বিতর্কিত সাহিত্যিক জেমস জয়েস
বিশ্ব সাহিত্যের এক অন্যতম প্রতিভাশালী আইরিশ লেখক জেমস জয়েস (James Joyce)। বিশ শতকের প্রথম দিকে সাহিত্য জগতে আবির্ভাব ঘটে তাঁর, অসংখ্য উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, নাটকের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়েছিল। তাঁর উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায় চেতনাপ্রবাহ রীতির বিস্ময়কর প্রয়োগ।
চিন্তা প্রবাহ মানে কি?
সাধারণভাবে আমরা নাটক, সিনেমায় যে জীবনের প্রতিফলন দেখি, সেটাই কি আমাদের জীবনের আসল প্রতিচ্ছবি? আড়ম্বরতা, গুছিয়ে কথা বলা, সবসময় সেজেগুজে চলা- এগুলো সমাজের ক্ষুদ্র একটা অংশের চিত্র মাত্র। এখানে দেখানো জীবনটা সমাজের আসল চিত্র কখনোই নয়। ‘ব্লুম’ চরিত্রের মধ্যে জয়েস দেখিয়েছেন, ব্লুম সাইকেলে করে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গাড়ি, ট্রাম এগুলো দেখছে আর আপনমনে ডুবে যাচ্ছে নিজের জীবনের চিন্তায়।
সমাজে বিচিত্র ধরনের মানুষের বাস। তাদের চিন্তাধারা আরও বেশি বিচিত্র। সবার চিন্তাগুলো যদি এক করা যায়, তাহলে দেখা যাবে অনেকেই একই চিন্তা করছেন ভিন্নভাবে। জেমস জয়েস বলেন,
”সবার যদি একটা সমষ্টিগত ধারণা থাকতো আমাদের সমাজের প্রতিটি মানুষের চিন্তা- সচেতনার ব্যাপারে তাহলে খুব ভালো হতো। সবাই সবার ধারণা ও অনুভূতির ব্যাপারে সচেতন থাতে পারতাম। এর ফলে আমরা খুব সহজে অন্যকে ক্ষমা করতে পারতাম, কারোর উপর রেগে যেতেও আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হতো। এই সমষ্টিগত চিন্তা-ভাবনা আমাদের জীবনকে একটা নতুন চেতনায় আলোকিত করতো, যেখানে সবাই সবাইকে নিয়েই ভাবে।”
আমাদের মনের প্রকাশ মুখের ভাষাতে সবসময় ঘটে না। প্রায়ই নানা মানুষকে সন্তুষ্ট করতে আমরা আমাদের মুখের কথায় প্রয়োগ করি এক, আর আমাদের মনে থাকে অন্য কিছু। আবারো অনেক সময় দেখা যায়, আমাদের প্রয়োগ করা ভাষাতে আমাদের মনের কথাগুলো যেন প্রাণ খুঁজে পায় না অনেক সময়ই। তাই তো জয়েস তাঁর শেষ উপন্যাস Finnegans Wake-এ এক বিচিত্র ভাষাই আবিষ্কার করে ফেলেন। প্রায় চল্লিশের উপরে বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি তৈরি করে ফেলেন এই অদ্ভুত ভাষাশৈলীর। তাঁর ভাষার শব্দ লগুলো ছিল উদ্ভট রকমের! যেমন- funferall, bisexcycle ইত্যাদি।
জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এই সাহিত্যিক, সমাজের বাস্তব ছবি দেখার জন্য ঘুরেছেন পথে-প্রান্তরে, দেশে দেশে।
জীবনের প্রথম ২০ বছর তিনি জন্মভূমি ডাবলিনেই কাটিয়েছেন। যে শহরকে তিনি একইসাথে পাগলের মতো ভালোবাসতেন এবং ঘৃণাও করতেন। তাঁর লেখাতেই উঠে এসেছে –
“Each of my books is a book about Dublin. Dublin is a city of scarcely 300,000 population, but it has become the universal city of my work.” (“আমার প্রতিটি বই ডাবলিন সম্পর্কে একটি বই। ডাবলিন খুব কমই 300,000 জনসংখ্যার একটি শহর, কিন্তু এটি আমার কাজের সার্বজনীন শহর হয়ে উঠেছে।”)
এ সময় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন অলিতে-গলিতে, পথে-প্রান্তরে। খুব কাছ দিয়ে দেখেছেন মানুষের জীবন। পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন শহর যেমন- ট্রিএস্ট, জুরিখ এবং প্যারিসের মতো শহরগুলোই হয়ে ওঠে তাঁর অস্থায়ী সব ঠিকানা।
প্রচণ্ড শব্দ সচেতন এই প্রথিতযশা কথা সাহিত্যিক তাঁর লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের গল্প, সমাজের গল্প। তাঁর লেখায় একধারে স্থান পেয়েছে সমাজের সব স্তরের মানুষের কথা বলেছেন এবং সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। খুব সাধারণ জীবনের বর্ণাঢ্যতা, আবার মানব মনের বিচিত্র সব চিন্তা প্রবাহ (যা stream of consciousness নামে পরিচিত)। এমনকি শেষ উপন্যাসে তিনি আবিষ্কারই করে ফেলেন এক বিচিত্র ভাষা শৈলীর। আজকের আয়োজন এই সাহিত্যিককে নিয়েই।
আবার তাঁর ‘ইউলিসিস’ উপন্যাস অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট হয়ে নিষিদ্ধও থেকেছিল দীর্ঘদিন। বিশ্ব সাহিত্যে বিখ্যাত ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসটি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ট রচনা হিসেবে বিবেচিত হয়। আধুনিক আভাঁ-গার্দ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল জেমস জয়েসের। সংস্কৃত, গ্রিক, আরবি সহ মোট সতেরোটি ভাষা জানতেন জেমস জয়েস। তাঁর আধুনিক লিখনশৈলী, সুব্যাপ্ত চিন্তার জগত আমেরিকান কবি এজরা পাউণ্ডকেও আকৃষ্ট করেছিল।
১৮৮২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি আয়ারল্যাণ্ডের ডাবলিনের ব্রাইটন স্ট্রীটে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জেমস জয়েসের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম ছিল জেমস অগাস্টিন অ্যালয়সিয়াস জয়েস (James Augustine Aloysius Joyce)। তাঁর বাবা জন স্টেনিসলস জয়েস একজন চমৎকার গায়ক ছিলেন কিন্তু গানকে কখনও তিনি নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেননি। উত্তরাধিকার সূত্রে জন স্টেনিসলস বিপুল সম্পত্তি পেয়েছিলেন। প্রথমে ডাবলিনে একটি ডিস্টিলারি কোম্পানির সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করলেও পরবর্তীতে তিনি ১৮৮৭ সালে ডাবলিন কর্পোরেশনের একজন রেট কালেক্টর হিসেবে নিযুক্ত হন। তখন তিনি পরিবারকে নিয়ে একটি ব্রে শহরে চলে যান। জেমস জয়েসের মায়ের নাম জন মেরি জেন মুরে (Mary Jane Murray)। স্টেনিসলস এবং মেরি জেনের দশটি সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন জেমস জয়েস। ১৮৯১ সালে জয়েস মাত্র নয় বছর বয়সে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন ‘এট টু, হিলি’ (Et Tu, Healy) নামে। এটি চার্লস টিউয়ার্ট পার্নেলের মৃত্যুতে লেখা। জয়েসের বাবা এই কবিতা ছাপিয়ে বন্ধুদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। সেইবছরই জয়েসের বাবার অতিরিক্ত মদ্যপান, পরিবার এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি উদাসীনতা তাঁদের পরিবারকে গভীর দারিদ্র্যের দিকে নিয়ে যায়৷ ‘স্টাবস গেজেট’-এ জয়েসের বাবা জন স্টেনিসলসকে ঋণখেলাপী এবং দেউলিয়া হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।
১৮৮৮ সালে কিলডার কাউন্টির ক্লেন শহরের নিকটবর্তী জেসুইটদের বোর্ডিং স্কুল ক্লঙ্গোয়েস উড কলেজে প্রাথমিক পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন জেমস জয়েস । কিন্তু ১৮৯২ সালে জয়েসের বাবা তাঁর পড়াশোনার খরচ যোগাতে না পারায় সেই প্রতিষ্ঠান ছাড়তে বাধ্য হন জেমস জয়েস। তখন বাড়িতেই পড়াশোনা চলতে থাকে জয়েসের। কখনো কখনো ডাবলিনের নর্থ রিচমন্ড স্ট্রীটের ক্রিশ্চিয়ান ব্রাদার্স ও’কনেল স্কুলে যেতেন জয়েস কারণ সেখানকার জেসুইট যাজক জন কনমী জয়েসের পরিবারকে চিনতেন। জন কনমী জয়েসের বাবার অনুরোধে তাঁকে ডাবলিনে জেসুইটদের স্বেচ্ছাসেবী মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেলভেডের কলেজে বিনামূল্যে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেন। ১৮৯৩ সালে জয়েস এবং তাঁর এক ভাই সেখানে পড়াশোনা শুরু করেন। বেলেভেডের কলেজে জয়েস দুবার মারিয়ান সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখানে জেসুইটদের শিক্ষা পরিকল্পনা দ্বারাই তাঁর বৌদ্ধিক শিক্ষা গড়ে উঠতে থাকে। এই বেলভেডের কলেজে ১৮৯৮ সালে ইংরেজি রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। বোঝা যায় তখন থেকেই তাঁর লিখন দক্ষতা উন্নত হচ্ছিল।যখন তিনি ডাবলিনের ইউনিভার্সিটি কলেজের ছাত্র, তখন থেকেই তিনি পুরোদমে বই রিভিউ, কবিতা, ছোটগল্প এগুলো লেখা শুরু করেন। কিন্তু এতে তো আর পেট চলবে না! তিনি প্যারিসে চলে গেলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়াশোনা করার জন্য। কিন্তু ফল হল উল্টো, লাইব্রেরিমুখী হবার বদলে সমানতালে ভিড় জমাতে শুরু করলেন মদখানা আর পতিতালয়ে।
১৮৯৮ সালে জেসুইটদের দ্বারাই পরিচালিত ইউনিভার্সিটি কলেজে ইংরেজি, ফরাসি এবং ইতালীয় ভাষা শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন জেমস জয়েস। সেখানে দার্শনিক থমাস অ্যাকুইনাসের লেখা দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। সেসময় ডাবলিনে বিভিন্ন সাহিত্য এবং নাট্যবৃত্তে অংশগ্রহণ করতেন জেমস। ১৯৯০ সালে প্রথম তাঁর লেখা প্রকাশিত হয় ‘দ্য ফোর্টনাইটলি রিভিউ’ কাগজে। লেখাটি ছিল হেনরিক ইবসেনের ‘হোয়েন উই ডেড অ্যাওকেন’-এর একটি সমালোচনা। ইবসেনের নাটক পাঠ করার জন্য নিজে নিজেই নরওয়েজিয়ান ভাষা শিখে ফেলেছিলেন তিনি। একজন অনুরাগী পাঠক হিসেবে হেনরিক ইবসেনকে একটি চিঠিও লেখেন জেমস জয়েস এবং পরে তিনি ‘আ ব্রিলিয়ান্ট কেরিয়ার’ নামে একটি নাটকও লেখেন কিন্তু তিনি নিজেই সেই পাণ্ডুলিপি নষ্ট করে দিয়েছিলেন। ১৯০১ সালের নভেম্বর মাসে তিনি ‘আইরিশ লিটারারি থিয়েটার সংস্থা’র টলস্টয়, ইবসেনদের নাটক মঞ্চস্থ করার ব্যাপারে উদাসীনতার সমালোচনা করে লেখেন ‘দ্য ডে অব দ্য রেবলমেন্ট’। ১৯০২ সালে জেমস জয়েস ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ডাবলিনের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি মেডিকেল স্কুলের লেকচারগুলি শুনতে শুরু করেন তিনি এবং প্যারিসে বিবলিওথেক-সেন্ট-জেনেভিয়ে লাইব্রেরিতে পড়াশোনার জন্য প্যারিসে থাকতে শুরু করেন। যদিও ১৯০৩ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে জয়েস ফিরে আসেন বাড়িতে। মায়ের মৃত্যুর পর জেমসের বাবা আরও বেশি মদ্যপানে বুঁদ হয়ে থাকতে শুরু করেন, ফলে তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়ে। সেসময় গ্রন্থ সমালোচনা করে জীবন নির্বাহ করতেন জেমস।
১৯০৪ সাল জয়েসের জীবনের এক উল্লেখযোগ্য বছর। সেবছরই ১০ই জুন তিনি নোরা বার্নাকেলের (Nora Barnacle) সঙ্গে পরিচিত হন। হঠাৎ করেই জয়েসের ভালো লেগে গেল গ্যালওয়ের এক অশিক্ষিত কিন্তু অত্যন্ত আবেদনময়ী নারী নোরা বার্নাকেলকে। নোরাও পড়ে গেলেন ভালোবাসার এক মায়াবী জালে। পরবর্তীতে জয়েস সম্পর্কে নোরার অভিব্যক্তি ছিল এমনই-
”electric blue eyes, yachting cap and plimsolls. But when he spoke, well then, I knew him at once for just another worthless Dublin boaster trying to chat up a country girl.”(“বৈদ্যুতিক নীল চোখ, ইয়টিং ক্যাপ এবং প্লিমসোলস। কিন্তু যখন সে কথা বলত, তখন আমি তাকে একবারে চিনতাম আর একজন অকেজো ডাবলিন অহংকারী একজন দেশের মেয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে।”)
নোরা ডাবলিনে চেম্বারমেইড হিসেবে কাজ করতেন। ১৬ই জুন প্রথমবার তাঁরা একসঙ্গে ঘুরতে যান। এই ঘটনার কথা জেমস জয়েস তাঁর ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসেও লিখেছিলেন।
ইউলেসিসের (Ulysses) নামকরণ করেছেন বিখ্যাত গ্রিক এক বীরত্বগাঁথা থেকে। ইউলেসিসে বর্ণনা করা হয়েছিল এক মহান গ্রিক বীরের ট্রয় যুদ্ধ জয় শেষে তাঁর নিজ দেশ ইথাকায় ফেরার উপাখ্যান। কিন্তু জয়েস পশ্চিমা উচ্চ সংস্কৃতির চর্চা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসে দেখিয়েছেন এক সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট। তাঁর ইউলিসিসের নায়ক কোন মহান সম্রাট অথবা কোন বীর নয়। তাঁর নায়ক এক সাদামাটা, দয়ালু, বোকা মানুষ; নাম তার লিওপারড ব্লুম। খুব ছোটোখাটো একটা চাকরি করা ব্লুমের চরিত্রে ত্রুটির কোন শেষ নেই। সে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়, তার স্ত্রী অন্যের সাথে সম্পর্কে জড়িত। ক্যাথলিক সমাজে ইহুদি ব্লুম উপেক্ষার পাত্র। কেউই তার দিকে ভালো নজরে তাকায় না। তারপরও লিওপারড স্বপ্ন দেখে একটি সুন্দর, হাসিখুশি জীবনের স্বপ্ন।
নায়কোচিত কোন গুণ না থাকা সত্ত্বেও জয়েস এই রকম ব্যক্তিত্বের দিকে ‘সমাজের দৃষ্টি’ নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তাঁর মতে, ব্লুমের অধিকার রয়েছে সমাজ থেকে যোগ্য সম্মান পাবার। অবশ্যই তাকে নিয়েও সমাজের ততটা আগ্রহ থাকা উচিত যতটা আগ্রহ থাকে মানুষের গ্রিক বীর ইউলিসিসের গল্পের প্রতি। জয়েজ বলেন,
”আমাদের সমাজ অত্যন্ত হীনভাবে তার উঁচু শ্রেণী নিয়ে সবসময়ই ব্যস্ত। কিন্তু লিওপারড ব্লুমও যে একজন মানুষ, জীবন যুদ্ধের একজন নায়ক, একথা সমাজ বিবেচনা করে না।”
জেমস জয়েস এই চরিত্রের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আমরা আমাজের জীবনে যে প্রতিদিনের কাজগুলো করি (যেমন- খাওয়া, নিজের দুঃখে ও মানুষের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, বাজার করা, কাপড় ধোয়া ইত্যাদি) এগুলো আদৌ ছোট কোন ব্যাপার নয়। আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করি তাহলে দেখতে পাবো এই ব্যাপারগুলো সুন্দর, গভীর এবং আসলেই প্রশংসার দাবীদার। আমাদের প্রতিদিনের জীবন ঐ গ্রিক বীরের তুলনায় কোন অংশে কম নয়। আমাদের প্রত্যেকের জীবনটা একেকটা ছোট ছোট যুদ্ধক্ষেত্র আর এখানে আমরাই সৈনিক। জয়েসের উপন্যাস আমাদের এই প্রচলিত নজর বা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কথা বলে। আমাদের নিজেদেরকেই নিজেদের সমাদর করা শিখতে হবে, এটা মেনে নিতে হবে যে আমাদের ক্ষুদ্র জীবনের নায়ক বা নিয়ন্ত্রক আমরাই।
নোরা এবং জেমসের এই সম্পর্ক টিকে ছিল জেমস জয়েসের মৃত্যুকাল পর্যন্ত।
ডাবলিন যে তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটা অংশ- বিষয়টি তিনি তাঁর বাবার মতোই কখনোই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। একটা স্বাধীন, সুন্দর ডাবলিনের স্বপ্ন দেখতেন তিনি ছোটবেলাতেই। বাবার মতোই তাঁরও সাঙ্গীতিক প্রতিভা ছিল এবং তিনি ‘ফিস সিওয়েল’ নামক এক আইরিশ সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। ১৯০৪ সাল থেকেই সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন জেমস এবং ঐ বছর ৭ই জানুয়ারি ‘আ পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট’ নামের একটি গদ্য বিখ্যাত ‘ডানা’ কাগজে প্রকাশের জন্য পাঠান তিনি, কিন্তু সেই লেখা প্রত্যাখাত হয়। বাইশ বার নাকচ হওয়া ছোটগল্পের বইটি ছাপাতে রাজি হন লন্ডনের এক প্রকাশক। পরবর্তীতে প্রথিতযশা মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ’A Portrait of the Artist’এর সম্পাদনার কাজ করেন।
তিনি তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘The Portrait of the Artist as a Young Man’এ বলেছেন, একজন শিল্পীর সত্যিকারের শিল্পী হয়ে উঠতে দুটি গুণ থাকা দরকার-
১। Integritas বা শিল্পী হিসেবে একজনের শৈল্পিক সত্ত্বার অখণ্ডতা।
২। Claritas বা পাঠকের কাছে একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতা।
তিনি আরও বলেছেন,”স্রষ্টা অনেক কণ্ঠে তোমার সাথে কথা বলেছেন, কিন্তু তুমি শুনতে পাও নি।”
সেই গদ্যটিকে তিনি যৌবনের প্রারম্ভে শুরু করা ‘স্টিফেন হিরো’ নামক এক কাহিনি-গদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে একটি উপন্যাস তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন যদিও তা সম্পূর্ণ করতে পারেননি তখন। এরপর ইয়েটসের লেখা ‘টু আয়ারল্যাণ্ড ইন দ্য কামিং টাইমস’ কবিতাটিকে একপ্রকার ব্যঙ্গ করে রচনা করেন ‘দ্য হোলি অফিস’ কবিতাটি। এই রচনাটির ভাগ্যেও প্রত্যাখান জোটে, এরপর তিনি ‘চেম্বার মিউজিক’ নামে একগুচ্ছ কবিতা রচনা করেন এবং সেটিও প্রত্যাখ্যাত হয়। ‘ডানা’ পত্রিকায় একটি এবং ‘দ্য স্পীকার’ কাগজে দুটি কবিতা প্রকাশ করতে পেরেছিলেন জেমস। কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্পও রচনা করছিলেন তিনি সমানভাবে। সেই সময় তিনটি গল্প—’দ্য সিস্টার্স’, ‘ইভলাইন’ এবং ‘আফটার দ্য রেস’, ‘আইরিশ হোমস্টিড’ পত্রিকায় উইলিয়াম রাসেল প্রকাশ করেছিলেন। ১৯০৭ সালে ‘চেম্বার মিউজিক’ নামক কবিতার বইটিই ছিল জেমস জয়েসের প্রথম প্রকাশিত বই। ১৯২৭ সালে ‘পোয়েমস পেনিয়াচ’ নামে তেরোটি ছোটো কবিতা সম্বলিত একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর।
নোরা এবং জেমস জয়েস বিবাহ না করেই আয়ারল্যাণ্ড ত্যাগ করেন এবং ১৯০৪ সালের অক্টোবরে একপ্রকার স্বেচ্ছা-নির্বাসন নেন তাঁরা। ইংল্যাণ্ডের এক এজেন্টের কাছে জেমস জানতে পারেন জুরিখে বার্লিটজ্ ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুলে শিক্ষকের একটি পদ খালি রয়েছে, কিন্তু সেখানে পৌঁছে জেমস জয়েস দেখেন যে পদটি ততদিনে পূর্ণ হয়ে গেছে। নোরা এবং জেমস এক সপ্তাহ জুরিখে অবস্থান করেন এবং বার্লিটজ স্কুলের ডিরেক্টর জেমস জয়েসকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকা ইতালির ট্রিয়েস্টের বার্লিটজ স্কুলের শাখায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ট্রিয়েস্টের স্কুলেও শূন্যপদ না থাকায় সেই স্কুলের ডিরেক্টর জেমসকে ক্রোয়েশিয়ার পুলায় একটি বার্লিটজ স্কুলে ব্যবস্থা করে দেন এবং পরবর্তীকালে তাঁকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির নৌ-ঘাঁটিতে পাঠান, যেখানে নৌ-অফিসারদের ইংরেজি শিক্ষা দিতেন জেমস জয়েস । সেসময় নোরা গর্ভবতী হয়। সময় পেলেই জেমস লেখালেখি করতে শুরু করেন, এই সময়ই ‘ক্লে’ নামে আরেকটি গল্প লেখেন তিনি। সব গল্পই ‘ডাবলিনার্স’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল পরবর্তীকালে। পুলা শহরটি ভালো না লাগায় ট্রিয়েস্টের বার্লিটজ্ স্কুলে পদ খালি হতেই সেখানে চলে আসেন জেমস এবং ইংরেজি পড়াতে থাকেন। ১৯২০ সাল পর্যন্ত ট্রিয়েস্টই জয়েসের প্রধান বাসস্থান ছিল। ১৯০৫ সালের ২৭ জুলাই জেমস এবং নোরার প্রথম সন্তান জর্জিয়ার জন্ম হয়। এসময় জেমস শত উত্থান-পতন সত্ত্বেও লেখা ছাড়েননি তিনি। ‘স্টিফেন হিরো’ উপন্যাসের ২৪টি অধ্যায় তিনি শেষ করেন এই সময় এবং ‘ডাবলিনার্স’-এর গল্পগুলিও ততদিনে প্রায় সমাপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ‘ডাবলিনার্স’ ছাপা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছিল বিস্তর। রিচার্ডসন নামে এক ব্যক্তি এই গল্পগ্রন্থ ছাপার জন্য চুক্তি করলেও পরে প্রকাশনার খ্যাতির ক্ষতি আশঙ্কা করে চুক্তি থেকে সরে আসেন।
১৯০৬ – ০৭ সালে জেমস রোমান ব্যাঙ্কের একজন করেপন্ডেসন্স ক্লার্ক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। রোমে থাকাকালীনই তিনি তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘দ্য ডেড’ রচনা করেন যা ‘ডাবলিনার্স’ গ্রন্থটির শেষ গল্প। সাত মাস রোমে কাটিয়ে ১৯০৭-এ তাঁরা ট্রিয়েস্টে ফিরে আসেন। এসময় ইংরেজি ভাষার একজন অর্ধ সময়ের প্রভাষক হিসেবে বার্লিটজে কাজ করেন এবং প্রাইভেট টিউশন করতে থাকেন। ১৯০৭ সালের ২৬শে জুলাই নোরা দ্বিতীয় সন্তান লুসিয়ার জন্ম দেয়। ১৯০৮ সালে কিছু সময়ের জন্য মদ্যপান ছেড়ে দিয়ে অসমাপ্ত ‘স্টিফেন হিরো’ লেখাটিকে ‘আ পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়ং ম্যান’ নামের উপন্যাস হিসেবে গড়ে তুলতে থাকেন তিনি।
১৯০৯ সালের অক্টোবরে আয়ারল্যাণ্ডের ডাবলিনে প্রথম সিনেমা হল ‘ভোল্টা সিনেম্যাটোগ্রাফ’-এর উদ্ভব তাঁরই হাত ধরে। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অবশেষে ১৯১৪ সালের ১৫ই জুন ‘ডাবলিনার্স’ প্রকাশিত হয় এবং বিখ্যাত লেখক এজরা পাউণ্ডের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এজরা পাউণ্ড ‘আ পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়ং ম্যান’ উপন্যাসটিকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের জন্য লণ্ডনের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘দ্য ইগোইস্ট’-এর সম্পাদককে রাজি করালে জয়েস পুরোদমে তা লিখে শেষ করেন এবং ১৯১৪ ও ১৯১৫ সাল জুড়ে তা প্রকাশিত হয়। ১৯১৬ সালে বি.ডব্লিউ. হুয়েবশ্চ দ্বারা এটি গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সন্তানাদি নিয়ে জুরিখে বসবাস করতেন জেমস জয়েস ও নোরা। তখন অর্থকষ্টের সময় এজরা পাউণ্ড, ইয়েটস এবং ‘ইগোয়িস্ট’ পত্রিকার সম্পাদকদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা লাভ করেছিলেন জেমস জয়েস । যুদ্ধের সময়, জুরিখে অবস্থানকালে ক্রমে ক্রমে বিখ্যাত উপন্যাস, বিশ্ব সাহিত্যের বিস্ময় ‘ইউলিসিস’ গড়ে উঠতে থাকে। আমেরিকান জার্নাল ‘দ্য লিটল রিভিউ’তে ১৯১৮ সালের মার্চ থেকে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বৃহৎ উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। অনেক বাধা-বিপত্তির পর ১৯২১ সালে সিলভিয়া বিচ জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করলেও ১৯২২ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে এবং আমেরিকায় অশ্লীলতার অভিযোগে ‘ইউলিসিস’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৩৪ সালে আদালতে বিচারপতি এম.উলসে যখন ঘেষণা করেন ‘ইউলিসিস’ পর্নোগ্রাফি নয়, তারপর থেকেই আমেরিকায় আবার পাঠকেরা এই উপন্যাস পড়তে থাকেন। ১৯৩৬ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে ‘ইউলিসিস’ কালো তালিকা থেকে মুক্তি পায়। ১৯২৩ সালেই একটি পরীক্ষামূলক উপন্যাসের কাজ শুরু করেন, যেটি ‘ফিনেগানস ওয়েক’ নামে ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়। ‘এক্সাইল’ নামে তাঁর একটিমাত্র নাটক ১৯১৮তে প্রকাশ পায়। আয়ারল্যাণ্ডের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন জেমস জয়েস । নাৎসি উৎপীড়ন থেকে অনেক ইহুদিকে রক্ষাও করেছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয়ের ফলে নাৎসি দখলদারিত্বের জন্যই জয়েসরা চলে আসেন জুরিখে।
তাঁর গ্রন্থাবলী
১). চেম্বার মিউজিক (কবিতা, ১৯০৭)
২). ডাবলিনারস (ছোট-গল্প সংকলন, ১৯১৪)
৩). অ্যা পোর্টেট অব দ্য আর্টিস্ট এস অ্যা ইয়াং ম্যান (উপন্যাস, ১৯১৬)
৪). এক্সাইলস (নাটক, ১৯১৮)
৫). ইউলিসিস (উপন্যাস, ১৯২২)
৬). পমেস পেনিইচ (কবিতা, ১৯২৭)
৭). কালেকটেড পোয়েমস (কবিতা ১৯৩৬)
৮). ফিনেগানস ওয়েক (উপন্যাস, ১৯৩৯)
মরণোত্তর প্রকাশনা
৯). স্টিফেন হিরো (অগ্রদূত অ্যা পোর্ট্রেট; রচনাকাল ১৯০৪–০৬, প্রকালকাল ১৯৪৪)
১৯৪১ সালের ১৩ জানুয়ারি জুরিখে ডুওডোনাল আলসারের জন্য অস্ত্রোপচারের ফলে ৫৯ বছর বয়সে জেমস জয়েস এর মৃত্যু হয়।
————————————————-
* [কৃতজ্ঞতা ও ঋণস্বীকার – সজল পাইক ও উইকিপিডিয়া]