বিবাহ বন্ধন
কথায় বলে বিবাহ বন্ধন,বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ। বিবাহকে বন্ধন বলা হয়েছে। কিন্তু এই বন্ধন একপেশে। বন্ধনটা স্ত্রীর বেলায় প্রযোজ্য। পুরুষ একেবারে মুক্ত। মনুস্মৃতি পড়লেই বোঝা যায় নারীকে সমাজের অবহেলিত প্রাণীদের আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। নারীকে অবিশ্বাসীনি আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।কিন্তু গৃহকোণেও পড়ে থাকলেও স্বামী দুঃচরিত্র,কালো কুৎসিত হলেও নারী তাঁকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করতে বাধ্য ছিল।
আসাম,বিহার, ওড়িশায় ও অন্ধ্র প্রদেশের বিশাখাপত্তনমে ঘুরে এসে আমার মনে হয়েছে যে ভাষার ভেদাভেদে কিন্তু পুরুষের আধিপত্যের কোন হেরফের হয়নি। স্বামী যতো টা অধিকারের ধ্বজা তুলেছেন ,স্ত্রীর অধিকার বোধটা কিন্তু ‘বেসিক হিউম্যান নিড’ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। পুরুষের অধিকারের গরব, মানে তার একটি স্ত্রী ধন আছে। ঠিক যেমনটা ভূসম্পত্তির মালিক তাঁর সম্পত্তির গর্বে গর্বিত হন।কারণ সম্পত্তিটা এজমালির নয় বলে। সেই সম্পত্তিটা জমি হলে ,দেখভালের দরকার নেই। ভরুক সে জমি আগাছায়। আর পুকুর হলে, চলুক সে পুকুরে একই সাথে শৌচকর্ম–স্নান-পান।দেব-দেবীর ও সেই জলে চলুক পূজা।ভূস্বামী নামে মাত্রই ভূস্বামী। সেই ভূস্বামী আবার লেঠেল দিয়ে পরের জমি করায়ত্ত করেছেন। সেই ভাবে ই বিবাহ করে নামামাত্রই স্বামী হতেন।আবার অনেক সময় “ভাত দেবার ভাতার নয় কিল মারার গোঁসাই” হয়েছেন। শুধু মাত্র গরিবের ঘরের স্ত্রী যে, স্বামী-সন্তানের খাবার জোগাড় করতে ঘর থেকে বেরিয়েছে তাই নয়,বড় ঘরে ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুরুষ স্ত্রী কে উপঢৌকন দিয়ে ওপরওলা কে তুষ্ট করে মোটা টাকার লালসা মিটিয়েছেন। এখানে ও স্ত্রী মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে।কারণ কিল মারার গোঁসাইএর মাসলের জোর অনেক বেশি। গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হয়ে ও বেশির ভাগ ঘরে শায়ত্বশাসন চলে। জজের বিচারে উকিলের সওয়াল জবাবের সুযোগ থাকে। সরকারি উকিল আর বিরোধী উকিলের সওয়াল জবাবে,যে বেশি বিচক্ষণ ও যে বেশি নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয় তাঁর ওপর ই জজের মত নির্ভর করে। ঘরের মালিক বলে, তুমি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক তাই সয়ংক্রিয় ভোট চলতে পারে কিন্তু ঘরে “নৈব নেব চ”। রবিঠাকুর বলেছেন, “বিশ্বে যা কিছু মহান, যা কিছু সুন্দর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর”। সৃষ্টি র আদিতে নারী ও পুরুষ সমানভাবে আলোকিত। দেব-দেবীর দিক থেকে দেখি মাতৃরূপের প্রাধান্য।দেবী দুর্গা জগতের অসুর দলনী রূপে দেখা দেন। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন,”বন্দেমাতরম্, সুজলম্, সুফলম্, মলয়জ শীতলম্, “। যে ভূমির ওপরে আমরা রয়েছি তাঁকে আমরা মাতৃরূপে ই দেখি এই মায়ের রূপ কিন্তু খর্গ ধারিনী মা কালীর নয়।এই মায়ের রূপ সর্বংসহা। এই ধরিত্রীতে কতো সন্তানের রক্ত ক্ষরণ হয়েছে তার হিসেব নেই। বসুধা সর্বংসহা হয়ে সহ্য করে যাচ্ছেন। পুরুষের কাছে এই সমাজের নারীর “ইমেজ” সর্বংসহা। নারীকে এই রুপে দেখতে পুরুষ ভালবাসে। এখানে ই ঘরে ঘরে শায়ত্ব শাসনের শুরু। যদিও নারী গর্ভে শিশু বেড়ে ওঠে,মাতৃদুগ্ধে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পরিচর্যা করেন মা।সেখানে কন্যা সন্তান হলে সব দায় বর্তায় মায়ের ওপরে। মায়ের আঁচলে বেড়ে ওঠা পুত্র সন্তান যুবক থেকে বয়স্ক হওয়া অবধি আর একটা গন্ডি তৈরি হয়।সবকিছু ভুলে সে গৃহের কর্ণধার হয় সে।সেখানে ও তার জননী নিগৃহীতা হন।
জাতী,বর্ণভেদের সৃষ্টি করেছিল কুল শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ। কুলশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ। কুলীনত্বের জয়ডঙ্কা বাজিয়ে চিতায় ওঠার আগেও নাতনি সমান কন্যাকে বিবাহ করে।সে যুগে কিছু পুরুষ লাম্পট্যের কিছু প্রমাণ রেখে গেছেন সর্বংসহা ধরিত্রীর উপরে। সে যুগে কিছু মেয়ের চোখের জল মোছাতে এগিয়ে এসেছেন রাজা রামমোহন রায় ও পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। তেমন কারোকে আজ আর চোখে পড়ে না। আজ সমাজের কিছু কীট গ্রস্ত পুরুষ, নারীকে ধর্ষণ করছে ।কিছু পুরুষ সাঁঝের বেলায় মধু খেতে যান,তাতে কুলে কালি লাগে না। স্বামী পরস্ত্রী গামী হয়েও অপবিত্র থেকে যান। সেই পরস্ত্রী গামী স্বামী রাতে স্ত্রী সহবাস করলে ও সতী স্ত্রী অচ্ছুত হন না। এখানে বিবাহ বন্ধন কথাটা একপেশে। পুরুষ মুক্ত বিহঙ্গের মতো ফুলে ফুলে মধু খাবে অথচ স্ত্রীর একটু এদিক ওদিক হলেই হৈ হৈ রৈ রৈ রব। এ কোন নারী? যে নারী সেই স্বামীর সন্তান কে পৃথিবীতে এনে স্বামীকে পিতৃত্বের আনন্দ দিয়েছে।
আর একটা নিয়ম বিবাহিতা স্ত্রীকে ভোরের আলো ফোটার আগেই স্বামীর শয্যা ছাড়তে হবে লোকচক্ষুর অন্তরালে। স্বামীর শয্যায় স্ত্রী কে দেখাটা লজ্জার হলেও কিন্তু পুত্র বঁধু গর্ভবতী হলে কিন্তু সকলে খুশি হতেন। আজকাল অবশ্য এটা মানা হয় না। আমি আগের কথা লিখছি। পুত্র বঁধু গর্ভবতী খুশি হতেন কারণ ওটাই স্ত্রীর ধর্ম। স্ত্রী যেন দুধেল গাই। গাইয়ের সংখ্যা বাড়লে আয় বাড়বে। অতি গর্ভ ধারণে অনেকের অকাল মৃত্যু ঘটতো। অবশ্য এ যুগে সেই চল নেই। দিন পাল্টেছে। এখন “হম্ দো হমারা দো” চালু হয়ে যেতে বাবা মায়েরা সজাগ হয়ে গেছে। শাশুড়ি গন পুত্রবঁধূর ভালো দেখতে পেতেন না।আমি অবশ্য সবার কথা বলছি না। সেই সব শাশুড়ি ছেলের অপকর্ম কে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রয়াস পেতেন। তাঁদের ধারণা “সোনার আংটি ব্যাকা আর ট্যাকা “।ছেলের চরিত্র যায় না। সে হাজার মেয়েকে ভোগ করুক, তাতে দোষের কিছু নেই।
অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যখন তিনি শাশুড়ি হতেন তখন তিনি ও একই নিয়মে চলতেন। “বারট্যান্ড রাসেল” একজায়গায় বলেছেন যে, একটি ছেলে তার থেকে বয়সে ছোট ছেলেদের মারতো। তাকে তিনি মারার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে, ছেলেটির থেকে বড়ো ছেলেরা তাঁকে রোজ মারে ,তাই ওর মনে হয় যে এটা সে ঠিকই করছে।
আবার মনুস্মৃতি তে ফিরি। মনুস্মৃতি বিধান দিয়েছিল, স্বামীর যদি কোন গুন না থাকে ,সে যদি কুরূপা হয়,যদি সে অন্য সে অন্য জায়গায় আনন্দ সন্ধানে যায়, তবু ও স্ত্রীর সেই স্বামীকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করাই পুণ্য কাজ। ইন্দ্রিয়ের দাস,মাতাল স্বামীকে স্ত্রী যদি অসম্মান করে তবে তাকে তিন মাসের জন্য পরিত্যাগ ও অলংকারাদি থেকে বঞ্চিত করা স্বামীর কর্তব্য। এরপর প্রশ্ন করাই যেতে পারে, কেন মেয়েরা সব দুঃখের ভার বইবে?অপরাধী কে হাতে,পায়ে, কোমড়ে দড়ি বেঁধে নেওয়া হয়। বিয়ে টা ও তার একটা ঘষা মাজা অপরাধীর রুপ। বিবাহ বন্ধনের প্রতিক হিসেবে দেখা যায়—নাকে দড়ি হলো ,নাকে নোলক। যেটা স্বধবাদের পড়তে হয়। এরপর হলো পায়ে বেড়ি। যেটা পায়ের মল। যেটা পড়লে বন্দীনি কোন ক্রমেই পালাতে পারবে না। কারণ বন্দীনি কে চলতে হলে সকলকে সচকিত করেই চলতে হবে ছম্ ছম্ শব্দ করে।হাতের বেড়ি হলো শাঁখা, পলা ,নোয়া। সবশেষে বিবাহের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো সিঁদুর দান।এটাও সাংকেতিক চিন্হ বহন করে। বলির পাঁঠা কে সুন্দর করে স্নান করিয়ে পাঁঠার মাথায় সিঁদুর লিপে দেওয়া হয়। ঠিক তেমনি ভাবেই নববঁধুকে সিঁদুর দেওয়া হয়। বলির পাঁঠা যেমন বলির আগে। ম্যাঁ ম্যাঁ করে কাঁদে। নববধূ ও তেমনি পতিগৃহে যাবার আগে কাঁদে।
আর একটা কথা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সেটা বধুঁ হত্যা। এতে শ্বশুর বাড়ির সাথে সমদোষে দুষ্ট বাপের বাড়ি। মেয়ের বাবা ও মা।শ্বশুর বাড়ির অত্যাচারে মেয়ে বাপের বাড়ি চলে এলে,লোকলজ্জ্বার ভয়ে মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে আবার পাঠিয়ে দেন মেয়ের বাবা ও মা। মেয়ের ভার বইতে চান না। সেসব মেয়েরা আত্মহত্যা করে নতুবা সেখানে বধুঁ হত্যা হয়ে যায়। অনেক দিন আগে এক প্রতিবাদী মাঝারি লেখকের লেখা পড়েছিলাম। তিনি লিখেছিলেন–“পতিতাবৃত্তি কে মানা যায় না”। এর ধারে কাছের মত অনেক পুরুষের। আমার ধারণা বৃত্তি কথাটা আমরা ব্যবহার হয় ইচ্ছাকৃত কাজে। যা আমরা বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। অতি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, পরিবারের পুরুষ দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে যে সব মেয়েরা ঘর বাঁধার লোভে কোন পুরুষের সাথে ঘর ছাড়ে তাদের ঠাঁই হয় পতিতালয়ে। এই সব নারীরা পতিতালয়ে ঢোকার আগে ও জানে না তারা বিক্রিত হতে চলেছে। রেড লাইট এরিয়ায় কেস স্টাডি করে দেখা গেছে, জেনে শুনে কেউ এখানে আসেনি। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কিছু লোক তাদের নিয়ে গেছে রেড লাইট এরিয়ায়। তাই যে কাজ ইচ্ছানুযায়ী নয় ।তাই “পতিতা বৃত্তি ” কথাটা এখানে খাটে না।
অনেকের মতে ডিভোর্স বহুগামী হতে সাহায্য করে। আমার মনে হয় ডিভোর্স না করে ও বহুগামীতা রোধ করা যায় না। যে দেশে হাইকোর্টে প্রতিটা ঘরেই টেবলে ফাইলের পর ফাইল ঠাসা।চেয়ার এ বসা মানুষটির মুখ কোন রকমে দেখা যায়। তারিখের পর তারিখ চলে যায়। লোক আদালতে কেস উঠলেও বিবাদী পক্ষ না আসায় কেস্ এগোয় না। লোক আদালতে কেস স্টাডিতে দেখা গেছে যে,সন্তান সম্ভবা স্ত্রী কে বাপের বাড়ি রেখে স্বামী তার কর্মস্থল মুম্বাই ফিরে গেছে। আর ফিরে আসেনি স্ত্রী ও কন্যা সন্তানকে মুম্বাই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। সেই সন্তানের বয়স ষোলো, যখন লোক আদালতে কেস ওঠে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে লোক আদালতে কেস চলেনি এবং ডিভোর্স মেলেনি সেই স্ত্রীর। এই ভাবে ই ভদ্র ঘরে বহু সংখ্যক পতিতার সৃষ্টি হবে। এ দায় কার???
সাইকো সবকিছুর মূল। ভালোবাসা আয়নার মতো,যেমন দেখাও তেমনি দেখি।যেখানে, ‘”আই অ্যাম ওকে, ইউ আর ওকে”। সেখানে ভাঙ্গন ধরাতে পারে না। বড়ো বড়ো সভায় আমরা কথায় কথায় উদারতার যে ছবি আঁকি।সে ছবির অন্তরালে আর একটা ছবি মিশে থাকে। তা আমাদের জিন্ এর ছবি। সেই জিন ই নারীর চলার আটকে রাখে।তাই আজকের অনেক পুরুষের মনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায় নারীর চলার পথ।