Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রাতে বিছানায় শুয়ে বুবুন আম্মাকে জিজ্ঞেস করল, “আম্মা, তোমার আজকাল বাসায় আসতে এত দেরি হয় কেন?”

“বদমাইশগুলো খুব খেপেছে তো, তাই কাজ বেড়ে গেছে।”

আম্মা বদমাইশ বলতে কাঁদের বোঝাচ্ছেন বুবুন জানে–তারা হচ্ছে খবিরউদ্দিন আর তার দলবল। সে জিজ্ঞেস করল, “কী করে আম্মা?”

“একটা মেয়েদের স্কুল পুড়িয়ে দেয়, নাহলে কোনো স্কুলে যায় বলে কাফের বলে ফতোয়া দিয়ে দেয়, এইসব ভণ্ডামি।” আম্মা দাঁত-কিড়মিড় করে বললেন, “ইচ্ছে করে সবগুলোর মুখ ছিঁড়ে ফেলি।”

আম্মা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন, কেমন জানি ক্লান্তির নিঃশ্বাস। বুবুনের আম্মার জন্যে এত মায়া লাগল সেটি আর বলার মতো নয়। আম্মা মানুষটি যে এত একা বুবুন সেটা আগে কখনোই টের পায়নি, আব্বা আসার পর বুঝতে পেরেছে। বুবুন যখন কখনো কখনো সুমির বাসায় যায়, দেখে সুমির আব্বা আর আম্মা বসে বসে গল্প করছেন, হাসিঠাট্টা করছেন, মাঝে মাঝে বিকেলবেলা দুজনে গল্প করতে করতে হাঁটতে বের হন। দেখে কী ভালোই না লাগে! অথচ তার আব্বা থেকেও নেই, আম্মা একেবারে একা। আব্বা মানুষটা একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো, বুবুন যেসব জিনিস নিয়ে কথা বলে আব্বাও ঠিক একই জিনিস নিয়ে কথা বলেন! আম্মার কথা বলার কোনো মানুষ নেই। রাত দশটা বাজতে -বাজতেই আব্বা দাঁত মেজে বিছানায় শুয়ে পড়েন। যদি কোনোভাবে আব্বার স্মৃতি ফিরিয়ে আনা যেত কী মজাটাই-না হত! আগেরবারের চেষ্টাটা একেবারে মাঠে মারা গেছে, কিন্তু তাই বলে কি হাল ছেড়ে দেওয়া যায়? আবার চেষ্টা করতে হবে, কী দিয়ে চেষ্টা করবে সেটা ঠিক করতে হবে। বুবুন আম্মার গলা জড়িয়ে ডাকল, “আম্মা”

“ঘুমিয়ে গেছ?”

“ঘুমুতে দিচ্ছিস কই!”

“একটা গল্প বলো-না আম্মা!”

“গল্প? এখন? তোর মাথা-খারাপ হয়ে গেছে?”

“আব্বার গল্প।”

আম্মা অন্ধকারেই বুবুনের দিকে তাকালেন, “আব্বার গল্প?”

“হ্যাঁ, আব্বা যখন ভালো ছিলেন তখন কী করতেন সেই গল্প?”

“কেন? সেই গল্প এখন কেন?”

“এমনি শুনতে ইচ্ছা করে। বলো-না!”

বুবুন ভেবেছিল এই মাঝরাতে আম্মা নিশ্চয়ই গল্প বলবেন না কিন্তু কী ভেবে সত্যি সত্যি গল্প বলতে লাগলেন। আমেরিকায় যখন পিএইচ. ডি. করছেন তখন বাসায় বেড়াতে এসেছে বন্ধুবান্ধব। একজন একটু চালবাজ ধরনের মানুষ, শুধু বড় বড় কথা বলছিল, রাতে আব্বা মুখোশ পরে তাকে কীভাবে ভয় দেখালেন সেই গল্প। শুনে হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়ে গেল বুবুন।

