বিদেহী
আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগে মিহিজামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। চারদিকে ছিল ঘন সবুজের সমারোহ। ছোট ছোট টিলা পাহাড়ে ভর্তি ছিল জায়গাটা। এখন সুন্দর পাহাড়ি এলাকা ছাড়া আর কোনও টিলা নেই বললেই চলে। দূরে পাহাড়গুলো অবশ্য যেমন ছিল তেমনই আছে।
মিহিজামে খুকুদিরা থাকতেন গোলাপবাগের কাছে ছোট্ট একটি বাড়িতে। চারদিকে লাল মাটির প্রান্তর। বন উপবন। কী চমৎকার সবুজের সমারোহ সেখানে! সময়টা তখন ভাদ্র-আশ্বিন মাস। হঠাৎ কিছুদিন জ্বর ভোগ করে শরীরটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এমন সময় অপ্রত্যাশিতভাবে একদিন খুকুদির একটা চিঠি এসে হাজির। খুকুদি সেই চিঠিতে আমাদের সবার কুশল নিয়ে বারবার অনুরোধ করেছেন ওঁদের মিহিজামে একবার বেড়াতে যাওয়ার জন্য। বিশেষ করে আমাকে। লিখেছেন, ‘এই শরতে অন্তত কয়েকটা দিন আমাদের এখান থেকে ঘুরে যা। দেখবি খুব ভাল লাগবে। আমার তো এখন এমন হয়েছে যে মিহিজাম ছেড়ে আর কোথাও যেতেই ইচ্ছে করে না। আসবি তো?’
চিঠি পেয়ে আমি তো লাফিয়ে উঠলাম। বাবা মা’ও উৎসাহিত হলেন খুব।
বাবা বললেন, “তা কয়েকটা দিন ছেলেটা যদি একটু হাওয়া বদল করে আসে তো মন্দ কী? খুকু যখন অত করে লিখেছে তখন যাক না, শরীরটা ভাল হবে। দুর্বলতাও কাটবে।” মায়েরও অমত হল না। অতএব যাওয়ার দিন ঠিক হল।
বাবার এক বন্ধু ছিলেন রেলের চেকার। উনি প্রায়ই চিত্তরঞ্জন মধুপুর হয়ে ঝাঁঝার দিকে চলে যেতেন। আমাকে একদিন তাঁরই সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হল চিত্তরঞ্জনে। মিহিজাম গেলে চিত্তরঞ্জনেই নামতে হয়। লাইনের এপার আর ওপার। খুকুদিরা তো দারুণ খুশি হলেন আমাকে দেখে। খুকুদির বাবা মা খুকুদি, সকলেরই আনন্দ আর ধরে না!
খুকুদি বললেন, “তুই এসেছিস এতে যে আমার কী আনন্দ তা কী বলব। প্রায়ই তোর কথা ভাবি। একসঙ্গে ছিলাম কতদিন। এখন আমি একা।”
আমি বললাম, “অনেকদিন পর তোমাকে দেখে আমার আনন্দ হচ্ছে খুব। বাড়ি তো চিনে গেলাম। এখন সময় সুযোগ হলে আমি একাই চলে আসতে পারব।”
খুকুদিদের বাড়িটা দোতলা। ওপরে দুটো ঘর, নীচে দুটো। খুকুদির বাবা-মা নীচের ঘরে শোন, খুকুদি ওপরে। খুকুদির পাশের ঘরটাই আমার জন্য বরাদ্দ হল। আমাকে যে ঘরটায় থাকতে দেওয়া হল সেই ঘর থেকে দূরের হিলটপের দৃশ্য দেখা যেত ভালভাবে। বন সবুজে ঘেরা হিলটপের দৃশ্য ছিল কী চমৎকার! জানলা খুললে সুগন্ধ ফুলের সৌরভে মন প্রাণ আমোদ করে দিত।
ঘর দেখে দারুণ খুশি হলাম আমি। খুকুদিকে বললাম, “আপনার বাবা এই একটা ভাল কাজ করেছেন। এমন সুন্দর পরিবেশে বাড়িটা কিনেছেন যে, তা বলবার নয়।”
খুকুদি বললেন, “এই তো দু’ মাস হল কেনা হয়েছে বাড়িটা। আগে আমরা লাইনের ওপারে আমলাদহিতে থাকতাম। বাবার চাকরির মেয়াদও শেষ হল, আমরাও বাড়ি কিনে চলে এলাম। মাত্র দশ হাজার টাকায় পেয়ে গেলাম বাড়িটা। ওইজন্যই তো চিঠি লিখলাম তোকে, আয় এসে ঘুরে যা।”
“ভাগ্যিস এলাম। এরপরে মা বাবাকেও নিয়ে আসব একবার। এমন সুন্দর পরিবেশ।” “আমার কাছে তো এই বাড়িটা এখন স্বৰ্গ। দারুণ পছন্দ বাড়িটা।”
“আমারও।”
যাই হোক, খুকুদিদের আদর-যত্নে বেশ ভালভাবেই কেটে গেল কয়েকটা দিন। মিহিজামকে আমি এমনই ভালবেসে ফেললাম যে, এই জায়গা ছেড়ে আর বাড়ি ফিরে যেতেও ইচ্ছে করল না। জ্বরের ক্লান্তি দূর হলে দেহমনেও বল পেলাম। রোজ ভোরে উঠে খুকুদির সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, তারপর আদিবাসী গ্রাম ঘুরে শাল-মহুয়ার গন্ধে মেতে ঘরে ফেরা, বেলায় হাট বেড়ানো আর বিকেল হলেই হিলটপে উঠে বসে থাকা, এ কী ভোলবার? হাওড়া শহরের ঘিঞ্জি পরিবেশে থেকে যা কল্পনাও করিনি কখনও।
একদিন হল কি, খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। অন্যদিন খুকুদি আমাকে ডাকেন। আজ আমিই খুকুদিকে ডাকব বলে দরজা খুলে বারান্দায় এসেই দেখি খুকুদির বয়সী একটি অচেনা মেয়ে খুকুদির ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এই ক’দিনে মেয়েটিকে আমি একবারও দেখিনি। কে উনি? এত ভোরে কী করতে এসেছিলেন এখানে? মেয়েটি দারুণ সুন্দরী। এই আধো অন্ধকারেও তার রূপের ছটায় চারদিক যেন আলো হয়ে উঠেছে। উনি আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিস্ময়ভরা চোখে একবার দেখে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন।
বিস্ময় আমারও বড় কম হল না! আমি খুকুদির ঘরের দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে সাড়া দিলেন খুকুদি। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বললেন, “ভাগ্যে ডাকলি তুই। খুব ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এত ঘুম আমি কখনও ঘুমোইনি।”
আমি বললাম, “উনি কে খুকুদি?”
“কার কথা বলছিস?”
“এই যে একটু আগে যিনি আপনার ঘর থেকে বেরোলেন?” “আমার ঘর থেকে! কী যা-তা বলছিস তুই? এই তো আমি ঘুম থেকে উঠলাম। দরজার খিল খুললাম।”
আমি তখন সব কথা বললাম খুকুদিকে।
খুকুদি বললেন, “ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখিসনি তো?”
“না। যা দ্যাখবার তা আমি সজ্ঞান অবস্থাতেই দেখেছি।”
খুকুদি বললেন, “কী জানি বাবা, কী দেখতে কী দেখেছিস তুই। নে, রেডি হয়ে নে। এইবেলা ঘুরে আসি একটু। খুব মেঘ করেছে আকাশে। যে কোনও মুহূর্তে বৃষ্টি হতে পারে।” আমার কি বলার অপেক্ষা রাখে? সঙ্গে সঙ্গে রেডি হয়ে নিলাম আমি। তারপর খুকুদির সঙ্গে চললাম প্রাতভ্রমণে। ওই মেয়েটির ব্যাপারে আর কোনও কথাবার্তা না হলেও মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল আমার।
আজ আমরা রেল ব্রিজ পার হয়ে অন্যদিকে চললাম। আকাশ তখনও ভালভাবে ফরসা হয়নি। এক জায়গায় পাঁচিল-ঘেরা একটি বাগানের ভেতর গাছে গাছে অসংখ্য চাঁপাফুল ফুটে থাকতে দেখে আমাদের লোভ হল খুব।
খুকুদি বললেন, “চাঁপাফুল আমার দারুণ প্রিয়। আমাদের বাগানেও গাছ আছে। কিন্তু এর গন্ধটা যেন অসাধারণ। কিন্তু এই ফুল কী করে পাই বল তো?”
আমি বললাম, “ভেতরে যেন কাদের সব কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ঢোকার কোনও রাস্তাও আছে।” আমার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম একদল মেয়ে কলকল করতে করতে পাঁচিলের একটা ভাঙা অংশ থেকে বেরিয়ে আসছে।
ওরা বেরিয়ে এলে আমরাও ঢুকলাম। খুকুদি আঁচলভরে ফুল নিতে লাগলেন। আমি একপাশে একটি গোলঞ্চগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ দেখি একটু আগেই বাড়িতে দেখা সেই মেয়েটি খুকুদির পাশে পাশে থেকে ফুল কুড়িয়ে চলেছেন। খুকুদি তাকে লক্ষ না করলেও উনি কিন্তু মাঝে মাঝেই আড়চোখে তাকিয়ে দেখছেন আমার দিকে।
এমন সময় টপ টপ করে দু-একটা বৃষ্টির ফোঁটা আমার গায়ে পড়ল। আমি বললাম, “আর না খুকুদি, চলে এসো। না হলে ভিজে যাব আমি।”
কিন্তু খুকুদি আমার কথা শুনলেনই না। ভিজে-ভিজেও ফুল কুড়িয়ে চললেন। বৃষ্টির জল গায়ে পড়তেই সেই মেয়েটি ম্যাজিকের মতো উধাও। আমি কাছে গিয়ে খুকুদির হাত ধরে টান দিতেই খুকুদি যেন স্বাভাবিক হলেন। বললেন, “এঃ হে! তুই একেবারে ভিজে গেছিস রে! সবে জ্বর থেকে উঠেছিস তুই। হায় ভগবান!”
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “খুকুদি, সেই মেয়েটা।”
“কার কথা বলছিস তুই?”
“সেই যাকে তোমার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম।” “কোথায় সে?”
“এখন কোথায় জানি না, তবে উনি তো তোমার পাশে পাশে থেকেই তোমার সঙ্গে ফুল তুলছিলেন।”
খুকুদি আমার একটা হাত শক্ত করে ধরে বাগান থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন, “তোর কী হয়েছে বল তো আজ? বারবার কাকে দেখছিস তুই?”
আমি আস্তে করে বললাম, “একজনকেই।”
এমন সময় প্রবল বর্ষণ শুরু হল। আমরা একজনদের গাড়িবারান্দার নীচে আশ্রয় নিয়ে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে আকাশ ফরসা হয়ে গেছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে বৃষ্টি থামলে বাড়ি ফিরে এলাম।
এর পর সারাটা দিন বেশ ভালই কাটল। মাঝে মাঝে মেঘ জমে বৃষ্টি হয়, কখনও রোদ ওঠে। বাগানের শিউলিগাছ থেকে টুপটাপ ফুল ঝরে পড়ে। আমি জানলার ধারে বসে প্রকৃতির লীলারূপ দেখি।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে তেড়ে জ্বর এল খুকুদির। সে কী জ্বর! তার সঙ্গে ভুল বকা। মাথায় আইস ব্যাগ চাপানো হল। ডাক্তার এলেন, ওষুধ দিয়ে গেলেন। তাই দেখে খুব মন খারাপ হয়ে গেল আমার। এই প্রথম ঘরের জন্য মন কেমন করতে লাগল। মা-বাবার কথা মনে পড়ল। আর একটুও এখানে থাকতে ইচ্ছে করল না আমার।
আজ আর বিকেলে কোথাও আমি বেড়াতে গেলাম না। বাড়ির ছাদে উঠে পায়চারি করে সময় কাটাতে লাগলাম। মাঝে একবার গেলাম খুকুদির ঘরে। খুকুদির তখন জ্ঞান নেই। জ্বরটা একভাবে রয়েছে। চোখ দুটো লাল। কাউকেই চিনতে পারছেন না। এমনকী নিজের মা-বাবাকেও না।
খুকুদির মা সমানে কেঁদে চলেছেন। ওঁর কান্না দেখে আমারও চোখে জল এল। খুকুদি বিহনে আমি একা পড়ে গেলাম।
রাত্রিবেলা খাওয়াদাওয়ার পর ওপরের ঘরে শুতে গিয়েই বিপত্তি। দেখলাম আমার আগেই বিছানা দখল করে কে যেন শুয়ে আছে। ঘরের ভেতরটা ম ম করছে চাঁপাফুলের গন্ধে। আমার সারা শরীর জুড়ে একটা হিম স্রোত নেমে এল। আমি দারুণ ভয়ে চিৎকার করে ছুটে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।
সে রাতটা নীচের ঘরেই শুয়ে কাটল আমার। এর পর সারারাত আমি ভয়ে ঘুমোতে পারলাম না। আমার বিছানা দখল করে যিনি শুয়ে ছিলেন তাঁর কথা আমি কাউকে বলিনি। সেই তিনি, একই দিনে পর পর তিনবার যাঁকে দেখলাম।
যাই হোক, সকাল হতেই একজন লোককে দিয়ে আমাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা হল। তখন বেনারস এক্সপ্রেস চালু ছিল। সেই গাড়িতেই হাওড়ায় এলাম।
এর ঠিক দু’দিন পরেই খুকুদি মারা গেলেন। ওঁর নাকি খুব খারাপ ধরনের ম্যানেঞ্জাইটিস হয়েছিল। পরে অবশ্য বাবার মুখে শুনেছিলাম খুকুদির বাবা যে ভদ্রলোকের কাছ থেকে ওই বাড়িটা কিনেছিলেন তাঁরও একমাত্র মেয়ে ওই রোগেই মারা যান। তবে কি খুকুদির মৃত্যুর দূত হয়ে সেই মেয়েরই কায়াহীন ছায়া এসেছিল খুকুদিকে সতর্ক করতে অথবা কাছে টানতে? কে জানে?