Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে সেনজিৎ রাজোদ্যানে একাকী বিচরণ করিতেছিলেন। মধ্যাহের তপ্ত বায়ু মন্দীভূত হইয়া অগ্নিকোণ হইতে মৃদু শীতল মলয়ানিল বহিতে আরম্ভ করিয়াছিল, সুদূর চম্পারণ্যের চাঁপার বন হইতে সুগন্ধ আহরণ করিয়া মহারাজের আতপ্ত ললাট স্নিগ্ধ করিবার চেষ্টা করিতেছিল।

মহারাজের চক্ষের উৎভ্রান্ত দৃষ্টি তাঁহার অশান্ত চিত্তের প্রতিচ্ছবি বহন করিতেছিল। পাদচারণ করিতে করিতে তিনি অন্যমনে যুখী গুল্ম হইতে পুষ্প তুলিয়া নখে ছিন্ন করিতেছিলেন, কখনও ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া আকাশে যেখানে সূৰ্য্যস্তের বর্ণ-বিলাস চলিতেছিল সেই দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চাহিতেছিলেন।

এই সময় রাজ্যের মহামাত্য ধীরপদে আসিয়া মহারাজকে আশীর্বাদ করিয়া দাঁড়াইলেন। অপ্ৰসন্ন সপ্রশ্ন মুখে মহারাজ তাঁহার প্রতি চাহিলেন। কোনও কথা হইল না; মন্ত্রী নীরবে একটি ক্ষুদ্র লিপি বাহির করিয়া তাঁহার হস্তে দিলেন।

ভূৰ্জপত্রে লিখিত লিপি; তাহাতে এই কয়টি কথা ছিল—

বৈশালিকা নারী সম্বন্ধে সাবধান। কোনও কুটিল উদ্দেশ্যে সে মগধে প্রেরিত হইয়াছে। সম্ভবত মহারাজকে রূপমোহে বশীভুত করিয়া লিচ্ছবির কার্যসিদ্ধি করা তাহার অভিপ্ৰায়।

পত্র পাঠ করিয়া মহারাজ আরক্ত মুখ তুলিলেন; মন্ত্রী অন্য দিকে চাহিয়া ধীরস্বরে বলিলেন–বৈশালী হইতে আমাদের গুপ্তচর অদ্য এই পত্ৰ পঠাইয়াছে।

মহারাজ কথা কহিলেন না, লিপির দিকে কিছুক্ষণ বিরাগপূর্ণ নেত্ৰে চাহিয়া থাকিয়া ভূৰ্জপত্ৰ খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া বাতাসে উড়াইয়া দিলেন। মন্ত্রী অবিচলিত মুখচ্ছবি লইয়া পুনর্বার মহারাজকে আশীর্বাদপূর্বক প্রস্থান করিলেন।

ক্রমে রাত্রি হইল, আকাশের আভুগ্ন চন্দ্ৰকলা এতক্ষণ মলিন-মুখে ছিল, প্রতিদ্বন্দ্বীর তিরোভাবে এখন যেন বাঁকা হাসি হাসিয়া উঠিল। মহারাজের সন্নিধাতা স্বর্ণপাত্রে স্নিগ্ধ আসব লইয়া উপস্থিত হইলে মহারাজ একনিশ্বাসে সুরা পান করিয়া পত্র দূরে নিক্ষেপ করিলেন।

তারপর একে একে বয়স্যরা আসিল। কিন্তু মহারাজের মুখে প্রকট বিরক্তি ও নির্জনবাসের স্পাহা লক্ষ্য করিয়া তাহারা সঙ্কুচিতভাবে অপসৃত হইয়া গেল। বটুকভট্ট আসিয়া মহারাজের চিত্তবিনোদনের চেষ্টা করিল, তাহার চটুলতা কিয়াৎকাল ধৈর্যসহকারে শ্রবণ করিয়া মহারাজ তাঁহার প্রকৃত মনোভাব ব্যক্ত করিলেন, বলিলেন—বটুক, তোমাকে শূলে দিবার ইচ্ছা হইতেছে।

বটুক দ্রুত পলায়ন করিতে করিতে বলিল, মহারাজ, ও ইচ্ছা দমন করুন, আমি শয্যায় শুইয়া মরিতে চাই।

রাত্রি ক্রমশ গভীর হইতে লাগিল। উৎকণ্ঠিত সন্নিধাতা মহারাজের আশেপাশে ঘুরিতে লাগিল; কিন্তু কাছে আসিতে সাহস করিল না। সদ্য-প্ৰসন্ন মহারাজের এরূপ ভাবান্তর পূর্বে কেহ দেখে নাই, সকলেই উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। রাজপুরীর সৃপকার হইতে সম্বাহক পর্যন্ত সকলের ধ্যই কানে কানে বাতা প্রচারিত হইয়া গেল—দেবপ্রিয় মহারাজের আজ চিত্ত সুস্থ নাই। যবনী প্ৰতীহারীরা উর্ধর্ব-চোখে চাহিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল; তাহদের বমচিচ্ছাদিত বক্ষও মহারাজের জন্য ব্যথিত হইয়া উঠিল।

সেনজিৎকে রাজ্যের আপামর সাধারণ সকলেই ভালবাসিত। বিশেষত পুরপরিজন তাঁহাকে দেবতাঞ্জানে পূজা করিত, তাঁহার অল্পমাত্র ক্লেশ দূর করিবার জন্য বোধ করি প্রাণ দিতেও কেহ পরাজুখি হইত না। রাজা যেখানে প্রজার বন্ধু সেখানে এমনই হয়। কিন্তু তবু আজিকার এই মধুর। বসন্ত-রজনীতে মহারাজ বক্ষে অজ্ঞাত সন্তাপের অগ্নি জ্বালিয়া একাকী পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন, পত্রিমিত্ৰ বয়স্য পরিজন কেহ সত্ত্বনা দিবার জন্যও তাঁহার সম্মুখীন হইতে সাহসী হইল না।

রাত্রি দ্বিপ্রহর হইতে যখন আর বিলম্ব নাই তখন মহারাজ দ্রুত পদচারণা করিতে করিতে সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন। নিস্তব্ধ বাতাসে সুমধুর বীণা-ধ্বনি তাঁহার কৰ্ণে প্রবেশ করিল। ধ্বনি অন্তঃপুরের দিক হইতে আসিতেছে। অতি মৃদু ধ্বনি, কিন্তু যেন প্ৰাণের দুরন্ত আক্ষেপভরে কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে।

ব্যাধ-বংশী-আকৃষ্ট মৃগের মতো মহারাজের পদদ্বয় অজ্ঞাতসারে ঐ বীণা-ধ্বনির দিকে অগ্রসর হইল, তিনি পরিখার প্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইলেন

পরিখার পরপারে প্রাচীরের অন্তরালে বসিয়া কে বীণা বাজাইতেছে। ক্রমে বীণাধ্বনির সহিত একটি কণ্ঠস্বর মিশিল। তরল খেদ-বিগলিত কণ্ঠস্বর—মনে হয় যেন জ্যোৎসা কুহেলির সহিত মিশিয়া মিলাইয়া যাইতেছে। মহারাজ তন্ময় একাগ্র হইয়া শুনিতে লাগিলেন। প্রথমে দুই-একটি কথা, তারপর সম্পূর্ণ সঙ্গীত তাঁহার শ্রুতিগোচর হইল।

আধ-আধ প্ৰাকৃত ভাষায় গ্রথিত সঙ্গীত, তাহার মর্ম—

হায় ধিক কন্দর্পদর্পাহতা!
মন্মথ তোমার মন মথন করিল,
প্রিয়জনকে নিকটে পাইয়া তুমি লজ্জা বিসর্জন দিলে।
হায়, কেন লজ্জা বিসর্জন দিলে?
প্রিয়জনের ঘৃণা তোমার অঙ্গ দহন করিল,
মদন তোমার অন্তর দহন করিল—
তুমি অন্তরে বাহিরে পুড়িয়া ভস্মীভূত হইলে!
হায় ধিক কন্দর্পদর্পাহতা!

বুকভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাসে সঙ্গীত মিলাইয়া গেল। মহারাজ কয়েক মুহূর্ত পাষাণমূর্তির মতো দাঁড়াইয়া রহিলেন, তারপর উর্ধর্বশ্বাসে সে স্থান ছাড়িয়া উদ্যান উত্তীর্ণ হইয়া নিজ শয়নীভবনে প্রবেশ করিলেন।

শুষ্ক ইন্ধনে অগ্নি অধিক জ্বলে। সে রাত্রে মহারাজের নয়নে নিদ্ৰা আসিল না।

একে একে ফায়ুনের মদোচ্ছাসিত দিনগুলি কাটিতে লাগিল। মহারাজের চিত্তে সুখ নাই, মুখে হাসি নাই—তিনি দিন দিন শীর্ণ হইতে লাগিলেন।

মহারাজের প্রকৃতি যেন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়া গেল। অকারণ ক্রোধ—যাহা পূর্বে কেহ দেখে নাই—তাঁহার প্রতি কার্যে প্রতি সম্ভাষণে পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে লাগিল। মানুষের সাহচর্য বিষবৎ অসহ্য হইয়া উঠিল। প্রত্যহ সন্ধ্যা হইতে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত উদ্যানে উদভ্ৰান্তের ন্যায় বিচরণ

একমাত্র বটুকভট্টই বোধ হয় মহারাজের চিত্তবিক্ষোভের যথার্থ কারণ অনুমান করিয়াছিল; কিন্তু ব্ৰাহ্মণ বাহিরে মুখতার ভান করিলেও ভিতরে তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন—সে ঘূনাক্ষরে কাহারও কাছে কোনও কথা প্ৰকাশ করিল না। নারীবিদ্বেষী মহারাজের এত দিনে চিত্তবিকার উপস্থিত হইয়াছে, এ কথা তিনি স্বয়ং যখন গোপন করিতে চান তখন তাহা প্ৰকাশ করিয়া দিলে তাঁহার লজ্জা বৃদ্ধি পাইবে। এরূপ ক্ষেত্রে আপাতত এ কথা প্রচ্ছন্ন রাখাই শ্রেয়। মহারাজ যখন কন্দপের নিকট পরাভব স্বীকার করিবেন, তখন আপনিই সকল কথা প্ৰকাশ হইয়া পড়িবে।

কিন্তু মহারাজের চিত্তে প্ৰফুল্লতা আনয়ন করিবার চেষ্টাও বটুকভট্টের সফল হইল না। সে সহজভাবে ইহাই বুঝিয়াছিল যে, মহারাজ যখন উল্কার প্রতি মনে মনে অনুরক্ত হইয়াছেন, তখন উভয়ের মিলন ঘটাইতে পারিলেই সব গণ্ডগোল চুকিয়া যাইবে। মহারাজের নারীবিদ্বেষ ও বিবাহে অনিচ্ছা যদি এইভাবে পরিসমাপ্তি লাভ করে, তবে তো সব দিক দিয়াই মঙ্গল। মগধের পট্টমহাদেবী হইতে উল্কার সমকক্ষ আর কে আছে?—এই ভাবিয়া বটুক তাহার সমস্ত ছলা-কলা ও রঙ্গভঙ্গ ঐ উদ্দেশ্যেই নিয়োজিত করিয়াছিল। কিন্তু হায়, মহারাজের হৃদয় মন্থন করিয়া যে একই কালে অমৃত ও গরল উঠিয়াছে, তাহা আনুগত বটুক জানিতে পারে নাই।

এমনই ভাবে দিনগুলি ক্ষয় হইতে লাগিল, ওদিকে আকাশে চন্দ্ৰদেব পূর্ণ হইয়া উঠিতে লাগিলেন। শেষে একদিন বসন্তোৎসবের মধুরাকা আসিয়া উপস্থিত হইল।

দেশসুদ্ধ নরনারী উৎসবে মাতিল। সকলের মুখেই আনন্দের—তথা আসবের মদবিহ্বলতা। এমন কি যবনী প্ৰতীহারীরাও মাধ্বী পান করিয়া অরুণায়িত-নেত্রে পরস্পরের অঙ্গে কুকুম-পরাগ নিক্ষেপ করিয়া, বীণ বাজাইয়া, দ্রাক্ষাবনের গীত গাহিয়া উৎসবে মগ্ন হইল।

কেবল মহারাজ সেনজিৎ ভ্রূকুটি-ভয়াল মুখে সহচরহীন নিঃসঙ্গতার মধ্যে বিরাজ করিতে লাগিলেন।

সেদিন সন্ধ্যার পূর্বে তিনি ক্লান্তদেহে উদ্যানে গিয়া একটি মর্মরবেদীর উপর উপবেশন করিয়া শূন্যদৃষ্টিতে আকাশের দিকে চাহিলেন। অমনি সম্মুখে পরিখার পরপারে অন্তঃপুর-ভবনের শুভ্ৰচুড়া চোখে পড়িল। মহারাজ সেদিকে পশ্চাৎ ফিরিয়া বসিলেন। উদ্যানে কেহ নাই, উদ্যান-পালিকারাও আজ উৎসবে গা ঢালিয়া দিয়াছে; মহারাজকে কেহ বিরক্ত করিল না।।

ক্রমে সন্ধ্যা হইল। পূর্ব-দিগন্তে পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি মারিল। দিনের আলো সম্পূর্ণ নিভিয়া যায় নাই, অথচ চাঁদের কিরণ পরিস্ফুট হইতে আরম্ভ করিয়াছে—দিবা-রাত্রির এই সন্ধিক্ষণে মহারাজের চিত্তও কোন ধূসর বর্ণপ্রলেপহীন অবসন্নতায় নিমগ্ন হইয়া গিয়াছিল, এমন সময় অকস্মাৎ একটি তীর আসিয়া তাঁহার পাশে পড়িল। চকিতে মহারাজ তীরটি তুলিয়া লইলেন; তীরের অগ্রভাগে ধাতু-ফলকের পরিবর্তে অশোকপুষ্প গ্রথিত, তীরগাত্রে একটি লিপি জড়ানো রহিয়াছে। কম্পিত হস্তে লিপি খুলিয়া মহারাজ পড়িলেন—লাক্ষারাগ দিয়া লিখিত লিপি–

আজ বসন্ত-পূর্ণিমার রাত্রে নির্লজ্জা উল্কা প্রার্থনা জানাইতেছে, মহারাজ একবার দর্শন দিবেন কি?

মহারাজ পত্ৰখানি দুই হাতে ধরিয়া দুরন্ত আবেগে মুখের উপর চাপিয়া ধরিলেন। রুদ্ধ অস্ফুট স্বরে বলিলেন—উল্কা মায়াবিনি—

বাসনা প্রতিরোধেরও সীমা আছে! মহারাজ সেনজিতের অন্তর্দ্বন্দ্ব শেষ হইল।

সেদিন প্ৰভাতে শয্যা ত্যাগ করিবার পর হইতেই উল্কা মনে মনে মহারাজের আগমন প্ৰতীক্ষা করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এ কয় দিন মহারাজ তাহাকে দেখেন নাই, কিন্তু সে সৌধশীর্ষ হইতে লুকাইয়া মহারাজকে দেখিয়াছিল। তাই মদনোৎসবের প্রভাতে ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে তাহার মনে হইয়াছিল—আজ তিনি আসিবেন। পুরুষের মন এত কঠিন হইতে পারে না, আজ মহারাজ নিশ্চয় ধরা দিবেন।

কর্পূর-সুবাসিত জলে স্নান করিয়া সে প্রসাধন করিতে বসিয়াছিল। সখীরা তাহাকে অপরূপ সাজে সাজাইয়া দিয়াছিল; কিন্তু তবু তাহার মনঃপূত হয় নাই। বার বার কবরী খুলিয়া নূতন করিয়া কবরী বাঁধিয়াছিল—অঙ্গের পুষ্পাভরণ ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছিল, চন্দনের পত্ৰলেখা মুছিয়া বক্ষে কুস্কুমের পত্ৰলেখা আকিয়াছিল, আবার তাহা মুছিয়া চন্দনের চিত্ৰ লিখিয়ছিল। শেষে রাগ করিয়া সখীদের বলিয়াছিল-তোরা কিছু জানিস না। আজ আমার জীবনের মহা সন্ধিক্ষণ, এমন করিয়া আমাকে সাজাইয়া দে—যাহাতে মহেশ্বরের মনও জন্য করিতে পারি।

সখীরা হাসিয়া বলিয়াছিল—সেজন্য সাজিবার প্রয়োজন কি?

কিন্তু প্ৰভাত বহিয়া গেল, মহারাজ আসিলেন না।

উল্কার পুষ্পাভরণ অঙ্গ-তাপে শুকাইয়া গেল, সে আবার নূতন পুষ্পভুষা পরিল। দ্বিপ্রহর অতীত হইল, অপরাহু ক্ৰমে সায়াহ্নে গড়াইয়া গেল, তবু মহারাজ দর্শন দিলেন না। সখীরা উল্কার চোখের দৃষ্টি দেখিয়া ভীত হইল।

সন্ধ্যার সময় প্রাসাদ চড়ে উঠিয়া উল্কা দেখিল—মহারাজ উদ্যানে বসিয়া আছেন, তাঁহার মুখ বিপরীত দিকে। তিক্ত অন্তঃকরণে উল্কা ভাবিল—ধিক আমাকে!

তারপর মহারাজের সমীপে তীর নিক্ষেপ করিয়া, বসন-ভুষণ ছিঁড়িয়া দূরে নিক্ষেপ করিয়া উল্কা শয্যায় পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। উল্কার চোখে বোধ করি জীবনে এই প্রথম অশ্রু দেখা দিল।

রাত্ৰি হইল। নগরীর প্রমোদ-কলরব ক্রমশ মেীন রাসনিমগ্ন হইয়া আসিতে লাগিল। চন্দ্ৰ মধ্যগগনে আরোহণ করিলেন।

উল্কার সখীরা সপ্তপর্ণ-বৃক্ষের শাখায় হিন্দোল বাঁধিয়াছিল। উল্কা যখন দেখিল মহারাজ সত্যই আসিলেন না, তখন সে বুকের কঞ্চুকী কবরীর মালা ফেলিয়া দিয়া কেশ এলাইয়া সেই হিন্দোলায় গিয়া বসিল। তারপর শুষ্ক চোখে চাঁদের দিকে চাহিয়া ভাবিতে লাগিল—ব্যর্থ! ব্যর্থ! পারিলাম না! এত ছলনা চাতুরী সব মিথ্যা হইল। কোন দৰ্পে তবে মগধে আসিয়াছিলাম? এখন এ লজ্জা কোথায় রাখিব? উঃ—এত নীরস পুরুষের মন? ধিক আমার জীবন? আমার মৃত্যু ভাল!

উল্কা।

কে ডাকিল? কণ্ঠস্বর শুনিয়া চেনা যায় না। উল্কা গ্ৰীবা ফেরাইয়া দেখিল, বৃক্ষচ্ছায়ায় এক পুরুষ আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

উল্কা! রাক্ষসি! আমি আসিয়াছি।

উল্কা চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, তাহার সর্বাঙ্গ থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। তরুপত্রের ছায়ান্ধকারে ঐ মূর্তি দেখিয়া সে প্রতিহিংসা ভুলিয়া গেল, মগধ ভুলিয়া গেল, বৈশালী ভুলিয়া গেল। দুৰ্দমনীয় অভিমানের বন্যা তাহার বুকের উপর দিয়া বহিয়া গেল। এমন করিয়াই কি আসিতে হয়? সমস্ত আশা-আকাঙক্ষা নির্মূল করিয়া, অভিমান-দৰ্প ধূলায় মিশাইয়া দিয়া কি আসিতে হয়? নির্লজ্জার। প্ৰগলভ লজ্জাহীনতার কি ইহার বেশি মূল্য নাই?

মহারাজ উল্কার অতি নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন, দুই হস্ত তাহার শ্লথবাস স্কন্ধের উপর রাখিয়া ক্ষুধিত নয়নে তাহার চক্ষের ভিতর চাহিয়া বলিলেন—উল্কা, আর পরিলাম না। আমি তোমায় চাই। আমার রক্তের সঙ্গে তুমি মিশিয়া গিয়াছ, আমার হৃৎস্পন্দনে তোমার নাম ধ্বনিত হইতেছে—শুনিতে পাইতেছ। না? এই শুন। বলিয়া তিনি উল্কার মুখ নিজ বক্ষে চাপিয়া ধরিলেন।

অভিমানও ভাসিয়া গেল। এই থরথর ব্যাকুলতার সম্মুখে মান-অভিমান বিলাস-বিভ্রম কিছুঁই রহিল না; শুধু রহিল চিরন্তন প্রেমলিঙ্গু নারীপ্রকৃতি। উল্কা স্মৃরিত অধরোষ্ঠ সেনজিতের দিকে তুলিয়া ধরিয়া স্বপ্ন-বিজড়িত দৃষ্টিতে চাহিল, পাখির তন্দ্ৰাকৃজনের ন্যায় অস্ফুটকণ্ঠে বলিল—প্রিয়! প্ৰিয়তম-—!

মহারাজের তপ্ত অধর বারম্বার তাহার অধরপাত্ৰে মধু পান করিল। তবু পিপাসা যেন মিটিতে চায় না! শেষে মহারাজ। উষ্কার কানে কানে বলিলেন-উল্কা, সত্য বল, আমাকে ভালবাস? এ তোমার ছলনা নয়?

উল্কার শিথিল দেহ সুখ-তন্দ্ৰায় ড়ুবিয়া গিয়াছিল, মহারাজের এই কথায় সে ধীরে ধীরে সেই তন্দ্ৰ হইতে জাগিয়া উঠিল। তাহার মুকুলিত নেত্ৰ উন্মীলিত হইয়া ক্ৰমে বিস্ফারিত হইল; তারপর মহারাজের বাহুবন্ধনমধ্যে তাহার দেহ সহসা কঠিন হইয়া উঠিল।

অভিনয় করিতে করিতে নটীর আত্মবিস্মৃতি ঘটিয়াছে; ছলনা কখন সত্যে পরিণত হইয়াছে হতভাগিনী জানিতে পারে নাই।

কিন্তু এখন? কৰ্ণমধ্যে সে বজ্রনির্ঘোষ শুনিতে পাইল—তুমি বিষকন্যা!

সবলে নিজ দেহ মহারাজের বাহুমুক্ত করিয়া লইয়া সে সরিয়া দাঁড়াইল, ত্রাস-বিবৃত চক্ষে তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল। মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না; শুধু তাহার কণ্ঠের শিরা দপ দপ করিয়া স্পন্দিত হইতে লাগিল।

মহারাজ দুই বাহু বাড়াইয়া অগ্রসর হইলেন—প্ৰাণাধিকে—

না না রাজাধিরাজ, আমার কাছে আসিও না–। উল্কা আবার সরিয়া দাঁড়াইল।

মৃদু ভর্ৎসনার সুরে মহারাজ বলিলেন—ছি উল্কা! এই কি ছলনার সময়?

উল্কা স্খলিতস্বরে বলিল—মহারাজ ভুল বুঝিয়াছেন, আমি মহারাজকে ভালবাসি না।

সেনজিৎ হাসিলেন—আর মিথ্যা কথায় ভুলাইতে পরিবে না। —এস—কাছে এস।

ব্যাকুল হৃদয়-ভেদী স্বরে উল্কা কাঁদিয়া উঠিল—না না—প্রিয়তম, তুমি জানো না।–তুমি জানো না—

সেনজিতের মুখ ম্লান হইল, তিনি ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন—বোধ হয় জানি। তুমি বৈশালীর কুহকিনী, আমাকে ভুলাইতে আসিয়াছিলে; কিন্তু এখন আর তাহাতে কি আসে যায় উল্কা?

কিছু জানো না; মহারাজ, আমাদের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। তুমি ফিরিয়া যাও, আর আমার মুখ দেখিও না। মিনতি করিতেছি, তুমি ফিরিয়া যাও।

তাহার ব্যাকুলতা দেখিয়া মহারাজ বিস্ময়ে তাহার দিকে আবার অগ্রসর হইলেন। তখন উল্কা ব্যাধ-ভীত হরিণীর ন্যায় ছুটিয়া পলাইতে লাগিল; তাহার কণ্ঠ হইতে কেবল উচ্চারিত হইল—না না না–

সেনজিৎ তাহার পশ্চাদ্ধাবন করিলেন, কিন্তু ধরিতে পারিলেন না। উল্কা গৃহে প্রবেশ করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল।

অধীর ক্রোধে মহারাজ দ্বারে সবেগে করাঘাত করিতে লাগিলেন। কিন্তু দ্বার খুলিল না।

দ্বারের অপরদিক হইতে উল্কা বলিল–রাজাধিরাজ, বিস্তীর্ণ ধরণীতে আপনার যোগ্য নারীর অভাব হইবে না। আপনি উল্কাকে ভুলিয়া যান।

তিক্ত বিকৃতকণ্ঠে মহারাজ বলিলেন—হৃদয়হীনা, তবে কেন আমাকে প্রলুব্ধ করিয়াছিলে?

মিনতি-কাতরস্বরে উল্কা বলিল—আৰ্য, বুদ্ধিহীন নারীর প্রগলভতা ক্ষমা করুন। আপনি ফিরিয়া যান—দয়া করুন। আমাদের মিলন অসম্ভব।

কিন্তু কেন—কেন? কিসের বাধা?

দ্বারের অপর পার্শ্বে উল্কার দুই গণ্ড বহিয়া অশ্রুর বন্যা নামিয়াছে, তাহা মহারাজ দেখিতে পাইলেন না; শুধু শুনিতে পাইলেন, অর্ধব্যক্ত স্বরে উল্কা কহিল—সে কথা বলিবার নয়।

দন্তে দন্ত চাপিয়া মহারাজ বলিলেন–কেন বলিবার নয়? তোমাকে বলিতে হইবে, আমি শুনিতে চাই।

ক্ষমা করুন।

না, আমি শুনিব।

দীর্ঘ নীরবতার পর উল্কা বলিল—ভাল, কল্য প্রাতে বলিব।

মহারাজ দ্বারে মুখ রাখিয়া কহিলেন-উল্কা, আজিকার এই মধুযামিনী বিফল হইবে?

হাঁ মহারাজ।

যেন বক্ষে আহত হইয়া মহারাজ ফিরিয়া আসিলেন। ক্লান্তির নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন—ভাল। কল্য প্ৰভাতেই বলিবে?

বলিব।

তারপর তুমি আমার হইবে?

উল্কা নীরব।

মহারাজ বলিলেন—উল্কা, তুমি কি? তুমি কি নারী নও? আমাকে এমন করিয়া দগ্ধ করিতে তোমার দয়া হয় না?

উল্কা এবারও নীরব।

অশান্ত হৃদয় লইয়া মহারাজ চলিয়া গেলেন। উল্কা তখন দ্বারসম্মুখে ভূমিতলে পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল, আর নিজ মনে বলিতে লাগিল—ফিরিয়া গেলেন, মহারাজ ফিরিয়া গেলেন। প্ৰিয়তম, কেন তোমাকে ভালবাসিলাম? কখন বাসিলাম? যদি বাসিলাম তো আগে জানিতে পারিলাম না কেন? শ্মশানের অগ্নিশিখা আমি, কেমন করিয়া এই অভিশপ্ত দেহ তোমাকে দিব?

শ্মশানের প্ৰেত-পিশাচরা বোধ করি শ্মশান-কন্যার এই অরুন্তুদ ক্ৰন্দন শুনিয়া অলক্ষ্যে অট্টহাস্য করিয়া নিঃশব্দে করতালি দিয়া নাচিতে লাগিল।

হায় উল্কা, তোমার পাষাণ-হৃদয় পাষাণই থাকিল না কেন? কেন তুমি ভালবাসিলে?

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress