Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

অতঃপর ষোল বৎসর কাটিয়া গিয়াছে।

কালপুরুষের পলকপাতে শতাব্দী অতীত হয়; কিন্তু ক্ষুদ্রায়ু মানুষের জীবনে ষোল বৎসর অকিঞ্চিৎকর নয়।

মগধে এই সময়ের মধ্যে বহু পরিবর্তন ঘটিয়া গিয়াছে। পূবাধ্যায়বর্ণিত ঘটনার পর পাটলিপুত্রের নাগরিকবৃন্দ ত্ৰয়োদশ বর্ষ মহারাজ চণ্ডের দোর্দণ্ড শাসন সহা করিয়াছিল; তাহার পর একদিন তাহারা সদলবলে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল। জনগণ যখন ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে, তখন তাহারা বিবেচনা করিয়া কাজ করে না—এ ক্ষেত্রেও তাহারা বিবেচনা করিল না। ক্রোধান্ধ মৌমাছির পাল যদি একটা মহিষকে আক্রমণ করে, তাহা হইলে দৃশ্যটা যেরূপ হয়, এই মৎস্যন্যায়ের ব্যাপারটাও প্রায় তদ্রুপ হইল।

গর্জমান চণ্ডকে সিংহাসন হইতে টানিয়া নামাইয়া বিদ্ৰোহ-নায়কেরা প্ৰথমে তাহার। মণিবন্ধ পর্যন্ত হস্ত কাটিয়া ফেলিল। মহারাজ চণ্ডকে এক কোপে শেষ করিয়া ফেলিলে চলিবে না, অন্য বিবেচনা না থাকিলেও এ বিবেচনা বিদ্রোহীদের ছিল। মহারাজ এত দিন ধরিয়া যাহা অগণিত প্রজাপুঞ্জকে দুই হস্তে বিতরণ করিয়াছেন, তাহাই তাহারা প্রত্যাৰ্পণ করিতে আসিয়াছে। এই প্রতাপািণক্রিয়া এক মুহূর্তে হয় না।

অতঃপর চিণ্ডের পদদ্বয় জঙ্ঘাগ্ৰন্থি হইতে কাটিয়া লওয়া হইল। কিন্তু তাহাতেও প্রতিহিংসাপিপাসু জনতার তৃপ্তি হইল না। এভাবে চলিলে বড় শীঘ্ৰ মৃত্যু উপস্থিত হইবে—তাহা বাঞ্ছনীয় নয়। মৃত্যু তো নিস্কৃতি। সুতরাং জননায়করা মহারাজের বিখণ্ডিত রক্তাঞ্ছত দেহ ঘিরিয়া মন্ত্রণা করিতে বসিল। হিংসা-পরিচালিত জনতা চিরদিনই নিষ্ঠুর, সেকালে বুঝি তাহাদের নিষ্ঠুরতার অন্ত ছিল না।

একজন নাসিকাহীন শৌণ্ডিক উত্তম পরামর্শ দিল। চণ্ডকে হত্যা করিয়া কাজ নাই, বরঞ্চ তাহাকে জীবিত রাখিবার চেষ্টাই করা হউক। তারপর এই অবস্থায় তাহাকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া প্রকাশ্য সর্বজনগম্য স্থানে বধিয়া রাখা হউক। নাগরিকরা প্রত্যহ ইহাকে দেখিবে, ইহার গাত্রে নিষ্ঠীবন ত্যাগ করিবে! চণ্ডের এই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখিয়া ভবিষ্যৎ রাজারাও যথেষ্ট শিক্ষালাভ করিতে পরিবে।

সকলে মহোল্লাসে এই প্ৰস্তাব সমর্থনা করিল। প্ৰস্তাব কার্যে পরিণত হইতেও বিলম্ব হইল না।

তারপর মগধবাসীর রক্ত কথঞ্চিৎ কবোষ্ণ হইলে তাহারা নূতন রাজা নিবাচন করিতে বসিল। শিশুনাগবংশেরই দূর-সম্পর্কিত সৌম্যাকান্তি এক যুবা—নাম সেনজিৎ—মৃগয়া পক্ষিপালন ও সূরা আস্বাদন করিয়া সুখে ও তৃপ্তিতে কালযাপন করিতেছিল, রাজা হইবার দুরাকাঙক্ষা তাহার ছিল না—সকলে তাহাকে ধরিয়া সিংহাসনে বসাইয়া দিল। সেনজিৎ অতিশয় নিরহঙ্কার সরলচিত্ত ও ক্রীড়াকৌতুকপ্রিয় যুবা; নারীজাতি ভিন্ন জগতে তাহার শত্রু ছিল না; তাই নাগরিকগণ সকলেই তাহাকে ভালবাসিত। সেনজিৎ প্রথমটা রাজা হইতে আপত্তি করিল; কিন্তু তাহার বন্ধুমণ্ডলীকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখিয়া সে দীর্ঘশ্বাস মোচনপূর্বক সিংহাসনে গিয়া বসিল। একজন ভীমকান্তি কৃষ্ণকায় নাগরিক স্বহস্তে নিজ অঙ্গুলি কাটিয়া তাহার ললাটে রক্ত-তিলক পরাইয়া দিল।

সেনজিৎ করুণবচনে বলিল—যুদ্ধ করিবার প্রয়োজন হইলে যুদ্ধ করিব, কিন্তু আমাকে রাজ্য শাসন বা বংশরক্ষা করিতে বলিও না।

তাহাই হইল। কয়েকজন বিচক্ষণ মন্ত্রী রাজ্যভার গ্রহণ করিলেন; মহারাজ সেনজিৎ পূর্ববৎ মৃগয়াদির চাচা করিয়া ও বটুকভট্টের সহিত রসালাপ করিয়া দিন কটাইতে লাগিল। নানা কারণে কাশী কৌশল লিচ্ছবি তখন যুদ্ধ করিতে উৎসুক ছিল না; ভিতরে যাহাই থাকুক, বাহিরে একটা মৌখিক মৈত্রী দেখা যাইতেছিল,—তাই মহারাজকে বর্ম-চৰ্ম পরিধান করিয়া শৌর্য প্রদর্শন করিতে হইল না। ওদিকে রাজ-অবরোধও শূন্য পড়িয়া রহিল। কাঞ্চুকী মহাশয় ছাড়া রাজ্যে আর কাহারও মনে খেদ রহিল না।

মগধের অবস্থা যখন এইরূপ, তখন লিচ্ছবি রাজ্যের রাজধানী বৈশালীতেও ভিতরে ভিতরে অনেক কিছু ঘটিতেছিল। মহামনীষী কৌটিল্য তখনও জন্মগ্রহণ করেন নাই, কিন্তু তাই বলিয়া রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কূটনীতির অভাব ছিল না। বৈশালীতে বাহ্য মিত্রতার অন্তরালে গোপনে গোপনে মগধের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলিতেছিল।

শিবমিশ্র বৈশালীতে সাদরে গৃহীত হইয়াছিলেন। লিচ্ছবিদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত—রাজা নাই। রাজার পরিবর্তে নিবাচিত নায়কগণ রাজ্য শাসন করেন। শিবমিশ্রেীর কাহিনী শুনিয়া তাহারা তাঁহাকে সসম্মানে মন্ত্রণাদাতা সচিবের পদ প্ৰদান করিলেন।

কেবল শিবমিশ্রের নামটি ঈষৎ পরিবর্তিত হইয়া গেল। তাঁহার গণ্ডের শৃগালদংশনক্ষত শুকাইয়াছিল বটে, কিন্তু ক্ষত শুকাইলেও দাগ থাকিয়া যায়। তাঁহার মুখখানা শৃগালের মতো হইয়া গিয়াছিল। জনসাধারণ তাঁহাকে শিবমিশ্র বলিয়া ডাকিতে লাগিল। শিবমিশ্র তিক্ত হাসিলেন, কিন্তু আপত্তি করিলেন না। শৃগালের সহিত তুলনায় যে ধূর্ততার ইঙ্গিত আছে, তাহা তাঁহার অরুচিকর হইল না; ঐ নামই প্ৰতিষ্ঠা লাভ করিল।

দিনে দিনে বৈশালীতে শিবামিশ্রের প্রতিপত্তি বাড়িতে লাগিল। ওদিকে তাঁহার গৃহে সেই শ্মশানলব্ধ অগ্নিকণা সাগিকের যত্নে বধিত হইয়া উঠিতে লাগিল।

চণ্ড ও মোরিকার কন্যা উস্কাকে একমাত্র অগ্নির সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। যতই তাহার বয়স বাড়িতে লাগিল, জ্বলন্ত বহ্নির মতো রূপের সঙ্গে সঙ্গে ততই তাহার দুর্জয় দুর্বশ প্রকৃতি পরিস্ফুট হইতে আরম্ভ করিল। শিবমিশ্র তাহাকে নানা বিদ্যা শিক্ষা দিলেন, কিন্তু তাহার প্রকৃতির উগ্রতা প্রশমিত করিবার চেষ্টা করিলেন না। মনে মনে বলিলেন—শিশুনাগবংশের এই বিষযাকণ্টক দিয়াই শিশুনাগ্যবংশের উচ্ছেদ করিব।

তীক্ষ্ণ-মেধাবিনী উল্কা চতুঃষষ্টি কলা হইতে আরম্ভ করিয়া ধনুর্বিদ্যা, অসিবিদ্যা পর্যন্ত সমস্ত অবলীলাক্রমে শিখিয়া ফেলিল। কেবল নিজ উদ্দাম প্রকৃতি সংযত করিতে শিখিল না।

মগধের প্রজাবিদ্রোহের সংবাদ যেদিন বৈশালীতে পৌঁছিল, সেদিন শিবমিশ্র গূঢ় হাস্য করিলেন। এই বিদ্রোহে তাঁহার কতখানি হাত ছিল, কেহ জানিত না। কিন্তু কিছু দিন পরে যখন আবার সংবাদ আসিল যে, শিশুনাগবংশেরই আর একজন যুবা রাজ্যাভিষিক্ত হইয়াছে, তখন তাঁহার মুখ অন্ধকার হইল। এই শিশুনাগবিংশ যেন সৰ্পবংশেরই মতো-কিছুতেই নিঃশেষ হইতে চায় না।

তারপর আরও কয়েক বৎসর কাটিল; শিবমিশ্র উল্কার দিকে চাহিয়া প্ৰতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

যেদিন উল্কার বয়স ষোড়শ বৎসর পূর্ণ হইল, সেই দিন শিবমিশ্র তাহাকে কাছে ডাকিয়া বলিলেন—বৎসে, তুমি আমার কন্যা নহ। তোমার জীবন-বৃত্তান্ত বলিতে চাহি, উপবেশন করব।

ভাবলেশহীন কণ্ঠে শিবামিশ্র বলিতে লাগিলেন, উল্কা করলগ্নকপোলে বসিয়া সম্পূর্ণ কাহিনী শুনিল; তাহার স্থির চক্ষু নিমেষের জন্য শিবামিশ্রের মুখ হইতে নড়িল না। কাহিনী সমাপ্ত করিয়া শিবমিশ্র বলিলেন—প্ৰতিহিংসা-সাধনের জন্য তোমায় ষোড়শ বর্ষ পালন করিয়াছি। চণ্ড নাই, কিন্তু শিশুনাগবিংশ অদ্যাপি সন্দপেৰ্শ বিরাজ করিতেছে। সময় উপস্থিত—তোমার মাতা মোরিকা ও পালক পিতা শিবামিশ্রেীর প্রতি অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণ কর।

কি করিতে হইবে।

শিশুনাগবিংশকে উচ্ছেদ করিতে হইবে।

পন্থা নির্দেশ করিয়া দিন।

শুন, পূর্বেই বলিয়াছি, তুমি বিষকন্যা; তোমার উগ্র অলোকসামান্য রূপ তাহার নিদর্শন। পুরুষ তোমার প্রতি আকৃষ্ট হইবে, পতঙ্গ যেমন অগ্নিশিখার দিকে আকৃষ্ট হয়। তুমি যে পুরুষের কণ্ঠালগ্ন হইবে তাহাকেই মরিতে হইবে। এখন তোমার কর্তব্য বুঝিয়াছ? মগধের সহিত বর্তমানে লিচ্ছবিদেশের মিত্রভাব চলিতেছে, এ সময়ে অকারণে যুদ্ধঘোষণা করিলে রাষ্ট্রীয় ধনক্ষয় জনক্ষয় হইবে, বিশেষত যুদ্ধের ফলাফল অনিশ্চিত। মগধবাসীরা নূতন রাজার শাসনে সুখে সঙ্ঘবদ্ধভাবে আছে—ব্রাজ্যে অসন্তোষ নাই। এরূপ সময় রাজ্যে রাজ্যে যুদ্ধ বাধানো সমীচীন নয়। কিন্তু শিশুনাগবংশকে মগধ হইতে মুছিয়া ফেলিতে হইবে, তাই এই পন্থা অবলম্বন করিয়াছি। বর্তমান রাজা সেনজিৎ ব্যাসনপ্রিয় যুবা, শুনিয়াছি রাজকার্যে তাহার মতি নাই—সৰ্ব্বপ্রথম তাহাকে অপসারিত করিতে হইবে। —পরিবে?

উল্কা হাসিল। যাবক-রক্ত অধরে দশনদুতি সৌদামিনীর মতো ঝলসিয়া উঠিল। তাহার সেই হাসি দেখিয়া শিবামিশ্রেীর মনে আর কোনও সংশয় রহিল না।

তিনি বলিলেন—এখন সভায় কি স্থির হইয়াছে, বলিতেছি। মগধে কিছু দিন যাবৎ বৈশালীর প্রতিভা কেহ নাই, কিন্তু মিত্ররাজ্যে প্রতিনিধি থাকাই বিধি, না থাকিলে সৌহার্দোর অভাব সূচনা করে। এজন্য সঙ্কল্প হইয়াছে, তুমি লিচ্ছবি-রাষ্ট্রের প্রতিভূস্বরূপ পাটলিপুত্রে গিয়া বাস করিবে। প্রতিভাকে সর্বদা রাজ-সন্নিধানে যাইতে হয়, সুতরাং রাজার সহিত দেখা-সাক্ষাতে কোনও বাধা থাকিবে না। অতঃপর তোমার সুযোগ।

উল্কা উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল—ভাল। কিন্তু আমি নারী, এজন্য কোনও বাধা হইবে না?

শিবমিশ্র বলিলেন—বৃজির গণরাজ্যে নারী-পুরুষে প্ৰভেদ নাই, সকলের কক্ষা সমান।

কবে যাইতে হইবে?

আগামী কল্য তোমার যাত্রার ব্যবস্থা হইয়াছে। তোমার সঙ্গে দশ জন পুরুষ পার্শ্বচর থাকিবে, এতদ্ব্যতীত সখী পরিচারিকা তোমার অভিরুচিমত লাইতে পার।

উল্কা শিবামিশ্রের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, অকম্পিত স্বরে বলিল—পিতা, আপনার ইচ্ছা পূর্ণ করিব। যে দুগ্রহের অভিসম্পাত লইয়া আমি জন্মিয়াছি, তাহা আমার জননীর নিষ্ঠুর হত্যার প্ৰতিশোধ লইয়া সার্থক হইবে। আপনি যে আমাকে কন্যার ন্যায় পালন করিয়াছেন, সে ঋণও এই অভিশপ্ত দেহ দিয়া প্ৰতিশোধ করিব।

শিবামিশ্রেীর কণ্ঠ ঈষৎ কম্পিত হইল, তিনি গম্ভীর স্বরে বলিলেন—কন্যা, আশীর্বাদ করিতেছি, লব্ধকমা হইয়া আমার ক্ৰোড়ে প্রত্যাগমন কর। দধীচির মতো তোমার কীর্তি পুরাণে অবিনশ্বর হইয়া থাকিবে।

পাটলিপুত্রের উপকণ্ঠে রাজার মৃগয়া-কানন। উল্কা ভাগীরথী উত্তীর্ণ হইয়া, এই বহু যোজন ব্যাপী অটবীর ভিতর দিয়া অশ্বারোহণে চলিয়াছিল। তাহার সঙ্গী কেহ ছিল না, সঙ্গী সহচরদিগকে সে রাজপথ দিয়া প্রেরণ করিয়া দিয়া একাকী বনপথ অবলম্বন করিয়াছিল, পুরুষ রক্ষীরা ইহাতে সসম্রমে ঈষৎ আপত্তি করিয়াছিল। কিন্তু উল্কা তীব্ৰ অধীর স্বরে নিজ আদেশ জ্ঞাপন করিয়া বলিয়াছিল—আমি আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ। তোমরা নগরতোরণে পৌঁছিয়া আমার জন্য প্ৰতীক্ষা করিবে। আমি একাকী চিন্তা করিতে চাই।

স্থির আচপল দৃষ্টি সম্মুখে রাখিয়া উল্কা অশ্বপৃষ্ঠে বসিয়া ছিল, অশ্বও তাড়নার অভাবে ময়ুরসঞ্চারী গতিতে চলিয়াছিল; পাছে আরোহিণীর চিন্তাজাল ছিন্ন হইয়া যায় এই ভয়ে যেন গতিছন্দ অটুট রাখিয়া চলিতেছিল! শস্পের উপর অশ্বের খুরধ্বনিও অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছিল।

ছায়া-চিত্রিত বনের ভিতর দিয়া কৃষ্ণ বাহনের পৃষ্ঠে যেন সঞ্চারিণী আলোকলতা চলিয়াছে—বনের ছায়ান্ধকার ক্ষণে ক্ষণে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে। উল্কার বক্ষে লৌহজালিক, পার্শ্বে তরবারি, কটিতে ছুরিকা, পৃষ্ঠে সংসপিত কৃষ্ণ বেণী; কৰ্ণে মাণিক্যের অবতংস অঙ্গারবৎ জ্বলিতেছে। এই অপূর্ব বেশে উল্কার রূপ যেন আরও উন্মাদকর হইয়া উঠিয়াছে।

কাননপথ অর্ধেক অতিক্রান্ত হইবার পর সহসা পশ্চাতে দ্রুত-অস্পষ্ট অশ্বখুরধ্বনি শুনিয়া উল্কার চমক ভাঙ্গিল। সে পিছু ফিরিয়া দেখিল, একজন শূলধারী অশ্বারোহী সবেগে অশ্ব চালাইয়া ছুটিয়া আসিতেছে; তাহার কেশের মধ্যে কঙ্কপত্র, পরিধানে শবরের বেশ। উস্কাকে ফিরিতে দেখিয়া সে ভল্ল উত্তোলন করিয়া সগর্জনে হাঁকিল—দাঁড়াও।

উল্কা দাঁড়াইল। ক্ষণেক পরে অশ্বারোহী তাহার পার্শ্বে আসিয়া কৰ্কশ স্বরে বলিল—কে তুই?—রাজার মৃগয়া-কাননের ভিতর দিয়া বিনা অনুমতিতে চলিয়াছিস? তোর কি প্রাণের ভয় নাই? এই পর্যন্ত বলিয়া পুরুষ সবিস্ময়ে থামিয়া গিয়া বলিল—এ কী! এ যে নারী!

উল্কা অধরোষ্ঠ ঈষৎ সঙ্কুচিত করিয়া বলিল—নারীই বটে! তুমি কে?

পুরুষ ভল্ল নামাইল। তাহার কৃষ্ণবর্ণ মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটিয়া উঠিল, চোখে লালসার তীক্ষ্ণ আলোক দেখা দিল। সে কণ্ঠস্বর মধুর করিয়া বলিল—আমি এই বনের রক্ষী। সুন্দরি, এই পথহীন বনে একাকিনী চলিয়াছ, তোমার কি দিগভ্ৰান্ত হইবার ভয় নাই?

উল্কা উত্তর দিল না; বল্গার ইঙ্গিতে অশ্বকে পুনর্বার সম্মুখদিকে চালিত করিল।

রক্ষী সনির্বন্ধ স্বরে বলিল—তুমি কি পাটলিপুত্ৰ যাইবে? চল, আমি তোমাকে কানন পার করিয়া দিয়া আসি! বলিয়া সে নিজ অশ্ব চালিত করিল।

উল্কা এবারও উত্তর দিল না, অবজ্ঞাস্ফুরিত-নেত্রে একবার তাহার দিকে চাহিল মাত্র। কিন্তু রক্ষী কেবল নেত্ৰাঘাতে প্ৰতিহত হইবার পাত্র নয়, সে লুব্ধ নয়নে উল্কার সর্বাঙ্গ দেখিতে দেখিতে তাহার পাশে পাশে চলিল।

ক্ৰমে দুই অশ্বের ব্যবধান কমিয়া আসিতে লাগিল। উল্কা অপাঙ্গ-দৃষ্টিতে দেখিল, কিন্তু কিছু বলিল না।

রক্ষী আবার মধু-ঢালা সুরে বলিল—সুন্দরি, তুমি কোথা হইতে আসিতেছ? তোমার এরূপ কন্দৰ্প-বিজয়ী বেশ কেন?