পরদিন খুব ভোরে জাহিদ চাচা এবং আরও কয়েকজন মহিলা এসে হাজির। তাদের সবারই কিছু-একটা ব্যাপার হয়েছে, আম্মার সাথে চাপা গলায় গম্ভীরমুখে সবাই কিছু-একটা আলোচনা করলেন, তারপর সবাই মিলে নাশতা না করেই বের হয়ে গেলেন।

বুবুন আব্বাকে আবিষ্কার করল বাসার বাইরে। চারিদিকে অযত্নে কিছু ফুলগাছ লাগানো ছিল, আব্বা সেগুলো ঠিক করতে শুরু করেছেন। আব্বা যখন ডাক্তার রাজীব হাসানের কাছে ছিলেন তখন নাকি শুধু ফুলগাছ নিয়েই থাকতেন। বুবুন বেশ খানিকক্ষণ আব্বার সাথে সাথে ফুলগাছের নিচে মাটি নিড়িয়ে দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার, শুকনো পাতা, মরা ডাল কেটে দেওয়া এইসব দেখল। আব্বা এই কাজগুলো করেন খুব যত্ন করে, দেখে মনে হয় ফুলগাছ নয় যেন একটা ছোট বাচ্চাকে আদর করছেন। আব্বাকে দেখে বুবুন আরও একটা মজার জিনিস আবিষ্কার করল, আব্বা কথা বলতে বলতে কাজ করতে পারেন না। বুবুন যখন কিছু-একটা জিজ্ঞেস করে, আব্বা তখন কাজ বন্ধ করে ঘুরে বুবুনের দিকে তাকান এবং উত্তর দেন। উত্তর দেওয়া শেষ হলে আবার কাজ শুরু করেন। কিন্তু প্রায় সময়েই দেখা যায় আগে কী করছিলেন সেটা এর মাঝে ভুলে গেছেন, নতুন করে অন্য একটা-কিছু করতে শুরু করেছেন! দেখে বুবুনের আব্বার জন্যে ভারি মায়া লাগতে থাকে, সে আব্বাকে একা একা কাজ করতে দিয়ে হাঁটতে বের হল।

হেঁটে হেঁটে সুমিদের বাসায় কাছে এসে সে দেখতে পেল সুমি বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আচার খেতে খেতে একটা বই পড়ছে। বুবুনকে দেখে মুখ তুলে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”

“কোথাও না। এমনি–”

”এমনি কী?””মনটা বেশি ভালো না তাই–”

“মন ভালো না?” সুমি অবাক হয়ে বলল, “মন আবার ভালো না হয় কেমন করে?” কী হয়েছে?”

“না, কিছু না।” বুবুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “যাই, হেঁটে আসি।”

বুবুন পকেটে হাত দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করছিল, সুমি তখন বই বন্ধ করে উঠে এল। হাতের আচারটুকু বুবুনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে খা। আচার খা। মন ভালো হবে।”

“না।” বুবুন মাথা নাড়ল, “আমার আচার ভালো লাগে না।”

“আচার ভালো লাগে না?” সুমি চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বলছিস

“দাঁত টক হয়ে যায়।”

সুমি আঙুল চেটে খেতে খেতে বলল, “সেটাই তো মজা!”

বুবুন কোনো কথা বলল না, সুমি জিজ্ঞেস করল, “এখন বল তোর মন খারাপ কেন?”

বুবুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ব্যাপারটা হচ্ছে আম্মাকে নিয়ে।”

“কী হয়েছে চাচির?”

“কিছু হয়নি, কিন্তু এই মেয়েদের স্কুল, নারী নির্যাতন, ফতোয়াবাজি এইসব নিয়ে একেবারে সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত ঘুরতে থাকেন। কোনো

কোনো দিন বাসায় আসতে আসতে রাত দশটা বেজে যায়।”

“হু।” সুমি মাথা নাড়ল,”চাচির খুব খাটনি হয়।”

“কিন্তু খাটনিটা তো ঠিক আছে। আম্মা একেবারে মোঘের মতো খাটতে পারে। একজন মানুষ যখন এত পরিশ্রম করে রাতে ফিরে আসে তখন তার কি একটু কথাবার্তা বলার ইচ্ছা করে না?”

সুমি মাথা নাড়ল। বুবুন বলতে লাগল, “সমান-সমান একজন মানুষের সাথে কথা বলার ইচ্ছা করে। কিন্তু আম্মার সেই কথা বলার মানুষ নেই। বাসায় এসে একা একা গালে হাত দিয়ে বসে বসে দেখেন আমি আর আব্বা কী করছি!”

কথা বলতে বলতে হঠাৎ বুবুনের চোখে পানি এসে গেল, সে খুব চেষ্টা করল সেটা লুকিয়ে রাখতে, সুমিও এমন ভান করল যেন দেখতে পায়নি। আঙুল চাটতে চাটতে বলল, “তুই মন খারাপ করিস না, চাচার নিশ্চয়ই একসময় সবকিছু মনে পড়ে যাবে। আগের বার এমন ঘাপলা হয়ে গেল–”

“হুঁ।“

“আরেকবার চেষ্টা করতে হবে। এইবারে ঠিক করে প্ল্যান করতে হবে। আগেরবারের মতো আউলাঝাউলা করলে হবে না। প্রথমে চাচার জীবনের একটা ঘটনা জানতে হবে। সেখানে যা যা ঘটেছিল হুবহু সেটাই করতে হবে। তা হলে দেখিস ঝপাং করে সব মনে পড়ে যাবে!”

বুবুন সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, “কাল রাত্রে আম্মা একটা গল্প বলেছেন। যখন আমেরিকা ছিলেন তখন কী হয়েছিল সেই গল্প।”

“কী হয়েছিল?”

আব্বা কীভাবে মুখোশ পরে তাঁর চালবাজ বন্ধুকে ভয় দেখিয়েছিলেন বুবুন সেই গল্পটা সুমিকে খুলে বলল। শুনে সুমি হাতে কিল দিয়ে বলল, “এই তো চাই! এইটাই করতে হবে?”

“এইটাই?”

“হ্যাঁ, বুঝতে পারছিস না এর মাঝে সব আছে। মুখোশ পরে যখন ভয় দেখানো হবে সেই ভয় পেয়ে হঠাৎ করে সবকিছু মনে পড়ে যাবে। ফার্স্টক্লাস! চল গাব্বু আর পিয়ালকে গিয়ে বলি।”

“এখনই?”

“এখন নয় তো কখন? দেরি করে লাভ কী?”

এবারের পরিকল্পনাটা আগেরবার থেকে বেশি যত্ন করে করা হল। গাব্বর একটা রবারের মুখোশ আছে, মুখোশটা পরানো গাল্লুকে, একটা সাদা চাঁদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল সারা শরীর, দুই হাত উপরে তুলে যখন সে হেঁটে আসতে লাগল তাকে দেখতে ভয়ংকর দেখাতে লাগল সত্যি, কিন্তু আরে ছোটখাটো হওয়ায় দেখে কেন জানি ভূত না হয়ে ভূতের বাচ্চার মতো মনে হতে লাগল। সুমি মাথা নেড়ে বলল, “আরও লম্বা হতে হবে।”

গাব্বু বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি এখন লম্বা হব কেমন করে?”

“পিয়াল, তুই পর দেখি।”

পিয়াল মাথা নেড়ে বলল,”আগে মুখোশটা সাবান দিয়ে ধুয়ে আন। ভিতরে গাব্বুর সব জীবাণু আছে–”

“ফাজলেমি করবি না। দাবড়ানি দিয়ে একেবারে ছাড়াভ্যাড়া করে দেব।”

পিয়ালকে মুখোশ পরিয়েও খুব লাভ হল না। বুবুন বলল, “একজনের ঘাড়ে আরেকজন উঠলে হয়।”

সুমি হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস!”

গাব্বু এবং পিয়াল দুইজনেই মাথা নেড়ে প্রবল আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত গাবুকে পিয়ালের ঘাড়ে উঠতে হল এবং এবার সাদা চাঁদর দিয়ে ঢেকে দেবার পর সত্যি সত্যি তাদের দুজনকে একটা সত্যিকারের বিদঘুঁটে ভূতের মতো দেখাতে লাগল। সুমি খুশি হয়ে বলল, “ফার্স্ট ক্লাস!”

বুবুন, সুমি, গাব্বু আর পিয়াল মিলে অনেক সময় নিয়ে পুরো ব্যাপারটা বেশ কয়েকবার প্র্যাকটিস করে নিল। গাব্বু কখন পিয়ালের ঘাড়ে উঠবে, কখন হাঁটবে, তখন সুমি কোথায় থাকবে, বুবুন কী করবে, যদি কোনো-একটা ঝামেলা হয়ে যায় তখন কী করা হবে, বড় মানুষদের এসে গেলে কীভাবে সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে এইরকম খুঁটিনাটি বাদ দেওয়া হল না। কবে ভূত সেজে আব্বাকে ভয় দেখানো হবে সেটা নিয়েও একটু আলোচনা করা হল, দেখা গেল কেউই বেশি দেরি করতে রাজি না, পারলে এখনই করে ফেলে। কিন্তু একজন মানুষকে তো আর দিনের বেলায় ভূতের ভয় দেখানো যায় না অন্তত সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সন্ধ্যেবেলা বাসা থেকে বের হতে হলে একটা জুতসই কৈফিয়তও দিতে হবে। আগেরবার যে-ঝামেলাটা হয়ে গিয়েছিল সেটা জানজানি হয়নি সেটাই ভরসা, তা হলে আর কোনো কথাই কাজে লাগত না।

সন্ধ্যেবেলা পিয়াল খবর নিতে এল যে আব্বাকে ভূত সেজে ভয় দেখানোর ঘটনাটি কী আজকেই করা হবে কি না। আম্মা তখনও আসেননি, আব্বা নিজের ঘরে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা টিকটিকির দিকে তাকিয়ে আছেন, বাসায় আর কেউ নেই কাজেই মনে হয় ভয় দেখানোর জন্যে এটাই ভালো সময়। পিয়াল খবর নিয়ে চলে গেল, কিছুক্ষণের মাঝেই অন্য সবাইকে নিয়ে চলে আসবে। বুবুনের বুকের ভিতর ধক ধক করতে থাকে–আব্বার মতো এরকম ভালোমানুষকে ভয় দেখানো কি ঠিক হচ্ছে? ভয় পেয়ে যদি কিছু-একটা হয়ে যায়? বুবুন জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিল, এটা অনেকটা অসুখ হলে ইনজেকশান দেওয়ার মতো বা পেট কেটে অ্যাপেন্ডিক্স বের করার মতো, জিনিসটা করার সময় কষ্ট হয় কিন্তু করার পর তার ফল হয় ভালো।

বুবুন ঘুরে আরও একবার আব্বাকে দেখে এল, আব্বা এখনও খুব মনোযোগ দিয়ে দেয়ালের টিকটিকির দিকে তাকিয়ে আছেন, টিকটিকি বা ঘাসফড়িঙের মতো জিনিসের মধ্যেই আব্বা কী এত কৌতূহলের ব্যাপার খুঁজে পান কে জানে! কিছুক্ষণের মাঝেই দরজার মাঝে টুকটুক করে শব্দ হল, বুবুন সাবধানে দরজা খুলে দিতেই পিয়াল গাব্বু আর সুমি নিঃশব্দে ঘরের মাঝে ঢুকল। সুমি ফিসফিস করে বলল, “চাচা কোথায়?”

“ঐ ঘরে।”

“সবাই রেডি হয়ে যাও।”

কোনো শব্দ না করে গা মুখোশটা পরে পিয়ালের ঘাড়ের উপরে উঠে গেল। সাদা চাঁদর দিয়ে পুরোটা ঢেকে দেওয়া হল। গাব্বর হাতে একটা মোমবাতি, সেই মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দেওয়া হল। সুমি হাতে একটা দুধের খালি টিন নিয়ে এসেছে, ভিতরে মুখ লাগিয়ে কথা বললে থমথমে একটা আওয়াজ বের হয়। সবকিছু ঠিকঠাক আছে দেখার পর বুবুন বাইরের ঘরে গিয়ে মেইন সুইচটা অফ করে দিল সাথে সাথে সারা বাসা অন্ধকার হয়ে যায়, শুধু করিডোরে পিয়ালের ঘাড়ে বসে থাকা গাব্বর হাতে একটা মোমবাতি টিমটিম করে জ্বলছে।

সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, বুবুন শুনতে পেল আব্বা তার ঘরে বসে থেকে নিজের মনে বললেন, “কারেন্ট চলে গেছে।” খানিকক্ষণ কোনো শব্দ নেই, তারপর আব্বা ডাকলেন, “বুবুন!”

বুবুন কোনো কথা বলল না। সুমি তখন টিনের ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে থমথমে গলায় বলল, “আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগের কথা। ডক্টর রওশানের স্বামী মাসুদ আহমেদ ফিজিক্সে পিএইচ. ডি, করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে।”

আব্বা ভয়-পাওয়া গলায় বললেন, “কে কথা বলে?”

”অতীত কথা বলে। কথা বলে পুরানো দিনের স্মৃতি।”

“বুবুন!” আব্বা ডাকলেন, “বুবুন, তুই কোথায়?”

“সেই সময় একদিন মাসুদ আহমেদের বাসায় এল তাঁর এক বন্ধু। বন্ধুকে ভয় দেখাবেন ঠিক করলেন মাসুদ আহমেদ। তার এই কাজে সহযোগী ছিলেন তার স্ত্রী রওশান।”

আব্বা ভাঙা গলায় ডাকলেন, “বুবুন!”

সুমি বলল, “মুখে মুখোশ পরে ভূত সাজলেন মাসুদ আহমেদ। ভয়ংকর চেহারার ভূত! কেমন ছিল সেই ভূত? তাকে কি দেখতে চান?”

আব্বা ঘর থেকে বের হয়ে এলেন, করিডোরে এসে দেখলেন লম্বা সাদা কাপড় পরা ভয়ংকর দর্শন বীভৎস একটি ভূত দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মোমবাতি জ্বলছে, মোমবাতির সেই ক্ষীণ আলোতে ভূতটির সমস্ত বীভৎসতা যেন একশো গুণ বেড়ে গেছে। সুমি বলল, “আমি ভয় দেখাতে আসিনি মাসুদ আহমেদ। আমি এসেছি স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনতে। মনে আছে এইভাবে ভূত সেজে আপনি ভয় দেখিয়েছিলেন?”

আব্বা কোনো কথা না বলে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছু-একটা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। গাব্বকে ঘাড়ে নিয়ে পিয়াল তখন এক পা এগিয়ে এল। সুমি তার থমথমে গলায় বলল, “মনে আছে? মনে আছে আপনার?”

আগে যেভাবে রিহার্সাল দেওয়া ছিল সেই হিসেবে তখন পিয়ালের আরও এক পা এগিয়ে যাবার কথা, পিয়াল ঠিক সেভাবে সামনে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে তাল হারিয়ে ফেলল, তাল সামলাতে গিয়ে কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেল, পায়ের নিচে চাঁদর আটকে গেল হঠাৎ এবং কিছু বোঝার আগে প্রচণ্ড শব্দে গাব্বকে নিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল পিয়াল। হাতের মোমবাতি ছিটকে পড়ল নিচে, নিভে না গিয়ে সেটা জ্বলতে থাকে একটা কাগজের উপরে, দেখতে দেখতে সেখানে আগুন জ্বলে উঠল। গাব্বু চিৎকার করে উঠল যন্ত্রণায়, পিয়াল বিকট স্বরে আর্তনাদ করতে লাগল, আর আব্বা ডাকতে লাগলেন, “বুবুন! বুবুন!” সুমি গলা ফাটিয়ে চাচাতে লাগল, “আগুন! আগুন!”

বুবুন মেইন সুইচ টিপে আলোটা জ্বালিয়ে দিলেই সমস্যার বড় অংশ মিটে যেত কিন্তু এই বিশাল গোলমালের মাঝে সেটা তার আর মনে পড়ল না, সেও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে অন্ধকারে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল।

আগুন নেভানোর জন্যে অন্ধকারে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খেতে লাগল, তার মাঝে বুবুন হাতড়ে বাথরুম থেকে বালতি দিয়ে পানি এনে ঢেলে দিল আগুনের মাঝে, আগুন নিভে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে গেল সাথে সাথে। ঠিক সেই সময় শুনতে পেল দরজার ধাক্কা দিচ্ছে অনেকে মিলে, বুবুনের মেইন সুইচের কথা মনে পড়ল তখন। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে মেইন সুইচ অন করার চেষ্টা করার কোনো মানে হয় না, আছাড় খেয়ে পড়ে গাব্বু বা পিয়ালের কী অবস্থা হয়েছে কে জানে–বুবুন আগে পরে কিছু চিন্তা না করে দরজা খুলে দিল। বাইরে অনেক মানুষ–অন্ধকারে দেখা যায় না, গলায় স্বর শুনে বুঝতে পারল সেখানে আম্মা আছেন, জাহিদ চাচা আছেন, গাব্বর বড় ভাই, পিয়ালের আব্বা, পাশের বাসার দারোয়ান, আম্মার অফিসের কিছু লোকজন, গাড়ির ড্রাইভার এমনকি মনে হল দুই-একজন পুলিশও আছে। সবাই মিলে চিৎকার করতে লাগল এবং আম্মার গলা উঠল সবার উপরে, “কী হয়েছে? বুবুন কই? মাসুদ কই? চিৎকার করে কে?”

বুবুন বুঝতে পারল তারা এখন যে-বিপদে পড়েছে খোদা নিজে যদি উদ্ধার করেন কেউ তাদের উদ্ধার করতে পারবে না। কী করবে বুঝতে না পেরে সে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল, সবাই হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে গেল, আম্মা তখন ভাঙা গলায় কেমন যেন ভয়-পাওয়া গলায় ডেকে উঠলেন, “বুবুন! বাবা তুই কোথায়?”

“এই তো আম্মা!”

আম্মা হঠাৎ জাপটে ধরে ফেললেন, তারপর ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগলেন, “ভালো আছিস তুই বাবা? ভালো আছিস?”

বুবুন ঠিক বুঝতে পারল না কেন আম্মা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। একজন একটা ম্যাচ জ্বালাল এবং তখন বুবুনের মেইন সুইচের কথা মনে পড়ল। সেটা বলার পর জাহিদ চাচা গিয়ে মেইন সুইচটা অন করতেই সারা বাসাটি আলোকিত হয়ে উঠল চারিদিক এক নজর দেখে বুবুনের হঠাৎ মনে হল অন্ধকারই অনেক ভালো ছিল।

গাঙ্কুর গলা থেকে তখনও সেই ভয়ংকর মুখোশটা ঝুলছে, কপালের খানিকটা কেটে সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে, পিয়ালের গায়ে সাদা চাঁদরটা লেপটে আছে, সেটা পানিতে ভেজা এবং সে মেঝেতে বেকায়দাভাবে শুয়ে আছে। আব্বা খুব কাছেই উবু হয়ে বসে এই দুজনকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন, পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সুমি, হাতের খালি দুধের টিনটা নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। মেঝেতে পোড়া কাগজ এবং পানি থৈথৈ করছে, ঘরের ভিতরে ধোয়ার গন্ধ। সবচেয়ে প্রথমে কথা বললেন, পিয়ালের আব্বা, হুংকার দিয়ে বললেন, “পিয়াল, হারামজাদা উঠে আয়।”

আব্বা উবু হয়ে বসে থেকে বললেন, “পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে।”

পিয়ালের আব্বা তখন কয়েক পা এগিয়ে এসে, “আমি ব্যথা পাওয়ার মজা টের পাওয়াচ্ছি।”

কয়েকজন মিলে তখন পিয়ালের আব্বাকে না থামালে সেখানেই একটা রক্তারক্তি হয়ে যেত। গাব্বর বড় ভাই বলল, “কী হয়েছে এখানে?”

জাহিদ চাচা বললেন, “সেটা আমরা পরে দেখব। এখন দেখা যাক কেউ বেশি ব্যথা পেয়েছে কি না।”

পিয়াল ওঠার চেষ্টা করল, আম্মা এবং জাহিদ চাচা এগিয়ে গেলেন, কিন্তু তার আগেই আব্বাকে ধরে পিয়াল উঠে বসেছে। গাব্বও মুখোশটা খুলে পিছনে দাঁড়িয়ে গেল। সুমি দুধের টিনটা হাতে নিয়েই আব্বার গা-ঘেঁষে দাঁড়াল।

জাহিদ চাচা বললেন, “মনে হচ্ছে কেউ বেশি ব্যথা পায়নি।” গাব্বু কপালের রক্তটা মুছে ফেলে মাথা নাড়ল। আম্মা বললেন, “ব্যথা নয়, এখন যেটা পাচ্ছে সেটা হচ্ছে ভয়।”

পিয়ালের আব্বা হুংকার দিয়ে বললেন, ‘ভয়ের দেখেছ কী? আমি যখন বাপের নাম ভুলিয়ে দেব তখন বুঝবে ভয় কাকে বলে!”

আম্মা হাসার চেষ্টা করে বললেন, “বাচ্চা মানুষ, কিছু-একটা অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে গুবলেট করে ফেলেছে। আমি দেখছি কী হয়েছে!” পিয়ালের আব্বা বললেন, “বাসায় নিয়ে যাই আমি।”

আম্মা বললেন, “আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমরা ওদের বাসায় পৌঁছে দেব।”

আব্বা বললেন, “হ্যাঁ। এখন ওরা খুব ভয় পাচ্ছে। আমাকে ভয় দেখাতে গিয়ে নিজেরাই ভয় পেয়ে গেছে।”

পিয়ালের আব্বা আবার হুংকার দিলেন,”আপনাকে ভয় দেখাতে এসেছিল? আপনাকে?”

আব্বা তাড়াতাড়ি পিয়াল, গাব্বু এবং সুমিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “না-না, এমনি এমনি মিছিমিছি ভয়।” আব্বা তারপর হাসার চেষ্টা করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন পুরো ব্যাপারটিতে ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই। ছোট বাচ্চারা যেভাবে হেসে একটা জটিল ব্যাপারকে সহজ করে দেওয়ার চেষ্টা করে অনেকটা সেরকম।

আম্মা পিয়ালের আব্বাকে বলল, “আপনি বাসায় গিয়ে শান্ত হন, আমরা ওদের দেখছি।”

বাসা থেকে সবাই বের হওয়ামাত্র সুমি আম্মার কাছে এসে বলল, “চাচি। আমি সব পরিষ্কার করে দেব। আপনি বুঝতেই পারবেন না কিছু হয়েছে এখানে।”

আম্মা বললেন, “তোমাকে কিছু করতে হবে না মা। তোমাদের কারও কিছু যে হয়নি তার জন্যেই খোদার কাছে হাজার শোকর।”

আব্বা মাথা নাড়লেন, “হাজার শোকর।”

আম্মা খানিকটা তুলো নিয়ে গাব্বর কপাল পরিষ্কার করতে করতে বললেন, “এখন তো কেউ নেই, বলো দেখি ব্যাপারটি কী হয়েছে?”

কেউ কোনো কথা বলল না। আম্মা মাথা নেড়ে বললেন, “পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে বুবুনের আব্বাকে তোমরা ভয় দেখাতে এসেছিলে কেন?”

সুমি বলল, “আসলে ভয় দেখাতে আসিনি। চাচার যেন সবকিছু মনে পড়ে যায়–”

আম্মা ভুরু কুচকে তাকালেন। বুবুন বলল, “মনে নেই, তুমি যে বলেছিলে আব্বা ভূত সেজে ভয় দেখিয়েছিল? ঠিক সেরকম–”

পিয়াল বলল, “ঠিক সেইরকম করতে যাচ্ছিলাম যেন দেখেই চাচার সবকিছু মনে পড়ে যায়। এই গাধা গাবুটার জন্য”

গাব্বু ফোঁস করে উঠে বলল, “আমাকে দোষ দিচ্ছিস কেন? নিজে আছাড় খেয়ে পড়েছিস আর দোষ আমার?”

আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, “একজনের ঘাড়ে আরেক জনের ওঠা ঠিক হয় নাই। ওজনের চাপে সাইজ ছোট হয়ে যায়।”

আম্মা চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী বললে? একজনের ঘাড়ে আরেকজন উঠেছিলে?”

সুমি বোকার মতো একটু হেসে বলল, “বেশিক্ষণের জন্যে তো না, এই একটু সময়ের জন্যে!”

আম্মা হাল ছেড়ে দেবার চেষ্টা করে বললেন, “তোমরা যে বুবুনের আব্বাকে সবকিছু মনে করানোর চেষ্টা করছ, সেই কাজটা খুবই মহৎ, কিন্তু আর করো না। যদি করতেই চাও অন্যভাবে করো যেখানে কারও ঘাড় ভাঙার ভয় থাকে না, বাড়িতে আগুন লাগার ভয় থাকে না, দুই-চারজন খুন-জখম হওয়ার চান্স থাকে না। ঠিক আছে?”

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”

রাতে ঘুমানোর সময় আম্মা বুবুনকে বললেন, “বুবুন, তোকে একটা কথা বলি।”

আম্মার গলায় স্বর শুনে ভয় পেয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, “কী কথা আম্মা?”

“তুই যখন স্কুলে যাবি স্কুল থেকে বাসায় আসবি বা বাইরে খেলবি তখন কখনো কোনো অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলবি না।”

“কেন আম্মা? কী হয়েছে”

“খুব সাবধানে থাকবি। কখনো একা থাকবি না, সবাই একসাথে থাকবি। সবসময়। ঠিক আছে?”

“কেন আম্মা?”

আম্মা একটা নিঃশ্বাস ফেলেন, তারপর বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঐ যে খবিরউদ্দিন আর তার জামাতি দল আছে না, তারা একেবারে খেপে গেছে। আমাকে থামানোর জন্যে এরা যা খুশি করতে পারে। একাত্তর সালে করেছে না! ইউনিভার্সিটির সব টিচারকে মেরে শেষ করে ফেলেছিল। তাই ভাবছিলাম,

“কী ভাবছিলে?”

“আমাকে ভয় দেখানোর জন্যে যদি তোকে কিডন্যাপ করে নেয়। তাই বলছিলাম খুব সাবধানে থাকবি। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

“আজকে বাসায় এসে যখন দেখলাম এরকম তুলকালাম হচ্ছে আমি ভেবেছিলাম বুঝি তোকে ধরে নিয়ে গেছে, যা ভয়টা পেয়েছিলাম! ওহ!”

বুবুন আম্মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, কেন আজকে এত বড় ঘটনার পরেও আম্মা একটুও রাগ করেননি হঠাৎ করে পরিষ্কার হয়ে গেল বুবুনের কাছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *