Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিবেক যদি দেখা দেয় || Shibram Chakraborty

বিবেক যদি দেখা দেয় || Shibram Chakraborty

বিবেক যদি দেখা দেয়

সকাল থেকেই মনটা খিঁচড়ে ছিল।

মুখ-হাত ধুয়ে সবেমাত্র বারান্দায় বেরিয়েছি—প্রাতঃকালীন বায়ু সেবনের মতলবেই, এমন সময়ে নীচের রাস্তা থেকে আকস্মিক আর্তনাদ—এক ভিখিরির!

‘দু-দিন থেকে কিছু খাইনি বাবু!’

ভিখিরি আর ভিখিরি! সারা পৃথিবী যেন ভিখিরিতেই ছেয়ে গেছে। আর এই বাড়ির রাস্তা দিয়েই যত তাদের শোভাযাত্রা!

আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে আমার।

‘যাও যাও! কিছু হবে না। আমিও খেতে পাইনি চার দিন থেকে—তা জান?’

চলে যায় বেচারা।

কিন্তু তারপর থেকেই আমার মনটা যেন আধমরা হয়ে আছে। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না। ভিখিরিটাকে—? যাকগে!—অত আর ভেবে পারা যায় না!

সকালে কাগজ আসে। খবরগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে যাই—

জেনারেল ফ্রাঙ্কোর শিশু-বৃদ্ধ-নির্বিচারে নিরীহ নরনারীর ওপর বোমাবর্ষণ! প্যালেস্টাইনকে দ্বিধাবিভক্ত করার দুরভিসন্ধি ইংরেজের। অ্যাবিসিনিয়ায় মুসোলিনির মারপ্যাচ! জু-দের ওপর হিটলারি হুমকি! চিনের বিরুদ্ধে জাপানের যুদ্ধযাত্রা!

এতক্ষণে মনের খচখচানি অনেকটা কমে আসে—স্বচ্ছন্দ বোধ করতে থাকি। খবরের কাগজ তুলে এবার স্বদেশের দিকে দৃষ্টি দিই—

না খেতে পেয়ে আত্মহত্যা করেছে পাঁচ জন, চাকরি না পেয়ে জন চারেক। একটা মেয়ে পুড়ে মরেছে, কেন কে জানে। কোন জমিদার কোথায় অত্যাচার করেছে প্রজাদের ওপর। পুলিশের লাঠি চলেছে কোথায়! একটা ছেলে চাকরি খুইয়ে কোন আপিসের বড়োসাহেবের কাছে দরবার করতে গেছল, দর বাড়াতে না পেরে নামঞ্জুর হয়ে সেই আপিসেরই চারতলা থেকে পড়ে মাথার খুলি চুরমার করেছে।

—ক্রমশ মনটা হালকা হতে থাকে।

আদালতের রিপোর্ট থেকে জানা গেল, কে নাকি কংগ্রেসের কাজে সর্বস্বান্ত হয়ে, নিজের দেওয়ানি মোকদ্দমার ব্রিফ দিতে গেছল কংগ্রেসের নেতা এক ব্যারিস্টারকে, তিনি বিনা ফিসে ব্রিফ নিতে অস্বীকৃত হওয়ায়, সেমোকদ্দমায় হেরে গিয়ে অপর পক্ষের উলটো চাপে পড়েছে। বেচারা এখন জেলে—এই তৃতীয় বার, কিন্তু সিভিল ডিসওবিডিয়েন্সের ফলে নয় এবার। তারই অপর পৃষ্ঠায় সেই কংগ্রেসি নেতার অ্যালবার্ট হলের বক্তৃতার রিপোর্ট—লম্বা-চওড়া, প্রায় দু-কলমব্যাপী!

আনন্দের আতিশয্যে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে ফেলি—!

বিনা বিচারে এবং বিনা প্রমাণে যাদের বন্দি করে রাখা হয়েছে প্রায় বছর সাতেক ধরে—তাদের নাকি অন্তত আরও সাত বছর থাকতে হবে; আরও সাত বছর কী সত্তর বছর তা অবশ্য এখনও স্থির হয়নি এবং এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না; প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রাক্কালে ভোটদাতাদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কিছুই নাকি একালে আর তিনি রাখছেন না—ইত্যাদি।

এতক্ষণে আমার উৎসাহ একেবারে চরমে ওঠে। পুলকের মাথায় বলেই ফেলি,—‘আমার সবচেয়ে বড়ো শত্রুও যদি আসে আমার সামনে এখন, তাকেও আমি মার্জনা করে দেব। হ্যাঁ—এক্ষুনিই।’

সেই মুহূর্তেই দরজা ঠেলে একজন ঢোকে আমার ঘরে। এক খর্বাকৃতি বামন দেড় হাত তার উচ্চতা। পোশাক-পরিচ্ছদ যদ্দূর নোংরা হতে হয়। বয়েস আন্দাজ করার উপায় নেই—পঁচিশও হতে পারে, পঞ্চাশও; ঠিক করে কিছুই বলা যায় না। কেবল খর্ব হয়েই উনি ক্ষান্ত হননি—একাধারে বামন এবং অষ্টাবক্র। কোনো অঙ্গের সঙ্গে কোনো অঙ্গের মিল নেই—প্রত্যেক প্রত্যঙ্গই বিসদৃশ।

একেবারে পরিচিতের মতো এসে সেঘরে ঢোকে। জুতোর বাক্সটাকে চেয়ার করে বসে আমার সামনেই।

অবাক কান্ড! চিনি না তো একে! অথচ চেনা চেনা বোধ হচ্ছে যেন, খুব ভালো করে লক্ষ করলে মনে হয়, হয়তো আয়নার মধ্যেই কখনো দেখে থাকব একে! আকার-প্রকার অনেকটা আমার সঙ্গেই খাপ খায়—অষ্টাবক্রতা বাদ দিলে হুবহু আমারই পকেট এডিশন! আমার প্যারোডি যেন!

আমার জানা নেই, অথচ আমারই কোনো যমজ ভাই নয় তো? বহুকালের হারিয়ে-যাওয়া?

যমই হোক আর যমজই হোক, এমন অনাহূত আবির্ভাব আমি আদপেই পছন্দ করি না। রুক্ষকন্ঠেই বলি—‘কে বাপু তুমি? একটু আগেই একজনকে তাড়িয়েছি, আবার—’

‘হ্যাঁ, জানি জানি—আর বলতে হবে না। আজ সকালেই এক ভিখিরিকে তুমি দরজা থেকে তাড়িয়েছ।’

‘তাড়িয়েছি বেশ করেছি—তোমার কী তাতে?’

‘বেচারা খায়নি দু-দিন থেকে!’

‘না খেয়ে আমার মাথা কিনেছে আর কী!’

‘আমার তাতে কিছু ক্ষতি হয়েছে বলেই বলছি। তোমার ব্যবহারে তোমার আর কী হয়, আমার গায়েই তো আঘাত লাগে। ভিখিরিকে দূর করে কী করেছ দ্যাখো—এইখানটা কুঁচকে গেছে আমার। এইমাত্রই।’

একটা প্রত্যঙ্গ সেপ্রদর্শন করে।

‘চিরদিন আমি এমনি ছিলাম না—এমনি দুমড়ানো, ত্যাবড়ানো, অদ্ভুত, কুশ্রী, কদাকার। আমার বক্রতার খর্বতার জন্য তুমিই দায়ী।’

আমি অবাক হয়ে যাই। বলে কী এ?

অভিযোগের ফিরিস্তি শুনে যাই, বিস্ময়াভিভূত হয়েই শুনি, আমার ক্ষুদ্রকায় ‘ক্যারিকেচার’ আমারই মুখের উপর আমার কেচ্ছা একটার পর একটা উদগীর্ণ করে চলে।

ছোটোবেলা থেকে আজ পর্যন্ত আমার আগাগোড়া ইতিহাস! কবে একটা টিকটিকির (পুলিশের গোয়েন্দা নয়!) ল্যাজ ছিঁড়েছিলাম; ইঁদুরের গলায় দড়ি বেঁধে সবেগে ঘুরিয়েছি; কবে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিলাম এক ক্লাসফ্রেণ্ডকে (ক্লাসফ্রেণ্ড কি ক্লাস-ফো সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে এখন!); হাসপাতাল থেকে কবে এক কাচের পিচকিরি চুরি করেছি; পরীক্ষার খাতার নম্বর পরীক্ষকের অজ্ঞাতসারে, সাত থেকে সাতাত্তরে পরিণত করেছি নিজের সৌজন্যে; কোন দিন কাকে ধাপ্পা দিয়েছি, ঠকিয়েছি, গালমন্দ করেছি—তারই এক সুদীর্ঘ তালিকা।

কতক্ষণ আর স্তম্ভিত হয়ে নিজের নিন্দায় কর্ণপাত করা যায়? আমি উসকে উঠি—‘ঢের হয়েছে! তুমি থামো। এসব নিয়ে আমি নিজেই কতদিন মাথা ঘামিয়েছি, ঘুম পায়নি কত রাত্রে, দুঃখ পেয়েছি কত দুঃসময়ে। নিজেই আমি জানি, তোমাকে আর মনে করিয়ে দিতে হবে না।’

‘তোমাকে মনে করিয়ে দেওয়াই তো কাজ আমার!’

