বালিডাঙার মাঠ
মির্জানগরের মাঠ পেরিয়ে কানানদী পার হয়ে কিছুটা পথ গেলেই ডান দিকে যে পুকুরটা পড়বে সেই পুকুরকে এ অঞ্চলের লোক এড়িয়ে চলে। কেননা, ভয়ঙ্কর পুকুর সেটা। সুরুকখানার পুকুর। পুকুরের চারপাশে ঘন বাঁশবন। গভীর কালো জল। পুকুর-ভর্তি মাছ। কিন্তু ধরে না কেউ। এমনও প্রবাদ আছে, এই পুকুর থেকে নাকি মাছরাঙায় মাছ নেয় না। সাপেও ব্যাঙ ধরে না। অথচ মেছো পুকুর। আদিবাসী সম্প্রদায়ের কিছু লোক বা যাযাবর বেদেনিরা দু-একবার চেষ্টা করেছিল এই পুকুরের পাশে বসবাস করে এর বদনাম ঘোচাতে কিন্তু পারেনি। একরাত যে থেকেছে সে-ই বলেছে ‘বাপরে বাপ’।
তা এই পুকুরকে নিয়ে কিন্তু আজকের এই গল্প নয়। বর্ধমানের মুছখানা মথুরাপুর থেকে হরিহর যাচ্ছিল ওর বোনের বাড়ি। অনেকদিন কোনও খবরাখবর না পেয়ে মনে মনে খুব উৎকন্ঠিত হয়েছিল। এমন সময় হঠাৎই একজনের মুখে শুনতে পেল ওর বোনের নাকি খুব অসুখ। তাই আর একটুও দেরি না করে সে গামছায় দুটি মুড়ি বেঁধে রওনা হল বোনের বাড়ির দিকে।
হরিহর যে পথে যাচ্ছিল সেই পথেই এই সুরুকখানা এবং বালিডাঙার মাঠ। তা এই দুটো জায়গাই ছিল খুব খারাপ। এখন বালিডাঙার মাঠ পার হতে পারলে খুব তাড়াতাড়ি ওর বোনের বাড়ি পৌঁছনো যায়। আর এই মাঠকে ত্যাগ করলে বা অন্য পথে ঘুরে গেলে তিন-চার মাইল পথ হাঁটা তো বেশিই হয় উপরন্তু বোনের বাড়ি পৌঁছতে রাতও হয়ে যায় খুব। তাই হরিহর মনের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করে জেনেশুনেই এই বালিডাঙার মাঠে নামল।
ভূতের উপদ্রবের জন্য এ-মাঠে চাষও হয় না বলতে গেলে। আর লোকজনও থাকে না। হরিহর মাঠে নেমে দেখল, ধু-ধু করছে মাঠ। দিগন্তবিস্তৃত। চৈত্রের রোদ্দুরে লি-লি করছে যেন। এই দিনের আলোয় তাই ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। একবার জয়দুর্গা বলে কোনওরকমে মাঠটা পার হতে পারলেই নিশ্চিন্তি। রাতভিত হলে অবশ্য অন্য কথা ছিল। এখন এখানে ভয় কী? ভূতেরা আর যাই করুক দিনের বেলায় তো ভয় দেখাবে না। আর সত্যিই যদি ভয় দেখায় তো ভূত কী জিনিস তা স্বচক্ষে দেখাই যাবে। কেননা, ভূত আছে শুনেছে। অন্ধকারে পুকুরপাড়ে বনে-বাদাড়ে ভূতের ভয়ে গা ছমছম করে, তাও জানে। কিন্তু ভূত ও নিজে কখনও দেখেনি, বা কেউ দেখেছে বলে শোনেনি। তা এই বালিডাঙার মাঠে এসে সত্যি-সত্যিই যদি ভূত দেখা যায় তো মন্দ কী?
হরিহর আপন মনেই এগিয়ে চলেছে। তা ছাড়া সত্যি বলতে কী, মনটাও ওর ভাল নেই। বহু কষ্ট করে বোনটার বিয়ে দিয়েছে ও। অথচ এই এক বছরের মধ্যে ওর এমন একটা অসুখের কথা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। তাই স্বাভাবিকের চেয়েও একটু দ্রুত পা চালিয়ে ও মাঠের ওপর দিয়ে পথ চলতে লাগল।
বেশ খানিকটা গেছে এমন সময় হঠাৎই মনে হল কে যেন ওর পেছন-পেছন আসছে। হরিহর একবার তাকিয়ে দেখল। কই, কেউ তো নেই। আবার চলা শুরু করল। আবার ওই একই রকম মনে হল। ভারী মজার ব্যাপার তো!
এমন সময় হঠাৎ ওর সামনে কে যেন একজন পথরোধ করে দাঁড়াল। দেখল কাস্তে হাতে এক কৃষাণ। মাথায় গামছার ফেট্টি বাঁধা। কৃষাণটি গম্ভীর গলায় বলল, “ওহে ও ছোকরা, বলি এই ভরদুপুরে বালিডাঙার মাঠ পার হয়ে যাচ্ছ কোথায়?”
হরিহর বলল, “আমার বোনের খুব অসুখ। তাই দেখতে যাচ্ছি।”
“কেন, আর কোনও পথ ছিল না?”
“সে-পথে গেলে রাত্রি হয়ে যাবে, তাই এই পথে যাচ্ছি। খুব বাড়াবাড়ি অসুখ কিনা।”
“বাড়াবাড়ি না ছাই। বুকে সর্দি বসে জ্বর হয়েছিল। এখন সেরে গেছে। ভালই আছে এখন। তুমি আর এগিও না। যেমন এসেছ তেমনই ফিরে যাও। হয় ঘুরে যাও, নয়তো ঘরে যাও।”
“তা কী করে হয় ভাই?”
“যা বলছি শোনো। আর এগিও না। আমাদের সভা চলছে এখন। গেলে অসুবিধে হবে। তোমার বোনের বাড়ির খবর ভাল।”
হরিহর বলল, “খবর ভাল হোক মন্দ হোক, এত পথ কষ্ট করে এসেছি যখন, ফিরে তো যাব না। আবার কাল কে আসে? যা হয় হবে। আমি যাবই।”
কৃষাণ বলল, “আমার কথা তা হলে শুনবে না তুমি?”
হরিহর ওর কথার উত্তর না দিয়েই এগিয়ে চলল। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরই হঠাৎ ওর শরীরে কীরকম যেন একটা শিহরন খেলে গেল। ও দেখল একটা প্রাচীন বটগাছের নীচে কতকগুলো কায়াহীন ছায়া গোল হয়ে বসে আছে। আর তাদের মাঝখানে বসে আছে গলায় হাড়ের মালা পরা আর-এক ছায়ামূর্তি। এই কি তবে ভূতের রাজা? আর এরা সবাই ভূত? ভূত ছাড়া এরা আর কীই-বা হতে পারে? কারও কোনও শরীর নেই। শুধু ছায়াগুলো রয়েছে।
হরিহর যেতেই ওদের সভার কাজ থেমে গেল।
সবাই চুপচাপ।
ভূতের রাজা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে হরিহরের দিকে তাকিয়ে বলল, “কে তুই! এমন আচমকা এসে পড়ে আমাদের সভার কাজ পণ্ড করলি কেন?”
হরিহর দারুণ ভয় পেয়ে বলল, “আজ্ঞে, আমি নিরুপায় হয়ে এই পথে এসে পড়েছি। তা ছাড়া আমি তো আপনাদের কোনও ক্ষতি করিনি। আমি তো এপাশ দিয়ে যাচ্ছি।”
“আমার কোনও লোক তোকে এ-পথে আসতে বারণ করেনি?”
“করেছিল। তবে সে যে আপনার লোক তা অবশ্য আমি জানতাম না।”
“সে আমারই লোক।”
ভূতের রাজা হরিহরকে আর কিছু বলল না, শুধু হাত নেড়ে দলের লোকেদের ইশারা করতেই সবাই মিলিয়ে গেল। পরক্ষণেই ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া বইল শুধু। হরিহর বুঝল কাজটা সে সত্যিই ভাল করেনি।
হরিহরের একবার ভয় হল। আবার ভয়কে জয়ও করল সে। জীবনে এই প্রথম ভূত দেখল ও। তাও দিনদুপুরে। এ গল্প ও করবে কার কাছে? যাকে বলতে যাবে সেই তো
হাসবে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক হরিহর নিজে তো করেছে। হ্যাঁ, আছে। সত্যিই আছে। এবং সে ভূত জনশ্রুতির নয়, বাস্তবের। কেননা, সে নিজের চোখে ভূত দেখেছে।
যাই হোক, সন্ধের আগেই সে বোনের বাড়িতে পৌঁছল। হরিহরের মুখে সব কথা শুনে ওর বোনের শ্বশুর এবং অন্যান্য লোকেরা সবাই খুব বকাবকি করল ওকে। সবাই বলল, “কাজটা খুব ভাল করোনি হরিহর। যে-পথে কেউ আসে না সে-পথে এই ভরদুপুরে কেন তুমি এলে? তাও এলেই যখন, ওই কৃষাণের নিষেধ তুমি উপেক্ষা করলে কেন? এখন যদি তুমি ওদের কোপদৃষ্টিতে পড়ো, তোমাকে রক্ষা করবে কে?”
হরিহরের বোন বলল, “তা ছাড়া আমার সত্যি-সত্যিই কোনও ভারী অসুখ হয়নি দাদা। সামান্য একটু জ্বরই হয়েছিল। বুকে সর্দি বসে জ্বর। কয়েকটা ইনজেকশন নিতেই সেরে গেছে। এদিকে অনেকদিন তুমি আসোনি বলে তোমার কোনও খবর-টবর না পেয়ে মনে দুঃখ হয়েছিল খুব। দারুণ অভিমান হয়েছিল। তাই আমাদের গ্রামের একজন লোক তোমাদের ওদিকে গেলে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বউমা, তোমার বাপের বাড়িতে কোনও খবর দিতে হবে?’ তা আমি বলেছিলাম, ‘না। কোনও খবরই দিতে হবে না। তবে দাদার সঙ্গে যদি দেখা হয়, কিছু যদি জিজ্ঞেস করে তখন বোলো যে, তোমার বোন মরতে বসেছে। তুমি সেই কথা শুনেই ছুটে এসেছ দাদা। কিন্তু এটা তুমি কী করলে?””
যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। কাজেই আর ভেবেচিন্তে কোনও লাভ নেই। এখন ভালয়-ভালয় ও পথ ত্যাগ করে অন্য পথে বাড়ি ফিরতে পারলেই হয়! কিন্তু বাড়ি ফেরার আগে সেই রাতেই হরিহর দু-একবার রক্তবমি করে অসুস্থ হয়ে পড়ল। শুধু কি রক্তবমি? সেইসঙ্গে প্রবল জ্বর আর ভুল বকা।
পরদিন সকালেই হরিহরের ইচ্ছেমতো ওর বোনের বাড়ির লোকেরা হরিহরকে গোরুর গাড়িতে শুইয়ে তার গ্রামে পাঠিয়ে দিল।
বালিডাঙা থেকে অত শরীর খারাপ নিয়ে মথুরাপুরে ফিরে এল বটে হরিহর, তবে কিনা কাজের কাজ কিছুই হল না। যত দিন যেতে লাগল ততই স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে লাগল ওর। বহু ডাক্তার বদ্যি ওঝাপত্তর করল। কিন্তু না। কিছুতেই কিছু হল না। হাজার রকমের তুকতাক, জলপড়া, ঝাড়ফুঁক, সবই বৃথা হল।
অবশেষে এক সত্যিকারের গুনিনের সন্ধান পেল ওর বাড়ির লোকেরা।
গুনিনকে সন্তুষ্ট করে ডেকে আনতেই সব দেখেশুনে গুনিন বললেন, “হ্যাঁ। আমি পারব এ ভূত ছাড়াতে। এ বড় জাঁদরেল ভূত। খুব রেগে গিয়ে ধরে আছে ওকে।”
তা গুনিনের ঝাড়ফুঁকে সত্যিই কাজ হল। দু-চারবার সরষে চোঁয়া ছুড়ে মারতেই আর প্যাকাটির ফুঁ দিতেই “বাবা রে, মা রে” করে ভূত হরিহরকে ছেড়ে পালাতে পথ পেল না। কিন্তু মুশকিল হল এই, গুনিন আসেন, ঝাঁড়ফুঁক করেন, ভূতও পালায়। কিন্তু যেই গুনিন বাড়ি ফেরেন, ভূত এসে আবার ধরে। বারবার যখন এইরকম হতে থাকে রোগীর বাড়ির লোকেরা তখন আবার ধরে গুনিনকে। বলে, “বাঁচান মশাই। মরে গেলুম। আর তো পারি না। আপনি গেলেই রোগী সুস্থ হয়। আর আপনি খালপার হলেই আবার ধরে রোগীকে।”
তা সেদিন গুনিন নিবারণ হালদারমশাই খুবই রেগে বললেন, “আজই তা হলে ও ব্যাটার শেষদিন হোক। ওর জন্য আমার কেন বদনাম হয়। তা ঠিক আছে, তোমরা যাও। আজ গিয়ে আমি এমন ওষুধ দেব যে, আর ওর ধারেকাছে কোনও ভূত কখনও আসতে সাহস করবে না। ও ভূত তো কোন ছার।” এই বলে হালদারমশাই তাঁর শেষ দাওয়াই ব্রহ্মকবচ হাতে নিয়ে রওনা হলেন রোগীর বাড়ির দিকে।
গ্রামসুদ্ধ লোক গুনিনের কেরামতি দেখবার জন্য হাঁ করে বসে ছিল। গুনিন যেতেই হইহই করে উঠল সকলে।
হালদারমশাই বললেন, “না, আজ আর আমি কোনওরকম ঝাড়ফুঁক করব না। একটা রক্ষাকবচ পরিয়ে দেব শুধু। তারপর দেখব কোন ভূতে কী করে ওকে ধরে।” গুনিনকে দেখেই ভূত পালাল।
সুস্থ লোকটির গলায় কবচ বেঁধে গুনিন বললেন, “এই তোমার রক্ষাকবচ বাবা। খুব যত্নে রেখো এটা। অন্তত বছরখানেক। আর তোমাকে ভূতে ধরবে না।”
হরিহর হালদারমশাইকে প্রণাম করল। এবং সত্যি-সত্যিই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। অর্থাৎ, সেদিন গুনিন চলে যাওয়ার পরেও আর তাকে কোনও ভূতেই ধরল না।
এই ব্যাপারে ওঝা হিসেবে নিবারণ হালদারের ধন্য ধন্য পড়ে গেল চারদিকে। পড়বে নাই-বা কেন? এমন বেয়াড়া ব্যাপার তো হামেশা ঘটে না। তা কে কবেই বা এসব দেখেছে। ওইরকম একটা ঢ্যাঁটা-ভূতকে জব্দ করা কি চাট্টিখানি কথা? হালদারমশাইও তাই বিজয়গর্বে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন চারদিকে।
পরদিন সন্ধেবেলা ফাঁকা মাঠে একা পেয়ে ভূতেরা এসে ধরল হালদারমশাইকে। বলল, “হালদার, তুই মস্ত গুনিন। গুনিনের সেরা গুনিন। কিন্তু আমাদের পেছনে লেগে তুই খুব একটা ভাল করলি না। এখনও বলছি আমাদের শিকার আমাদের হাতে তুলে দে।”
হালদার বললেন, “থাম ব্যাটারা। আমি নিবারণ হালদার। আমার সঙ্গে লাগতে আসিস না। আর ওকে তোদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তা হলে এই যে দেশময় ধন্যি-ধন্যি পড়ে গেছে আমার নামে, সব তা হলে বৃথা হয়ে যাবে। তোরা অন্য কাউকে ধর। আমি তাকে ছাড়াব না।”
“হরিহর আমাদের শিকার। আমরা খুব রেগে আছি ওর ওপর। কাজেই ওকে ছাড়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।”
“তা আমার কী? হরিহরকে ভাল করে আমার দেশজোড়া খ্যাতি। এ সুনাম আমিও হারাতে চাই না।”
ভূতেরা বলল, “আমাদের কথা তুই শুনবি না তা হলে?”
“না।”
“ঠিক আছে। আমরাও এর বদলা নেব। তোর একটিমাত্র ছেলে তো? আনাচে-কানাচে যেখানে-সেখানে ঘোরে। আমরা তার গলা টিপে মারব। তবে তোকে আমরা আর একবার ভেবে দেখার সময় দিলাম।”
“তোদের যা ইচ্ছে কর।”
“তা তো করব। কিন্তু এখনও বলছি হালদার, ওই কবচ তুই খুলে নিয়ে আয়।’
“সম্ভব নয়।”
“তা হলে ধরলাম তোর ছেলেকে। তোর ছেলে এখন পুকুরপাড়ে ওর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। ধরলাম ওকে। এখনই বেশি ক্ষতি করব না। তবে ঘাড়টা একটু ব্যথা করে দেব।” বলে একটু নীরবতার পর আবার বলল, “তোর ছেলের মুখ দিয়ে এখন রক্ত উঠছে হালদার। তাড়াতাড়ি যা। তবে তুই যাওয়ার আগেই আমরা ওকে ছেড়ে দেব।” এই কথা বলেই ভূতেরা বেপাত্তা।
আর নিবারণ হালদারও দারুণ ভয় পেয়ে ছুটলেন সেই পুকুরপাড়ে তাঁর ছেলের কাছে। ওই তো। ওই তো তাঁর ছেলেকে ঘিরে সবাই কেমন গোল হয়ে বসে আছে। তবে কি সত্যিই ভূতেরা ধরল ওকে?
হালদারমশাই গিয়ে ঝাড়ফুঁক করে জলপড়া দিয়ে ছেলেকে ঘরে আনলেন। ছেলের তখন প্রবল জ্বর। অনবরত ভুল বকছে। শুধু বলছে, “ও বাবা গো! কী বড় বড় চোখ। ও বাবা গো। আমাকে কামড়াতে আসছে। আমি মরে যাব বাবা গো। ওই দ্যাখো, আমার কাঠ সাজাচ্ছে।”
হালদারমশাই দেখলেন গতিক সুবিধের নয়। তাঁর যতরকম বিদ্যে জানা ছিল প্রয়োগ করে ছেলেকে তিনি সুস্থ করবার চেষ্টা করলেন। অবশেষে অনেক চেষ্টার পর একটু সুস্থ হল ছেলেটি।
পরদিন সন্ধেবেলা ভূতেরা আবার হালদারমশাইকে বলল, “কী গুনিন, দেখলি তো আমাদের মহিমা? আমরা যা বলি তা করি। এখনও সময় আছে কিন্তু। তোর ছেলেকে শুধু ধরেই একটু মোচড় দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। এবার কিন্তু জানে মেরে দেব। ভেবে দ্যাখ কী করবি? তোর কাছে খ্যাতি বড় না ছেলে বড়? ভেবে দ্যাখ, তোর কিন্তু ওই একটিমাত্র ছেলে।”
হালদার বললেন, “আমার কাছে খ্যাতিই বড়। ছেলে নয়।”
“ঠিক আছে। হরিহরের বদলাটা তোর ছেলেকে দিয়েই নিতে হবে দেখছি। তবে আর একবার সুযোগ তোকে দেব।”
হালদার চিন্তান্বিত হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। চিন্তার কারণ আছে বইকী! হতচ্ছাড়া ভূতগুলো আগে যদি কিছু বলত, তখন না হয় চিন্তা করে দেখা যেত। কিন্তু এখন নিজের হাতে লোকের গলায় কবচ বেঁধে সেই কবচ খুলে আনবে কী করে? এদিকে ওদের যত রাগ এখন ছেলেটার ওপর পড়েছে। হালদারমশাইয়ের সবকিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে যেতে লাগল।
বাড়ি ফিরতেই হালদারমশাইয়ের স্ত্রী তো কেঁদে এসে হালদারের পা দুটি জড়িয়ে ধরলেন।
হালদার বললেন, “কী ব্যাপার! হল কী তোমার? কাঁদছ কেন?”
“তার আগে বলো, তোমার কি সত্যি-সত্যিই মতিচ্ছন্ন হয়েছে?” ?”
“তার মানে
“তার মানে তুমি ভালরকমই জানো।”
“আরে! কী হল বলবে তো?”
“কী হল তুমি জানো না? এই তো একটু আগে পুকুরঘাটে আমাকে দেখা দিয়ে ওরা বলে গেল তুমি নাকি ওদের কথায় রাজি হচ্ছ না? ওরা বলছে এখনও সময় আছে, হালদারমশাইকে একটু বুঝিয়ে বলো যেন ওই কবচটা কালই গিয়ে খুলে নিয়ে আসে। ওরা এ কথাও বলেছে, আমরা সচরাচর কারও ক্ষতি করি না। ওই লোকটাকে বারণ করা সত্ত্বেও আমাদের জরুরি মিটিং-এর দিন ও জোর করে ওই মাঠে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ওরা বারবার বলেছে তুমি ওঝাগিরি করছ বলে ওদের কোনও রাগ নেই তোমার ওপর কিন্তু ওদের কথা তুমি যদি না শোনো, যদি তুমি ওদের মুখের গ্রাস ফিরিয়ে না দাও তা হলে তোমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই ওরা তোমার ছেলেকে মারবে। আমাকে মারবে। এখন বলো তোমার এত দরদ কেন ওদের ওপর? কীসের এত জেদ তোমার? শুধু তোমার গোঁয়ার্তুমির জন্যই না ওরা আমার ছেলেটার মুখ দিয়ে খানিকটা রক্ত ওঠাল। সব জেনেশুনেও চুপ করে আছ তুমি? তুমি বাপ না পিশাচ?” ▾
হালদারমশাই এবার রীতিমতো ভয় পেয়ে বললেন, “ওরা বুঝি এইসব কথা বলেছে তোমাকে?”
“না বললে জানলাম কী করে বলো?”
“কিন্তু মুশকিল হয়েছে কি জানো, আমি ওই কবচ কী করে খুলে আনব?”
“কেন? কাল সকালেই তুমি অন্য একটা বাজে কবচ হাতে নিয়ে ওদের বাড়ি যাও। তারপর গিয়ে বলো, এই নতুন কবচটা আরও বেশি জোরালো। এই কথা বলে আসল কবচটা খুলে নিয়ে নকল কবচ পরিয়ে চলে এসো। ভূতেরা বলেছে ওই কবচ খুলে নিয়ে তুমি ঘরে ফিরলেই ওরা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে মেরে ফেলবে লোকটাকে। ঝামেলা একেবারেই চুকে যাবে।”
হালদারমশাই বললেন, “বেশ। তাই করব। ওরা আবার এলে এই কথাই তুমি বলে দিও।”
হালদারগিন্নি দু’ হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন।
পরদিন সকালে হালদারমশাই নতুন একটি কবচ নিয়ে আবার গেলেন মথুরাপুরে। হরিহর তখন গোয়ালে গোরু-বাছুরের দেখাশোনা করছিল। হালদারমশাইকে দেখেই এগিয়ে এল সে, “ব্যাপার কী হালদারমশাই?”
হালদারমশাই বললেন, “ব্যাপার কিছুই নয়। শুধু দেখতে এলাম আর কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা।”
“কী যে বলেন! আপনার দেওয়া কবচ গলায় বেঁধে রেখেছি। ভূত তো ভূত, ভূতের বাবারও আর সাধ্য নেই যে এখানে আসে।”
“ঠিক আছে। এখন ওই কবচটা তুমি আমাকে ফেরত দাও।”
“সে কী!”
“ভয় নেই। এই কবচের বদলে তোমাকে আর একটা এমন কবচ দেব যে, তা আরও সাঙ্ঘাতিক। এই কবচটা তো শুধু তোমাকেই রক্ষা করবে, কিন্তু এই নতুন কবচ রক্ষা করবে তোমার পুরো পরিবারকে।”
এই কথা শুনে হরিহর সরল বিশ্বাসে কবচটা খুলে দিল হালদারমশাইকে। তাঁরই দেওয়া জিনিস তিনি ফিরিয়ে নেবেন, এতে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আবার হয়তো একদিন নতুন কোনও কবচ দেবেন। এরকম তো হতেই পারে। তাই সরল বিশ্বাসে কবচটা হালদারমশাইকে দিয়ে দিল হরিহর।
হালদারমশাই নিজে হাতে ওর গলা থেকে রক্ষাকবচটি খুলে নিয়ে নতুন একটি নকল কবচ বেঁধে দিলেন। তারপর ভগবানের নাম স্মরণ করে বেরিয়ে এলেন ওদের বাড়ি থেকে। মথুরাপুরের সীমানা যেই পেরিয়েছেন অমনই শুনতে পেলেন কে যেন বলল, “আমাদের রাজা তোর ওপর খুব খুশি হয়েছে গুনিন। আমরা তোর ওপর সন্তুষ্ট। আর তোর বউ-ছেলের কোনও ভয় নেই। এখন ওরা নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারবে। তোর ছেলের ওপর থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছি। আর এও বলে রাখছি, আমরা যদি কাউকে কখনও ধরি আর ওঝা হয়ে তুই যদি সেখানে যাস, তা হলে তোকে দেখামাত্রই আমরা তাকে ছেড়ে দেব।”
হালদারমশাই নিশ্চিন্ত হলেন। একজন রোগীকে সারাতে না পারলেও এরকম অনেক রোগীকে যদি বাঁচাতে পারেন, সেটাই বা মন্দ কী! তাঁর কর্মদক্ষতা তাতে কিছুমাত্র কমবে না। বরং উত্তরোত্তর সুনাম বৃদ্ধিই পেতে থাকবে।
ওদিকে হালদারমশাই চলে আসামাত্রই হরিহরও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। ওর বাড়ির লোকেরা দেখল হরিহরের মুখটা কেমন যেন বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। হরিহর কথা বলতে পারছে না। দুটো চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। এক অদ্ভুত আতঙ্কে নীল হয়ে আসছে ক্রমশ । বাড়ির লোকেরা দেখতে না পেলেও হরিহর বেশ বুঝতে পারল কালো পোড়া দুটো হাত ওর গলা টিপে ওকে মেরে ফেলতে চাইছে। হরিহরের শ্বাস বন্ধ হয়ে এল। ও ধীরে-ধীরে লুটিয়ে পড়ল মাটির বুকে। ওর মুখ দিয়ে এক ঝলক রক্ত বেরিয়ে এল। তারপর প্রাণহীন দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটির বুকে।
ওর বাড়ির লোকেরা গুনিনকে ডাকতে ছুটল। কিন্তু গুনিন তখন কোথায়? গুনিন তখন নাগালের বাইরে।