বাদামী -7
উত্তম মধ্যম প্রহারে অজ্ঞান হয়ে গেছে শশী। ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে সে।জ্ঞান ফিরতে বুঝলো ঘরে সে একা,দরজা খোলা পড়ে আছে। সারা শরীরে বিষ ব্যথা। শরীর টা কে টেনে হিঁচড়ে দরজা অবধি নিয়ে যেতে হবে। কান্নার ও ক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে। “হে রাম, ,শক্তি দাও।মুঝে দয়া করো রাম জী”।কোন রকমে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। গোঙাতে গোঙাতে বলে,”বিটিয়া রানি,মুঝে মাফ কর দে বেটা”।
আজ বাদামীর বিয়ের ছ’মাস পূর্তির দিন। তাই বাগান থেকে টাটকা গোলাপ ছিঁড়ে একটা ফুলের তোড়া বানিয়ে ফেলল বাদামী। তারপর ফুলদানিতে ভরে রাখল।পেছনে শব্দ হতে দেখল অফিস এর আর্দালি এসেছে। মেম্ সাব, সাব আনে মে দের হোগা। সাহাব তোমাকে বলেছে? হাঁ জী ।আপ চায়ে পিয়েঙ্গে? না ,দরকার নেই।
বেশ কিছু ক্ষন পর ঘরে ফিরেছে হর কিষণ সিং। তাঁর থমথমে মুখখানা নজরে পড়েছে বাদামীর। কি গো শরীর খারাপ নাকি? কথাটা বলেই হর কিষণের গলার তাপ মেপেছে বাদামী। না না কিছু ই হয়নি।চিন্তায় পড়ে গেছি। কিসের জন্য চিন্তা? তোমাকে নিয়েই চিন্তা। জরুরি কাজে পান্ডু যেতে হবে। তোমাকে রেখে যেতে মন চাইছে না। ভাবছি যাব না।হোক গে ডিমোশন।
বাদামী স্বামীকে অভয় দিলো। কি যে বলো!!তুমি যাও। ক’দিন ই বা লাগবে! তা,মাত্র তিন দিন। বাব্বা!আমি ভাবলাম যেন কতোদিন থাকবে না। আজই যাবে?ক’টায় ট্রেন? আধ ঘণ্টা পরে। স্যুটকেস গোছানো ই আছে। সে কি তুমি গুছিয়ে রেখেছিলে?আগে থেকেই জানতে? না,হঠাৎ কখন কোথায় ও যেতে হয়, তাই। খাবার টা প্যাক করে দাও। ট্রেন এ খেয়ে নেবো। ঠিকানা টা দিয়ে যেও। সে তুমি অফিস এ পাবে । ঝড়ের গতিতে বেড়িয়ে গেছে হর কিষণ সিং। কতগুলো কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বাদামীর। ব্যাপারটা খাপছাড়া হলেও সূত্র খুঁজে পায় বাদামী। তিন দিন ও পার হলো না শুভাকাঙ্ক্ষীরা বাড়ি বয়ে খবর দিয়ে গেল যে , হর কিষণ সিং তেজপুর চলে গেছে। একেবারে। যার জায়গায় সে রিলিভিং এ এসেছিল সেই অরুণ বোস এসে গেছে। ঘেন্না, আর ঘেন্নায় ভরে গেল বাদামীর মনটা। এ তো সুবোধ সিং এর থেকে ও এক কাঠি ওপরে। মায়ের কাছে ছুটে গেছে বাদামী।নির্জীব হয়ে পড়ে আছে শশী। মায়ের মুখ দেখে বাদামীর মন কু- ডাক ডেকেছে। তবু ও সামলাতে পারেনি নিজেকে।মায়ের বুকে মাথা রেখে কেঁদেছে। মায়ের প্রশ্ন মেয়েকে। কি হয়েছে?চলে গেছে? ঝিমিয়ে পড়া শশী বলেছে। হ্যাঁ। একেবারে চলে গেছে। আমি আগেই জানতাম। যে বাপ তার মেয়েকে আট হাজার টাকার বিনিময়ে ভাড়া খাটায়, তার মেয়ের কি হবে? মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আবার বলে। কাঁদবি না।শক্ত কর নিজেকে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এ সব লোকের জন্য চোখের জল ফেলা পাপ। রাম জী কা নাম লেও।হে রাম, হে রাম, হে রাম। স্তব্ধ হয়ে গেছে বাদামী। বাবুজী এমন করতে পারে?শুধু মাত্র টাকার বিনিময়ে কাম মেটানোর ব্যবস্থা করেছিল হর কিষণ সিং?ধিক্কার এমন জীবনের!ছুটে বেড়িয়ে এসেছিল মায়ের কাছ থেকে।
বাদামী বাঙলো বাড়িতে ছুটে গেল একটু আশ্রয়ের আশায়। ছোট্ট মেয়েদের বহু দিনের টিউটর বাদামীকে ফেরাননি অফিসার গিন্নি,বাচ্চাদের। মা।
কোয়ার্টার এ ফেরার পর অরুণ বোস এসেছেন বাদামীর কাছে। মা,কোয়ার্টার টা এবার ছেড়ে দিতে হবে। তোমার বাবা এমন একটা কাজ কি করে করলো ভেবে পাই না। আমরা দুঃখিত। আমাদের মেয়ের মতো তুমি ইচ্ছে করলে একটা ঘরে থাকতে পারো যতো দিন কিছু ব্যবস্থা হয়। বাদামী বলে—-কিন্তু এতো ফার্নিচার! ও সব তো আমার। হর কিষণ তো একটা স্যুটকেস নিয়ে এসেছিল।আমি ই ব্যবহার করতে বলেছিলাম। কাকাবাবু, আমি কাল ই চলে যাব। কালই আসতে পারেন।
সে রাতে ই রাম জী শশী কে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। মেয়ের সাথে স্বামীর এই প্রতারণাটা সইতে পারেনি শশী।একা ঘরে ই মারা গেছে। ডাক্তার বলেছে —“ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক “।প্রতিবেশীরা বলেছে “মরে বেঁচেছে অভাগীনি”। বাদামী খবর পেতে পেতে মরদেহ শ্মশানে চলে গেছে। চোখের জল শুকিয়ে গেছে বাদামীর। যখন স্পর্শ করেছে তখন সে দেহ পাথরের মতো শক্ত। অফিসার গিন্নি পিঠে হাত দিয়ে সাহস জুগিয়েছেন। সান্ত্বনা দিয়েছেন । কি রে, বাইরে কোথাও গিয়ে থাকবি? কোথায় যাব?আমার তো কেউ নেই। দেখি,দাদাকে বলে, যদি তোর একটা চাকরি জোগাড় করতে পারি।অবশ্য আমার কাছে থেকে মেয়ে দের পড়াতে পারিস। কিন্তু তোর ভবিষ্যতের জন্য বাইরে যাওয়ার কথা বলছি।তবে কচি বয়স তোর তাই এতো চিন্তা। আন্টি, তাহলে খুব ভালো হয়।আর পারছি না। চোখের জল বাঁধ মানে না বাদামীর।তা দেখে মিসেস বল বাদামীকে টেনে নিয়েছেন নিজের কাছে। সাত দিন ও থাকতে হয়নি শিলিগুড়িতে। মিসেস বল, তাঁর দাদাকে বলে গুয়াহাটি রেলওয়ে স্কুলের প্রাইমারি সেকশন এ একটা টিচারের পোস্ট ক্রিয়েট করেছেন। লাফিয়ে উঠেছে বাদামী। একেবারে জড়িয়ে ধরেছে মিসেস বল কে। আন্টি, ইউ আর গ্রেট। আরে গ্রেট আমার দাদা। সে বিশেষ কৌশল আর ক্ষমতা বলে এটা সম্ভব করেছে। দাদা মজদুর ইউনিয়ন এর সেক্রেটারি। সবাই কে সাহায্য করা ওর কাজ।
বাদামী -8
সকাল থেকে ই আকাশ গুড় গুড় করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি আকাশ ভেঙ্গে পড়বে। বাদামীর মনটা ও থমথমে। মাঝে মাঝেই বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো মায়ের কথা মনে পড়ছে। মন বলছে, মায়ের কামনা সিদ্ধ হতে চলেছে। বাড়ির বাইরে পা দেবার আগের মুহূর্তেই ঝড়ের গতি বেড়ে গেল। শুরু হলো বৃষ্টির তাণ্ডব ।যতো বাধা আসুক না কেন, যে ভাবেই হোক বাদামী শরীরটাকে টেনে ট্রেন এ তুলবেই তুলবে। শিলিগুড়ির বাইরে এই প্রথম পা দিচ্ছে। ভেতরের শূন্যতা কে উস্কে দিচ্ছে প্রকৃতি।মন কেমন করা হাওয়া বইছে বাইরে। ট্রেন এ উঠে স্বস্তি হলো। যাক একটা হিল্লি হলো। ট্রেন ছাড়ার পর বৃষ্টি ধরে এলো। জানালা দিয়ে ছুটন্ত মেঘ দেখা যাচ্ছে। রেল গাড়ির তালে তালে মেঘেরা ছুটছে।
মায়ের গলার স্বর শুনতে পাচ্ছে ঐ মেঘের দলের ফাঁক থেকে। রেল গাড়ির সঙ্গে চলেছে বাদামীর মাঁ। ভেসে চলেছে ঐ মেঘের পালঙ্কে।বলছে, “ভয় নেই আমি আছি।” ঠিক যেমনি ছোট বেলায় বলতো,”মে হুঁ না,ডর মৎ”। ঢুলতে ঢুলতে কখন সকাল হয়ে গেছে তা বাদামী বুঝতেও পারেনি ।পাশের লোকটি তার স্ত্রী কে বলছে,এটা হলো বাংলা আর অহম এর বর্ডার। দু’পাশে সবুজের সমারোহ। অহমে ট্রেন ঢুকতে সবুজের প্রলেপটা আরও গাঢ় লাগছে। অবশ্য বাংলার মেটেলি জংশনও দারুণ লাগছিল।সবুজ গালিচায় মোরা গোল পাহাড়টা বৃষ্টিতে ভিজে আরও সবুজ হয়ে গেছে।
পাশের লোক টি ফকিরাগ্রামে কিছু খাবার আনতে নেমে গেল।এই ফাঁকে বৌটির সঙ্গে আলাপ হলো। ওমা,!এই বয়সে রেল এর স্কুল এ কাজ পেয়ে গেছো?ভালো ই হলো আমার মেয়ে ও ঐ স্কুলে পড়ে। মেয়ে কোথায়? ওর ঠাকুমার কাছে। স্কুল চলছে তো ,কামাই দিলে অসুবিধা। ভালো ই হলো, গেলে দেখা হবে। এরই মধ্যে বৌটির স্বামী এসে গেল। দু’হাত ভর্তি খাবার দাবার।বৌটির মুখখানা স্বামীর প্রেমে ডগমগ করছে। মনে পড়ে হর কিষণ এর কথা।ভেতরটা কুরে কুরে খেতে থাকে। শয়তান টাকে শায়েস্তা না করা অবধি শান্তি নেই। মা বলেছে শক্ত হতে, তাই হবে বাদামী। এই যে ভাই ফকিরাগ্রামের সিঙাড়া আর কাঁচাগোল্লা বিখ্যাত খেয়ে দেখুন। একটু আগেই তুমি বলেছে এখন টিচার শুনে আপনি হয়ে গেল। বাদামী দ্বিধা ভরেই তুলে নিল খাবার টা।একা চলাফেরা কখনো করেনি। এই প্রথম ই বলা যায়। তায় সকাল থেকে খাওয়া হয় নি। টেস্ট সত্যি ই ভালো তবে শিলিগুড়ির এয়ারভিউ হোটেলের খীরের সিঙাড়ার স্বাদের কাছে হার মানবে এই কাঁচাগোল্লা। আমিন গাঁও পৌঁছেই স্টীমার ঘাটে মাছ ভাত খাওয়া হলো। ওপারে পান্ডু।স্টীমারে করেই পান্ডু পৌঁছানো হবে। ঘাটে স্টীমার বাঁধা।ওপারে পান্ডু পৌঁছালে আবার ট্রেন এ করে গৌহাটি পৌঁছাতে হবে। নতুন অভিজ্ঞতা দারুণ লাগছে বাদামীর।এই প্রথম স্টীমার এ উঠলো বাদামী। বিশাল নদ এই ব্রহ্মপুত্র। পাহাড়ের ওপরে কামাক্ষা মায়ের মন্দির দেখা যাচ্ছে। ঝিকমিক করছে ব্রহ্মপুত্রের জল। সূর্যের ছটায় জলে হীরের চমক। কিছুক্ষনের মধ্যে ভোঁ ভোঁ ভোঁ শব্দ করে দুলকি চালে স্টীমার চলতে লাগল। বাদামী তার যৎ সামান্য জিনিসপত্র বৌটির কাছে গচ্ছিত রেখে ,ঘুরে ফিরে দেখতে লাগল।
দোতলা যান।নিচুতলায় মাছ,দুধ,মাখন, সবজির সঙ্গে নিত্য যাত্রী। এরা তৃতীয় শ্রেণীর।দোতলায় এক পাশে কাঠের বেঞ্চ পাতা সেকেন্ড ক্লাস। অন্য পাশে কেতাদুরস্ত টেবিল চেয়ার। তাও যেমন তেমন নয়। টেবিল এ দুধ সাদা ঢাকনি আর চেয়ার নরম গদিতে মোড়া। দুই তরফের ফারাক টা দেখেই অনুমান করা যায় যে ব্রিটিশ রাজ নিজেদের সঙ্গে নেটিভদের আসনের ফারাক টা বেশ মোটা দাগেই বেঁধে রেখেছিল। আস্তে আস্তে পান্ডু এগিয়ে আসছে। দুর থেকে সবুজে লালের ছিটে নজরে এসেছে। এখানকার মাটির রং লাল। মায়ের সিঁদুরের রং টা মনে পড়ছে। মায়ের সিঁদুরটা ছিল মেটে সিঁদুর। শক্ত হলো বাদামী। পুরোনো কে ভুলতে চায় সে। গৌহাটি রেলওয়ে হাইস্কুলে পৌঁছাতে বেলা দুটো বেজে গেল।সব ব্যবস্থা করাই ছিল তাই বাদামীর কষ্ট হলো না। স্কুলের কাছেই রেল কোয়ার্টার এ ঠাঁই হলো বাদামীর।এই প্রথম একটা একেবারে নিজস্ব ঠাঁই।
উল্টো দিকের মিসেস ভাটিয়া যেচে এলেন আলাপ করতে। বাদামী কে জোর করে নিয়ে গেলেন নিজের কোয়ার্টার এ। আরে চলো তো।প্রথম দিকে আমার ও খুব খারাপ লেগেছিল। আজ রাতে তুমি আমার এখানেই খাবে। বুঝলে? না না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না আমি করে নেব। লজ্জায় পাশ কাটাতে চেয়েছে বাদামী। সে পরে করবে । মুন্নি, এদিকে এসো, আন্টিকে নমস্তে বলো। মিসেস ভাটিয়া তাঁর মেয়ে কে ডেকেছেন।মায়ের কথায় এগিয়ে এসেছে ডল পুতুলের মতো ছোট্ট মুন্নি। নমস্তে আন্টি জী। এখন ও কথা পরিস্কার হয়নি। মিসেস ভাটিয়া চিৎকার করে বললেন তোমার হাতে কি? তার আগেই অদ্ভুত এক কান্ড ঘটল। মুন্নির হাতের বস্তু মুখে চালান মুখে চালান করে দিল মুন্নি। আর তখনই একটা দেখার মত ব্যাপার। মুন্নির সারা মুখ সাদা হয়ে গেল।শুধু চোখ জোড়া বাদে। চোখ জোড়া আপনা থেকে ই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বুঝি তাই সাদা হয়নি।
কি খেলি বল?
চিৎকার করে উঠলেন মিসেস ভাটিয়া। এতো টুকু মেয়ের এমন দুষ্টুমি বাদামী এই প্রথম দেখল। আপনার ই তো দোষ আপনি কেন দেখতে চাইলেন ?নইলে তো ও একটু একটু করে টেস্ট করে দেখ তো আটা টা খেতে কেমন। মিসেস ভাটিয়া বাদামীর কথা শুনে হাসলেন। মুখ খানা দেখো, ভূতের মতো লাগছে। ভাবটা এমন যেন গোবেচারা। যাও রানীদির কাছে জামা বদলে এসো। রানী ওর জামা টা ছাড়িয়ে দে।