‘আমার মনের খবর তুমি জানলে কী করে হে?’

‘কেন, আমিই তো জানব!’

‘তুমিই জানবে! বটে! কে তুমি শুনি? সাক্ষাৎ পির নাকি!’

‘না।’

‘হলেও আমার কিছু আসত-যেত না; আমি মুসলমান নই।’

‘তবে কী তুমি? ভূত-প্রেত?’

‘উঁহুঁ।’

‘গনতকার টনতকার?’

‘আমি তোমার বিবেক।’

বিবেক! আমি চমকে উঠি।

যিশুখ্রিস্ট মারা যাবার উনিশ শো সাইত্রিশ বছর পরে—এখনও ধরাতলে বিবেকের অস্তিত্ব রয়েছে নাকি? হয়তো পড়ে থাকতে পারে একটুকরো কাঁটার মতো বোকাসোকা কোনো মানুষের মনের কোণে-টোনে কোথাও—দেখা যায় কি যায় না—কখনো-সখনো অকারণে এক-আধটু খচখচ করাই হল ওর কাজ—তা, না, জলজ্যান্ত একেবারে কিনা চোখের সামনে! কই বাপু, এতক্ষণ এই খবরের কাগজ এত ঘেঁটেও তো কোথাও সন্ধান পাইনি তোমার—পৃথিবীর কোনো অংশ-প্রত্যংশেই ঘুণাক্ষরেও তোমার সংবাদ ছিল না!—

আমার সমস্যাটাই সংক্ষেপ করে প্রশ্নরূপে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছি, সেবলে ওঠে, ‘বুঝেছি কী বলতে চাও। আমি মারা যাইনি এখনও, যেতে পারিনে। আমাকে মেরে ফেলা সহজ নয় অত। তবে অদৃশ্য থাকাই আমার স্বভাব। তুমি এইমাত্র তোমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো শত্রুকে দেখতে চেয়েছিলে—তাই আমি তোমার সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছি।’

‘ও!’ এতক্ষণে এই প্রাদুর্ভাবের রহস্য প্রাঞ্জল হয় আমার কাছে।

‘এবং মার্জনা করতেও চেয়েছিলে। দেখচ তো, অনেক দিন থেকেই আমি অত্যন্ত মলিন হয়ে আছি! ময়লা জমেছে সর্বাঙ্গে। মার্জিত হওয়াও আমার দরকার।’

‘ময়লা জমেছে সেকি আমার দোষে?’

‘নিশ্চয়ই! এক-একজনের বিবেক দেখবে কেমন ঝকঝক করছে। তাদের সাফ বিবেক—দিন রাত তারা পরিষ্কার রাখে।’

‘তোমাকে পরিষ্কার করার দায় পড়েছে আমার! লোকের কাছে নিজের বিবেক বলে তোমার পরিচয় দিতেও লজ্জা করে। কুঁজো নুলো, খোঁড়া, কালো, বেঁটে, কদাকার তুমি!’

‘তার জন্য কে দায়ী? তুমিই তো!’

‘আমি!’ হতবাক হতে হয়। ‘তোমার চেহারার মালিক আমি নই। আমি তোমায় তৈরি করিনি। খোদাকে দোষ দিতে পারো।’

‘হ্যাঁ, তুমিই তো করেছ। যখন তুমি আট-ন বছরের, তখন আমি ছিলুম পাঁচ হাত লম্বা—দেখতে ঠিক ছবির মতো। এখন এই দেড় হাতে আর এই বিটকেল চেহারায় এসে দাঁড়িয়েছি।’

‘ছেলেবেলাতেই মারা যাওয়া উচিত ছিল তোমার! আমিও বঁাচতুম তাহলে।’

‘আমি মারা গেলে তোমাকে এত মনঃকষ্ট দেবে কে? আমি কষ্ট করেও বেঁচে থাকি—তোমার মনকে বঁাচিয়ে রাখবার জন্যে।’

‘কৃতার্থ করো! বাধিত করো আমায়!’ বিরক্তি দমন করা শক্ত হয় আমার পক্ষে।

বলেই চলে সে—‘এক সময়ে তোমার বিবেক খুব প্রকান্ড ছিল এবং আমি খুব সুখী ছিলাম তোমাকে নিয়ে। কিন্তু ক্রমশই তুমি কেমন বদলে যেতে লাগলে—’

‘হয়েছে হয়েছে! আর শুনতে চাই না।’ আমি বাধা দিই। ‘একটু আগেই একচোট আত্মজীবনী শুনেছি, আর না।’ আমার তরফের অভিযোগ আমি ব্যক্ত করি অবশেষে,—‘কিন্তু তোমারও এ কেমনধারা ব্যবহার আমি জানতে চাই।’

‘কীরকম?’

‘সবসময় সব তাতেই তুমি আমাকে মনঃপীড়া দাও। তোমার কোনো প্রিন্সিপলই নেই। ধরো, আমি ওই ভিখিরিটাকে তাড়িয়ে দিয়েছি—তার জন্যে সারা সকালটাই তুমি আমার মনটাকে তেতো করে রাখলে। কিন্তু আমি ভিখিরিকে খাইয়েও দেখেছি, তাতেও তুমি সন্তুষ্ট নও। দিন চার আগেই তো একজনকে আমি ভরপেট খাইয়েছি, অমনি তুমি বলে উঠেছিলে—‘না হে, এ ভালো করছ না! এইভাবে কুঁড়েমির প্রশ্রয় দিচ্ছ। অমনি পেলে আর কোনোদিন কি ও খেটে খাবে? ওর পরকাল ঝরঝরে করে দিচ্ছ! তোমার প্ররোচনায় খাইয়েও মনে শান্তি পেলাম না।’

‘তারপর—?’

দম নেবার জন্য থামি!

বিবেক একটু মুচকি হাসে—‘বলে যাও, বলে যাও।’

‘তারপর পরশুদিন আরেকটা ভিখিরিকে আমি তাড়াইওনি খাওয়াইওনি। স্পষ্টই বলে দিয়েছি যে আদর্শ নাগরিক হতে হলে, অমন করে থাকা চলবে না। তোমার আখেরে ক্ষতি হবে, এই জন্যই তোমাকে খেতে দেব না। তখন তোমার ব্যবহারটা কীরূপ হয়েছিল, শুনি? তুমি কী বলেছিলে আমায় মনে মনে? মনে পড়ে? বলেছিলে, ‘‘অমন স্পষ্ট করে, রূঢ কথাটা না বললেই কি চলত না? খাবার না পাক, দুটো মিষ্টি কথাই শুনে যেত নাহয়।’’ এবং এই নিয়ে ভেবে ভেবে সমস্ত দিনভর কী কষ্টটাই-না গেছে আমার! তারপর আজ—‘‘আজকের কথা আর বলতে চাই না!’’

মৃদু মধুর হাস্য করে আগন্তুক বলে, ‘আমার স্বভাবই ওই। সব বিষয়ে, সব ব্যাপারে, সব সময়ে তোমাকে সজাগ রাখা। তোমাতে আর একটা গাধায় এইখানেই তো তফাত। তোমার তবু একটুখানি বিবেক এখনও রয়ে গেছে, গাধার একেবারেই নেই—কোনো কালেই ছিল না।’

‘একটা গাধার বোঝার চেয়ে তুমি কিছু কম হালকা নও!’ আমি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি—‘তোমার বোঝা বইতে আর রাজি নই আমি। তোমার দুর্ব্যবহারে অনেক দিন থেকেই আমি চটেছি। এতকাল ধরে, ঘা মেরে মেরে তোমাকে এখনও যে কেন এতটুকু একটা লাট্টুতে পরিণত করতে পারিনি, এই আমার আফশোস। ভদ্রসমাজে বসবাসের যোগ্য তুমি নও। তোমাকে একটা হোমিওপ্যাথিক পিল বানিয়ে কোনো গাধার পেটে পাঠাতে পারলেই আমার শান্তি হত!’

‘আহা, চটছ কেন? অত ক্রোধ কীসের?’

‘এতদিন কী ক্ষতি করেছ আমার, জান তুমি? তোমার জন্যই আমি কিছু হতে পারিনি, কিছু করে উঠতে পারলাম না। সব তাতেই তোমার বাধা, কেবলই বাধা। সবসময়েই। এগোতেও বাধা, পেছোতেও বাধা! এবার আমায় রেহাই দাও।’

‘উঁহুঁহু।’ বিবেক আবার ঘাড় নাড়েন।

‘তুমি যদি এখনও আমাকে পরিত্যাগ কর তাহলে এখনই আমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়! যাদের তুমি ছোটোবেলাতেই ছেড়ে গেছ তারাই আজ দশজনের মধ্যে একজন—ভাগ্যবান, ধনবান, কীত্তিমান! তারাই খোলার বাড়ি থেকে গোলাবাড়ি করেছে; ফুটপাথ থেকে মন্ত্রীর মসনদে গিয়ে বসেছে! তুমি তাল থেকে তিলে না দাঁড়ালে কারও তিল থেকে তালে পরিণত হবার আশা নেই। তুমিই মানুষের অবনতির মূল—তুমি থাকতে উন্নতি নেই কারও। তোমারও তো বিবেক আছে—তুমি নিজেই তো বিবেক—বলো-না ঠিক কথা বলছি কি না?’

‘কী জানি! হয়তো ঠিক বলছ, হয়তো ঠিক বলছ না!’ দুষ্টুমি ভরা দৃষ্টিতে সেদৃকপাত করে।

‘তাহলে দয়া করো! চলে যাও আমার কাছ থেকে। আজ সকালের সেই ভিখিরির মতো। চিরদিনের জন্য চলে যাও, কখনো আর কোনো অজুহাতেই ফিরে এসো না। তোমাকে আমার দরকার নেই। এখনও তো সবে আমি কলেজের ছাত্র, অনন্ত সম্ভাবনা আমার সম্মুখে, কত কীই-না হতে পারি আমি। নাম-করা উকিল হতে পারি, ডাক্তার হতে পারি, আদালতের সেরা ব্যারিস্টার হতে পারি। অন্তত একটা অপরাজেয় কথাশিল্পী হওয়াও অসম্ভব না হতে পারে আমার পক্ষে। আজকের খবরের কাগজ থেকে বিস্তর আশ্বাস আমি পেয়েছি। হয়তো আমার কোনো ডিকটেটার হওয়াও সম্ভব। আর কিছু না হতে পারি, নিদেন প্রধানমন্ত্রী তো হতে পারব না, যদি তুমি আমাকে ছেড়ে না যাও!’

দীর্ঘ বক্তৃতার শেষে দাঁড়ি টানি; বেদম হয়ে থামতে হয়। বিবেক কেবল মাথা নাড়ে—‘উঁহুঁহু। তোমাকে ছেড়ে থাকা কি পোষায় আমার?’ ঠোঁট বঁাকিয়ে সেবলে, ‘আমার উপর যতই অত্যাচার কর আর অনাচার কর—তোমাকে ছেড়ে যাব না। আমি যে তোমারই।’

তারপরেই দারুণ দীর্ঘনিশ্বাস এবং সঙ্গে সঙ্গেই এক হৃদয়ভেদী কটাক্ষ!

‘তবে রে—’ বলে, আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি জুতোর বাক্সের ওপর, দু-হাতের মুঠোয় ওর গলা টিপে ধরি। ‘এইখানেই শেষ আজ। হত্যাই করব তোমায়!’

ও কামড়ে দেয় আমার হাতে। ‘উঃ!’ চেঁচিয়ে উঠি আমি। উচ্ছ্বসিত বীররস বিগলিত করুণ রস হয়ে আসে।

সেই ফাঁকেই সেহাত ছাড়িয়ে একেবারে দরজার কাছে। দেহকে বহিষ্কৃত করে শুধু মুখ বাড়িয়ে বলে—‘তুমি বড়ো সুবিধের নও তো হে! এবার থেকে অদৃশ্য হয়েই থাকতে হবে দেখছি।’

‘তাহলে তুমি আর আমায় নিষ্কৃতি দিলে না! ডিকটেটার কি কথাশিল্পী হওয়া স্বপ্নই থেকে গেল তবে আমার!’ নিজের কন্ঠস্বর নিজের কাছেই কাহিল শোনায় নিতান্ত।

‘যতদিন আমার কামড়ের জ্বালা টের পাবে ততদিন তো না!’ এই বলে বিবেক অন্তর্হিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী ইত্যাদি হওয়া আর সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। তখন থেকে বিবেকের দংশন-জ্বালাই অনুভব করছি—দিনরাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *