Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিষ || Tarapada Roy

বিষ || Tarapada Roy

বিষ

বাংলা গল্পের ইংরিজিতে নাম দেওয়া মোটেই উচিত নয়। তাই বাধ্য হয়ে এ গল্পের নাম দিতে হল বিষ। না হলে গল্পটির প্রকৃত নাম হয় পয়জন (Poison), অবশ্য ইংরেজি শব্দটি বাংলা হরফে পয়জন লিখলেও চলত। তবে শব্দটা গল্পের নাম হিসেবে চোখে ভাল লাগছে না। তাই অগত্যা বিষ, বিষই বা খারাপ কী?

গল্পের ভিতর যাতে কোনও অনাবশ্যক জটিলতার সৃষ্টি না হয় তাই পয়জনের ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।

পয়জন একটি জগৎবিখ্যাত সুরভির নাম। আগেকার দিনে যেমন সুগন্ধির নামকরণে। প্রস্তুতকারকেরা প্রায়ই কিছুটা, কোথাও বা চূড়ান্ত রোমান্টিকতা দেখাতেন যেমন ইভনিং ইন প্যারিস বা প্যারিসের সায়াহ্ন অথবা প্রগাঢ় ইনটিমেট।

এখনকার প্রচলিত বিদেশি সুরভিগুলোর নাম আর তেমন মধুর রোমান্টিক নয় বরং উলটো, তীব্র তীক্ষ্ণ সেই সব নাম। ব্ল্যাক উইডো, বুট বা পয়জন এসব নাম দেখে অনুমান করাই কঠিন এগুলো। প্রসাধন সামগ্রী, গন্ধদ্রব্য। কাউন্টারে আনকোরা ক্রেতারা এসব নাম দেখে কখনও কখনও যে ভড়কিয়ে যায় না তা নয়।

আপাতত এই ক্ষুদ্র গৌরচন্দ্রিকার পরে আমরা আসল কাহিনিতে সরাসরি প্রবেশ করছি।

স্মৃতিশেখর দত্ত উত্তর আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাজ্যের একটি ভুবনবিদিত প্রতিষ্ঠানের উচ্চস্তরের গবেষক। তাঁর বিষয় হল ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান। পদার্থ, রসায়ন ও উদ্ভিদবিদ্যার সীমান্ত এলাকায় তাঁর কলা গাছের ফলের মধ্যে তাপ লেগে যে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার দ্বারা ফল পাকে, সেই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা যায় কিনা এই নিয়ে স্মৃতিশেখর গত সাড়ে দশ বছর গবেষণা করছেন। এই গবেষণায় যদি তিনি সফল হতে পারেন তাহলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর ফল উৎপাদন দ্বিগুণ, তিনগুণ হারে বেড়ে যাবে। এবং সেই সঙ্গে স্মৃতিশেখর নোবেল পুরস্কারও পেয়ে যেতে পারেন।

স্মৃতিশেখরের বয়স চুয়াল্লিশ। আজ প্রায় দীর্ঘ কুড়ি বছর তিনি মার্কিন দেশে আছেন। তিনি কলকাতারই ছেলে, কলকাতা থেকেই বিদেশে গিয়েছিলেন। কিন্তু এখন আর দু-চারজন পুরনো বন্ধুবান্ধব, দূর সম্পর্কের কিছু আত্মীয় ছাড়া কলকাতায় তাঁর আর কেউ নেই। মা বাবা উভয়েই বেশ কিছুদিন হল বিগত হয়েছেন। থাকার মধ্যে এক দিদি আছেন, তার জমজমাট সংসার বর্ধমানে।

স্মৃতিশেখর মুক্ত পুরুষ। বছর পনেরো আগে একবার কলকাতায় এসে বিয়ে করেছিলেন। তখন মা বাবা বেঁচে ছিলেন, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে, পাত্রী যাচাই করে, গড়িয়াহাট রোডে বিশাল বাড়ি ভাড়া করে, দেশাচার কালাচার পালন করে, শাস্ত্রসম্মতভাবে স্মৃতিশেখরের বিয়ে হয়েছিল। সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, বিদুষী, সুলক্ষণা, সর্বগুণসম্পন্না, গৃহকর্মনিপুণা ইত্যাদি রবিবারের খবরের কাগজের বিজ্ঞাপিত পাত্রীর যা যা যোগ্যতা থাকে স্মৃতিশেখরের স্ত্রী প্রিয়ংবদার সে সবই ছিল।

তবে কিছুদিন সংসার করার পর স্মৃতিশেখর আবিষ্কার করেছিলেন যে তার স্ত্রী আর যাই হোক না কেন প্রিয়ংবদা নন। প্রবাসে কঠোর পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে সামান্য বিশ্রাম ও শ্রান্তির সময়ে প্রায় অকারণে প্রিয়ংবদার কর্কশ ও নিষ্ঠুর বাক্যবাণ স্মৃতিশেখরের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।

প্রিয়ংবদার রাগ হয়তো অকারণ ছিল না। মার্কিন শহরতলিতে নির্জন, বন্ধ বাড়িতে নিঃসঙ্গ জীবন তাকে খিটখিটে করে তুলেছিল। এমনিই আশৈশব তিনি অসহিষ্ণু ছিলেন। তা ছাড়া মার্কিনিদের কথা বোঝার অপারগতা এবং সেইসঙ্গে ইংরেজিতে মৌখিক কথাবার্তা চালানোর অভ্যাস না থাকায় প্রিয়ংবদা বিদেশে একেবারে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন।

প্রথম দু-চার মাস সাহেবি জীবনদারার চটক ও চমক দেখে এবং মধুচন্দ্রিমার আমেজে মোটামুটি ভালই ছিলেন প্রিয়ংবদা কিন্তু পরে অস্থির হয়ে পড়লেন। সেই অস্থিরতা প্রকাশিত হল স্মৃতিশেখরের প্রতি ব্যবহারে।

আরও একটা কারণ এখানে উল্লেখ করে রাখা উচিত। অনেকদিন ওদেশে থাকার ফলে নিজের প্রতিষ্ঠানে এবং বাইরে স্মৃতিশেখরের বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবী হয়ে ছিল, সাহেবমেম, ভারতীয় সব রকমই।

প্রথম থেকেই এদের কাউকেই প্রিয়ংবদা মোটেই সহ্য করতে পারেননি। তার কোন সন্দেহ হয়েছিল এরা সবাই তাকে করুণার চোখে দেখে। এবং সন্দেহটা ঠিকই ছিল। সবাই ভাবত স্মৃতিশেখরের মতো ব্রিলিয়ান্ট লোক কী করে এমন সঙের পুতুলের মতো শাখা, সিঁদুর পরা মেয়ে সম্বন্ধ করে বিয়ে করে নিয়ে এল।

অবশেষে যা অনিবার্য তাই ঘটল। একটা সদ্য দেশ থেকে আসা বাঙালি ছেলে তারও প্রিয়ংবদার মতো একঘরে অবস্থা। তবে তার একটা কাজ আছে এই যা তফাত। অচিরেই সেই ছেলেটি আর তার প্রিয়ংবদা বউদি খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল। সময়ে অসময়ে ছুটির দিনে সে যথাসাধ্য প্রিয়ংবদা বউদিকে সঙ্গদান করতে লাগল।

একদিন অতিরিক্ত সঙ্গদান করার সময়ে স্মৃতিশেখর হঠাৎ একটু অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। তখন স্মৃতিশেখরের মুখ দর্শন করার অবস্থা প্রিয়ংবদার ছিল না। তিনি দয়িতের সঙ্গে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এক বস্ত্রে স্বামীগৃহ ত্যাগ করেন।

তারপরে প্রিয়ংবদার কোনও খোঁজখবর স্মৃতিশেখর নেননি। দেশ থেকে প্রিয়ংবদার নামে কখনও দুয়েকটা চিঠিপত্র প্রথম দিকে এসেছে, সেগুলো প্রাপক অনুপস্থিত লিখে পরের ডাকে প্রেরকের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন।

মুক্ত জীবন স্মৃতিশেখর মেনেই নিয়েছিলেন। এখানে বহুলোক এরকম জীবনযাপন করে। কিন্তু গত বছর দেশ থেকে দিদি এসেছিলেন তার কাছে বেড়াতে। স্মৃতিশেখরই দিদিকে একটা রিটার্ন টিকিট পাঠিয়ে ছিলেন।

স্মৃতিশেখর এক মেমসাহেবের সঙ্গে তখন যুগ্ম জীবনযাপন করছিলেন। মাস দুয়েকের জন্যে সেই মেমসাহেবকে তিনি অন্যত্র রাখার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু দিদি আসার পরেও সেই মেমসাহেব মাঝেমধ্যেই আসত, রাতে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করত।

বুদ্ধিমতী অগ্রজার দৃষ্টি এড়াতে পারল না এই ব্যাপারটা। দিদি স্মৃতিশেখরকে বললেন, ওই ক্যারল না কী নাম ওই মেয়েটার, ওর বয়েস কত?

স্মৃতিশেখর ক্যারলের এ দিকটা কখনও ভেবে দেখেননি, আমতা আমতা করে অনুমানে বললেন, তা বোধহয় পঞ্চাশ, পঞ্চান্ন হবে।

দিদি তাই শুনে বললেন, এ কী অলক্ষুণে কথা। তাহলে তো ওর বয়েস আমার চেয়ে বেশি।

মূল মার্কিন ভূখণ্ডে এ জাতীয় কথা খুব বেশি হয় না। স্মৃতিশেখর কী আর বলবেন, চুপ করে রইলেন।

স্মৃতিশেখর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর দিদি চেপে ধরলেন, এ ভাবে চলবে না। এ কী অনাচার। পশুর জীবন! তুই আবার বিয়ে কর।

স্মৃতিশেখর সহজে রাজি হননি। অনেক দোনামনা করে আগের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা দিদিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে অনেক কথা বললেন তিনি। তা ছাড়া বয়েস বাড়ার ব্যাপারটা রয়েছে।

দিদি বললেন, তোর আর কী বয়েস হয়েছে। তুই এবার দেশে আয়। এবার আর ভুল হবে না। এবার তোর যোগ্য, উপযুক্ত মেয়ে দেখে রাখব।

স্মৃতিশেখর বললেন, আমি বছরখানেকের মধ্যে এখানকার পাট গুটিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছি। গবেষণা ঢের হয়েছে, বয়েসও বেড়ে যাচ্ছে। তখন দেশে ফিরে গিয়ে আবার বিয়ে করার কথা ভাবা যাবে।

স্মৃতিশেখর ভেবে দেখেছেন গত কয়েক বছর ধরে তার গবেষণা প্রায়ই একই জায়গায় ঠেকে রয়েছে, হঠাৎ নতুন করে আর কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। হাতে যে পরিমাণ ডলার জমেছে তা ছাড়া বাড়ি, গাড়ি বেচে যা পাওয়া যাবে ভারতীয় টাকায় তার পরিমাণ অকল্পনীয়। সে টাকায় কলকাতায় সবচেয়ে ভাল ফ্ল্যাট কিনে, ব্যাঙ্কে টাকা জমা রেখে তার সুদে একটা জীবন চমৎকার কেটে যাবে।

.

সেই চমৎকার জীবন কাটানোর জন্যে অবশেষে স্মৃতিশেখর দেশে ফিরে এসেছেন। আগেই দক্ষিণ কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট বায়না করে রেখেছিলেন এক বন্ধুর মারফত। এখন ফিরে এসে টাকা পয়সা মিটিয়ে, ফার্নিচার কিনে সাজিয়ে গুছিয়ে সেই ফ্ল্যাটে উঠেছেন।

অতঃপর দিদির বুদ্ধিমতো ও পছন্দমতো একটি বয়স্কা পাত্রীও সংগ্রহ হয়েছে।

বছর চল্লিশ বয়েস হবে হিমানী নামে এই পাত্রীটির। বিবাহ ব্যাপারে হিমানীর অভিজ্ঞতা বিস্তর। বছর দুয়েক আগে ডিভোর্স হয়েছে স্বামীর সঙ্গে। তার আগে একবার বিধবা হয়েছিলেন। তবে প্রথম বিয়েটার কথা সবাই জানে না, স্মৃতিশেখরের দিদিও জানেন না। তিনি খবরের কাগজে উদার মতাবলম্বী, সংস্কারমুক্ত পাত্র চাই। পাত্র নিজেও যোগাযোগ করিতে পারেন এই বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেছিলেন।

হিমানী গায়ে গতরে শক্ত সমর্থ, আঁটোসাটো মেয়েমানুষ। একটি সওদাগরি দপ্তরে ব্যক্তিগত সচিবের কাজ করেন। বহুদর্শী রমণী এবং একটু দুশ্চরিত্রাও, সেটা অবশ্য হিমানী মনে করেন তার চাকরির অঙ্গ।

স্মৃতিশেখর-জাতীয় ব্যক্তি সম্পর্কে হিমানীর অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। তার অফিসেও ওপরওয়ালাদের মধ্যে দুয়েকজন বিলেতফেরত গবেষক, তার মধ্যে একজন রীতিমতো লম্পট। হিমানী তাকেও কখনও কখনও সাহচর্য দিয়েছেন।

এই হিমানীদেবীর সঙ্গে স্মৃতিশেখর দত্তের বিয়ে আজ দুপুরেই রেজিস্ট্রি হয়েছে, নিতান্ত সাদাসিধে ভাবে আজ স্মৃতিশেখরের দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটে বিবাহরজনী তথা ফুলশয্যা পালিত হচ্ছে।

স্মৃতিশেখরের দিদি-জামাইবাবু, ভাগনে-ভাগনিরা দিনের বেলায় এসেছিল, তারা সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বর্ধমান ফিরে গেছে। হিমানীর অফিসের কেউ কেউ আর এক ছোটভাই এসেছিল, স্মৃতিশেখর নিজে থেকে কাউকে বলেননি। নব দম্পতিকে অভিনন্দন জানিয়ে হিমানীর লোকেরাও কিছু আগে বিদায় নিয়েছে।

শূন্য ফ্ল্যাটে এখন শুধু হিমানী আর স্মৃতিশেখর।

স্মৃতিশেখর বহুদিন মার্কিন দেশে থাকলেও সাধারণত মদ্যপান করেন না। বিমানবন্দরে সস্তায় কেনা এক বোতল কনিয়াক ছিল তার কাছে, সম্পূর্ণ অটুট।

আজ এই মধুর সন্ধ্যায় তিনি সেই পানীয়ের বোতল খুলে বসলেন। দেখা গেল, সুপানীয়ে হিমানীর অরুচি নেই।

শৌখিন জাফরিকাটা ফিকে নীল বিলিতি কাঁচের গেলাসে বরফকুচি দিয়ে সোনালি কনিয়াক খেতে খেতে খুবই অন্তরঙ্গ ও ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়লেন স্মৃতিশেখর ও হিমানী। অনেক গোপন অন্তরঙ্গ কথাবার্তা হল তাদের মধ্যে। দুজনেই কিঞ্চিৎ বেশি মদ্যপান করে ফেললেন।

স্মৃতিশেখর তার দুঃখময় প্রাক্তন দাম্পত্যজীবনের কাহিনি করুণভাষায় ব্যক্ত করলেন। সে গল্প শুনে হিমানীর চোখে জল এল। বিশেষ করে মত্ত স্মৃতিশেখর যখন বললেন, এবারে যদি তার দাম্পত্যজীবন সুখের না হয়, তিনি আত্মহত্যা করবেন। এবং এই বলে সত্যিই যখন স্মৃতিশেখর হিমানীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন, কিছুটা আবেগের আতিশয্যে কিছুটা কনিয়াকের প্রভাবে হিমানী কেমন গোলমাল হয়ে পড়লেন।

কথায় কথায় হিমানী তার প্রাক্তন দুই পতিদেবতার গল্প এবং কখনও সখনও অল্পসল্প নৈতিক পদস্খলনের কাহিনী স্মৃতিশেখরকে শোনালেন। কিন্তু স্মৃতিশেখর তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তার এই গল্প শুনতে শুনতে কখন যে স্মৃতিশেখর ঘুমিয়ে পড়েছেন।

মধুযামিনীতে সহধর্মিণীকে উপহার দেওয়ার জন্য পয়জননামক মহার্ঘ সুরভি, সেও বিমানবন্দরে ডিউটি ফ্রি শপ থেকে কেনা, এক শিশি বালিশের নীচে রেখেছিলেন স্মৃতিশেখর।

স্মৃতিশেখরের মাথার চাপে সেই সুদৃশ্য মসৃণ শিশিটা বালিশের নীচ থেকে বেরিয়ে এসেছে। বালিশের ওপর স্মৃতিশেখরের মাথাটা ঠিক করে দিতে গিয়ে হঠাৎ শিশিটা বিশেষ করে শিশিটার নামের দিকে হিমানীর চোখ পড়ল। এ নামের কোনও সুরভি আছে হিমানী তা জানেন না।

মুহূর্তের মধ্যে মত্ত হিমানী ধরে নিলেন স্মৃতিশেখর আত্মহত্যার জন্য সদাই প্রস্তুত। মাতাল অবস্থাতেই তিনি ভাবতে লাগলেন আমার প্রাক্তন জীবনের সেইসঙ্গে চরিত্রের দোষের যেসব কথা বলা বলে ফেললাম ঘুম থেকে উঠে সেসব মনে পড়লে স্মৃতিশেখর হয়তো তখনই ওই পয়জন খেয়ে সুইসাইড করবে।

কনিয়াকের বোতলে তখনও কিঞ্চিৎ অবশিষ্ট ছিল। দুশ্চিন্তা করতে করতে বোতল থেকে সরাসরি ঢকঢক করে পান করতে লাগলেন হিমানী। অবশেষে তার ভাবনাচিন্তা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।

টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে একবার বাথরুম থেকে ঘুরে এসে একটা ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিলেন হিমানী। মরতে যদি হয় আমিই মরব, আমার এই অপবিত্র নারীদেহ থাকা না থাকা সমান। স্মৃতিশেখরের মতো ভাল লোকটাকে মরতে দেওয়া যায় না।

মাতালের যেমন চিন্তা তেমন কাজ। মুহূর্তের মধ্যে বালিশের পাশে হাত দিয়ে পয়জনের শিশিটা তুলে নিয়ে, একটু কষ্ট করে ছিপিটা খুলে পুরো শিশিটা নিজের গলার মধ্যে ঢেলে দিলেন হিমানী। এবং সঙ্গে সঙ্গে এক আর্ত চেঁচানি বেরিয়ে এল তার গলা দিয়ে।

সেই আর্তনাদে স্মৃতিশেখরের নেশা কেটে গেল। তিনি ধড়ফড় করে উঠে বসলেন, দেখতে পেলেন মেঝেতে শূন্য পয়জনের শিশি গড়াগড়ি যাচ্ছে আর মহামূল্য সুরভি হিমানীর ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়াচ্ছে। তার মুখ দিয়ে কেমন গাজলা বেরচ্ছে।

স্মৃতিশেখর বুদ্ধিমান লোক। একটু সময় লাগল ব্যাপারটা অনুধাবন করতে। তারপর হিমানীর গলায় আঙুল দিয়ে বমি করাতে লাগলেন। হিমানীর মুখ থেকে দরদর করে বেরিয়ে বিশ্ববিখ্যাত সুরভির গন্ধে আমোদিত হয়ে উঠল ফ্ল্যাট গৃহ৷ সেই মধুযামিনীর ফুলশয্যা কক্ষে যদি আড়ি পাতা যেত তাহলে দেখা যেত আধো ঘুমে আধো জাগরণে মদিরাময় স্মৃতিশেখর আর সুরভিস্নাতা হিমানী পরস্পরের বক্ষলগ্ন হয়ে কী সব অস্ফুট কথা বলছেন। সারা ঘরে ভুরভুর করছে ভুবনমোহিনী সৌরভ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress