বাদামী – 9
বড়ো জোর আড়াই বছর হবে মুন্নির। মুন্নির জন্য ই মন বসে গেছে গৌহাটিতে। টুল টুলে মুখে দুষ্টু হাসি। মাথা ভরা ঝাঁকড়া চুল। যেন একটা ছোট্ট পুতুল। মুন্নির কথা মনে হলেই বাদামী চলে যায় সেখানে। অর্থাৎ মিসেস ভাটিয়ার কোয়ার্টার এ।চকোলেট মুন্নির বড়ো প্রিয়। তাই চকোলেট পেলেই বাদামীকে জাপ্টে ধরে গালে চুমো খাবে। বলবে, আন্টি ইউ আর এ গুড গার্ল। বাদামী ওকে কাছে টেনে চকোলেট বার করলো। মিসেস ভাটিয়া বললেন। -বাদামী ওকে চকোলেট দেবে না। মায়ের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাদামীর কোল থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে মুন্নি। কোমরে হাত দিয়ে মেঝেতে ডান পা ঠুকে ঠুকে বললো-। -আন্টি আমাকে চকোলেট দেবে দেবে দেবে। বলেই দৌড়ে পালিয়ে গেছে ভেতরের ঘরে। – –দেখেছো, কি একখানা মেয়ে হবে বলোতো! সকালে স্কুল,দুপুর কাটে না তাই বাদামী হেন্ড্রিক কলেজ এ ভর্তি হয়ে গেল। ইংরাজি ভালো লাগে তাই ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে নিলো। এরপর সন্ধ্যা অবধি লাইব্রেরিতে কাটাতে হয় বলে মুন্নির রাগ। -যাও,তোমার সঙ্গে কথা বলবো না। কথায় দারুণ মুখভঙ্গি একখানা। সে রাগ ভাঙ্গাতে অনেকক্ষণ তাকে আদর করতে হবে। দেখতে দেখতে কি ভাবে যে তিন টে বছর কেটে গেল বাদামী বুঝতেই পারলো না। অনার্স নিয়ে পাশ করল বাদামী। এবার কানাঘুষো চলতে লাগল স্কুলে। মিসেস ভাটিয়া এদের জগতের বাইরের লোক। তাই টিচার্স রুমেই বাদামীকে বললেন,—–বাদামী তোমার মাথাটা তো খাসা মনে হচ্ছে। এবার এম এ তে ভর্তি হয়ে যাও। কথাটা মনে ধরে যায় বাদামীর। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেল দারুণ খুশি হয়ে মিসেস ভাটিয়া বাদামীকে বললেন। –দেখো বাদামী কখনো কিছু দরকার হলে আমাকে বলতে দ্বিধা করবে না। নিজে তো পড়তে পারিনি। তুমি পড়ছো তাই ভালো লাগছে। বাদামীর বড়ো আপন মনে হলো মিসেস ভাটিয়াকে। কখনো দরকারে মিসেস ভাটিয়া বাদামীর ক্লাস নিয়েছেন। আবার কখনও ক্লাস এর খাতা ও দেখে দিয়েছেন। শিলিগুড়ির রানীদি,বেলাদি ওরা নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। কতো ই বা বয়স তখন বাদামীর। সেই বয়সের স্কুল ফাইনাল পাশ করা বাদামীর সাধ জেগেছিল এম এ পড়ার। বাবার জেদেই আর এগোনো হয়নি। চোখটা জ্বালা করে ওঠে। মায়ের সে সময়ের মুখখানা চোখে ভাসে। ফ্রেমে বাঁধানো ছবি নয়। জীবন্ত ছবি। একেবারে চলমান। মায়ের ছোঁয়া রান্নাঘরের সবকিছু। সেই পেতলের লম্বা হাতল অলা হাতা,কাঁসার গ্লাসে ডাল-লাগা হাতের ছাপ। বাবার কথা মনে হতেই মনটা তেতো হয়ে গেল। ভুলতে চায় সব কিছু। তবু ও মা থেকে যায়। মা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতো এখন। আমার দুঃখী মা গো,তোমার ইচ্ছা আমি পূরণ করব। এম . এ .তে ভর্তি হবার কথা টা চাউর হয়েছে সে কথা বাদামী স্কুল এ ঢুকেই বুঝতে পেরেছে। ঝাল ঝাড়ার জন্য কতগুলো কথা ছুড়ে মারা হচ্ছে বাদামীর উদ্দেশ্যে। ওসব আর গায়ে লাগে না বাদামীর। মিসেস ভাটিয়া ওদের হয়েই বলেছেন। -কিছু মনে করো না ওদের কথায়। দোষ ওদের নয়। অনেক ইচ্ছে তো অনেকেরই থাকে, তবে মেটে না। আর পূরণ না হলে ই অন্য কে ঈর্ষা করে। ঐ সব বলে গায়ের জ্বালা মেটায়। -না,আমি কিছু মনে করিনি। তাছাড়া ওগুলো আমাকে আরো শক্ত করে। মিসেস ভাটিয়া একটা রাত দিনের কাজের লোক জোগাড় করে দিয়েছেন। যাতে বাদামী আপত্তি না করে তাই বলেছেন। -দেখো বাদামী আমার মেয়েটা তোমার ঘরে তালা দেখে কান্নাকাটি করেত। তাই রামরতিয়াকে তোমার ঘর সামলাতে এনেছি। মুন্নি যখন তখন ঢুকতে পারবে। ওঁর কথায় বাদামী হেসেছে। ভালো করেই মুন্নির উল্লেখ করার উদ্দেশ্যে টা বুঝেছে। প্রিভিয়াস পরীক্ষার সময় খাওয়া দাওয়ার কোন ও ঠিক ছিল না। আবার মুন্নির মায়ের ঘরে খাওয়ার অনুরোধও রাখেনি বাদামী । তাই মুন্নির নাম করেই কাজের লোকের ব্যবস্থা,যাতে সে আপত্তি না করে। বাদামী পড়ার জন্য বই খোলে না, জানার আগ্রহেই বই খোলে। সেক্সপিয়র এর সনেট পড়ে আরও বেশি জানতে পারে তাঁকে। শেক্সপিয়ারের লেখা, “কিং লিয়র” পড়ে, নিজের কথা মনে হয়। অন্ধ বৃদ্ধ রাজা ‘লিয়র’তাঁর বড়ো মেয়েদের কথা শুনে ছোট মেয়ের প্রতি অন্যায় করেছিলেন। কিন্তু পড়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হন। বাদামী ভাবে, বাবুজী সব জেনে ও বাদামীর প্রতি ঘোর অন্যায় করেছে কিন্তু এতো টুকু অনুতপ্ত হয়নি। যাক্ গে যা ছেড়ে এসেছি তা ভেবে লাভ কি? বাদামীর সবচেয়ে প্রিয় পেপার হলো ‘হিস্ট্রি অব ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ‘। ভাষার ইতিহাস জানতে জানতে ই পড়া হয়ে যায়। স্কুলের টিফিনের ঘন্টা তখন ও শেষ হয়নি। হঠাৎ ই টিচার্স রুমের হাওয়া গরম হয়ে উঠলো। সকলের খাওয়া প্রায় শেষ। অনুরূপা চৌধুরী বেশ সুর করেই বললেন। -আমার তো মনে হয় বাদামী পাশ করে আমাদের হেড মিস হবে। কি বলো,এখন থেকেই তোয়াজ করা শুরু করে দেই। বাদামী বোঝে হুল ফোঁটাতেই কথাটা বলা। ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গে টিচার্স রুমে হাসির ধুম পড়ে যায়। আর একজন ফোড়ন দিলো।- -যা বলেছিস। এম . এ .পড়ে বাদামী এবার ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হবে। আবার হাসি। এবার অনুরূপার পাশের জন বলে। –এম এ পাশ করা এতো সোজা না বুঝলে?কথায় আছে না চ্যাঙ যায় ব্যঙ যায় চুনোপুঁটি বলে আমি একটু যাই। এও তাই।ক’বার খাবি খায় সেটা দেখো। আর পারে না বাদামী। জলের খালি বোতলটা নিয়ে ঠান্ডা জল আনতে যাবার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ায়। ঘরের দরজার কাছে যেতে কানে আসে। -দেমাক দেখেছিস! এই সেদিন চাকরিতে ঢুকে নিজেকে কি মনে করে! বাদামী মানুষের খারাপটা এতো বেশি দেখেছে যে এসব কটু কথায় কর্ণ পাত করে না। আবার ওদের মানুষ বলেও গন্য করে না। এরা কেমন শিক্ষিকা! অন্য দিনের মতোই আজ ও গুয়াহাটি থেকে ট্রেন এ কামাখ্যা রোড অবধি এসেছে। আজ এম এর রেজাল্ট বার হবে । উত্তেজনা হচ্ছে। যদিও জানে পাশ করবেই। মন বলছে, ‘হে রাম ,মুখ রক্ষা করো। আমার মায়ের ইচ্ছে যেন পূরণ হয়’। দোতলায় সিঁড়ি ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে উঠেছে বাদামী। নোটিশ বোর্ড এ নামের লিস্ট রয়েছে। দু’নম্বরে মিস বাদামী সিং। ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড হয়েছে বাদামী। মায়ের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। তিলমাত্র দাঁড়ায়নি সেখানে। মুখোমুখি হয়েছে ডি. এস . এর সাথে। তিনি বলেন–কি ,রেজাল্ট পেলে? –হ্যাঁ, সার। বলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছে ডি .এস. কে। হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট তরুণ বরফুকন এর চেম্বার এর কাছে গিয়ে তাজ্জব বনে গেছে। টি .কে. বি. –র নামের পাশে হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট কথা টা উবে গেছে। পাশেই ছিল সুমিতা। –হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট কথা টা টি. কে. বি . নেই কেন? -ওমা! তুই জানিস না! তাই তো হয় । এখানকার নিয়ম অনুযায়ী তিন বছর পর পর এক একজনের টার্ম আসে। এর পরই ডক্টরেট সোম মানে—ডি. এস . এর পালা। -তাই নাকি?তুই এতো জানলি কি করে? -আমি ছ’বছর এখানে আসছি। চার বছর রিসার্চ করছি। ডক্টরেট এর থিসিস এখন ও জমা দেইনি। –কেন? স্কলারশিপ এর টাকা বন্ধ হয়ে যাবে। চাকরি না জুটলে কি করে সংসার চলবে!! -তোর বাবা? -এম এ অবধি বাবা পড়িয়েছেন। আর বোঝা চাপাতে পারবো না বাবার কাঁধে। তুই ডক্টরেট করবি? –ইচ্ছে তো করে। কি করতে হবে করা যাবে? –অ্যাপ্লাই কর ,ডি এস এর সাথে কথা বল। ডি. এস. খুব হেল্প করেন।