জঙ্গলমহলের প্রাণের লোকদেবী- মা বামুন বুড়ি (সন্ন্যাসী মাতা)
শাল মহুয়ার ছায়া ঘেরা এক সুন্দর মন্দির প্রাঙ্গণ– মা বামুন বুড়ির আটন বর্তমানে মন্দির। মন্দির প্রাঙ্গণ গাছ-গাছালির ছায়া ঘেরা। ঘন সবুজ বনানীর বুক চিরে কালো অজগরের মত রাস্তা এঁকে বেঁকে গেছে দিগন্ত পেরিয়ে। বনের মাঝে এয়তির রাঙ্গা সিঁথির মতো লাল রাস্তাটা চলেছে নাম না জানা গ্রামের উদ্দেশ্য। এই অঞ্চলের মানুষদের বড় আপনজন “মা বামুন বুড়ি”– “সন্ন্যাসী মাতা”! লোকশ্রুতি যে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো এই থান— লোক পরম্পরায় যা শোনা গেল! মাঘ মাসে তিন তারিখে হয় বার্ষিক পূজা ও মেলা! সারা জঙ্গলমহল থেকে লোকজন আসেন এখানে। মানব মহাসাগর হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। বৈশাখ সংক্রান্তিতে সারাদিনব্যাপী মাতৃআরাধনা ও নাম গান হয়। দলে দলে ভক্ত জন কীর্তন করতে করতে মায়ের মন্দিরে আসেন— ছলন উৎসর্গ করেন। লৌকিক রীতিতে অব্রাহ্মণ দেহুরীর ভক্তি অঞ্জলি তে মাকে অর্চনা করা হয়। মার আরাধনা রীতি বড় মনছোঁয়া। এখানে পুজোর বিশেষ রীতি হল মালসা ভোগ দেওয়া। চিঁড়ে গুড় ফল মিষ্টান্ন খৈ সব একসাথে মিশিয়ে ভোগ তৈরি করা হয়। এছাড়াও মাটির দুটি ছলন প্রতি মালসার সাথে দেওয়া হয়। ভৈরবের জন্য গাঁজা ও কল্কে দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। জঙ্গলমহলের বিভিন্ন লোক দেবদেবীর পূজার রীতি এরকম একই।
মা বামন বুড়ি কখনো বলদ বাহিনী কখনো ঘোড়া বা হাতি তাঁর বাহন। তিনি সমগ্র জঙ্গলমহলকে তাঁর নিরাপত্তার আঁচলে ঢেকে রেখেছেন।
পাঁচটি মালসাতে চিড়ে ভোগ রাখা হয়। এবার বিভিন্ন ফুল দিয়ে ওই মালসা গুলিকে সাজানো হয়। প্রতি মালসাতে একটি করে তুলসী পাতা দেওয়া হয়। এবার প্রতি পূজক একটি মালসা অঞ্জলিতে নিয়ে মাকে কায় মনোবাক্যে নিজের প্রার্থনা জানিয়ে দেহুরীর হাতে ওই মালসা অর্পণ করেন। ওই মালসাগুলিকে এবার মায়ের ছলনে সামনে সাজিয়ে লালশালু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
পাঁচটি মালা ও তিনটি করে বেলপাতা ওই শালু ঢাকা মালসাগুলিতে অর্পণ করা হয়। ধূপদীপ দিয়ে আরতি করা হয়। পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে মাকে অন্তরের কামনা জানানো হয়।।
লালমাটিয়া অহল্যা ভূমির প্রান্তরে সরল প্রান্তিক মানুষদের বিশ্বাস ও ভক্তি এই লোক দেবদেবীদের তাদের যাপনের অঙ্গ করে তুলেছে।
লালমাটিয়া অঞ্চলের বিশাল জনজীবনের সাথে মিশে আছে লোক দেব-দেবীদের পরান কথা। এই রুক্ষ জঙ্গল ঘেরা অহল্যা ভূমির প্রান্তরে সরল প্রান্তিক মানুষদের বিশ্বাসেই পাথর জাগ্রত হয় প্রচলিত কাহিনী ও সিঁদুরের মহিমায়। এই লোক দেব-দেবীদের চরণে নিবেদিত হয় তাদের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের নৈবেদ্য। প্রকৃতিকে ঈশ্বর জ্ঞানে অর্চনা করার আবহমান ঐতিহ্যকে বজায় রেখে চলেছেন এঁরা। লোক দেবতারা মানুষের দিন যাপনের মাঝে মিশে গেছেন।
আটন সংলগ্ন সবুজ শালজঙ্গল ও চাষ জমির শ্যামলিমায় যেন মায়ের আঁচলের স্নেহস্পর্শ। সবুজ পাতায় সোনা রোদের ঝিকিমিকি যেন মাকে আরাধনা করছে।
মন্দির সোপানে বসে দূর শাল জঙ্গলের শ্যামলিমায় মন হারিয়ে গেল। মনে গুনগুন করে উঠল ক্রান্তদর্শী কবির সেই অমোঘ বাণী
” বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও—“
” জয় সন্ন্যাসী মাতা”–” জয় মা বামুন বুড়ি”
নমি নমি চরণে!