Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সেদিন অপরাহ্নে যে স্ত্রীলোকটি বিরাজের শিয়রে বসিয়াছিল, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া বিরাজ জানিল, সে হুগলির হাসপাতালে আছে। দীর্ঘকাল বাত-শ্লেষ্মা বিকারের পর, যখন হইতে তাহার হুঁশ হইয়াছে, তখন হইতেই সে ধীরে ধীরে নিজের কথা স্মরণ করিবার চেষ্টা করিতেছিল। একে একে অনেক কথা মনেও পড়িয়াছে।

একদিন বর্ষার রাত্রে স্বামী তাহার সতীত্বের উপর কটাক্ষ করিয়াছিলেন। তাহার পীড়ায় জর্জর, উপবাসে অবসন্ন, ভগ্নদেহ, বিমল মন, সে নিদারুণ অপবাদ সহ্য করিতে পারে নাই। দুঃখে দুঃখে অনেকদিন হইতেই সে হয়ত পাগল হইয়া আসিতেছিল। সেদিন অভিমানে ঘৃণায় আর তাঁহার মুখ দেখিবে না বলিয়া, সমস্ত বাঁধন ভাঙ্গিয়া চুরিয়া ফেলিয়া নদীতে মরিতে গিয়াছিল—কিন্তু, মরে নাই।

তাহার পর জ্বর ও বিকারের ঝোঁকে বজরায় উঠিয়াছিল এবং অর্ধপথে নদীতে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া, সাঁতার দিয়া তীরে উঠিয়াছিল, ভিজা মাথায়, ভিজা কাপড়ে সারারাত্রি একাকী বসিয়া জ্বরে কাঁপিয়াছিল, শেষে কি করিয়া না জানি, এক গৃহস্থের দরজায় শুইয়া পড়িয়াছিল। এতটাই মনে পড়ে। কে এখানে আনিয়াছে, কবে আনিয়াছে, কতদিন এমন করিয়া পড়িয়া আছে—মনে পড়ে না। আর মনে পড়ে, সে গৃহত্যাগিনী কুলটা—পরপুরুষ আশ্রয় করিয়া গ্রামের বাহির হইয়াছিল।

ইহার পরে আর সে ভাবিতে পারিত না—ভাবিতে চাহিত না। তারপর ক্রমশঃ সারিয়া উঠিতে লাগিল, উঠিয়া বসিয়া একটু একটু করিয়া হাঁটিয়া বেড়াইতে লাগিল। কিন্তু ভবিষ্যতের দিক হইতে নিজের চিন্তাকে সে প্রাণপণে বিশ্লিষ্ট করিয়া রাখিল। সে যে কি ব্যাপার, তাহা তাহার প্রতি অণু-পরমাণু অহর্নিশ ভিতরে ভিতরে অনুভব করিতেছিল সত্য, কিন্তু যে যবনিকা ফেলা আছে তাহার এতটুকু কোণ তুলিয়া দেখিতেও ভয়ে তাহার সর্বাঙ্গ হিম হইয়া যাইত, মাথা ঝিমঝিম করিয়া মূর্ছার মত বোধ হইত। একদিন অগ্রহায়ণের প্রভাতে সেই স্ত্রীলোকটি আসিয়া তাহাকে কহিল, এখন সে ভাল হইয়াছে। এইবার তাহাকে অন্যত্র যাইতে হইবে। বিরাজ ‘আচ্ছা’ বলিয়া চুপ করিয়া রইল। সে স্ত্রীলোকটি হাসপাতালের লোক। সে বুঝিয়াছিল, এ পীড়িতার আত্মীয়-স্বজন সম্ভবতঃ কেহ নাই, কহিল, রাগ করো না বাছা, কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, যাঁরা তোমাকে রেখে গিয়েছিলেন তাঁরা আর কোনদিন ত দেখতে এলেন না, তাঁরা কি তোমার আপনার লোক নয়?

বিরাজ বলিল, না, তাঁদের কখনও চোখে দেখিনি। একদিন বর্ষার রাত্রে আমি ত্রিবেণীর কাছে জলে ডুবে যাই। তাঁরা বোধ করি দয়া করে এখানে রেখে গিয়েছিলেন।

ওঃ, জলে ডুবেছিলে? তোমার বাড়ি কোথা গা?

বিরাজ মামার বাড়ির নাম করিয়া বলিল, আমি সেখানেই যাব, সেখানে আমার আপনার লোক আছে।

স্ত্রীলোকটির বয়স হইয়াছিল এবং বিরাজের মধুর স্বভাবের গুণে একটু মমতাও জন্মিয়াছিল, দয়ার্দ্র-কণ্ঠে বলিল, তাই যাও বাছা, একটু সাবধানে থেকো, দুদিনেই ভাল হয়ে যাবে।

বিরাজ একটুখানি হাসিয়া বলিল, আর ভাল কি হবে মা? এ চোখও ভাল হবে না, এ হাতও সারবে না।

রোগের পর তাহার বাঁ চোখ অন্ধ এবং বাঁ হাত পড়িয়া গিয়াছিল। স্ত্রীলোকটির চোখ ছলছল করিয়া উঠিল, কহিল, বলা যায় না বাছা, সেরে যেতেও পারে।
পরদিন সে নিজের একখানি পুরাতন শীতবস্ত্র এবং কিছু পাথেয় দিয়া গেল, বিরাজ তাহা গ্রহণ করিয়া নমস্কার করিয়া বাহির হইয়া যাইতেছিল, সহসা ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আমি নিজের মুখখানা একবার দেখব—একটা আরশি যদি—

আছে বৈ কি, এখনই এনে দিচ্ছি, বলিয়া অনতিকাল পরে ফিরিয়া আসিয়া একখানি দর্পণ বিরাজের হাতে দিয়া অন্যত্র চলিয়া গেল। বিরাজ আর একবার তাহার লোহার খাটের উপর ফিরিয়া গিয়া আরশি খুলিয়া বসিল। প্রতিবিম্বটার দিকে চাহিবামাত্রই একটা অপরিমেয় ঘৃণায় তাহার মুখ আপনি বিমুখ হইয়া গেল। দর্পণটা ফেলিয়া দিয়া সে বিছানায় মুখ ঢাকিয়া গভীর আর্তকণ্ঠে কাঁদিয়া উঠিল। মাথা মুণ্ডিত—তাহার সেই আকাশভরা মেঘের মত কাল চুল কৈ? সমস্ত মুখ এমন করিয়া কে ক্ষতবিক্ষত করিয়া দিল? সেই পদ্মপলাশ চক্ষু কোথায় গেল? অমন অতুলনীয় কাঁচা সোনার মত বর্ণ কে হরণ করিল? ভগবান! এ কি গুরুদণ্ড করিয়াছ! যদি কখন দেখা হয়, এ মুখ সে কেমন করিয়া বাহির করিবে! যতদিন এ দেহে প্রাণ থাকে, ততদিন আশা একেবারে নির্মূল হইয়া মরে না। তাই, তাহারও হয়ত অতি ক্ষীণ একটু আশা অন্তঃসলিলার মত নিভৃত অন্তস্তলে তখনও বহিতেছিল। দয়াময়! সেটুকু শুকাইয়া দিয়া তোমার কি লাভ হইল!

তাহার জ্ঞান ফিরিয়া আসিবার পরে রোগশয্যায় শুইয়া স্বামীর মুখ যখন উজ্জ্বল হইয়া দেখা দিত, তখন কখনও বা সহসা মনে হইত, যাহা সে করিয়াছে, সে ত অজ্ঞান হইয়াই করিয়াছে, তবে কি সে অপরাধের ক্ষমা হয় না? সব পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত আছে, শুধু কি ইহার নাই? অন্তর্যামী ত জানেন, যথার্থ পাপ সে করে নাই, তথাপি যেটুকুও হইয়াছে, সেটুকুও কি তাহার এতদিনের স্বামী-সেবায় মুছিবে না? মাঝে মাঝে বলিত, তাঁর মনে ত রাগ থাকে না, যদি হঠাৎ গিয়া পায়ের উপর পড়ি, সব কথা খুলে বলি, আমার মুখের পানে চেয়ে কি করেন তা হলে? তাহা হইলে সম্ভবত কি যে করেন, কল্পনাটাকে সে যে কত রঙে, কতভাবে ফুটাইয়া দেখিবার জন্য সারারাত্রি জাগিয়া কাটাইত, ঘুম পাইলে উঠিয়া গিয়া চোখেমুখে জল দিয়া আবার নূতন করিয়া ভাবিতে বসিত—হা ভগবান! তাহার সেই বিচিত্র ছবিটাকে কেন এমন করিয়া দুই পায়ে মাড়াইয়া গুঁড়াইয়া দিলে! সে তাহার স্বামীর পায়ের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া কোন্ লজ্জায় আর এ-মুখ তুলিয়া তাঁহার মুখের পানে চাহিবে!

ঘরে আর একজন রোগিণী ছিল, সে বিরাজের কান্না দেখিয়া উঠিয়া আসিয়া বিস্ময়ের স্বরে প্রশ্ন করিল, কি হল গা? কেন কাঁদচ?

সে বিরাজের কান্নার হেতু জানিতে চায়!

বিরাজ তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া বসিল এবং কোনদিকে না চাহিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।

সেইদিন লোকপরিপূর্ণ শব্দমুখর রাজপথের এক প্রান্ত বাহিয়া যখন সে তাহার অনভ্যস্ত ক্লান্ত চরণ দুটিকে সারাজীবনের অনুদ্দিষ্ট যাত্রায় প্রথম পরিচালিত করিল, তখন বুক চিরিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস বাহির হইয়া আসিল। সে মনে মনে বলিল, ভগবান! হয়ত ভালই করিয়াছ। আর কেহ চাহিয়া দেখিবে না—এই মুখ, এই চোখ, হয়ত এই যাত্রারই উপযুক্ত। গ্রামের লোক জানিয়াছে, সে গৃহত্যাগিনী কুলটা। তাই, যে মুখ তুলিয়া তাহার গ্রামের মুখ, তাহার স্বামীর মুখ দেখা নিষিদ্ধ হইয়া গিয়াছে, সে মুখ হয়ত এমন হওয়াই তোমার মঙ্গলের বিধান! বিরাজ পথ চলিতে লাগিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress