Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিস্মৃত-প্রেম || Sankar Brahma

বিস্মৃত-প্রেম || Sankar Brahma

বিস্মৃত-প্রেম

এক).

বাজারের এদিকটায় মাতালদের ভিড় । মদের দোকান আছে একটি। এদের গায়ের ছোঁয়া লাগতেই আরও রাগ বাড়ছে সমীরের। সবকিছুই ঘৃণা করে সে। ঘৃণা চেপে রাখতে পারে না। মুখে ফুটে ওঠে, মুখ বেঁকে যায় তার। কয়েকদিন ধরে কবিতা না লিখতে পারলে, এমন দশা হয় । কিছুই ভাল লাগে না। ঘরেও মন টেকে না। বাইরে বেরিয়ে এসে অস্থির ভাবে হাঁটা শুরু করে। কোথায় যাবে, কেন যাবে? তা সে কিছুই জানে না। যে দিকে দু’চোখ যায়, যে দিকে যেতে মন চায়, সেদিকেই হাঁটতে থাকে। মনে মনে নিজের প্রতি তার একটা উদগ্র রাগ থাকে,যা ঘৃণায় পরিণত হয় । সেটা আসলে না লিখতে পারার রাগ তার কষ্টে রূপন্তরিত হয়। আর তারই প্রতিফলন ঘটে সমাজের সব কিছুর প্রতি তার ঘৃণার ভাবে ।
চেহারাটা তার মন-কারা! দেখতে সুদর্শন সে। বেশ লম্বা, দশজনের ভিড়ে দাঁড়ালে মাথা উঁচু হয়ে থাকে সবার ওপরে। ছিপছিপে শরীর অথচ সুগঠিত। দুটি চোখ গভীর কালো আর দ্যুতিময়। মাথাভর্তি একরাশ কালো চুল মুখের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে ।
ক্ষণিকের জন্যে ঘৃণায় মুখ কুঁচকে গিয়েছিল তার । তারপরেই বিভোর হয়ে গেল সে তার নিজের ভাবনায়। আশপাশে আর নজরই রইল না তার। নজর দেওয়ার প্রবৃত্তিও রইল না। কথা বলে চলছে সে নিজের সঙ্গে আপনমনে। মনে মনে সে আওড়ে চলেছে তার আগামী কবিতার লাইনগুলি। নিজের বলা কথাগুলি নিজেই শুনছে সে। আর মনে মনে বুঝতে পারছে, তালগোল পাকিয়ে গেছে তার মাথার ভিতরটা।
এ’সময় একটু মাল খেতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু পকেটে তেমন রেস্ত নেই তার, যে মদের দোকানে বসে একা একা মদ খাবে।
আসলে গোটা দুনিয়াটার উপর বিদ্বেষে ভরে আছে মনের ভিতরটা। কবিতার ভাবের উপরে বিদ্বেষ। কবিতার শব্দের উপর বিদ্বেষ। কবিতার লাইনগুলির উপর বিদ্বেষ। বাইরের দুনিয়ার প্রতি তাই তার আর কোন আগ্রহ নেই।
সে নিজের মনে মনে কথা বলতে বলতে চলছে।

দুই).

মন কেমনকরা এক চৈত্রের উদাস সন্ধ্যায় মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিল সমীর এক কফি-শপে। সত্যি কথা বলতে কি, দেখতে তেমন আহামরি কিছু নয়। কাপড় চোপড়েও বিশেষত্ব ছিল না কিছু। চুলগুলি অগোছালো ভাবে পিঠে ছড়িয়ে ছিল । যুবতী তাকে বলা যাবে না। পঁচিশ-ছাব্বিশের কাছাকাছি বয়স , আবার মেয়ে বলাটাও ঠিক হবে না । তাকে দেখে মনে হল সমীরের, সে শুধু তারই জন্য। ওকে দেখা মাত্র হৃদকম্পন বেড়ে গেল, বুক শুকিয়ে যেন সাহারা। আপনাদের হয়তো একটা নির্দিষ্ট ধরণের মেয়ে পছন্দ – যার পায়ের গোছা হালকা পাতলা, কিংবা চোখ পটল-চেরা , চাঁপার কলির মতো আঙুল।
সমীরের নিজেরও পছন্দ-অপছন্দ বলে একটা ব্যাপার আছে । কখনও-সখনও এমন হয়েছে যে, কাফেতে বসে সে কফি খাচ্ছে , তখন পাশের টেবিলের মেয়েটির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছে, শুধুমাত্র তার নাকের গড়ন ভাল লেগেছে বলে। নাক তার খুব পছন্দের জিনিষ। কিন্তু এই মেয়েটির ক্ষেত্রে তার নাকের গড়ন কেমন ছিল তা সে মনে করতে পারছে না কিংবা আদৌ তার নাক ছিল কিনা তা-ও খেয়াল নেই। তবে যা মনে আছে, মেয়েটি মোটেই তেমন সুন্দরী দেখতে ছিল না। আজব ব্যাপার হলো তাকেই সমীরের ভাল লেগে গেল। ‘মাইরী কাল যার সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার, সে বোধহয় আমার জন্যই জন্মেছে।’ বারদুয়ারীতে( বাংলা মদের দোকান) বসে কথাটা সমীর বলল আমাকে।
– ও তাই নাকি, আমি বললাম , দেখতে কেমন ছিল সে, খুব সুন্দরী বুঝি ?
– না, মোটেই সুন্দরী নয় সে।
– তবে যে রকম ডাসা মাল তোর পছন্দ, সে রকম নাকি?
– জানি না রে ভাই। তার কোনও কিছুই মনে নেই আমার।
– তার মুখের গড়ন কিংবা ধর বুকের সাইজ?
– ওসব তো দেখিনি আমি, শুধু দেখেছি তার চোখদু’টি ।
– আশ্চর্য
– হ্যাঁ, সত্যি। আশ্চর্য-ই বটে। গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে আমি বললাম,সে যাক গে, কী করলি শেষপর্যন্ত? কথা বলেছিস? পিছু নিয়েছিলি তার?
– নাহ্। শুধু পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে কপি-শপ থেকে বেরিয়ে, গায়ে শুধু মৃদু বাতাস লাগল তার যাওয়ার। কালকের বিকালটা সত্যিই খুব মনোরম ছিল , সমীর কথাটা বলে কেমন উদাস হয়ে গেল। তারপর গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিল।
– কথা বলতে পারতিস তার সঙ্গে।
– ইচ্ছে হয়নি। হয়তো দশ মিনিট কথা বলা যেত। ওর নিজের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, বলতে পারতাম আমার কথাও।
– তবে বলিস নি কেন?
– ওই যে বললাম, ইচ্ছে হয়নি। এখন ভাবি, কে ওকে পাঠাল আমার জন্য কফি-শপে? ভিজে ছোলা চিবোতে চিবোতে আমি বললাম, কথাবার্তা শেষ করে তোরা কোথাও গিয়ে লাঞ্চ সারতে পারতিস, দেখতে পারতিস কোনও সিনেমা। আর বরাত ভাল থাকলে হয়তো বিছানা অবধি গড়াতে পারত ব্যাপারটা। কথাটা বলেই, আমি আমার স্বভাব-সুলভ ভঙ্গীতে, হাসলাম।
সমীর আমার কথা শুনে রাগ করবে ভেবেছিলাম। বরং সে বলল, হ্যাঁ, হৃদয়ে আমারও নানা রকম অজানা সম্ভাবনা উঁকি মারছিল। কিন্তু মনের কথাটা যে কী করে বলি তাকে? আর বলবই- বা কী?
– গুড ইভিনিং। একটুখানি কথা বলার সময় হবে আপনার? দুর, নেহাতই হাস্যকর। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দালালদের মতো ।
– মাফ করবেন, সারারাত খোলা থাকে এরকম কোনও ঔষধের দোকান কি আপনার জানা আছে ? না, এটাও একই রকম হাস্যকর। তাছাড়া ওষুধ কেনার মতো কোন প্রেসক্রিপশনও তখন আমার কাছে ছিল না ।
তারপর গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিয়ে বলল, কিংবা বলতে পারতাম, আপনাকে খুব ভাল লাগে আমার। হয়তো কথাটা বিশ্বাসই করত না সে । বলে বসতে পারত, আমাকে আপনার ভাল লাগে তো হয়েছেটা কী তাতে? আমার আপনাকে পছন্দ নয় মোটেও। বলতেই পারত সে এমন কথা। তাহলে তো ওই আঘাত আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারতাম না। বয়স আমার বত্রিশ, দিনে দিনে তা বাড়ছে। বিষণ্ণ সুরে কথাটা বলল বসন্ত।

আবার এক সন্ধ্যায় একটা ফুলের দোকানের সামনে আমরা মুখোমুখি হয়ে ছিলাম। একে অপরকে অতিক্রম করে চলে গেলাম। তার শাড়ির হালকা স্পর্শ ছুঁয়ে গেল আমাকে। নাকে এল গোলাপের ঘ্রাণ। কথা বলার জন্য কিছুতেই এগোতে পারলাম না। বাসন্তী রঙের একটা শাড়ি পরে ছিল সে, ডান হাতে ধরা ছিল তার একটা কবিতার বই। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, বইটি আমারই লেখা।
কয়েক পা এগিয়েই পেছনে ফিরে দেখি ভিড়ের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেছে সে।
এখন আমার মনে হচ্ছে, ওকে তখন আমার বলা উচিত ছিল, আপনাকে ভীষণ চেনা চেনা লাগছে , কোথাও দেখেছি যেন এর আগে? কবিতার বইটি পড়েছেন? কেমন লাগলো? আর শেষ হতে পারতো….
কী দিয়ে যে শেষ হতে পারত, তা পরিস্থিতিই ঠিক করে দিত।


তিন).

দশবছর আগে, এই কলকাতায় ছিল একটা ছেলে আর একটা মেয়ে । ছেলেটির বয়স তখন ছিল বাইশ আর মেয়েটির ষোলো। ছেলেটি দেখতে খুব হ্যান্ডসাম ছিল, তবে মেয়েটিও ছিল না তেমন নজরকাড়া সুন্দরী। তারা দু’জনেই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বিশ্বাস করত যে, পৃথিবীর কোথাও-না-কোথাও তাদের জন্য পছন্দসই কোনও জুটি আছে। হ্যাঁ, দৈবে বিশ্বাস করত তারা, আর সেই দৈব-বশেই ঘটনাটি ঘটল।
একদিন রাস্তার এক মোড়ে মুখোমুখি দেখা হল তাদের দু’জনের। ছেলেটি বলল, খুবই আশ্চর্য ব্যাপার, সারা জীবন ধরে আমি তোমাকে খুঁজছি। আমার জন্যই জন্ম হয়েছে তোমার।
– আর তুমি, মেয়েটি বলল , তুমিও আমার জন্যই। যেমন ভাবে আমি আমার মনের মধ্যে একটা মধুর স্বপ্ন এঁকে রেখিছি। তুমি ঠিক সেই স্বপ্নের রাজকুমার। বলেই তারা পরস্পর হাত ধরাধরি করে একটা পার্কের মধ্যে গিয়ে বসল আর ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে নিজেদের মধ্যে কথা বলে যেতে লাগল। এখন আর তারা নিঃসঙ্গ নয়। কাক্ষিত মানুষের দেখা পেয়ে গেছে। একেবারে অলৌকিক ব্যাপার, একটা মহাজাগতিক শক্তির টান। তখন মোবাইলের এতো প্রচলন ছিল না।

এরই মধ্যে মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগের ব্যাপারও দু’একবার ঘটেছে তাদের মধ্য। একদিন ছেলেটি মেয়েটিকে বলল, তোমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছি, শুনবে?
– বল শুনি।

” তুমি আমার মিষ্টি সোনা, তুমিই আমার মন
তোমার উপর রাগ করে আর থাকব কতক্ষণ?
সুজন আছে অনেক আমার, মিষ্টিসোনা এক
মনকে বলি, মিষ্টি সোনার দিকেই শুধু দেখ।

অনেক মায়ায় গড়েছি এই স্বপ্নের সংসার,
তুমি ছাড়া জানো সেথায় কেউ থাকে না আর,
একটি শিশুর মুখ উঁকি দেয় হঠাৎ অপলক,
তোমার কাছে পৌঁছে গেলেই সুখের স্বর্গলোক।

বাতাস জানে সে’সব কথা, আকাশ শুনে হাসে
হাস্নুহানার গন্ধ এসে বসে আমার পাশে,
আমি তাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারি,
হাস্নু শুনে, বিশ্রি ভাবে হাসতে থাকে ভারী।

তোমার ভিতর মায়ার জগৎ থাকে বিলক্ষণ
সকল সময় সেইখানে যে থাকে আমার মন,
তোমার দিকে বিশ্ব জগৎ তাকায় অনিমেষ
একটি নতুন মুখ উঁকি দেয় হঠাৎ কেমন বেশ।”

ষোড়শী মেয়েটি কবিতাটি শুনে কি বুঝল কে জানে? লজ্জায় রাঙা হয়ে, মাথা নামিয়ে নিল নীচের দিকে।

ছেলেটি আর মেয়েটি দু’জনকেই, বসন্ত রোগ এসে ভয়াল কামড় বসাল, এক বসন্তে। জীবন-মৃত্যুর সাথে কয়েক সপ্তাহ লড়াই করার পর, তারা সুস্থ হয়ে উঠল বটে, তবে হারিয়ে ফেলল বিগত দিনের সব স্মৃতি । যখন জ্ঞান ফিরল তাদের মাথার ভিতরটা একেবারে শূন্য, ফাঁকা হয়ে গেল।

তারা দুজনেই ছিল বুদ্ধিদীপ্ত মনের, দৃঢ়চেতা স্বভাবের। নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টার পর তারা আবার অর্জন করল সেইটুকু বোধশক্তি আর জ্ঞান , যার ফলে তারা নতুন করে সমাজের স্বাভাবিক জীবনের স্রোতে ফিরে আসতে পারল। এখন তারা সুস্থ-সবল তরুণ তরুণী। তারা এখন জানে কী করে এক রাস্তা থেকে আর এক রাস্তায় গিয়ে বাস ধরতে হয়। ফুলের দোকানে গিয়ে দাম দর করে ফুল কিনতে হয়।
সময় বয়ে যায় দ্রুত গতিতে। শীগগিরই ছেলেটির বয়স বত্রিশে গিয়ে পৌঁছাল আর মেয়েটির ছাব্বিশে।
চৈত্রের এক চমৎকার মায়াময় সন্ধ্যায় তরুণীটিকে দেখে আলোড়নকারী প্রেমানুভূতির সঞ্চার হল ছেলেটির মনে।
বসন্তের মন আনচান করা সেই সন্ধ্যায় করণীয় কাজ শেষ করে কফির খোঁজে সমীর হাঁটছিল কফি-শপের দিকে। আর তরুণীটিও বসেছিল সেই কফি-শপে, যেখানে সে গিয়ে ঢুকলো। একে অপরকে দেখল । হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির একটা ম্লান সূক্ষ্ম রশ্মি মুহূর্তের জন্য আলো ছড়াল মনের ভিতরে। বুকের ভিতর বেজে উঠল বসন্তের সুর-লহরী।
কিন্তু তার স্মৃতির রশ্মি তখন খুবই ক্ষীণ যে মনের ভিতরে, দশ বছর আগের সেই স্মৃতি তখন বড়ই ম্লান। কোনও স্বচ্ছতা নেই তাতে আর । দুবার দেখা হওয়া সত্বেও তারা কোনও কথা না বলে একে অপরকে দেখেও ভিড়ের মধ্যে দিব্যি মিশে গেল, হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *