Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিপদ ও তারাপদ || Tarapada Roy

বিপদ ও তারাপদ || Tarapada Roy

বিপদ ও তারাপদ

সেই কবে, কতকাল আগে, নিতান্তই ইয়ার্কি করে আমি লিখেছিলাম,

বিপদ এবং তারাপদ
কখনও একা আসে না।

সবাই জানেন, অকারণে বিপদে পড়া আমার পুরনো স্বভাব। এবার আমেরিকায় এসে নিতান্ত পরোপকার বৃত্তি পালন করতে গিয়ে আবার বিপদে পড়লাম।

বিপদ বলে বিপদ, রীতিমতো গোলমাল।

আসলে দোষটা সম্পূর্ণই আমার। আজীবন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কিছু না কিছু করে এসেছি। তা, সে লেখাপড়াই হোক, বাজার করাই হোক কিংবা স্নান-খাওয়া, অফিস যাওয়া, আড্ডা দেওয়া।

কিন্তু নিরিবিলি অবসর যাকে বলে তা এ জীবনে খুব বেশি পাইনি। কলকাতার বাসায় তো ফোনের অত্যাচারে আপন মনে একা থাকার সুযোগ নেই। সেই যে কবি লিখেছিলেন যে পাখির গানে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি, পাখির গানে আমরা জেগে উঠি, সেটা অনুকরণ করে বলা যায় টেলিফোনের ঝংকারে ঘুমোই, টেলিফোনের ঝংকারে ঘুম থেকে উঠি।

অবশ্য এসব কথা বলে আমি জাহির করতে চাইছি না যে আমি খুব করিৎকর্মা লোক। তালেবর ব্যক্তি।

সে যা হোক, পঁয়ত্রিশ বছর সরকারি চাকরি ঘাড়-মুখ গুঁজে করার পরে অবসর পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, সমুখে শান্তি পারাবার।

কিন্তু তা হয়নি। বাসায় ভিড় আরও বেড়ে গেছে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী। সদর দরজা বন্ধ করলেই কলিংবেলের কর্কশ ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং। তদুপরি টেলিফোনের রিং রিং তো আছেই।

.

অবশেষে এখন আমার সত্যিকারের অখণ্ড অবসর পূর্ণ বিশ্রাম।

প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর প্রান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য। চিরবসন্তের দেশ। শীত কখনওই জোরালো নয়, গ্রীষ্ম কখনওই প্রখর নয়। ফুল-ফল, গাছপালা, নদী-পর্বতের বিচিত্র সমারোহ।

ক্যালিফোর্নিয়ার এক প্রান্তে উপকূলবর্তী ছবির মতো শহর বার্কলে, মহানগরী সানফ্রানসিসকোর শহরতলিই বলা যায়। চারদিক জলে ঘেরা, এপাশে ওপাশে ছোটবড় পাহাড়, বনমালা। এত রকমের গাছ, এত রকমের ফুল কোথাও সচরাচর দেখা যায় না।

আবহাওয়া দার্জিলিংয়ের মতো। তবে অত বৃষ্টি হয় না। শীতে বরফ পড়ে না, তবে বরফ পড়ার কাছাকাছি পৌঁছে যায় পারদের মাত্রা।

এ কালে ফায়ারপ্লেস প্রায় উঠেই গেছে। এখানে এই বার্কলে শহরে কোনও কোনও পুরনো বাড়িতে বসবার ঘরে ফায়ার প্লেস বা কাঠ দিয়ে আগুন জালানোর জায়গা এখনও আছে। ব্যবহৃতও নিশ্চয় হয়, না হলে প্রতিটি দোকানেই জ্বালানি কাঠ বিক্রির জন্যে মজুত থাকে কেন? তা ছাড়া দু-একজনকে জ্বালানি কাঠ, প্যাকেট বদ্ধ ফায়ারউড কিনতেও দেখেছি।

তা যা হোক আমরা যে বাড়িতে আছি সে বাসায় ফায়ারপ্লেস একটা আছে কিন্তু তার ব্যবহার নেই। তা বদলে ইলেকট্রিকের রুম হিটার। বারবার কাঠ দেয়ার প্রয়োজন নেই, হঠাৎ আগুন লেগে যাওয়ার ভয় নেই। তা ছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী তাপমাত্রা কমানো বাড়ানো যায়।

শীতের নিভৃতে এই বিখ্যাত উপনগরীতে ভালই ছিলাম। নিরুপদ্রব, নিরিবিলি। কলকাতায়। সল্টলেকের বাড়িতে যে ব্যস্ততা, লোক সমাগম, পিয়ন, কুরিয়ার, চিঠিপত্র, টেলিফোন, কলিংবেল, ক্যানভাসার, ভিখিরি এমনকী কুকুর বেড়াল; এখানে তার কোনওটাই নেই, একেবারে ফাঁকা ফাঁকা। এখানে কাক পর্যন্ত নেই, একদিন সন্ধ্যায় বার্কলে মেরিনে বেড়াতে গিয়ে দুর থেকে একটা কাক দেখতে পেলাম, ছোটজাতের দাঁড়কাক। আমি একটু এগিয়ে যেতেই কাকটা কাকা করে ডেকে উড়ে গেল।

আহা, কতদিন পরে কাকের ডাক শুনলাম, শুনে কান-প্রাণ জুড়িয়ে গেল।

সত্যি এখানে, এমন সুন্দর জায়গায় পাখি এত কম কেন! সামান্য কাক, তার ডাকও শোনা যায় না।

কাকের ডাকের জন্যে এই আকুলতা, এটা কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। আসলে নিথর নীরবতায় আমি হাঁফিয়ে উঠলাম। রাস্তায় যাই, দোকান বাজারে ঘুরি, লোকজনের সঙ্গে দেখা হয়, ইয়েস-নো, থ্যাংক ইউ, হ্যাভ আ নাইস ডে। সময় আর কাটতে চায় না, কাটে না।

এই সময় স্থানীয় খবরের কাগজ, যার নাম বার্কলে ডেইলি প্ল্যানেট (Berkeley Daily Planet), অর্থাৎ বাংলায় বার্কলে দৈনিক গ্রহ পড়ে আমি একটা জিনিস জানতে পারলাম, বলা উচিত গ্রহের ফেরে পড়লাম।

বার্কলে প্ল্যানেটে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে স্থানীয় সিনিয়র সিটিজেনস সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন থেকে।

মার্কিন দেশে পঁয়ষট্টি বছর বয়েস হলে সরকারি ভাবে সিনিয়র সিটিজেন গণ্য করা হয়। আমার অবশ্য এই হিসেব অনুযায়ী সিনিয়র সিটিজেন হতে আরও দুয়েক বছর লাগবে কিন্তু বিজ্ঞাপনটি পড়ে আমি কিঞ্চিৎ প্রলুব্ধ বোধ করলাম।

প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল যে সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় সিনিয়ররা বা প্রধানেরা এখানে নানারকম বেশি সুবিধে পায়। বাসে-ট্রেনে, টিউবে টিকিটের দাম কম, সিট সংরক্ষিত। ট্যাক্সের সুবিধে, চিকিৎসার সুবিধে এমনকী মার্কিন নাগরিক হলে ভরণপোষণের জন্যে অনুদান।

আমি ভারতীয় নাগরিক। ভরণপোষণ, ট্যাক্সের সুবিধে আমার প্রাপ্য নয়, আমি চাইও না। তবে অ্যামট্রাকের টিকিট ভাড়ার সময় সস্তায় পেয়েছি, সেখানে ষাট বছরেই সিনিয়র। আবার সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের টিকিটে প্রবীণের সুবিধে পেয়েছি।

সে যা হোক, বার্কলে প্ল্যানেটের বিজ্ঞাপনে বলেছে ইংরেজি ও এক বা একাধিক প্রাচ্য ভাষা বোঝে এবং বলতে পারে এমন প্রবীণ ব্যক্তি চাই। বিশেষ কোনও নির্দিষ্ট কাজ নেই। তবে প্রয়োজনে ইংরেজিতে কথোপকথনে অপারগ মাতৃভাষীদের সাহায্য করতে হবে। কোনও বেতন দেওয়া হবে না, তবে যাতায়াত-ফোন ইত্যাদি বাবদ সপ্তাহে পঞ্চাশ ডলার পর্যন্ত ভাতা দেওয়া হতে পারে।

আমি দেখলাম, এই হল সুবর্ণ সুযোগ। আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে হচ্ছে না। তা ছাড়া প্রবীণ নাগরিক কল্যাণ সমিতির অফিসও আমার বাসস্থানের খুবই কাছে। আমি টেলিগ্রাফ অ্যাভিনিউ নামক রাজপথের যে মোড়ের পাশে থাকি তার ঠিক পরের মোড়ের কাছেই ওই সমিতির অবস্থান।

ভেবে দেখলাম, টাকা-পয়সার ব্যাপার নয়, এ দেশে আমি ডলার উপার্জন করতে আসিনি তবে আমার সময় কাটানোর জন্যে বিজ্ঞাপিত কাজটি সহায়ক হতে পারে। কেউ হয়তো বলতে পারেন, এমন অমূল্য, অসীম অবসর পেয়েছেন খাতা কলম নিয়ে বসে ভালমন্দ কিছু লিখলেই পারেন।

দুঃখের বিষয়, তা পারি না। যথেষ্ট চাপ না থাকলে এবং গোলমাল হইচই ইত্যাদির মধ্যে না থাকলে আমার লেখা হয় না। এ আমার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে আর এই বয়েসে স্বভাব তো বদলানো যায় না।

সুতরাং বিজ্ঞাপনের ঠিকানায় নির্দিষ্ট দিন সকালবেলায় পৌঁছে গেলাম। দেখলাম রীতিমতো সুগঠিত একটি সংস্থা। পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য-সদস্যাবৃন্দ একটা বড় গোল টেবিল ঘিরে ইতস্তত বসে আছেন। বিশাল ঘরের চারপাশে এবং সামনের বারান্দায় বেশ কয়েকটা সোফা। এক প্রান্তে। একটা কফি তৈরির মেশিন, দুধ, চিনি ইত্যাদি। পাশে রাখা প্লেটে অল্প কিছু পয়সা রেখে যে যার ইচ্ছে মতো কফি বানিয়ে খাচ্ছে। পাশে একটা বড় প্লেটে কয়েকটা বিস্কুটের, কুকির খোলা প্যাকেট।

আমি গিয়ে আত্মপরিচয় দিলাম। আমার চেহারায় বোধহয় একটা বয়স্কভাব দেখা দিয়েছে, কর্তাব্যক্তিরা একবারও আমার বয়েস জানতে চাইলেন না। এমনকী আমার কী ধরনের ভিসা, এ দেশে কোনও সচেতন কাজ করার অধিকার আমার আছে কি এসব বিষয়ে এঁরা কোনও প্রশ্নই করলেন না।

আমি যখন জানালাম যে আমি ইংরেজি ও বাংলা বলতে, বুঝতে পারি, হিন্দিতেও কাজ চালাতে পারি এবং উর্দুতেও চলনসই–এঁরা খুব আশ্বস্ত হলেন। বুঝতে পারলাম, এঁদের আমার মতো লোক দরকার।

এঁদের পরোপকারবৃত্তির মধ্যে প্রধান হল বিদেশিদের সাহায্য করা। বিমানবন্দরে সরকারি অফিসে বা আদালতে এমন অনেক বিদেশিকে দেখা যায় যারা মাতৃভাষা ছাড়া আর কোনও ভাষায় পারঙ্গম নয়। এদের কোনও প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায় না। এরা কিছুই বলতে পারে না। মধ্যে থেকে ঝামেলায় পড়ে।

তা ছাড়া সিনিয়র সিটিজেনদের একটা বড় দায়িত্ব হল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট, হয়তো কোথাও বিয়ে ভাঙার মুখে, সেখানে স্বামী বা স্ত্রী সাহায্য চাইলে সাহায্য করা। এমনকী কেউ হয়তো আত্মহত্যা করতে চাইছে কিংবা ড্রাগের নেশা ছাড়তে পারছে না–এসব ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভাষা বুঝতে না পারলে কিছু করা অসম্ভব। সেই জন্যে দোভাষী প্রয়োজন।

কাজের গুরুত্ব না বুঝে আমি বোকার মতো রাজি হয়ে গেলাম।

বার্কলে ডেইলি প্ল্যানেট পত্রিকায় এবং অন্যান্য জায়গায় নিয়মিত প্রধান নাগরিক সমিতির আবেদন বেরোয়–

যেকোনও মর্মান্তিক বিপদে সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করুন।

বিস্তারিত বিজ্ঞাপন ছাড়াও সমিতির সদস্যেরা পাড়ায় পাড়ায় যোগাযোগ রাখেন। সদা সাহায্যের জন্যে তারা হাত বাড়িয়ে রয়েছেন।

দুদিন পরে একদিন সকালবেলা চা খাচ্ছি, এমন সময় সমিতির এক কর্তাব্যক্তির ফোন পেলাম, গাড়ি যাচ্ছে। ভীষণ জরুরি। এখনই চলে আসুন।

কোনও রকমে জামাকাপড় পরে, দাড়ি-টাড়ি না কামিয়েই ছুটলাম। জায়গাটা ওকল্যান্ডের দরিদ্র অঞ্চল, ছোট ছোট ঘিঞ্জি একতলা বাড়ি। বোরখা পরা এক মহিলা ছটফট করছেন আর উর্দুতে নাকি সুরে কঁদছেন। উর্দু যে খুব ভাল বুঝি তা নয়, তবে হিন্দিটা বুঝি, কলকাতা দূরদর্শনের উর্দু সংবাদটাও অনুধাবন করতে পারি, সেই যোগ্যতা নিয়ে কিছুটা শুনে বুঝতে পারলাম, মহিলা সন্তানসম্ভবা, আসন্নপ্রসবা। তার স্বামী কাজে গেছেন। এদিকে তার গর্ভযন্ত্রণা শুরু হয়েছে।

পাড়াপ্রতিবেশীরা প্রায় সবাই কৃষ্ণাঙ্গ বা মেক্সিকান। তারা এঁদের কথাও বোঝেন না, এঁদের সঙ্গে মেলামেশাও নেই। এঁরা যে কোথা থেকে কীভাবে এখানে এসে পৌঁছেছেন, ঈশ্বর জানেন।

তা, ব্যাপারটা বুঝতে আমার খুব বেশি দেরি হল না। আমি সঙ্গী সিনিয়র সিটিজেনকে বলতেই তিনি অ্যাম্বুলেন্সে মহিলাকে প্রসূতিসদনে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।

এর মধ্যে দুটো বড় ঝামেলা দেখা দিল। প্রথমটা হল, মহিলার কোনও হাসপাতালে টিকেট করা আছে কিনা, মেডিক্যাল ইন্সিওরেন্স আছে কি না কিছু জানা গেল না। দুনম্বর সমস্যা আরও জটিল, মহিলার স্বামীকে কী করে জানানো হবে যে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

অবশ্য এ নিয়ে ভাববার দায়িত্ব আমার নয়। প্রবীণ সমিতি বুঝবে কী করবে। আমি বাড়ি ফিরে এলাম।

দুদিন মোটামুটি কাটল।

আসল গোলমাল হল তৃতীয় দিন রাতে। রাতে মানে গভীর রাতে, দেড়টা-দুটো হবে, টেলিফোন বাজল।

টেলিফোন বেজে চলেছে, ঘুম চোখে ধরলাম ফোনটা। ওপ্রান্ত থেকে শোনা গেল, মি. রায়?

আমি বললাম, ইয়েস স্পিকিং।

ওপ্রান্ত বলল, প্লিজ স্পিক হিয়ার।

আমি একটু অপেক্ষা করতেই ফোনে শুনতে পেলাম, খাঁটি বাঙাল কণ্ঠস্বর, আমি কিন্তু এক্ষুনি লাফামু।

আমি প্রায় কিছুই বুঝতে না পেরে বাঙাল ভাষাতেই প্রশ্ন করলাম, তুমি লাফাবা ক্যান? কী হইছে?

বাঙাল কণ্ঠের বাংলাদেশি জবাব এল, আমি মরুম। আমি এ দ্যাশে আর থাকুম না। তারপর কী ভেবে বললে, চাচু, আপনি তো আমাগো দ্যাশের লোক?

আমি বললাম, আগে টাঙ্গাইল বাড়ি ছিল।

সে বলল, চাচু, আমার বাড়ি মানিকগঞ্জে। আপনাগোর পাশে। আমি কিন্তু এখন লাফামু।

আমি আর কী বলব, জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কোথায়? লাফানের কী দরকার?

সে বলল, আমি আলতাবাতাস হাসপাতালের তিনতলায়। আমি আর এইখানে থাকুম না। এবার লাফামু।…

.

উপরিউক্ত আলতাবাতাস হাসপাতাল আসলে হল সুবিখ্যাত আলটাবেটস হসপিটাল; এতদঞ্চলে, সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। মানিকগঞ্জের এই ছোকরাকে সেখানে রাখা হয়েছে স্নায়ুরোগের চিকিৎসার জন্যে। রেখেছেন যিনি তিনি একটি ভারতীয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক। নানা রকম ফন্দিফিকির করে ছোকরা এদেশে এসেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই খাবারের দোকানে বয়ের কাজ সংগ্রহ করে।

বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের প্রায় সর্বদাই আত্মগোপন করে থাকতে হয়। গৃহ-পরিজন থেকে দূরে অনাত্মীয় প্রবাসে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়।

সেদিন ছেলেটিকে বুঝিয়ে বললাম যে হাসপাতালের তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়লে তোমার হাত-পা ভাঙবে, মাথা ফাটবে কিন্তু মারা যাবে না। সেটা খুবই বিশ্রী ব্যাপার হবে।

সে বলল, আমি কী করুম? এখানে তো কাছাকাছি কোনও উচা বাড়ি নাই।

যা হোক, আত্মহত্যা করার চেষ্টা থেকে তাকে অন্তত সেদিনের মতো নিবৃত্ত করা গেল।

কিন্তু আমার ফ্যাসাদ শুরু হয়ে গেল।

.

সে যে কী বিপদ।

দিনরাত জরুরি বার্তা আসছে। বাংলা-হিন্দি-উর্দুতে ভয়াবহ সব সমস্যা।

এয়ারপোর্টে কে সন্দেহজনক জিনিস নিয়ে ধরা পড়েছে, হিন্দিতে কী সব বলছে। আদালতে সাক্ষী বাংলা ছাড়া আর কোনও ভাষায় কথা বলতে পারে না। পুলিশের আসামি উর্দুভাষায় জবানবন্দি দিচ্ছে।

সকলের সব কথা বুঝতে পারি তাও নয়। তা ছাড়া এ বয়েসে এত ধকল পোষায় না। এদিকে সিনিয়র সিটিজেন সমিতির একমাত্র বলভরসা আমি।

এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্যে আমি শেষ পর্যন্ত নিতান্ত নিরুপায় হয়ে একটা বুদ্ধি বার করলাম। সমিতির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আমি বাংলায় কথা বলতে শুরু করলাম। তারা যাই বলুন, যে বিপদের কথাই বলুন, আমি বাংলায় জবাব দিই, আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। আমার কথা শুনে। বৃদ্ধ ভদ্রলোকেরা কিছুই বুঝতে পারেন না।

দুদিন পরে দেখি আমার সেই গ্রহ দৈনিক বার্কলে প্ল্যানেটে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে–

মানসিকভাবে সুস্থ বাংলা-হিন্দি-উর্দু দোভাষী অবিলম্বে চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress