঠিক বলেছিস। এখন থেকেই শুরু করে দিই! বুবুনকে হাইজ্যাক না করলেও ক্ষতি নাই–আমরা ধরে নেব হাইজ্যাক হয়ে গেছে।”
“কিন্তু কী করা শুরু করবি?”
পিয়াল মুখ গম্ভীর করে বলল, “যেমন মনে কর আমরা একটা ওয়ারলেস ট্রান্সমিটার তৈরি করে ফেলতে পারি। সেইটা বুবুনের পকেটে থাকবে, কাজেই তাকে যেখানেই নেবে আমরা বাইরে থেকে সেটা বুঝে ফেলব।”
সুমি ভুরু কুঁচকে বলল, “বানাতে পারবি তুই?” পিয়াল মুখে তাচ্ছিল্যের একটা ভাব করে বলল, “এইটা বানানো কঠিন কী? একেবারে পানিভাত! আমার কাছে সার্কিট আছে।”
গাব্বু বলল, “আমরা আগে থেকে খবিরউদ্দিনের দলবলের লিস্ট করে ফেলতে পারি।”
পিয়াল মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। তা হলে যখন পুলিশ ধরতে আসবে তখন কাকে কাকে ধরতে হবে বুঝতে কোনো অসুবিধাই হবে না।”
গাব্বুর চোখ চকচক করতে থাকে, “আমাদের যখন ফাঁইট দিতে হবে তখন ব্যবহার করার জন্য কিছু ডেঞ্জারাস অস্ত্র জোগাড় করতে পারি।”
“হ্যাঁ, আর বুবুন যেন পালিয়ে আসতে পারে সেইজন্যে তার হাতে একটা হ্যাঁকস দিতে হবে। শিকল কেটে চলে আসতে পারবে। তার সাথে টর্চলাইট। আর চাকু।”
গাব্বু জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তার সাথে কয়েকটা পেট্রোল বোমা।”
বুবুন চোখ কপালে তুলে বলল, “পেট্রোল বোমা?”
“হ্যাঁ। পেট্রোল বোমা ছাড়া কোন অ্যাডভেঞ্চার করাই ঠিক না।”
বুবুন বলল, “আসলে যদি খবিরউদ্দিনের আস্তানাগুলো আগে থেকে বের করে রাখতে পারি তা হলেই অনেক বড় কাজ হবে।”
পিয়াল বলল, “মুশকিল হল আমরা তো খবিরউদ্দিনকেই কোনোদিন দেখি নাই।”
বুবুন হঠাৎ চমকে উঠে বলল, “কিন্তু আমরা তো তার এক সাগরেদকে দেখেছি, মনে নেই?”
“কোন সাগরেদ?”
“ঐ যে টিলার উপরে দেখেছিলাম ইঁদুরের মতো দেখতে! আমরা শিয়াল দেখতে গিয়ে ফিরে আসছিলাম, তখন একজন জিজ্ঞেস করল রওশান নামের মেয়েলোকটার বাসা কোথায়?”
পিয়াল বলল, “ও! ও! সেই লোকটা? আমি তো ওকে আরও দেখেছি?”
“কোথায় দেখেছ?””আমাদের স্কুলের সামনে যে একটা ফার্মেসি আছে সেখানে বসেছিল।”
সুমি চোখ বড় বড় করে বলল, “মনে হয় বুবুনকে হাইজ্যাক করার জন্যে এসেছিল।”
“হতে পারে।”
বুবুন গম্ভীর হয়ে বলল, “আম্মা বলেছে, এদেরকে কোনো বিশ্বাস নাই।’
“খুব সাবধানে থাকতে হবে বুবুনকে।” সুমি গম্ভীর হয়ে বলল, “পাহারা দিয়ে রাখতে হবে সবসময়।”
গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “কাছে এসে দেখুক না, লাথি মেরে হাঁটুর জয়েন্ট খুলে দেব।”
সেদিন সন্ধ্যেবেলা অনেকদিন পর ডক্টর রাজীব হাসান আব্বাকে দেখতে এলেন। দুজনেই দুজনকে দেখে খুব খুশি হয়ে উঠলেন, রাজীব হাসান আব্বার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, “ভালো আছ মাসুদ?”
“জি ডাক্তার সাহেব, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ, আমিও ভালো আছি।”
“আমার গাছগুলোও ভালো আছে? বারান্দার পাশে যেগুলো লাগিয়েছিলাম?”
“হ্যাঁ, সেইগুলো ভালো আছে। এত বড় বড় ফুল ফুটেছে, তুমি থাকলে নিশ্চয়ই আরও বড় ফুল ফুটত।”
“আর পিছনেরগুলো?”
”সেগুলোও ভালো আছে। এখন তুমি বলো এখানে তোমার কেমন লাগছে।”
“ভালোই লাগছে। তবে—”
”তবে কী?”
“বাচ্চাদের সবসময় দেখে রাখতে হয়। বুবুনের বন্ধুরা আছে, তাদের মাথায় একবারে বুদ্ধি নাই।”
“বুদ্ধি নাই?”
“না, সবসময় উলটাপালটা কাজ করে বিপদে পড়ে যায়।” আব্বা মুখ গম্ভীর করে মাথা নাড়তে লাগলেন।
“তাই নাকি?”
“জি। আমি না থাকলে আরও বড় বিপদে পড়ে যাবে।”
“তা হলে তো তোমার থাকতেই হবে।”
“মনে হচ্ছে আরও কিছুদিন থাকতে হবে। তা ছাড়া এখানে একটা বাগান শুরু করেছি সেটারও দেখাশোনা করা দরকার। মাটি ভালো না এখানে।”
রাজীব হাসান মুচকি হেসে বললেন, “তোমার স্ত্রীর সাথে ভাব হয়েছে?”
আব্বাকে এক মুহূর্তের জন্যে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখাল, “স্ত্রী?” পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “ও! বুবুনের আম্মা?”
“হ্যাঁ।”
“একটু একটু হয়েছে। খুব ব্যস্ত থাকে তো, বাসায় আসতে আসতেই রাত হয়ে যায়।”
ডাক্তার রাজীব হাসান আব্বার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তাঁকে পরীক্ষা করলেন, চেয়ারে বসিয়ে হাঁটুর মাঝে ঠোকা দেওয়া, চোখের মণির দিকে তাকিয়ে দেখা, হাতের আঙুল পায়ের আঙুল টিপে টিপে দেখা এই ধরনের নানারকম পরীক্ষা। সবকিছু দেখে ডাক্তার রাজীব হাসান খুব খুশি হয়ে বললেন, “তোমার আর কোনো চিন্তা নেই মাসুদ। এইভাবে যদি আরও কিছুদিন চলতে থাকে তোমার শরীর একেবারে ঠিক হয়ে যাবে।”
আম্মা একটু পরেই এলেন, তাঁকে অফিসের গাড়ি নামিয়ে দিতে এসেছে। সাথে জাহিদ চাচাও ছিলেন, আম্মা তাঁকেও নামিয়ে নিলেন। রাতে সবাই একসাথে খেল, আগে থেকে ঠিক করা ছিল না বলে আয়োজন খুব সামান্য, কিন্তু সবাই খুব মজা করে খেল। খেতে খেতে খবিরউদ্দিনের কাজকর্মের কথা শুরু হল। আব্বা খানিকক্ষণ শুনে বললেন, “খবিরউদ্দিন কে?”
আম্মা বললেন, “একজন খুব খারাপ মানুষ।”
আব্বা বললেন, “ও।”
আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, “কেন খারাপ শুনবে না?”
“কেন খারাপ?”
আম্মা বলতে শুরু করেছিলেন তখন বুবুন বলল, “আম্মা তুমি ঠিক করে বলতে পারবে না, জাহিদ চাচা খুব সুন্দর করে বলেন। জাহিদ চাচা আপনি বলেন–”
জাহিদ চাচা হেসে চোখ পাকিয়ে হাত-পা নেড়ে বক্তৃতার মতো করে বলতে শুরু করলেন, “উনিশ শো একাত্তর সালের রাজাকার কমান্ডার, জামাতে ইসলামীর লিডার, এন-জিও-বিরোধী, নারীশিক্ষা বিরোধী, ফতোয়াবাজ, ধর্মব্যবসায়ী রগকাটা নেতা খবিরউদ্দিন বদের হাঁড়ি—”
জাহিদ চাচার কথা শুনে সবাই হাসতে শুরু করল, আব্বা হাসিতে যোগ না দিয়ে খুব চিন্তিত মুখে আম্মা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
পরদিন স্কুলে যাবার সময় পিয়াল তার পকেট থেকে একটা ছোট পকেট রেডিও বের করে বুবুনকে দিয়ে বলল, “শোন।”
“কী শুনব? ক্রিকেট খেলা আছে নাকি?”
“না, ক্রিকেট খেলা না। এফ. এম. ট্রান্সমিটার তৈরি হয়ে গেছে, দুইশো মিটার দূর থেকে শুনতে পারবি।”
বুবুন রেডিওটা অন করতেই সেটা কটকট শব্দ করতে শুরু করল। পিয়াল বুক-পকেট থেকে আরেকটা ছোট সার্কিট বোর্ড বের করে বলল, “এই যে আমার ট্রান্সমিটার। এইখানে থেকে সিগনাল আসছে।”
“ধুর!” গাব্বু মুখ বাঁকা করে বলল, “গুল মারছিস!”
“বিশ্বাস করলি না? এই দ্যাখ–বলে পিয়াল কোথায় জানি কানেকশান খুলে নিতেই কটকট শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। গালুর মুখ হাঁ হয়ে যায়।”তুই নিজে তৈরি করেছিস?”
“নিজে নয়তো কী? আমার কী অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে নাকি! এই দ্যাখ এই যে ভেরিয়েবল রেজিস্টর এটা বাড়িয়ে কমিয়ে কটকট শব্দ তাড়াতাড়ি করা যায়।”
পিয়াল কী-একটা জিনিস ঘুরিয়ে দিতেই কটকট শব্দটা খুব দ্রুত হতে শুরু করল আবার উলটোদিকে ঘোরাতেই শব্দটা আস্তে আস্তে হতে লাগল। পিয়াল মুখে একটা দুনিয়া জয় করার ভাব করে বলল, “যদি বুবুন দেখে ভিতরে বিপদ বেশি তা হলে রেজিস্ট্যান্স কমিয়ে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়ে দেবে তখন শব্দ হবে কট কট-কট-কট-কট আবার যদি দেখে অবস্থা নিরাপদ তা হলে রেজিস্ট্যান্স বাড়িয়ে দেবে, তখন শব্দ হবে ক… ট … ক … ট, আমরাও তখন ঢুকে যাব–”
গাব্বু মাথা নাড়ল, “সব অস্ত্রপাতি নিয়ে।”
বুবুন পিয়ালের তৈরি ট্রান্সমিটার হাতে নিয়ে বলল, “কত দূর থেকে এটা কাজ করে?”
“ফাঁকা জায়গা হলে তিন-চারশো মিটার হওয়া কথা। আমি অবিশ্যি পরীক্ষা করে দেখিনি।”
চল পরীক্ষা করে দেখি।”
“চল।”
তখন-তখনই তারা দুই দলে ভাগ হয়ে গেল, এক দল তাড়াতাড়ি সামনে হেঁটে গেল, অন্য দল পিছনে দাঁড়িয়ে রইল, দেখা গেল প্রায় আধ কিলোমিটার সামনে চলে যাবার পরেও শব্দ বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
বিকেলবেলা স্কুল ছুটির পর সবাই বাসার দিকে রওনা দিয়েছে হঠাৎ পিয়াল চাপা গলায় বলল, “সর্বনাশ!”
গাব্বু ভয় পেয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
“ঐ লোকটা!”
“কোন লোকটা!”
পিয়াল চাপা গলায় বলল, “ঐ যে টিলার উপরে ছিল। বুবুনের বাসার খোঁজ নিচ্ছিল। ইঁদুরের মতো দেখতে
সুমি বলল, “খবরদার কেউ ঘুরে তাকাবি না। কিছুই হয়নি এরকম ভাব করে হেঁটে যা।”
সবাই খুব স্বাভাবিক ভঙ্গি করে হাঁটতে লাগল। সুমি চাপা গলায় বলল, “পিয়াল, লোকটা কি আমাদের পিছনে পিছনে আসছে? তুই তাকিয়ে দ্যাখ, লোকটা যেন বুঝতে না পারে সেভাবে তাকাবি।”
পিয়াল সাবধানে চোখের কোন দিয়ে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ আসছে। সাথে আরও একজন আসছে।”
“কীরকম দেখতে?”
“কালো দাড়ি। খাটাশের মতো চেহারা।”
“সবাই স্বাভাবিক ভঙ্গি করে হাঁটতে থাক। দেখে যেন সন্দেহ না করে।”
সবাই স্বাভাবিক ভঙ্গি করে হাঁটতে থাকল, ছোট রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় ওঠার পরেও লোক দুইজন পিছনে পিছনে আসতে লাগল, দেখে কোনো সন্দেহই রইল না যে মানুষগুলো ওদের পিছনে পিছনে আসছে। সুমি বলল, “গাব্বু আর পিয়াল। তোরা এই দোকানে থেমে যাবি ভান করবি দোকান থেকে কিছু কিনছিস। আমরা হাঁটতে থাকব।”
“কী লাভ তা হলে?”
“তোরা মানুষ দুইজনের পিছনে চলে যাবি। তা হলে দেখতে পারবি কী করছি। বিপদ দেখলে সাবধান করতে পারবি।”
“ঠিক আছে।”
“আমরা মানুষ দুইজনকে খসিয়ে দেবার চেষ্টা করব।”
“কীভাবে?”
“হঠাৎ দৌড়ে কোনো একটা গলিতে ঢুকে যাব।”
“তখন আমরা কী করব?”
“তোরা পারলে মানুষ দুজনকে ফলো করবি–দেখিস কোথায় যায়।”
“ঠিক আছে।”
পিয়াল আর গাঙ্কু একটা দোকানে থেমে গেল, ভান করতে লাগল সেই দোকান থেকে কিছু কিনবে। সামনে একটা গলি, ইচ্ছে করলে এই গলিটা দিয়েও বেশ খানিকটা ঘুরে বাসায় যাওয়া যায়। সুমি ফিসফিস করে বুবুনকে বলল, “গলিটার কাছে এসে হঠাৎ করে ভিতরে ছুট দিবি।”
বুবুনের বুক ধ্বকধ্বক করছে, কোনোমতে ঢোক গিলে বলল, “ঠিক আছে।”
দুজনে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে যেন কিছুই হয়নি সেইভাবে হেঁটে যেতে থাকে। হঠাৎ মনে হল পিছন থেকে একটা মাইক্রোবাস এসে থামল। বুবুনের চোখের কোনা দিয়ে দেখল হঠাৎ করে একজন মানুষ তার দুই হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাকে ধরার জন্যে। সত্যিই মানুষটা তাকে ধরতে চাইছে নাকি অন্যকিছু করছে বুবুন সেটা আর যাচাই করার জন্যে অপেক্ষা করল না। হঠাৎ করে ঝটকা মেরে মানুষটির হাতের নাগালের বাইরে সরে গিয়ে এক দৌড়ে গলির মাঝে ঢুকে গেল। সুমি পিছনে পিছনে ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে বলল, “পালা!”
পিছনে অনেক কয়জন মানুষের পায়ের শব্দ এবং গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেল কিন্তু বুবুন বা সুমির পিছনে ঘুরে তাকানোর সাহস হল না। দুজনে প্রাণপণে ছুটতে থাকে, পিছনে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে দৌড়ানো খুব সোজা ব্যাপার নয় কিন্তু সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ ডানদিকে আরেকটা সরু গলি দেখা গেল, দুজন মানুষ কষ্ট করে যেতে পারে এরকম। সুমি চাপা গলায় বলল, “ডানদিকে!”
বুবুন সুমির পিছনে পিছনে গলিতে ঢুকে গেল। আঁকাবাকা গলি সেদিক দিয়ে আরও খানিকক্ষণ দৌড়ে একটা বাসায় পিছনে লুকিয়ে দুজনে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে। বুবুন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “কী মনে হয়? লোকগুলোকে খসাতে পেরেছি?”
সুমি সাবধানে মাথা বের করে পিছনে উঁকি মারার চেষ্টা করতে করতে বলল, “মনে হয় পেরেছি। কাউকে তো দেখি না?”
“মাইক্রোবাসটা কি আমাকে ধরতে এসেছিল?”
“তাই তো মনে হয়।”
“খুব বাচা বেঁচে গেছি। কী সর্বনাশ!”
“সুমি কোনো কথা না বলে খুব চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইল!”
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে দুজনে আবার হাঁটতে শুরু করে। একটু পরে পরে পিছনে তাকাচ্ছিল কাউকে দেখা যায় কি না দেখতে। অনেক রাস্তা ঘুরে তারা শেষ পর্যন্ত বাসায় পৌঁছাল। দেরি দেখে সুমির আম্মা চিন্তা করছিলেন, তাদের দেখে নিশ্চিন্ত হলেন। বুবুনের বাসায় আম্মা নেই, আব্বা সাধারণত বাইরে বাগানে কাজ করেন, আজকে আব্বাকেও দেখা গেল না। এখানকার মাটি খারাপ বলে মাঝে মাঝে টিলার কাছ থেকে মাটি আনতে যান, এখনও সেরকম কোথাও গিয়েছেন হয়তো। গাব্বু আর পিয়ালকে দেখা গেল না, এখনও বাসায় আসেনি।
রাস্তায় যে বুবুনকে প্রায় ধরে নিয়ে যাচ্ছিল সেই কথাটা কাউকে বলা হল না, আম্মা এলে আম্মাকে বলা যেতে পারে। অন্যেরা কথাটা মনেহয় বিশ্বাস করবে না, আর যদি বা বিশ্বাস করে পুরো দোষটা তাদের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া হবে। কিছু-কিছু ব্যাপারে বড়মানুষেরা খুব চিবিত্র।
আরো ঘণ্টাখানেক পরে গাব্বু আর পিয়াল ফিরে এল, তাদের দুজনকেই খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে। গাব্বু হাতে কিল দিয়ে বলল, “পেয়ে গেছি!”
“কী পেয়েছিস?”
“খবিরউদ্দিনের ঘাটি।”
“কেমন করে পেয়েছিস?”
“বলছি, শোন।”
গাব্বুর কথা বলার ধরন ভালো না, কোনোকিছু গুছিয়ে বলতে পারে না। ছোট একটা জিনিস নিয়ে মাথা-গরম করে সেটা নিয়েই চেঁচামেচি করতে থাকে। সেদিক দিয়ে পিয়াল আবার অন্যরকম, অল্প খানিকটা বলেই থেমে যায়, ধরে নেয় সেটা থেকেই সবাই সবকিছু বুঝে নেবে।
দুজনের কথা থেকে যেটুকু বোঝা গেল সেটা এরকম: এরা যখন দোকান থেকে কিছু কিনবে ভান করে মানুষ দুজনের পিছনে চলে এল তার একটু পরেই একটা সাদা রঙের মাইক্রোবাস এসে থামল বুবুনকে ধরার জন্যে। ঠিক যখন ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলবে তখন বুবুন আর সুমি দৌড়ে গলিতে ঢুকে গেল–মানুষগুলো তখন একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, ওরা তো জানে না বুবুন আর সুমি এরকম একটা জিনিসের জন্যে তৈরি হয়ে আছে!
মাইক্রোবাসটা ঘুরিয়ে গলিতে ঢোকানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে আবার বের হয়ে এল। তখন কালো দাড়িওয়ালা মানুষটা মাইক্রোবাসটায় উঠে চলে গেল–গাব্বু আর পিয়াল কিছু করতে না পেরে তার নম্বরটা শুধু টুকে রাখল।
ইঁদুরের মতো মানুষটা তখন শহরের দিকে ফিরে যেতে লাগল। গাব্বু আর পিয়াল তখন তার পিছুপিছু আসতে লাগল। শহরে, ফোন ফ্যাক্স-এর একটা দোকান থেকে কয়েকটা টেলিফোন করল, কাকে করল কী বলল সেটা তারা ধরতে পারেনি। মানুষটা সেখান থেকে বের হয়ে একটা ফার্মেসিতে গেল, সেখান থেকে একটা হার্ডওয়্যারের দোকানে। সেই দোকান থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিল, তখন পিয়াল আর গাব্বও একটা রিকশা নিল, তাদের কপাল ভালো যে পকেটে রিকশাভাড়া ছিল। সেই রিকশা করে মানুষটা শহরের প্রায় বাইরে একটা বাড়িতে হাজির হয়। বাড়িটা নির্জন একটা জায়গায়, চারিদিকে দেয়াল, সামনে বড় গেট। সেই গেটে অনেক বড় তালা ঝুলছে। মানুষটা সেই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চারিদিকে খুব সন্দেহের চোখে তাকাল, গাব্বু আর পিয়ালের কপাল ভালো, কারণ তারা ততক্ষণে রিকশা থেকে নেমে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেছে।
একটু পরে ভিতর থেকে একজন মানুষ গেট খুলে দিল, তখন তারা দেখতে পেল ভিতরে সেই মাইক্রোবাসটা দাঁড়িয়ে আছে, নম্বরটা টুকে রেখেছিল বলে বুঝতে কোনো অসুবিধে হয়নি!
গাব্বু আর পিয়াল দূর থেকে বাসাটা ভালো করে দেখে চলে এসেছে, আসার সময় কাছাকাছি দোকানে, এক-দুইজন মানুষকে জিজ্ঞেস করেছে বাসাটা কার, তারা কেউ বলতে পারেনি। সবার ধারণা বাসাটাতে কেউ থাকে না, খালি পড়ে থাকে। তবে গাব্বু আর পিয়ালের মনে এতটুকু সন্দেহ নেই যে বুবুনকে যদি ধরতে পারত তা হলে এই বাসাতেই নিয়ে আসত।
গাব্বু আর পিয়ালের গল্প শেষ হবার পর চারজনই খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। সত্যি সত্যি যদি খবিরউদ্দিনের দলবল বুবুনকে ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে থাকে তা হলে আসলেই খুব ভয়ের কথা। কিছু-একটা করা না হলে বুবুনের তো স্কুলে যাওয়াই বন্ধ করে দিতে হবে।
স্কুল থেকে দেরি করে এসেছে বলে গাব্বু আর পিয়াল তাড়াতাড়ি বাসায় চলে গেল। সুমিও কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেল, বুবুন একা একা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে রইল। আব্বা কোথায় গেছেন কে জানে, আব্বা চলে এলে গল্পগুজব করা যেত। টিলার দিকে গিয়ে দেখে আসা যায় আব্বা কোথায় আছেন, কিন্তু আজকের ঘটনার পর একা একা যাওয়ার সাহস করছে না।
আস্তে আস্তে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল তখনও আব্বার দেখা নেই। এবার বুবুনের একটু একটু ভয় লাগতে থাকে। কোথায় গেছেন আব্বা? একা একা বের হয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেননি তো? একেবারে বাচ্চা একজন মানুষের মতো–যদি কিছু-একটা বিপদ হয় তখন কী হবে?
ঠিক সন্ধ্যেবেলা আম্মা ফিরে এলেন, গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে জাহিদ চাচা বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী খবর ইয়ংম্যান।”
বুবুন বলল, “খবর ভালো না।”
জাহিদ চাচা ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী হয়েছে?”
“আজকে কয়েকজন লোক আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করছিল।”
আম্মা আর জাহিদ চাচা একসাথে চিৎকার করে উঠলেন, কী বলছ!”
“হ্যাঁ। তাছাড়া আব্বাকে দেখছি না বিকাল থেকে।”
জাহিদ চাচা গাড়ি থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে পড়লেন।”কোথায় গিয়েছেন?”
“জানি না।”
আম্মা হঠাৎ কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। তাঁকে দেখে মনে হতে লাগল যে তার বুকের ভিতরে কোনো ধরনের যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছিল বুঝি পড়ে যাবেন, কোনোভাবে গাড়ির জানালা ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “বুবুন বাবা, কাছে আয়।”
বুবুন আম্মার কাছে এগিয়ে গেল, আম্মা কীরকম জানি শক্ত করে তাকে ধরে ফেলে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোকে কখন কিডন্যাপ করতে চেষ্টা করছিল? কীভাবে? কোথায়?”
বুবুন মাত্র বলতে শুরু করেছে ঠিক তখন আট-নয় বছরের একটি ছেলে হাতে একটা ঠোঙা নিয়ে এসে হাজির হল। ছেলেটা আম্মাকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে রওশান কার নাম?”
আম্মা বললেন, “আমার নাম। কেন, কী হয়েছে?”
ছেলেটা ঠোঙাটা আম্মার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে এইটা আপনারে দিতে বলেছে।”
“কে বলেছে?”
“একটা লোক। আমারে দশ টাকা দিছে।”
আম্মা কেমন জানি বিবর্ণ হয়ে ঠোঙাটা নিয়ে খুললেন, ভিতরে ভঁজ-করা একটা কাগজ। কাগজটা খুলে আবো-অন্ধকারে পড়ার চেষ্টা করলেন। বুবুন জিজ্ঞেন করল, “কী লেখা আম্মা?”
আম্মা বিড়বিড় করে পড়লেন, “এইবার ঠোঙাটা খালি। কাল ভোরের মাঝে তুমি যদি এই এলাকা ছেড়ে না যাও অরেকটা ঠোঙা পাঠাব, সেই ঠোঙায় থাকবে তোমার স্বামীর একটা আঙুল। কাল রাতের মাঝে যদি না যাও যে-ঠোঙাটা আসবে সেটা হবে আরও বড় কারণ তার মাঝে থাকবে তোমার বেকুব স্বামীর মাথা! আল্লাহর কসম আমরা বাজে কথা বলি না।”
আম্মা একটা চাপা আর্তনাদ করে উঠলেন, বুবুনের মাথা ঘুরে উঠল হঠাৎ তার আব্বাকে ধরে নিয়ে গেছে খবিরউদ্দিনের লোক!
জাহিদ চাচা বললেন, “দেখি চিঠিটা!”
“আরও একটা লাইন আছে।” আম্মা কাঁপা গলায় পড়লেন শেষ লাইনটা, “এই চিঠির কথা যদি জানাজানি হয় বড় ঠোঙাটা কাল ভোরেই চলে আসবে।”
আম্মা অপ্রকৃতিস্থের মতো তাকালেন, বুবুন অবাক হয়ে দেখল, আম্মা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না বুবুনকে ধরে হঠাৎ মাটিতে উবু হয়ে পড়ে গেলেন।