বিগ্রহ রহস্য : 08
দীনগোপাল গেট থেকে নিচের রাস্তায় নেমেছেন, ঝোপের আড়াল থেকে কর্নেল বেরিয়ে বললেন–গুড মর্নিং দীনগোপালবাবু!
দীনগোপাল চমকে উঠেছিলেন। বললেন–ও! ডিটেকটিভ মশাই!
মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছেন? কর্নেল সহাস্যে বললেন–আমারও একই অভ্যাস। চলুন, গল্প করতে করতে যাই!
–গপ্পের মেজাজ নেই। তাছাড়া আমি একা বেড়ানোই পছন্দ করি।
দীনগোপাল স্থির দাঁড়িয়ে গেছেন। কর্নেল বললেন–ওই টিলার পিপুল গাছের তলার বেদিতে কী আছে দীনগোপালবাবু যে, রোজ ভোরে একবার করে গিয়ে দেখে আসেন? নিশ্চয় ঈশ্বরচিন্তায় মনোনিবেশ করতে যান না! আপনি তো নাস্তিক!
দীনগোপাল আস্তে বললেন–আপনি কী বলতে চান?
–এভাবে দাঁড়িয়ে আমরা বিতর্ক বাধালে লোক জড়ো হবে। এবার কর্নেল অমায়িক কণ্ঠস্বরে বললেন।চলুন না, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
দীনগোপাল তবু দাঁড়িয়ে রইলেন।
কর্নেল বললেননবকে গোপনে একটা মাফলার কিনে আনতে বলেছিলেন কেন দীনগোপালবাবু?
–আপনি বড় বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন কিন্তু!
নব পুলিশকে নিজেই আগ বাড়িয়ে বলেছে, সে অবিকল প্রভাতবাবুর মাফলারটার মতো একটা মাফলার কিনে সোফার তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। নবর কৈফিয়ত হলো, সে প্রভাতবাবুকে পুলিশের সন্দেহ থেকে বাঁচাতে এ কাজ করেছে। এখন কথা হলো, নবর এ গরজ কেন? এক হতে পারে, সে। প্রভাতবাবুর সঙ্গে কোনও চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। কিন্তু এটা তার চরিত্রের সঙ্গে মানায় না। সে অসৎ লোক হলে শান্তর বালিশের তলায় লুকনো সোনার ঠাকুর নিজেই হাতাতো। তা সে করেনি। আপনাকে দিয়েছিল। কাজেই এটা স্পষ্ট যে সে তার মনিবের হুকুমেই মাফলারটা কিনে নিয়ে গিয়ে…
–আপনি থামুন! বলে দীনগোপাল পা বাড়ালেন।
কর্নেল তাকে অনুসরণ করে বললেন দীনগোপালবাবু, নব আগ বাড়িয়ে নিজেই মাফলার কেনার দায় নিজের ঘাড়ে নিয়েছে। কারণ তার আশঙ্কা, আপনার কোনও বিপদ ঘটতে পারে–যেহেতু সে আপনার বাড়িতে আর নেই, থানার লক-আপে বন্দী। নব খুব বুদ্ধিমান। সে একটা আভাস দিয়েছে।
দীনগোপাল ঘুরে বললেন–আমার বিপদ হবে না।
–দীনগোপালবাবু! আপনি কেন প্রভাতবাবুকে পুলিশের সন্দেহ থেকে বাঁচাতে চেয়েছেন?
বলব না।
–প্রভাতবাবুর গলার ডোরাকাটা মাফলার ফাঁস করে শান্তর বডি কড়িকাঠে লটকানো হয়েছিল। কাজেই প্রভাতবাবুর প্রতি পুলিশের সন্দেহ স্বাভাবিক। আমারও সন্দেহ স্বাভাবিক। সেই সন্দেহ সত্যে পরিণত হয়েছে। পাইপ পরীক্ষার সময় উনি ইচ্ছে করেই আমাদের সামনে মরচে-ধরা পাইপ গুঁড়ো করার ছলে হাতে রক্তপাত ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু একটা হাতে। অথচ আপনার ঘরে গিয়ে দেখেছি ওঁর দুহাতের আঙুলে ব্যান্ডেজ। তার মানে, উনিই ভাঙা জানালার পাইপ বেয়ে নেমে গিয়েছিলেন! একটা হাতের আঙুল কেটে রক্ত পড়েছিল। সেটা গোপন করার সুযোগ ছাড়েননি। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তাড়াহুড়োর দরুন অন্য হাতের আঙুলে রক্ত ঝরালেন। তার মানে, প্রভাতবাবুই শান্তকে নিজের মাফলারে কড়িকাঠে ঝোলান। আত্মহত্যার কেস সাজানো।
–দীনগোপাল নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে শুনছিলেন। গলার ভেতর বললেন কী অদ্ভুত কথা! প্রভাত আমাকে কাল বলল, সে নিচের ঘরে সোফায় ঘুমিয়ে থাকার সময় তার গলার মাফলার চুরি করেছে শান্তর খুনী।
কর্নেল তার কথার ওপর বললেন না। তা সত্য নয়।
দীনগোপাল চটে গেলেন। কী বাজে কথা বলছেন! ভোর ছটায় মর্নিং ওয়াকে বেরুনোর সময় আমি ওর হাতের কাছ থেকে বল্লমটা নিয়ে গিয়ে লনে পুঁতে দিয়েছিলাম। ও টেরই পায়নি! কাজেই ওর গলা থেকে মাফলার খুলে শান্তকে মেরে কড়িকাঠে লটকে ওকেই কি দায়ী করার কারসাজি নয় খুনীর? প্রভাতের ঘুম মানে মড়া। তার প্রমাণ আমিও হাতে-নাতে পেয়েছিলাম। কাজেই প্রভাত যখন গতকাল আমাকে বলল, তার মাফলার হারিয়েছে এবং সেটাই খুনী শান্তর গলায় বেঁধেছিল, তখন তাকে বাঁচানো আমার কর্তব্য মনে হয়েছিল।
–গতকাল সকালে নীতার চোখে পড়ে প্রভাতবাবুর মাফলার নেই এবং সেটা ডোরাকাটা মাফলার।
হ্যাঁ। প্রভাত বলল, মাফলারের কথা তার খেয়ালই ছিল না! আমি জানি প্রভাতের বড্ড ভুলো মন।
–প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা নিজের মাফলারের কথা ভুলে থাকা! শান্তর গলায় একইরকম মাফলার দেখেও সন্দেহ না জাগা! আপনিই বলুন দীনগোপালবাবু, এ কি বিশ্বাসযোগ্য?
দীনগোপাল আড়ষ্টভাবে বললেন–কিন্তু আমি ওর হাতের কাছ থেকে বল্লমটা নিলেও ও টের পায়নি। কাজেই ওর কথা বিশ্বাস করেছিলাম।
কর্নেল একটু হাসলেন।–প্রভাতবাবু ঠিকই টের পেয়েছিলেন। সবটাই ওঁর অভিনয়। মাফলারের ব্যাপারটা ওঁর প্রতি সন্দেহ জাগাবে জানতেন, তাই ঘুমের ভান করে পড়েছিলেন।
দীনগোপাল চঞ্চল হয়ে উঠলেন। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। প্রভাত কেন নিজের গলার মাফলারে শান্তকে লটকে আত্মহত্যার কেস সাজাল? ও নির্বোধ। কিন্তু এত বেশি নির্বোধ?
–তাড়াহুড়ো করা ওঁর স্বভাব। ভাবেননি কী করছেন। পরে যখন বুঝেছিলেন ভুল করে ফেলেছেন, তখন আর উপায় নেই। শান্তর ঘরের দরজা ভেতর থেকে নিজেই বন্ধ করে পাইপ বেয়ে নেমে গেছেন। পাইপের অবস্থাও বুঝেছেন। পাইপ বেয়ে আবার উঠে যাওয়ার রিস্ক ছিল। নিজের মাফলার ব্যবহারে ওঁর হঠকারী নাটুকে চরিত্রের পরিচয় মেলে।
–কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, প্রভাত কেন শান্তকে খুন করবে? দীগোপাল দৃঢ়কণ্ঠে বললেন। আপনার বুদ্ধি আছে। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই কোথাও ভুল করছেন।
না দীনগোপালবাবু!
দীনগোপাল খাপ্পা হয়ে বললেন–প্রভাত খুনী?
–তাকে আমি খুনী বলেছি কি? তবে তিনিই আত্মহত্যার কেস সাজিয়েছিলেন।
হেঁয়ালি! খালি প্যাচালো কথাবার্তা।
–হেঁয়ালি নয় দীনগোপালবাবু! প্রভাতবাবু খুনীকে বাঁচাতে ও কাজ করেছিলেন। তার মানে, তিনি জানেন খুনী কে!
–আমার মেজাজ খারাপ করে দিলেন! দীনগোপাল পা বাড়িয়ে বললেন। এখনই গিয়ে প্রভাতকে চার্জ করছি।
না, না! এ ভুল করবেন না, আমার প্ল্যান ভেস্তে যাবে।
–কী আপনার প্ল্যান?
–আজ রাত্রে, ধরুন ন’টা নাগাদ আপনি ওই টিলার মাথায় পিপুলতলার বেদিটার কাছে চুপিচুপি যাবেন। খুনীর জন্য আমি একটা ফাঁদ পাততে চাইছি, দীনগোপালবাবু! আপনার সহযোগিতা চাই।
দীনগোপাল ঢোক গিলে বললেন–ওখানে কেন?
কর্নেল হাসলেন। ওখানেই আপনি কোথাও সোনার ঠাকুর লুকিয়ে রেখেছেন, খুনীর বিশ্বাস।
দীনোপাল মুখ নামিয়ে গলার ভেতর বললেন–সে কেমন করে জানবে?
–এই জানাজানিটা রিলেপদ্ধতিতে হয়েছে।
–ফের হেঁয়ালি করছেন?
প্রসূন হনিমুনে এসে সোনার ঠাকুরের কথা জানতে পেরেছিল। সে আপনাকে ফলো করেছিল। কিন্তু সঠিক জায়গাটি জানতে পারেনি। তবে টিলাটির কোথাও আপনি ঠাকুর লুকিয়ে রাখেন, এটুকু তার জানা। এর পর নীতার সঙ্গে মিটমাটের জন্য সে শাস্ত্র সাহায্য চায়। শান্তকে সে হারানো ঠাকুর উদ্ধারের ব্যাপারে সাহায্য করতে চায়। যাই হোক, শান্ত বেঁচে নেই। শান্তর কাছ থেকেই তার খুনী জানতে পারে একটা হাফ কিলোগ্রাম ওজনের নিরেট সোনার ঠাকুরের কথা। খুনী ভেবেছিল, শান্তকে মেরে ওটা হাতাবে। শান্তর কাছে প্রসূনের চিঠিতে আভাসে লেখা ছিল কোন এরিয়ায় ওটা লুকিয়ে রেখেছেন আপনি। কিন্তু খুনী ভেবেছিল, চিঠিটাতে একজ্যাক্ট স্পট লোকেট করা আছে। তাই শান্তকে খুন করে তার জিনিসপত্র হাতড়ে একাকার করে সে। তার পোশাক তন্নতন্ন করে খোঁজে। না পেয়ে মাফলারটার দিকে চোখ পড়ে। হ্যাঁ, দীনগোপালবাবু! সাবধানতাবশে মাফলারটার ভেতর শান্ত প্রসূনের চিঠি এবং এরিয়ার ম্যাপ এঁকে লুকিয়ে রেখেছিল। ওতে হাত দিয়েই খুনী লুকনো কাগজ টের পায়। এক ঝটকায় ওটা ব্র্যাকেট থেকে তুলে নেয়। সোয়েটারের ভেতর লুকিয়ে ফেলে। কিন্তু পরে মাফলার ছিঁড়ে কাগজগুলো বের করে সে বুঝতে পারে, ঠকে গেছে। ওতে হিন্ট আছে মাত্র।
দীনগোপাল অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন–এমনভাবে বলছেন যেন আপনিও তখন ও-ঘরে ছিলেন!
কর্নেল হাসলেন।–তথ্য জোড়াতালি দিয়ে জেনেছি। ঘটনার দিন সকালে আমি পশ্চিমের মাঠে শান্তর মাফলারটা পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। মাফলারটা ছেঁড়া ছিল। মাঠে ভেঁড়াখোঁড়া মাফলার পড়ে থাকা নিয়ে আমার মাথাব্যথার কারণ ছিল না। তাছাড়া তখনও জানতাম না আপনার বাড়িতে কী ঘটেছে।
দীনগোপাল চার্জ করার ভঙ্গিতে বললেন–এত যখন জানেন, তখন আপনিও জানেন খুনী কে। কিন্তু তাকে ধরিয়ে দিচ্ছেন না কেন?
–খুনীকে ধরার আগে একটু খেলা করা আমার চিরাচরিত স্বভাব দীনগোপালবাবু! সত্যি বলতে কী, মাঝে মাঝে এই যে শৌখিন গোয়েন্দাগিরি করে থাকি, সেটা আমার একধরনের প্রমোদ। তাস নিয়ে পেসে খেলা!
–আপনি আমাকে লাস্ট কার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। দীনগোপাল রুষ্ট হয়ে বললেন। আমি আপনার তুরুপের তাস!
ব্যাপারটা এভাবে নেবেন না প্লিজ! কর্নেল অমায়িক কণ্ঠস্বরে বললেন। আমি আপনার সাহায্য চাইছি শুধু।
–ঠিক আছে। কিন্তু প্রভাত সব জেনেও চুপ করে আছে কেন? ও কোনও কথা আমাকে গোপন করে না। এমন সাংঘাতিক কথা আমাকে জানাল না? কেন?
কর্নেল হাসলেন। আমার অনুমান আছে কিছু, হাতে তথ্য নেই। থাকলে জোর দিয়ে বলতে পারতাম কেন এমন করে চেপে রেখেছেন উনি।
অনুমানটাই শোনা যাক।
–পরশু রাত্রে ভোর চারটে থেকে ছ’টার মধ্যে শান্তবাবু খুন হয়েছেন। প্রভাতবাবু ভোর চারটেতে তার বাহিনী ডিসপার্স করে সোফায় শুয়ে পড়েন। কেমন তো?
–হ্যাঁ। তাই শুনেছি।
–তারপর উনি যেভাবেই হোক জানতে পারেন, ওপরে কিছু ঘটছে। আপনার বাড়িটা পুরনো। ওপরতলায় কিছু সন্দেহজনক শব্দ হলে নীচের তলা থেকে শোনা খুবই সম্ভব। তাছাড়া প্রভাতবাবু নাটুকে চরিত্রের এবং হটকারী স্বভাবের মানুষ।
–ঠিক ধরেছেন। সেজন্যই রাজনীতি করে কিছু বরাতে জোটাতে পারেনি।
–প্রভাতবাবু ওপরে গিয়েই খুনীকে দেখতে পান। খুনী এমন লোক, তাকে দেখেই হতবাক হয়ে পড়েন। সেই সুযোগে খুনী তার হাতে-পায়ে ধরে তোক, অথবা…
–অথবা কী? দীনগোপাল মারমুখী হয়ে প্রশ্নটা করলেন।
–প্রভাতবাবুর আর্থিক অবস্থা হয়তো ভাল নয়।
–মোটেও নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামী পেনসন জুটিয়েছিল, তাই রক্ষা। নইলে না খেয়ে মরত।
–তাহলে বলব, দুটোই তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। একটা হলো, খুনীর অনুনয়-বিনয় খুনী তাঁর স্নেহভাজনও বটে। দ্বিতীয়ত, সে তাকে সোনার ঠাকুরের ভাগ দিতে চেয়েছিল। আমার ধারণা, এই দুটো কারণেই প্রভাতবাবু তাকে বাঁচাতে তাড়াহুড়ো করে আত্মহত্যার কেস সাজান। কিন্তু নিজের বোকামি টের পান, যখন নীতা তাঁকে মাফলারের কথাটা বলে। তিনি বুঝতে পারেন, ব্যপারটা আর চাপা থাকবে না।
আপনার অনুমানে যুক্তি আছে বটে!
–এতে খুনীর হাতে ব্ল্যাকমেল্ড হওয়ার ঝুঁকিও টের পান প্রভাতবাবু। খুনী তাঁকে সম্ভবত তারপর আড়ালে শাসিয়েও থাকবে। মাফলারটা প্রভাতবাবুকে। আইনত খুনী সাব্যস্ত করে কি না, বলুন? ফলে প্রভাতবাবু আরও ভয় পেয়ে আপনার শরণাপন্ন হন। একটা ডোরাকাটা মাফলার আপনার সাহায্যে যোগাড় করেন। এও প্রভাতবাবুর হটকারিতা!
দীনগোপাল আবার রুষ্ট হয়ে বললেন–কিন্তু নবটার কী আক্কেল! নব কেন আগ বাড়িয়ে পুলিশকে কথাটা বলতে গেল?
নব আপনার বিপদের আশঙ্কা করে প্রভাতবাবুকে ধরিয়ে দিতে চেয়েছে। কারণ সে সোনার ঠাকুরের ঘটনাটা জানে। তাছাড়া এমন কিছু সে দেখেছিল, যা এখনও কবুল করেনি পুলিশকে। কিন্তু ওই জানাটুকু তার পক্ষেও বিপজ্জনক। খুনী জানে যে নব তাকে ওপরে উঠতে এবং নীচে নামতে দেখেছে।
–তাহলে প্রভাতকেও ওপরে উঠতে এবং নীচে নামতে দেখেছিল নব?
–আমার তাই ধারণা। কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন।–এই ধারণার ফলে আমিই তার নিরাপত্তার জন্য পুলিশের হেফাজতে তাকে সরিয়ে রেখেছি।
দীনগোপাল ফোঁস শব্দে শ্বাস ছেড়ে বললেন–সোনার ঠাকুর এমন সর্বনাশ ঘটাবে ভাবতে পারিনি। আমি নাস্তিক। আমি ঠাকুর-ভগবান-দৈবে বিশ্বাসী নই। আমার কাছে ওটা নেহাত একটা সোনার পিণ্ডমাত্র। আমার ইচ্ছা ছিল, শিগগির ওটা ফিরোজাবাদে আমার অ্যাটর্নি মিশবাবুর সাহায্যে গোপনে বিক্রি করব এবং সেই টাকায় অনাথ আশ্রম খুলব। সরডিহির রাজফ্যামিলি গরিব প্রজাদের রক্ত চুষে সেই টাকায় সোনার ঠাকুর বানিয়ে পুজো করত! আপনি জানেন, কেন আমি এতগুলো সুফলা জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলাম? ওই রাজাদের অত্যাচারে। ওরা আসলে জমিদার, খেতাবে লেখে রাজা না গজা! আমি ওদের ফ্যামিলিকে ঘৃণা করি। ওদের সঙ্গে আমি মামলা লড়ে ফতুর হয়েছি! কাজেই শান্ত ওদের সোনার ঠাকুর চুরি করেছে দেখে আমি খুশি হয়েছিলাম। শান্তর চুরি করা ঠাকুর আমি লুকিয়ে ফেলেছিলাম।–সেটা নিছক শান্তর বিপদের কথা ভেবেই নয়। খুলেই বলছি, প্রতিশোধের প্রবৃত্তিবশেও বটে!
কর্নেল দেখলেন, দীনগোপালের মুখ ঘৃণায় বিকৃত। কর্নেল আস্তে বললেন– বুঝতে পারছি।
দীনগোপাল বললেন–ঠিক আছে। একটা শর্তে আপনাকে সাহায্য করব। ফাঁদ পেতে খুনীকে ধরুন। কিন্তু স্পষ্ট বলছি, আমি সোনার ঠাকুর কাউকে দেব না। আমি ভান করব, যেন সত্যি ওটা খুঁড়ে বের করছি। এই শর্ত। ওটা সময়মতো গোপনে বের করে যা প্ল্যান আছে, করব।
বলে দীনগোপাল রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেন। পশ্চিমদিকে গতি। কর্নেল উল্টোদিকে চললেন। সরডিহি থানার সেকেন্ড অফিসার ভগবানদাস পাণ্ডের কুকুরনিধন অভিযানের ফলাফল জানতেই।
লাঞ্চের পর অমরবাবু এবং কর্নেল রোদে বসে গল্প করছিলেন। একসময় অমরবাবু চাপা স্বরে বলে উঠলেন–আমি বোধহয় একটা ভুল করছি, কর্নেল!
কর্নেল চোখ বুজে চুরুটে টান দিয়ে বললেন কী ভুল?
–পুটুকে একলা হতে দিচ্ছি না। ওর ফাঁদে পাখিটা এসে পড়ছে না। দূর থেকে ঘুরে যাচ্ছে। ওই দেখুন!
কর্নেল চোখ খুললেন। তারপর বাইনোকুলারে চোখ রাখলেন অমরবাবুর নির্দেশ অনুসারে। বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন–। সেচ খালের ধারে নীতা একা দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক আছে! চলুন, আমরা কিছুক্ষণ বাইরে কোথাও ঘুরে আসি।
অমরবাবু উঠে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলেন–পুঁটে!
ঘরের ভেতর থেকে সাড়া এল।–পুঁটে-ফুটে বলে কোনও প্রাণী নেই পৃথিবীতে।
ইস! অভিমানের বহর দেখো! অমরবাবু অট্টহাসি হাসলেন–শোন, বেরুচ্চি আমরা। ফিরে এসে যদি শুনি বেরিয়েছিলে কোথাও ফের হাজতে ঢোকাব। সাবধান!
প্রসূন বেরিয়ে এল।–আমাকে একা ফেলে যাওয়া ঠিক হচ্ছে কি? আমার যদি কোনো বিপদ হয়?
রামলাল আছে। ডাকবি।
প্রসূন নেমে এসে রোদে বেতের চেয়ারে বসল। বলল–রামলাল আমাকে বাঁচাতে পারবে না। মঙ্গল সিং ছিল। তাকে ওই পাণ্ডে ভদ্রলোক নাকি তাড়া করে ভাগিয়ে দিয়েছিন এরিয়া থেকে। তাই না রামলাল?
রামলাল ঘাসে বসে রোদ পোহাচ্ছিল। বলল–আজিব বাত স্যার! বাজারমে শুনা, মংলু ডাকু জিন্দা হ্যায়। ইয়ে ক্যায়সে হোসকতা, মুঝে তো মালুম নেহি। পুলিশ ভুল দেখা জরুর!
রাস্তায় পৌঁছে অমরবাবু বললেন–পাখি আমাদের দেখছে! ঘুঘুপাখির সঙ্গে প্রেমিকার উপমা অবশ্য জুতসই হবে না। তবে এক্ষেত্রে ব্যাপারটা তাই। দাঁড়াচ্ছে।
কর্নেল হাসলেন।–চলুন! আপনাকে বরং লাল ঘুঘু দেখাব। বিরল প্রজাতির ঘুঘু! তবে যথার্থ ঘুঘু।
বলে কর্নেল ঘুঘুপাখির বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। পায়রা আর ঘুঘুর মধ্যে কী কী পার্থক্য, ওরা সত্যিই কাঁকর খায় কি না, ভিটেয় ঘুঘু-চরানো কথাটার উৎপত্তি কী সূত্রে–এইসব বিষয়ে বিশদ বিবরণ। অমরবাবু মন দিয়ে শোনার ভান করছিলেন। কিন্তু দৃষ্টি ক্যানেলের দিকে। কর্নেল দীনগোপালের বাড়ির কাছে পৌঁছে একটু দাঁড়ালেন। অমরবাবু বললেন কী ব্যপার?
বাড়িটা উঁচু চমির ওপর, রাস্তাটা নিচুতে। গরাদ-দেওয়া গেটের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, প্রভাতরঞ্জন উত্তেজিতভাবে কিছু বলছেন এবং অরুণ, তার স্ত্রী ঝুমা, দীপ্তেন্দু তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বারান্দার পশ্চিম দিকটায় রোদ পড়েছে। সেখানে বেঞ্চে বসে ঝিমোচ্ছে দুজন বন্দুকধারী সেপাই।
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন–আশ্চর্য তো!
কী আশ্চর্য? অমরবাবু ব্যস্তভাবে জানতে চাইলেন।
–মিঃ ত্রিবেদী..
কর্নেলকে থামতে দেখে অমরবাবু বললেন–কোথায় ত্রিবেদী সায়েব?
কর্নেল বললেন–আসুন তো! ব্যাপারটা জানা দরকার।
অমরবাবু তাকে অনুসরণ করলেন। গেট খুলে তারা লনে ঢুকলে দলটি তাঁদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর প্রায় মারমুখী হয়ে তেড়ে আসতে দেখা গেল প্রভাতরঞ্জনকে। কর্নেলের সামনে এসে তিনি গর্জন করলেন–গেট আউট! আভি গেট আউট! এরপর ত্রিসীমানায় দেখলে তুলে ছুঁড়ে ফেলব।
অমরবাবু ফুঁসে উঠলেন। কাকে কী বলছেন মশাই? আপনি জানেন ইনি কে?
প্রভাতরঞ্জন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন–খুব জানি। ডি-টেক-টি-ভ! টিকটিকি! ঘুঘু! এমন বিস্তর ঘুঘু আমার পলিটিক্যাল লাইনে দেখা আছে। গেট আউট!
বলে কর্নেলের কাঁধে ধাক্কা দিতে হাত বাড়ালেন। অমরবাবু সহ্য করতে পারলেন না। দ্রুত জ্যাকেটের ভেতর থেকে রিভলবার বের করে প্রভাতরঞ্জনের কানের কাছে নল ঠেকিয়ে বললেন–আমি সি আই ডি ইন্সপেক্টর। এখনই এঁর পায়ে ধরে ক্ষমা না চাইলে আপনাকে অ্যারেস্ট করব।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–এ কী করছেন অমরবাবু! আপনিও দেখছি প্রভাতবাবুর মতো নাটুকে মানুষ!
অরুণ, ঝুমা, দীপ্তেন্দু দৌড়ে এল। প্রভাতরঞ্জন হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। ভাঙা গলায় চেঁচালেন–পুলিশ! পুলিশ!
এ এস আই মানিকলাল বাড়ির পেছনদিকে কোথাও ছিলেন। ছুটে এলেন। সেপাই দুজনও উঠে দাঁড়িয়েছিল। এগিয়ে এল।
মানিকলাল অমরবাবুকে স্যালুট ঠুকে বললেন কী হয়েছে স্যার? •
অমরবাবু রিভলবার জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে ক্রুদ্ধস্বরে বললেন–এই লোকটাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যান। আপনাকে নিশ্চয় বলে দেওয়া হয়েছে, আজ এই কোসের চার্জে আমি আছি ইউ আর টু ক্যারি আউট মাই অর্ডার।
মানিকলাল প্রভাতরঞ্জনের দিকে এগিয়ে এলে কর্নেল বললেন–প্লিজ মিঃ লাল! অমরবাবু, আপনাকে অনুরোধ করছি, এখানেই ব্যাপারটা শেষ হোক। একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।
অমরবাবু রাগে গরগর করছিলেন। কী সাহস! আপনার গায়ে হাত তুলতে এলেন উনি?
প্রভাতরঞ্জন মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গলার ভেতর বললেন–হাত তুলেছি কি কম দুঃখে? দীনুদাকে উনি বলেছেন আমি শান্তর বডি আমার মাফলারে বেঁধে কড়িকাঠে ঝুলিয়েছি! আমি খুনীকে চিনি! দীনুদা আমাকে সব বলেছে। শুনে আমার মাথার ঠিক ছিল না।
কর্নেল অবাক হয়ে বললেন–দীনগোপালবাবু বলেছেন আপনাকে?
–হ্যাঁ। বলে প্রভাতরঞ্জন ভাঙা গলায় ডাকতে থাকলেন–দীনুদা! দীনুদা।
দীপ্তেন্দু বলল–আমি ডেকে আনি জ্যাঠামশাইকে! ব্যাপারটা খুব গোলমেলে।
সে পা বাড়ালে কর্নেল বললেন–থাক দীপ্তেন্দু! বরং আমরাই ওঁর কাছে। যাই।
দীপ্তেন্দু আঁঝাল স্বরে বলল–বড্ড গোলমেলে ঠেকছে ব্যপারটা। এর মীমাংসা হওয়া দরকার।
–নিশ্চয় দরকার। কারণ আমারও সব গোলমেলে ঠেকছে। কর্নেল দাড়িতে অভ্যাসমতো হাত বুলিয়ে একটু হাসলেন।দীনগোপালবাবু হঠাৎ মত বদলেছেন, এই একটা পয়েন্ট। আর একটা পয়েন্ট হলো, ও সি মিঃ ত্রিবেদীও মত বদলেছেন। দুটোই পরস্পর সংযুক্ত পয়েন্ট।
অমরবাবু বললেন–আমার মনে হয় কর্নেল, ব্যাপারটা খুলে বলা উচিত। নইলে আবার ড্রামাটিক কিছু ঘটে যেতে পারে।
পারে। আপনি ঠিকই বলেছেন। কর্নেল সায় দিলেন। মিঃ ত্রিবেদীকে বলেছিলাম প্রভাতবাবুকে অ্যারেস্ট করে লক-আপে ঢোকাতে। তা করেননি।
প্রভাতবাবু চমকে উঠে বললেন–শুনুন! শুনুন তাহলে! সাধে কি আমি… বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন–আপনার নিরাপত্তার স্বার্থে তা করতে বলেছিলাম। কারণ খুনী এখন বিপন্ন বোধ করছে। অথচ মিঃ ত্রিবেদী কেন আপনাকে গ্রেফতারে মত বদলালেন? সম্ভবত দীনগোপালবাবু তাকে কিছু বলে এসেছেন পরে।
দীপ্তেন্দু বলল–জ্যঠামশাইকে ডাকলেই জানা যাবে।
অরুণ বলল–তুই যা দীপু! ওঁকে ডেকে আন।
দীপ্তেন্দু হন্তদন্ত পা বাড়াল। কর্নেলের কণ্ঠস্বর হঠাৎ বদলে গেল। গম্ভীর স্বরে ডাকলেন–দীপ্তেন্দু! শোনো, কথা আছে।
দীপ্তেন্দু একবার ঘুরে তাঁর দিকে তাকাল। মুখের রেখায় বিকৃতি ফুটে উঠল। তারপর সে আবার পা বাড়াল। দৌড়ে যাবার ভঙ্গি।
কর্নেল সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেললেন। দীপ্তেন্দু নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কর্নেল চোখের পলকে তাকে জুডোর এক পাচেই ধরাশায়ী করে ডাকলেন অমরবাবু! মিঃ লাল! শান্তর খুনীকে গ্রেফতার করুন।
অমরবাবু ফের রিভলবার বের করে ছুটে গেলেন। মানিকলাল গিয়ে দীপ্তেন্দুর জ্যাকেটের কলার ধরে হ্যাঁচকা টানে সোজা দাঁড় করিয়ে দিলেন! ইতিমধ্যে অমরবাবু তার কানের নিচে রিভলবারের নল ঠেকিয়েছেন। দীপ্তেন্দু মুখ নামিয়ে রইল।
প্রভাতরঞ্জন হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন। এতক্ষণে সংবিৎ ফিরল। কপা-কাঁপা গলায় বললেন–আমি হতচ্ছাড়াকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম…আমার ভুল হয়েছিল…আমি ওকে…।
–সোনার লোভে, প্রভাতবাবু! কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন।–সোনার ঠাকুরের ভাগ দিতে চেয়েছিল দীপ্তেন্দু!
প্রভাতরঞ্জন দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলেন।–আমি পাপী! মহা-পাপী!
মানিকলাল অমরবাবুকে বললেন–আসামীকে নিয়ে যাই, স্যার!
কর্নেল বললেন–এক মিনিট। আগে আসামীর কাছ থেকে ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ আর নিকোটিমরফিডের তৃতীয় অ্যালটা বের করে নিই।
বলে দীপ্তেন্দুর জ্যাকেটের সামনের বাঁ দিকের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। বেরিয়ে এল একটা সুচ-বসানো ইঞ্জেকশান সিরিঞ্জ। মানিকলাল বললেন– সর্বনাশ! একেবারে রেডি সিরিঞ্জ!
হ্যাঁ। হঠাৎ দৌডুনোর ঝাঁকুনিতে জ্যাকেট খুঁড়ে সুচটা বেরিয়ে পড়েছিল। কর্নেল বললেন। তবে নিকোটিমরফিড ভরা ছিল, জানতাম না। তার মানে এবার দীনগোপালবাবুকেই চুপ করিয়ে দিতে যাচ্ছিল দীপ্তেন্দু।
অরুণ ও ঝুমা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতক্ষণে ঝুমা এগিয়ে এল, তার পেছনে অরুণ। ঝুমার হাতের মুঠোয় একটা খালি অ্যাল। দেখিয়ে শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল–এটা কিছুক্ষণ আগে আমি ওইখানে ঘাসের ভেতর কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। তাই নিয়েই আমরা আলোচনা করছিলাম। এমন সময় আপনারা এসে পড়লেন। কিন্তু আমরা..আমি কল্পনাও করিনি দীপ্তেন্দু এ কাজ করবে।
কর্নেল বললেন–প্রভাতবাবু! তাহলে আপনি কি দীনগোপালবাবুকে খুনীর নাম বলে দিয়েছেন?
প্রভাতরঞ্জন চোখমুখে শ্বাস ফেলে বললেন–হ্যাঁ। সকালে মর্নিং ওয়াক করে এস দীনুদা আমাকে আড়ালে ডেকে চার্জ করলেন। আমি…আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। নামটা বলে দিলাম। শুনে দীনুদা কেঁদে ফেললেন। শেষে বললেন, ঠিক আছে। চেপে যাও। আমিও চেপে থাকি। বরং সোনার ঠাকুরটা পুলিশকে জমা দেবার ব্যবস্থা করি। ওটাই সর্বনাশের মূল।
তারপর উনি কি বেরিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ।
–তাহলে মিঃ ত্রিবেদীকে কিছু বলে এসেছেন। কর্নেল বললেন।–মিঃ লাল! আপনি আসামীকে থানায় নিয়ে যান। মিঃ ত্রিবেদীকে শিগগির আসতে বলুন।
দীপ্তেন্দুকে ধরে নিয়ে গেলেন মানিকলাল। সেপাই দুজন সঙ্গে চলল। কর্নেল বললেন–চলুন, দীনগোপালবাবুর সঙ্গে এবার দেখা করা যাক।
যেতে যেতে অমরবাবু বললেন কর্নেল! খুনী কে, আপনি জানতেন। কিন্তু কী সূত্রে জানলেন, সবটা শুনতে চাই। দীনগোপালবাবুর ঘরে বসে শুনব।
কর্নেল বললেন–সূত্র অতি সামান্যই! মাত্র একটা সূত্রে।
বলেন কী! একটা মাত্র সূত্র?
–হ্যাঁ, একটা মাত্র সূত্র। কিন্তু মোক্ষম সূত্র।
–কী সেটা?
কর্নেল বারান্দায় উঠে বললেন শান্তকে মারা হয়েছিল বিষাক্ত নিকোটিনের ইঞ্জেকশানে। দীপ্তেন্দু পেশায় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। গতকাল নিজেই অতিবুদ্ধিবশে অর্থাৎ বেগতিক দেখে জানিয়েছিল, তার ব্যাগ থেকে একটা বিষাক্ত ইঞ্জেকশানের অ্যাম্পুল চুরি গেছে। দুটো অ্যাম্পুল ছিল নাকি। কিন্তু আসলে ছিল তিনটে অ্যাম্পুল–সে তো দেখতেই পেলেন। যাই হোক, ওর কথায় সন্দেহ করার উপায় ছিল না। স্টেটমেন্ট দিয়ে চলে যাচ্ছে, হঠাৎ আমি পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করলুম, ওষুধটা কি ওর কোম্পানি নতুন ছেড়েছে বাজারে? ও বলল, হ্যাঁ, নতুন।
এটাই আমার সূত্র। নতুন শব্দটা!
অরুণ বলল-বুঝলাম না।
কর্নেল একটু দাঁড়িয়ে বললেন না বোঝার কী আছে! বাজারে নতুন ছাড়া বিষাক্ত ওষুধ। সে-ওষুধটা কী, এ বাড়িতে একমাত্র দীপ্তেন্দুর নিজেরই জানার কথা। আর কে জানবে? এবাড়িতে তো সে ওষুধ বেচতে আসেনি এবং কেউ এ বাড়িতে ডাক্তারও নন যে তাকে নতুন ওষুধটার গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে। বোঝাবে। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, তার কাছে ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ থাকার কথা কে জানবে, সে নিজে ছাড়া? সে তো ডাক্তার নয়।
বসার ঘরে ঢুকে প্রভাতরঞ্জন বললেন-রাত চারটেয় ওই সোফায় সবে শুয়েছি, কিন্তু জেগেই আছি, আলো নিভিয়ে দিয়েছি–হঠাৎ পায়ের শব্দ। দেখি, কেউ উঠে যাচ্ছে সিঁড়িতে। আমার একটু গোয়েন্দাগিরির স্বভাব। একটু পরে চুপিচুপি উঠে গেলাম। গিয়ে শুনি শান্তর ঘরে ধস্তাধস্তির শব্দ। তারপর আমার বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে গেল। ভাইয়ে-ভাইয়ে খুনোখুনি! কী করব, বলুন?..
দীনগোপাল বিছানায় বসেছিলেন তাকিয়ায় হেলান দিয়ে। হাতে একটা ময়লা হয়ে-যাওয়া সোনার নৃসিংহমূর্তি। মুখ তুললেন। বিভ্রান্ত দৃষ্টি।
অরুণ বলে উঠল–ওঃ! কী যে হতো আর একটু হলেই! দীপু সোনার ঠাকুর পেয়ে যেত। জ্যাঠামশাইকে..ও গড!
ঝুমা কপালে বুকে হাত ঠেকিয়ে বলল–ঠাকুর বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
দীনগোপাল আস্তে বললেন–ত্রিবেদী সায়েব আসেননি?
–এখনই এসে যাবেন। বলে কর্নেল ঘরে ঢুকলেন।
দীনগোপাল একটু কেশে ক্লান্তভাবে বললেন–আপনারা বসুন। বউমা, এঁদের জন্য চা বা কফির ব্যবস্থা করো।
ঝুমা ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেল। কর্নেল একটু হেসে বললেন–আমি একটা ফাঁদ পাততে চেয়েছিলাম। কেন আপনি হঠাৎ মত বদলালেন দীনগোপালবাবু?
–আমার আর ধৈর্য রইল না। অসহ্য লাগছিল। দীনগোপাল কাতরস্বরে বললেন।–ভোরবেলা আপনার সঙ্গে কথা বলার পর পথে যেতে যেতে আমার মনে হলো, বড় ভুল করে আসছি এতদিন। সোনার ঠাকুর নয়, সোনা নিছক সোনার লোভ বড় সর্বনেশে। আমার বিবেক কর্নেল, বিবেক আমাকে যা বলল, তাই করলাম। এই সোনার পিণ্ডটা তুলে নিয়ে এলাম পিপুলতলার বেদি থেকে। বেদির এক কোনার নিচে পোঁতা ছিল। ওটা একটা দেবতার স্থান।. নিরাপদ জায়গা। এলাকার কোনও মানুষ ওখানে মাটি খুঁড়ে অপবিত্র করবে না জানতাম।
প্রভাতরঞ্জন ফুঁপিয়ে উঠলেন। কিন্তু দীপু এবার তোমাকেই খুন করতে আসছিল জানো?
–তুমি থামো! দীনগোপাল ধমক দিলেন। ন্যাকামি করে বুড়ো বয়সে কাঁদতে লজ্জা হয় না? বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি তুমি! আমাকে খুন করত দীপু? আমি রেডি ছিলাম। দেখছ? খুনী ভাইপোর হার্ট ঘেঁদা করে দিতাম। দরজায় দেখলেই এইটে বিধিয়ে দিতাম।
বলে খাটের পেছন থেকে নবর সেই বল্লমটা তুলে দেখালেন। ফের বললেন– কিন্তু তুমি বাঁচবে কী করে, সে কথা এবার চিন্তা করো। তুমি খুনের প্রমাণ চাপা দিতে চেয়েছিলে। তুমি খুনীর অ্যাসিস্ট্যান্ট! হাঁদা মাথামোটা, শিবের ষাঁড়!
প্রভাতরঞ্জন কাচুমাচুভাবে বললেন–সব খুলে বলব আদালতে। তাতে জেল হবে, হোক! জেলে জেলে জীবন কেটেছে। আমি জেলের ভয় করি না।
দীনগোপাল বাঁকা মুখে বললেন, তুমি তো জেলের পাঁচিল টপকাতে ওস্তাদ! আর আজকাল যা জেলের অবস্থা হয়েছে। রোজই তো কাগজে পড়ি কয়েদি পালাচ্ছে-বজ্র আঁটুনি, ফস্কা গেরো।
অমরবাবু হাসলেন।–উনি রাজসাক্ষী হবেন। ওঁকে বাঁচিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা যাবে।
–আপনি কে?
কর্নেল বললেন–উনি প্রসূনের জামাইবাবু। কলকাতার সি আই ডি ইন্সপেক্টর অমর চৌধুরী।
দীনগোপাল ভুরু কুঁচকে কিছু স্মরণ করার চেষ্টা করে বললেন–নামটা চেনা লাগছে।…ও! তুমি প্রমোদের ছেলে না? প্রসূন বলত বটে তোমার কথা। দীনগোপাল সোজা হয়ে বসলেন।তোমার বাবা ছিলেন আমার স্নেহভাজন। বন্ধুও বলতে পারো। নামকরা শিকারী ছিলেন। সরডিহি আসতেন মাঝে মাঝে শিকার করতে। তোমার বাবা কেমন আছেন?
অমরবাবু বললেন–বাবা গত বছর মারা গেছেন জ্যাঠামশাই!
–আহা রে! বলে বিষণ্ণ দীনগোপাল একটু চুপ করে থাকলেন। তুমি আমাকে জ্যাঠামশাই বললে। খুব ভাল লাগল। বলে কর্নেলের দিকে তাকালেন দীনগোপাল-খুনেটাকে ধরতে পেরেছেন, না পালিয়ে গেছে?
প্রভাতরঞ্জন বললেন–তোমাকে খুন করতে আসছিল। কর্নেলসায়েব পেছন থেকে আমার মতোই জুডোর প্যাঁচে ওকে মাটিতে ফেলে কুপোকাত করেছেন।
-শাট আপ! তোমার সঙ্গে কথা বলব না। কর্নেল, বলুন!
কর্নেল বললেন–তাকে প্রেফতার করে থানায় পাঠানো হয়েছে, দীনগোপালবাবু!
নবর কী হবে? নব ছাড়া, আমি যে অচল!
–আশা করি, ত্রিবেদী সায়েব তাকে আর আটকে রাখবেন না। সঙ্গে নিয়ে আসবেন।
দীনগোপাল বিকৃত মুখে বললেন–ও সি ভদ্রলোক আপনার চেয়ে এককাঠি সরেস। তাকে বললাম, নবকে ছেড়ে দিয়ে প্রভাতকে ধরে নিয়ে আসুন। ওর পেটে গুতো মারলে সব বেরুবে। তো বলেন কী কর্নেলসায়েবের ফাঁদ আমিই পাতব। কর্নেলসায়েব টিলাপাহাড়ে ফঁদ পাততে চান, আমি পাতব আপনার ঘরে। আপনি সোনার ঠাকুর হাতে নিয়ে বসে থাকবেন। তা এই তো বসে আছি। তার আগেই খুনে বদমাশকে পাকড়াও করে কর্নেলসায়েবই টেক্কা দিলেন।
বলে ঘুরলেন কর্নেলের দিকে। আপনি আগেই জানতে পেরেছিলেন কে শান্তর আসল খুনী? আপনার মন্তটা কী?
কর্নেল একটু হেসে বললেন–মন্তরটা হল নতুন ওষুধ।
–হেঁয়ালিটা এবার ছাড়ুন তো মশাই!
কর্নেল তার ছোট্ট সূত্রটির লম্বা-চওড়া ব্যাখ্যা দিতে থাকলেন। ব্যাখ্যা শেষ হতে ঝুমা ট্রে সাজিয়ে কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে এল। সেই সময় সদলবলে হাজির হলেন গণেশ ত্রিবেদী। তার সঙ্গে ভগবানদাস পাণ্ডেও।
ত্রিবেদীর প্রথমেই চোখ গেল সোনার ঠাকুরের দিকে। বললেনবাঃ! কথা রেখেছেন দীনগোপালবাবু! কিন্তু আমি দুঃখিত, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার খুনীকে আমার ফঁদে পড়ার সুযোগই দিলেন না! হারিয়ে দিলেন বুদ্ধির খেলায়। ওকে! হার মানছি। অ্যান্ড কনগ্রাচুলেশন!
তিনি কর্নেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন, মুখে অট্টহাসি। কর্নেল হ্যান্ডশেক করে বললেন তবে আপনিও পরোক্ষে আমাকে বুদ্ধির খেলায় হারিয়ে দিয়েছেন মিঃ ত্রিবেদী!
–সে কী! কীভাবে বলুন তো?
–প্রভাতবাবুকে আমার কথামতো প্রেফতার না করে।
ত্রিবেদী চেয়ার টেনে বসে বললেন–আমি ভাবলাম, তাহলে খুনী সতর্ক হয়ে যাবে। কারণ প্রভাতবাবু তাকে সাহায্য করেছেন এবং তার চেয়ে বড় কথা, প্রভাতবাবু প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। প্রভাতবাবুকে গ্রেফতার করলেই সে পালাবে।
–ঠিক তাই।…কর্নেল পাণ্ডের দিকে ঘুরে বললেন–আপনাকে খুব দুঃখিত দেখাচ্ছে মিঃ পাণ্ডে!
ত্রিবেদী ফের জোরে হেসে উঠলেন। কালা কুত্তা! দা ব্ল্যাক ডগ এপিসোড! আমি ওঁকে বোঝাতে পারছি না। কী দেখতে কী দেখেছেন। মঙ্গল সিং মরা মানুষ। আপনি তার ভূত দেখেছেন। তবে কুকুরের ব্যাপারটা আলাদা। কোনও কোনও কুকুরের অদ্ভুত স্বভাব থাকে। জিনিসপত্র কামড়ে নিয়ে পালায়। একবার আমার একপাটি জুতো নিয়ে পালিয়েছিল। স্যুটকেসটা নিশ্চয় চামড়ার ছিল, পাণ্ডেজি!
পাণ্ডে মাথা নেড়ে বললেননাঃ! ডাকু মঙ্গল সিং বেঁচে আছে। আমি তাকে খুঁজে বের করবই। আর ওর কালো কুকুরটাকে গুলি করে মারব।…
দীনগোপাল ঝুমার উদ্দেশে বললেন নীতু কোথায়? তাকে দেখছি না কেন?
ঝুমা বেরিয়ে যাবার সময় বলে গেল–বেড়াতে বেরিয়েছে। আমি ওকে খুঁজে আনছি।
একটু চুপ করে থাকার পর দীনগোপাল বললেননব? ও সি সায়েব! নবকে ছাড়ছেন না কেন? আমার ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে।
ত্রিবেদী বললেন আমাদের সঙ্গেই এসেছে। কিচেনে ঢুকেছে। আপনার বউমার কাছে এখন সম্ভবত সে চার্জ বুঝে নিচ্ছে। আমাদের জন্য কফি আনতে বলছি তাকে।
কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন–লাল ঘুঘুর ঝকটি এতক্ষণ এসে গেছে। এই চান্সটা মিস করতে চাই নে। অমরবাবু, আপনি এখানেই আড্ডা দিন ততক্ষণ। আমি একা যেতে চাই। লাল ঘুঘুর ছবি তুলতে খুব সতর্কতা দরকার।
দ্রুত বেরিয়ে এলেন কর্নেল। বারান্দায় একটু থেমে বাইনোকুলার রাখলেন চোখে। তারপর পা বাড়লেন।
গেটের কাছে ঝুমা দাঁড়িয়ে খুঁজছিল নীতাকে। ক্যানেলের দিকে দৃষ্টি। কর্নেলকে দেখে সে বলল কর্নেল! আপনার বাইনোকুলার দিয়ে নীতাকে খুঁজে বের করুন তো! আমার বড় অস্বস্তি হচ্ছে।
কর্নেল তার হাতে বাইনোকুলার দিয়ে বললেন–উত্তর-পূর্বে ইরগেশান বাংলোর ওখানটা লক্ষ্য করো।
ঝুমা দেখতে দেখতে বলল–সর্বনাশ!
কর্নেল হাত বাড়িয়ে বললেন–সর্বনাশ কিসের ঝুমা? কই, আমার যন্তর দাও। বেশিক্ষণ দেখতে নেই ওসব দৃশ্য। অবশ্য এও একধরনের খুনোখুনি বলা চলে। পরস্পর পরস্পরের হার্টে ছুরি মারছে।
ঝুমা দুরবীন যন্ত্রটি ফেরত দিয়ে বলল–প্রসূন দীপ্তেন্দুর চেয়ে সাংঘাতিক ছেলে!
ঝুমা, প্রেম তার চেয়েও সাংঘাতিক। বলে কর্নেল নিচের রাস্তায় নেমে গেলেন।
ঝুমা বলল–একটা কথা কর্নেল!
-বলো।
–বাসস্টপের লোকটা কে, জানেন? জানতে পেরেছেন?
–তুমি জানো মনে হচ্ছে!
ঝুমা মাথা নাড়ল।জানি না। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে প্রসূন এবং নীতার দুজনেই চক্রান্ত করে…।
কর্নেল হাত নেড়ে বললেন, না।
তবে কে সে?
দীপ্তেন্দু। দেখো ঝুমা, অপরাধীদের এই একটা চিরাচরিত স্বভাব অতিরিক্ত চালাকি বলো, কিংবা উল্টোটাও বলো, নিজের অলক্ষ্যে নিজেই একটা-দুটো সূত্র রেখে দেয়। এক্ষেত্রে দেখো! শান্ত, নীতা, তোমার স্বামী অরুণ, প্রভাতবাবু প্রত্যেকে বলেছেন, বাসস্টপে একই চেহারার একটা লোক তাদের একটা কথা বলে নিপাত্তা হয়ে গেছে। কিন্তু দীপ্তেন্দু কী বলেছে? না, তার স্ত্রীকে ওই রকম চেহারার একটা লোক বাসস্টপে একই কথা বলেছে। কেন দীপ্তেন্দু এমন বলল? তার মনে অপরাধবোধজনিত দুর্বলতা একটা সংশয় সৃষ্টি করেছিল। কী সংশয়?-না দৈবাৎ যদি কেউ তাকে চিনে ফেলে থাকে। নিজের স্ত্রীর নামে ব্যাপারটা সে চাপাতে চেয়েছিল। এত দৈবাৎ কারুর মনে সন্দেহ দেখা দিলেও সেটুকু ঘুচে যাওয়ার চান্স আছে। দীপ্তেন্দুর স্ত্রী স্কুল-টিচার। রেসপন্সি পার্সন। কাজেই ব্যাপারটা গুরুত্ব পাবে।
কর্নেল পা বাড়িয়ে ফের বললেন–যাই হোক। তার মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের কার্ড সে দিয়েছিল মিঃ ত্রিবেদীকে। ওতে তার বাড়ির ফোন নম্বর ছিল। সকালে আমি কলকাতায় ট্রাংককল করি ওর স্ত্রীকে।
ঝুমা সাগ্রহে বলল কী বললেন রমাকে?
কর্নেল হাসলেন।বললাম, আপনি বাসস্টপে সেদিন সন্ধ্যায় যে সানগ্লাস পরা দাড়িওলা লোকটাকে দেখেছিলেন, যে আপনার স্বামীকে বলতে বলেছিল সরডিহির জ্যাঠামশাইয়ের বিপদ, সে ধরা পড়েছে।
-মা কী বলল শুনে?
–ভদ্রমহিলা বললেন, কী আজগুবি কথাবার্তা বলছেন? কে আপনি? আমি বললাম, সরডিহি থেকে পুলিশ অফিসার বলছি। আপনার দেখা বাসস্টপের লোকটাকে পাকড়াও করেছি। রমা দেবী বললেন, টকিং ননসেন্স! এমন কোনও ব্যাপার ঘটেনি। আমার স্বামী এক সপ্তাহ আগে শিলং গেছেন। ওঁর অফিসে রিং করে জেনে নিন। এই নিন ওঁর অফিসের নাম্বার। সে-নম্বার অবশ্য তখন আমার হাতেই।
তারপর দীপুর অফিসে ফোন করলেন? করলাম।
ঘণ্টা দুই পরে অফিস আওয়ার্সে। থানা থেকে ট্রাংককল। লাইন পেতে দেরি হয় না। ওর অফিস রমাদেবীর কথা কনফার্ম করল। দীপ্তেন্দু এক সপ্তাহ আগে নর্থ-ইস্টার্ন জোনে ট্যুরে গেছে।
বলে কর্নেল হনহন করে হেঁটে চললেন। দিনের আলো গোলাপী হয়ে এসেছে। কুয়াশার ধূসরতা ঘনিয়েছে পশ্চিমের টিলার গায়ে। ঝুমা গেটে দাঁড়িয়ে রইল। দৃষ্টি সেচ বাংলোর দিকে।
উঁচু জমিটার ঝোপে লাল ঘুঘুর ঝক বসে আছে। টেলিলেন্স ক্যামেরায় জুড়ে পরপর কয়েকটা ছবি তুললেন কর্নেল। তারপর সেই নিচু জমিতে নামলেন এবং ইচ্ছে করেই জুতোর শব্দ করলেন। ঝকটা উড়ল।
অমনি উড়ন্ত অবস্থায় ফের ঘুঘুর ঝকটির ছবি তুললেন। ক্যামেরা নামিয়ে ওদের গতিপথ লক্ষ্য করেছেন, সেই সময় চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলেন, কী একটা চকচকে জিনিস ঝিলমিল করছে।
কর্নেল এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, ইঞ্জেকশানের একটা অ্যাল। শান্তর মাফলারের সঙ্গে এখানে ফেলে গিয়েছিল দীপ্তেন্দু। রুমালে জড়িয়ে কুড়িয়ে নিলেন অ্যাম্পুলটা। এটা একটা প্রমাণ। কোর্ট একজিবিট।
একটু পরে বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিয়ে ছোট টিলাটার দিকে হেঁটে চললেন কর্নেল।
শীর্যে পিপুলতলায় উঠে বেদির নিচে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটা টাটকা খোঁড়া গর্ত দেখতে পেলেন। এখানেই দীনগোপাল মূর্তিটা পুঁতে রেখেছিলেন। এতক্ষণে আবিষ্কার করলেন, এখানে বেদির গায়ে স্বস্তিকা চিহ্নের একটা খোদাই করা রেখার নিচে একটা ছোট্ট গোল লালচে ছোপ। সিঁদুরেরই ছোপ। বেরঙা হয়ে গেছে এবং ঘাসের ভিতর চাপা পড়েছে। সংকেতচিহ্ন দিয়ে রেখেছিলেন দীনগোপাল।
হঠাৎ কুকুরের গরগর চাপা গর্জন শুনে উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল। দ্রুত রিভলবার এবং ফর্মুলা-টোয়েন্টির কৌটো বের করলেন জ্যাকেট থেকে।
কুকুরটা নিচের দিকে পাথরের আড়ালে গর্জন করছে। কিন্তু আসছে না। কর্নেল ডাকলেন–মঙ্গল সিং! আ যাও। ডরো মাত! চলা আও মঙ্গল সিং! হাম। তুমহারা দোস্ত হ্যায়!
পশ্চিমের ঢালে নিচের দিকে বড় পাথরের আড়াল থেকে একটা প্রৌঢ় শীর্ণ চেহারার লোক বেরুল। কালো অ্যালসেশিয়ানটা তার পায়ের কাছে। সে জিভ বের করে জুলজুলে চোখে কর্নেলকে দেখছে আর সমানে গরগর করছে।
কর্নেল হাসলেন। কুত্তা বহৎ ট্রেইন্ড মালুম হোতা। ঠিক হ্যায়। উসকো হুয়া বইঠকে রহনে হুকুম দো। তুম একেলা আও, মঙ্গল সিং! ঘাবড়াও মাত্। হাম দোস্ত হ্যায়।
মঙ্গল সিং ডুকরে কেঁদে উঠল হঠাৎ।–হ্যাম জিন্দা আদমি নেহি, সাব! হামকো মার ডালাপানিমে ফেক দিয়া। বাবুলোগোনে চোরি কিয়া, তো হাকা পর যেত্তা জুলুম!
–জানি। হামকো সবহি মালুম হ্যায় মঙ্গল সিং! বলে কর্নেল বেদির কাছে গর্তটা দেখালেন।–ইয়ে দেখো। বুঢ়াবাবু সোনেকা ঠাকুর উঠাকে লে গয়া। দে দিয়া পুলিশ কি হিফাজতমে। অব কিস্ লিয়ে তুমি হিয়া ঘুমতে হো? কৈ ফয়দা নেহি জি!
কর্নেল পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে ফের বললেন– আভি তুরন্ত ফিরোজাবাদ হোকে কলকাত্তা চলা যাও। বড়া শহর, মঙ্গল সিং! দুরি জিন্দেগি মিলা তুমকো। ইয়ে নয়া জিন্দেগিকি নয়া লড়াই শুরু করো। লে লো ইয়ে রূপৈয়া!!
মঙ্গল সিং চোখ মুছে বলল–হাম্ ভি নেহি লেতা সাব!
বখশিস মঙ্গল সিং!
–কাহে সাব?
কর্নেল হেসে উঠলেন। তুমহারা কুত্তাকা খেল দেখা। বঢ়েয়া সার্কাস। দিখায়া তুম! এইসা ডগ-ট্রেইনার হাম কভি নেই দেখা।
নোটটা বেদিতে রেখে কর্নেল একটুকরো পাথর চাপা দিলেন। তারপর চাপাস্বরে ফের বললেন–পাণ্ডেজি পুলিশ ফোর্স লেকে আতা, তুরন্ত ভাগ যাও।
বলে হনহন করে নেমে এলেন পুবের ঢাল দিয়ে। ঝোঁপজঙ্গলের ভেতর ঢুকে সোঁতায় নামলেন। শীর্ণ সেতায় পাথরের ফাঁক দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। পাথরে পা রেখে ওপারে গেলেন কর্নেল। তারপর রাস্তায় উঠলেন। সাঁকোয় বাইনোকুলারে দেখলেন, কালো কুকুরটি একশো টাকার নোটটা মুখে করে নিয়ে নেমে যাচ্ছে। টিলার ওধারে অদৃশ্য হয়ে গেল দুটি প্রাণী।
একটা আশ্চর্য তৃপ্তির স্বাদে আপ্লুত হলেন কর্নেল। কালো কুকুরের সার্কাস দেখার জন্য নাকি সরডিহি এলাকার প্রাক্তন ডাকু মঙ্গল সিংয়ের ভয়ঙ্কর-নিষ্ঠুর ছুরিটার সুভেনির মূল্য ওই একশোটা টাকা?
অথবা নিজের জীবনের প্রতীক-মূল্য মিটিয়ে দিয়েছেন তার আততায়ীকে? সেকেন্ডের জন্য লাফ দিয়ে সরে না গেলে তার মৃত্যু হতো সেদিন বিকেলে। অব্যর্থ লক্ষ্যভেদটিকে ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিলেন–হয়তো দৈবাৎ, একান্তই দৈবাৎ। তাই নিজের জীবন ফিরে পাওয়ার মূল্য এভাবে শোধ করলেন। পৃথিবী নামক একটি প্রাণময় গ্রহে বেঁচে থাকার কত রকম স্বাদ, কত বিচিত্র অনুভূতি, রূপ রস গন্ধ স্পর্শ, প্রকৃতি ও প্রাণীর কত রহস্যজালে পরিকীর্ণ এই পৃথিবীকে একটু একটু করে বোঝবার চেষ্টা এই জীবন! সেই জীবনের মূল্য ওই সামান্য টাকায় শোধ হবার নয়। ওই কাগুঁজে মুদ্রাটি নিতান্তই তার কৃতজ্ঞতার প্রতীক মাত্র। মঙ্গল সিং তাকে জীবনের মূল্য উপলব্ধির সুযোগ দিয়েছে।
জীবনে কতবার এবাবে মৃত্যুর মুখ থেকে ছিটকে সরে গেছেন কর্নেল। আর প্রতিবার যেন একটি করে পর্দা উন্মোচিত হয়েছে জীবনের। এভাবে খোলস ছাড়তে ছাড়তে বারবার নতুনতর জীবনের মধ্যে বেঁচে থাকতে থাকতে নির্বাণের পরম স্তরে পৌঁছুতে চান কর্নেল নীলাদ্রি সরকার–স্বাভাবিক মৃত্যুই তার বাঞ্ছিত। অস্বাস্থ্যে নয়, আততায়ীর আঘাতে নয়, দুর্ঘটনায় নয়–তিনি চান সেই মৃত্যু, যা প্রকৃতি তাকে আদরে উপহার দেবে। প্রকারান্তরে যা প্রকৃতির নিজের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া। প্রকৃতি থেকে এসে প্রকৃতিতে ফিরে যাওয়া। খেলাশেষে ক্লান্ত শিশু যেভাবে ঘরে ফেরে, মা তাকে ধুলো মুছিয়ে কাছে টেনে নেন।
কর্নেল!
চমকে উঠলেন কর্নেল। ঘুরে দেখলেন, নীতা ও প্রসূন। প্রসূনই তাকে ডেকেছে। তার মুখে বিষাদ-মেশানো ক্ষীণ হাসির রেখা। নীতার মুখে ঈষৎ গাম্ভীর্য। টিলাপাহাড়ের ফাঁক দিয়ে আসা শেষ লালচে রোদের ছটায় সেই গাম্ভীর্য ঈষৎ উজ্জ্বলও।
কর্নেল একটু হাসলেন। কনগ্রাচুলেশন!
নীতা বলল আমি আপনাকে এখানে দেখতে পেয়ে চলে এলাম।
–আর পুটু সরি।
প্রসূন বলল–নেভার মাইন্ড! আমি পুটু! পুটু বলেই তো আমার বউ পালায়।
–তাহলে প্রসূন বলাই নিরাপদ। কর্নেল চুরুট বের করে বললেন–তো আমাকে দেখে নীতা চলে এসেছে। আশা করি, প্রসূনও তাই? অর্থাৎ দুজনে একত্ৰ বেড়াতে বেরোওনি? আমি–এই বৃদ্ধ ঘুঘু তোমাদের দুজনেরই লক্ষ্য ছিল? ভাল। তো দেখ, এই সময়টাকেই ভারতীয় শাস্ত্রে গোধূলি লগ্ন বলা হয়। এই সময়টা বিপজ্জনক সুন্দর কারণ এই লগ্নে ভারতীয় নর-নারী বিয়ে নামক ফাঁদে পড়ে। এগেন সরি ডার্লিংস! তোমাদের ক্ষেত্রে পুনর্মিলন বলাই উচিত। সুখী হও!
ঋষির ভঙ্গিতে কর্নেল ডান হাত প্রসারিত করলেন। এবার নীতার ঠোঁটের কোনায় ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠল এবং মুহূর্তের জন্য তার মুখে ভারতীয় নারীর লজ্জার রঙ ঝলমল করল। আস্তে বলল সে–চলুন। গল্প করতে করতে ফেরা যাক।