Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী || Shipra Mukherjee » Page 8

বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী || Shipra Mukherjee

বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 15

অটো এসে দাঁড়াল। তাকে হিন্দিতে বোঝান শুরু করলাম। বিনায়ক টেম্পল হয়ে একে একে সব মন্দিরে যাব। ——– ঠিক আছে স্যার আপনারা উঠে পড়ুন। ওর মুখে বাংলা শুনে আমি খুব খুশি হয়ে বললাম। ———- তুমি বাঙালি? ——- হ্যাঁ স্যার। মুর্শিদাবাদ বাড়ি। আমার বাবার জন্ম এখানেই। গাড়িতে উঠে পড়লাম একে একে। মাসীমা,,মেশোমশায় আর মন্দাকিনী পেছনে আর সামনে আমি।ড্রাইভারের পাশে বসলাম। কথা বলতে বলতে চললাম। ওরা মুসলিম। তবুও দুর্গা, কালীর নাম জানে নুর মহম্মদ। দুর্গা পুজোর তিন দিন খিচুড়ি ভোগ খায় ওরা। সমস্ত কাজ ফেলে মন্ডপে যায়। নুর বলল—— মাসীমা এটা রামকৃষ্ণ মঠ। বিচ রোড থেকে বাঁয়ে কিছুটা উঠে ই এই মঠ। তার আগেই রামকৃষ্ণ মিশনের লাইব্রেরি চত্বর। একটু উঁচুতে উঁচুতে উঠতেই রামকৃষ্ণ মিশনের চত্বর। মাসীমা ,মেশোমশায় ভেতরে গিয়ে প্রণাম করে এলেন। কম্পাউন্ড এর ভেতরে কোয়ার্টার ও রয়েছে। অটো এগিয়ে চলল। নুর আমাদের নানা তথ্য পরিবেশন করছে।কাঁচের ঘেরাটোপের সব বাহারে দোকান। বাঁয়ে চিল্ড্রেন পার্ক পড়ল।এটা ভু ডা পার্ক। একটা জংশন এলে নুর চেঁচিয়ে বলল। ——— দিদি এটা অন্ধ্র ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস। বিশাল চত্বর জুড়ে আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্ট। এর পেছনেই ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাম্পাস। কম্পাউন্ডের মধ্যেই কোয়ার্টার। সোজা চলল অটো। রাস্তায়, ডানে পেতলের বা সোনার গনেশ মূর্তি বসান। অগণিত ভক্তের লাইন বলে দিচ্ছে পুজারীর পুজোয় এরা তৃপ্ত। আমি ও সিদ্ধিদাতা কে মনের কথা বললাম। এবার হল ঝামেলা।নুর পুলিশের ভয়ে আমাকে সামনে বসতে দিল না।বাধ্য হয়ে আমাকে পেছনেই ঠেসে ঠুসে বসতে হল। ওখানে অটোর পেছনে সীট এর সামনে একটা সরু কাঠের পাটাতন থাকে। তাতেই আমাকে বসতে হল। মন্দাকিনী ধারে বসেছে। তাই ওর দু পায়ের দু,পাশে আমার পা দু’খানা।এই মুহূর্তে আমার মনে হল আমার পা দু’খানা না থাকলেই বুঝি ভাল হতো।আমি বুঝতে পারছি আমার পায়ের দিকে মাসীমার দৃষ্টি।তার মানে আমার পা কোন অসৎ আচরণ করছে কিনা? আমি বাক হীন। আমি স্থবিরের মত বসে থাকলে ও নুর আমাকে সভ্য থাকতে দিচ্ছেনা। একটা ঝাকি লাগার সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নিচু করলাম যাতে মাথা লোহায় ঠুকে না যায়। আর মন্দাকিনী ঝুঁকে পড়ল আমার হাটুর ওপর। আমার শরীর কেঁপে উঠল। মাসীমা ও টাল সামলাতে না পেরে নুরের কাঁধ চেপে ধরলেন। ———- আচ্ছা ছেলে বটে তুমি।মারবে নাকি? মাসীমার রাগের কারণ টা বুঝেছি।কথাটা নুরকে বললেও তার মেয়ের শরীর যে আমার হাঁটু ছুঁয়েছে তা দেখেছেন বলেই গলার স্বর কর্কশ। মোর আসতে আমি নেমে দাঁড়ালাম। আর সিগন্যাল নেই, অতএব সামনে বসা যাবে। চৈতন্য মঠ থেকে বের হতে ছয়টা বেজে গেল। নুর বলল—— পান্ডুরঙ্গা মন্দির দেখে তারপর কালি মন্দির। পান্ডুরঙ্গা মন্দিরের চূড়ো অনেক উপরে উঠে গেছে। চূড়োতে নানা দেব দেবীর মুর্তি। প্রতিটি কুঠুরিতে একটা করে ঠাকুরের মূর্তি বসান। বিশাল চত্বর গাছ গাছালিতে ভরা ছায়া ঘন পরিবেশ। আর কে বিচ এসে নুর কে ধন্যবাদ দিলাম। দিতেই তো হয় এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য। সেই মূহুর্তের অনুভূতি কি ভোলার?সেই চোখে চোখ পড়েছিল তখন। সে চোখে রাজ্যের লজ্জা ছেয়ে ছিল। জুতো খুলে মন্দির চত্বরে ঢুকতে হল।প্রথমেই শিব মন্দিরে উঠলাম। প্যাগোডার আকারে ঐ মন্দির দাক্ষিনাত্য আর ইউরোপীয় স্থাপত্য আর ভাস্কর্যের নমূনা এখানে।বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা টাইলস বসানো হয়েছে। মেশোমশায়কে বললাম—– দেখুন মেশোমশায় কি সুন্দর স্টিলের পাইপ দিয়ে হতল না বানিয়ে কংক্রিটের বাঁশ তৈরি করে হাতল ব্যবহার করেছেন আর্কিটেক্ট ডক্টর জোসেফ। সমুদ্রের নোনা হাওয়া লেগে নষ্ট হওয়ার ভয় নেই। এখানকার শিব মূর্তির ওজন দশ কিলো।শক্ত পারদ দিয়ে তৈরি। মেশোমশায় ও আমি কালি মন্দিরের দিকে পা বাড়ালাম। দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের ধাঁচে এই মন্দির গড়া হয়েছে। মা কে প্রণাম করলাম। বিহারের কালো পাথরে গড়া মায়ের প্রতিমা।ওজন একশো আশি কিলো।শত পদ্মের পাঁপড়ি হয়েছে রাজস্থানের শ্বেত পাথর দিয়ে।হিন্দু,মুসলিম, খৃষ্টান সবার অবদান আছে এই মন্দিরের কারুকাজে। দুই পাশে দুটো দড়ি বাঁধা হয়েছে প্রবেশ পথে। যাতে মহিলা ও পুরুষ আলাদা ভাবে মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে। মাঝখান টা একেবারেই ফাঁকা যাতে দুরের দর্শনার্থীদের মায়ের মুর্তি দেখতে অসুবিধা না হয়।ভীড় থাকলে মায়ের মূর্তি ঢাকা না পড়ে। মেশোমশায় বললেন—–চোখ জুড়ানো রূপ মায়ের। ———- হ্যাঁ। কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্টস কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ঈষা মহম্মদ একজন নামী ভাস্কর ও পেন্টার।তাঁরই পরিচালনায় ভাস্কর শ্রী সুরজিৎ দাস মা কালী র মূর্তির ও শিব লিঙ্গ খোদাই করেন। ——— এ তথ্য কি ঐ পি আর ও র কাছ থেকেই পেয়েছো? উত্তরে সায় দিলাম। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। ডান দিকে মুখ ফেরাতে চোখে পড়ল দুরের “ডলফিন নোজ” এর অসংখ্য বাতির রোশনাই। সারে সারে জ্বলছে নানা রংএর বাতি। যেন জড়োয়া নেকলেস। পেছনেই ছিল মন্দাকিনী। মন্দাকিনীকে বললাম——- চেয়ে দেখ,তোমার ঐ ঝুঠো পাথরের নেকলেস এর থেকেও বেশি দামি মনে হচ্ছে না? আমার কথায় সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হল সেই তারার মালার দিকে। মন্দাকিনী বলল—–আমরা ওখানে যাব। মেশোমশায় বললেন—-দূর থেকে রামকৃষ্ণ বিচ কে ও সুন্দর লাগবে। তাই না কেষ্টা? বললাম——লাগবে তো।কৈলাশগিরির থেকে ভাইজ্যাগ শহর টাকে দেখলে মনে হবে আকাশ টা মাথার ওপরে নেই। নিচে নেমে এসেছে।ওপর থেকে রাস্তার গাড়ির লাইন দেখে মনে হবে লাল,সবুজ, হলুদের স্রোত চলেছে এঁকে বেঁকে। মন্দাকিনী বলল—মা সমুদ্রে নামব। মাসীমা বললেন–এত রাতে কেউ সমুদ্রে নামে? আমি বললাম—–কাল তো আমরা ঋষিকোন্ডা, বিমুনিপত্তনম যাব। তখন ই নামবে। সমুদ্রকে উপভোগ করার এখানে দারুণ ব্যবস্থা। কোষ্টাল ব্যাটারি থেকে বিমুনিপত্তনম অবধি পুরো বিচ্ রোড কাডাপ্পা স্ল্যাব ঢেলে বসার ব্যবস্থা।সবই টুরিস্ট দের জন্য। একদিকে অনন্ত সাগর আর অন্য দিকে পেল্লাই পেল্লাই এপার্টমেন্ট। মাসীমা বললেন—- এখানে বসে সমুদ্র দেখতে দারুণ। আমরা সবাই একে একে বসে পড়লাম মায়ের মন্দির মুখী হয়ে। মাঝে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলেছে এঁকে বেঁকে। হঠাৎই মাসীমার গলা কানে এল। আদুরে সুরে বলছেন মেশোমশায়কে——হ্যাঁ গো, এখানে একটা বাড়ি কিনে নাও না।নেবে? মাসীমার আদুরে মুখখানা দেখে আমার মনে হল আজ থেকে কুড়ি বছর পর মন্দাকিনী ও আমাকে এমন বলবে।ঠিক এমনই আদুরি ভাবে মন্দাকিনী মাঝে মাঝেই বলে।মনে হল মেয়েরা চাহিদা মেটাতে এই পদ্ধতিই ব্যবহার করে। আমি কুড়ি বছর পর কি করব তা বুঝতেই মেশোমশায়ের দিকে তাকালাম। যা বোঝার তা বুঝে গুটি গুটি সড়ে পড়লাম ওখান থেকে। মন্দাকিনী যে আমার পিছু নিয়েছে তা ওর গলার স্বরে বুঝলাম। ———– কৃষ্ণ দা,দাঁড়াও। ————- কি হল,,,চলে এলে? ———- আহা,তুমি যেন ন্যাকা।কিছুই বোঝ না। ———- বোঝাবুঝির কি আছে?ওসব তোমাদের ঘরের ব্যাপার। ———— ঠিক আছে বাবা। এই চল না সমুদ্রে নামি। ওর মুখের ভাব এখন একটু আগের দেখা মাসীমার আদুরে ভঙ্গিটা।। শক্ত হয়েই বললাম —– মায়ের কাছে শিখে নিলে তাই না?আমি তোমার বাবার মতো না। মুখে যাই বলি না কেন। মনে জানি আমি কি? কিন্তু আমাকে শক্ত হতেই হবে। ওর খিলখিলানো হাসি আমার কঠোরতাকে চূড়মার করে দিল। হাসি! না জল তরঙ্গ? ———- মশায়, আমাকে শিখতে হয় না। বুঝলে? মায়ের ই তো মেয়ে তাই ওটা জন্মগত। তুমি নরম কি শক্ত তা কিন্তু বাজি ধরো না।হেরে যাবে। বুঝলাম, ঐ মেয়ে আমাকে সমুদ্রে নামিয়ে ছাড়বে। তাই ওর মনকে ঘোরাতে বললাম। ———— এই আইসক্রিম খাবে? ওর ভাবে বুঝলাম, আমি যা ভেবেছি তা ঠিক। লাফিয়ে উঠল মন্দাকিনী। বলল——- তুমি না দারুণ! ভাবলাম এই মেয়েকে পোষ মানাতে বেশি বেগ পেতে হবে না। ভাবের ঘোরে চললাম” সুখ সাগর ” এর দিকে। চারটে পেস্তা কিসমিস দেওয়া আইসক্রিম নিলাম। এগুলাম মাসীমারা যেদিকে আছেন সেদিকেই। মেশোমশায় খুশি হয়ে বলেন। ———- দেখেছ মায়া,কেষ্টার কেমন বুদ্ধি।এ জায়গায় এমন করেই আনন্দ করতে হয়। আইসক্রিম খেতে খেতে মাসীমা বললেন। ——— কত বছর পর আইসক্রিম খেলাম! খুব স্বাদ যুক্ত। মেশোমশায় বললেন——-এবার ফেরার পালা। সমুদ্রের গর্জণে জেগে গেলাম। জেগে আটটা বেজে গেছে। বেশ কড়া রোদ উঠে গেছে। বেলা নয়টায় গাড়ি এসে যাবে। মাসীমার গলা কানে এল। ———- হ্যাঁগো, কেষ্টাকে ডাকো। কি ঘুমতে পারে ছেলেটা!আর মন্দা তোকে ও বলি— বেশি বাড়িস না। পই পই করে বারণ করেছি ঐ ছেলেটার সঙ্গে বেশি গা ঘেষাঘেষি করিস না। এবার মেশোমশায় বললেন—-,মন্দার মা,তোমাকে কতোবার বলেছি যে, সকালে উঠেই সবার পেছনে লেগো না। তাতে আমার দিন খারাপ যায়। আবার মাসীমার গলা——– তুমি ভাব আমি মেয়ের পেছনে লাগি?মেয়ে বড় হলে মায়ের কি অবস্থা।তা ছাড়া মেয়ে বড় হলে আর সঙ্গে একটা যোয়ান ছেলে থাকলে কি হয়!বেশ আমি কিছুই বলব না। দেওয়ালের এপার আর ও পার। সবই শুনতে পাচ্ছিলাম। কথা শুনতে শুনতে আমার তৈরি হবার গতিটা চরমে উঠেছিল। তাই পনের মিনিট এ তৈরি হয়ে নিলাম। মাসীমাকে দোষ দিই না।আমার একটা বোন থাকলে কি আমিও খুশি হতাম ওর ঐ গায়ে পড়া ভাব দেখে! আমার ই মত একটা বাউন্ডুল ছেলেকে পছন্দ করলে!কখন ও না।বরং ওর পিঠে দু,ঘা বসিয়ে দিতাম। ঘর থেকে বের হতে চোখাচোখি হল মাসীমার সাথে। আপন জনের মতোই হাসলাম। মায়ের কাজ মাসীমা করেছেন। তাই বলে কি তিনি শত্রু! হাসি হলো ছোঁয়াচে। তাই আমার হাসির বদলে মাসীমা ও হাসলেন। ——–তুমিও তৈরি? মাসীমা আর মেশোমশায় তৈরি হলেও মন্দাকিনীর এখনও পাত্তা নেই। মেশোমশায় বললেন —- ——দেখো মায়া, মন্দার দেরি হচ্ছে কেন? মেশোমশায়ের কথা শেষ হবার আগেই মন্দা এল। চেয়েই রইলাম। মাসীমার বলা “যোয়ান ছেলে” কথাটা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। দারুণ দেখাচ্ছে ওকে। সমঝে চলতে হবে। দুর্বল হয়ে লাভ নেই। কোথায় না কোথায় বিয়ে হবে তার ঠিক নেই! গাড়ি এসে দাঁড়াল।

বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 16

গাড়ি দাঁড়াল এসে।আমি হাত ব্যাগ আর টুকটাক ঝোলা ব্যাগ হাতে নিয়ে এগুলাম গাড়ির দিকে। আজকের গাড়ি টাটা স্যুমো।অবশ্য এত বড় গাড়ি আমাদের দরকার ছিল না।খুশি হলাম আরামে যাওয়া যাবে এই ভেবেই। মাসীমা বললেন। —- সবকিছু নিয়েছ? বললাম—হ্যাঁ মাসীমা। একে মসৃণ রাস্তা তায় নতুন গাড়ি। মনটা ফুর ফুর করে উড়ছে আমার। এ. সি .কার এর ঠান্ডা বিলি কাটছে শরীরে। মনটা খারাপ হয়ে গেল মন্দার জন্য। যে ভাবে মানুষ হয়েছে তাতে আমার সাথে গাঁট ছড়া বাঁধলে ওর কি এই সাচ্ছন্দ থাকবে?নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে রাগ হল। মন্দার তখন কষ্টের সীমা থাকবে না।কিন্তু আমার ও জেদের সীমা থাকা উচিত। আবার ভাবলাম, চাকরিটা ই বড় হল?ডক্টরেট করা ছেলে কি হেলা ফেলার?কটা লোকের ডক্টরেট করা জামাই জোটে? প্রফেসর ডঃ সোম বহুদিন বলেছেন একটা দরখাস্ত দিতে। কিন্তু কেন দেবে?একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্য নিজের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দেবে সে? মেশোমশায় বললেন—-কি হল কেষ্টা,চুপ চাপ কেন? বললাম—-আজ আকাশ টা পরিস্কার। তাই সমুদ্রের নীলের বাহার। আসমানের রং ও নীল। মন্দাকিনী বলল—তারমানে নীল সবুজের তালমেল। কাছের ঢেউ যেন কাঁচ কাটা সবুজ। আমি বললাম ঠিক বলেছ। আয়নার ধারের সবুজ। মন্দাকিনী বলল—-ঢেউ ভেঙ্গে যেন সাদা গোরের মালা,গড়িয়ে গড়িয়ে তীরে ভেসে আসছে। মাসীমা বললেন——মন্দাও যে কবিত্ব করছে!এবার পড়াশোনা শিকেয় তুলে কবিতা লেখ। কবি হলে তো চাকরি করা যায় না। প্রথম কথা মন্দাকে বললেও পরের ছত্র যে আমার দিকে ছোঁড়া তা বুঝলাম। তারমানে বোঝা গেল মেয়ের ভাবগতিক না বোঝার মত নিরেট মাসীমা নন।মেয়ের মন যে এই কন্দর্প কান্তি কেষ্টার প্রতি আকৃষ্ট তা জানেন বলেই কেষ্টার চাকরি না করায় কুপিতা। মনে হল মেশোমশায় মাসীমাকে কিছু বললেন। সে দিকে কান দিতেই মন্দাকিনীর গলা কানে এল। মা,বাবা অনেক খরচ করে আমাদের বেড়াতে এনেছে।সেই সময়টা অন্তত আনন্দ করতে দাও। শোন মেয়ের কথা।কে না করেছে আনন্দ করতে?– মাসীমা বললেন। মায়া, মেয়ে ঠিক ই বলেছে।সব ভুলে এখন আনন্দ কর। আর মেয়েকে যদি কবি বল তবে আমি খুশি হব। মনে আছে আমার কবিতার খাতা? মন্দাকিনীর উল্লসিত চিৎকারে পিছু ফিরলাম। —– বাবা!তুমি আমাকে দেখাওনি কেন? আরে বাবা, সে সব ছাইপাশ।কোথায় গেছে কে জানে? কথাটা বলতে বলতে মেশোমশায় মাসীমার দিকে চাইছিলেন। লোভ সামলাতে পারলাম না সেই মুখ দেখার। যাকে ভেবেই মেশোমশায় কবিতা লিখেছিলেন। মাসীমার মুখখানার হাসি বলছে তিনি মেয়ের আর তার বাপের ছলাকলার মজা লুটছেন। মা তুমি রেখেছ সেই খাতাটা! মাসীমা বললেন—–আলমারির লকারে আছে। এখন মাসীমার গালে লালের ছোঁওয়া। মেশোমশায় বললেন—-অ্যাঁ!!তুমি যত্ন করে রেখেছ? মেশোমশায়ের চেহারা ছবিই বলছে যে তিনি ধন্য। মন্দাকিনীর দৃষ্টি আমার দিকে। যা বোঝার তা বোঝা হল।তাই মুখ ফিরিয়ে নিলাম। সাব মেরিন এর কাছে গাড়ি দাঁড়াল। আমি বললাম——এশিয়া মহাদেশে এটাই প্রথম এবং বিশ্বে দ্বিতীয় ডুবো জাহাজ। এখন যেটাকে মিউজিয়ামে রুপাইত করা হয়েছে। মেশোমশায় বললেন—–বসে কেন? চল নামি।দেখে আসি ভেতর টা। আবার ও বললাম—–ইন্ডিয়ান নেভি আর এ.পি. ট্যুরিজম এর বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। “আই.এন. এস কারসারা” তৈরি হয়েছিল রাশিয়ায়, স্টিল বডি। একানব্বই মিটার লম্বা এই ডুবোজাহাজ। উনিশ শো উনসত্তর এর আঠেরই ডিসেম্বর সমুদ্রে ভেসেছিল। ইন্ডিয়ান নেভির ই.ন.স কারসারা ভারতের জলে এক নাগারে জুঝেছিল শত্রুর সঙ্গে। মেশোমশায় বললেন—–তুমি কি ইন্দো পাক যুদ্ধের কথা বলছ? হ্যাঁ। উনিশ শো একাত্তরের যুদ্ধে নক্ষত্রের মত সাগর জলে যুদ্ধ করেছিল এই ডুবোজাহাজ। সবই বললাম মেশোমশায়কে। সাব মেরিনে আর একবার ঢুকেছিলাম ।কিন্তু তার সাথে এর কোন মিল নেই। এটা পুরোপুরিই যুদ্ধ জাহাজ। ডিজাইন করেছে ন্যাশনাল শিপ ডিজাইন আর রিসার্চ সেন্টার। ইস্টার্ন নেভাল কমান্ড এর সঙ্গে যুক্ত হয়েই করেছে। ওয়ার মেমোরিয়াল হিসাবে রাখা হয়েছে। খরচ হয়েছিল তখন সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। মেশোমশায় বললেন—-বাব্বা! হ্যাঁ। একত্রিশ বছর দেশের জন্য খেটে আঠাশে ফেব্রুয়ারির দু হাজার শালে ল্যান্ড করেছে “ইনস কারসারা ” আর কে বিচ এ। মনে ভাবলাম এই বিশাল কায়া ধারি যান কি কষ্ট না করেছে!পেনশন ভোগ! সে তো আমাদের মত টুরিস্ট দের কুড়ি টাকা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। সেটা কি কারসারার পেনশন নয়? অস্ত্র সমেত পুরো জাহাজ টা সমুদ্র থেকে তটভূমিতে তুলে আনা হয়েছে।পাকাপোক্ত কংক্রিটের চত্বরেই রাখা হয়েছে।উদ্দেশ্য গৌরবময় সাব মেরিন এর ভেতরের অবস্থা ও নৌসেনাদের জীবন জনগণ কে বোঝান। কতো কষ্টের মধ্যে তাদের শত্রুর মুখোমুখি হতে হয়। সাবমেরিন ট্রেনিং স্কুলে শিক্ষা নিতে হয় তাদের। থিওরী, ও প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং নিতে হয়।আবার ড্যামেজ কন্ট্রোল, এমারজেন্সীতে কি করে পালাতে হয়।আর যুদ্ধ কৌশল। কি করে ‘ওয়েপন ফায়ারিং করতে হবে।সবই বললাম। মেশোমশায় বললেন—-বাব্বা।এত সব? বললাম——–প্রথমে সমুদ্র কে জানা।ছয় মাস পর অফিসার ও সেলর দের পরীক্ষা হয়।বিশ্ব বিখ্যাত “ডলফিন ব্যাজ ” পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। মন্দাকিনী হঠাৎই বলল—-সাতাত্তর জন অফিসারের এইটুকু শোবার জায়গা?কি করে হয়? আমি বললাম —— আট জন অফিসার আর উনসত্তর জন সেলর। এটা যুদ্ধ জাহাজ বুঝলে? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোয়।শুধু তাই নয়। দু টো মাত্র ওয়াশ বেসিন আর দুটো টয়লেট। এত গুলো মানুষের রান্নার কুক মাত্র দু’জন। মাসীমা বললেন——সে কি গো, কি করে করে? বললাম—–হ্যাঁ।রান্না ঘরের মাপ চার বাই ছয়। মাসীমা বললেন——- বোধহয় একটু একটু করে রাঁধে।সবার সময় কোথায় একসাথে খাবার!! বললাম—হয়তো তাই।ওদের কাজটাই হল সব সময় তৎপর হয়ে থাকা।তাছাড়া যন্ত্র পাতি, কামান, গোলা বারুদ, জীবন রক্ষাকারী সামগ্রীর সঙ্গে অফিসার আর সেলার দের থাকার সামান্য জায়গা।সেখানে সবার একসাথে খাবার কথা অবান্তর। জাহাজ এর ভেতর হাঁটতে হাঁটতে ওখান কার একজন কর্মীর সাথে আলাপ হল। তিনি আমাদের সব বুঝিয়ে দিলেন। কোথায় আছে নেভিগেশন লাইট, একঝ্স্ট পাইপ রেডিও, স্যাটেলাইট নেভিগেশন অ্যান্টেনা,নেভিগেশন পেরিস্কোপ, ব্রিজ উইন্ডোজ, আন্ডার ওয়াটার টেলিফোন অ্যান্টেনা। মন্দাকিনীর উৎসাহ দেখে ভদ্রলোক খুশি হয়ে বললেন, আরো আছে, দেখুন হাইপ্রেসার এয়ার স্টোরেজ ট্যাঙ্ক, টরপেডো লোডিং হ্যাচ, টরপেডো ফায়ার কন্টোলার। দু হাজার সাল থেকেই দেশের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। ভাবলাম, কারসারা দাঁড়িয়ে আছে তার অতীত দুঃখ, বেদনা,যুদ্ধ জয়ের আনন্দ ও গৌরব গাঁথা বহন করে। অনুপ্রাণিত হবে দেশের যুব গোষ্ঠী।নিজেকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে। দেশের জন্য যারা আত্ম ত্যাগ করেছেন তাঁরা কতটুকু পেয়েছেন? দিনে একবার ও কি আমরা তাঁদের কথা ভাবি? সাব মেরিন থেকে বেড়িয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম। সবাই স্তব্ধ। ঋষিকোন্ডার দিকে গাড়ি ছুটল। বাঁয়ে তাক লেগে যাবার মত ইমারত আর ডানে সুনীল সাগর।বাঁয়ে কৈলাশগিরিকে রেখে আমরা সোজা চললাম। মেশোমশায় বললেন——-দেখো মায়া, কি বিশাল বিচ।আমরা দেশে আছি না বিদেশে!কি বল কেষ্টা? বললাম——-বিমনিপত্তনম অবধি প্রায় তিরিশ কিলোমিটার সমুদ্র তট পাবেন। একদিকে পূর্ব ঘাট পর্বত মালা,অন্য দিকে বঙ্গোপসাগররের উপকূল। যে না দেখেছে বুঝবে না। মেশোমশায় বললেন—— এতোটা সমুদ্র তট রেখা? বললাম, কোষ্টাল ব্যাটারি র আগে ফিসিং হারবার থেকে রাস্তা এসেছে। মন্দাকিনী বলল—–রামকৃষ্ণ বিচ এ লেখা দেখলাম ” সুইমিং ইজ ডেঞ্জারাস ” লেখা। কে কার কথা শোনে!মাঝে মাঝেই দেহ ভেসে উঠছে।বোর্ড-এ লেখা থাকলেও তেলেগু তে লেখা থাকায় অনেকেই পড়তে পারে না। মাসীমা বললেন—– আমি বাবা চান করব না। পুরীতে যা ঝকমারি দেখলাম!ঢেউ ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল। মন্দাকিনী বলল, পড়বে না ।আমি ধরে রাখবো তোমাকে।তোমার জন্য চুড়িদার এনেছি। আমায় পাগল পেয়েছিস?যেমন তুই তেমন তোর বাবা। ——–আমি আবার কি করলাম?—-মেশোমশায় বলেন। সিমহাচলমে তুমি বলিনি ,কেষ্টার মত পাজামা আনলে ভাল হতো।বলো নি? মন্দাকিনী হাসতে শুরু করল। বলল——– বাবা!তুমি মাকে পাজামা পাঞ্জাবী পড়াতে চেয়েছিলে? নে আর হাসিস না।তোর মায়ের যেমন বুদ্ধি ,এক বললে আর এক বোঝে।মায়া, তুমি এমন হৈ চৈ করছ যেন কোনদিন পাজামা পড়নি।প্যান্ট তো পড়েছো। কি বলে রে তোর বাবা! মেশোমশায় হাসতে হাসতেই বললেন। মনে নেই!ফুন্টসেলিং বেড়াতে গিয়ে আমার প্যান্ট আর- – – — । মেশোমশায়ের কথা শেষ হতে পেল না।তার আগেই মন্দাকিনী হামলে পড়ল। মা,তুমি এত স্মার্ট ছিলে! তোর মা স্মার্ট!তাহলেই হয়েছে!খুব শীত ছিল। তাই আমার প্যান্ট আর সোয়েটার পড়ে ওপরে শাড়ি পড়েছিল। এবার মাসীমার গলায় কান্নার সুর। তোমার পেটে পেটে এই ছিল। ঠিক আছে আমি তোমার কবিতার খাতা কেষ্টাকে দেখাব। এবার মেশোমশায়ের জোকের মুখে নুন পড়া অবস্থা। মিঠে সুরে বললেন। ছিঃ ছিঃ। ওসব লেখা কি কারো কে দেখায়?তুমি বরং আগুনে দিয়ে দিও। আর তুমি যে আমাকে হাটের মাঝে অপমান করলে? মান অভিমানের পালায় আমি না থাকলেই হতো। তাই চুপ করে রইলাম। মেশোমশায় চাপা গলায় কি যেন বললেন। তবুও কানে এল। মনি,রাগ করোনা প্লীজ। বঝলাম লোক সমক্ষে মায়া হলেও মনি ডাকটা একেবারেই শয়নাগারের।সেই মোক্ষম অস্ত্র কাজে লাগালেন। মাসীমা গললেন না তাই মেশোমশায় অন্য চেষ্টা চালালেন। মেয়ের কাছেও ধরা পড়ে গেলেন। তা তাঁর কথাতেই প্রকাশ হয়ে গেল। তোর মা অনেক টা জায়গা নিয়ে বসে আছে, তাই ঠেললাম। ইস তোর মা একেবারে ঘেমে গেছে। এবার মাসীমা বললেন, তোমার আর চাটুকারিতা করতে হবে না। কোথায় চাটুকারিতা?ইস ঘেমে গেছ। প্রেসারের ওষুধ খেয়েছ? কান পেছন দিকে হলেও দৃষ্টি সাগরে,আর মন মন্দাকিনীতে।যে মেয়ে অমন টুস টাস করে আম খেতে পারে।পুরীর কথাই বা ভোলে কি করে! মেশোমশায়ের কথায় চিন্তা ছুটে গেল। কেষ্টা, তোমার গাইড বই কি বলে?চুপ করে কেন?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

2 thoughts on “বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী || Shipra Mukherjee”

  1. চোখের সামনে মনে হচ্ছে দৃশ্য গুলো ফুটে উঠছে, খুবই ভালো লাগলো দিদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *