অচ্ছোদসরসীনীরে রমণী যেদিন
নামিল স্নানের তরে , বসন্ত নবীন
সেদিন ফিরিতেছিল ভুবন ব্যাপিয়া
প্রথম প্রেমের মতো কাঁপিয়া কাঁপিয়া
ক্ষণে ক্ষণে শিহরি শিহরি । সমীরণ
প্রলাপ বকিতেছিল প্রচ্ছায়সঘন
পল্লবশয়নতলে , মধ্যাহ্নের জ্যোতি
মূর্ছিত বনের কোলে , কপোতদম্পতি
বসি শান্ত অকম্পিত চম্পকের ডালে
ঘন চঞ্চুচুম্বনের অবসরকালে
নিভৃতে করিতেছিল বিহ্বল কূজন ।
তীরে শ্বেতশিলাতলে সুনীল বসন
লুটাইছে এক প্রান্তে স্খলিতগৌরব
অনাদৃত — শ্রীঅঙ্গের উত্তপ্ত সৌরভ
এখনো জড়িত তাহে — আয়ুপরিশেষ
মূর্ছাম্বিত দেহে যেন জীবনের লেশ —
লুটায় মেখলাখানি ত্যজি কটিদেশ
মৌন অপমানে । নূপুর রয়েছে পড়ি ,
বক্ষের নিচোলবাস যায় গড়াগড়ি
ত্যজিয়া যুগল স্বর্গ কঠিন পাষাণে ।
কনকদর্পণখানি চাহে শূন্য-পানে
কার মুখ স্মরি । স্বর্ণপাত্রে সুসজ্জিত
চন্দনকুঙ্কুমপঙ্ক , লুণ্ঠিত লজ্জিত
দুটি রক্ত শতদল , অম্লানসুন্দর
শ্বেতকরবীর মালা — ধৌত শুক্লাম্বর
লঘু স্বচ্ছ , পূর্ণিমার আকাশের মতো ।
পরিপূর্ণ নীল নীর স্থির অনাহত —
কূলে কূলে প্রসারিত বিহ্বল গভীর
বুক-ভরা আলিঙ্গনরাশি । সরসীর
প্রান্তদেশে , বকুলের ঘনচ্ছায়াতলে
শ্বেতশিলাপটে , আবক্ষ ডুবায়ে জলে
বসিয়া সুন্দরী , কম্পমান ছায়াখানি
প্রসারিয়া স্বচ্ছ নীরে — বক্ষে লয়ে টানি
সযত্নপালিত শুভ্র রাজহংসীটিরে
করিছে সোহাগ — নগ্ন বাহুপাশে ঘিরে
সুকোমল ডানা দুটি , লম্বা গ্রীবা তার
রাখি স্কন্ধ- ‘ পরে , কহিতেছে বারম্বার
স্নেহের প্রলাপবাণী — কোমল কপোল
বুলাইছে হংসপৃষ্ঠে পরশবিভোল ।
চৌদিকে উঠিতেছিল মধুর রাগিণী
জলে স্থলে নভস্তলে ; সুন্দর কাহিনী
কে যেন রচিতেছিল ছায়ারৌদ্রকরে
অরণ্যের সুপ্তি আর পাতার মর্মরে ,
বসন্তদিনের কত স্পন্দনে কম্পনে
নিশ্বাসে উচ্ছ্বাসে ভাষে আভাসে গুঞ্জনে
চমকে ঝলকে ।
যেন আকাশবীণার
রবিরশ্মিতন্ত্রীগুলি সুরবালিকার
চম্পক-অঙ্গুলি-ঘাতে সংগীতঝংকারে
কাঁদিয়া উঠিতেছিল — মৌন স্তব্ধতারে
বেদনায় পীড়িয়া মূর্ছিয়া ।
তরুতলে
স্খলিয়া পড়িতেছিল নিঃশব্দে বিরলে
বিবশ বকুলগুলি ; কোকিল কেবলি
অশ্রান্ত গাহিতেছিল — বিফল কাকলি
কাঁদিয়া ফিরিতেছিল বনান্তর ঘুরে
উদাসিনী প্রতিধ্বনি ছায়ায় অদূরে
সরোবরপ্রান্তদেশে ক্ষুদ্র নির্ঝরিণী
কলনৃত্যে বাজাইয়া মাণিক্যকিংকিণী
কল্লোলে মিশিতেছিল ; তৃণাঞ্চিত তীরে
জলকলকলস্বরে মধ্যাহ্নসমীরে
সারস ঘুমায়ে ছিল দীর্ঘ গ্রীবাখানি
ভঙ্গিভরে বাঁকাইয়া পৃষ্ঠে লয়ে টানি
ধূসর ডানার মাঝে ; রাজহংসদল
আকাশে বলাকা বাঁধি সত্বর-চঞ্চল
ত্যজি কোন্ দূরনদীসৈকতবিহার
উড়িয়া চলিতেছিল গলিতনীহার
কৈলাসের পানে ।
বহু বনগন্ধ বহে
অকস্মাৎ শ্রান্ত বায়ু উত্তপ্ত আগ্রহে
লুটায়ে পড়িতেছিল সুদীর্ঘ নিশ্বাসে
মুগ্ধ সরসীর বক্ষে স্নিগ্ধ বাহুপাশে ।
মদন , বসন্তসখা , ব্যগ্র কৌতূহলে
লুকায়ে বসিয়া ছিল বকুলের তলে
পুষ্পাসনে , হেলায় হেলিয়ে তরু- ‘ পরে
প্রসারিয়া পদযুগ নবতৃণস্তরে ।
পীত উত্তরীয়প্রান্ত লুণ্ঠিত ভূতলে ,
গ্রন্থিত মালতীমালা কুঞ্চিত কুন্তলে
গৌর কণ্ঠতটে — সহাস্য কটাক্ষ করি
কৌতুকে হেরিতেছিল মোহিনী সুন্দরী
তরুণীর স্নানলীলা । অধীর চঞ্চল
উৎসুক অঙ্গুলি তার , নির্মল কোমল
বক্ষস্থল লক্ষ্য করি লয়ে পুষ্পশর
প্রতীক্ষা করিতেছিল নিজ অবসর ।
গুঞ্জরি ফিরিতেছিল লক্ষ মধুকর
ফুলে ফুলে , ছায়াতলে সুপ্ত হরিণীরে
ক্ষণে ক্ষণে লেহন করিতেছিল ধীরে
বিমুগ্ধনয়ন মৃগ — বসন্ত-পরশে
পূর্ণ ছিল বনচ্ছায়া আলসে লালসে ।
জলপ্রান্তে ক্ষুব্ধ ক্ষুণ্ন কম্পন রাখিয়া ,
সজল চরণচিহ্ন আঁকিয়া আঁকিয়া
সোপানে সোপানে , তীরে উঠিলা রূপসী —
স্রস্ত কেশভার পৃষ্ঠে পড়ি গেল খসি ।
অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের তরঙ্গ উচ্ছল
লাবণ্যের মায়ামন্ত্রে স্থির অচঞ্চল
বন্দী হয়ে আছে , তারি শিখরে শিখরে
পড়িল মধ্যাহ্নরৌদ্র — ললাটে অধরে
ঊরু- ‘ পরে কটিতটে স্তনাগ্রচূড়ায়
বাহুযুগে সিক্ত দেহে রেখায় রেখায়
ঝলকে ঝলকে । ঘিরি তার চারি পাশ
নিখিল বাতাস আর অনন্ত আকাশ
যেন এক ঠাঁই এসে আগ্রহে সন্নত
সর্বাঙ্গে চুম্বিল তার , সেবকের মতো
সিক্ত তনু মুছি নিল আতপ্ত অঞ্চলে
সযতনে — ছায়াখানি রক্তপদতলে
চ্যুত বসনের মতো রহিল পড়িয়া ।
অরণ্য রহিল স্তব্ধ , বিস্ময়ে মরিয়া ।
ত্যজিয়া বকুলমূল মৃদুমন্দ হাসি
উঠিল অনঙ্গদেব ।
সম্মুখেতে আসি
থমকিয়া দাঁড়ালো সহসা । মুখপানে
চাহিল নিমেষহীন নিশ্চল নয়ানে
ক্ষণকাল-তরে । পরক্ষণে ভূমি- ‘ পরে
জানু পাতি বসি , নির্বাক্ বিস্ময়ভরে ,
নতশিরে , পুষ্পধনু পুষ্পশরভার
সমর্পিল পদপ্রান্তে পূজা-উপচার
তূণ শূন্য করি । নিরস্ত্র মদনপানে
চাহিলা সুন্দরী শান্ত প্রসন্ন বয়ানে ।