Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বুঝেসুঝে বেঁচে থাকা || Samaresh Majumdar

বুঝেসুঝে বেঁচে থাকা || Samaresh Majumdar

কর্তামশাই জমিটা কিনে দিয়ে বলেছিলেন, ‘হারা, সারাজীবন আমাদের বাড়িতে চাকরি করলি, এবার একটু স্বাধীনভাবে থাক। তোর তিরিশ বছরের যত মাইনের টাকা, তা পোস্ট অফিসের খাতায় আছে। খাতাটা নে। আমি বুড়ো হয়ে গেছি, কবে হুট করে চলে যাব। তুই বুঝেসুঝে বেঁচে থাকিস।’

জমির দলিল, পোস্ট অফিসের পাসবুক তার হাতে তুলে দিয়ে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কর্তামশাই। বাড়ির বউদের একটুও সম্মতি ছিল না, তাঁরা চাইছিলেন হারা বাড়িতেই থাকুক। কিন্তু কর্তামশায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস তাঁদের ছিল না। তখন কর্তামশায়ের ছিল শেকড় তোলার সময়। খাঁচায় পোষা সুন্দর পাখিগুলোকে একে-একে ছেড়ে দিলেন। জামা-জুতো কেনা বন্ধ করে দিলেন। বড়ছেলে সাহস করে বলেছিল, ‘হারা তো দশ বছর বয়স থেকেই এ বাড়িতে, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। ওই জমি আর টাকা নিয়ে একা সামলাতে পারবে কি? বেহাত না হয়ে যায়!’

কর্তামশাই বলেছিলেন, ‘সাইকেলে চড়তে গেলে পড়তে হয়, সাঁতার শিখতে গেলে জল খেতে হয়। ওর না হয় সেরকম একটু হবে। তাই বলে একটা মানুষ আর কতকাল গোলাম হয়ে। থাকবে!’

মোট দেড় বিঘে কাঠা জমি। বাস রাস্তা থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ। জমিটা উঁচুতে, নিচে জলঢাকা নদী। জংলা হয়ে পড়েছিল। কর্তাবাবু লোক দিয়ে সেটা পরিষ্কার করিয়ে একটা সুন্দর চালাঘর তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘জমির পেছনে পরিশ্রম দে হারা। জমি তোকে সখাওয়াবে।’

দু-বছর ধরে তারা সেই পরিশ্রম করে গেছে দাঁতে দাঁত চেপে। ভোর থেকে জমির সঙ্গে লড়াই। তাকে তৈরি করতে, শান্ত করতেই কয়েক মাস কেটে গিয়েছিল। তারপর শহর থেকে বীজ কিনে এনে যত্ন করে লাগানো। কাজ করতে-করতে বিকেল হয়ে যেত। তখন কাঠের উনুনে ভাত। চাপাত, সঙ্গে আলু আর ডিম। ডিম তার ভারি পছন্দ। কর্তাবাবুর বাড়িতে সপ্তাহে মাত্র একটা দিন ডিম হত।

তারপর মাটি ছেড়ে গাছগুলো আকাশ দেখতে চাইল। আট কাঠা জমি তখন সবুজে সবুজ। জলঢাকার ওপর থেকে হওয়ারা ছুটে এসে ওদের সঙ্গে খেলা করে অবিরাম। জলঢাকার জলে ওদের স্বাস্থ্য বেশ পুরুষ্টু। কর্তামশাই দেখতে এলেন। গাড়ি জমি অবধি আসে না। ধরে-ধরে নিয়ে আসতে হল। গাছগাছালির দিকে তাকিয়ে শিশুর মতো হাসলেন, চোখের ওপরে হাত তুলে দেখলেন, ‘ওরে হারা, সবুজ হয়ে আছে রে তোর বাগান। কী-কী লাগিয়েছিস?’

হারা হাতজোড় করে বলেছিল, ‘আজ্ঞে কর্তা, উচ্ছে, বেগুন, পালং, সিম, বরবটি, পেয়ারা, ঢ্যাঁড়শ। বর্ষা চলে গেলেই পেঁয়াজ, আদা, রসুন আর আলু লাগাব। তারপরে কপি। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি। ওদিকে কয়েকটা আমগাছ লাগিয়েছি। লিচুও। তালগাছ।’

‘সর্বনাশ! তুই তালগাছ লাগাতে গেলি কেন হারা?’ কথা শেষ করতে না দিয়ে কর্তামশাই গলা তুললেন।

‘আজ্ঞে, ও-বাড়িতে ছিল–’

‘হতভাগা! এই গাছের তাল তুই মরার আগে খেতে পারবি? তালগাছ যে লাগায় তার নাতি খায়! তোর নাতি কোথায়, যে খাবে?’ কর্তামশাই মাথা নাড়লেন, ‘শোন, জীবন থেকে অনেক কিছু শিখেছি আমি। তার মধ্যে একটা হল, যে-কাজের ফল বেঁচে থাকতে-থাকতে তুই ভোগ করতে পারবি সেই কাজটাই কর। লোকে বারো ইঞ্চি দেওয়ালের বিশাল বাড়ি বানিয়ে ভাবে নাতি পুতিরা সব একসঙ্গে থাকবে সেই বাড়িতে। এক পুরুষ পরেই দেখা যাচ্ছে সেই বাড়িতে ঘুঘু চরছে। নাতি-পুতিরা যে-যার কাজ নিয়ে বাইরে গিয়ে বাসা নিয়েছে।’

‘আজ্ঞে, ও-দুটোকে তুলতে মায়া লাগবে কিন্তু আর ওরকম গাছ লাগাব না।’ হারা বলেছিল।

‘কিন্তু হারা, তোর জমিতে ফুলের গাছ নেই কেন?

‘ফুল?’

‘হ্যাঁ, গোলাপ, টগর, নয়নতারা, সূর্যমুখী?

‘আজ্ঞে।’

‘ওগুলো খাওয়া যায় না বলে লাগাসনি?”

কথাটা ঠিকই বলেছেন কর্তাবাবু। যে-গাছের কাছে কিছু পাওয়া যাবে তাদের কথাই ভেবেছিল সে। ফুলেদের কথা মাথায় আসেনি।

কর্তামশাই বলেছিলেন, ‘শুধু পেটকে খাওয়ার দিবি হারা? মনেরও তো খাওয়ার দরকার। গোলাপ যখন ফুটবে মৌমাছি ভিড় করবে, তখন দেখবি মন ভালো হয়ে যাবে। আর বেশি যদি ফুল ফোটে তাহলে ব্যাপারিরা এসে তোর কাছ থেকে কিনে নিয়ে যাবে। উপরি রোজগার করতে পারবি!’

পরের দিন পোস্ট অফিস থেকে টাকা তুলে ছ’রকমের ফুলের গাছ লাগাল হারা। গাছগুলোর জায়গা হল তার জমির একপাশে।

প্রথমবার যখন ঢ্যাঁড়শ-উচ্ছে-বেগুন-পালং পুরুষ্টু হল তখন বুক জুড়ে থইথই আনন্দ। একটা ব্যাগে পুরে সেগুলো নিয়ে হাজির হল পুরোনো বাড়িতে। বউরা সেসব দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কর্তাবাবু বিছানা ছেড়ে আসতে পারবেন না শুনে হারা নিজেই গেল তাঁর কাছে। হাত-জোড় করে তার জমির প্রথম ফসল নিবেদন করল প্রাক্তন মনিবের কাছে।।

কর্তা আরও দুর্বল হয়েছেন, শরীর ছোট হয়ে গেছে। তবু উজ্জ্বল চোখে সেসব দেখে বললেন, ‘আমি জানতাম তুই পারবি হারা। মাটিকে ভালোবাসবি, সময়ে তাহলেই মাটি দেবে তোকে। ভালোভাবে থাকিস হারা। আর শোন, কাছে আয়!’

অবাক হয়ে সাদা-কালো খোঁচা-দাড়ি মুখ নিয়ে হারা কর্তামশায়ের মুখের কাছে এগিয়ে গেল। কর্তামশাই বললেন, ‘আর একা থাকিস না। দেখেশুনে বুঝে একটা ভালো মেয়েকে বিয়ে করে একসঙ্গে থাক। শলাপরামর্শ করার জন্যেও মানুষের মানুষ দরকার হয়।’

ঠিক পাঁচ দিন পরে ভোরবেলায় কর্তামশাই দেহরক্ষা করেন। দুটো গোলাপ ফুটেছিল সেই ভোরে। কর্তামশাইকে দেওয়ার জন্যে পাঁচ মাইল রাস্তা হেঁটে এ-বাড়িতে এসে খবর পেল হারা। সবাই কান্নাকাটি করছে। কান্না পেল হারারও। কিন্তু দৌড়ে কর্তামশায়ের বাড়ির পিছনে গোয়ালঘরের সামনে গিয়ে সে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। হঠাৎ খেয়াল করে কালীগাই তার সামনে এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হারা তাকে বলল, ‘জানিস কালী, কর্তামশাই নেই। আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন ভগবানের কাছে।’

কালী মুখ নামাল। হারা তার মাথা জড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল।

আজ যা চোখের সামনে, কাল তা স্মৃতি হয়ে যায়। কর্তামশাই চলে যাওয়ার পরেও সূর্য উঠেছে, রাত নেমেছে, বৃষ্টি ঝরেছে, তার বাগানে যেমন ফল ফলেছে তেমনই একটা দিক ফুলে-ফুলে ছেয়ে গেছে। এখন ফুলগুলোর দিকে তাকালে মন ভালো হয়ে যায়। ঠিকই বলেছিলেন। কর্তামশাই। এত মৌমাছি কোথায় ছিল কে জানে, সবাই ভিড় করেছে ফুলগুলোর চারপাশে। সেই সঙ্গে এসেছে একটা ভ্রমর, একা-একা। বেচারা যে-ফুলে বসতে চাইছে সেই ফুলের মধু খেয়ে গেছে মৌমাছি। উড়তে-উড়তে সেটা চলে এল নয়নতারার কাছে। সেখানে কোনও মৌমাছি যায়নি এখনও। হারা খুশি হল, অতগুলো ফুলের মধু সবুজ ভ্রমর একাই খেতে পারবে। কিন্তু এ কী! নয়নতারার বুকে শুড় ঢুকিয়েই বের করে নিচ্ছে ভ্রমরটা। নয়নতারার মধু হয় না। নাকি! ভ্রমর সেখান থেকে উড়ে গেলে হারা গুটিগুটি এগিয়ে গেল। একটা ফুল ছিঁড়ে তার ভেতরবুকে চটচটে যে রস দেখতে পেল সেটা জিভে ঠেকাতেই হেসে ফেলল সে। মধুর স্বাদও কখনও তেতো হয়।

দিনটা কেটে যায় গাছগাছালির সঙ্গে। কার একটু অসুখ হয়েছে, কার ডাল ভেঙেছে, কার শরীরে পোকা কামড়াচ্ছে তার খবরদারি করা আর সবাইকে স্নান করাতেই দিন শেষ হয়ে যায়। জলঢাকা থেকে জল বালতিতে তুলে ওপরে আনতে বড় কষ্ট। শেষপর্যন্ত একটা পাতকুয়ো তৈরি করিয়ে নিয়েছিল সে। মুশকিল হল গরম পড়লে পাতকুয়োর জল নিচে নেমে যায়। জমতে সময় লাগে। তাই কপিকলের ব্যবস্থা করেছে হারা। পরিশ্রম তেমন করতে হয় না। নদী থেকে জল। তুলে ঢেলে দিতেই সেটা আপনি জমিতে এসে পড়ে।

মুশকিল হয় রাতের বেলায়। সন্ধের পর থেকেই এখানে শনশন হাওয়া বয়। মাঝে মাঝে তার জোর এত বাড়ে যে ঝড় বলে মনে হয়। তখন নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়ালে কীরকম অসহায় লাগে। ঘরে ঢুকে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেও সহজে ঘুম আসে না। আর যদি বৃষ্টি নামে তো কথাই নেই। আকাশ ফাটিয়ে বাজ পড়ে, ঝমঝম বৃষ্টি অন্ধকারকে চটকায়। তখন মনে হয় পৃথিবীতে কেউ নেই। আর প্রতি মুহূর্তে ভয় হয় গাছগুলোর ক্ষতি হল না তো! ভোর হতে না-হতে মাথায় বস্তা ঢেকে বাইরে বেরিয়ে চোখে জল এসে যাওয়ার উপক্রম হয়। যেন বুনো মোষ কাল রাত্রে বাগানে ঢুকে তছনছ করে গেছে। আহত গাছেরা নিঃশব্দে আর্তনাদ করে যাচ্ছে, বাঁচাও বাঁচাও।

দশ মিনিট হাঁটাপথের পরে পিচের রাস্তা। দিনভর বাস-ট্রাক যায়। পিচের রাস্তার ওপাশে মাইলখানেক গেলে মাঝারি গ্রাম। কাছাকাছি লোকালয় বলতে ওটাই। ওই গ্রাম থেকে দু-চারজন মাঝে-মাঝে আসে হারার বাগান দেখতে। ওরা জানে কর্তামশাই হারাকে বাগান করে দিয়েছেন। তাই সমীহ করে কথা বলে। বাগানের একপাশে বসে বিড়ি খেতে-খেতে সুখদুঃখের গল্প করে। হারার ত্রিভুবনে কেউ নেই শুনে সমবেদনা দেখায়। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, প্রচুর কাজ বাকি আছে বলে হারা তাদের বিদায় করে। মাঝে-মাঝে সে বিরক্ত হয়। মানুষের কথা বলার পুঁজি বড্ড কম। দুদিন কথা বললেই একই কথা শুনতে হয়। তার বেশিরভাগই হা-হুতাশ। সে হাবেভাবে বোঝাতে চায়, আমি বেশ আছি, তোমরা তোমাদের মতো থাকো। গতকাল এক বুড়ো এল, সঙ্গে

কাগজে মুড়ে চা-পাতা। বলল, ‘একজন দিলে তাই তোমার কাছে নিয়ে এলাম। বাড়িতে তো অনেক মুখ, কার গলায় দেবো এটুকু। জল ফুটিয়ে ভিজিয়ে দাও, চা খাই দুজনে জুত করে।’

ব্যাপারটা পছন্দ হল না হারার, ‘দুধ নেই, চা হবে কী করে?’

‘আহা, দুধের কী দরকার! ওই তো গাছে লেবু ঝুলছে, ওর রস কয়েক ফোঁটা দিলে জব্বর স্বাদ হবে হে।’

বুড়োমানুষ বলে মেনে নিল হারা। গ্লাসে চা ঢেলে নিজেও নিল। চায়ে চুমুক দিয়ে বুড়ো বলল, ‘আহা, চমৎকার হয়েছে। তা বাবা হারাধন, কিছু কি ভেবেছ?’

চা খেতে ভালোই লাগছিল। হারা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্যাপারে?’

‘এইসব জায়গায় একা থাকা ঠিক নয়। দিনের বেলায় তবু এক কথা, রাত নামলে হাওয়া বয়। সেই হাওয়া সবসময় ভালো হয় না হে। তোমার এই জমি, এত বছর এমনি পড়ে ছিল কেন?নাড়ু মণ্ডল তো খদ্দের পাচ্ছিল না। কর্তামশাই সস্তায় তোমাকে কিনে দিতে পেরেছেন। কেন জানো?’ বৃদ্ধ চায়ে চুমুক দিল।

মাথা নেড়ে ‘না’ বলল হারা।

‘চার-পাঁচ বছর অন্তর এখানে ডাইনির কুদৃষ্টি পড়ে।’

‘ডাইনি?”

‘না। তাকে কেউ দ্যাখেনি। বাতাসে তার কুদৃষ্টি ভেসে আসে। তখন তো এখানে বুনো ঝোঁপ আর

লম্বা ঘাস ছাড়া কিছু ছিল না। সকালে হঠাৎ দেখা যেত সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম আমরা ভাবতাম কেউ বোধহয় আগুন দিয়েছে। কিন্তু কে দেবে? তোক কোথায়! এসব খুব রহস্য।’ বুড়ো বলল। ‘আমার কোনও ক্ষতি হবে বুঝলে কর্তামশাই এই জমি কিনতেন না।’ বেশ জোরের সঙ্গে বলল হারা।

‘তা বটে। তবে ভয় হয়। হঠাৎ একদিন দেখব, এই সুন্দর বাগান ছাই হয়ে পড়ে আছে। তুমি তো একা থাক, তোমার কী হল তা জানতেও পারব না। কর্তামশাই কি কিছু বলেছেন?’

‘কী ব্যাপারে?’

‘এই এখানে কীভাবে থাকলে ভালো হয়?’

হাসল হারা, ‘ছেড়ে দিন ওসব কথা।

‘তোমাকে পছন্দ করি বলেই তো বলি। আসলে কী জানেনা, এই জমিতে কোনওদিন লক্ষ্মীর পা পড়েনি। লক্ষ্মী এলে কু-বাতাস আর কাছে ঘেঁষতে পারবে না। তুমি বাপু আর লক্ষ্মীছাড়া হয়ে থেকো না।’ কথাগুলো বলে বুড়ো চলে গেল।

ক’দিন থেকে ঝুপঝুপ বৃষ্টি আর হাওয়া চলছিল। জলঢাকার জল বাড়ছে। প্রতি বছর বর্ষার সময় বাড়ে। তখন সিকি মাইল চওড়া নদীটাকে ভয়ঙ্কর দেখায়। ঢেউয়ের ছোবলের শব্দ শোনা যায়। কিন্তু নদীর জল যতই বাড়ুক তা থাকে জমির অনেক নিচে। ওপাশের নিচু জমিগুলো এখন। জলঢাকার জলে ডুবে থাকলেও হারার কোনও ভয় নেই। এরকম এক বৃষ্টির রাত্রে ঘরে বসে হারার মনে হল বাতাসে অন্যরকম শব্দ বাজছে। হ্যারিকেনের আলোটাও দপদপ করছে, যদিও ঘরে বাতাস ঢোকার কোনও সুযোগ নেই। বুড়ো বলেছিল কু-বাতাসের কথা। এটা কি তাই! বাইরে বেরুতে ঠিক সাহস হচ্ছিল না। এইসময় বৃষ্টি থামল কিন্তু বাতাসের শব্দটা বেজে যাচ্ছে। সমানে। সাহস করে বাইরে বের হল হারা। চারধারে নীলচে কুয়াশা স্থির হয়ে আছে অথচ বাতাস বইছে। এই বাতাস উঠে আসছে জলঢাকার বুক থেকে। লাউ, কুমড়ো, চালকুমড়োর লতাগুলো মাচা আঁকড়ে কোনও মতে ঝুলছে কিন্তু ছোট গাছগুলো গিয়েছে কাত হয়ে। হঠাৎ শোঁ-শোঁ। আওয়াজ উঠল। নীল কুয়াশারা ছুটোছুটি শুরু করল জমির ওপর। দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল হারা।

কর্তামশাই বলেছিলেন, শলাপরামর্শ করার জন্যেও মানুষের মানুষ দরকার হয়। বুড়ো বলে গেল, তুমি বাপু আর লক্ষ্মীছাড়া হয়ে থেকো না। ব্যাপারটা ভাবতেই চোখ বন্ধ করে হাসল হারা। পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে এ কথাটা কর্তামশায়ের বাড়িতে কাজ না করলে জানতই না। খাটো শরীর, মুখচোখ ভদ্রালোকের মতো নয়, হাফপ্যান্টের তলায় পা দুটো দিনকে দিন সরু হয়ে যাচ্ছে। এইসব নিয়ে সে বিয়ে করতে চাইলেই কোনও মেয়ে রাজি হবে?কর্তামশায়ের বাড়িতে কাজ করার সময় এসব চিন্তা মাথায় ছিল না। মেয়েমানুষের সঙ্গে ভাব করার ইচ্ছে হত না। একবার একটা মেয়ে ও-বাড়িতে এসেছিল ক’দিনের জন্যে বড়বউকে রান্নার কাজে সাহায্য। করতে। অন্য বউরা যে-যার বাপের বাড়িতে গিয়েছিল তখন, বেড়াতে। সেই মেয়ে গোয়ালঘরে ঢুকে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘গাইগুলো যখন পাল খায় তখন তুমি দ্যাখো?

গম্ভীর হয়ে উত্তর দিয়েছিল হারা, ‘দেখতে হয়।’

হেসে গড়িয়ে পড়েছিল মেয়ে। হাসতে-হাসতে বলেছিল, ‘তা ওসব দেখে তোমার ইচ্ছে জাগে না?’

উত্তর দেয়নি হারা কিন্তু বড়বউকে বলে দিয়েছিল কথাগুলো। সেদিনই মেয়েকে বিদায় করেছিল বড়বউ।

সকাল হল। সঙ্গে-সঙ্গে হারা লেগে গেল চিকিৎসা করতে। জলকাদা মেখে চেহারাটার কী অবস্থা। দাঁড়িয়েছে, তা নিয়ে ভাবার সময় ছিল না। কাদা শুকিয়ে চামড়ায় সেঁটে গেছে। এগারোটা নাগাদ কাজ যখন শেষ তখন বুড়োর গলা কানে এল, ‘আয়, ইদিকে আয়।’

আবার কাকে নিয়ে এল। গাছের আড়ালে থেকে দেখতে চাইল হারা। বুড়ো তখন ঘরের সামনে চলে গেছে, ‘ও হারাধন, কোথায় গেলে! দ্যাখ কে এসেছে, তুমি না ডাকলে ভেতরে আসতে চাইছে না। হারাধন!’ বুড়োর গলায় আজ স্নেহ মাখামাখি।

‘না ডাকতেই ভিড় জমছে, ডাকলে তো চোখে অন্ধকার দেখব।’ কথা না বলে পারল না হারা।

‘ও, তুমি ওখানে। কাল রাত্রে ঝড় হয়েছিল বটে। খুব চিন্তা হচ্ছিল তোমার জন্যে। সেই কু বাতাসের কথা মনে আসছিল। তাই আমার ছোটশালির মেয়ে বেড়াতে আসতেই বললাম, চল, হারাধনকে দেখে আসি। সারা রাত মুখ বুজে থাকে বেচারি!’ বুড়ো হাসল, ‘আয় মা, হারাধনের। মুখ শুনে মন বিচার করিস না।’

বলেছি তো, যার জায়গা সে না ডাকলে পা বাড়াব না।’

বেশ খসখসে মেয়েদের গলা শুনতে পেল হারা। ব্যাপারটা কী?বুড়ো একে নিয়ে এল কেন? উঠে দাঁড়াল হারা।

বুড়ো বলল, ‘আচ্ছা জ্বালায় পড়া গেল। ও হারাধন, অতিথিকে বিমুখ কোরো না।’

হারা ইতস্তত করে বলল, ‘ঢোকার পথ খোলাই আছে, এলেই হয়। তবে কিনা আমি কাজে ব্যস্ত।’

এবার তিনি ঢুকলেন। পরনে হলুদ শাড়ি হলুদ জামা। শাড়ি নেমেছে হাঁটু আর গোঁড়ালির ঠিক মাঝ বরাবর। বড় মুখ, ছোট চোখ কিন্তু নাকখানি বেশ টিকোলো। গায়ের রং মাজা আর শরীর স্বাস্থ্য দেখলে মনে হবে আধ সের চালের ভাত স্বচ্ছন্দে মেরে দিতে পারে।

এই মেয়ের বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। বাগানে ঢুকে কোমরে হাত রেখে বলল, ‘বাঃ। জব্বর বাগান তো! ও মেসো, কতদিন এমন বাগান দেখিনি। আমাদের ওখানে তো ভালো বাগান হয় না।’

বুড়ো ধমকাল, ‘আঃ। ওখানকার কথা বলার কী আছে। ওখানে অনেক কিছুই হয় না। এই বাগান আমাদের হারাধনের হাতে গড়া।’

‘ও মা! ওপাশেনদী বুঝি।’ দৌড়ে গেল মেয়ে নদীর দিকে, ‘বাব্বা! কী ঢেউ। রাগে ফুঁসছে, খুব গতর বেড়েছে যে!’

বুড়ো হাসল, ‘তোর মুখ বড় আলগা। ও হারাধন, এটি আমার শালির মেয়ে, পদ্ম। দেখতে-শুনতে কেমন সেটা তো বুঝতেই পারছ, গৃহকর্মনিপুণা, স্বভাবচরিত্র ভালো তবু স্বামীর ঘর করা ওর হল না।’

মাথা নাড়ল বুড়ো।

‘কেন?যার এত গুণ তার দোষ কোথায়?’

‘মারে হরি রাখে কে? সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। সাতাশেও যখন বংশরক্ষা করতে পারল না তখন শ্বশুর-শাশুড়ি আবার ছেলের বিয়ে দিতে চাইল। পঞ্চায়েতের কাছে গিয়েছিল। তারাও বিধান দিল, বংশরক্ষা করার জন্যে দ্বিতীয় বিবাহে কোনও অপরাধ হয় না। কিছু টাকা। হাতে গুঁজে দিয়ে বাপের বাড়িতে ওকে পাঠিয়ে ওর স্বামী আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ল। কী আর বলব?’ বুড়ো শ্বাস ফেলল।

‘তারও তো দু-বছর পেরিয়ে গেল। কই, বাচ্চা হয়েছে? তাহলে তো ডুমুরগাছেও ফুল ফুটতে দেখত লোকে।’ মুখ ঘুরিয়ে বলল পদ্ম। তারপর খিলখিল করে হাসতে লাগল।

‘কী হল? অ্যাই পদ্ম!’ বুড়ো ধমকাল।

‘তুমি না বলেছিলে মেসো, চল, তোতে আমাতে চা খেয়ে আসি! তা যেরকম সঙের মতো দাঁড়িয়ে দেখছে, চা তোমার কপালে নেই। বরং পেয়ারা পেকেছে, তাই খাও।’ পদ্ম ঘুরে নদীর দিকে তাকাল।

বুড়ো বলল, ‘যাও হে হারাধন, চান করে এসো। মুখে গায়ে কাদামাটি শুকিয়ে আছে তোমার।’

পদ্ম বলল, ‘রান্নাঘরটা কোথায়? চা বানাই।’

বুড়ো বলল, ‘ব্যাটাছেলে, একা থাকে। শোওয়া, রান্না একই ঘরে হয়। যা, ঘরে গিয়ে দ্যাখ।’

হারা দেখল পদ্ম তার শরীর দুলিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছে। দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি মেরেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘এম্মা! এ তো আঁস্তাকুড়, মেসো, বলে দাও, যেখানে খাবে সেখানেই হাগবে–এ চলবে না, তিন দিনের মধ্যে রান্নাঘর বানাতে বলো।’

বুড়ো বলল, ‘হবে হবে। সব হবে। অত তাড়াহুড়ো করলে চলে! এই নে, চা-চিনি। গাছ থেকে লেবু পেড়ে দিচ্ছি। চা বানা।’

ওরা যখন বিদায় হল তখন সূর্য মাঝ-আকাশ ছাড়িয়েছে। ওদের এড়াবার জন্যে সারাক্ষণ। বাগানের কাজ করে গেছে হারা। আরও আগাছা পরিষ্কার করেছে, মাটি কুপিয়েছে। যাওয়ার সময় পদ্ম চোখ ঘুরিয়ে বলে গেছে, ‘বুঝলে মেসো, গাছেদের সঙ্গে বাস করলে মানুষও যে গাছের মতো বোবা হয়ে যায় জানতাম না।’

সেই ছেলেবেলা ইস্তক হারা কর্তামশায়ের বাড়ির ছেলেমেয়ে দেখেছে। বড়মা যেমন, বাড়ির বউরাও তেমনই কখনও গলা তুলে কথা বলত না। এরকম বেঁকিয়ে, চিমটি কেটে কথা বলার অভ্যেস তাঁদের ছিল না। মেয়েমানুষের জিভে যদি এত ধার হয় তাহলে তার পক্ষে ঘর করা কী করে সম্ভব! হারার মনে হল, বংশরক্ষার জন্যে নয়, ওই মুখ সহ্য করতে না পেরে ওকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়েছে।

জলঢাকার জলে এখন সাপের ছোবল। দেখলেই ভয় করে। সাঁতার কাটার কথা চিন্তাও করা যায় না। ভাত চড়িয়ে দিয়ে নিচে নেমে কোনওরকমে কাদামাটি ধুয়ে একটা ডুব দিয়ে ওপরের দিকে তাকাতেই চোখ ছোট হল হারার। ঢেউয়ের ধাক্কায় মাটি ধুয়ে যাচ্ছে। বেশ বড়-বড় চাঙড় খসে পড়ছে। এভাবে চললে একদিন-না-একদিন তার জমি নদী খেয়ে ফেলবে। কী করা যায়? মনে অস্বস্তি। তাড়াতাড়ি সেদ্ধভাত খেয়ে হারা বড় রাস্তায় চলে এল। কিছু লোক জটলা করছে রাস্তার পাশে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে।

একজন বলছিল, ‘আমি নিজের কানে শুনে এলাম নিচের একটা গ্রাম, জলঢাকায় জলের তলায় চলে গেছে। সাতজন মানুষ সেই জলে ভেসে গেছে।’

আর একজন বলল, ‘কান মিথ্যে শোনে আর চোখ সত্যি দ্যাখে। চোখে যখন দ্যাখোনি তখন বিশ্বাস করো না।’

দুজনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। ওদের একজন হারাকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘তোমার খুব সাহস ভাই। একা থাকো। তা নদী কত দূর?মাটি ভাঙছে না তো?

‘ভাঙতে শুরু করেছে। গেল কয়েক বছর এরকম হয়নি।’ হারা বলল, ‘কী করা যায় বুঝতে পারছি না।’

‘সেচ দপ্তরে চলে যাও। ওদের ডিউটি হল নদীকে সামলে রাখা। আজই যাও।’ লোকটা উপদেশ দিল। আর একজন বলল, ‘ঘরে মেয়েমানুষ থাকলে নদী ঘেঁষত না। জানো তো, নদীও যে মেয়েমানুষ, সতীন সহ্য করতে পারে না। দূরে-দূরে থাকে।’

সেচ দপ্তরের অফিসে বাসে চেপে যেতে হবে। আধ ঘণ্টার পথ। সঙ্গে বাসভাড়া আনেনি, তা ছাড়া সন্ধে হতেও দেরি নেই। হারা ঠিক করল কাল সকালেই সেখানে যাবে।

সন্ধে থেকেই ঝুপঝুপ বৃষ্টি। মাথায় বস্তার ঘোমটা চাপিয়ে নদীর ধারে এল হারা। অন্ধকারে কিছু। দেখা না গেলেও জলের ফোঁসফোসানি শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ কাছাকাছি কোথাও মাটির চাঙড় ভেঙে পড়ল জলে। ঝপাং শব্দ কানে এল।

কর্তামশাই খুব বুঝেসুঝেই এই জমি তাকে কিনে দিয়েছেন। তখন নদী ছিল বেশ দূরে, জমিটাও উঁচুতে। এতগুলো বর্ষা গেল কিন্তু কোনওবারই নদী এমন খেপে ওঠেনি। এই জমি যদি নদী খেয়ে নেয় তাহলে তার কী হবে? কোথাও গিয়ে দাঁড়াবার জায়গা নেই তার। ও-বাড়িতে নতুন লোক কাজে লেগে গিয়েছে বহু দিন।

বৃষ্টিটা ধরল। বস্তা সরিয়ে রেখে বাগানে ঢুকল হারা। সূর্যমুখী গাছটা ক’দিন থেকেই নেড়া। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। বাকি গাছগুলো শরীরে ফোঁটা-ফোঁটা জল নিয়ে যে-ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, তা দেখে বুক ছ্যাঁত করে উঠল হারার। কর্তামশায়ের শরীর যখন শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তখন শ্মশানযাত্রীরা এইভাবে তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল।

প্রায় দৌড়েই ঘরে চলে এল সে। অন্ধকার ঘর। আলো জ্বালতে ইচ্ছে করছে না। মাটিতে বেশ জোরে লাথি মারল সে। কী শক্ত! এর জমি ও দখল করলে মারপিট হয়, পুলিশ আসে। কিন্তু যদি নদী জমি খেয়ে নেয় তাহলে সবাই মেনে নেয়। নদী নাকি মেয়েমানুষ। আজ বিকেলে লোকটা বলেছিল। মেয়েমানুষের এত তেজ কি ভালো?

হঠাৎ যেন মনে হল কয়েকজন কথা বলছে। ফিসফিস করে। এত রাত্রে কে এল এখানে? কারা এল? মাঝে বাতাসে গলার স্বর মিলিয়ে যাচ্ছে। যারাই আসুক তাকে ডাকছে না কেন? সন্তর্পণে দরজার কাছে এসে বাইরে মুখ বাড়াল। অন্ধকারে কারও অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বাতাসে ভেসে আসছে অস্পষ্ট শব্দ। কান পাতল হারা। না কথা নয়, চাপা, অস্পষ্ট কান্না। তার বাগানে সেই কান্নাটা ঘুরে বেড়াচ্ছে? সে ঘরে ঢুকে লণ্ঠন জ্বেলে নিয়ে বাইরে পা রাখতেই কান্নাটা। আচমকা বন্ধ হয়ে গেল। যেন তাকে দেখতে পেয়ে চুপ মেরে গেল যারা কাঁদছিল। হারা লণ্ঠন হাতে নিয়ে পুরো বাগান তন্নতন্ন করে খুঁজল। না, কেউ নেই। হঠাৎ তার নজর গেল লাউগাছটার দিকে। আজ বিকেলেও লাউলতা মাচা আঁকড়ে ছিল। এখন কুমড়োগাছের সঙ্গে জড়াজড়ি করে পড়ে আছে মাটিতে। এটা কী করে সম্ভব হল। দুটো গাছের শেকড় তো বেশ তফাতে। তাহলে ব্যবধান ঘোচাল কী করে?

হারার মনে হল গাছেরাই এতক্ষণ কাঁদছিল। ওরাও টের পেয়ে গেছে, এই বাগান নদীর পেটে চলে যাবে। যদি মাঝরাত্রে ব্যাপারটা হয় তাহলে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকেও নদী ওদের সঙ্গে খেয়ে ফেলবে। লাউলতাকে কুমড়োলতার শরীর থেকে ছাড়াতে চেষ্টা করল হারা। কিন্তু গঁড়গুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে তবু ওরা আলাদা হচ্ছে না।

রাতটা কেটে গেল কিন্তু জলঢাকার জল বেড়ে গেল অনেকটা। এরকম বাড়লে আজ রাত্রেই কর্তামশায়ের কিনে দেওয়া জমি বাগানসমেত গিলে ফেলতে পারবে নদী। সকালে সেচ দপ্তরে গিয়েছিল হারা। গিয়ে জানতে পারল নদীর জল না কমলে কিছুই করা যাবে না। পাহাড়ে নাকি একটা বাঁধ ভাঙব-ভাঙব হয়েছে, সেটা ভাঙলে আর দেখতে হবে না। ওরা উপদেশ দিল, জমির মায়া ত্যাগ করে হারা যেন নিরাপদ জায়গায় চলে যায়। বাঁধ ভাঙলে নদীকে রোখা যাবে না।

আজ সারাদিন বৃষ্টি হয়নি। গালে হাত দিয়ে গাছগুলোকে দেখতে-দেখতে কান্না পেয়ে গেল। হারার। এদের ফেলে কোথায় যাবে সে! না। ইচ্ছে করলে ও-বাড়িতে যেতে পারে। বউরা খুশি হবেন। কিন্তু এরা তার ছেলেমেয়ের মতো। বাপ হয়ে পালিয়ে বাঁচবে?

বিকেলে আর একবার নদী দেখে এসে সূর্যমুখীর পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরাল হারা। ঠিক তখনই গলা কানে এল, ‘দুপুরে ডিমের ঝাল বেঁধেছিলাম। মেসো বলল ওটা নাকি অমৃত। তার পরেই স্নেহ উথলে উঠল মেসোর, যা পদ্ম, ছেলেটাকে দিয়ে আয় একটা ডিম। হাত পুড়িয়ে খায়, খেলে জিভের স্বাদ পালটাবে। তা যেখানে ইচ্ছে রেখে বাটিটা ফেরত দিলে ফিরে যেতে পারি।’

আদিখ্যেতা! মনে-মনে বলল হারা। আজ রাত্রেই যার সর্বনাশ হতে পারে, তাকে ডিম খাওয়াতে এসেছে! আর ডিমের ঝোল কি করে অমৃত হয়! ন্যাকামি।

‘কী আমাকে বকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে নাকি?’ পদ্মর কণ্ঠস্বর আরও ঝাঁঝাল হল।

ফেরত দেওয়া যেত। কিন্তু বুড়োটা হয়তো দুঃখ পাবে। মরার আগে কাউকে দুঃখ দিয়ে কী লাভ। ঘরে ঢুকে একটা বাটি নিয়ে এল হারা, এনে উঁচু করে ধরল। গম্ভীর মুখে ঝোল আর দুটো ডিম তাতে ঢেলে দিল পদ্ম। তারপর বালতিতে রাখা জলে ধুয়ে নিল সেটা।

‘দুটো কেন? একটা হলেই তো হত।’ হারা বিড়বিড় করল।

‘কীসে কী হয় আমার জানা নেই। সেদ্ধভাত খেয়ে-খেয়ে পেটে নিশ্চয়ই চড়া পড়ে গেছে। তাই ভাবলাম। অবশ্য খেতে না চাইলে ফেলে দিলেই হয়। পাশেই তো নদী।’ চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে-দেখতে বলল পদ্ম।

আজ পদ্মার শরীরে নীল শাড়ি, নীল জামা। খোঁপা বেঁধেছে আলগা করে, তাতেও নীল ফিতে। নদীর দিকে এগিয়ে গিয়ে পদ্ম বলল, ‘সর্বনাশ, এ কী চেহারা! সবাই বলছে বান আসবে বড়। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে পৃথিবী, মেসোর বাড়ি তো উঁচুতে। সেখানে জল যেতে পারবে না। এখানে থাকতে ভয় লাগছে না?’

‘ভয় কীসের? বড়জোর মরে যাব, তার বেশিকী হবে?

‘ডিম দুটো খেয়ে মরলেই খুশি হব।’ হঠাৎ গলার স্বর পালটে গেল পদ্মর, ‘আরে! ছুটে গেল একটা জুইফুলের গাছের পাশে, কী সুন্দর কুঁড়ি ধরেছে। কাল সকালেই ফুল হয়ে যাবে।’

যদি নদীর পেটে না যায়! মনে-মনে বলল হারা। আর তখনই আচমকা মন হালকা হয়ে গেল। এই ফুল-ফলের গাছনদীর বুকে চলে গেলেও ভাসতে-ভাসতে কোথাও গিয়ে ঠেকবে। জল নেমে গেলে সেখানেই হয়তো শেকড় ঢোকাবে মাটিতে। অথবা বীজ ছড়াবে ফলগুলো। আবার নতুন গাছ জন্মাবে পৃথিবীতে। কিন্তু মানুষের প্রাণ চলে গেলে তার আর নতুন জন্ম হয় না। অতএব মায়া করে কী লাভ। যা হওয়ার তাই হোক। চুপচাপ তাই মেনে নেবে সে। বিধিলিপি মেনে নেওয়াই ভালো।

এই সময় বৃষ্টি শুরু হল আর পদ্ম চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই রে!’

জলের ছাঁট থেকে বাঁচতে সে দৌড়ে চলে গেল ঘরের ভেতরে। বৃষ্টি পড়ছিল গায়ে মাথায়। হারা মাথা নাড়ল। আবার বৃষ্টি মানে পাহাড়ে বাঁধ ভাঙবে। জলের ঢল নামবে নদীতে। আজ রাত্রেই হারিয়ে যাবে তার জমি-বাগান।

‘তাপ-উত্তাপ নেই তা দেখেই বুঝেছিলাম। তাই বলে বৃষ্টির জলও টের পাচ্ছে না, জ্বর হলে দেখার কেউ নেই। মনে রাখলে ভালো।’ পদ্ম চেঁচিয়ে উঠল।

হারা ঘরের দরজায় এল। গামছা টেনে মাথা মুছল। ‘আঁধার হয়ে আসছে, বৃষ্টিও বাড়বে।

এইবেলা বাড়ি ফিরে যাওয়াই মঙ্গল।’

‘ছাতি থাকলে ভালো হয়।’

‘ছাতি নেই, বস্তা আছে। তাই মাথায় দিয়ে–।’

‘এম্মা! বস্তা মাথায় রাস্তায় হাঁটব!’

“কিন্তু অন্ধকার হয়ে এল বলে!’

‘হোক। তেমন বুঝলে মেসো ছাতা নিয়ে আসবে।’

অগত্যা হ্যারিকেন জ্বালাল। বেশি তেল নেই। নাই থাক। কাল তেল কেনার দরকার হবে না। বাঁচলে তবে তো আলো!

বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। দরজা ভেজিয়ে ঘরের একপাশে তক্তাপোশের কোণে বসল হারা। পদ্ম বসেছে অন্য প্রান্তে।

‘তবু ভালো এই ঘরে জল পড়ে না।’ পদ্ম বলল।

‘বান আসতে পারে। কোনওরকমে চলে যাওয়াই ভালো।’

ভিজলেই জ্বর আসে। আমার জন্যে কাউকে অত চিন্তা করতে হবে না। আমি ঠিক আছি।’ পদ্ম ঠোঁট বেঁকাল।

কেউ যদি সেধে মরতে চায় তো মরুক! পকেট থেকে বিড়ি বের করে সযত্নে তার মুখে আগুন দিল হারা। সঙ্গে-সঙ্গে খিঁচিয়ে উঠল, ‘ঘর বন্ধ তার ওপর বিড়ি ধরানো হচ্ছে! গন্ধে গা গুলিয়ে যায়। অতই যখন নেশা তখন সিগারেট খেলেই তো হয়। ম্যাগো!’ আঁচল তুলে নাকে চাপা দিল পদ্ম।

হারা নির্বিকার। বিড়ি শেষ করে বলল, ‘বাতিতে তেল কম। ভাত রাঁধতে হলে এইবেলা বেঁধে নেওয়া ভালো।’

‘আমি কি এ-বাড়ির বউ যে স্বামীর জন্যে ভাত রাঁধব?যার দরকার সে বেঁধে নিক।’ পদ্ম শুয়ে পড়ল তক্তাপোশে। ‘আর পারি না বাবা। এমন হাড়বজ্জাত বৃষ্টি জন্মে দেখিনি।’

হারা উঠে দাঁড়াল। বিকেলের ভাত এখনও কিছুটা হাঁড়িতে জল মেশানো রয়েছে। সঙ্গে ডিমের ঝোল। নিজের জন্যে রাঁধার কোনও দরকার নেই। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে মেঘ ডাকল, বাজ পড়ল। কোথাও। ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল পদ্ম। দু-হাতে কান ঢেকে অদ্ভুত গলায় বলে উঠল, ‘বাড়ি যাব।’

‘গেলেই হয়, দরজা খোলাই আছে।’ হারা বলল।

ধপ করে তক্তাপোশ থেকে নেমে পড়ল পদ্ম। তারপর কোনও দিকে না তাকিয়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকারে।

যে-মেয়ে বিকেল-সন্ধেয় বারংবার বলা সত্বেও যেতে চায়নি, সে এরকম তুমুল বৃষ্টিতে চলে যাবে ভাবতে পারেনি হারা। ঘনঘন বাজ পড়ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নিশ্চয়ই ভিজতে ভিজতে পৌঁছে। যাবে। ভালোই হয়েছে। নইলে আজ রাত্রে মেয়েটা তাদের সঙ্গে নদীর তলায় চলে যেত।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মন খামচাতে লাগল কেউ। শেষপর্যন্ত বুড়োর বাড়িতে পৌঁছুতে পারল তো?

কাদাপথে যদি কোনও অঘটন হয়? বস্তা টেনে নিয়ে মাথায় দিয়ে বেরিয়ে এল হারা বাইরে। আকাশ যেন সমুদ্র। আর সেই সমুদ্দুর ধেয়ে আসছে পৃথিবীকে। নদীর দিকে এগিয়ে গিয়ে থতমত হয়ে গেল সে। নদী থেকে ঢেউয়ের সেই ভয়ঙ্কর আওয়াজটা এখন ভেসে আসছে না কেন? জল বয়ে যাচ্ছে গম্ভীর হয়ে। শিকার ধরার আগে জানোয়ারেরা যেমন ওত পেতে থাকে। সেইরকম অবস্থা নাকি?

বাগানের গাছগুলোর দিকে তাকাতে পারল না হারা। তাও অন্ধকার বলে ওরা অনেকটা চোখের আড়ালে। ধীরে-ধীরে বাইরে বেরিয়ে এল সে। পথ বলে যেটা ছিল সেটা এখন জলে-কাদায় চুপসে আছে। হাঁটে কার সাধ্যি! মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তারই আলোয় পথ দেখে দেখে, টলতে টলতে পিচের রাস্তায় উঠে এল হারা। না, কোথাও পদ্ম পড়ে নেই। তার মানে সে ঠিকঠাক মেসোর বাড়িতে পৌঁছে গেছে। সে-বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করতে ইচ্ছে হল না তার। বুড়ো জিজ্ঞাসা করতেই পারে, এমন বৃষ্টিতে ওকে একা ছেড়ে দিলে কী করে হারাধন?

ফিরে এল হারা। ঘরের সামনে পৌঁছে অবাক হয়ে দেখল পদ্ম ভেজা চুল থেকে জল ঝাড়ছে! তার

শাড়ি জামা ভিজে চপচপে।

‘এ কী!’ মুখ ফসকে শব্দটা বেরিয়ে এল হারার।

‘কাদায় পিছলে পা মচকে গেছে। নইলে কে ফিরত এখানে! কিন্তু এই ভেজা কাপড় পড়ে থাকলে নির্ঘাত জ্বর হবে, ফুলু হতেও পারে। তাতে যদি কারও খারাপ লাগে তাহলে একটা শুকনো কাপড় দেওয়া হোক।’ পদ্ম হ্যারিকেনের দিকে তাকাল। সেটাদপদপ করছে।

‘এখানে মেয়েদের কাপড় কী করে থাকবে? তাহলে আমাকে যেতে হয়–।’

‘কোথায়?’

‘যাকে মেসো বলা হয় তার বাড়িতে। গিয়ে চেয়ে নিয়ে আসি।’

‘থাক। কী বুদ্ধি! ঢাক পিটিয়ে পাড়ার লোককে না জানালে চলছেনা। মেয়েদের জামা না থাক, নিজের কিছু শুকনো নেই?’ পদ্ম ঝাঁঝিয়ে উঠল। চিরকাল বাড়িতে খাকি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে এসেছে হারা। তাই আছে গোটা দুয়েক। আছে শার্ট আর তিনটে ধুতি। তক্তাপোশের নিচ থেকে টিনের স্যুটকেস বের করে একটা ধুতি বের করে দিল সে।

‘এম্মা এ যে মিলের ধুতি। বিধবা না হয়েই থান পরবো নাকি?’ ধুতি খুলে উলটোদিকে মুখ করল পদ্ম, ‘মেয়েমানুষের কাপড় ছাড়ার সময় ব্যাটাছেলের থাকতে নেই। বৃষ্টিতে বেরুতে হবে না, দরজার দিকে মুখ করে থাকলেই চলবে।’

অগত্যা দরজার দিকে মুখ ফেরাল হারা। জামা-কাপড় ছাড়তে-ছাড়তে পদ্ম চাপা গলায় বলল, ‘খবরদার এদিকে তাকাবে না। তাকালে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব। বলব তুমি আমার ইজ্জত নষ্ট করেছ, হ্যাঁ। মুশকিল হল এই বৃষ্টিতে চিৎকার কারও কানে যাবে না। সত্যি, বৃষ্টি বলতে বৃষ্টি! তাই মেসো ছাতা নিয়ে আসতে পারেনি এখনও। নিজে যখন পারেনি তখন আমি যে যেতে পারলাম না তা ঠিক বুঝবে। অবশ্য চিন্তার কিছু নেই। মেসো জানে তার হারাধন বড় ভালো ছেলে। তিনকাল গেছে তবু শালগ্রাম শিলা হয়ে আছে। এ:, একে মিলের ধুতি তারপর ছোট। কী জ্বালা! হ্যাঁ, মুখ ফেরাতে ইচ্ছে করলে আপত্তি নেই, তবে আমার দিকে না তাকালে খুশি হব।’

হারা ফিরল, ‘আমি আজ সারারাত জাগব। ইচ্ছে হলে খাটে ঘুমানো যেতে পারে। কিছু ভাত আছে, ডিমের ঝোল দিয়ে খেয়ে নিলেই হয়।’

‘রাত জাগতে হবে কেন?কী মতলব?’

‘নদীকে বিশ্বাস নেই। ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে। যদি মাঝরাতে গিলে খায় তাহলে ঘুমিয়ে পড়লে টের পাব না।’ পদ্মর দিকে তাকাল হারা। সঙ্গে-সঙ্গে ধুতির ছোট্ট আঁচল বুকের দিকে টানল পদ্ম। আর তার ফলে কোমরের ওপরের অংশ থেকে কাপড় সরে গেল। হ্যারিকেনের আলো অনেকক্ষণ। দপদপ করছিল এবার টুক করে নিভে যেতেই কানে তালা পড়ার মতো শব্দ করে বাজ পড়ল।

চিৎকার করে উঠল পদ্ম, ‘ওরে মাগো, বাবাগো!’

‘আরে কিছু না, এখানে কিছু হয়নি।’

সঙ্গে-সঙ্গে আবার মেঘের গর্জন হতেই তড়াক করে লাফিয়ে নামল পদ্ম। থরথর করে কাঁপতে লাগল সে। অন্ধকারেও মনে হচ্ছিল হারার পদ্ম পড়ে যাবে। সে হাত বাড়াল শূন্যে, ‘ভয়ের কিছু নেই। হাত ধরলে ভয় কমে।’

‘কোথায় হাত? আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’ কাতরে উঠল পদ্ম।

এই সময় হারার হাত ভেজা চুল স্পর্শ করতেই পদ্ম তাকে জড়িয়ে ধরল। হারা বলল, ‘আঃ, এত জোরে কেন? উঃ।’

‘আমি মরে যাব।’ পদ্ম কেঁদে উঠল।

‘শব্দ শুনলে কারও মরণ হয় না। মরবে নদী এই ঘর খেয়ে নিলে।’ শ্বাস ফেলল হারা।

‘নদী এই ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে জেনেও পড়ে থাকা কেন?’

‘নিজের প্রাণ বাঁচাতে গাছগুলোকে ফেলে যাব কেমন করে? ওরা তো আমার ছেলেমেয়ের

মতো।’ হারা বলল।

মিনিট দুয়েক স্থির থেকে আস্তে-আস্তে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে পদ্ম বলল, ‘তুমি সত্যি ভালোমানুষ।’

হারা হাসল শব্দ করে।

‘এই অন্ধকারে মেয়েমানুষের শরীর পেয়েও শালগ্রাম শিলা হয়ে থাকলে। নাকি মরবে ভেবে ঠান্ডা হয়ে গেছ।’

‘আমি তো মরেই আছি। মরে গেলে মানুষের শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। কর্তামশায়ের শরীরও হয়ে গিয়েছিল মরার পরে।’

‘এসো, খাটে এসে বসো।’

ঘুম ভামল শেষপর্যন্ত। ভাঙতেই হারা দেখল পাশে পদ্ম হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। তার শরীরের ঊর্ধ্বাংশে ধুতি নেই। হালকা আবছা একটা আলো ঘরে তিরতিরিয়ে চলে এসেছে। হঠাৎ হারার শরীর থরথরিয়ে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বাইরে বের হল। আশ্চর্য! গাছগুলো আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখে যেন ঝকমকিয়ে উঠল ওরা। দৌড়ে নদীর কাছে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল হারা। নদীর জল এখন অনেক নিচে নেমে গেছে ঢেউয়ের ছোবল আর নেই। শান্ত হয়ে মাথা নিচু করে বয়ে যাচ্ছে জল।

তার বাগান বেঁচে গেল। আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠল সে। এবং তখনই মনে পড়ল লোকটার কথা। ‘ঘরে মেয়েমানুষ থাকলে নদী কাছে ঘেঁষত না। নদীও যে মেয়েমানুষ, সতীন সহ্য করতে পারে না। দূরে-দূরে থাকে।’

হেসে ফেলল হারা। তারপর বড়-বড় পা ফেলে চলে এল ঘরে। পদ্ম তখনও ঘুমোচ্ছে, তার মুখের ওপর ঝুঁকে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই মেয়ে, আমার ঘরের বউ হবে?’

ঘুম ভেঙে যাওয়ার হকচকিয়ে তাকাল পদ্ম।

হারা জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার ঘরের বউ হবে?’

দু-কান ছোঁয়া একটা হাসি হাসল পদ্ম। তারপরে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘কী হবে? কাকে বিয়ে করব? শালগ্রাম শিলাকে!’

সাঁতার না-জানা বালকের মতো জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল হারা। নাকানিচুবুনি খেতে-খেতে বলল, তোমাকে সতীন নিয়ে ঘর করতে হবে কিন্তু–।’

‘ওমা! সে কোথায়?

‘পাশেই।’ ডুবে যাওয়ার আগে উচ্চারণ করল হারাধন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress