বিগ্রহ রহস্য : 05
কর্নেল রাত প্রায় বারোটা অব্দি জেগে ছিলেন! প্রসূনের ফেরার অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ অমন করে তার চলে যাওয়ায় অবাক হয়েছিলেন। ফলে প্রসূনের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রহস্যটার একটা ক্ষীণ সূত্র যে আছে, বুঝতে পেরেছিলেন। রামলাল তিন নম্বরের বাঙালি সায়েবের জন্য এগারোটা অব্দি অপেক্ষা করে শুয়ে পড়েছিল। বলেছিল–আজিব আদমি! হাম ক্যা করে বোলিয়ে স্যার? সুবেমে নেহি ললাটে তো থানেমে খবর কিয়েগা। কর্নেল শুধু বলেছিলেন–ঠিক হ্যায়, রামলাল।
এই বাংলোয় টেলিফোন একটা আছে। কিন্তু কিছুদিন থেকে ডেড। রামলাল এক্সচেঞ্জে খবর দিয়েছে। এখনও কেউ সারাতে আসেনি। সরডিহিতে নাকি সবই এরকম ঢিমেতেতালা চালে চলে। রামলালের মতে, খোদ ডি ই সাহেব এসে। পড়লে ফোনটা চালু হবার সম্ভাবনা আছে। নইলে ডেড থেকেই যাবে।
অভ্যাসমতো ভোর ছটায় কর্নেল প্রাতঃভ্রমণে বেরুলেন। বাইরে গাঢ় কুয়াশা। আজ ঠাণ্ডাটাও জোরালো। গায়ে ওভারকোট চড়িয়ে হনুমান টুপি পরে বেরুতে হলো। প্রজাপতির নাগাল পাওয়া এ আবহাওয়ায় অসম্ভব। তাই প্রজাপতি ধরা জালটি সঙ্গে নেননি। তবে বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা নিয়েছিলেন। রিভলবারও। কাল থেকে অতর্কিত মৃত্যু-বিভীষিকাটি মনে যখন তখন গভীর জলের মাছের মতো ঘাই মারছে।
দীনগোপালের বাড়ির নিচের রাস্তা দিয়ে পশ্চিমে টিলা পাহাড়গুলোর দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন কর্নেল। ছোট্ট সোঁতার ওপর ব্রিজে পৌঁছে দক্ষিণ-পশ্চিমে সেই পিপুল গাছ-শীর্ষক টিলাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। কুয়াশায় সব একাকার।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর টিলাটির দিকে এগিয়ে চললেন। পিপুল গাছের তলার প্রায় চৌকো বেদির গড়ন কালো পাথরটিকে গতকাল সকালে লক্ষ্য করেছেন। গতকাল দিনশেষে তারই ওপর বসে থাকতে দেখেছেন নিজের আততায়ীকে, যার একটা কালো অ্যালসেশিয়ান আছে।
পাথরটি কেন যেন তার মনোযোগ দাবি করছে। সেটির গড়নে কোনও অস্বাভাবিকতা আছে কি? পরীক্ষা করার তাগিদেই এখন খুব সতর্কতার সঙ্গে চারদিক দেখতে দেখতে টিলায় উঠছিলেন কর্নেল। কুয়াশার সঙ্গে স্তব্ধতাও এই পারিপার্শ্বিককে নিঝুম করে রেখেছে। তবে এমন স্তব্ধতা তার জন্য এখন নিরাপদ।
পিপুলতলায় পৌঁছে চোখে পড়ল, বেদির পেছনে একরাশ ছাই। কেউ আগুন জ্বেলে তাপ নিয়েছে–সম্ভবত গতকাল সন্ধ্যার দিকেই। কারণ, কিনারায় মাকড়সার জাল এবং তাতে শিশিরের ফোঁটা জমেছে। সেই আততায়ী ছাড়া আর কে হতে পারে? অবশ্য সর্বক্ষেত্রে দুয়ে দুয়ে চার হয় না।
টিলার ওপাশটা কিছুটা খাড়া। ন্যাড়া পাথর উঁচিয়ে আছে। ডাইনে বাঁয়ে ঢালুতে ইতস্তত কয়েকটি ঝোঁপ। দেখে নেওয়ার পর চৌকো পাথরটার দিকে মনোযোগ দিলেন কর্নেল।
হুঁ পাথরটার গড়ন স্বাভাবিক নয়। তার মানে, কোনো সময়ে মানুষের হাত পড়েছিল এর গায়ে–এটা আসলে একটা বেদিই বটে। তাছাড়া যে আঁক জোকগুলোও প্রাকৃতিক সৃষ্টি ভেবেছিলেন, সেগুলো মানুষেরই তৈরি। অজস্র স্বস্তিকা চিহ্ন খোদাই করা হয়েছিল একসময়। প্রকৃতির আঘাতে ক্ষয়ে গিয়ে বিশৃংখলা রেখায় পরিণত হয়েছে।
তাহলে বলা যায়, এটা কোনও পূজা-বেদি, অথবা কোনও দেব-দেবীর থান। এলাকার আদিবাসী বা তথাকথিত নিম্নবর্ণীয় মানুষদের পুজো-আচ্চা হতো একসময়। যে কারণে হোক, পরিত্যক্ত হয়েছে।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল, গতকাল সকালে দীনগোপাল তাকে এখানে দেখে প্রায় তেড়ে এসেছিলেন! কেন? দীনগোপাল কি তার উপস্থিতি অবাঞ্ছিত মনে করেছিলেন এখানে? কী আছে এখানে?
পাথরটা ঠাণ্ডা হিম। তবে কর্নেলের হাতে দস্তানা পরা আছে। ঠেলে নড়ানোর চেষ্টা করে বুঝলেন অসম্ভব। তারপর ফের ছাইগুলোর কাছে গেলেন।
হঠাৎ চোখে পড়ল, ছাইয়ের পাশে ইঞ্চিটাক এক টুকরো কাপড়জাতীয় জিনিস। সেটা দৈবাৎ পোড়েনি। হাতে নিয়েই কর্নেল বুঝতে পারলেন, এটা সেই ছাইরঙা মাফলারেরই অংশ। সম্ভবত কালো কুকুরের মালিক এখানে বসে মাফলারটা নিশ্চিহ্ন করেছে। সম্ভবত এই কথাটিই মাথায় আসছে। কারণ কে এ কাজ করেছে কর্নেল বস্তুত দ্যাখেননি। ধরা যাক, সে-ই খুনী। কিন্তু একটা খটকা থেকে যাচ্ছে। মর্গের পরীক্ষায় খুন যখন সাব্যস্ত হতোই, তখন শান্তর মাফলার নিয়ে খুনীর এত মাথাব্যথা কিসের? সে কি এত নির্বোধ যে, ভেবেছিল পোস্টমর্টেম ছাড়াই শান্তর লাশ দাহ করা হবে? দেয়ালের ব্র্যাকেট থেকে শান্তর মাফলারটা এক ঝটকায় টেনে নিয়ে যাওয়া এবং মাঠে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়ার মধ্যে আপাতদৃষ্টে মনে হয়, শান্তর আত্মহত্যাই সে সাব্যস্ত করাতে চেয়েছিল। কিন্তু পোস্টমর্টেমের কথা অবশ্যই ভাবা উচিত ছিল তার। যে কোনও অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় অন্তত সরডিহির মতো জায়গায় পুলিশকে না জানিয়ে দাহ করার ঝুঁকি আছে। সে ঝুঁকি দীনগোপালবাবু বা তাঁর ভাইপো-ভাইঝিরা নেবে কেন? তাছাড়া অমন হুঁশিয়ার মানুষ প্রভাতরঞ্জন সেখানে উপস্থিত!
বিশেষ করে নীতা কর্নেলকে এখানে ডেকে এনেছে। অন্যেরা যদি বা পারিবারিক কেলেঙ্কারি ঢাকতে, ধরা যাক, পুলিশকে না জানিয়ে দাহ করে ফেলতেন নীতা চুপ করে থাকত না।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দুটো পয়েন্ট কর্নেলের মাথায় ভেসে এল।
একঃ শান্তর আত্মহত্যার খবর পুলিশকে প্রথম কে জানিয়েছিল, জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছেন।
দুই : শান্তর মাফলার নিয়ে আসা কি শান্তর আত্মহত্যা আপাতদৃষ্টে সাব্যস্ত করা, নাকি অন্য কোনও গুঢ় কারণ ছিল–যখন শান্তর লাশের পোস্টমর্টেমের চান্স প্রায় ৯৯ শতাংশ?
পুবে সরডিহির মাথায় কুয়াশার ভেতর আবছা লালচে গোলা–সূর্য উঠে গেছে। লালচে রঙটা দ্রুত সোনালী হয়ে যাচ্ছে। আশে-পাশে কুয়াশা অনেক পাতলা হয়েছে। কর্নেল চুরুট জ্বাললেন। কিন্তু কাশি পেল। খালি পেটে চুরুট টানেন না কখনও। আসলে কেসের ওই পয়েন্ট দুটো তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল এবং তারপর মনে পড়ে গিয়েছিল প্রসূনের অন্তর্ধানের কথাটি। কোনও বিপদ ঘটেনি তো তার! শান্তর খুনের খবর শুনেই অমন উত্তেজিত হয়ে বেরিয়ে নিপাত্তা রইল সে। কর্নেল বেদিতে ঘষে চুরুটটি নিভিয়ে ফেললেন।
কিছুক্ষণ পরে হলদেটে রোদ ফুটলে বাইনোকুলারে লাল ঘুঘুর আঁক খুঁজতে থাকলেন। সেই উঁচু ডাঙাজমিটার ওপর থেকে বাইনোকুলার বাঁ দিকে ঘোরাতেই রাস্তার উত্তরে সমান্তরালে ক্যানেলের পাড়ে দুটি মূর্তি আবছা ভেসে উঠল। এদিকে পেছন-ফেরা দুটি মানুষ। একজন পুরুষ, অন্যজন মেয়ে।
চমকে উঠেছিলেন কর্নেল। ঠোঁটে হাসিও ফুটেছিল। কিন্তু তারা এদিকে ঘুরে একটা টাড় জমির ওপর দিয়ে রাস্তার দিকে আসতে থাকল, তখন নিরাশ হলেন। প্রসূন ও নীতা নয়, দীনগোপালের আরেক ভাইপো অরুণ আর তার স্ত্রী ঝুমা।
অরুণ খুব হাত নেড়ে স্ত্রীকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। ঝুমা যেন বুঝতে চাইছে না, এরকম হাবভাব। কর্নেল বাইনোকুলার নামালেন চোখ থেকে। কোনও দম্পতিকে এভাবে দূর থেকে লক্ষ্য করাটা অশালীন। বিশেষ করে যখন ওরা টিলার মাথায় কর্নেলকে দেখতে পাবে, কী ভাববে?
ওরা রাস্তা ধরে পশ্চিমে এগিয়ে আসছে। ব্রিজের ওপর এসে গেলে কর্নেল টিলা থেকে নিম্নগামী হলেন। সোঁতার পাড় ধরে রাস্তার কাছে পৌঁছে একটু কাশলেন! অমনি অরুণ ভীষণ চমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। তার দিকে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কেমন চোখে তাকিয়ে রইল। কর্নেল বুঝলেন, তাকে ওরা চিনতে পারছে না। পিরবার কথাও নয়। ওভারকোট, তার ওপর হনুমান টুপিতে সাদা দাড়ি পুরোটাই ঢাকা।
কিন্তু কাছাকাছি গেলে ঝুমা একটু হেসে ফেলল। কর্নেলও সহাস্যে বললেন– গুড মর্নিং!
অরুণ তখনও চিনতে পারেনি। গোমড়া মুখে আস্তে বলল–মর্নিং!
ঝুমা বলল–ও আপনাকে চিনতে পারছে না। আবার, এতক্ষণ আমাকেই উল্টো বোঝাবার চেষ্টা করছিল আমি মানুষ চিনি না! বুঝুন কর্নেল কেমন অবজার্ভার আমার এই হাজব্যান্ড ভদ্রলোক!
সঙ্গে সঙ্গে অরুণ জিভ কেটে হাত বাড়িয়ে বলল হ্যালো কর্নেল! সরি ভেরি সরি। একেবারে চেনা যায় না এ বেশে! বলে কর্নেলের দস্তানা পরা হাতে হাত দিয়ে সে ঝাঁকুনি দিয়ে হৃদ্যতা প্রকাশ করল।
কর্নেল বললেন–ঝুমাদেবী, আশা করি এই বাইনোকুলারটি দেখেই চিনতে পেরেছেন এ বৃদ্ধকে?
–হ্যাঁ। ঝুমা মাথা দোলাল। তবে নীতার মতো আমাকেও তুমি না বললে রাগ করব।
অরুণ বলল–আমাকেও।
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। আমি সব মানুষের নৈকট্যপ্রার্থী।
–কী বললেন, কী বললেন? অরুণ ছেলেমানুষি ভঙ্গি করে বলল, নৈকট্যপ্রার্থী! দারুণ একটা কথা। মুখস্থ রাখার মতো। নৈকট্য-প্রার্থী! তারপর সে ঝুমার দিকে ঘুরল।–সরি! ঝুমা, ইংরেজিতে এর সেন্সটা একটু ক্লিয়ার করে দেবে?
ঝুমা চোখ পাকিয়ে বলল–তুমি ইংলিশম্যান নাকি? বাঙালির ঘরে জন্ম বাংলা বোঝো না!
অরুণ জোকারের ভঙ্গি করল।–্যাশ! ঊ্যাশ হয়ে গেছি ক’বছর ওয়েস্টে। থেকে। তবে এক মিনিট!..হু, কথাটার মানে, হি লাইকস টু কাম নিয়ারার। ইজ ইট?
ঝুমা ধমকের সুরে বলল–খুব হয়েছে। কর্নেল বুঝি মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন?
কর্নেল একটু মাথা নেড়ে বললেন–একটা কথা। গত রাতে আশা করি কোনও গণ্ডগোল হয়নি। পুলিশ পাহারা ছিল যখন, তখন কোনো ..
অরুণ কথা কেড়ে বলল–হয়েছে। সাংঘাতিক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল, নীতু। ইজ লাকি–জোর বেঁচে গেছে। তবে পুলিশ-টুলিশ বলছেন, বোগাস! মামাবাবু ভাগ্যিস ছিলেন, তাই নীতু বেঁচে গেল।
ঝুমা কী বলতে যাচ্ছিল, কর্নেল দ্রুত বললেন–প্রসূন?
স্বামী-স্ত্রী উভয়ে চমকে কর্নেলের দিকে তাকাল। তারপর ঝুমা শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে বলল–হ্যাঁ, নীতার বর। আপনি চেনেন ওকে?
–চিনি। কর্নেল বললেন-প্রসূন ওবাড়ি গিয়েছিল? তারপর?
অরুণ উত্তেজিতভাবে বলল–যাওয়া মানে কী? হামলা! মামাবাবুর চোখে পড়ে যায় সময়মতো। ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। মামাবাবুকে আপনি চেনেন না, কর্নেল!
ঝুমা বলল–আঃ! তুমি বড় বাড়াবাড়ি করো সবতাতে। কর্নেল, আমি, বলছি কী হয়েছিল। প্রসূনের কী উদ্দেশ্য ছিল জানি না তবে ও কাল রাত্তিতে ওবাড়ি ঢুকেছিল। গেটে তালাবন্ধ ছিল। ও পেছনদিককার ভাঙা পাঁচিলের বেড়া দিয়ে ঢুকছিল। সেই সময় মামাবাবু দোতলা থেকে ওকে দেখতে পান। তারপর চুপিচুপি নেমে গিয়ে ওঁত পেতেছিলেন। প্রসূন ঢোকামাত্র মামাবাবু ওকে ধরে ফেলেন। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার।
কর্নেল গুম হরে বললেন–তাহলে সে এখন থানার লক-আপে?
অরুণ বলল-হা! এবার তো বোঝা গেল হু ইজ দা মার্ডারার।
–কীভাবে বোঝা গেল?
অরুণ রুষ্ট মুখে হাসবার চেষ্টা করল। পিওর ম্যাথ, কর্নেল!
বুঝলাম না।
ঝুমা, বুঝিয়ে দাও। আমার রাগ হলে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
ঝুমা বললনীতুর সঙ্গে প্রসূনের বিয়ের পেছনে ছিল শান্ত। শান্ত প্রসূনের বন্ধু ছিল। শান্ত পলিটিক্স করত শুনেছেন হয়তো? আপনি ডিটেকটিভ। আপনি নিশ্চয় জানেন শান্ত কী ছিল!
অরুণ মন্তব্য করল–এক্সট্রিমিস্ট! বাংলায় কী যেন বলে, ঝুমা?
–উগ্রপন্থী। ঝুমা শ্বাস ছেড়ে বলল।–তো শান্ত মাঝে মাঝে নীতুর ফ্ল্যাটে গিয়ে লুকিয়ে থাকত। প্রসূনের সঙ্গে কী ব্যাপারে যোগাযোগও যেন ছিল। নীতা তো স্পষ্ট করে কিছু বলে না।
প্রসূন ব্যাটাছেলেও পলিটিক্যাল এক্সট্রিমিস্ট! অরুণ ফের মন্তব্য করল।
ঝুমা বলল–যাই হোক, নীতুর সঙ্গে সেই সূত্রে প্রসূনের আলাপ। শেষে বিয়ে।
কর্নেল বললেন বুঝলাম। কিন্তু প্রসূন কেন শান্তকে খুন করবে?
অরুণ বলল-পলিটিক্যাল রাইভ্যালরি হতে পারে। আবার প্রসূনের এও ধারণা হতে পারে, নীতুর সঙ্গে তার ডিভোর্সের পেছনে শান্তর প্রভোকেশন বাংলায় কী বলে ঝুমা?
–প্ররোচনা। কর্নেল বললেন।
ঝুমা বলল–অসম্ভব নয়। নীতুর কাছেই শুনেছিলাম একসময় ওর বরের সঙ্গে শান্তর নাকি কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল। মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল বহুদিন।
অরুণ সায় দিয়ে বলল– মনে পড়ছে। তুমিই বলেছিলে কথাটা।
কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন-ফেরা যাক। তোমরা ঘোরো বরং।
বলেই আর পিছু ফিরলেন না। হনহন করে এগিয়ে চললেন সরডিহির দিকে। কিছুক্ষণ পরে কর্নেলের মনে হলো, শান্তর অপমৃত্যুর শোকের একটুও ছায়া যেন নেই দম্পতির মধ্যে। ঝুমার মধ্যে নাও পড়তে পারে। অরুণ তো শান্তর খুড়তুতো ভাই। তার আচরণে এতটুকু শোকের ছাপ নেই!
অবশ্য এও সম্ভব, শান্তর জীবনরীতি বা কাজকর্মে তার আত্মীয়রা কেউ খুশি। ছিল না। হয়তো বিব্রতই বোধ করত। শান্তর মৃত্যুতে তাই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে।
কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে গেল, কাল সকালে দীনগোপালের বাড়িতে পুলিশ দেখে যখন ওখানে ঢুকেছিলেন, কোনও চোখে জলের ছাপ দেখেননি। শুধু…
কী আশ্চর্য! থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন কর্নেল। শুধু ওই ঝুমাই খুব কেঁদেছে মনে হচ্ছিল।
আর নীতা? তার মুখে শোকের ছাপ ঘন ছিল। কিন্তু চোখ দুটো শুকনোই ছিল। কর্নেলকে দেখামাত্র তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। সেটা স্বাভাবিকই। কিন্তু কাল সকালে দীনগোপালের ঘরে যখন ঝুমাকে লক্ষ্য করেন কর্নেল, এমন কি কফি নিয়ে ঢোকার সময়ও–তাকে ভীষণ বিহ্বল দেখাচ্ছিল।
এখন অন্য ঝুমাকে দেখে এলেন। সেই বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠেছে। তাকে শান্ত আর স্বচ্ছন্দ দেখাচ্ছে। প্রসূনকে পুলিশ লক-আপে ঢুকিয়েছে বলেই কি?
অথবা নিজেরই চিন্তা-ভাবনার বেড়াজালে জড়িয়ে অকারণ সবকিছুকে সন্দেহজনক গণ্য করে ফেলছেন, তিনি নিজেই। কর্নেল ঝুমার ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেললেন মন থেকে। আবার হাঁটতে থাকলেন।
বাংলোয় পুলিশের জিপ, তারপর মিঃ পাণ্ডেকে দেখতে পেয়েছিলেন কর্নেল। লনে ঢুকলে পাণ্ডে উত্তেজিতভাবে কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করেছেন, কর্নেল দ্রুত বললেন–জানি মিঃ পাণ্ডে! শ্রীমতী নীতার হাজব্যান্ড প্রসূন ধরা পড়েছে গতরাতে।
পাণ্ডে থমকে গেলেন প্রথমে। তারপর হাসলেন।–এক্স-হাজব্যান্ড বলুন?
–এখনও ডিভোর্স আইনত সেট হয়নি। লিগ্যাল সেপারেশনের পিরিয়ড চলছে, মিঃ পাণ্ডে! কাজেই আইনত ভুল বলিনি।
লনে রোদে বেতের চেয়ার-টেবিল পেতে রেখেছে রামলাল। শিগগির কফি এনে হাজির করল। পাণ্ডে কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন রামলাল আমাকে খানিকটা বলেছে এবং তার ধারণা, আপনার সঙ্গে তিন নম্বরের বাঙ্গালি সায়েব, মানে প্রসূন মজুমদারের পরিচয় আছে। তার খোঁজেই আপনি বেরিয়েছেন, এও রামলালের বিশ্বাস।
রামলাল বিনীতভাবে একটু তফাতে দাঁড়িয়েছিল। একটু হেসে বলল–ওহি শোচা, স্যার!
কর্নেল বললেন–তুম আভি ব্রেকফাস্ট বানাও, রামলাল! ফির বাহার যানে পড়ে? পাণ্ডেজিকে লিয়ে ভি!
পাণ্ডে হাত নেড়ে বললেন–নেহি রামলাল! কর্নেল, প্লিজ! এইমাত্র গিন্নির হাতের তৈরি পুরি একপেট খেয়ে বেরিয়েছি।
কর্নেল সেই পোড়ামুখো চুরুটটি জ্বেলে বললেন–আপনাদের আসামীর কথা শোনা যাক।
পাণ্ডে হাসলেন–সে আপনার কথা বলেছে। তাই ও সি সায়েব আপনার কাছে আমাকে পাঠালেন। আপনাকে নিয়ে দীনগোপালবাবুর বাড়ি যেতেও বলেছেন–কাল আপনার সঙ্গে ওঁর কথাও হয়েছে। ওখানে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার ভেতর বললেন, কী বলেছে প্রসূন আমার সম্পর্কে?
–আপনি ওকে চেনেন। আর..
–আর?
কলকাতার সি আই ডি ইন্সপেক্টর মিঃ অমর চৌধুরী নাকি তার জামাইবাবু। রাত্রেই এই ব্যাপারটা কলকাতায় পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে। মিঃ চৌধুরী আজ দুপুরের মধ্যে এসে পড়বেন শ্যালককে সনাক্ত করতে। হ্যাঁ, প্রসূন মজুমদার নামে তার এক বাউণ্ডুলে শ্যালক আছে এবং দীনগোপালবাবুর ভাইঝি নীতার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল, সেও ঠিক।
–তাহলে?
পাণ্ডে গম্ভীর হয়ে বললেন–রাত্রে চুপিচুপি ও-বাড়ি ঢোকার কোনও বিশ্বাসযোগ্য কৈফিয়ত দিতে পারেনি প্রসূন মজুমদার।
কী বলছে সে?
–আপনার কাছে শান্তবাবুর খুনের খবর শুনেই নাকি ওর মাথার ঠিক ছিল না। কারণ শান্তবাবু নাকি ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। বেশ! কিন্তু তাই বলে চুপিচুপি ভাঙা দেয়ালের বেড়া গলিয়ে ঢোকার কী উদ্দেশ্য? জেরায় জেরবার করেও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। খালি এক কথা, মাথার ঠিক ছিল না। ধোলাই দিলে হয়তো বেরুত। কিন্তু সি আই ডি ইন্সপেক্টরের শ্যালক। দেখা যাক, যদি মিঃ চৌধুরী এসে বলেন, এটি তার জাল শ্যালক, তাহলেই থার্ড ডিগ্রি চড়াব।
পাণ্ডে পুলিশি উল্লাসে খুব হাসতে থাকলেন। কর্নেল বাংলোর তিন নম্বর ঘরের দিকে তাকিয়ে বলনে প্রসুনের ঘরটা আশা করি সার্চ করেছেন?
পাণ্ডে মুখে হাসি রেখেই ভুরু কুঁচকে বললেন–শুনেছি আপনি নানা বিষয়ে জিনিয়াস। তবে আমাদের পুলিশ-মস্তিষ্কে কিছু জ্ঞান বুদ্ধি থাকা সম্ভব, কর্নেল।
— আমি শুধু জানতে চাইছিলাম কিছু পাওয়া গেছে নাকি।
–একটা স্যুটকেস পাওয়া গেছে মাত্র। থানায় নিয়ে গিয়ে খোলা হবে। চাবি আসামীর কাছে আছে। তাই এখনই তালা ভাঙার জন্য ব্যস্ত হইনি। হ্যাঁ, স্যুটকেসটা জিপে আছে। দেখতে চান কি?
পাণ্ডের বলার ভঙ্গিতে ঈষৎ কৌতুক ছিল। কর্নেল কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন। একটু পরে পাণ্ডে বললেন–আপনাকে ন’টার মধ্যে দীনগোপালবাবুর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে থানায় ফিরব। ও সি সায়েব বলেছেন, ন’টার আগেই ও-বাড়ি যাবেন। একটু কথা বলা দরকার ওঁর সঙ্গে। এখন পৌনে ন’টা প্রায়। রামলাল!
কিচেন থেকে সাড়া এল-স্যার!
কর্নেলসাবকা ব্রেকফাস্ট? জলদি কিও রামলাল!
–আভি যাতা হুজৌর!
ব্রেকফাস্টের ট্রে সাজিয়ে রামলাল এসে গেল। পাণ্ডে বললেন–আপনি চালিয়ে যান। ততক্ষণ আমি ড্যামের পাখি দেখি। আপনার বাইনোকুলারটা দিন, প্লিজ!
কর্নেল বাইনোকুলার দিলে পাণ্ডে লনের শেষ প্রান্তে পূর্বদিকের নিচু পাঁচিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওদিকেই জলাধার। পাখি দেখতে থাকলেন পুলিশ অফিসার ভগবানদাস পাণ্ডে।
কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বাইনোকুলার ফেরত দিয়ে বললেন–জিনিসটা অসাধারণ! আমি এবার একটা বাইনোকুলার কিনবই। পুলিশের কাজের জন্য সরকার কেন যে বাইনোকুলার দেন না, বুঝি না। সামরিক বাহিনীর বেলায় কিন্তু সরকার একেবারে দিলদরিয়া। কর্নেলের ব্রেকফাস্ট শেষ হয়েছে ততক্ষণে। আবার কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু পাণ্ডের তাড়ায় সেটা হলো না। ঘরে গিয়ে ওভারকোট-হনুমান টুপি খুলে টাক-ঢাকা একটা নীলচে টুপি পরে বেরিয়ে এলেন।
পাণ্ডে ততক্ষণে জিপের কাছে চলে গেছেন। কর্নেল দেখলেন, পাণ্ডে জিপের ভেতর ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ স্থির হয়ে গেলন কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তারপর। সোজা হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন কর্নেল! কর্নেল! আশ্চর্য তো!
কর্নেল এগিয়ে যেতে যেতে বললেন কী ব্যাপার মিঃ পাণ্ডে?
পাণ্ডে পাগলের মতো জিপের ভেতর, পেছনের দিকটায় এবং চারদিকে কখনও গুঁড়ি মেরে, কখনও কাত হয়ে চক্কর দিচ্ছিলেন কর্নেল কাছে গিয়ে তাঁকে দু কঁধ ধরে মুখোমুখি দাঁড় করালেন। আস্তে বললেন-প্রসূনের স্যুটকেসটা খুঁজছেন কি?
পাণ্ডে নড়ে উঠে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলেনে–অসম্ভব! আমি ওটা সিটের পাশে রেখেছিলাম।
–নেই?
না। কোথাও নেই! বলে পাণ্ডে হাঁক ছাড়লেন–রামলাল! ইধার আও শুয়ারকা বাচ্চা!
রামলাল কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। কর্নেল বললেন রামলাল কিছু জানে না মিঃ পাণ্ডে!
পাণ্ডে হুংকার ছেড়ে বললেন–আলবাৎ জানে! ও ব্যাটাই হাফিজ করে দিয়েছে কোন ফাঁকে।
না মিঃ পাণ্ডে! এক মিনিট। বলে কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রাখলেন। প্রথমে দক্ষিণে সরডিহি বসতি এলাকা, তারপর পশ্চিমে ঘুরলেন।–ওই দেখুন মিঃ পাণ্ডে! প্রসূনের স্যুটকেস নিয়ে একটা কালো কুকুর এইমাত্র ক্যানেলের পাড় থেকে নামছে।
পাণ্ডের হাতে বাইনোকুলারটি তুলে দিলেন। পাণ্ডে তার নির্দেশমতো দেখতে দেখতে বারকতক কই কই কোথায়’ বলার পর লাফিয়ে উঠলেন। মাই গুডনেস! কী অদ্ভুত!
কর্নেলের হাতে ফিতে-পরানো দূরবীন যন্ত্রটি ফেরত দিয়েই জিপে ঢুকলেন পাণ্ডে। স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল এবার যন্ত্রটিতে চোখ রাখলেন। এইমাত্র রাস্তা পেরিয়ে কালো কুকুরটি দক্ষিণের মাঠে পৌঁছুল। তারপরই তার মালিককে দেখা গেল। দৌড়চ্ছে। নিচু জমিতে আড়াল হয়ে গেল দুজনেই। একটু পরে আবার এক পলকের জন্য দেখা গেল তাদের। এবার লোকটার হাতে স্যুটকেসটা। পাণ্ডের জিপ কাছাকাছি পৌঁছোনোর অনেক আগে ওরা নিপাত্তা হয়ে গেল টিলাগুলোর কাছে।
কর্নেল ঘুরে ডাকলেন–রামলাল!
রামলাল কাঁপা কাঁপা গলায় সাড়া দিল–হুঁজৌর!
-তোমার কোনও ভয় নেই, রামলাল! ডরো মৎ!
–জি হুজৌর!
–আচ্ছা রামলাল, সরডিহিমে কিসিকা কালা বিলায়তি কুত্তা হ্যায়?
–নেহি তো! রামলাল বিব্রত মুখে বলল।–হ্যামনে নেহি দেখা স্যার! হাম যব ছোটা থা, রাজাসাবকা কোঠিমে বিলায়তি কুত্তা দেখা। লেকিন কালা কুত্তা! নেহি হুজৌর! আপকা কিরিয়া..রামজিকা কিরিয়া…বজরঙ্গবলীজিকা কিরিয়া হুজৌর!
সরডিহি থানার অফিসার-ইন-চার্জ গণেশনারায়ণ ত্রিবেদী সেকেন্ড অফিসার ভগবানদাস পাণ্ডের তুলনায় স্থিতধী প্রকৃতির মানুষ। কর্নেলের কাছে ঘটনাটি ‘লালবাড়ি’ অর্থাৎ দীনগোপালের বাড়ির লনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। শোনার পর প্রথমে একচোট হাসলেন। তারপর বললেন–পাণ্ডেজিকে নিয়ে সমস্যা হলো, সবকিছুতে তর সয় না। রুটিন জব হিসেবেই কাজে নামেন এবং কত শিগগির কাজটা শেষ করে ফেলা যায়, সেদিকেই মনোযোগ দেন বেশি। যেমন দেখুন, এই শান্তবাবুর কেসটা। আমি বেশ বুঝতে পারছি, দৈবাৎ আপনি গিয়ে না পড়লে উনি সুইসাইড কেস ধরে নিয়েই যত শিগগির পারা যায় নিষ্পত্তি করে ফেলতেন। এদিকে আমাদের হাসপাতালের মর্গের বা অবস্থা। ডোমই বডি কাটাকুটি করে। নেহাৎ আইনমাফিক একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট : নাকে রুমাল গুঁজে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। ডাক্তারবাবুও তাই। স্পেশাল কেস এবং চাপ না থাকলে কদাচ নিজের হাতে ছুরি ধরবেন না। যাই হোক, কালো কুকুর ব্যাপারটা কেসটাকে ভীষণ ঘুলিয়ে দিল দেখছি। প্রসূন মজুমদারের স্যুটকেসে কী এমন ছিল যে ওটা হাফিজ করে নিয়ে গেল? হুঁ, কালো কুকুরের মালিকের সঙ্গে প্রসূনের ভাল চেনাজানা আছে। আগে থেকে বলা ছিল আর কী! প্রসূন কোনোভাবে বিপদে পড়লে তার সঙ্গী স্যুটকেসটা যেন হাতিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। কী বলেন কর্নেল?
ত্রিবেদী দেখলেন কর্নেল যেন তার কথা শুনছেন না। চোখে বাইনোকুলার এবং নিশ্চয় পক্ষীদর্শন। একটু বিরক্ত হলেন মনে মনে। কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন–আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করছিলাম, কর্নেল!
কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে হাসলেন। শুনেছি। তবে প্রশ্নের জবাব জানা নেই বলে চুপচাপ পাণ্ডেজির অবস্থা দেখছিলাম।
–কী অবস্থা ওঁর?
–দুরবস্থা বলা চলে। হন্যে হয়ে ফিরে আসছেন জিপের দিকে।
লনে দুটো চেয়ার পেতে দিয়ে গেছে নব। ত্রিবেদী এতক্ষণে বসলেন। অনেকটা তফাতে বাড়ির পুবে ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে দীপ্তেন্দু, প্রভাতরঞ্জন, ঝুমা ও অরুণ চাপা গলায় কথা বলছে। দীনগোপাল তাঁর ঘরে। নব কফি আনল এতক্ষণে।
সে চলে যাচ্ছে, কর্নেল ডাকলেন–শোনো!
নব ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল–চিনি লাগবে স্যার?
না। কর্নেল তাকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে দেখতে দেখতে বললেন।–তোমার নাম কী যেন?
আজ্ঞে নব দাস।
–তুমি কত বছর এ বাড়িতে কাজ করছ?
–তা আজ্ঞে বিশ-বাইশ বছর হবে প্রায়।
–হুঁ, তুমিই শান্তবাবুর ঘরের দরজা ভেঙেছিলে শুনলাম?
নব একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল–আজ্ঞে স্যার…ডাকাডাকি করে সাড়া পাচ্ছিলাম না, তাই..
–তোমার কোনও সন্দেহ হয়েছিল নিশ্চয়?
হয়েছিল স্যার! অতক্ষণ ধরে ডাকছি, জোরে ধাক্কা দিচ্ছি দরজায়। সাড়া পাচ্ছি না।
কর্নেল সে কথায় আমল না দিয়ে বললেন–কেন সন্দেহ হয়েছিল, বলতে ভয় কী নব?
নব আরও ঘাবড়ে গেল। আমতা-আমতা করে বলল-ওই তো বললাম স্যার! ধাক্কা দিয়ে…
–তুমি শান্তবাবুকে কড়িকাঠ থেকে ঝুলতে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে, থানায় খবর দিতে দৌড়েছিলে?
–হ্যাঁ স্যার!
–কেন?
কর্নেলের কণ্ঠস্বরে তীব্রতা ছিল। নব একটু ইতস্তত করার পর গলার ভেতর বলল–শান্ত দাদাবাবু পরশু রাত্তিরে আসার পর আমাকে চুপিচুপি বলেছিল, আমার কোনও বিপদ হলে যেন পুলিশে তক্ষুণি খবর দিই।
ত্রিবেদী একটু চটে গিয়ে বললেন তার মানে, শান্তবাবু টের পেয়েছিলেন তার বিপদ ঘটতে পারে! আশ্চর্য ব্যাপার, তুমি বুন্ধুর মতো একথা চাপা দিয়েছ! বলে বুকপকেট থেকে নোটবই বের করলেন। কর্নেল! এখানেই শুরু করা যাক। শুভস্য শীঘ্রম্।
কর্নেল বললেন–নব, তুমি কখনও কালো অ্যালসেশিয়ান কুকুর দেখেছ? নবর মুখের চমক স্পষ্ট দেখা গেল। ঢোক গিলে বলল–দেখেছি স্যার!
-কোথায় দেখেছ?
–দিনকতক আগে ওদিকের পাঁচিলে বেড়া গলিয়ে ঢুকছিল। নব বাড়ির পেছনে দক্ষিণ দিকটা আঙুল তুলে দেখাল।–আমি বল্লম নিয়ে ছুটে গেলাম। সাংঘাতিক কুকুর স্যার! খোঁচা খেয়ে তবে পালিয়ে গেল। কর্তামশাই তখন ছিলেন না। ফিরে এলে বললাম।
–কী বললেন উনি?
–কিছু তো বললেন না।
–আচ্ছা নব, তুমি কখনও সোনার ঠাকুর দেখেছ?
হঠাৎ এ প্রশ্নে নব হকচকিয়ে গেল।সোনার ঠাকুর স্যার? কে–কেন। স্যার?
–আহা, দেখেছ কি না বলো!
নব অবাক চোখে তাকিয়ে বলল–না তো স্যার! চোখে কখনও দেখিনি। তবে শুনেছি।
–কী শুনেছ?
–রাজবাড়ির মন্দিরে নাকি সোনার ঠাকুর ছিল। চুরি হয়েছিল সেটা, তাও শুনেছি।
–পরশু রাত্তিরে বাড়ি পাহারা দিচ্ছিলেন তোমার দাদাবাবুরা। তখন তুমি কোথায় ছিলে?
নব কাচুমাচু মুখে হাসবার চেষ্টা করল।–খামোকা হইচই! আসলে মামাবাবুমশাই বরাবর এরকম জানেন স্যার? তিলকে তাল করেন। তবে হ্যাঁ, ওঁর গায়ে জোর আছে বটে। অরুণ দাদাবাবুর মতো তগড়াই লোককে কুপোকাৎ করে ফেলা চাট্টিখানা কথা নয়।
ত্রিবেদী বিরক্ত হয়ে বললেন–শুনেছি। কর্নেল, এবার আমি ওকে একটু বাজিয়ে দেখি।
কর্নেল বললেন–এক মিনিট। নব, আমি জিজ্ঞেস করছিলাম, পরশু রাত্তিরে বাড়ি পাহারার সময় তুমি কোথায় ছিলে?
নব ঝটপট বলল–আমি আমার ঘরেই ছিলাম স্যার! আমার খামোকা শীতের রাত্তিরে ছোটাছুটি পোষায় না। তবে ঘুমোনোর কথা যদি বলেন, তার জো ছিল না। বাইরে ওই দাপাদাপি, এদিকে শান্ত দাদাবাবুর কথাটা মনে গেঁথে আছে কাজেই ঘুম আসছিল না। সত্যি বলছি স্যার, সারাটা রাত্তির আমি জেগেই কাটিয়েছি। ভোরবেলা কৰ্তমশাই বেরুলেন। তারপর বসার ঘরে মামাবাবু মশাইয়ের হাতের কাছ থেকে আমার বল্লমটা তুলে নিয়ে গিয়ে কোণে পুঁতে বেড়াতে বেরুলেন–সব দেখেছি। কর্তামশাই খুব রেগে গেছেন, জানেন?
এই সময় পাণ্ডে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে গেলেন। বললেন–পাত্তা পেলাম না কুকুরটার!
ত্রিবেদী বললেন–আপনি এখনই গিয়ে লক-আপে প্রসূন মজুমদারকে চার্জ করুন। স্যুটকেসে কী ছিল জানা দরকার। ডিটেলস লিস্ট তৈরি করে ওর সই করিয়ে নেবেন। তারপর কুকুর-টুকুর নিয়ে দেখা যাবে।
পাণ্ডে চলে গেলেন। ত্রিবেদী নবর দিকে তাকালে নব কুণ্ঠিত মুখে বলল– যদি হুকুম দেন একটা কথা বলি স্যার!
ত্রিবেদী চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন–কথা তুমি অনেক জানো। বলছ না। বলাচ্ছি থামো!
নব বেজায় ভড়কে করুণ মুখে বলল–আমি তো নিজে থেকেই সব বলছি স্যার! বলছি না?
কর্নেল বললেন–কী বলতে চাইছিলে নব?
নব গলা চেপে বলল–প্রসূনবাবু ভেতর-ভেতর সাংঘাতিক লোক।
-কীরকম সাংঘাতিক? ত্রিবেদী একটু আগ্রহ দেখালেন।–খুলে বললো, সাংঘাতিক মানে কী?
নীতা দিদিমণির সঙ্গে বিয়ের পর সেবার এলেন। দিন পনেরো ছিলেন। তো প্রায় দেখতাম ওই বস্তিতে গিয়ে মহুয়া খাচ্ছেন। আর স্যার, সেই মঙ্গল সিং-মংলা ডাকু স্যার, তার সঙ্গে আড্ডা দিতেও দেখেছি।
কর্নেল ত্রিবেদীর দিকে তাকালেন। ত্রিবেদী বললেন রাজ-মন্দিরের সোনার ঠাকুর চুরির কেসে প্রথমে মংলা ডাকুকেই পাকড়াও করেছিলাম। বলছি সে কথা। তবে কর্নেল, আমার মনে হচ্ছে দ্য কেস ইজ সেট। থ্যাংক য়ু নব! তোমাকে আর দরকার নেই। কেটে পড়ো।
নব চলে গেলে কর্নেল বললেন–কেস সেট মানে কী মিঃ ত্রিবেদী?
ত্রিবেদী হাসলেন। সিগারেট ধরিয়ে বললেন–প্রসূন মজুমদারের সঙ্গে মংলা ডাকুর যোগাযোগ ছিল। এদিকে প্রসূন শান্তবাবুর বন্ধু। শান্তবাবু এই এরিয়ার একটা গুপ্ত বিপ্লবী দলের লোক ছিলেন। তাহলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা? বলে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন।বলুন, কী দাঁড়াচ্ছে তাহলে?
কর্নেল বললেন–ধোঁয়া!
-সরি! ত্রিবেদী ধোঁয়া হাত দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে খুব হাসলেন।–হুঁ, আসল কথাটা বলা হয়নি। বললেন আপনিও বুঝবেন কেস ইজ সেট। মংলা ডাকুকে সোনার ঠাকুর চুরির কেসে ধরে নিয়ে আটচল্লিশ ঘণ্টা জেরা করা হয়েছিল। মুখ দিয়ে শুধু একটা কথাই বের করানো গিয়েছিল : ‘সোনার ঠাকুর চুরি যাবে আমি জানতাম। ব্যস! এটুকুই।
-তারপর?
ত্রিবেদী নির্বিকার মুখে বললেন–পুরো কথাটা জানবার জন্য থার্ড ডিগ্রি চড়ানো হলো। একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। মারা যায় ব্যাটাচ্ছেলে। বুঝতেই পারছেন, এ ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষে যা করা দরকার, তাই করা হয়েছিল। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তার মৃত্যুর রিপোর্ট তৈরি হলো। কাগজগুলো তা যথারীতি খেল এবং ফলাও করে ছাপল।
–এসব ক্ষেত্রে তো তদন্ত করার কথা! তাছাড়া তার বডি…
কথা কেড়ে ত্রিবেদী দ্রুত বললেন–এটা গত বর্ষার সময়কার ঘটনা। ওই ওয়াটার ড্যামে বডিটা ফেলে দেওয়া হয়। তখন ড্যামের জল ছাড়া হয়েছে। রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, বন্যা এলাকায় ডাকাতি করতে যাওয়ার সময় পুলিশ। খবর পেয়ে নৌকা নিয়ে তাকে তাড়া করে। নৌযুদ্ধ বলতে পারেন।
ত্রিবেদী অট্টহাসি হাসলেন। কর্নেল বললেন–মঙ্গল সিংয়ের ছবি আপনার থানায় আছে কি?
–আছে। কেন?
কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে বললেন নিছক কৌতূহল। তো কেস ইজ সেটল্ড’ ব্যাপারটা কী?
ত্রিবেদীও গম্ভীর হলেন।–আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন না দেখে অবাক লাগছে। দীনগোপালবাবুর হাতে সোনার ঠাকুর দেখার কথা নীতা দেবী আপনাকে বলেছেন–আপনিই কাল বললেন। প্রসূনও নিশ্চয় দেখেছিল। নীতাকে বলেনি। ঠাকুর চুরি করেছিল শান্তবাবুর দল। শান্তবাবু সেটা এ বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন। তার জ্যাঠামশাইয়ের চোখে পড়ে উনি সেটা হাতান। শান্তবাবু মাল বেহাত হলে দলের ভয়ে কেটে পড়েন। মাইন্ড দ্যাট, এসবই আপনার থিওরি।
–বেশ। তারপর?
প্রসূন শান্তবাবুর দলের লোক। সে এতদিন পরে শান্তকে খুন করে শোধ নিয়েছে–প্রতিহিংসা বলতে পারেন। আক্রোশ বলতে পারেন। তারপর তার প্ল্যান ছিল দীনগোপালবাবুকে খুন করা। গতরাতে সেই উদ্দেশ্যেই চুপিচুপি এ-বাড়ি ঢুকছিল। ঠিক যেভাবে চুপিচুপি ঢুকে শান্তবাবুর ঘরে খাটের তলায় লুকিয়েছিল।
প্রসূন গতকাল সন্ধ্যায় এসেছে সরডিহিতে।
ত্রিবেদী জোর গলায় বললেন কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন? সে আগেও এসে কোনও হোটেলে থাকতে পারে। তারপর সেচ বাংলোয় উঠে আপনার কাছে ভালমানুষ সেজেছে!
কুকুরটা..
কর্নেলকে থামিয়ে ত্রিবেদী বললেন–কুকুরটা ট্রেন্ড অ্যানিম্যাল। তার মালিক প্রসূনেরই কোনও সহকারী। তার গ্যাংয়ের লোক। স্যুটকেসে নিশ্চয় কোনও ইনক্রিমিনেটিং ডকুমেন্টস ছিল। আড়াল থেকে সে প্রসূনকে গার্ড দিচ্ছিল।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–পিওর ম্যাথ। বিশুদ্ধ গণিত!
ভুরু কুঁচকে ত্রিবেদী বললেন–হোয়াটস রং ইন ইট? গণ্ডগোলটা কেন? কলকাতায় সুযোগ ছিল।
ত্রিবেদী একটু ভেবে বললেন–মনে হচ্ছে, বাসস্টপের লোকটা প্রসূনই। এভাবে দীনগোপালবাবুর আত্মীয়দের এখানে পাঠিয়ে সে তাদের ঘাড়েই দোষটা চাপাতে চেয়েছিল। জ্যাঠামশাইয়ের সম্পত্তি একটা ফ্যাক্টর। পুলিশ স্বভাবত এই অ্যাঙ্গেলে এগোবে ভেবেছিল প্রসূন।
–মামাবাবু প্রভাতরঞ্জনকেও এখানে পাঠাল কেন তাহলে? তার জানার কথা, এই ভদ্রলোক বিচক্ষণ মানুষ। এ বয়সেও এঁর গায়ের জোর আসাধারণ।
ত্রিবেদী হাসলেন। সেজন্যই প্রভাতবাবুর উপস্থিতি দরকার মনে করেছে, যাতে তাকে আমরা প্রথমেই সন্দেহ করি।
কর্নেল নিভন্ত চুরুটটি জ্বেলে বললেন–আপনি অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার। আপনি ভালই জানেন, সব ডেলিবারেট মার্ডার অর্থাৎ পরিকল্পিত খুনের প্রধানত দুটো মোটিভ থাকে। পার্সোনাল গেইন ব্যক্তিগত লাভ বা কোনও স্বার্থসিদ্ধি এবং প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। আপনি কি মনে করেন, প্রসূন এটুকুও বোঝে না যে প্রভাতবাবুর মোটিভ আপনারা খুঁজে পাবেন না কিংবা আইনত সাব্যস্তও করতে পারবেন না?
ত্রিবেদী ফের অট্টহাসি হাসলেন। কর্নেল! এই এরিয়া সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা নেই। যাই হোক, আমাদের হাতে রেকর্ডস আছে। এটাই সুবিধে। প্রভাতবাবু ওদিকে ফিরোজাবাদে খনি এলাকায় ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতি করতেন। এখন অবশ্য আর রাজনীতি করেন না–অন্তত ওই এলাকায় করেন না। যখন করতেন, তখন শান্তবাবুদের দলের সঙ্গে ওঁদের প্রচণ্ড শত্রুতা ছিল। প্রসূনের মাথায় এই অ্যাঙ্গেলটাও কাজ করে থাকবে।
কর্নেল সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, পিওর ম্যাথ।
গণেশ ত্রিবেদী ঘড়ি দেখে বললেন–যাই হোক, আসল কাজ শুরু করা যাক। দেরি হয়ে গেল বড্ড। তো প্রভাতবাবুর কথা যখন উঠল, ওঁকেই প্রথমে ডাকা যাক।