বিচারের বাণী
চারুলতা আজ বিচারপতির আসন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে মেয়ের সাথে শেষ দেখা করতে চলেছেন দিল্লি। ছোটবেলায় থাকতেন কোপাই নদীর ধারে জাঙলা গ্ৰামে। এক্কেবারে অজপাড়াগাঁয়ে। কাহার শ্রেণীর কন্যা। আইন পড়তে কোলকাতায় আসে। ভীষণ মেধাবী, শরীরের রূপটান নজর কাড়ে।
বাবা বড়বাজারে কাজ করতেন। ভাড়াবাড়িতে বহুকষ্টে বাবার সাথে থেকে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আদালতে প্র্যাক্টিস করতে থাকে। এইসময় তার আয়কর দপ্তরের মুখপাত্র নীলোৎপল চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ হয় আইন উপদেষ্টা হিসেবে। ক্রমে তাঁরা ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। চারুলতা কোলকাতায় স্থায়ীভাবে স্থিত হওয়ার জন্য একপ্রকার তাড়াহুড়ো করে নীলোৎপলকে বিয়ে করে।
নীলোৎপল তাঁর অতীত সম্মন্ধে জানায় তাঁর স্ত্রী সুইসাইড করে মারা গেছে, মানসিক রোগী ছিল।
কিন্তু বিয়ের পর প্রতিবেশীদের কাছে চারুলতা জানতে পারে নীলোৎপলের অন্য মেয়ের সঙ্গে দহরম মহরম থাকায় প্রায়ই অশান্তি হতো এবং একদিন নীলোৎপলই স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারে।
কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন দিলে স্ত্রী বাঁচবার আশায় তাঁর হাত ধরেছিলো, সে ঠেলে সরিয়ে বাথরুমে চলে যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঝি এসে দৃশ্য দেখে দাদাবাবু বলে চীৎকার করলে স্ত্রী শুধু বলতে পেরেছিল, দাদাবাবুই একাজ করেছে, হাত বাড়িয়েছিলাম বাঁচতে, বাথরুমে চলে গেল।
ঝিয়ের চীৎকারে নীলোৎপল বাথরুম থেকে বেরিয়ে চাদর চাপা দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। দুদিন কোমায় থেকে মারা যায়। এক নেতার সাহায্যে বিষয়টা সুইসাইড বলে চালিয়ে দেয়।
চারুলতা গ্ৰামের মেয়ে, তারপর জাতে কাহার। তাঁদের গ্ৰামেও এমন নজির আছে অনেক। নীচুজাত বলে অবহেলাও জোটে। সব শুনে নীলোৎপলের প্রতি ভালোবাসা কিছুটা হলেও আলগা হয়। কিছু বুঝতে না দিয়ে সংসার করে। কারণ সে জানে নীচু জাতের মেয়ে সে, তাকে প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে।
নীলোৎপলের কথাবার্তা সুন্দর। তবে একটু মেয়ে ঘেঁষাও বটে। চারুলতা সবই নজর করে।
সময়ের বিবর্তে সংসার সন্তান নিয়ে তাঁরা সুখী। একটাই মেয়ে, দিল্লিতে থাকে। নীলোৎপলের বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া বরাবরের অভ্যাস। অবসরের পর তার আরও বেড়েছে। নিজের মত জীবনযাপন করছে।
তিন বন্ধু মিলে একসময় ভালকিমাচান বেড়াতে গিয়ে ওখানকার আদিবাসী এক মেয়েকে পটিয়ে রাতে ডেকে মদ খেয়ে ফূর্তি আনন্দ করে। আদিবাসী নারীদের অভিযোগ মেয়ের শ্লীলতাহানি ও যৌননির্যাতন হয়েছে। ব্যাস, আদালতে মামলা গড়ায়।
বিচারকের আসনে তখন চারুলতা। নীলোৎপল স্ত্রীকে সব মিথ্যা বলে বোঝায়। ওদিকে আদিবাসীরা ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করে।
মামলা চলাকালীন চারুলতার সতীনের আগুনে পুড়ে মৃত্যুর কাহিনী মনে পড়লে মুহূর্তে রায় দেয়, অভিযুক্তদের পাঁচ বছরের হাজতবাস আর নির্যাতিতাকে কুড়ি হাজার টাকা জরিমানা প্রদান। অনাদায়ে আরও ছয় মাস জেল। নীলোৎপল হতবাক।
এতদিনে মনে প্রশান্তি চারুলতার। প্রথম বৌকে পুড়িয়ে মারা আসামীকে বিচারের বাণী শুনিয়ে সতীনকে মনে মনে প্রণাম করলো চারুলতা।
মায়ের রায় শুনে মেয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেয়।
আজ পাঁচ বছর পর নীলোৎপল ছাড়া পাচ্ছে। তাই চারুলতা স্বেচ্ছাবসর নিয়ে দিল্লিতে চলেছেন মেয়েকে তার বাবার অতীত জানাতে। নীলোৎপলকেও চিঠি লেখে। তারপর শেষ জীবন কাটাবে বৃদ্ধাশ্রমে নিরালায়।