বিশু পাগলা
অদ্ভুতুরে পাগলটাকে প্রাণখুলে হাসতে দেখে বললাম- এত হাসছিস কেন , কি হয়েছে ?
আমাদের সহনাগরিক বিশু পাগল কিছুদূরে একজনের দিকে আঙুল তুলে বলল – ওর জন্য।
– মানে !
– আরে এখান দিয়ে যাচ্ছিল , আমি ভিক্ষে চাইতেই একশ টাকা দিল,এদিকে ওর জুতোটা দেখেছ ? এবার আর কোন মুচি সারাবেই না ।
আমি বিশুর দেখান লোকটাকে দেখে চমকে গেলাম, এ তো আরেক বিশু , আমার বন্ধু , বিশ্বজিৎ । একটু আগেই এসেছিল , ছোটবেলার অনেক স্মৃতিচারণ হল , অবশ্যই তার সঙ্গে লাল উষ্ণ তরল। তখনই জেনেছিলাম যে বিশুর চাকরি গেছে বিশ্ব নাগরিকরা যখন বাধ্য হয়েছিল গৃহবন্দি থাকতে। করত একটা দোকানে সেলসের কাজ, মালিক হাতে এক মাসের মাইনে ধরিয়ে দিয়ে করেছিল বিগ স্যালুট । তারপর …….ঘরে চারটে পেট, একমাত্র মেয়ে ক্লাশ নাইনে উঠেছে। আশি পার মা প্রায় বিছানায়, গিন্নির শদুয়েক অসুখ, শুধু ওষুধের বিল মাসে হয় হাজার পাঁচেক । শুনে মনটা ব্যথাতে ভরে উঠেছিল। স্কুল জীবনে বিশু ছিল লেখাপড়াতে আমাদের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে , প্রতিটা পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে অন্যদের চোখ টাটাতো। সেই বিশু সাম্যবাদের মালা গলায় ঝুলিয়ে দেশ উদ্ধারে নেবে নিজের যৌবন খুইয়েছে। বঞ্চিত মানুষদের অধিকার ছিনিয়ে আনতে ব্যস্ত বিশু দেখেনি তার দাদারা তাকেই বঞ্চিত করেছে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে। লুটেপুটে নে মা শ্যামা গানের শেষে বিশু দেখে এজমালি বাড়িতে তার একটা ঘর আর এক চিলতে বারান্দা জুটেছে । তার বাথরুম ভাড়াটের সাথে , দাদাদের সব নিজস্ব। তার প্রতিবাদী কন্ঠস্বর বৌদিদের কোরাসের কাছে হাওয়াতে মিলিয়ে গিয়েছিল।
বিশু খুব ন্যায়বান, তাই বাল্য প্রেমকে স্বীকার করে ঝুমুকে ঘরে এনেছিল অনাড়ম্বর ভাবে।
আজ এতকথা মনে পরে যাবার পর বিশুকে হাজারটা টাকা নগদ আর একটা চেকে দশ হাজার টাকা দিতেই শঙ্খচূড়ের মত ফণা তুলে বলেছিল – অভিজিৎ সহমর্মিতা জানাবি, ভিক্ষে দিয়ে আমার লড়াইকে থামানোর চেষ্টা করবি না।
আমি হতবাক। তবুও উঠে যাবার সময় প্রায় জোর করে ওর মেয়ের দিব্যি খেয়ে হাতে হাজার টাকা গুঁজে দিয়েছিলাম । মনে হয় ওখান থেকেই একশ টাকা বিশু পাগল পেয়েছে ।
– কি ভাবছ গো দাদা ?
পাগলের প্রশ্নে চটকা ভাঙে । বলি
– ও ব্যাটা মাতাল , ওকে নিয়ে হাসিস না। ও যে কি তা তুই জানিস না। আজ ও আদর্শের জন্য এইখানে আর যাদের কথা শুনে ও আদর্শ ছাড়ল না তারা এই প্যাচপ্যাচে গরমে এসির হাওয়া খাচ্ছে, কত শিক্ষিত তুই পাগল জানিস ?
গলা খাঁকরানি দিল বিশু পাগল –
দেখ দাদা , যেভাবে ভিক্ষে করি তার জন্য তোমরা পাগলা বল। শুনে রাখ আমার ঝোলাতেও আছে মাস্টার্সের সার্টিফিকেট, অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার , সব থাকলেও কাবেরী নেই তাই আমিও নেই। আমিও বঞ্চিত পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ পাওয়া থেকে। কাবেরী এল না জীবনে, শুধু বসিয়ে গেল এখানে ,প্রথম প্রথম এই চেহারা দেখে অনেক কথা শুনেছি , দাদা তুমিই বল পেট কি কোনও কথা মানবে ? বাধ্য হলাম তোমাদের বিশু পাগল হতে।
আমি শুনে থ । ভাবলাম কি বিচিত্র এই জগৎ।
ঘোর কাটিয়ে বললাম- তোর সঙ্গে পরে কথা বলব এখন ওই বিশুকে বাড়ি ছেড়ে আসি , মনে হচ্ছে ও আউট, খালি পেটে মাল খেলে যা হয় ।
পাগল আবদার করল সে’ও যাবে। নরম গরম, না কিছুতেই বিশু পাগল নমনীয় হল না। বললাম-
তুই ওকে পাহারা দে যেন অন্য কোথাও না যায়, আমি গাড়ি আনছি।
ফোন করে গাড়ি আনতে বললাম। একপ্রকার জোর করে বিশুকে গাড়িতে তুললাম। ওর বাড়ি যাবার পথে অনেক খাবার কিনলাম। প্রতিবারই বিশু তীব্র প্রতিবাদ করেছে , তখন প্রকাশ করলাম আমার IPS রূপ।
ঝুমনা অনেকদিন বাদে আমাকে দেখে যেমন খুশি ঠিক ততটাই বিব্রত। নোনাধরা অন্ধকার ঘরে ওদের স্নেহের তৃষাকে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে খাবারগুলো তুলে দিলাম। দেখলাম তৃষা লজ্জা পাচ্ছে। অনেক কথার ফাঁকে ঝুমনা আর তৃষাকে ডেকে বললাম-
– সে কোন এক সময় হবে বিশু আমাকে ধার দিয়েছিল, তারপর আর দেখা হয়নি, ওর’ও খেয়াল নেই। আজ যখন দেখা হল প্লিজ আমাকে ঋণমুক্ত কর।
বলে পাঁচ হাজার টাকা জোর করে দিলাম।
গতানুগতিক জীবন, একদম কি ভাবিনি বিশুর কথা , ভেবেছি ! কাজের চাপে সে কবেই হারিয়েছে কে জানে । এমন সময়, একদিন সিকিউরিটি বেল বাজিয়ে ঢুকে জানাল যে বিশু পাগলা জোর করে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে , ওরা কি পুলিশ ডাকবে !
গম্ভীর গলাতে বললাম আসতে দিতে।
বিশু এসেই বলল – তুমি যে এত বড় অফিসার জানতাম না । কাজের কথা বলে চলে যাই।
– বল
– আমি দাদা পাগলা সেজে কিছু কামিয়েছিলাম। আগেরদিন তোমার বন্ধুর বাড়ি চিনেছি। আজ আমার জমানো পঞ্চাত্তর হাজার টাকা ঝুমনা বৌদির হাতে দিয়ে এলাম। বলেছি দাদা আমার লটারির দোকান থেকে টিকিট কেটেছে , তার টাকা এইটা , এটা বিশুদার হকের টাকা, এত ডেকেছি আসছে না তাই বাধ্য হলাম। বৌদি নিল। আমার কাজ আপাতত শেষ দাদা ।
পাগলার কথা শুনে উঠে দাঁড়ালাম, হাত মিলিয়ে একটা স্যালুট দিলাম, মনে হল সরকারি ব্যাজ, চেয়ার আর তকমা মানবতার কাছে অর্থহীন।