বাহন বিড়ম্বনা
“এবার অন্তত একটা বাইক কেন তুই কাজল” পিঠ চাপড়ে কিছুটা তাচ্ছিল্য করে সেদিন স্টেশনে বলেছিল প্রাণ কৃষ্ণ । ট্রেন থেকে নেমে স্ট্যান্ডে দুই স্কুল বন্ধু নিজের নিজের বাহন বের করতে গিয়ে নানা কথার মধ্যেই কাজলকে আর একধাপ উঠে প্রাণকৃষ্ণ, “কি রে, নাহয় বল আমি সহজ কিস্তিতে ব্যবস্থা করছি গাড়ি লোন” । প্রত্যুত্তরে কাজল বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছিল, ‘ কিচ্ছু দরকার নেই ভাই, আমার পুরনো সাইকেলটা ছিল আবার গত পূজায় এই নতুন সাইকেলও কিনেছি। শুনে প্রাণ এমন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো যেন কাজলটা কি না বোকা!
প্রাণ আর কাজল একসাথে স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করেছিল তারপর চাকরি সূত্রে দুজনের পথ আলাদা হয়ে যায় । কাজল স্বাস্থ্য দপ্তরের একটা প্রজেক্টে দিল্লিতে থাকার পর প্রায় বারো বছর ফিরেছে নিজের শহর বর্ধমানে। এখন তার কলকাতায় নতুন কাজ। কাজল প্রাইমারি স্কুলে চাকরির সুবাদে প্রতিদিন ডানকুনি যায় আর সেই সূত্রে মাঝে মধ্যে দুই বন্ধুর ফেরার পথে দেখা হয়।
প্রাণ তার বাবার পুরনো বুলেট গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে আজও কাজলের সাইকেলের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কাজল গ্যাস বেলুনে পিন ফোটানোর মতো বললো, “বলি প্রাণ, যা দিন কে দিন কোলা ব্যাঙ হচ্ছিস বরং একটা সাইকেল কেন, ভালো ব্যায়াম হবে বুঝলি বন্ধু”। কোনো সাড়া না দিয়ে প্রাণ কেটে পড়তেই হো হো করে হেসে উঠলো কাজল। এমন ভাবে জব্দ না করলে এমন ধাতের মানুষ গুলো বড্ড বেড়ে যায়, হিতাহিত জ্ঞান থাকে না কাকে কখন কি বলছে!
কাজলের ঠিক এটাই খারাপ লাগে, সে বোঝে আজকাল সবটাই প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনীয়তা নিরিখে বিচার না করে স্ট্যাটাস দিয়ে মানুষকে দেখা হয়। একজন সাইকেল চাপছে মানেই তাকে নিচু দেখার কেমন যেন একটা প্রবণতা। একটা সহানুভূতি ঘুরপাক খায় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে, যেন কেনার ক্ষমতা নেই, বেচারা গরীব এমন একটা ভাবনা অন্যদের বিষয়ে ভেবে নেওয়ার ভুল প্রবৃত্তি কাজ । অথচ দূষণ বিহীন, চালানোর পক্ষে বেশ ভালো এমন একটি দ্বি-চক্রযান সাইকেলের ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতেই পারে না পৃথিবী জুড়ে, বরং সাইকেলের প্রশংসার জুরি মেলা সত্যি ভার।
আজকাল এই ভাবনা গুলো মানুষের দৃষ্টিতে ঘুরপাক খায়, বরং কমার থেকে অন্যকে আন্ডার এস্টিমেট করার প্রবণতা বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে । পাশের বাড়ির ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রটি পড়াশোনা কমপ্লিট করে যখন টিউশন শুরু করলো তার কাছে সন্তান দের পড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করেও কাজল অভিভাবক দের মুখে শুনেছে অনির্বাণ স্যার খুব ভালো কিন্তু ওই যখন সাইকেল নিয়ে পড়াতে যায় তাদের নাকি অস্বস্তি হয়। খুব আশ্চর্য লেগেছে শুনে কাজলের, পরে নিজেকে স্বান্তনা দিতে ব্যাখ্যা দিয়েছে হ্যাঁ প্রেস্টিজ তো লাগবেই, বিশাল সব মার্বেল খচিত প্রাসাদের নিচে সাইকেল স্ট্যান্ড করা থাকলে স্ট্যাটাসের দফা রফা, তারপর স্কুলে যদি জানে কোনো এক গরীব মাস্টার মশাই পড়াতে যায় সাইকেল নিয়ে, সত্যিই তো মনে সম্মান সব জলাঞ্জলি।
যারা সাইকেল চাপে তারা বেশ বোঝে এই বাহনটি কাছে পিঠে যাওয়ার জন্য বেশ ভরসা যোগ্য, যথেষ্ট খরচ বিহীন পরিবহনের সেরা ভূমিকায় তবু একে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খায় একটা অবজ্ঞা চাহনি । এটাই কি তবে আমাদের সাধের ভারতবর্ষের সার্বিক চিন্তা ভাবনা!কাজল নিজেও কাজ বা বাজারে সাইকেল নিয়ে বেরুলে কেমন যেন একটা ভেতরে গিলটি ফিল করে!অথচ এটা তার কাছে অতিবাস্তব ঘটনা এই যে তার দুবেলা সেই সকাল আর সন্ধ্যায় ট্রেন চেপে স্কুল যাওয়া, বাড়ির সামনে স্টেশন তাতে বাইক অপ্রয়োজনীয়। কেবল হয়তো ছুটির দিনে ব্যবহার হবে কিন্তু সেতো ওই দুদিন তার স্ত্রী কন্যার কাছে যায় প্রায় দেড়শ কিমি দূরত্বের অন্য শহরে! সুতরাং তার বাইক নিত্য ব্যবহারের পরিবর্তে অকেজো হয়ে নষ্ট হবে বেশি।
আজকাল যে জিনিসটা মানুষের প্রয়োজন সেটা কেনার জন্য অত্যন্ত সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যায়। সেই কারণেই গরীব বস্তির মানুষগুলোও ঝুপড়িতে সহজ কিস্তিতে টিভি, ফ্রিজ, কুলার যা কিছু আধুনিক সরঞ্জাম কিনে ফেলছে। কাজলের সুপ্ত ইচ্ছে আছে যদি ট্রান্সফার নিয়ে সে ও বহু দূর জেলায় পরে থাকা তার সহধর্মিনি হোম টাউনে ফিরতে পারে তখন তো অবশ্যই কিনবে কিন্তু এই মুহূর্তে বাইক বা স্কুটি সত্যিই তার কাছে বোঝা। মানুষ তার প্রয়োজন অনুসারে কিনবে বাহন বা অন্যান্য কিছু, তারমানে এই নয় যে, সে সাইকেল চালাচ্ছে বলে তাকে হেয় করতে হবে বা সে বড্ড গর্হিত কাজ করছে!
একবার গরমের ছুটিতে মেয়েকে নিয়ে পার্কে গেছিলো কাজল। সেখানে ছোট্ট সন্তান খেলতে খেলতে তারই ক্লাসের বন্ধুকে খুঁজে পায়। দুজনে চরম হুটোপুটি শেষে সন্ধ্যা নামতেই যখন তার মা স্কুটি স্টার্ট দিলো, কাজল মেয়ের দৃষ্টি ঘোরাতে কিছুক্ষন মাঠে ফুটবল খেলায় মন দিলো। একমাত্র কাজলই জানে তার এমন সুকৌশল অবলম্বনের কি কারণ ! আসলে ওদের সামনে সাইকেল বের করে মেয়েকে চাপিয়ে নিয়ে আসতে তার যেন কোথায় একটা কুণ্ঠা বোধ কাজ করেছিল। সে ভেবেছিলো তাকে নিয়ে যা বলে লোকে ভাবুক এর প্রভাব যেন ক্ষুদে বাচ্চার মনে না পরে তাদের ক্লাসের বন্ধুদের ভাবনার মধ্যে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটাই আমরা, এটাই আমাদের ভাবনার পরিমণ্ডল। “ও বাবা চলো গো, মা চিন্তা করবে, ঠাম্মার সন্ধ্যা আরতি দেখবো তো”! কন্যার ডাকে সম্বিত ফিরতেই ঝেড়ে মেরে উঠেছিল কাজল যা আজও তার মনকেও নাড়া দেয়। একদিন ছোট্ট কন্যা হঠাৎ ন্যানো গাড়ির কথা প্রশ্ন করে কাজলকে। কেন রে কি করে শুনলি বলতেই বাবাকে জড়িয়ে আবদার এলো, “বাবা আমাদের গাড়ি কিনবে না! কাল ওর প্রিয় বান্ধবী অনুসুয়ারা গাড়ি কিনে ক্লাসে সব্বাই কে খুশি হয়ে খবর টা দিচ্ছিল”।
“কই গো আজ তো বাজার যাবো, বেশ কিছু কেনাকাটা আছে তুমি কি পারবে ফেরার পথে বাজার আসতে”? সহ ধর্মিনীর প্রশ্নে সায় দিতেই আবার অনুরোধ ভেসে আসে, ‘ যাই হোক ঐ সাইকেল নিয়ে আসবে না কিন্তু, প্রয়োজনে আজ টোটো করে স্টেশন যাও”। কি কারণ বা বৃত্তান্ত আর জানতে চায় নি কাজল, ভেতরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলেছিল। গত বার এমন একদিন বাজারে পাশে পাশে সাইকেলটা নিয়ে হাঁটছিল ওরা দুজনে, হঠাৎ ওয়াইফের এক কলিগ সামনে পরে যায়। যখন স্ত্রী তার হাজব্যান্ডের পরিচয় করাচ্ছিল ওই কলিগের মুখে কেমন যেন একটা তাচ্ছিল্য ভাব, বেশ বুঝেছিল কাজল ও তার স্ত্রী আসল গুণ যাই হোক মানুষের, বাহ্যিক চাকচিক্য বিচার করার প্রবণতা।
তবু এটা তো মানতেই হবে সময়ের তালে তাল মিলিয়ে মানুষের সখ আহ্লাদ এটা থাকাও জরুরি। তাই প্রায় একবছর হলো যে স্কুটি কিনেছে কাজল, নিয়ম করে স্টার্টও দেয় পাছে ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় ওটাতে জং না ধরে। লক ডাউনে অফিস দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় স্কুটির ব্যবহার বেড়েছে নানা কাজে যাওয়ার জন্য কিন্তু সাইকেল জং ধরে একপ্রকার অকেজো অবস্থায়, যা এক মহা মুস্কিল। তাই ঘরে ওভাবে সাইকেলটা ফেলে আরও নষ্ট না হয় তাই ভালো ভাবে সার্ভিসিং করে কাজের দিদিকে দিয়েদিল তার ছেলে ব্যবহার করবে এই আশায়। মানুষ এক ভাবে আর হয় অন্য, দুদিন কাজের দিদি কামাই করে কে বাড়িতে আসে নি কেন খোঁজ নিতে গিয়ে কাজলের চোখ কপালে ওঠে। সে দেখে তার দেওয়া সাইকেলটা দু টুকরো হয়ে উঠোনে হতশ্রী অবস্থায় পড়ে আছে। দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার, ইস এই তার প্রিয় বাহনের শেষে কিনা এমন ভগ্ন দশা দেখতে হলো তাকে!এই কিনা সম্মান প্রদর্শন!
সময়ের সাথে সাথে পুরনো জিনিস বাতিল করতে হয় এটা ধরে নিয়েও সাইকেলের গুরুত্ব যে কি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ সারা বিশ্ব এই দূষণ বিহীন অত্যন্ত সহজ পরিবহনের বাহন সাইকেল কে বেশি বেশি বুকে টেনে নিচ্ছে নির্দ্বিধায়। বড়ো বড়ো মহারথী, নেতা মন্ত্রী রাষ্ট্র প্রধান গণ তাদের পার্লামেন্ট যাওয়ার বাহন হিসাবে সাইকেলের ব্যবহার বাড়িয়ে চলেছে আর আমরা স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বছর অতিক্রম করে অন্যদের যা খুশি বলে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভেবে আনন্দ পাই। লক ডাউনের পরবর্তী কালে সামগ্রিক পরিবহন ব্যবস্থা স্তব্ধ থাকার সময় প্রচুর মানুষ তাদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য সাইকেলের উপর শরণাপন্ন হয়। সেই সময় বেড়ে যায় সাইকেল কেনার হিড়িক যা দেখে কাজল ভীষন খুশী হয়। সেও একটা কিনে ফেলেছিলো বাহন সাইকেল যা স্কুটির পাশে রেখে এখন খুব খুশি। নতুন সাইকেল কাজলের মধ্যে জমা ক্ষত গুলো মুছিয়ে দিয়েছে অনেকটা। কাজলের গর্ব করে বলতে ইচ্ছা করছে, “হ্যাঁ আমি এখনো সাইকেল চালাই”।