বিদ্রোহীনি মা
-মা তোমার নাম কি?
আমার মেয়ে জবাব দিল স্বর্ণালি ।
– তুমি পড়াশোনা কতদূর অবধি করেছ?রান্না করতে পারো?
– সামান্য পারি ,আমি বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ থেকে বি -এস সি,প্রানীবিদ্যা নিয়ে অনার্স করেছি । ওখানেই এম -এস-সি করছি।
– আমার ছেলে অঙ্কে অনার্স – মাস্টার্স দুটোই কলকাতা বিদ্যালয় থেকে ।
– আজকের পেপারটা আমাকে একটু পড়ে শুনাও তো।এবার ছেলের মা,দিদি, মেয়ের পাশে এসে বললেন দেখিতো তোমার চুল কতো বড়? চুল খুলে দেখে বললেন বা চুল তো বড় আছে।আমি এইবার অনেক কষ্ট করে বললাম কেন দিদি বড় চুল আপনাদের পছন্দ নয়?
– না বড় চুলই পছন্দ।
উনি তাড়াতাড়ি বলেলেন চুল ছোট মানে মেয়ে পার্লারে যায়, আর পার্লারে যাওয়া মেয়েরা বিশেষ ভাল হয় না।আচ্ছা তুমি লক্ষীর পাঁচালি সূর করে পড়তে পারো?খালি চোখে পড়তে পারো। আমি বললাম মেয়ের চোখে চশমা লাগে নি এখনো।
বলি দেবার পাঁঠাকে যেমন দেখেশুনে নিতে হয়,নিখুঁত চাই,তেমনি পাত্রপক্ষ আমার মেয়েকে ও দেখতে এসে নেড়েচেড়ে দেখছিল ।আমি রাগে ভাবি,আমার মেয়ে সুন্দরী পড়াশোনায় খুব ভালো,তাকেও এইসব অসভ্যতা সহ্য করতে হবে।আমার কাজের মাসি খাবার দিতে এসে ,এ অন্যায় সহ্য করতে না পেরে বলেই বসে
“বলি ছাগল কিনতি এয়েচ , না কনে দেকতি এয়েচ?ত্যাখন থেনে এমন নেড়িচেড়ি দেখতিচ।আমি ও দেখতে পেলাম যেন আমার মেয়ে ঠিক বলির পাঁঠার মত কাঁঠালপাতা চিবাতে চিবাতে মন্দিরে নয়,শ্বশুরবাড়ি চলেছে।তারপর সম্বিত ফিরতেই মাসিকে বললাম,এরকম বলতে নেই,ওনার একমাত্র ছেলে বলে কথা। মাসি বলে সে তো তোমারো একমাত্র সোনার মেডেল পাওয়া মেয়ে।অসংলগ্ন কথাবার্তায় পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আমি মেয়েকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলাম ,যাবার সময় লক্ষ্য করলাম ঐ মহিলা মেয়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন তারমানে পা ঠিক আছে কিনা দেখছেন ।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর মুখ অপমানে লাল হয়ে গেছে। আমার এই মেয়েকে আমি অনেক আদরে বড় করেছি ওর যখন তিন বছর বয়স সে সময় ওর বাবা নিরুদ্দেশ। কিন্তু আমি আমার মেয়েকে নিয়ে আমার বাবা-মার কাছে ফিরে যায় নি।মামা, মামি,দাদু দিদা অনেক করে বলেছিল,ওখানে ফিরে যেতে।। আমার মেয়ে যেন কখনো কোথাও অপমানিত না হয় সেই দিকে খেয়াল রাখতাম । আমার মনে আছে একবার ও তৃতীয় ক্লাসে পড়ার সময় অঙ্ক খাতা না নিয়ে যাওয়াই ওর ক্লাস টিচার রুলার দিয়ে ওকে এতো জোরে হাতে বাড়ি দিয়েছিল যে মেয়ের হাত কেটে গেছিল। আমি পরের দিনই স্কুলে গিয়ে ঐ শিক্ষিকার নামে প্রধান শিক্ষিকার কাছে নালিশ করেছিলাম ।সামান্য অপরাধে শিশুর উপর গায়ে হাত তুলবে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। আমি মেয়েকে বিয়ে দেয়ার ব্যাপারেও এখন রাজি ছিলাম না। কিন্তু মেয়ের বড় পিসি এসে বলল এই বিয়ে যদি হয় তা হলে তুই অমত করিস না, ছেলে খুব ভালো শিক্ষিত । ওরা স্বর্নালিকে লেখা পড়া করাবে বলেছে। কিন্তু দিদি শিক্ষিত পরিবারের মানুষিকতা যে এতটা ছোট তা আমি ভাবতেও পারিনি। আমার মনে হল বলির ছাগল কিনতে গেলেও আমরা এতো কিছু দেখিনা আর ওরা তো ওদের পরিবারের বউকে দেখতে এসেছে । যেই পরিবারে বিয়ের আগেই মেয়ের এত অসন্মান বিয়ের পরের অবস্থা তো বুঝাই যায়।
ছেলের বাবা ,আমার দিকে তাকিয়ে বললেন মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে এখন বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করেন তবে আগেই আপনাদের একটা কথা বলে নেই আমাদের কোন দাবি দাওয়া নেই কিন্তু আপনারা আপনাদের মেয়েকে খুশী হয়ে কিছু দিতে চাইলে আমরা কোন আপত্তি করব না।আমি তারপরে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললাম তুমি বাংলা পড়তে পারো পাত্রেরবাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন আমার ছেলে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়েছে। বাবা তুমি কি কথা বলতে পারো না ? না , মানে এতক্ষন তোমাকে কোন কথা বলতে শুনলামনা তো তাই জিজ্ঞাসা করলাম ।
ছেলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল না অ্যান্টি,আমি বাংলাটা পারি না।ইংরেজি মিডিয়াম তো।কোন স্কুলে পড়েছ?নব নালন্দাতে।কিন্ত্ত ওখানে তো বাংলা ছিল।ও তোমার তৃতীয় বিষয় হিন্দি ছিল।
না না আমারর বাংলা ছিল।আসলে কোনদিন বাংলা টা ভালো করে পড়ি নি।
কিন্তূ আমার মেয়ে তোমার স্কুলে পড়েছে।
এইবার ছেলে অসহায় চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলের বাবা তাড়াতাড়ি বললেন ,আমার ছেলে স্টার পেয়ে পাশ করেছে।আমার মেয়ে তো ৯২শতাংশ পেয়েছে,তাই বাংলা পড়তে পারে। এইবার আমি মহা বিরক্ত হয়ে ননদেরর দিকে তাকিয়ে বললাম কিগো দিদি তুমি না বলেছিলে এরা খুব শিক্ষিত,এখন দেখি এই যুগে শিক্ষিতা মেয়ের সাথে কিরূপ ব্যবহার করতে হয় জানা নেই ।
– এইবার আমি পাত্রের দিদির দিকে তাকিয়ে বললাম এই যে আপনার মেয়েকে দেখি ভ্রু প্লাগ করা তারমানে আপনার মেয়ে পার্লারে যায়। নিজেদের বেলায় সব ঠিক আর বউদের বেলায় সব বেঠিক, তাই না? আর সাজ সজ্জা তো মেয়েদের জন্যই,মেয়েরা সাজলে যদি সংসারে মন না থাকতো তাহলে কোন সংসারই টিকে থাকতো না । কারন সব মেয়েরাই সাজে।
আমি বললাম আপনাদের আমার মেয়ে পছন্দ হয়েছে কিন্তু আমার আপনাদের কাউকেই পছন্দ হয়নি । আপনারা আসতে পারেন ।
– আমার মেয়েকে আমার সামনে আপনারা অপমান করে যাবেন আর আমি খুশী হয়ে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিবো যাতে আমার মেয়েকে আপনারা ভবিষ্যতে আরও অপমান করতে পারেন আমি সেই মা নয় । আপনারা আসতে পারেন। আমি সারাজীবন মেয়েকে আইবুড়ি করে রাখব তাও ভাল,এরকম নিচু মানসিকতার বাড়িতে মেয়েকে বলি দেব না।