বিশ্বাস
মানুষের বিশ্বাস যে কিভাবে সফলতা র সোপান হয়ে তার কাজকে মহিমান্বিত করে তার অনেক অনেক উদাহরন আমার জীবনে আছে। লোক সংস্কৃতি চর্চার কারণে এসব ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি এবং অবাক বিস্ময়ে সেই অনাদি-অনন্তের পায়ে মাথা নত হয়ে গেছে নিজে থেকেই। আজ থেকে প্রায় 30 বছর আগের কথা বিয়ের পর প্রথম দেশের বাড়ি গেছি। আমাদের দেশের বাড়ি কেলেঘাই নদীর তীরের এক গ্রামে। গ্রামের একপাশে জঙ্গল অন্য পাশে নদী। নদী তীরে ও জঙ্গল। ভারী সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ।
আমাদের বাড়ির এক বাধা মান্দার —-রাঙা দাদা– জঙ্গলমহলের প্রান্তিক গ্রাম বাগডুবি র বাসিন্দা ছিলেন। উনার মুখে এক লোক দেব দেবতার কথা শুনলাম কালুয়াষাঁড। নয়া গ্রামে সুবর্ণরেখা পেরিয়ে দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের জঙ্গল ।জঙ্গল এর পাশের গ্রামের নাম কালুয়াষাঁড। এই জঙ্গলের গভীরে রয়েছেন জঙ্গলের অধিষ্ঠাতা দেবতা র আটন। ভীষণ কৌতুহল হল। কিন্তু শাশুড়ি মায়ের ধমকে সব প্ল্যান চুরমার হয়ে গেল। উনি রাঙা দাদাকে খুব বকাঝকা করলেন আমাকে এই দেবতার কথা বলার জন্য। মাকে লুকিয়ে দাদার কাছে দেবতার কথা জানতে গিয়ে একটা অদ্ভুত কথা শুনলাম—– ঠাকুরের ইচ্ছে না হলে কেউ নাকি তার দর্শন পায় না! আর বিশ্বাসও আন্তরিকতা না থাকলে কালুয়া ষাঁডের পুজো দেওয়া যায় না।
এই লোকদেবতা গৃহপালিত পশু ও গ্রামের মানুষজন সবারই রক্ষাকর্তা জঙ্গলের হিংস্র জন্তুর হাত থেকে পশুপাল ও রক্ষক কে রক্ষা করেন ইনি। পুজো দিতে হলে ঢাক ঢোল বাঁশি বাজিয়ে পুজো নিয়ে যেতে হয় আর মানসিক এর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুজো দিতে হয় না হলে ঠাকুর পুজো গ্রহণ করেন না। কৌতুহল হল খুব কিন্তু যাওয়া আর হলো না। দন্ড পলের হিসেবে কেটে গেছে প্রায় দু’দশক। আমার ছোট জায়ের মুখে আবার শুনলাম বাবা কালুয়াষাঁডের কথা। আবার যাবার চেষ্টা করলাম সব ঠিক করে যাবার দিন হঠাৎ করে যার সাথে যাব তার বিশেষ কাজ পড়ে যাওয়ায় যেতে পারলাম না। উপরন্তু বাড়িতে সব জেনে গিয়ে ভীষণ বকা খেলাম। বুঝলাম বাবার ডাক আসেনি। এইসময় নয়া গ্রামে জঙ্গল কন্যা সেতু লাগোয়া ডাহি পার্কে রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসবের নিমন্ত্রণ পেলাম। ওখানে গিয়ে শুনলাম যে কালুয় ষাঁড যাবার রাস্তা পাকা হয়ে গেছে। গাড়ি নিয়ে সোজাআটন পর্যন্ত যাওয়া যাবে। এর কয়েক সপ্তাহ পরে একদিন একাই বেরিয়ে পড়লাম। কেশিয়াড়ি তে এসে গাড়ি বুক করলাম। যার গাড়ি সেই দাদা বললেন—- দিদি যদি একমনে ঠাকুরের কাছে যান তাহলেই দর্শন পূজা দুই ই হবে। তবে সবই ঠাকুরের ইচ্ছে। আপনার কি মানসিক আছে?
আমি বললাম– না না এমনি দর্শন করব আর পুজো দেবো! বেশ গল্প করতে করতে এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম আটনে! চারপাশের আদিম জঙ্গলঘেরা আটন ।সাবরা, চল্লা , তেঁতুল শ্যাওড়া গাছের বেষ্টনী। ছলনের স্তুপের ঢাকা পড়েছে আটন। শনি মঙ্গলবারে পুজোর ভিড়। বলির পাঁঠা ও মোরগের ছড়াছড়ি। প্রায় হাজার মানুষের ভিড়ে আটন চত্বর ঢেকে আছে। আমি ভাবলাম হয়তো পুজো দিতেই পারব না। পুজোর ডালা হাতে চারপাশে দেখছি হঠাৎ দেহুরির ডাকে চমকে উঠলাম— মানসিকের পূজা কি না বলতেই ডালা চাইলেন। দিলাম। নারকেল টা কি করব জানতে চাইলেন। ঠাকুরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করবো বলতেই বললেন— ফাটাও। ঠাকুরের সামনে মেঝেতে নারকেল টা ফাটালাম। ঠাকুর আমার পূজা স্বীকার করলেন। আমার মনষ্কামনা পূর্ণ হল। এবার মোবাইল হাতে পুর আটন ঘুরে ঘুরে ছবি তুললাম। অদ্ভুত বিশ্বাস মানুষের। আটনের একপাশে বাদ্য কররা বসে ঢাক ঢোল বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। পুজোর রীতি যে ঢাকঢোল বাজিয়ে পুজো নিয়ে যাওয়া। সবাই পূজা শেষে বাদ্যকরদের দক্ষিণা ও প্রসাদ দিচ্ছে।
ওখানে পৌঁছনোর আধঘণ্টার মধ্যে পূজা ও দর্শন হয়ে গেল। গাড়ির সারথি বললেন—- দিদি একমনে আন্তরিকতার সঙ্গে বাবাকে দেখতে চেয়ে ছিলেন তো তাই বাবা আপনার পুজো স্বীকার করেছেন।
সারা জঙ্গলমহলের আর কোথাও এই দেবতার অস্তিত্ব নেই। এই সীমান্ত বাংলার উড়িষ্যা সংলগ্ন প্রান্তে জঙ্গলের মধ্যে লোকদেবতার আটন খুবই বিস্ময় জাগায়। সন্নিহিত জঙ্গলও গ্রাম দুটোই দেবতার নামে। পৌষ সংক্রান্তি সময় 15 দিন ধরে গ্রামীণ মেলা বসে। এছাড়া প্রতি শনি মঙ্গলবার পুজোর ভিড় দেখা যায়। অব্রাহ্মণ দেহুরি লৌকক রীতিতে পুজো করেন। শুনলাম “ঝারিভোগ অর্থাৎ মদ ও প্রসাদ হিসাবে নিবেদিত হয়। দেহুরি সেই প্রসাদ দেবতার নামে গ্রহণ করেন। পুজো দিয়ে আটন ছেড়ে যাবার সময় পিছনে তাকানো মানা।
এই প্রান্তিক মানুষদের বিশ্বাসেই পাথর জাগ্রত হয় প্রচলিত কাহিনী ও সিঁদুরের মহিমায়। এই আমাদের শাশ্বত গ্রামীণ ভারত।