Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিগ্রহ রহস্য || Syed Mustafa Siraj » Page 4

বিগ্রহ রহস্য || Syed Mustafa Siraj

সরডিহি সেচ বাংলো বিশাল জলাধারের ধারে একটা টিলা জমির ওপর তৈরি। জলাধারটি পাখিদের স্যাংচুয়ারি বলা চলে। লাঞ্চের পর কর্নেল লনে ইজিচেয়ার পেতে বসে জলাধারের পাখি দেখছিলেন। এখনই হিমালয় ডিঙিয়ে সাইবেরিয়ার হাঁসের ঝাক আসতে শুরু করেছে। সারা শীত এখানে কাটিয়ে তারা আবার স্বদেশে ফিরে যাবে। একটি জলটুঙ্গির ওপর ঘন জঙ্গল। উঁচু মগডালে অদ্ভুত চেহারার সারস জাতীয় একটা পাখি বসে আছে। বাইনোকুলারে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করার পর কর্নেল চিনতে পারলেন, ওটা কেরানি পাখি ইংরেজিতে ‘সেক্রেটারি বার্ড’ বলা হয়। এ পাখি এখন দুর্লভ প্রজাতির হয়ে উঠেছে। দ্রুত ক্যামেরা নিয়ে এলেন তার রুম থেকে। টেলিলেন্স ফিট করে ছবি তুলতে যাচ্ছেন, পাখিটা হঠাৎ নিচের ডালে সরে গেল।

হতাশ মুখে ক্যামেরা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এমন সময়ে বাংলোর গেটের দিকে গাড়ির শব্দ। ঘুরে দেখলেন পুলিশের জিপ। চৌকিদার রামলাল দৌড়ে গিয়ে গেট খুলে দিল।

জিপটা প্রাঙ্গণে ঢুকল এবং নেমে এলেন সরডিহি থানার অফিসার-ইন-চার্জ গণেশ ত্রিবেদী। একা এসেছেন। কর্নেলকে সম্ভাষণ করে হাসতে হাসতে বললেন–হ্যাল্লো ওল্ড বস! আপনি দেখছি সত্যিই পূর্বজন্মে শকুন ছিলেন! কাল বিকেলে দর্শন দিয়ে যখন বললেন, ‘স্রেফ সাইট-সিইং’ তখনও অবশ্য মনে মনে একটু সন্দেহ জাগেনি, এমন নয়। কারণ সত্যিই যদি এটা নিছক সাইট সিইং হয়, তাহলে কেন থানায় গিয়ে নিজের উপস্থিতি জানাতে এত ব্যগ্র? তার মানে, ইউ নিড পোলিস হেল্প! ওক্কে? তারপর দেখছি সত্যি একটা বড়ি পড়ল।

কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন–মর্গের রিপোর্টে বলছে কি শান্তকে খুন করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল?

ত্রিবেদীকে লনে বসতে একটা চেয়ার এনে দিয়েছে রামলাল। বসে বললেন– হা। মারাত্মক নিকোটিন ইঞ্জেকশান করা হয়েছিল। ডান বাহুতে সোয়েটার আর শার্টের ভেতর ইঞ্জেকশানের চিহ্ন রয়েছে। একটু চুপ করে থেকে ফের বললেন–আপনার ধারণা খুনী আগেই খাটের তলায় অপেক্ষা করছিল। জানালা খুলে পাইপ বেয়ে পালিয়ে যায়। তাই কি?

কর্নেল ইজি চেয়ারে বসে বললেন–ঠিক তাই। রাত্রে দীনগোপালবাবুর বাড়ি পাহারা দিতে সবাই নিচে ছিলেন। তখন নিশ্চয় ওপরে শান্তর ঘরের দরজা খোলা ছিল। শুনলাম রাত্রে ওঁরা সবাই একটু সন্দেহজনক শব্দেই বাইরে ছুটোছুটি করে বেড়িয়েছেন। সেই সময় কোনও সুযোগে খুনী ওপরে উঠে গিয়েছিল।

কিন্তু একটা ব্যাপারে লক্ষ্য করুন। ত্রিবেদী বললেন শান্তবাবুকে কড়িকাঠে ঝোলানো একজনের পক্ষে সম্ভব কি না! ওঁর যা বডি ওয়েট, তাতে এঁকে ওভাবে লটকাতে হলে রীতিমতো একজন ‘অরণ্যদেব’ হওয়া দরকার। একা কারুর পক্ষে এটা কি সম্ভব?

কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, সেটা আমি ভেবেছি, খুনীর একজন সঙ্গী থাকা অবশ্যই দরকার।

–তাহলে দুজন লোক শান্তবাবুর ঘরে লুকিয়ে ছিল!

কর্নেল একটু হাসলেন।–আপাতদৃষ্টে খুনীর একজন সহকারীর অস্তিত্ব অস্বীকার করা যাচ্ছে না, এটুকু বলা চলে।

ত্রিবেদী চোখে ঝিলিক তুলে রহস্যের ভঙ্গিতে বললেন–যাই হোক, আমার একটুখানি ব্যাকগ্রাউন্ড জানা দরকার।

–কিসের?

পাণ্ডের কাছে শুনলাম, দীনগোপালবাবুর ভাইঝি নীতা দেবীই আপনার এখানে আগমনের কারণ। বাসস্টপে একটা লোক’-এপিসোডটাও জানা জরুরি।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন–এই এপিসোড় সম্পর্কে মিঃ পাণ্ডে আপনাকে যতটুকু বলেছেন, আমিও ততটুকু জানি। আর নীতার ব্যাপারটা বুঝতেই পারছেন। বাসস্টপে একটা লোক ওর জ্যাঠামশাইয়ের বিপদের কথা বলায় খুব ভয় পেয়ে আমার কাছে যায় এবং সাহায্য চায়। তবে…

তাকে আবার চুপ করতে দেখে ত্রিবেদী ব্যস্তভাবে বললেন–বলুন কর্নেল!

–গত বছর অক্টোবরে যখন এখানে বেড়াতে আসি, তখন আপনি কথায়, কথায় সরডিহি রাজবাড়ির মন্দির থেকে বিগ্রহ চুরি যাওয়ার ঘটনা বলেছিলেন।

ত্রিবেদী একটু অবাক হয়ে বললেন–হ্যাঁ! কিন্তু সে তো প্রায় দু’বছর আগের কেস। এখনও সে বিগ্রহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ওপর মহলের ধারণা, আর তা উদ্ধারের আশা নেই। কারণ মূর্তিটা নিরেট সোনার এবং প্রায় হাফ কিলোগ্রাম ওজন। চোর যাকে বেচেছিল, সে হয়তো গলিয়ে ফেলেছে সোনাটা। গয়না হয়ে কত সুন্দরীর শরীরে ঝলমল করছে এতোদিনে। কিন্তু এ কেসের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?

ত্রিবেদী হাসতে লাগলেন। কর্নেল বললেন–বিগ্রহটি ছিল নৃসিংহদেবের। তাই না?

–হ্যাঁ, কিন্তু… ।

অর্থাৎ মুখটা সিংহের, শরীর মানুষের। ত্রিবেদী হতাশ ভঙ্গিতে দুহাত চিতিয়ে বললেন–ওঃ কর্নেল! আপনি বড় হেঁয়ালি করতে ভালবাসেন।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার ভেতর বললেন নীতা আমার সম্পর্কে ওর কোনও এক বন্ধুর কাছে নাকি শুনেছিল। তো ওকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওর জ্যাঠামশাইয়ের কী বিপদ হতে পারে সে ভাবছে? যেন ও একটা অদ্ভুত কথা বলল। দু’বছর আগে… ।

ত্রিবেদী কান করে শুনছিলেন। বললেন বলুন প্লিজ! থামবেন না।

–দু’বছর আগে, ওর জ্যাঠামশাইয়ের কাছে নীতা বেড়াতে এসেছিল। সঙ্গে ওর স্বামী প্রসূনও ছিল। হনিমুন বলাই উচিত। তো একদিন নীতা আর প্রসূন সন্ধ্যা অব্দি বাইরে ঘুরে এসে সোজা ওপরে জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে যায় প্রসূন পেছনে ছিল, নীতা সামনে। নীতা লক্ষ্য করে, ওর জ্যাঠামশাই একটা ছোট্ট ধাতুমূর্তি হাতে নিয়ে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় কী যেন পরীক্ষা করছেন। নীতার পায়ের শব্দেই উনি মূর্তিটা লুকিয়ে ফেলেছিলেন। মাত্র এক পলকের দেখা। তবে নীতা দেখেছিল, মূর্তিটার মুখ মানুষের নয়–কোনও জন্তুর। তাছাড়া ওর বিশ্বাস, মূর্তিটা সোনার।

ত্রিবেদী সোজা হয়ে বসে বললেন–মাই গুডনেস! তাহলে তো এখনই অ্যাকশন নিতে হয় কর্নেল!

কর্নেল হাসলেন।–একটু ধৈর্য ধরতে হবে মিঃ ত্রিবেদী।

এইসময় বাংলোর চৌকিদার রামলাল কফি নিয়ে এল। কফির পেয়ালার চুমুক দিয়ে ত্রিবেদী তার উদ্দেশে বললেন–ঠিক হ্যায়! তুম আপনা কামমে যাও।

রামলাল ঝটপট সরে গেল। সরডিহি থানার পুঁদে অফিসার-ইন-চার্জের ভয়ে ইঁদুরও গর্তে সেঁধিয়ে থাকে, তো সে এক নাদান আদমি। সে বাংলোর পেছন দিকটায় চলে গেল।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন রামলাল খুব সজ্জন লোক, মিঃ ত্রিবেদী! আমার ধারণা, আপনাদের থানার রেকর্ডে ওর নামে কিছু নেই।

বলা যায় না! ত্রিবেদী হাসছিলেন।–সরডিহি এলাকায় সজ্জন মানুষ বলতে জানতাম একমাত্র ওই বাঙালি ভদ্রলোককে। কিন্তু আপনার কাছে যা শুনলাম, মনে হচ্ছে, এখানকার মাটিতেই ক্রাইমের জীবাণু থকথক করছে।

কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে বললেন রাজবাড়ির নৃসিংহ-মূর্তি দীনগোপালবাবু নিজে চুরি নাও করতে পারেন। দৈবাৎ তার হাতে আসাও স্বাভাবিক।

–তাহলে উনি তখনই থানায় জমা দিলেন না কেন?

–এখানেই রহস্যের একটা জট রয়ে গেছে, মিঃ ত্রিবেদী! কর্নেল আস্তে বললেন।নীতাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও জ্যাঠামশাইয়ের কাছে এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুলেছিল কি না। নীতা বলল, জ্যাঠামশাই রাগী মানুষ। কাজেই যে জিনিসটা উনি ওদের সাড়া পেয়েই লুকিয়ে ফেলেছেন, তা নিয়ে কথা তুলতে ভরসা পায়নি। তখন আমি বললাম, মূর্তিটা কি প্রসূনও দেখতে পেয়েছিল? না পেলে নীতা কি ওটার কথা পরে তাকে বলেছিল? নীতা জোর– গলায় বলল, সে প্রসূনকে ব্যাপারটা বলেনি। আর তার বিশ্বাস, প্রসূন কিছু দেখতে পায়নি। পেলে নিশ্চয় সে নীতার কাছে কথাটা তুলত। যাই হোক! নীতা বলল, তার জ্যাঠামশাই নাস্তিক মানুষ। অথচ তার কাছে একটা সোনার ঠাকুর–সেটা উনি লুকিয়ে রেখেছেন! এ থেকে নীতার বিশ্বাস, ওই সোনার ঠাকুরের জন্যই ওর জ্যাঠামশাইয়ের কোনও বিপদ হতে পারে।

ত্রিবেদী সিগারেট জ্বেলে বললেন–বুঝলাম। কিন্তু বাসস্টপের লোকটাই বা কে? মনে হচ্ছে, সে দীনগোপালবাবুর হিতৈষী এবং যেভাবেই হোক জানতে পেরেছে যে, সোনার ঠাকুরের জন্য ওঁর বিপদ ঘটতে চলেছে এত দিনে। এই

–আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হতে পারে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না।

কিন্তু এত দিনে কেন?

–খুঁজে বের করতে হবে। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন।–এটাই স্টার্টিং পয়েন্ট, মিঃ ত্রিবেদী।

ত্রিবেদী উত্তেজিতভাবে বললেন–আমি কিন্তু দীনগোপালবাবুকে সোজাসুজি চার্জ করার পক্ষপাতী।

উনি অস্বীকার করবেন।

নীতাদেবী সাক্ষী। উনি আপনাকে বলেছেন।

কর্নেল হাসলেন। দীনোপালবাবু অস্বীকার করলে শুধু মুখের সাক্ষ্যে কিছু হবে না, মিঃ ত্রিবেদী–অন্তত যতক্ষণ না সোনার মূর্তিটা ওঁর বাড়ি থেকে উদ্ধার করতে পারছেন।

–ওকে! ওঁর বাড়ি তন্নতন্ন করে সার্চ করব।

–দীনগোপালবাবুকে তত নির্বোধ বলে মনে হয়নি আমার। একটু ধৈর্য ধরা দরকার মিঃ ত্রিবেদী। কর্নেল নিভন্ত চুরুট জ্বেলে ফের বললেন তার আগে একটা জরুরি কাজ করতে হবে। আশা করি, আপনার সাহায্য পাব।

-বলুন।

সম্প্রতি, মানে গত কয়েকদিনের মধ্যে সরডিহির বাজারে কোনও দোকান থেকে ডোরাকাটা মাফলার বিক্রি হয়েছে কি না…

বাধা দিয়ে ত্রিবেদী বললেন–অসম্ভব। খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার ব্যাপার। অসংখ্য দোকান আছে অসংখ্য মাফলার বিক্রি হয়েছে সিজনের মুখে।

–হলুদ রঙের ওপর কালো ডোরা। এই বিশেষত্বের জন্য দোকানদারদের মনে পড়া স্বাভাবিক।

ত্রিবেদী ভুরু কুঁচকে বললেন–আপনি শান্তবাবুর গলায় আটকানো মাফলারটার কথাই বলছেন তো?

–হ্যাঁ, মিঃ ত্রিবেদী।

–বেশ তা! ওটা নিয়ে দোকানে দোকানে খুঁজলেই হলো।

–না মিঃ ত্রিবেদী। তাতে দোকানদাররা ভয় পেয়ে যাবে। বিশেষ করে পুলিশকে দেখেই।

ত্রিবেদী একটু ভেবে বললেন–ঠিক বলেছেন। সাদা পোশাকেই কেউ খোঁজ নেবে। সে ব্যবস্থা এখনই করছি গিয়ে।

–কিন্তু হাতে ওই মাফলার নিয়ে নয়।

ত্রিবেদী হাসলেন।না, না কখনই নয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, এতে লাভটা কী হবে? ধরা যাক, এমন একটা মাফলার মাত্র একজনেরই দোকানে ছিল এবং একজনই কিনেছে। কিন্তু তাতে কি প্রমাণ হবে সেটাই শান্তবাবুর গলায় আটকানো হয়েছিল? এ যেন অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া!

কর্নেল আস্তে বললেন–ঠিক। কিন্তু ছুঁড়ে দেখতেই বা ক্ষতি কী, যদি লক্ষ্যভেদ করা যায়?

–ওকে ওল্ড বস! গণেশ ত্রিবেদী এবার একটু গম্ভীর হলেন–এস ডি পি ও সায়েবের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করে আসছি। উনি বলছিলেন শান্তবাবুর মার্ডার কেসটা সি আই ডির হাতে ছেড়ে দিতে। কারণ শান্তবাবুর সঙ্গে একসময় এলাকার একটা গুপ্ত বিপ্লবী দলের যোগাযোগ ছিল। আই বি-র ফাইল দেখে উনি এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। দলটা ডাকাতি করে বেড়াত একসময়। ডাকাতি করা টাকায় চোরা অস্ত্র-শস্ত্র কেনার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু পুলিশ দলটা। খতম করে দিয়েছে। শুধু শান্তবাবু গা ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন পরে কলকাতায়। কোনো রাজনৈতিক মুরুব্বি ধরে সেট করে ফেলেন। সরডিহি থানায় নির্দেশ আসে, ডোন্ট বার অ্যাবাউট হিম। এখন কথা হলো, সি আই ডি-র হাতে কেসটা যাক–অন্তত আপনাকে এখানে দেখার পর আমার এতে প্রচণ্ড আপত্তি। এস ডি পি ও সায়েবকে আপনার কথা তখনই বললাম। উনি আপনার কথা জানেন। তবে মুখোমুখি আলাপ হয়নি বললেন।

–কী নাম বলুন তো?

রণবীর রায়। বাঙালি। তবে এই বিহারেই জন্ম। পাটনায় ওঁদের বাড়ি।

–হু, কী বললেন রণবীরবাবু?

ত্রিবেদী একটু হাসলেন।–আর কী বলবেন, ঠিক আছে। তাহলে যা ভাল বোঝেন, করুন। আমি যা ভাল বুঝেছি, করতে চাইছি, কর্নেল।

–বলুন।

–আমি নিজের হাতে নিয়েছি কেসটা। ও বাড়ির প্রত্যেককে আলাদাভাবে ডেকে জেরা করব? স্টেটমেন্ট সই করিয়ে নেব। আপনিও উপস্থিত থাকবেন এবং আমার ইচ্ছা, আপনিও জেরা করবেন।

কর্নেল একটু ভেবে বললেন-বেশ তো! শুধু একটা শর্ত।

শর্ত? কী শর্ত বলুন তো?

–দীনগোপালবাবুকে সেই সোনার ঠাকুর সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করবেন না। আমিও করব না। অবশ্য নীতাকে ও ব্যাপারে জেরা করতে পারেন।

আর কাউকে?

করতে পারেন। সে আপনার ইচ্ছা। তবে সাবধান! দীনগোপালবাবুর সঙ্গে সোনার ঠাকুরের সম্পর্কের কথা এড়িয়ে থাকাই উচিত হবে। বরং সোজাসুজি প্রশ্ন করতে পারেন, কেউ কোনও সোনার ঠাকুর দেখেছেন কি না!

ত্রিবেদী ঘড়ি দেখে বললেন–তিনটে বাজে। শান্তর বডি দাহ করতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আমার ইচ্ছা, বরং আগামীকাল সকালে–ধরুন, নটা নাগাদ দীনগোপালবাবুর বাড়িতেই সরেজমিন তদন্ত শুরু করবো। আপন ওই সময় ওখানে পৌঁছবেন। বাই দা বাই, যে ঘরে শান্তবাবু খুন হয়েছেন, সেই ঘরটা মিঃ পাণ্ডে গিয়ে লক করেছেন এবং দুজন কনস্টেবল পাহারা দিচ্ছে। নীচেও কয়েকজন কনস্টেবল রাখা হয়েছে। কোনও রিস্ক নিতে চীনে আমি।

বলে গণেশ ত্রিবেদী উঠে দাঁড়ালেন। কর্নেল তাকে এগিয়ে দেবার জন্য উঠলেন। ত্রিবেদী জিপে স্টার্ট দিলে হঠাৎ বললেন–আচ্ছা মিঃ ত্রিবেদী, সরডিহিতে কালো অ্যালসেশিয়ান কুকুর নিয়ে কাউকে ঘুরতে দেখেছেন কখনও?

–ত্রিবেদী স্টার্ট বন্ধ করে অবাক হয়ে বললেন–কেন বলুন তো?

–আমি একজনকে কালো অ্যালসেশিয়ান নিয়ে ঘুরতে দেখেছি মাঠে।

–ত্রিবেদী ফের স্টার্ট দিয়ে জোরে মাথা নাড়লেন।–নাঃ! আমি আড়াই বছর সরডিহিতে আছি। এ পর্যন্ত তেমন কাউকে দেখিনি। কুকুর অবশ্য অনেকেই পেষেন। তবে কালো অ্যালসেশিয়ান? নাঃ–দেখিনি।

-তাহলে বাইরের লোক। বেড়াতে এসেছে কুকুর নিয়ে।

ত্রিবেদী অট্টহাসি হাসলেন।–এ কেসের সঙ্গে লিংক থাকলে বলুন, তাকে খুঁজে বের করি।

কর্নেল হাত তুলে বললেন, না। কালো কুকুর আমার চক্ষুশূল। তাই এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম। কালো নাকি অশুভের প্রতীক। আমার কিছু কিছু কুসংস্কার আছে আর কী!

ত্রিবেদীর জিপ জোরে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। এতক্ষণে রামলাল বাংলোর পেছন থেকে এসে গেট বন্ধ করল।

কর্নেল বললেন রামলাল, আমি বেরুচ্ছি। ফিরতে দেরি হলে রাতের খাবারটা আমার ঘরের টেবিলে রেখে দিও।

রামলাল মাথা দোলাল। এই খেয়ালি বুড়ো কর্নেল সায়েবকে সে গতবছরই ভালভাবে চিনে ফেলেছে। তবে এটা ঠিকই যে, সে কথামতো রাতের খাবার টেবিলে রেখে গিয়ে শুয়ে পড়বে না। যতক্ষণ না কর্নেলসায়েব ফেরেন, সে জেগে থাকবে এবং গরম খাবারই পরিবেশন করবে।

সকালে যে উঁচু ঢিবির মতো জমিতে লাল ঘুঘুর আঁক দেখেছিলেন কর্নেল, সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। পড়ন্ত সূর্য প্রায় সামনা সামনি, তাই বাইনোকুলার ব্যবহার করার সমস্যা। নিচু জমিতে, যেখানে ছাইরঙা মাফলার পড়ে থাকতে দেখেছিলেন সকালে, সেখানে পৌঁছুতেই কোথাও চাপা গর্জন শুনতে পেলেন। কুকুরেরই গরগর গর্জন। থমকে দাঁড়ালেন। উঁচু ঝোঁপঝাড়ে ভরা ঢিবি জমি থেকে কালো কুকুরটা তার দিকে তেড়ে আসছে।

ঝটপট জ্যাকেটের পকেট থেকে নিজের আবিষ্কৃত প্রখ্যাত ‘ফর্মুলা-টোয়েন্টির’ কৌটোটি বের করলেন। প্রজাপতি ধরা জালের স্টিকের মাথায় কৌটোটা আটকানোর ব্যবস্থা আছে। কৌটো আটকে ছিপি খুলে স্টিকটা উঁচিয়ে ধরলেন কর্নেল।

কুকুরটা আসছিল দক্ষিণ থেকে। বাতাস বইছে উত্তর থেকে। ঝোপের কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। প্রকাণ্ড কুকুর। কুচকুচে কালো রঙ। লকলকে জিভ। গলার ভেতর বাঘের গজরানি যেন।

কর্নেল স্টিক উঁচিয়ে দু-তিন পা এগোতেই কুকুরটা কুঁই কুঁই শব্দ করে ঘুরল। তারপর লেজ গুটিয়ে নিমেষে অদৃশ্য হলো।

কর্নেল আপন মনে হাসলেন। কুকুর জব্দ করা এই বিদঘুটে গন্ধের লোশন আরও পাঁচটা টুকিটাকি জিনিসের মতোই তাঁর সঙ্গে থাকে, যখনই বাইরে কোথাও যান। কিন্তু সরডিহিতে এটা এত কাজে লাগবে, কল্পনাও করেননি।

কৌটোটা জ্যাকেটের ভেতর পকেটে চালান করে এবার দ্রুত মাফলারটা পড়ে আছে কি না খুঁজে নিলেন। নেই। কেউ কুড়িয়ে নিয়ে গেছে। আর, সেটাই স্বাভাবিক।

পরমুহূর্তে একটা অনুভূতি তাকে চমকে দিল–ষষ্ঠেন্দ্রিয়জাত বোধ, যেন কেউ উঁচুতে ঝোপের ভেতর দিকে তাকে লক্ষ্য করছে, এবং এক সেকেন্ডেরও হয়তো কম সময়ের জন্য কী একটা শব্দ শুনেছেন, এক লাফে বাঁদিকের একটা পাথরের চাইয়ের আড়ালে গিয়ে বসে পড়লেন–ঠিক বসে পড়া নয়, আছাড় খাওয়ার মতো পড়া। লম্বা চওড়া মানুষের এরকম ঝাঁপ দেওয়ায় মাটিতে ধপাস শব্দটা বেশ জোরালোই হলো।

সেই মুহূর্তে অদ্ভুত একটা ঘাস শব্দ হলো ডানদিকে, এখনই যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন। ঘুরেই দেখলেন, নরম মাটিতে ঘাসের ভেতর একটা ভোজালি গড়নের ভারী ছোরার বাঁট কাত হয়ে আছে। কেউ প্রচণ্ড জোরে ওটা তাঁকে তাক করে ছুঁড়েছে। দেখামাত্র জ্যাকেটের ভেতর থেকে রিভলবার বের করে ওপরের ঝোপের দিকে আন্দাজে গুলি ছুড়লেন। স্তব্ধতা চিড় খেল। লাল ঘুঘুর আঁকটা কোথাও ছিল। ডানার শব্দ করে উড়ে গেল। কর্নেল নির্ভয়ে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে রিভলবার উঁচিয়ে রেখে বাঁ হাতে গলায় ঝোলানো বাইনোকুলার চোখে রাখলেন। যে ছোরা ছুঁড়েছে, তার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র কখনোই নেই।, কিন্তু ঝোপের লতাপাতা লেন্সে ঢেকে যাচ্ছে। সাহস করে এগিয়ে গেলেন। উঁচু ঢিবি জমিতে উঠে চারদিকে লোকটাকে খুঁজলেন। যেন মন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

নেমে এসে ছোরাটা তুললেন। প্রায় আট ইঞ্জি লম্বা চকচকে ফলাটা নরম মাটিতে আমূল বিঁধে গিয়েছিল। শিউরে উঠলেন কর্নেল। একটু হঠকারিতা হয়ে গেছে তার দিক থেকে। আগে ভালভাবে চারদিক দেখে না নিয়ে নিচু জমিতে এসে দাঁড়ানো ঠিক হয়নি। সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে এক চুলের জন্য বেঁচে গেছেন। সামরিক জীবনে জঙ্গলে জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধের তালিম নেওয়ার সময় এ ধরনের হামলার জন্য প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকার বোধটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেটা কখনও কখনও কাজে লাগে। কোনো শব্দ বা আড়ালে কোনো উপস্থিতি বিপজ্জনক, নিমেষে টের পান। আবার সেই বোধ আজ কাজে লাগল। কিন্তু এই অতর্কিত উত্তেজনার জন্য যতটা নয়, ছোরাটা তাকে ছুঁড়ে ফেলত ভেবেই শরীর ক্লান্ত মনে হচ্ছিল।

কর্নেল পেছনকার খোলামেলা ন্যাড়া উঁচু জমিতে উঠে একটা পাথরে বসে পড়লেন। রিভলবারটা জ্যাকেটের ভেতর ঢুকিয়ে বাঁ হাতে ধরা ছোরাটার দিকে তাকালেন। মাঠে শেষ বিকেলে উত্তরের বাতাস যথেষ্ট হিম। কিন্তু তার শরীরে অস্বাভাবিক একটু উষ্ণতা। হাত কাঁপছে। মৃত্যুর বিভীষিকা তাকে দুর্বল করে না। নির্বুদ্ধিতাজনিত ঝুঁকি নিয়েছিলেন ভেবেই এই আড়ষ্টতা আর কম্পন।

ভাবছিলেন, কেন এমন একটা ঝুঁকি নিতে এসেছিলেন–জেনেশুনেও! বার্ধক্যজনিত বুদ্ধিভ্রংশ কি অবশেষে তাকে পেয়ে বসেছে এবং এই ঘটনা তারই সংকেত? কাঁপা কাঁপা হাতে ছোরাটা পাশে রেখে চুরুট ধরালেন কর্নেল। একটু পরে ধাতস্থ হলেন। কিন্তু শরীর অবশ মনে হচ্ছিল।

সূর্য পশ্চিমের পাহাড়ের নিচে নেমে গেল ক্রমশ। ধূসর আলো ঘনিয়ে এল। অন্যমনস্কতায় অথবা স্বভাববশে বাইনোকুলারে নিচু টিলাটা দেখতে গিয়েই চমকে উঠলেন। পিপুল গাছের তলায় কালো কুকুর আর সেই লোকটাতার ব্যর্থ আততায়ী দাঁড়িয়ে আছে। দুরত্ব প্রায় সিকি কিলোমিটার। তাকে দেখছে লোকটা! আবছা হয়ে আসছে তার মুখ। কুকুরটা পেছনকার দু-ঠ্যাং মুড়ে আছে। ক্রমশ গাছের তলার কালো পাথরটার সঙ্গে কুকুরটাও একাকার হয়ে গেল।…

–কে ওখানে?

দীনগোপাল গেটের কাছে ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাড়ির বারান্দার মাথায় যে বালবটা জ্বলছে, তার আলো গেট অব্দি পৌঁছোতে ফিকে হয়ে অন্ধকারে মিশে গেছে। গলার স্বরে আজ তীব্র চমক ছিল। কর্নেল সাড়া দিয়ে বললেন–আমি দীনগোপালবাবু! কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

–ডিটেকটিভ মশাই! দীনগোপাল আস্তে বললেন। তবু প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের আভাস কথাটাতে। তা আমার কাছে কী? আপনার মক্কেল এখন নেই। শ্মশানে যান, দেখা হবে।

লনের শেষে বাড়ির সামনেকার বারান্দায় একটা বেঞ্চে একদঙ্গল কনস্টেবল বসে আছে দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল গেটের কাছে গিয়ে বললেন–আপনি কি এখানে কারুর জন্য অপেক্ষা করছেন দীনগোপালবাবু?

দীনগোপাল রুক্ষ মেজাজে বললেন–আমার জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। কারুর অপেক্ষা করছি কি না এ প্রশ্ন অর্থহীন।

–আপনি শ্মশানে যাননি দেখে একটু অবাক লাগছে দীনগোপালবাবু!

-অবাক হবার অধিকার আপনার আছে। কিন্তু আমাকে উত্ত্যক্ত করার অধিকার আপনার নেই।

কর্নেল একটু হাসলেন। উত্ত্যক্ত করতে আমি আসিনি দীনগোপালবাবু। আমি আপনার হিতৈষী।

-আমার কোনো হিতৈষীর দরকার নেই।

–নেই! তার কারণ আপনি ভালই জানেন যে, আপনার প্রাণের ক্ষতি কেউ করবে না।

দীনগোপাল এক পা এগিয়ে বললেন–তার মানে?

তার মানে, আপনাকে মেরে ফেললে কারুর কোনও লাভ তো হবেই না, ভীষণ ক্ষতি হবে।

–এ হেঁয়ালির অর্থ বুঝলাম না।

–সোনার ঠাকুর ফিরে পাওয়ার আর সম্ভাবনাই থাকবে না।

দীনগোপাল কয়েক মুহূর্তের জন্য পাষাণমূর্তি হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর গলা ঝেড়ে আস্তে বললেন–সোনার ঠাকুর? কী অদ্ভুত কথা!

দীনগোপালবাবু! আপনি এবার বুঝতে পেরেছেন কি শান্তকে কেন মরতে হল?

দীনগোপালবাবু আবার পাষাণমূর্তি হয়ে গেলেন।

কর্নেল বললেন–আমি অন্তর্যামী নই। নিছক অঙ্ক কষে দুইয়ে দুইয়ে চার করেছি মাত্র। সরডিহির রাজবাড়ির সোনার ঠাকুর তারই গুপ্ত বিপ্লবী দল চুরি করেছিল, এটা স্পষ্ট। শান্ত সেটা আপনার বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিল। দৈবাৎ আপনি সেটা দেখতে পান। শান্তকে বাঁচানোর জন্যই আপনি সেটা লুকিয়ে ফেলেন। শান্ত খুঁজে না পেয়ে দলের কাছে কৈফিয়তের ভয়ে পালিয়ে যায়। সম্ভবত তারপরই নীতা তার স্বামীকে নিয়ে হনিমুনে আসে এখানে। এদিকে আপনি ঠিক করতে পারছিলেন না, মূর্তিটা কী করবেন। ফেরত দিতে গেলে ঝুঁকি ছিল। আপনাকে মিথ্যা কথা বলতে হতো। দীনগোপালবাবু, আপনি এমন মানুষ, যিনি সত্য গোপন করার চাইতে মিথ্যা বলাটাই অন্যায় মনে করেন। অতএব আপনি সত্যকে গোপন রেখে আসছেন এতদিন। কিন্তু আপনার এই নীতিবোধের ফলেই শান্তকে ফাঁদে পড়ে প্রাণ দিতে হলো।

দীনগোপাল হঠাৎ ঘুরে হনহন করে চলে গেলেন বাড়ির দিকে।

কর্নেল একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর রাস্তায় নেমে এলেন। সেচ বাংলোর দিকে এগিয়ে চললেন। কিছুটা চলার পর পুরসভা এলাকায় রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্ট থেকে আলো পড়েছে রাস্তায়। রাস্তাটা ডাইনে ঘুরে সরডিহি বাজার ও বসতির ভেতর ঢুকে গেছে। বাঁদিকে সংকীর্ণ ঢালু রাস্তাটা গেছে সেচ বাংলোর দিকে। এ রাস্তার আলো নেই। দুধারে ঘন গাছপালা। প্যান্টের এক পকেটে রুমালে জড়ানো ছোরাটার অস্তিত্ব অনুভব করলেন কর্নেল। সহসা তীব্রভাবে একটা গা শিরশির করা বিভীষিকা কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকে নাড়া দিল। অন্য পকেট থেকে দ্রুত টর্চ বের করে জ্বাললেন।

দুধারে আলো ফেলতে ফেলতে হাঁটছিলেন কর্নেল। এমন কি রিভলবারটাও বের করে তৈরি রেখেছেন, মৃত্যুর বিভীষিকা পিছু ছাড়ছে না যেন।

রামলালকে বারান্দার আলোয় দেখা গেল চড়াইয়ে ওঠার মুখে। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। গায়ে চাদর জড়ানো। আজ শীতটা একটু জোরালো হয়েছে। এখানে এভাবেই হঠাৎ শীত রাতারাতি বেড়ে যায়।

গেটে পৌঁছুলে সে উঠে দাঁড়াল। সেলাম দিয়ে এগিয়ে এল। বলল কলকাত্তাসে এক বাঙ্গালি সাহাবলোক আয়া স্যার। তিসরি নাম্বারামে উনহিকা আগাড়ি বুকিং থা। মালুম, ডি ই সাহাবকা কৈ জানপহচান আদমি। পুছতা এক নাম্বারমে কৌন আয়া? হাম বোলা, কর্নেল সাহাব।

কর্নেল দেখলেন পশ্চিমের তিন নম্বরের দরজা বন্ধ। পূবে জলাধারের দিকটায় এক নম্বর। কর্নেল তালা খুলে ঘরে ঢুকলেন! দরজা থেকে রামলাল মৃদু হেসে বলল–কফিউফি পিনা জরুরি হ্যায় স্যার। আজ বহৎ ঠাণ্ডা মালুম হোতা!

–হ রামলাল। কফি! বলে কর্নেল দরজা ভেজিয়ে দিলেন এবং পকেট থেকে রুমালে জড়ানো ছোরাটা বের করে বালিশের তলায় রেখে দিলেন। ইজিচেয়ারে বসে সাদা দাড়ি খামচে ধরে চোখ বুজলেন অভ্যাসমতো।

একটু পরে দরজায় টোকা দিয়ে রামলাল সাড়া দিল কফি স্যার।

–আও রামলাল। বলে কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন।

রামলাল পাশের টেবিলে কফির পেয়ালা রেখে বেরিয়ে যাবার সময় দরজা আগের মতো ভেজিয়ে দিচ্ছিল। কর্নেল বললেন–রনে দো!

রামলাল চলে যাওয়ার মিনিট দুই পরে খোলা দরজার সামনে একজন স্মার্ট চেহারার যুবক এসে দাঁড়াল। পরনে ঘিয়ে রঙের জ্যাকেট আর জিনস। একটু হেসে নমস্কার করে বলল-আসতে পারি?

কর্নেল এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বললেন–আসুন!

যুবকটি ঘরে ঢুকে একটু তফাতে একটা চেয়ারে বসে বলল–আপনিই কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার? আমার সৌভাগ্য, আপনার সঙ্গে এখানে মুখোমুখি পরিচয় হবে কল্পনাও করিনি। চৌকিদারের কাছে বর্ণনা শুনেই চিনতে দেরি হয়নি, আপনি তিনিই।

–আপনি আমাকে চেনেন?

-জামাইবাবু, মানে আমার দিদি কেয়ার স্বামী অমর চৌধুরী লালবাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ডিটেকটিভ ডিপার্টের ইন্সপেক্টর। তার কাছে আপনার সাংঘাতিক সব গল্প শুনেছি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন তাহলে আমরবাবুর শ্যালক আপনি?

আমার নাম প্রসূন মজুমদার।

কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন।–আশা করি দীনগোপালবাবুর ভাইঝি শ্ৰীমতী নীতার…

প্রসূন এক নিঃশ্বাসে এবং কাচুমাচু হেসে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল–ঠিক ধরেছেন। আমিই সেই হতভাগা।

বলার ভঙ্গিতে কর্নেল হেসে ফেললেন। পরক্ষণে একটু গম্ভীর হয়ে বললেন নীতার সঙ্গে তো আপনার ডিভোর্স হয়ে গেছে?

–পুরোটা হয়নি, আইনত। প্রসূনও একটু গম্ভীর হলো–লিগাল সেপারেশনের পিরিয়ড চলছে।

–আপনার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তুলেছি বলে এ বৃদ্ধকে ক্ষমা করবেন। তবে প্রশ্নটা জরুরি ছিল।

–প্লিজ কর্নেল আমাকে তুমি বলুন।

কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন–হুঁ। তুমি আমরবাবুর শ্যালক। স্বচ্ছন্দে তুমি বলা চলে।

এবং ব্যক্তিগত প্রসঙ্গও তোলা যায়। প্রসূন শুকনো হাসল। ফের বলল– সেই সঙ্গে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে সামনে পেয়ে আশাও জাগে।

পুনর্মিলনের?

প্রসূন আস্তে বলল–নীতা বড় অবুঝ মেয়ে। দোষের মধ্যে আমি একটু আধটু ড্রিংক করি। বেহিসেবি খরচ করে ফেলি। কিন্তু ও আমাকে ভুল বুঝেছিল। অকারণ আমাকে সন্দেহ করত, আমার চরিত্র নাকি ভাল নয়। একেবারে মিথ্যা।

–হুঁ! তো তুমি কি নীতার সঙ্গে বোঝাপড়া করতেই এখানে এসেছ?

–তাই। শেষ চেষ্টা বলতে পারেন। লিগাল সেপারেশন পিরিয়ড শেষ হতে আর এক মাস বাকি।

–তুমি কীভাবে জানলে নীতা সরডিহিতে এসেছে?

–আমার দিদি কেয়ার সঙ্গে নীতার খানিকটা বন্ধুত্ব আছে। বয়সের তফাত মেয়েদের মধ্যে বন্ধুতার বাধা নয়, আপনি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন।

–তোমার দিদি তোমাকে বলেছে নীতা সরডিহি গেছে?

কথা প্রসঙ্গে বলে ফেলেছিল। মানে, জামাইবাবুর সঙ্গে নীতাদের ব্যাপারে কী আলোচনা করছিল। তখন…

–কেন গেছে বলেনি তোমার দিদি? প্রসূন একটু অবাক চোখে তাকিয়ে বললনা তো! তাছাড়া নীতা তো মাঝে মাঝে আসে এখানে।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন–তুমি শান্তকে নিশ্চয় চেনো?

চিনি। উগ্রপন্থী রাজনীতি করে। জামাইবাবু ওকে বহুবার বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

–তুমি জানো গত রাতে ওর জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে শান্ত খুন হয়েছে?

প্রসূন ভীষণ চমকে উঠল।–শান্ত খুন হয়েছে? শান্ত…সর্বনাশ!

বলেই সে চেয়ার থেকে উঠে পড়ল এবং ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কর্নেল তাকিয়ে রইলেন শুধু। একটু পরে বাইরে গিয়ে দেখলেন, তিন নম্বর ঘরের দরজায় তালা আঁটা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress