বিহুপরী
পরী ডিব্রুগড়ের তরাইজান গ্রামের বিহুদলের নিয়মিত সদস্য l বৈশাখ মাসে ওদের বায়না অনেকগুলো থাকে l আশে পাশের গ্রামগুলোর বিহু কমিটিগুলোতে ওদের চাহিদা তুঙ্গে l এবারও ছিল l কিন্তু এই মারণ রোগ দেশে ছড়িয়ে পড়তে সরকার সবরকমের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে l গতবার বিহুপরির শিরোপা পরীর মাথায় উঠেছিল l ভালো টাকা হাতে পেয়েছিল l নিজের জন্য মেখলা চাদর কিনেও বেশকিছু টাকা তুলে দিয়েছিলো মা’র হাতে l বাবা তার ছোটবেলায় মারা গিয়েছে চারদিনের ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগে।
পরীর আবার মন দেওয়া নেওয়ার পালা চলছে পাড়ারই এক যুবক কিশোরের সাথে l কিশোরও বিহু দলের নিয়মিত সদস্য ছিল l ভালো ঢোল বাজায় l দুই বছর হলো কোম্পানির কাজে যোগ দিয়েছে হায়দরাবাদে l শপিং মলে গার্ডের চাকরি l হাইয়ার সেকেন্ডারি পযন্ত পড়াশোনা l কোম্পানির লোকেরা এসে লোভ দেখালো l গ্রামের আরো আট-দশজন ছেলে আছে একসাথে l সরকারের হাতে কোনো চাকরি নেই l বড় কোনো কোম্পানি আসছে না জঙ্গিবাদের ভয়ে l তার উপরও বিভিন্ন দল সংগঠনের অযৌক্তিক দাবি রয়েছে l তাই ইয়ং জেনারেশনের ছেলেরা পাড়ি দিচ্ছে ভিনদেশে l ফি বছর এই সময়ে আসে l এবারও রওয়ানা দিয়েছিলো আসবে বলে l তারপর সব বন্ধ হয়ে গেলো লক ডাউনে l খবর এসেছে ওদেরকে আসাম-বেঙ্গল বর্ডার শ্রীরামপুরে কোয়ারান্টিনে রেখেছে l চৌদ্দদিন থাকতে হবে l
পরী উদাসভাবে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে l এই সময় প্রকৃতি যেন সেজে উঠে l শিমুল-পলাশরা রাঙিয়ে দেয় মানুষের মন l কিশোর-কিশোরীদের মনে প্রেমের বন্যা বয় l ভূপেন হাজারিকার কথায়, ‘বৈশাখ, একটি ঋতু নয়, নয় শুধু একটি মাস, বৈশাখ অসমীয়া জাতির আয়ুষরেখা, গণ জীবনের ঈর্ষা l ‘ পাশের রুমে পরীর ছোট ভাই বিপুল গানের রেওয়াজ করছে l জুবিনকন্ঠী হিসাবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে l কমিটিগুলো ভালো টাকাই দেয় l বিহুতে গাইবে বলে বেশ কয়েকটি কমিটির সাথে বায়না হয়েছিল l এবার আর কোনো আশা নাই l তবুও রেওয়াজ চালিয়ে যাচ্ছে l
হঠাৎ পরীর মনে হলো, গ্রামের শেষ মাথায় যেখানে গাড়ির রাস্তা চলে গিয়েছে, সেই পথ ধরে কেউ যেন এদিকে আসছে l আবছা চেহারা ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে l কিশোর না, হাঁ কিশোরই তো l আনন্দে পরীর মন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো l যেন হাজার বাতির আলোকমালা জ্বলল আকাশে l মনে হলো বিহুতলীতে পরী বিহুপরি সেজে নাচছে ঢোল পেঁপার সুরে সুরে l কিশোর মাথায় গামোচা, কোমরে ঢোল নিয়ে নেচে নেচে গাইছে, ‘আচিন আয়াং মানে কি ও মরমী’, আচিন আয়াং মানে হলো বুকে জমে থাকা ভালোবাসা’ l পরীর যেন আনন্দের সীমা নেই, খুশিতে মন ভরে যাচ্ছে l
‘ও পরী ! ও পরী ! এখনো ঘুমিয়ে আছিস যে বড়’ l মা’র কথায় পরী হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসলো l মা বলছে, ‘সন্ধ্যা হয়ে এলো, গোসাঁই ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালা গিয়ে l’ মুহূর্তে পরীর মন বিষাদে ভরে গেলো l এতক্ষন তাহলে স্বপ্ন দেখছিলো l তখনও পাশের রুমে বিপুল গান চৰ্চা করছে, ‘আচিন আয়াং মানে কি ও মরমী………: l