বাদামী – 11
নো মেড সার্ভেন্ট। সুতরাং তোমাকে কষ্ট করতে হবে। –না না, কিছু অসুবিধা নেই। করে নেব। –ঠিক আছে যাও। আমি ততক্ষণে তোমার কাজের একটা ছক কেটে দিচ্ছি। কিচেন এ যেতে যেতে চোখে পড়ল স্যারের কাগজ কলম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া। পুরুষ মানুষের কিচেন ।তায় স্যারের ভাষায় ‘নো মেইড সার্ভেন্ট ‘,তাই রান্না ঘরের চেহারা যেমনটা হওয়ার তেমনই রয়েছে। শোনা ছিল বছর চারেক আগে ওঁর স্ত্রী মারা গেছেন। কষ্ট হলো। নজর পড়ল ,সিঙ্কে সব বাসন পড়ে আছে । একটা স্যসপ্যান এ ভাত আর একটা বাটিতে আলু সেদ্ধ করা রয়েছে। এই ভাবে ই দিন চলে বুঝি! চার বছর ধরে এসব খেয়ে ই দিন কাটাচ্ছেন! আগে শোনা ছিল ডক্টরেট করার জন্য স্কলাররা নাকি গাইড দের ঘরের কাজ ও করে দেয়। তখন আশ্চর্য লাগলে ও এখন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হচ্ছে। কারণ ঘরের কাজে যে সময়টা ব্যস্ত থাকবেন স্যার, সে সময়টা বাদামীর কাজে লাগলে লাভটা বাদামীর ই হবে। ডক্টরেট সোম বাদামীর কাজের ছক কাটছেন। বাদামী ও কিচেন এ কোন কাজে আগে হাত দেবে তার ছক কেটে নিল। পার্টটাইম স্কলার বাদামী। বাধ্যতা মূলক নয় বলেই যে কোন গাইড এটা একটা ফালতু কাজ বলে মনে করতে পারেন। ডক্টরেট সোম আন্তরিক ভাবে ই বাদামীকে সাহায্য করছেন। তাই বলে কি বাদামীর কর্তব্যজ্ঞান হীন হওয়া উচিত?গ্যাস টা জ্বালানো যাক্। চায়ের বাসন ধুয়ে চায়ের জল বসিয়ে দিল। সেই ফাঁকে কিচেন সাফ করা, বাসন মেজে তুলে ফেলা হয়ে গেল। চা পাতা পট এ দিয়ে, গরম জল টি পট এ ঢেলে দিল। স্টাডি রুম এ চা নিয়ে ঢুকতে দেখল,দেবব্রত সোম একমনে লিখে চলেছেন। -স্যার, আপনার চা। কথাটা শুনে মুখ তুললেন তিনি। কিন্তু চিন্তাটা অন্য কোথাও। তবু ও বললেন-তোমার টা? -এই আনছি। আনছি কথা টা মুখে বললেও মনে জানে যে রান্না ঘরে অনেক কাজ পড়ে আছে। চা খেতে খেতে ই সেই কাজ গুলো সেরে ফেলবে বাদামী। –বাহ্ দারুণ হয়েছে চা টা। একটা চুমুক দিয়ে ই উৎফুল্লিত কন্ঠস্বর ডঃ সোমের। বাদামী ফিরে তাকাল সেদিকে। স্যার আবার ডুবে গেছেন তাঁর কাজে। বাদামী ডিম,আলু সেদ্ধ হতে তুলে নিল। বেশ লাল করে ভেজে তুলে নিল। শুকনো লঙ্কা কোথায় ও নেই। তাই জিরে তেজপাতা ফোঁড়ন দিয়ে কাজ চালিয়ে নিল বাদামী। সহজ পদ্ধতির রান্না হলে ও ডঃ সোমের মুখে উপাদেয় হবে। স্টাডি রুম এ চা নিয়ে ঢুকতেই স্যার বললেন-। –চা টা খেলে?দারুণ হয়েছিল। মেয়েদের হাতে সবকিছু ভালো হয়। উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল বাদামী। ডঃ সোম আবার মত্ত হয়ে গেছেন লেখায়। মাথা তুলে বললেন-। –কিসের গন্ধ বলো তো?একটা দারুণ গন্ধ বেড়িয়েছে।পাশের বাড়ির হবে। কথাটা বলেই হাসতে থাকেন। এতো হাসির কি হলো, তা বাদামী বোধগম্য হয় স্যারের বলা পরের কথাটা শুনে। –ওদের রান্নার গন্ধ মেখে মেখেই শুক্তো, মাছ,মাংস সবই খেয়ে ফেলি। বাদামীর মুখটা দিকে চেয়ে হঠাৎ ই তিনি থেমে যান। কষ্ট হয় বাদামীর। কিসের অভাব স্যারের! আহা,এমন দশাও মানুষের হয়। আবার বিয়ে করলে দোষ টা কোথায়! ইচ্ছে করেই বাদামী ঐ সাতখানা বইয়ে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে। –বাদামী, তুমি কি খেয়ে এসেছ? –হ্যাঁ স্যার, আপনার তো হয় নি,আপনি খেয়ে নিন। –ঠিক আছে, এটা লিখলাম। নাউ গো থ্রু ইট। গভীর ভাবে ডুবে গেছে বাদামী। লেখকের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা, যেগুলো জীবনে গভীর ভাবে দাগ ফেলে, সেগুলো তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হয়। আশা,হতাশা প্রতিফলিত হয় তাঁর লেখায়। যেমন হয়েছিল ডিকেন্সের, । “বাট দিস কাইন্ড অব সাইকোলজিক্যাল ” অনুসন্ধান করে লেখকের লেখার লেখার মূল্যায়নের কোন ক্ষতি হয় না। তাহলে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, ” লিটারেরি ওয়ার্কস আর অ্যাজ প্রোডাক্টস অব দি হিউম্যান ইমাজিনেশন,ওয়ার্কিং ইন সার্টেন ওয়েজ আন্ডার সার্টেন কন্ডিশনস”। এটা বোঝা গেল যে,লেখকের সাহিত্য সৃষ্টি হয় তাঁর চিন্তা বা ভাবের থেকে। –এ কী করেছ? বইয়ে ডুবে গিয়েছিল বাদামী। স্যারের কথায় চমকে বই থেকে মুখ তুললো বাদামী। চোখ পড়ল ডঃ সোম এর পরনে এখন দুধ সাদা পাজামা–পাঞ্জাবি । পরিপাটি করা চুল। কিছু অবাধ্য চুল কপালে দোল খাচ্ছে। বাদামীর চোখ ফেরানো উচিত তবু ও চেয়ে থাকে সেদিকে। স্যারের চোখে শিশুর মতো হাসিটা দেখেই বাদামী বোঝে তিনি কি বলছেন । আকাক্ষিত বস্তু পেলে শিশুর হাসিটা যেমন হয়, এ হাসিও তেমন। তারপর বলেন। –দেখেছ!কী কান্ড করেছ!ছিঃ।ছিঃ, ইউ আর নট মাই কুক। হাসলেন খুব। তারপর হাসতে হাসতে বললেন। –যাক্ গে,ভালো ই হয়েছে। আজ ভালোই খাওয়া জুটবে। মুখে ছিঃছিঃ করলে ও চোখের নজরে তা লেখা ছিল না। মানুষটার চোখে কি লেখা ছিল তা বাদামী পড়ে নিয়েছে। ঘরে ফেরার পথে সেই একজনের কথা বার বার মনে হয়েছে। বড়ো জোর তিরিশ পেরিয়েছে ডঃ সোমের। নজরে পড়ার মতো চেহারা। তবে নিজের প্রতি অবহেলা -টা অন্যের চোখে সহজেই ধরা পড়ে যাবার মতো বেশবাস। একটা যুবতী নারী তাঁর ঘরে যাচ্ছে। সে দিক দিয়ে একেবারে অন্য ধাতের মানুষ। শ্রদ্ধা জাগে বাদামীর। অমন একটা মানুষের সংসার করতে পারল না ওঁর স্ত্রী। কষ্ট হয় বাদামীর। ঘরে ফিরে ও মনে হয়েছে ঐ মানুষটার কথা, বিশেষ করে খেতে বসে। যাঁকে পাশের বাড়ির গন্ধ মেখে মেখেই খেতে হয়। এমন মানুষের কথা না ভেবে পারা যায়!নাঃ এবার থেকে খালি হাতে যাবে না। তাই রামরতিয়া কে ইউনিভার্সিটি যাবার সময় বলল। ,–দুটো আলাদা বাটিতে, ঝিঙে পোস্তো আর ভাপা ইলিশ ভরে দে। ব্যাগ এ খাবার ভরতে ভরতে বাদামীর মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। রিকশা ভাড়া দিয়ে ই ছুটতে লাগল বাদামী। মনে ভাবছে সরষে আর তেল ব্যাগে গড়িয়ে না পড়ে। তাহলে ই সাদা ব্যাগ টা নষ্ট হয়ে যাবে। ইউনিভার্সিটি পৌঁছে সিঁড়ি তে উঠতেই রহিতের মুখোমুখি। –বাদামী ক্যান্টিন এ যাবি? –আর ইউ ম্যাড? এখন আমরা আর স্টুডেন্ট নই। এমনি আমি ফাইভ মিনিটস লেট। একটা কাজ কর এক ঘন্টা পর আয়। –না ,তুই আয় । ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ক্যান্টিন এ আয়। –ঠিক আছে। বলেই পা চালালো বাদামী। ক্লাস এ পা দিয়ে ই ক্ষমা চেয়ে নিলো সবার কাছে। আজ স্টুডেন্ট খুব কম। আকাশ দেখেই বোঝা যায় যে বৈশাখ পড়েছে। তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হয়ে গেল। বৈশাখী হাওয়ায় মাতন লেগেছে গাছ পালায়। হলুদ ফুলে ভরে গেছে গাছটা। কী যেন নাম গাছটার! ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট এর শোভা বাড়াচ্ছে ঐ গাছ। টপাটপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল বাদামী। হাত ঘড়ি টা দেখে নিল। কি কথা বলতে রহিত ডেকেছে?কে জানে! স্টুডেন্ট থাকা কালীন ক্যান্টিন এ বসা আর এখন? অনেক পার্থক্য। তাই আপত্তি জানিয়েছে রহিত কে। সে দিক দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ক্যান্টিন এ বসা যায়। অবশ্য এই প্রথম যাচ্ছে। দুর থেকে নজরে এলো রহিতের সঙ্গে আরও একজন যুবক। তবে কি সে?মুহূর্তে হরজিতের কথা মনে হলো। সঙ্গের ছেলেটি পেছন ফিরে দাঁড়ানো। বাদামীকে দেখে এগিয়ে এল রহিত। ওঁরা কাছে আসতে বোঝা গেল কে সেই ছেলে! মাথা নেড়ে বাদামী কে উইশ করল সেই যুবক। রহিত বলল–চল,ভেতরে বসি। ঐ হরজিত কে দেখে মুখে কথা আসেনি বাদামীর। সেই ছেলের চোখ জোড়া বাদামীর। শরীরে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। সে যে পরম আনন্দে আছে তা তার কথায় বোঝা গেল। –রহিত, লেট আস সেলিব্রেট। আপনার জন্য কি বলবো? ‘-কিছু না। এবার রহিত এর দিকে ফিরে বলে–রহিত, কি বলবি বল। গলার স্বরটা একটু রুক্ষ্ম হয়ে গেল তা বুঝল বাদামী। –তোর কি তাড়া আছে? –হ্যাঁ। যা।বলার বল। রুক্ষ্ম স্বর শুনেই সেই ছেলে খাবার অর্ডারের নামে কেটে পড়েছে। এবার রহিত তাকে ই ডাকতে উঠে গেছে। –হরজিত প্লিজ কাম। হরজিত একা ফিরে এলো, সঙ্কুচিত মুখে বলল—– –আই মাস্ট অ্যাপলজাইজ টু ইউ। সোজা কথায় বলবো? –বলুন। –আই লাভ ইউ। তোমাকে বিয়ে করতে চাই। -তা সম্ভব নয়। কথাটা বলেই চলে এসেছে ওখান থেকে। এদের ভালবাসা সম্বন্ধে খুব ভালো ধারণা আছে বাদামীর। যতক্ষণ না নারী দেহটা আয়ত্তে আসে ততক্ষণ ই ভালবাসা থাকে। তাই এদের ভালবাসা বিয়ের ক’দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। রহিতের ওপরে রাগ হয়।হরজিতের প্রস্তাব টা বাদামীর মেজাজটাএকটু বিগড়ে দিয়েছে।ডঃ সোম এর বাড়িতে ঢুকতে ও মুখের আদল পাল্টায়নি বাদামীর। ডঃ সোম বললেন–কি ব্যাপার, আজ মেজাজটা ভালো নেই মনে হচ্ছে?