উল্কা বিরস-স্বরে বলিল—সে সংবাদে তোমার প্রয়োজন নাই।

রক্ষী অধর দংশন করিল; এ নারী যেমন রূপসী, তেমনই মদগর্বিতা! ভাল, তাহার মদগৰ্ব্ব লাঘব করিতে হইবে; এ বনের অধীশ্বর কে তাহা জানাইয়া দিতে হইবে।

রক্ষী আরও নিকটে সরিয়া আসিয়া হস্তপ্রসারণপূর্বক উষ্কার হাত ধরিল। উল্কার দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল, সে হাত ছাড়াইয়া লইয়া সৰ্প-তর্জনের মতো শীৎকার করিয়া বলিল—আমাকে স্পর্শ করিও না—অনাৰ্য।

রক্ষীর মুখ আরও কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করিল। সম্পূর্ণ অনার্য না হইলেও সে আর্য-অনার্যের মিশ্রণজাত অম্বষ্ঠ বটে, তাই এই হীনতা-জ্ঞাপক সম্বোধন তাহাকে অঙ্কুশের মতো বিদ্ধ করিল। দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করিয়া সে বলিল—অনাৰ্য্য! ভাল, আজ এই অনার্যের হাত হইতে তোমাকে কে রক্ষা করে দেখি—বলিয়া বাহু দ্বারা কটি বেষ্টন করিয়া উল্কাকে আকর্ষণ করিল।

উল্কার মুখে বিষ-তীক্ষ্ণ হাসি ক্ষণেকের জন্য দেখা দিল।

আমি বিষকন্যা—আমাকে স্পর্শ করিলে মরিতে হয়। বলিয়া সে রক্ষীর পঞ্জরে ছুরিকা বিদ্ধ করিয়া দিল, তারপর উচ্চৈঃস্বরে হাসিতে হাসিতে বায়ুবেগে অশ্ব ছুটাইয়া দিল।

পাটলিপুত্রের দুৰ্গতোরণে যখন উল্কা পৌঁছিল, তখন বেলা দ্বিপ্রহর। শান্তির সময় দিবাভাগে তোরণে প্রহরী থাকে না, নাগরিকগণও মধ্যাহ্নের খর রৌদ্রতাপে স্ব স্ব গৃহচ্ছায়া আশ্রয় করিয়াছে; তাই তোরণ জনশূন্য। কেবল উষ্কার পথশ্ৰান্ত সহচরীগণ উৎকণ্ঠিতভাবে অপেক্ষা করিতেছে।

উল্কা উন্নত তোরণ-সম্মুখে ক্ষণেক দাঁড়াইল। একবার উত্তরে দূর-প্রসারিত শূল-কণ্টকিত শ্মশানভূমির দিকে দৃষ্টি ফিরাইল, তারপর নিবদ্ধ ওষ্ঠাধরে তোরণ-প্রবেশ করিল।

কিন্তু তোরণ উত্তীর্ণ হইয়া কয়েক পদ যাইতে না যাইতে আবার তাহার গতি রুদ্ধ হইল। সহসা পার্শ্ব হইতে বিকৃতকণ্ঠে কে চিৎকার করিয়া উঠিল—জল! জল! জল দাও!

রুক্ষ উগ্ৰকণ্ঠের এই প্রার্থনা কানে যাইতেই উল্কা অশ্বের মুখ ফিরাইল। দেখিল, তোরণপার্শ্বস্থ প্রাচীরগাত্র হইতে লৌহবলয়-সংলগ্ন স্কুল শৃঙ্খল বুলিতেছে, শৃঙ্খলের প্রান্ত এক নিরাকার বীভৎস মূর্তির কটিতে আবদ্ধ। মূর্তির করপত্র নাই, পদদ্বয়ও জঙ্ঘা সন্ধি হইতে বিচ্ছিন্ন—জটাবদ্ধ দীর্ঘ কেশে মুখ প্রায় আবৃত। সে তপ্ত পাষাণ-চত্বরের উপর কৃষ্ণকায় কুম্ভীরের মতো পড়িয়া আছে এবং লেলিহা রসনায় অদূরস্থ জলকুণ্ডের দিকে তাকাইয়া মাঝে মাঝে চিৎকার করিয়া উঠিতেছে—জল! জল। মাধ্যন্দিন সূৰ্যতাপে তাহার রোমশ দেহ হইতে স্বেদ নির্গত হইয়া চত্বর সিক্ত করিয়া দিতেছে।

উল্কা উদাসীনভাবে সেই দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার মনে করুণার উদ্রেক হইল না। শুধু সে মনে মনে ভাবিল—এই মগধবাসীরা দেখিতেছি নিষ্ঠুরতায় অতিশয় নিপুণ।

শৃঙ্খলিত ব্যক্তি জন-সমাগম দেখিয়া জানুতে ভর দিয়া উঠিল, রক্তিম চক্ষে চাহিয়া বন্য জন্তুর মতো গর্জন করিল—জলি! জল দাও!

