বাদামী -12
ডক্টরেট সোম এর বাড়িতে ঢুকতে ও মুখের আদল পাল্টায়নি বাদামীর। —–কী ব্যাপার বাদামী, আজ একটু গম্ভীর লাগছে তোমাকে! কী ভেবে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন ডক্টরেট সোম। ——-তারপর বলো,তোমার কতদূর ‘ডেটা কালেকশন ‘ হয়েছে?শেক্সপিয়রের ড্রামা গুলো ভালো করে পড়ে নিও কিন্তু। অদ্ভুত একটা মেলবন্ধন। ভালো ও মন্দ, আনন্দ ও দুঃখের মধ্যেই একজনের লাভ হলো,সেখানেই আর একজনের ক্ষতি হচ্ছে। পৃথিবীর এই নিয়মটাই তাঁর নাটকে পাবে। ——– হ্যাঁ স্যার, শেক্সপিয়রের প্লের মধ্যে যে ডিফেক্টস –মানে খুঁত, আছে সেগুলো কি উল্লেখ করবো? ——ইয়েস। বলো দেখি কী ধরণের খুঁত আছে? ——গল্পের প্লট বেশির ভাগ সময়ে ঢিলে ঢালা। একটু দৃষ্টি দিলেই তিনি সেগুলো সুদৃঢ় করতে পারতেন। ——আরও আছে। কিছু কিছু ড্রামার শেষের দিকটা সুনিপুণ ভাবে শেষ করেননি। হঠাৎ ই শেষ করে ফেলেছেন। স্যামুয়েল জনসন এর “প্রিফেস টু শেক্সপিয়ার “পড়েছ?গো থ্রু ইট।পড়ে ফেলো। ডঃ সোম এর কথা শুনতে শুনতেই বাদামী ব্যাগটা খুলে বাটি দুটো বার করলো। ——-আজ আবার কী?জানো আমি রাঁধতে না পারলেও আমার ঘ্রাণ শক্তি কিন্তু প্রখর। বলবো কি এনেছো? ইলিশ ছাড়া আর কিচ্ছু না। না হেসে পারেনি বাদামী। এমন একটা মানুষকে খাইয়ে ও আনন্দ হয়। স্যারের কথা মতো জনসন এর “প্রিফেস টু শেক্সপিয়ার” খুলে বসলো বাদামী। কালি দিয়ে মোটা দাগ দিলো লেখাটায়, “হিজ ট্র্যাজেডি সিমস টু বি স্কিল,হিজ কমেডি টু বি ইন্স্টিংক্ট।” জীবনের ভাষা ই শেক্সপিয়ারের ড্রামার মূল ভাষা। আবার দাগ দিলো,”হিজ ড্রামা ইজ দ্যা মিরর অব লাইফ”। “মেনি অফ হিজ প্লেজ দ্যা ল্যাটার পার্ট ইজ এভিডেন্টলি নেগলেক্টেড”। না আজ আর না। ঘড়ি দেখলো বাদামী। অনেক দিন মিসেস ভাটিয়ার কাছে যাওয়া হয় নি। আজ ওখানে যাবে। *** দিন পেরিয়েছে অনেক। পুরুষ পুরুষ গন্ধটা গা সওয়া হয়ে গেছে বাদামীর। তবে ডঃ সোম গা ঘেঁষে দাঁড়ালেই বাদামীর বুকে ঢেকির পাড় চলতে থাকে। কান গরম হয়ে উঠলেই ছুটে গেছে রান্না ঘরে। আঁড়াল খুঁজতে। রহিতের সঙ্গে দেখা হয়েছে কয়েক বার। সেই মামেরা ভাই হরজিতের যে বাদামীকে মনে ধরেছে, সেকথা রহিত বারবার বলেছে । ——-মান যা না ইয়ার। হরজিত তোকে ভালবাসে। —-আমি তোকে বলেছি না। তা সম্ভব নয়। হরজিত এর প্রেম কে দূরে ঠেলে দিতে গিয়ে বাদামীর চোখে আর একজনের মুখ চোখে ভেসে উঠেছে। এমন একটা মানুষ কে ভালোবেসেও সুখ। **** পয়লা মে ছুটি ছিল। তবু ও স্যারের ওখানে যাবে ভেবে ই বাদামী ভোরে বাজারে গেছে। মন মতো জ্যান্ত পাবদা মাছ পেয়ে গেল। একটু বেশি করেই নিয়ে নিলো। বেশ পছন্দ সই পদ্ধতিতে রান্না করে নিল। তারপর টিফিন বাটিতে ভরে নিয়ে এসেছে। মাছ দেখে রসিকতা করতে ছাড়েন নি। হাসতে হাসতে বললেন——আমার তো দেখছি পুলিশের থেকেও ভাল অবস্থা। —–কেন স্যার? ——-না না। ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয়নি। ওদের যেমন মাছ,সব্জি, ফল কিনতে হয় না। আমার আবার পাল্লা টা একটু ভারী। গ্যাস খরচা আবার রাঁধতে ও হয় না। আর উপুরি পাওনা, রকমারি সুস্বাদু খাবার খেতে পাচ্ছি। স্যারের রসবোধে বাদামী শুধু মাত্র হেসেছে। ——কিন্তু আমার সুখের দিন তো শেষ হয়ে গেল। আবার বয়েল করো আর খাও। তোমার শরীর কি খারাপ? ——কৈ না তো। ভাব টা বদলানোর চেষ্টা করে বাদামী। ——-প্রায় সবই তো শেষ হয়ে গেল। লেখাটা শেষ হলে একেবারে শেষে রেফারেন্স বইয়ের নাম দিতে ভুলো না। মুখ ভার কেন? অবশ্য এতেও তোমাকে সুন্দর দেখায়। স্যারের কথায় ভেতরে কাঁপন লাগে বাদামীর। স্যারের মুখের দিকে তাকালো সে। তিনি কথাটা বলে ফেলে বুঝতে পারেন যে এটা বলা ঠিক হয়নি। তাই প্রসঙ্গান্তরে চলে যান। ——-ডক্টরেট এর কাজ তো হয়ে গেল কিন্তু আমার যে বদ অভ্যাস করে দিলে? —–কি স্যার? —–নিজের রান্না যে আর মুখে রুচবে না। —–একজন রান্নার লোক ঠিক করে দেব স্যার? ——–রান্নার লোক! না না ,তাতে হবে না। সে কী আমার মন ভরাতে পারবে? স্যার এর দৃষ্টি টা আজ অন্য রকম লাগছে। বাদামীর গালে লালের ছোপ পড়েছে। মাথা নিচু হয়েছে আপনা থেকেই। স্যার হেসে উঠতে বাদামী মাথা উঁচু করলো। ————–কি গো তুমি সত্যি সত্যি ভাবলে নাকি? আরে আমার হাতের রান্না আমি খুব ভালো খাই। আর,শোন তোমার আর আসার দরকার নেই। যা দরকার ইউনিভার্সিটিতে ই বলবে। ঘরে এসে ও স্যারের দৃষ্টি ভুলতে পারে না বাদামী। ঐ দৃষ্টি শরীর ছোঁয় না,মন কে ধরে রাখে। ঐ দৃষ্টি কি বলতে চেয়েছে তা না বোঝার মতো নিরেট নয় বাদামী। কেন বাড়ি যেতে মানা করেছে সেই মানুষ টা?তবে কি বাদামীর কাছে ধরা পড়ার ভয়ে ই! ইচ্ছে করেই ইউনিভার্সিটি যায় নি বেশ কিছু দিন। খুব খারাপ লাগছে । ঐ মানুষটাকে না দেখে কেমন করে থাকবে বাদামী!বাদামী কি অপবিত্র! তিন বছরের জীবনে হঠাৎ ছন্দপতন। খালি খালি লাগছে। একবার ভাবলো, চলে যাই সেই মানুষটার কাছে। পরমুহূর্তেই মনে হলো নিজের কালিমালিপ্ত জীবনের কথা। পরের সপ্তাহেই ইউনিভার্সিটিতে গেছে। ডঃ সোমের ঘরে যেতে হবে, থিসিস জমা দিতে। কী করে মুখোমুখি হবে সেই মানুষটার?ভাবতে ভাবতেই ডঃ সোম এর ঘরে গেল বাদামী। অনুমতি নিয়েই ঢুকলো সেই ঘরে। ———এসো। কী দেখছে বাদামী?বিধ্বস্ত চেহারা স্যারের। চুলের পরিপাটি নেই। বাদামি কে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চোখের দৃষ্টি গভীর। গলার স্বরেও গভীরতা। ———–কি হলো, এতো দিন আসোনি কেন?তোমার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল। কথাটা বলেই বসে পড়লেন। বাদামি কে বসতে ঈশারা করলেন। ——-আপনার শরীর ঠিক আছে তো? ——–শরীর ঠিক আছে। তবে মন ভালো নেই। স্যারের মনের কথা শুনে চুপ করে গেছে বাদামী। আবার তিনি বললেন। ——-তুমি ঠিক ই বলেছ। একা থাকতে পারব না। তোমাকে আমার পাশে চাই। হ্যাঁ, তোমাকে বিয়ে করতে চাই। প্লিজ, ‘ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড মি’। বলেই বাদামীর হাতটা চেপে ধরলেন ডক্টরেট দেবব্রত সোম। —–তা সম্ভব নয় স্যার। সম্ভব হলে আমার থেকে সুখী আর কেউ হতো না। স্যার, হাত টা ছাড়ুন, কেউ এসে পড়তে পারে। অপমানিত, আহত দৃষ্টি ডঃ সোম এর। একটা ও কথা বললেন না।ঐ হাত আলগা হতে নিজের হাত সরিয়ে নিয়েছে বাদামী। আহত দৃষ্টি চোখে পড়তে বাদামীর চোখে জল এসে গেছে। চোখের জল আড়াল করতে ডঃ সোমের চেম্বার থেকে নিঃশব্দে চলে এসেছে । একটা প্রণাম করার ইচ্ছা ছিল ঐ মানুষটাকে কিন্তু করা হয় নি। দুর্বলতা প্রকাশ হবার ভয়েই। বার বার সেই দৃষ্টি টা তাড়িয়ে বেড়িয়েছে বাদামীকে। মায়ের কথা মনে এসেছে ।”কী করবো মা,এমন একজন দেবতার মতো মানুষকে পায়ে ঠেললাম। তুমি বেঁচে থাকলে ঠিক তাঁর পায়ে ঠাঁই নিতে বলতে। আমি পারলাম না মা”। চোখের জলে বালিশ ভিজেছে বাদামীর। সকাল হতে ই ঠিক করে নিয়েছে বেশ কিছু দিন ইউনিভার্সিটি যাবে না। এই দেহ ঐ মানুষটাকে দিতে পারে না বাদামী। তাছাড়া এখন ক্লাস ও হচ্ছে না। বেশ কিছু দিন না দেখলে ঐ মানুষটা বাদামীকে ভুলে যাবে। বেশ কিছু দিন পর ইউনিভার্সিটি গেল বাদামী। লেকচারার দের রুম এ বসেছে সে।নারায়ণ এসে খবর দিল যে নবীন বরদলৈ তাকে ডাকছেন। চেম্বার এ ঢুকতেই এন.কে.বি বললেন——- —–ইয়র লেটার ফ্রম ডঃ সোম। শিকাগো চলে গেলেন। সাত দিনের মধ্যে সব কিছু ব্যবস্থা করে রিজাইন করে চলে গেলেন। এমন কি তোমার থিসিস অবধি সই করেছেন এতো তাড়াহুড়ো যে কেন করলেন বুঝলাম না। একজন গুনীলোক আমাদের ছেড়ে গেলেন। স্তব্ধ হয়ে গেল বাদামী। কান্নাটা গিলে ফেললো। খামটা নিয়ে সোজা ঢুকে গেল টয়লেট এ। একাকিত্ব দরকার। বুকটা বুঝি ভেঙে যাবে। একটা দম আটকানো কষ্ট। আর কোন দিন দেখা হবে না তার সঙ্গে। বলতে পারবে না বাদামী তার মনের কথা। ‘না বলে কেন চলে গেলে? মনের একটা কুঠুরি বলল,বললে কি করতে?তোমার সংস্কার ছেড়ে, যেতে তাঁর সঙ্গে”? আর একটা কুঠুরির মন বলল, তোমার উচিত শিক্ষা হয়েছে। সাদা লক্ষ্মী পায়ে ঠেললাম?পচে মর একা একা”। বিদ্রোহ করতে চাইল মন।”কেন তুমি বলে গেলে না?” মনকে বলল বাদামী,”তুমি কি ওকে ভালোবাস?” “হ্যাঁ, বাসি। ভালোবাসি।সত্যি ই ভালবাসি।” এ কি করছে সে?এরপর তো আর বাইরে বের হতে পারবে না। চোখে জলের ঝাপটা দিল। একাকিত্বের সুযোগ আর নিজেকে দেবে না। তাহলে প্রশ্ন উত্তরের ধাঁধায় নিজের কাছে হেরে যাবে। আয়নায় চোখ পড়ল। চোখ ফুলে লাল। ডঃ সোম কি হেরে গেছে?ঐ মানুষ টার কাছে সারাজীবন হারতে ও রাজি বাদামী। সেই সুযোগ না দিয়েই চলে গেল সেই মানুষটা।