আকাশে লেগেছে বৈশাখী রং
আকাশে লেগেছে বৈশাখী রং, ঝলসানো তামাটে আভা।
মামলার ফলের একদিন আগে, ভোরবেলা সবাই উঠে বিকৃত মুখে নাকে কাপড় চাপা দিল। অসহ্য দুর্গন্ধে ভরে উঠেছে চারদিক।
সবাই বাইরে এসে দেখল, বস্তির চারপাশে যেন সারা শহরের ময়লা ঢেলে দেওয়া হয়েছে। কী ব্যাপার! কে ফেলল এত ময়লা?
একটু পরেই এল মিউনিসিপ্যালিটির হেলথ অফিসার। সঙ্গে স্যানিটারি ইনস্পেক্টর আর উল্লসিত বিরিজমোহন।
বিরিজমোহনই প্রথম বলে উঠল, একেবারে জানোয়ারের ডেরা বাবুসাব! তারপর হেসে বলল বাড়িওয়ালাকে, এই যে বাবুসাহেব, জয় গোপালজি। হে অপসর সাব আপনার সঙ্গে হোড়া মোলাকাত করতে এসেছেন।
বাড়িওয়ালা খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেছে ব্যাপার দেখে। কেবল অসহ্য রাগে ও ঘৃণায় গোবিন্দ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। কোটরাগত চোখ দুটো তার জ্বলে উঠছে ধ্বক ধ্বক করে। সে বুঝতে পারল, একটা সর্বনাশের ষড়যন্ত্র হয়েছে। হয়তো সেই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে গেছে সবাই। আর মাত্র কয়েকদিন বাকি মামলার রায় বেরুবার। হয়তো মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান স্বয়ং যাবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হেলথ অফিসারের রিপোর্ট নিয়ে।
হ্যাটকোট পরা হেলথ অফিসার ঘৃণায় মুখ কুঁচকে, নাকে রুমাল চেপে, চোখে গগলস পরে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। পেছনে স্যানিটারি ইনস্পেক্টর।
গোবিন্দ তীব্র গলায় চেঁচিয়ে উঠল, হুজুর, চোখের ঠুলিটা খুলে ফেলে দিন, নইলে রঙ রোঝা যাবে না।
অফিসার সত্যি গগলসটা খুলে ফেলে ভূ কুঁচকে তাকাল গোবিন্দের দিকে–কী বলছ?
গোবিন্দের মুখটাই আগুনের মতো জ্বলে উঠল। কাছে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, বলছি, হুজুরের তো সবই জানা আছে। আর দেখে কী হবে?
হোয়াট? হেলথ অফিসারের মুখটা গোল আর লাল হয়ে উঠল।
গোবিন্দ আবার বলল, ময়লা মেথর দিয়ে না ফেলিয়ে দুদিন আগে এলেন না কেন হুজুর?
হেলথ অফিসার যেন গোবিন্দের ভাবটা বুঝতেই পারেনি, এমন ভাবে ফিরে তাকালেন স্যানিটারি ইনক্টেরের দিকে। বললেন, কী বলছে লোকটা?
ইনস্পেক্টর ভীত মানুষ। বলল, বুঝতে পারি না স্যার।
হেলথ অফিসার গোবিন্দকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বাড়িওয়ালা?
আমি ছুতোর, কিন্তু রাঁধিয়ে। বলে হাসতে গিয়ে হিংস্রভাবে দাঁত বের করে হিসিয়ে উঠল, কিন্তু হুজুর, জমিদারের পয়সা খাওয়া বেজন্মা নই। চোরের মতো মিছে রিপোর্ট লেখা আমার পেশা নয়।
মানে? হেলথ অফিসার হয়তো রাগেই কাঁপতে থাকে থরথর করে।
বিরিজমোহন ধমকে উঠল গোবিন্দকে, এও কামবাক্ত!
চোপ শালা! গোবিন্দের বাঁ হাতের এক থাপ্পড়ে বিরিজমোহন একেবারে ময়লার মধ্যে গড়িয়ে পড়ল।
অমনি সবাই হেসে উঠে ধেয়ে এল এ-দিকে।
স্যানিটারি ইনস্পেক্টর সরু গলায় ককিয়ে উঠল, স্যার চলে আসুন, দে আর গুণ্ডাজ।
তবে গুণ্ডার হাতেই আজ জান রেখে যেতে হবে, তাদের, যে শুয়ারের বাচ্চারা এ ময়লা ফেলিয়েছে। বলে গোবিন্দ হেলথ অফিসারের দিকে এগুতেই কে তাকে শক্ত হাতে ধরে ফেলল। সে তাকিয়ে দেখল, বাড়িওয়ালা।
হেলথ অফিসার ততক্ষণ স্যানিটারি ইনস্পেক্টরের পিছে পিছে সরে পড়তে আরম্ভ করেছে। আর বিড়বিড় করছে, ইয়েস, গুণ্ডাজ! মাডারার্স! এদিকে বিরিজমোহনকে নিয়ে হল্লা চলেছে। অনেক কষ্টে উঠে বিরিজমোহন খিস্তি করতে করতে একটা উল্লুকের মত চলতে আরম্ভ করল। তার সারা গায়ে ময়লা মাখা। এমনকী মুখে হাতেও। কেবল গোবিন্দ জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রইল পথের দিকে। বাড়িওয়ালা বলল, আমাকে বুঝিয়ে বল ফোরটুয়েন্টি, এ-সবের মানে কী?
সবাই ঘিরে এল গোবিন্দকে। কী হয়েছে, কেন এল এরা। কে ফেলল বস্তিটার চারপাশে এত ময়লা।
গোবিন্দ বলল, বুঝতে পারলে না? মামলার শেষ রক্ষে করতে চাইছে ওরা। মিসিপালটির বাবুরা আরজি করবে ধর্মাবতারের কাছে, এ ময়লা বস্তিটা যাতে তুলে দেওয়া হয়।
সবাই অবাক হয়ে এ বিচিত্র গল্প শুনল। কে বলল, আগে জানলে আমি সারারাত পাহারা দিতাম। দেখতাম কেমন করে শালা ময়লা ফেলে।
আগে জানলে! গোবিন্দ মনে মনে বলে, আগে জানলে অনেক কিছুই করা যেত। জমিদার এ মামলা-ই করতে পারত না। কিন্তু সে আর দেরি করতে পারে না। ছুটে চলে গেল উকিলের কাছে।
উকিলের কাছ থেকে ব্যারিস্টারের বাড়ি। এখন মনে পড়েছে, ব্যারিস্টার বাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন বাড়িটার আশেপাশে সব পরিষ্কার আছে কিনা।
গোবিন্দ এল ব্যারিস্টার বাড়ি। অন্ধ ব্যারিস্টারবাবু। গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বসে বসে লাল ফুটকি দেওয়া কাগজ হাতড়াচ্ছেন। সদাশিব মানুষ। গরিবের বন্ধু। কথার ফাঁকে ঝাঁকে টেবিলে টোকা দেন। আবার লাল ফুটকি কাগজ হাতড়ান। গোবিন্দ জানে না, ওটায় কী পাওয়া যায়। পাশে বসে থাকা কর্মচারীকে বলেন, সে লিখে নেয় সব কথা। আবার থেকে থেকে হঠাৎ গুনগুন করে ওঠেন।
গোবিন্দ এসে নমস্কার জানাতেই বললেন, কে, গোবিন্দ কী খবর?
গোবিন্দ সব কথা বলল। শুনে তিনি নীরব রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর বললেন, গোবিন্দ, শয়তানের সঙ্গে শয়তানীতে পাল্লা দেওয়া যায় না। ওদের অন্যভাবে কাবু করতে হয়। বু মানুষ শয়তানের কাছে হার মানে মাঝে মাঝে। তোমাদের হয়তো হার মানতে হবে। গোবিন্দ নিস্তব্ধ। তার বুকের মধ্যে এক অদৃশ্য শাণিত নখ খোঁচাতে লাগল।
তিনি আবার বললেন হঠাৎ, আচ্ছা গোবিন্দ, বস্তি যায় যাক, ওখানে তো সত্যি মানুষ থাকতে পারেন। বলে অন্ধকার চোখ দুটো তুলে তাকালেন যেন ঠিক গোবিন্দের দিকেই। গোবিন্দ বলল, কে থাকতে চায়। কিন্তু কোথায় থাকবে বাবু? এখান থেকে গেলে বিরিজমোহনের বস্তিতে যাবে। সে যে আরও নোংরা।
কেন, গরিবের মতো ভাল বাড়িতে?
সে কোথায় বাবু? সবই যে বস্তি। ভাল বাড়ির পয়সা কোথায়?
কেন, কোম্পানির কোয়াটারে?
লাইনে? সেও যে নরক বাবু। আর কটা লোক সেখানে থাকতে পারে? শতকরা পাঁচজন। আর এ বাড়ি যদি উঠিয়ে দেওয়া হয়, মানুষগুলো যাবে কোথায়?
তাঁর অন্ধ চোখের পাতা কেঁপে উঠল। বললেন, সব জায়গায় আঁটঘাট বাঁধা, না?
আপনি তো সবই জানেন।
নিশ্বাস ফেলে বললেন, সব কি জানি গোবিন্দ। তোমার কাছ থেকে জানলুম। তোমার কথাগুলিই শেষদিন বলব হাকিমকে। এ ছাড়া তো কোনও যুক্তি নেই।
গোবিন্দের কথা হাকিমকে! ছিঃ তা কি হয়। গোবিন্দের বুকটা ভেঙে দুমড়ে যেতে লাগল নিঃশব্দে।
দুপুরবেলা। নির্বাক নিস্বন্ধ বস্তি। যেন নেশা করে পড়ে আছে। হাওয়া নেই, বদ্ধ প্রমোট। বসন্ত গিয়ে গ্রীষ্ম আসছে। আসছে বৈশাখ। সবাই উন্মুখ হয়ে বসে আছে খবরের প্রত্যাশায়।
দুপুরের পর কোর্ট থেকে সবাই ফিরে এল খবর নিয়ে। জজ বলেছে-আইনত যদিও জমিটা প্রজারই ঠিকা স্বত্ব, তবু মিউনিসিপ্যালিটির রিপোর্ট অনুযায়ী এরকম একটা নোংরা আস্তানাবিশেষকে রাখা স্বাস্থ্য ও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক। যত শীঘ্র এর অপসারণ হয়, ততই মঙ্গল। মাত্র এক মাসের নোটিশ দিয়ে জানিয়েছেন, যেন এ বস্তিটি অপসারিত করা হয়। অন্যথায় উক্ত সময়ের পর সাত দিনের মধ্যে দখলকারী প্রজাকে উচ্ছেদ করা যাবে।
গোবিন্দের সমস্ত প্রচেষ্টা ভেসে গেছে। তার দু-হাত ধরে আক্ষেপ জানিয়ে গেছেন ব্যারিস্টার। বললেন, গোবিন্দ ওদের আইন যে বেআইনি হতে পারে এটা ওরা জানতে দিতে চায় না। এ আইন একদিন বদলাবে। উকিল আপসোস করেছে।
উঠোনে সবাই হাঁ করে বসে আছে। গোল হয়ে গেছে সকলের চোখগুলো বিস্ময়ে, দুশ্চিন্তার। একটা খাটিয়ার উপর খালি গায়ে শূন্য দৃষ্টিতে বসে আছে বাড়িওয়ালা। তার চোখের সামনে যেন সব অন্ধকার হয়ে গেছে। তার চিরজীবনের ব্যর্থতা যেন তার সামনে এসে খলখল করে হাসছে। বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।
গলির মুখটায় এসে দাঁড়াল গোবিন্দ। হাড্ডিসার ক্ষীণজীবী চেহারা, উসকো খুসকো চুল, চোয়াল দুটো ছুঁচলো হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। গায়ের জামাটা এখানে সেখানে ছেড়া। সর্বাঙ্গ ধুলিমলিন।
সবাই তার দিকে ফিরে তাকাল, কিন্তু কথা বলল না।
বাড়িওয়ালা মুখ ফিরিয়ে রইল তার দিক থেকে।
এমন সময় বাড়ির বাইরে গণ্ডগোল শুনে সবাই বেরিয়ে এল।
জমিদার এসেছে, এসেছে শাবল কুড়ল হাতে এক দঙ্গল মানুষ। তারা একদিনও সবুর করতে পারবে না। আর এসেছে বিরিজমোহন।
নাজির ঘোষণা করল গম্ভীর গলায় : মামলার রায় হতেই এ জমির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, জমি খালি করে দাও।
জমি খালি করে দাও? এ বস্তিটা সুদ্ধ?…হঠাৎ একটা চিল্কার আর হট্টগোল লেগে গেল।
হট্টগোল আর কান্না। ঘর খালি করো…খালি করা…
আকাশের গুমোট কেটে হাওয়া দিতে শুরু করেছে, অকাল বৈশাখী মেঘ হু-হু করে মাথা উঁচিয়ে ধেয়ে আসছে উত্তর পুব কোণ থেকে। গুমগুম শব্দে ভেসে আসছে রুদ্রের পদধ্বনি।
সারা বস্তিময় কোলাহল, কান্না, ছুটোছুটি জিনিসপত্রের দুমদাম আওয়াজ। …কোথা যাব…কোথা যাব!…
হঠাৎ দেখা গেল শাবল কুড়ল হাতে দলটা বস্তির একদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাঙতে আরম্ভ করেছে। মাটি আর ছিটে বেড়া, বাঁশ আর কঞ্চিপুরনোখোলা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, ধুলো উড়ছে।
গোবিন্দ নিথর। যেন আচমকা আক্রমণ বুদ্ধিবিভ্রম হয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে বাড়িওয়ালা পড় পড় করে টেনে ছিড়ছে বুকের চুল।
ছুটির ভোঁ বেজে উঠলো গোঁ-গোঁ করে। কালবৈশাখীর আভা উঠে আসছে মাঝ আকাশে। ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ।
মেয়ে আর শিশুর গলার আর্তনাদ ভেসে এল।
আচমকা সম্বিত ফিরে পেয়ে যেন গোবিন্দ তীব্র গলায় চিৎকার করে উঠল, না—না মিথ্যে কথা। এখনও সময় আছে। ভাঙতে পারবে না।
বলে সে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল শাবল কুড়লওয়ালাদের উপর। রোখ..থাম।…
জমিদার হুকুম করল, চালাও!
কিন্তু থেমে গেল ভাঙা। লোকগুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল গোবিন্দের দিকে। গোবিন্দ বলল, এখনও সময় হয়নি। এখনও উপর কোর্টে মামলা যাবে। কোনও পরচা না দেখিয়ে তোমরা ভাঙতে পারবে না। এতগুলি লোক কোথায় যাবে।
জাহান্নামে। বলে বিরিজমোহন চেঁচিয়ে উঠল। হটাও বদমাইসটাকে।
একটা ঠেলাঠেলি লাগল। একটা চাপা গুলতানি। তারপর হঠাৎ খানিকটা খোলার চালা ভেঙে পড়ল আর চিক্কার উঠল।
বাড়িওয়ালা ছুটে এল, ছুটে এল বস্তির সবাই। একমুহূর্তে যেন নাটকের মঞ্চে বিরতি নেমে এসেছে।
কে একজন চিৎকার করে উঠল, খুন!—
হা হা রবে মেঘ ছুটে আসছে, কালবৈশাখীর অট্টহাসি ভেসে আসছে আকাশ থেকে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।
বাড়িওয়ালা চিৎকার করে ডাকল, ফোরটুয়েন্টি!
নির্বাক গোবিন্দ, সারা গা মাথা রক্তারক্তি। আধবোজা চোখে যেন সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। রোগা শরীর, উসকো-খুসকো চুল। অনেকগুলো গলা সমস্বরে চিৎকার করে ইঠলো, খুন করেছে।–
জমিদারের দলটা পালাচ্ছে সকলের এ বিহুলতার ফাঁকে। শাবল কুড়লের দলটাও চেঁচাচ্ছে, খুন! কে খুন করল। কে? কে?
বিরিজমোহন চিৎকার করে বলল, ভূত। ভূতে মেরেছে ওকে।
তারা সব মেঘাচ্ছন্ন গাঢ় অন্ধকারে পালাল।
বাড়িওয়ালা গোবিন্দকে তুলে নিয়ে এল বস্তির উঠোনে।
বস্তির পূর্ব দিকটা প্রায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। সেই মুক্তপথে হু-হু করে হাওয়া আসছে। গোবিন্দ তখনও মরেনি। বোধ করি শেষবারের জন্য সে ও-দিকে ফিরে তাকাল। ওই উত্তর দক্ষিণে বিলম্বিত নিউ কর্ড রোড, পুর্বে ঝোপে ঝাড়ে ছাওয়া বাঁকা রাস্তা চলে গেছে রেললাইন পেরিয়ে, বহু দূরে বারাসাত…বসিরহাট..ইটিভেঘাট…ইচ্ছামতী! ছুতোর বউ, ছেলে…
বায়ুকোণ থেকে গোঁ গোঁ করে হাওয়াছুটে এল। গোবিন্দের মাথার চুলগুলি এলোমেলো হয়ে গেল। পূর্ব দিকটা বিধ্বস্ত হয়ে যেন বস্তিটা মাঠের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে যেন আকাশ এসে ছুঁয়েছে উঠোনটা। দুলারী এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। গোবিন্দের দোস্তানি। কিন্তু গোবিন্দের চোখের দৃষ্টি তখন স্থির হয়ে গেছে। সে আধখোলা চোখের দৃষ্টি যেন শান্ত, কিন্তু ক্ষুব্ধ।
কে একজন বলে উঠল, দ্যাখ, শাবল নয়, পেটের কাছে ছুরি মারার দাগ রয়েছে। লুকিয়ে মেরেছে, নইলে…
বাড়িওয়ালা বিড়বিড় করছে, জমিদার…দালাল!
একটা শিশুগলা ফিসফিসিয়ে উঠল, মেরে ফেলেছে ফোটুন্টি চাচাকে! খোলা পুব দিক থেকে ঝড়ের ঝাপটা বয়ে যেতে লাগল। সাপের ‘চেরা জিভের মতো যেন হিসিয়ে উঠছে বিদ্যুৎ। গুমগুম শব্দে ধরিত্রী কাঁপছে।
সমস্ত এলাকা খালি করে লোক আসছে, ভরে উঠছে উঠোনটা। সবাই দেখতে আসছে ফোরটুয়েন্টিকে।
একজন চেঁচিয়ে উঠল, আমি জানি ওকে কে মেরেছে। কিন্তু মাঝ পথেই অসহ্য তিক্ত গলাটা যেন চেপে বন্ধ হয়ে গেল।
বাড়িওয়ালা ছুটে ঘরে চলে গেল। অসহ্য একটা অপরাধ বোধের যন্ত্রণা তাকে কামড়ে ধরেছে, তার জীবনের শেষ সম্বল তিনশো টাকার থলিটা ছুড়ে ফেলে দিল মাটিতে। কার জন্য এ-সব! আমি বেইমান! আমি আসল ফকির বনেছি-ফকির।
দুলারী সকলের অলক্ষ্যে নিজের ঘরে গিয়ে মাটিতে মুখ দিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠল, আমার কলিজার দুটো পাশ; একটা জেলবন্দি আর একটা আমি আপন হাতে টিপে দিয়েছি, শেষ করেছি। আমার ভাঙা ঘর…।
সেই রুগ্ন ছেলেটির মধ্যবয়সী মা গোবিন্দের পাশে বসে তার কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিল, মুখের রক্ত মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, আমি তোকে যম বলেছি, আমার সোনার বাছা। তোর যম যেন কোনওদিন রেহাই না পায়।
তারপর সব নিস্তব্ধ। আস্তে আস্তে একটা অদ্ভুত গুলতানি উঠতে লাগল ভিড়ের মধ্যে। উঠোনের বাইরে মাঠে ছড়িয়ে পড়ছে ভিড়। আকাশের কালবৈশাখীর ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপটা গুলতানি হু-হু করে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে দিগন্তে।