উল্কা একজন সহচরকে ইঙ্গিত করিল; সে জলকুণ্ড হইতে জল আনিয়া তাহাকে পান করাইল। শৃঙ্খলিত ব্যক্তি উত্তপ্ত মরুভূমির মতো জল শুষিয়া লইল। তারপর তৃষ্ণা নিবারিত হইলে অবশিষ্ট জল সর্বাঙ্গ মাখিয়া লইল।

উল্কা জিজ্ঞাসা করিল—কোন অপরাধে তোমার এরূপ দণ্ড হইয়াছে?

গত তিন বৎসর ধরিয়া বন্দী প্রতিনিয়ত বিদ্যুপকারী নাগরিকদের নিকট এই একই প্রশ্ন শুনিয়া আসিতেছে। সে উত্তর দিল না—হিংস্ৰদূষ্টিতে উল্কার দিকে তাকাইয়া পিছু ফিরিয়া বসিল।

উল্কা পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল—কে তোমার এরূপ অবস্থা করিয়াছে? শিশুনাগবংশের রাজা?

শ্বাপদের মতো তীক্ষ্ণ দন্ত বাহির করিয়া বন্দী ফিরিয়া চাহিল। তাহার ভঙ্গি দেখিয়া মনে হইল, একবার মুক্তি পাইলে সে উল্কাকে দুই বাহুতে পিষিয়া মারিয়া ফেলিবে। উল্কা যে তাঁহাকে এইমাত্র পিপাসার পানীয় দিয়াছে, সে জন্য তাহার কিছুমাত্র কৃতজ্ঞতা নাই।

সে বিকৃত মুখে দন্ত ঘর্ষণ করিয়া বলিল—পথের কুকুর সব, দূর হইয়া যা। লজ্জা নাই? একদিন আমি তোদের পদতলে পিষ্ট করিয়াছি, আবার যেদিন এই শৃঙ্খল ছিড়িব, সেদিন আবার পদদলিত করিব। এখন পলায়ন কর-আমার সম্মুখ হইতে দূর হ।

উল্কার চোখের দৃষ্টি সহসা তীব্ৰ হইয়া উঠিল; সে অশ্বাপূষ্ঠে ঝুঁকিয়া জিজ্ঞাসা করিল—কে তুমি? তোমার নাম কি?

ক্ষিপ্তপ্রায় বন্দী দুই বাহু দ্বারা নিজ বক্ষে আঘাত করিতে করিতে বলিল—কে আমি? কে আমি? তুই জানিস না? মিথ্যাবাদিনি, আমাকে কে না জানে? আমি চণ্ড—আমি মহারাজ চণ্ড! তোর প্রভু। তোর দণ্ডমুণ্ডের অধীশ্বর! বুঝিলি? আমি মগধের নায্য অধিপতি মহারাজ চণ্ড।

উল্কা ক্ষণকালের জন্য যেন পাষাণে পরিণত হইয়া গেল। তারপর তাহার সমস্ত দেহ কম্পিত হইতে লাগিল, ঘন ঘন নিশ্বাস বহিল, নাসা স্ফুরিত হইতে লাগিল। তাহার এই পরিবর্তন বন্দীরও লক্ষ্যগোচর হইল, উন্মত্ত প্ৰলাপ বকিতে বকিতে সে সহসা থামিয়া গিয়া নিষ্পলক নেত্ৰে চাহিয়া রহিল।

উল্কা কথঞ্চিৎ আত্মসম্বরণ করিয়া সহচরদের দিকে ফিরিল, ধীরস্বরে কহিল—তোমরা ঐ পিপ্পলীবৃক্ষতলে গিয়া আমার প্রতীক্ষা কর, আমি এখনই যাইতেছি।

সহচরীগণ প্ৰস্থান করিল।

তখন উল্কা অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া বন্দীর সম্মুখীন হইল। চত্বরের উপর উঠিয়া একাগ্ৰদূষ্টিতে বন্দীর মুখ নিরীক্ষণ করিতে করিতে বলিল—তুমিই ভূতপূর্ব রাজা চণ্ড।

চণ্ড সবেগে মাথা নাড়িয়া বলিল—ভূতপূর্ব নয়—আমিই রাজা। আমি যত দিন আছি, তত দিন মগধে অন্য রাজা নাই।

তোমাকে তবে প্ৰজারা হত্যা করে নাই?

আমাকে হত্যা করিতে পারে, এত শক্তি কাহার?

রক্তহীন অধরে উল্কা জিজ্ঞাসা করিল—মহারাজ চণ্ড, মোরিকা নামী জনৈকা দাসীর কথা মনে পড়ে?

চণ্ডের জীবনে বহুশত মোরিকা ক্রীড়াপুত্তলীর মতো যাতায়াত করিয়াছে, দাসী মোরিকার কথা তাহার মনে পড়িল না।

উল্কা তখন জিজ্ঞাসা করিল—মোরিকার এক বিষকন্যা জন্মিয়াছিল, মনে পড়ে?

এবার চণ্ডের চক্ষুতে স্মৃতির আলো ফুটিল, সে হিংস্ৰহাস্যে দন্ত নিষ্ক্রান্ত করিয়া বলিল—মনে পড়ে, সেই বিষকন্যাকে শ্মশানে প্রোথিত করাইয়াছিলাম। শিবমিশ্রকেও শ্মশানের শৃগালে ভক্ষণ করিয়াছিল। অতীত নৃশংসতার স্মৃতির মধ্যেই এখন চণ্ডের একমাত্র আনন্দ ছিল।

উল্কা অনুচ্চ কণ্ঠে বলিল—সে বিষকন্যা মরে নাই, শিবমিশ্রকেও শৃগালে ভক্ষণ করে নাই। মহারাজ, নিজের কন্যাকে চিনিতে পারিতেছেন না?

চণ্ড চমকিত হইয়া মুণ্ড ফিরাইল।।

উল্কা তাহার কাছে গিয়া কৰ্ণকুহরে বলিল—আমিই সেই বিষকন্যা। মহারাজ, শিশুনাগবংশের চিরন্তন রীতি স্মরণ আছে কি? এ বংশের রক্ত যাহার দেহে আছে, সেই পিতৃহন্ত হইবে। —তাই বহুদূর হইতে বংশের প্রথা পালন করিতে আসিয়াছি।

চণ্ড কথা কহিবার অবকাশ পাইল না। উদ্যতফণা সৰ্প যেমন বিদ্যুদ্বেগে দংশন করে, তেমনই উল্কার ছুরিকা চণ্ডের কণ্ঠে প্ৰবেশ করিল। সে উর্ধর্বমুখ হইয়া পড়িয়া গেল, তাহার প্রকাণ্ড দেহ মৃত্যু-যন্ত্রণায় ধড়ফড় করিতে লাগিল। দুইবার সে বাক্য-নিঃসরণের চেষ্টা করিল। কিন্তু বাক্যস্ফুর্তি হইল না—মুখ দিয়া গাঢ় রক্ত নিৰ্গলিত হইয়া পড়িল। শেষে কয়েকবার পদপ্রক্ষেপ করিয়া চণ্ডের দেহ স্থির হইল।

উল্কা কটিলগ্ন হস্তে দাঁড়াইয়া দেখিল। তারপর ধীরপদে গিয়া নিজ অশ্বে আরোহণ করিল, আর পিছু ফিরিয়া তাকাইল না। তাহার ছুরিকা চণ্ডের কণ্ঠে আমূল বিদ্ধ হইয়া রহিল। নির্জন তোরণপার্শ্বে মধ্যাহ্ন-রৌদ্রে ষোল বৎসরের পুরাতন নাট্যের শেষ অঙ্কে যে দ্রুত অভিনয় হইয়া গেল, জনপূর্ণ পাটলিপুত্রের কেহ তাহা দেখিল না।

এইরূপে শোণিতপঙ্কে দুই হস্ত রঞ্জিত করিয়া মগধের বিষকন্যা আবার মগধের মহাস্থানীয়ে পদাপণ করিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *